সেই তুমি? পর্ব -২৩

0
2862

সেই তুমি?
পর্ব -২৩
Samira Afrin Samia(Nipa)

রাতে রিহা ইফান কে রেডি করিয়ে নিয়ে দুজন এক সাথে নিচে আসে। ইফানের হাত ধরে রিহা সিড়ি দিয়ে নিচে নামছে। সবাই ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে দেখছে। মনির চৌধুরী ওদের দুজনের দিকে একটু এগিয়ে এসে
— এই তো এসে গেছে আমার প্রিন্সেস। আসো ইফান তোমার জন্য ই এতক্ষণ সবাই অপেক্ষা করছিল।
রিহা আর ইফান নিচে এসে মনির চৌধুরীর সামনে দাঁড়ায়। রিহা তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে
— বাবা আমাদের জন্য তুমি এতো কিছু করেছো। থেংক্স বাবা।
— পাগল মেয়ে। আমার একটা মাত্র মেয়ের জন্য এতো কিছু না করলে কার জন্য করবো। আমার সব কিছু তো তোমার জন্য ই।
আচ্ছা তুমি ইফান কে নিয়ে এদিকে থাকো। আমি একটু দেখে আসি ওদিকে কি হচ্ছে। সবাই সব কিছু ঠিক মত করছে নাকি।
— আচ্ছা।
মনির চৌধুরী চলে গেলে ইফান একটু আস্তে করে রিহার কানের কাছে এসে
— কি হচ্ছে রিহা?
এতো বড় করে কিসের পার্টি হচ্ছে তোমাদের বাসায়?
— বলছিলাম না বাবা তোমার জন্য সারপ্রাইজ প্লেন করছে। এটাই হচ্ছে তোমার সারপ্রাইজ এর প্রথম ধাপ। তবে পুরো সারপ্রাইজ এখনও বাকি আছে।
— আমার জন্য সারপ্রাইজ প্লেন করে এতো বড় পার্টি।
এই পার্টিতে তো মনে হচ্ছে শহরের সব বড় বড় ধনী লোকেরা এসেছে।
— হুম। বাবার সাথে যারা সব সময় উঠাবসা করে তাদের আর বাবার কয়েকজন বিজনেস পার্টনার দের বলা হয়েছে।
— তাই তো দেখছি।
পার্টির আসল উদেশ্য টা কি, মানে কি মনে করে হঠাৎ এতো বড় পার্টির আয়োজন তা কিন্তু আমাকে এখনও বললে না।
— একটু সময় দেও। কিছুক্ষন পর তুমি নিজে থেকেই সব কিছু জানতে পারবে।
চলো এখন ডিংক্স নেই।
— আমার এসব ভালো লাগছে না রিহা। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। সব কিছু কেমন উলট পালট লাগছে।
— আরে এতো টেনশন নিও না তো এখানে যা হচ্ছে সব তোমার ভালোর জন্যেই হচ্ছে। তুমি যখন সত্যি টা জানতে পারবে আমি সিউর তখন তুমি আমার থেকেও বেশি খুশি হবে।
এখন চলো তো প্লিজ ইফান।

