ফাগুন চেয়েছে মন,পর্বঃ৭

0
229

ফাগুন চেয়েছে মন,পর্বঃ৭
অরিত্রিকা আহানা

সৃজন পরোপকারী শান্তশিষ্ট, কোমল স্বভাবের। ওর কাছে কেউ কেঁদেকেটে দুঃখের আলাপ করতে পারলেই হয়েছে। আগপাছ না ভেবে সব দান করে দেবে। সেইজন্যই সংসারের প্রতি একটু বেশি সচেতন সুধা এবং তাহেরা। ওদের উপস্থিতিতে কারো সাধ্য নেই সৃজনকে ঠকায়। ঘরে বাইরে সবদিকে ওদের নজর।

সৃজনেরও এসব নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই। অন্দরমহলের নারী কর্তৃত্ব সে বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়। সুধার হাতেই গোটা সংসারের দায়িত্ব। কোথাও এতটুকু খুঁত ধরার অবকাশ নেই। ওর মহিমাতেই মৃতপ্রায় বাড়িটা আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

এভাবেই দিন কাটছে। সাধারণত যেই মানুষ কোনকিছু নিয়ে অভিযোগ করে না তার প্রয়োজন অপ্রয়োজনের দিকে কেউ খেয়াল রাখার কথা ভাবে না। কিন্তু সুধা সবার চাইতে আলাদা। সংসারে সমস্ত প্রয়োজন অপ্রয়োজনের দিকেই ওর খেয়াল। ওর নেতৃত্বে সহজ সরল সৃজনকে ঠকানোর জো নেই কারোর।

সন্ধ্যার দিকে আসাদ ফোন করেছে। ঘরে নেটওয়ার্ক না থাকায় কথাবলার জন্য নিচতলার বারান্দায় নেমে এসেছিলো ফাগুন। রান্নাঘরের দরজায় সুধা এবং তাহেরাকে একসঙ্গে থেমে গেলো। তাহেরাকে নিয়ে মাসিক বাজারের লিস্ট তৈরী করছে সুধা। তাহেরা ওর পাশে বসে এটা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ফাগুন একদৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে রইলো। নিজেকে সুধার জায়গায় কল্পনা করলো! কল্পনা করতে গিয়ে মনে হলো বুকের ভেতর আক্ষেপের বেদনা বাজছে! আসাদের সঙ্গে আর কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। চুপচাপ ঘরে চলে গেলো!

লিস্ট তৈরী শেষে সেটা যত্ন করে ড্রয়ারে রেখে দিলো সুধা। সৃজন ফিরলে ওকে দিতে। রাতের খাবার টেবিলে সৃজনের সঙ্গে সংসারের নানা বিষয়ে আলাপ আলোচনা করে সুধা। সৃজন মন দিয়ে শোনে। আহামরি কোনো বিষয় না হলেও বড় মধুর হয় ওদের এই আলোচনা। প্রেমিক প্রেমিকার রোমান্টিক কথাবার্তায়ও ফাগুন এতটা আত্মতৃপ্তি খুঁজে পায় না।

মাসিক বাজারের হিসেব নিকেশ এতদিন তাহেরার হাতে থাকলেও এখন সব সুধার তত্ত্বাবধানে চলে গেছে। তাহেরা এইসব ব্যাপারে যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও সুধার মতন সাংসারিক বুদ্ধি ওর নেই। সব দিক মেইনন্টেন করে চলতে পারে না। তাই প্রতি মাসেই কিছুনা কিছু ঝামেলা হতো।

কিন্তু সুধা আসার পর থেকে এসব ঝামেলা বিদায় নিয়েছে। প্রতিমাসের শুরুতে কর্মচারী দিয়ে বাড়িতে বাজার পাঠিয়ে দেয় সৃজন। এতদিন সুষ্ঠু পরিচালনার অভাবে জিনিস অপচয় হতো। কখনো কখনো দেখা যেতো অপ্রয়োজনীয় জিনিসের ভিড়ে প্রয়োজনীয় জিনিসটাই ঘরে আসে নি। এসব ব্যাপারে সুধা পারদর্শী। সংসারের কোনো জিনিস যেমন ওর হাত দিয়ে অপচয় হয় না তেমনি প্রয়োজনীয় কোনো জিনিসও বাদ পড়ে না।


সৃজন ফিরলো রাত দশটায়। খাবার গরম করে টেবিলে রাখার সময় লিস্টটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিলো সুধা। ইশারায় খুলে দেখার নির্দেশ দিয়ে বললো,

‘সকাল বেলা তো তুমি আবার ভুলে যাবে। তাই এখনই দিয়ে দিয়েছি। একবার দেখে নাও সব ঠিকঠাক আছে কিনা?’

