#বাসি_ফুলের_সুবাস
#পর্ব_৬,০৭
#মাসুরা_খাতুন
০৬
“এই রাবু,এতো ভালো আচারটা কে বানিয়েছে রে? তুই তো এমন আচার বানাতে পারিস না, নাকি তোর তেনাদের গুরুমার কাছ থেকে শিখেছিলি?”
ভাবির সামনে কি সব বলছে ভাইয়া? আমি নিজেই হতবাক! ভাইয়া কি সবসময়ই এমন বেপরোয়া থেকে যাবে?
“কিকি বলছো ভাইয়া এসব।আর তুমি হটাৎ এলে? যাও খালাম্মার সাথে দেখা করে এসো।আর ভাবি আমি ছাদে গেলাম কাপড় তুলতে।”
বলেই কোন রকমে ওখান থেকে চলে এলাম।কিন্তু ভাবির চোখ মুখ দিয়ে তখন আগুন ঝরছিল।
চারদিকে মাগরিবের আজান হচ্ছে। আমি ছাদে এসেছি কাপড় তুলতে, অনেকক্ষণ হয়ে গেল।কাজ না থাকায় একা একা ছাদেই দাঁড়িয়ে আছি।নিজের সম্পর্কে ভাবছি,নিজের ভবিষ্যতের গভীরতা মাপছি।রেমি আপু কি সব বলল! ধুর,আমার মতো অনাথ এতিম মেয়ের অতো ভালো বিয়ে হয় না কি!এ শুধুই স্বপ্ন। আর সত্যিই কি আমার কোন দিন নিজের আপন কোন মানুষ হবে? কেউ কি আমায় সত্যি সত্যি সম্মান দিয়ে গ্রহণ করবে? আমার জীবনে কি নিজের একটা সংসার হবে? নিজের একটা পরিবার পাবো আমি? আর কিই বা আমার পরিচয়, আচ্ছা আমার নিজের বাবা মা কি বেঁচে আছেন? উনারা যদি বেঁচে থেকে থাকেন,তাহলে আমার কথা কি মনে পড়ে? আমার মা যিনি,উনিও কি আবির ভাইয়া বাড়ি না আসলে খালাম্মা যেমন করে কাঁদে তেমন করে কাঁদে আমার জন্য? বাবা নামের বিশাল ছায়া কি আমারও এ পৃথিবীতে আছে? মাথা ফে*টে যায় আমার এসব ভাবলে।যতো ভাবি শুধু এক আকাশ শুন্যতা ছাড়া আর কিছুই পাইনা সমাধান। আমি তো এটাও জানি না আমি হিন্দু নাকি মুসলমানের ঘরের সন্তান। এর চেয়ে আর কি কষ্ট একটা মানুষের থাকতে পারে?বুকের ভেতর কেমন ব্যথা করে আমার,দম বন্ধ বন্ধ লাগে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ি ছাদের এককোণে।দু হাত দিয়ে মুখ টা ঢেকে নিজের কষ্ট বিসর্জন দিতে থাকি।কেউ নেই আমার,কেউ নেই এ পৃথিবীতে। আমি বড় বেশি একা।নিজের বলে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে কষ্ট গুলো দূর করার মতো কেউ নেই আমার।মাঝে মাঝে বুক যখন বেশি ভারি হয়ে যায়, তখন হয় ঘরের মধ্যে কাঁথা মুড়ি দিয়ে, নয় তো এই বিশাল ফাঁকা ছাদে এসে নিজের মনটা হালকা করি।
হটাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পাই।চোখ মুছে তাকাতেই দেখি আবির ভাইয়া এসেছেন।ততক্ষণে অনেক টা অন্ধকার ও হয়ে এসেছে। কাছাকাছি না আসলে কারও মুখ চেনা যায় না। চোখ মুছে আমি উঠে দাঁড়ায়।
“ভাইয়া তুমি? কিছু দরকার? ”
“তুই কাঁদতে ও পারিস রাবু? বাহ্! আমি ভাবতাম তুই রোবট হয়ে গেছিস,কান্না, ব্যথা পাওয়া, কষ্ট, আবেগ এগুলো কিছুই নেই তোর।থাকলে কি আর এমন ভাবে সব মেনে নিতে পারতিস।”