রিহার ড্রেসে জোস পড়ে গেলে রিহা ড্রেস চেঞ্জ করতে যায়। ইফান একা দাঁড়িয়ে আছে। আজ কাল এসব পার্টি ইফানের কাছে একদম ভালো লাগে না। আগে অনেক পার্টি করেছে অনেক সময় তো পুরো রাত বাসায় না ফিরে বাইরে থেকে পার্টি করেছে। তখন সব কিছুই ইফানের কাছে ভালো লাগতো। এখন সব কিছুতেই কেমন অসস্তি লাগে। রাফি ইফানের কাছে এসে
— কি হিরো মুখ কালো করে এখানে এভাবে একা দাঁড়িয়ে আছো। কি হয়েছে?
— কিছু হয়নি। কি হবে?
— কিছু না হলে এখানে এতো বড় পার্টি হচ্ছে আর তুই এক কোনায় মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছিস। আগে তো পার্টি তোর জীবন ছিল। নাচানাচি গানবাজনা হৈইহোল্লর এগুলো ই তোর ভালো লাগতো।
— জানি না রে। কেন ই জানি এখন এসব মোটেও ভালো লাগে না। পার্টি তো একদমই না।
— পরিবারের সাথে থাকলে সব কিছুই ভালো লাগে। পরিবার থেকে দূরে থাকলে কিছুই ভালো লাগে না। কিছুতেই মন বসে না।
— হুম। তো এখন কোথায় থাকিস তুই?
তেমন একটা দেখি না তোকে।
— তুই তো সারা দিন রিহার সাথেই থাকিস আমাকে দেখবি কি করে?
— ভালো লাগে না রে কিছুই।
— তা ভাই শুনছি এই এতো বড় পার্টি নাকি তোর জন্য দেওয়া হচ্ছে। ব্যাপার টা কি? হঠাৎ করে তোর জন্য এতো কিছু আমাদের আঙ্কেলের কি মাথা ঠিক আছে?
— আমিও ঠিক জানি না এটা কিসের পার্টি।
— দেখিস ভাই আমার কিন্ত কিছুই ঠিক বলে মনে হচ্ছে না।
পেছন থেকে রিহা এসে
— কি ঠিক বলে মনে হচ্ছে না তোর?
রাফি আর ইফান রিহার কথা শুনে পেছনে তাকিয়ে
— এই তো ইফানের সাথে একটু কথা বলছিলাম।
— কি নিয়ে কথা বলছিলি তা ই তো জানতে চাইছি।
— তেমন কিছু না। তুই বুঝবি না।
— কি এমন কথা হচ্ছে যা আমি বুঝবো না?
— বললাম তো তোর এই ছোট মাথায় এতো বড় বড় কথা ঢুকবে না।

ইফান কে মনির চৌধুরী ডেকে নিয়ে গেছে উনার কয়েক জন গেস্টদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। রাফি রিহার সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
— আজ তোকে বেশ খুশি খুশি লাগছে কারণ কিরে?
— কারণ তো আছে কিছু একটা। কারণ যাই হোক সত্যি ই আজ আমি অনেক খুশি।
— তা তো বুঝতেই পারছি। দাঁড়িয়ে আছিস আমার সাথে কিন্তু তেমন কথা বলছিস না। যাও একটা দুইটা কথা বলছিস পরেও আমার দিকে না তাকিয়ে ইফানের দিকে তাকিয়ে কোনো কারণ ছাড়াই মুচকি মুচকি হাসছিস।
— তোর মাথায় এতো বুদ্ধি কেন হুম?
— আল্লাহর দান আমি কি করবো বল।
— হুম। শুন তাহলে আজ বাবা এই পার্টিতে আমার আর ইফানের বিয়ের এনাউন্সমেন্ট করবে। আজ এনগেজমেন্ট ও হয়ে যেতে পারে।
— কি বলছিস ইফান জানে এসব বিষয়ে?
— না ওকে কিছু জানাই নি। সারপ্রাইজ দিব।
— এতে ইফান সারপ্রাইজড হবে না। বরং উল্টো রাগ করে সবার সামনে মিসবিহেইভ করতে পারে।
— তুই টেনশন নিস না। বাবা সব কিছু সামলে নিবে।
— তুই ইফান কে সব কিছু জানিয়েছিস তো?
— কি জানাবো?
— কি জানাবি মানে? ইশিতার সাথে যা যা হয়েছে তার পেছনে কে আছে, কে করিয়েছে এসব তা জানাবি?
— তুই কি পাগল হয়ে গেছিস রাফি?
এসব জানলে ইফান আমাকে বিয়ে করবে তো দূর ও আমাকে মেরে ফেলবে।
— তাই বলে তুই ওকে ধোঁকা দিয়ে বিয়ে করবি?
— ধোঁকা কোথায়? আমি ইফান কে মন থেকে ভালোবাসি।
— এভাবে ইফান কে সত্যি টা না জানিয়ে বিয়ে করা ঠিক হবে না। বিয়ের পর যদি ইফান কোনো ভাবে সব কিছু জেনে যায় তখন?
— আমি ইফান কে কোনো ভাবেই সত্যি টা জানতে দিবো না। ইফান কে পাওয়ার জন্য আমি অনেক কিছু করেছি। এখন এই মুহূর্তে এসে ওকে পেতে পেতে হারাতে দিব না। কোনো ভাবেই না।
— আমি যদি ইফান কে সব কিছু বলে দেই তাহলে কি করবি তুই?
— তুই এমন টা করবি না আমি জানি।
— ধর যদি করে ফেলি?
— তুই খুব ভালো করেই জানিস ইফান কে নিজের করে পাওয়ার জন্য আমি কতটা নিচে নেমেছি। দরকার পরলে আরও নিচে নামবো পরেও ইফান কে হারিয়ে যেতে দিব না।
— তুই আমার সাথেও এমন কিছু করতে পারবি যেমন টা ইশিতার সাথে করেছিস?
— তুই মনে হয় এতো দিনেও আমাকে ঠিক মত চিনে উঠতে পারিস নি। ইফানের জন্য তুই কেন আমি দুনিয়ার সবার বিরুদ্ধে যেতে পারি।
— রিহা!
— রাফি দোস্ত তুই এমন কিছু করিস না যার কারনে তোর সাথেও আমার নিচু মানের কোনো কাজ করতে হয়। আমাকে এর থেকে বেশি নিচে নামতে বাধ্য করিস না।
তোর কাছে এটা আমার অনুরোধ প্লিজ দোস্ত আমার এই কথা টা রাখিস
— কিসের নিচে নামার কথা হচ্ছে?
ইফানের কথা শুনে রিহা হকচকিয়ে উঠলো।
— রাফির সাথে তো দেখছি ভালোই আড্ডা জমেছে।
— হুম তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
— কোথায় আর তোমার বাবার সাথে।
— ওহ।