সৃজন কাগজটা হাতে নিয়ে খুলে দেখলো। কিন্তু পড়ে দেখার প্রয়োজন মনে করলো না। ভাঁজ করে পুনরায় পকেটে ঢুকিয়ে নিলো। সুধা ওকে সতর্ক করে দিয়ে বললো,

‘বাজার করার সময় তুমি সঙ্গে থাকবে। নইলে দোকানদার দুইনাম্বার জিনিস ঢুকিয়ে দেয়।’

‘আচ্ছা।’

সৃজন খেতে খেতে বললো,

‘তোর কিছু লাগবে না?’

নিজের ব্যাপারে সুধাকে বিশেষ আগ্রহী দেখালো না। সৃজন মাসের শুরুতেই মায়ের ওষুধ আর হাত খরচের টাকা ওর হাতে তুলে দেয়। সেই টাকা এখনো আছে সুধার কাছে। এই বাড়িতে আসার পূর্বে মায়ের ওষুধ আর বাজার করে দিয়ে এসেছে। তাই অযথা খরচের পক্ষপাতী হলো না। শান্ত কন্ঠে বললো,

‘আমার কিছু লাগবে না।’

জবাবটা যেন সৃজনের জানা ছিলো। কন্ঠস্বরে মৃদু আক্ষেপ প্রকাশ করে বললো,

‘তোর কখনোই কিছু লাগে না।’

সুধা হাসলো। বললো,

‘লাগলে আমি তোমাকে বলবো।’

ওদের দুজনের কথাবার্তার মাঝখানে তাহেরা রান্নাঘর থেকে সুধাকে ডাক দিয়ে বললো,

‘ভাইজানের খাবার পানি গরম হইয়া গেছে আপা। কি করবো? নামায়া রাখবো?’

সুধা উঠে যেতে যেতে বললো,

‘তুই রাখ। আমি আসছি। ফ্লাস্কে ঢুকাবো।’

ফ্লাস্কে গরম পানি ঢুকানোর জন্য রান্নাঘরের দিকে গেলো সুধা। সৃজন চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। সুধা ফ্লাস্ক ভর্তি গরম পানি নিয়ে ফিরে এলো। ফ্লাস্কের ঢাকনাটা ভালো ভাবে আটকানোর সময় অতি দরকারি জিনিস মনে পড়ে যাওয়ার মতন করে বললো,

‘কালকে বাজার করে আসার সময় একটা বাসক গাছের চারা নিয়ে এসো।’

সৃজন খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করলো,

‘বাসক গাছের চারা দিয়ে কি করবি?’

‘কাল রাতে দেখলাম তুমি খুকখুক করে কাশছো। বাসক পাতা কাশির জন্য উপকারী। ঠান্ডা পড়লেই তো তোমার কাশির সমস্যা দেখা দেয়। তাই ভাবলাম বাড়িতে গাছ থাকলে বাইরে থেকে কিনে আনার ঝামেলা থাকবে না।’

সৃজন খুব বেশি অবাক হলো না। সুধার এমন চরিত্রের সঙ্গে ও পূর্বপরিচিত। স্নেহের দিক থেকে সুধা অনন্য। নইলে সামান্য কাশির জন্য বাড়িতে ওষুধের গাছ লাগিয়ে ফেলার চিন্তা কার মাথায় আসবে! বিনা প্রতিবাদে সুধার নির্দেশ মেনে নিলো। নেবেই বা না কেন? এমন অধিকার নিয়ে স্নেহ দেখানোর সাধ্য কজনের থাকে?

সৃজনের খাওয়া শেষে সব জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিলো সুধা। সৃজন নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার সময় হঠাৎ দোতলার দিকে ইঙ্গিত করে বললো,

‘ওর কিছু লাগবে কি না জিজ্ঞেস করেছিস?’