“তোমার এতো কঠিন কঠিন কথা আমি বুঝি না ভাইয়া। তবে একটা কথা হলো,মেনে না নিয়ে কি করতাম আমি বলতো? আমার চেয়ে অসহায় এ পৃথিবীতে কি আর কেউ হয়?ছোট বেলা থেকে পরের বাড়ির আশ্রিতা,পৃথিবীতে নিজের র*ক্তের বলতে কেউ নেই। এমন কি, কি আমার পরিচয় তাও আমি জানি না।এখানে মুখ বুজে না থেকে আমি কি করবো বলতো? ”
“তাই বলে দুইদিন হলো বউ হয়ে এসেছে, তারও এতো কথা শুনবি তুই?কেন তোর মুখ নেই? ”
“ককি সব বলছো ভাইয়া? কে কথা বলেছে? কেউ কিচ্ছু বলেনি।”
“আমি সবটা শুনেছি রাবু।কিন্তু তখন জবাব টা দেইনি কারণ সীমা টা দেখছিলাম, কতদূর এগিয়েছে। আচ্ছা, আমি কি মানুষ চিনতে সত্যিই ভুল করলাম রাবু? যাকে চেয়েছিলাম তাকে পাইনি,সে কিন্তু এমন ছিলো না।আর যাকে পেলাম, সে আমার মন বুঝলো না।আমার মনের মতো হতে পারলো না। আমি সত্যিই ব্যর্থ রাবু।”
“ছিহ্,এসব কি বলছো ভাইয়া। ভাবি খুব ভালো। আসলে আমারই অনেক টা দেরি হয়ে গিয়েছিল,ভাবির রাগ করাটা স্বাভাবিক। কিন্তু ভাবি কি রেমি আপুর সম্পর্কে কিছু জানে ভাইয়া?”
“হ্যাঁ।সবটাই জানে,আমিই বলেছিলাম বিয়ের আগে।ভেবেছিলাম বিয়ের আগেই অন্তত আমার বিষয়ে সবটা জানা উচিত। পায়েল ও এতিম মেয়ে। চাচা চাচির সংসারে থাকতো।টিউশনি করিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতো। তো,একদিন পরিচয় হয় ওর সাথে,এতিম হওয়ায় তোর কষ্ট আমি নিজে চোখে দেখেছি। আর ওকেও খুব মায়াবী মনে হলো।মনে হলো এ মেয়ে সত্যিই আমার মন বুঝবে,আমার চিন্তা ভাবনা গুলোকে সম্মান করবে।অন্তত একটা এতিম মেয়ে কে আমি সম্মান দিতে পারবো।তাই তো আমার সম্পর্কে সব কথা বলি,তোর কথা রেমির কথা।রেমি যে তোকে ভালোবাসে সেসব কথা খুলে বলি।ও সবটা শুনে সেদিন খুব সাপোর্ট করেছিল আমায়,তাই তো হীরে পেয়েছি ভেবে কাচকে মাথায় তুলি আমি।”
“না ভাইয়া,তুমি ভুল ভাবছো।ভাবি সবসময় আমার সাথে ওমন করেনা।খুব স্নেহ করেন আমায়,আর ভালোও বাসেন।তুমি চিন্তা করিও না তো।”
এতোদিনে বুঝলাম ভাবির আমার প্রতি প্রথম দিন থেকেই রাগ।ভাবি মুখে মুখে ভাইয়াকে বলেছিল ঠিকই কিন্তু মনে মনে আমার প্রতি একরাশ বিতৃষ্ণা নিয়েই এ বাড়িতে এসেছিল।কিন্তু সেসব কথা ভাইয়াকে বলে লাভ কি? শুধু শুধু ঝগড়া হবে উনাদের মধ্যে।আর তাছাড়া ও,ভাইয়া বা কতোক্ষণ থাকব? দু একদিন পরই চলে যাবেন।আর বাকি সময় গুলোতো আমার এ বাড়িতেই ভাবির সাথেই কাটাতে হবে।তাই এতোকাল যেমন সহ্য করে এসেছি, তেমন সহ্য করাই ভালো।দেখি সৃষ্টিকর্তা আমার জন্য কি রেখেছেন।
“এই রাবু,আয় তোকে একটা জিনিস দেখায়।ছাদের এই ধারটা তে আয়।”
বলে ভাইয়া আমায় টেনে যেই ধারে রেমি আপুদের বাড়ি সেই দিকটায় নিয়ে গেলেন। তারপর আমায় বললেন,
“কিছু দেখতে পাচ্ছিস?”