মনির চৌধুরী পার্টিতে উপস্থিত সকলের উদেশ্য করে হাতে মাইক নিয়ে স্টেজে দাঁড়িয়ে
— এটেনশম এ্যাভরিওয়ান। পার্টিতে উপস্থিত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আপনারা আজকে সবাই আমার এই পার্টিতে আসার জন্য প্রথমে সবাই কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অনেকে ই হয়ত জানেন না কিসের জন্য আজ এতো বড় করে পার্টি দেওয়া হচ্ছে।
আপনাদের সবার সুবিধার জন্য আমি আবার জানিয়ে দিচ্ছি আজকের এই পার্টি আমার মেয়ে রিহা ও ইফান কে ঘিরে দেওয়া হয়েছে।

মনির চৌধুরী রিহা কে হাতে ইশারা করে স্টেজে যেতে বললে রিহার ইফানের হাত ধরে ইফান কে নিয়ে স্টেজে উঠে যায়।
— আপনারা সবাই তো আমার মেয়েকে চিনেন ই। আমার মেয়ে আজ তার জীবনের সবথেকে বড় সিধান্ত টা নিতে যাচ্ছে।
এসব কি হচ্ছে ইফান কিছু বুঝতে না পেরে রিহার কানের কাছে এসে
— রিহা তুমি তো আগে আমাকে কিছুই জানাও নি। তুমি কি আজ তোমার বিয়ের এনাউন্সমেন্ট করতে যাচ্ছো। ছেলে টা কে?
— উফ ইফান তুমি ও না!
মনির চৌধুরী আবার বলতে লাগলো।
— রিহা তার ভালোবাসার মানুষের সাথে নিজের বাকি জীবন টা কাটানোর সিধান্ত নিয়েছে। খুব শিঘ্রই ওদের ভালোবাসার সম্পর্ক টা কে বিয়ে পবিত্র বাঁধনে আবদ্ধ করতে যাচ্ছে।
আমার মেয়ে যে ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করতে যাচ্ছে সে আর কেউ না, এই শহরের নাম্বার ওয়ান বিজনেসম্যান ইয়াশ চৌধুরীর একমাত্র ছোট ভাই মি.ইফান চৌধুরী।
এনাউন্সমেন্টে ইফানের নাম শুনে সবাই হাত তালি দিতে লাগলো। ইফান অবাক হয়ে রিহার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। এসব কি বলছে রিহার বাবা আগে থেকে তো এমন কোনো কথাই ছিল না। যা হচ্ছে সবই তো ইফানের অজানা। ইফান তো রিহা কে বিয়ে করার জন্য মোটেও রাজি না।
মনির চৌধুরী মাইক হাতে বলেই যাচ্ছেন।

— আজ যখন আপমারা সবাই এক সাথে আছেন খুশির একটা মুহূর্ত তৈরি হয়েছে তাহলে আজ শুধু রিং একচেঞ্জ করে রাখলে কেমন হয়? বিয়ের জন্য নাহয় পরে কোনো ভালো সময় দেখে দিন তারিখ ঠিক করা যাবে। কি বলেন আপনারা?