‘ওর’ বলতে ফাগুনের কথাই বুঝিয়েছে সৃজন। সুধা টেবিল গোছাতে গোছাতে খুব স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিলো,

‘তাহেরাকে পাঠিয়েছিলাম জিজ্ঞেস করতে। তাহেরা বললো ঘুমাচ্ছে। সকাল বেলা আবার পাঠাবো।’

সৃজন আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপচাপ ঘরে চলে গেলো।


পরেরদিন সকাল বেলা সৃজন কারখানার উদ্দেশ্যে বেরোবার পূর্বে আরেকবার তাহেরাকে ফাগুনের ঘরে পাঠালো সুধা।
ফাগুন তখন বিছানায় বসে একধ্যানে মোবাইল ফোনটার দিকে চেয়ে ছিলো।
গতকাল রাতে আসাদ মেসেজ পাঠিয়েছে। মেসেজে লিখা আছে যেকোনো মুহূর্তে ফাগুনকে নিয়ে পালাবে সে। খালেদ তালুকার ফাগুনের ডিভোর্সের বিষয়টা জেনে গিয়েছেন। সেইজন্য খেপে গিয়ে আসাদের পিছনে লোক লাগিয়েছেন। কয়েকদিন আত্মগোপনে থাকবে আসাদ। তারপর সুযোগ পেলে ফাগুনকে নিয়ে পালাবে। ফাগুনকে পালানোর জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকতে বলেছে।

মেসেজটা দেখার পর থেকে সারারাত অস্থিরতায় কেটেছে ফাগুনের। একফোঁটাও ঘুমাতে পারে নি। কখনো বারান্দায় পায়চারি করেছে আবার কখনো সৃজনের ঘরের দরজায় গিয়ে বিনা কারণে উঁকি দিয়েছে!

তাহেরা ওকে মূর্তির মতন বসে থাকতে দেখে দরজায় খটখট আওয়াজ করলো। ঘরে ঢুকে কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে বললো,

‘সুধা আপা জিগাইছে আপনার কিছু লাগবো কি না? ভাইজান বাজারে যায়। লাগলে লিস্ট কইরা দেন।’

ফাগুন অবাক হয়ে তাহেরার দিকে চাইলো। তাহেরা কি বলেছে ও শুনতে পায় নি। তাহেরা সেটা বুঝতে পেরে পূর্বের প্রশ্নটাই পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,

‘আপনার কিছু লাগবে? লাগলে ভাইজান আইনা দিবে।’

ফাগুন তখনও মেসেজটার কথা ভাবছিলো। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললো,

‘আমার কিছু লাগবে না।’

তাহেরা আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না। প্রায় ছুটে নেমে গেলো নিচতলায়। ফাগুন খাটের সঙ্গে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো।


ফাগুনের ঘুম ভাঙলো নিচতলায় হাসাহাসির শব্দ শুনে। নিচে কিছু একটা নিয়ে সুধার সঙ্গে হাসাহাসি করছে তাহেরা। ফাগুন আশেপাশে তাকিয়ে ফের চোখ বন্ধ করে ফেললো। আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ বিছনায়া শুয়ে রইলো। তারপর ধীরে ধীরে নিচে গেলো কি হয়েছে দেখার জন্য। বারান্দায় বসে মহাসমারোহে সৃজনের মাথায় বাটনা মেহেদি লাগিয়ে দিচ্ছে সুধা। পাশে দাঁড়িয়ে আছে তাহেরা।

সৃজন গেঞ্জির ওপর দিয়ে একটা গামছা পেঁচিয়ে চুপচাপ বসে আছে। বোঝাই যাচ্ছে ওকে জোর করে ধরে নিয়েছে এসেছে এই দুই রমনী!

ফাগুন দূর থেকে তাকিয়ে দৃশ্যটা দেখলো। সকালের সোনা রোদ এসে পড়ছে সৃজনের চোখমুখে। অপূর্ব সুন্দর লাগছে দেখতে! শিরশির করা এক অনুভূতি এসে ফাগুনকে ছুঁয়ে দিয়ে গেলো! উলটপালট হয়ে চিন্তাভাবনা। ঝড় উঠলো বুকের ভেতর! নিজের অজান্তেই কেঁদে ফেললো ফাগুন!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here