“কই নাতো।কি দেখব?”
উনি আঙুল উঁচিয়ে দেখালেন
“ঐ যে, ঐ পেত্নীটার ঘর।”
“ভাইয়া,তারমানে এই জন্যই তুমি আগে ছাদে এসে খালি এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে থাকতে? আমি এভাবে তো ভেবে দেখিনি! ”
“ঐ যে দেখছিস বারান্দা, পেত্নী টা রোজ দুপুর বারোটায় গোসল করে ওখানে আসতো চুল শুকাতে, আর ওখান থেকে মুখ ভেঙাতো আমায়।”
কথাটা বলেই বারান্দা দেখাতেই ভাইয়া দেখতে পায় রেমি আপু আর উনার স্বামী বারান্দায় বসে চা খাচ্ছেন। ঘরের ভেতরের হলুদ আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দৃশ্য টি।কিছু ক্ষণের জন্য ভাইয়া অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। আমার নিজের ও ভাইয়ার জন্য খারাপ লাগলো।কিন্তু পরক্ষণেই ভাইয়া নিজেকে ধাতস্থ করে বললেন,
“কেমন পেত্নী দেখেছিস,আজও আমায় জ্বা*লাতে বারান্দায় জামাই নিয়ে বসে আছে। ইচ্ছে করতেছে এক ধা*ক্কা দিয়ে দুটোরে পদ্মায় ফেলে দিই।শাঁকচুন্নি কোথাকার! ”
ভাইয়ার বলা দেখে প্রচন্ড হাসি পেল আমার।হেসে ওঠে ভাইয়ার এক হাত ধরে টেনে সিঁড়ির দিকে আসতে আসতে বললাম,
“তুমি এসতো,এতো জ্ব*লতে হবেনা।বাচ্চাদের মতো করিওনা।”
ভাইয়া ও হেসে উঠল আমার কথায় তারপর দুজন মিলে এগোতেই সামনে পড়ে ছোট ভাবি।ছাদে অন্ধকার হওয়ায় ভাবির মুখ বোঝা না গেলেও ভাবির কথার ধরনে আমি আর ভাইয়া দুজনেই হতভম্ব!
“কি ব্যাপার,কি হচ্ছে এখানে? এই রাবু,তোমার কোন কাজ নেই? সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হচ্ছে, তাও তোমার এ কয়টা কাপড় তোলা হলোনা?সবাই কে বোকা ভাবো তুমি?”
“ছিহ্ পায়েল! এটদ কেমন ভাষায় রাবুর সাথে কথা বলছো তুমি? বেশি বাড়াবাড়ি করছো কিন্তু তুমি।”
“বাড়াবাড়ি? বাড়াবাড়ি আমি করছি? নাকি তুমি,তোমরা? বাসার কাজের লোকের সাথে রাতে ছাদে একা একা কি করছো? তাও আবার এমন রঙ তামাশা হাসিখুশি মেজাজে? ”
“শাট আপ পায়েল! ছিহ্,এই তোমার মন মানসিকতা? আমার লজ্জা হচ্ছে তোমার জন্য। তোমায় আমি বিশ্বাস করে বিয়ে করেছিলাম!”