কয়েক জন লোক খুব উৎসাহ নিয়ে হ্যা, হ্যা হয়ে যাক বলে চেঁচিয়ে উঠছে। আবার কিছু লোক এক রাশ প্রশ্ন মনে চেপে রেখে শুধু হাত তালি দিচ্ছেন। আবার কয়েক জন তো বলেই ফেললো।
— ইয়াশ চৌধুরীর ভাইয়ের বিয়ের এনাউন্সমেন্ট হলো আর উনি এখানে উপস্থিত না। সব ঠিক আছে তো?
তাহলে কি ইয়াশ চৌধুরী ভাইয়ের বিয়েতে রাজি না?
উনার ফ্যামিলির কেউ ই তো দেখছি এই পার্টিতে আসেনি।
— আমার মেয়ের খুশির উপলক্ষে ই আজকের পার্টি। সো আপনারা সবাই মন খুলে আনন্দ করবেন। আর আমার মেয়ে ও মেয়ে জামাইয়ের জন্য অনেক অনেক দোয়া করবেন।
ইফান এতক্ষণ বহু কষ্টে নিজের রাগ কন্ট্রোল করলেও। এখন আর পারলো না।
— রিহা তুমি আমার সাথে সাইডে আসবে নাকি আমি এখুনি এখান থেকে বের হয়ে যাবো?
রিহা ইফানের দিকে তাকিয়ে রীতিমত ভয় পেয়ে গেল। ইফানের চোখ দিয়ে মনে হচ্ছে আগুন বের হচ্ছে। রাগে নাকের ডগা লাল হয়ে ফোলে উঠেছে। ইফান দাঁতে দাঁত চেপে কটমট করে কথা গুলো বললো রিহা কে।
— আমি যাচ্ছি।
রিহা ইফানের হাত ধরে
— প্লিজ ইফান! আমরা একটু আলাদা করে কথা বলতে পারি?
ইফান রাগে আগুন হয়ে রিহার দিকে তাকালো।ইফান আগে আগে স্টেজ থেকে নেমে গেল। রিহা ও ইফানের পেছনে চলে গেল। মনির চৌধুরী বিষয় টা লহ্ম করেছে।
ইফান রিহার রুমে যাওয়ার সাথে সাথে টেবিলের উপর রাখা ফুলদানি টা ছুঁড়ে ফেলে দিলো।
— কি হচ্ছিল এসব নিচে?
তুমি আর তোমার বাবা কি করতে চাইছো?
— ইফান তুমি এমন বিহেইভ করছো কেন?
— তুমি জানো না আমি কেন এমন করছি?
— আমি তোমাকে ভালোবাসি।
ইফান রেগে রিহার হাত ধরে পিছনে নিয়ে গিয়ে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে।
— কত বার বলবো আমি তোমাকে ভালোবাসি না।
তুমি জানো আমি কখনও তোমাকে ভালোবাসি নি।তার পর ও তুমি আর তোমার বাবা নিচে এতো বড় ড্রামা করলে। আমি তো এ জীবনে কখনও তোমাকে বিয়ে করবো না। কান খুলে শুনে রাখো তুমি যা চাইছো তা কখন পূরণ হবে না।
রিহা এক ঝটকায় ইফানের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে
— কেন ইফান?
কেন তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারবে না?
সেই চার বছর ধরে তুমি আমি এক সাথে আছি। কখন বন্ধুত্ব থেকে তোমার প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়ে গেছে তা আমি একদম ই বুঝতে পারিনি। এখন তোমাকে ছাড়া আমার শ্বাস নেওয়া ও দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। আমি তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি। প্লিজ ইফান তুমি আমাকে বিয়ে করে নেও প্লিজ।
— জাস্ট সেটআপ। আগেও বলেছি এখনও বলছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি না আর কোনো দিন বাসবো ও না। বিয়ে তো দূর আমি আর এক মুহূর্ত ও তোমার বাসায় থাকছি না।
আমি গেলাম আমার মত করে। বাই রিহা। আর হ্যা তোমার বাবাকে ও এই কথা টা ভালো করে বুঝিয়ে দিও।
ইফান রুম থেকে বের হতে নিলে রিহা পেছনে থেকে ইফান কে ডেকে উঠে। ইফান পেছনে ফিরলে রিহা ড্রেসিন টেবিলের আয়না ভেঙে একটা কাঁচের টুকরা হাতে নিয়ে।
— তুমি এই রুম থেকে এক পা বাইরে বের হলে আমি নিজেকে শেষ করে দিব ইফান। তোমাকে না পেলে এমনিতে ও আমি বাঁচতে পারবো না। যে জীবনে তুমি নেই সে জীবন রেখে কি করবো আমি?

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here