ভাইয়া ভাবির এমন শোরগোলে খালাম্মা ও উপরে চলে এলেন।এবার আমার সত্যিই ভয় হতে লাগল।আমার জন্য উনাদের অশান্তি হচ্ছে।
“ভাবি,বিশ্বাস করো, তুৃমি যা ভাবছো তেমন কিছু নয়।আমি আর ভাইয়া শুধু কথা বলছিলাম। আর তুমি ভাইয়া আর আমাকে ভুল বুঝছো।এতো খারাপ মন্তব্য করোনা ভাবি।উনি আমার ভাইয়া হোন।”
“তুমি চুপ করো! চোরের মায়ের বড় গলা! এসব কারণেই বুঝি সারাক্ষণ আবির ভাইয়া আবির ভাইয়া বলে এক ঢোক জল বেশি খাও? বেয়াদব মেয়ে। ”
“পায়েল একদম চুপ করো বলছি।নাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে। বেশি বলে ফেলেছো তুমি? আমি কিছু বলছিনা বলে আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না।ভুলে যেও না তুমিও কিন্তু রাবুর মতোই অনাথ। ”
“শাট আপ আবির! রাবুর সাথে আমায় তুলনা করো না।আমার শুধু বাবা মায় ছিলো না,কিন্তু পরিচয় হীন নই।আর ও? না জানি কোন ঘরের মেয়ে? না আছে জন্ম পরিচয়, না আছে কোন ঠিক ঠিকানা। ”
আবির ভাইয়া প্রচন্ড রেগে গেলেন। রাগের মাথায় ভাবির গালে দুটো চ*ড় বসিয়ে দিলেন। ভয়ে লজ্জায় আমিও কেঁদে দিলাম। খালাম্মা এসে ভাইয়াকে সামলালেন।আর ভাবি কে বললেন,
“শোন বউমা,তুৃমি যা কিছু ভাবছো সেটা ঠিক নয়।রাবুকে আবির নিজের বোনের মতোই দেখে।শুধু শুধু নিজেদের মধ্যে অশান্তি করো না।ছোট বেলা থেকেই ও রাবুকে ভালোবাসে বোনের মতো।তাই,অযথা কাদা ছুঁড়া ছু্ড়ি বাড়ির সম্মান নষ্ট করিও না।নীচে এসো।আর এই রাবু,এই কয়টা কাপড় তুলতে এসে তোর এতো দেরি হয় কেন রে? যা তাড়াতাড়ি গিয়ে কাপড় গুলো ভাজ কর।”
খালাম্মা ভাবিকে নিয়ে নীচে গেলেন। আমিও কাপড় গুলো নিয়ে নীচে গেলাম।ভয়ে আর আ*তংকে আমার হাত পা কাঁপছে। ভাবি শেষ পর্যন্ত এমন নোংরা কথা বলতে পারল? আর ভাইয়া ও এতোটা রেগে গেল? সব বোধ হয় আমার জন্য। আমারও কান্না থামছেনা।আমি ও নিজের ঘরে গিয়ে কাঁদতে লাগলাম। ঐ দিকে ভাবি কেঁদেই চলেছে,আর মুখে যা পারছে বলে যাচ্ছে।
আমাদের ছাদে জোরে জোরে কথা হওয়ায় আমায় কেউ কিছু বলছে নাকি দেখতে রেমি আপু ও ছাদে আসে।আপু বারান্দায় ছিলো তাই খুব সহজেই জোরে জোরে কথা শুনতে পায়।ভাইয়া তখন একায় ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল।আমরা চলে আসায় ভাইয়া ছাদের ধারে গিয়ে দাঁড়ায় আর হটাৎ চোখ পড়ে পাশের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা রেমি আপুর দিকে। আবছা অন্ধকারে ও দুজন ঠিক চোখাচোখি হয়ে যায় এতোদিন পর।মুখ স্পষ্ট দেখা না গেলেও দুজনেই বুঝে যায় যে দুজোড়া চোখের দৃষ্টি একে অপরের দিকে।আর চিকচিক করে ওঠে দুজনের চোখেই মুক্তোর দানার মতো লবনাক্ত জল,,,,,,,,,
চলবে,,,,,,
#বাসি_ফুলের_সুবাস
#পর্ব_৭
#মাসুরা_খাতুন
রাতে কাঁদতে কাঁদতে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।এ ঘটনার পর আর বাইরে যাই নি,কেউ ডাকেও নি। ভাইয়ার সামনে এখন যেতেও লজ্জা লাগবে। ছিহ! কি খারাপ অপবাদই না দিলো ভাবি? তবে আজ বুঝতে পারলাম ভাবির আমাকে অপছন্দের কারণ। রেমি আপুর সাথে আমার ভালো সম্পর্ক, আপু ভালোবাসেন আমায় আর তাই তো ভাবি আমায় প্রথম দিন থেকেই সহ্য করতে পারতো না।সবই আমার কপাল! নাহলে কেন আমার জীবন এমন হবে।রাতে যখন আমার ঘুম ভাঙলো তখন ঠিক রাত কতোটা জানিনা,তবে বাড়িতে যে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে তা বুঝতে পারছি বাড়ির নিরবতা দেখে।পানির তেষ্টা লাগলো খুব, তাই তো আমি উঠে গিয়ে বাইরে টেবিলে গিয়ে জগ থেকে পানি খেয়ে এলাম।আচ্ছা আবির ভাইয়া কি পরে ভাবিকে কিছু বলেছিল? ভাবি কি ওমন কাঁদছে এখনও? নাহ্,রাগে ভাইয়া একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছে। সত্যিই তো,আমি বাড়ির কাজের লোক আর আমার জন্য বাড়ির বউয়ের গায়ে হাত তোলা উচিত হয় নি।আগামী কাল থেকে আমি নিজেই ভাইয়াকে এড়িয়ে চলব,উনি আমায় ভালোবাসেন বলে বাড়ির সবাই যে মাথায় তুলবে তার কি মানে?তবে,একটা কথা সত্যি, তা হলো আমি মুক্তি চাই।সত্যিই এ বাড়ি থেকে মুক্তি চাই। পরিচয়হীন হয়ে পরের বাড়ির আশ্রিত কাজের লোক হওয়া যে কতোটা কষ্টের তা শুধু যে হয় সেই জানে।এমনি কাজের লোক যারা তারা তাও আমার থেকে স্বাধীন। এ বাড়িতে ভালো লাগলো না, বা পোষালো না আরেক বাড়িতে গেলাম। নিজের একটা স্বাধীন জীবন থাকল,দিনশেষে নিজের একটা ভাঙা ঘরে পরিবারের মানুষের সাথে শান্তির ঘুম ঘুমালাম। মাস শেষে মাইনে পেলাম, নিজের পছন্দ মতো সাধ্যের মধ্যে কোন কিছু কিনলাম। রেমি আপু বলে,মাঝে মাঝে নিজেও নিজেকে উপহার দেওয়া উচিত। এতে আত্মার শান্তি হয়। কিন্তু আমি তো পুরো অসহায়,কোন কিছু দেখলে খুব ইচ্ছে হলেও কখনও নিজের জন্য কিছু কিনতে পারিনি। অনেক সময় মেয়েদের সাজগোজের জিনিস পত্র ভ্যানে করে নিয়ে যখন বিক্রি করতে আসে,তখন খুব ইচ্ছে হয় কিছু নিতে, কত্তো সুন্দর সুন্দর জিনিস পত্র! কিন্তু কক্ষনো পারিনি কিছু নিতে , সবসময় মনের আশা গুলো মনেই রয়ে গেছে, পূরণ হয় নি।কারণ? কারণ হলো আমি এতিম। আবির ভাইয়া কে বললে হয়তো ভাইয়া কিনে দিতো,কিন্তু মুখ ফুটে কিছু চাইতে আমারই লজ্জা করে।তবে মাঝে মাঝে ভাইয়া আমায় দশ বিশ টাকা দিতো,সেটাও অনেক দিন পর।দেবে কেমন করে? ভাইয়া ও তো পড়াশোনা করে,খালুর কাছ থেকে চেয়ে চেয়ে নিতে হয়।আবির ভাইয়া একবার আমায় মেলা থেকে চকচকে সাদা পাথরের মালা এনে দিয়েছিল।ভিষণ সুন্দর দেখতে, অনেক দিন পড়েছি মালা টা।যখন কিছু আনতে বাড়ির বাইরে যেতাম,ইচ্ছে করেই সুন্দর মালা টা জামার নিচ থেকে বের করে গলার ওপর রাখতাম,যাতে আমার সাদা পাথরের মালা টা সবার নজরে পড়ে।সবাই বুঝবে আমার কতো সুন্দর মালা আছে।কিন্তু একদম মালাটা কাজ করার সময় লাকড়ির টান লেগে ছিঁড়ে যায়।খুব কষ্ট লেগেছিল সেদিন। কান্না ও এসেছিল। সুতো দিয়ে পাথরগুলো একসাথে জোড়া লাগাতে চেয়ে ও পারিনি।অবশেষে পাথর গুলো কুড়িয়ে এনে রেখে দিয়েছি আমার ঘরে টেবিলের ওপর।কতো সুন্দর পাথর গুলো চকচকা,ওগুলো ফেলে দেব কেন?রেমি আপু একবার একটা লিপস্টিক দিয়েছিল। দুই একদিন ঠোঁটে দিতেই খালাম্মার নজরে পড়তেই ফেলিয়ে নিয়ে ছেড়েছে।বলেছে এসব ফালতু জিনিস এ বাড়িতে থাকতে চাইলে দেওয়া যাবেনা।খুব কষ্ট লেগেছিল প্রিয় লিপস্টিক টা ফেলে দিতে,কিন্তু না দিলে তো আমায় বাড়িছাড়া হতে হতো।এগুলো তো মাত্র একটা দুটো ঘটনা, এমন আরও হাজার ও ঘটনা আছে আমার এই এতিম জীবনের।কতো সখ,কতো আহ্লাদ পূরণ না হওয়া রয়ে গেছে আমার।একা একা ঘরে শুয়ে শুয়ে ভাবি,হবে কি আমার স্বপ্ন গুলো কখনও পূরণ?
পরদিন সকাল বেলায় আবির ভাইয়া ব্যাগ গুছিয়ে চলে গেল। আর যাওয়ার আগে ভাবি কেও বলে গেলো ভালো হতে।ভাইয়া বলল, ভাবি যতোদিন না ভালো সুস্থ মনের মানুষ না হবে ততোদিন ভাইয়ার কাছেও ভালোবাসা পাবেনা।আর কড়া ভাবে বলে গেলো আমাকে যেন আর কিছু না বলে।তাহলে ভাইয়া কে একেবারে হারাবে।যাওয়ার আগে ভাইয়া আমাকেও খানিকটা বকে গেল।নিজের ওপর হওয়া অন্যায়ের জবাব না দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি ভাইয়া কে কি করে বোঝাবো,ভাইয়া যতোটা সহজ বলছে পৃথিবী ততোটা সহজ নয়।
ভাইয়া চলে যাওয়ার পর ভাবি তো কিছু বলল না,কিন্তু খালাম্মা খানিকটা চোটপাট করলেন আমাকে।উনার ছেলে চলে যাওয়ার জন্য আমাকেই দায়ী মনে করলেন।চুপচাপ চোখের জল ঝরালাম আমি।এটায় তো পারি শুধু আমি।
ভাইয়া যাওয়ার পর থেকে ভাবি আমার সাথে কথা বলছেনা। কিন্তু খালাম্মার আচরণ আরও রুক্ষ হয়ে গেছে। অল্পতেই রেগে যান,জন্ম পরিচয় নিয়ে কথা বলেন,মুখ দিয়েই পি*ষে ফেলেন।আমি বরাবরের মতোই বোকা।এটায় আমার একমাত্র জবাব,বোবাজবাব।কি মজার না? একজন একের পর এক বকেই যাচ্ছে, নোংরা কথা বলেই যাচ্ছে আর আরেকজন একদম চুপচাপ,বোবা।নিরবে চোখের জল ঝরিয়ে বোবা প্রতিবাদ করছে।
ভাবি আমার সাথে কথা না বললেও আমার বিষয় নিয়ে খুব মাথা ঘামাচ্ছেন দেখলাম। আজকাল আমাকে নিয়ে একটি বেশিই ভাবছে।আমি বড় হয়ে গেছি, বিয়ে দেওয়া উচিত এসব বিষয় খুবই খালুর কাছে বলছে।অথচ কয়দিন আগেই যখন রেমি আপু জামাই কে নিয়ে এসেছিল আমাদের বাড়ি,ভাইয়ার অফিসের ঐ ছেলেটার সাথে বিয়ে দেবে বলে বিয়ের কথা বলতে,তখন ভাবিই হাজারটা নীতিকথা শুনিয়েছিলেন। আমি এখনও ছোট আছি,বুদ্ধিসুদ্ধি এখনও ভালো হয় নি।পরের বাড়ি গিয়ে মানিয়ে নিতে পারব না,আরও কথা কথা। আসলে ভাবির উদ্দেশ্য যে ছিল রেমি আপুর ঠিক করা পাত্রের সাথে বিয়ে না দেওয়া সেটা আপু আমি দুজনেই বুঝেছিলাম। কারণ সেবার এসে আপু আট দিনের মতো ছিল,ভাবি যে আমার ভালো মন্দ নিয়ে ঠিক কতোটা চিন্তা করে তা আপু বুঝে গিয়েছিল। সেদিন বিয়ের প্রস্তাব এনে আপু আর ভাইয়াকে অনেক টা অপমান হয়েই যেতে হয়েছিল।একে তো খালাম্মা ও আপুকে খুব একটা পছন্দ করতেন না,তার ওপর ভাবি তো আপু কে সহ্যই করেনা।খালু বাসায় ছিলো না,তাই ভাবি আরও সুযোগ টা বেশি পেয়েছিল। এদের সবার চেয়ে আমার প্রতি আপুর ভালোবাসা টা বেশি হলেও অধিকার ছিল কম,তাই তো সেদিন ফিরে যেতে হয়েছিল আপু কে।আমি শুধু দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারিনি। আবির ভাইয়া যদি সেদিন সকালে রাগ করে চলে না যেত তাহলেও হয় তো অন্য কিছু হতে পারত।
আর এখন মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ভাবিই আমার বিয়ের জন্য এতো চিন্তা করছে।দু এক জায়গায় থেকে বিয়ের কথা আসতেই সবার পছন্দ হয়ে গেলো পাশের গ্রামের এক ছেলে কে।আমি কখনও উনাকে না দেখলেও উনি নাকি আমায় দু একবার দেখেছেন।একদিন ঘটা করে আমায় দেখতে আসা হলো।ভিষণ লজ্জা লেগেছিল মানুষ গুলোর সামনে গিয়ে বসতে।মাথা তুলে তাকাতে পারিনি আমি,তারমধ্যে লোকজন গুলো কি সব প্রশ্ন করতে লাগল আমায়।কাজকর্ম পারি কিনা? কুরআন পড়তে পারি কিনা? আরও অনেক কিছু। রেমি আপু আমায় কুরআন পড়া শিখিয়েছিল,কিন্তু নিজের কুরআন শরীফ না থাকায়,তারওপর সারাদিন কাজ করায় অনেক দিন পড়া হয় না।
অবশেষে শুনলাম উনাদের আমাকে পছন্দ হয়েছে।খুব তাড়াতাড়িই বিয়ের তারিখ ঠিক করা হলো।উনাদের বাড়ি থেকে ছয় সাতজন মানুষ আসবেন মাত্র।দুই দিন পরেই তারিখ দেওয়া হলো।আমার বিয়ে যেই মানুষটির সাথে হচ্ছে, মানে আমার স্বামী যিনি তাকে এক পলক দেখেছিলাম আমি।বয়স খুব বেশি না হলেও আবির ভাইয়া, আহির ভাইয়ার থেকে ও বড় হবেন অনায়াসে। লোকটি সারাবছর অন্যের বাড়ি কামলা খাটেন। ফসলি জমিতে কাজ করেন বারোমাস। স্বাস্থ্যবান না হলেও খুব শক্ত সামর্থ্য শরীর। লোকটাকে দেখেই লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিই।কিন্তু উনি কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে।
অবশেষে আজকে আমার এ বাড়ি থেকে যাওয়ার দিন এলো।আজ আমার বিয়ে,অথচ আবির ভাইয়া, আহির ভাইয়া কাউকেই জানানো হয়নি।একটা কাজের লোকের বিয়ে ঠিক যতোটুকু না হলেই নয় সেভাবে ব্যবস্থা করা হলো।তবে এতোদিনে আমি আমার কাজের মাইনে পেয়েছিলাম। আমার বিয়েতে নাকি বরপক্ষকে ত্রিশ হাজার টাকা যৌ*তুক দেওয়া হচ্ছিল। মূলত পায়েল ভাবিই এই কথাটা বারবার এসে এসে আমার কানে তুলছিল,যে আমার জন্য কতোটা করছেন উনারা এটা বোঝাতে। তারমানে এ লোকটিও টাকার বিনিময়ে বিয়ে করছেন আমায়? এতোক্ষণের মনোবল কেমন যেন ঠুনকো হলো আমার।আমার বিয়েটাও এ বাড়ির দয়া নিয়ে হচ্ছে? এমন কেন পৃথিবীর মানুষ! শুধু আমায় কি গ্রহণ করা যেতনা?উনারা কি জানেন না, আমি এতিম।অবশেষে কাজী সাহেব এসে কবুল বলার মধ্যে দিয়ে আমার জীবনের আরেক অধ্যায় শুরু হলো।যতোই হোক,এ বাড়ির প্রতি একটা মায়া পড়ে গেছে। ছোট বেলা থেকেই আছি এখানে, এর চারপাশে আমার ছোঁয়া লেগে আছে।নিজের ছোট্ট চার দেওয়ালের ঘরটা,আবির ভাইয়ার দেওয়া সাদা পাথরের মালার পাথর গুলো।এগুলো কি আর কখনও আমার ছোঁয়া হবে? আর কোনদিন কি এ বাড়িতে পা দিতে পারবো আমি? এই যে ছাদে যেই ফুলের গাছ গুলো,যারা আমার কষ্ট ভাগাভাগির সঙ্গী, ওরা কি আর কোন দিন আমার স্পর্শ পাবে? আর রেমি আপু, আবির ভাইয়া, সোনিয়া ভাবি? উনাদের সাথে কি কখনও দেখা হবে আমার আর? উনারা কি কখনও যাবেন আমার সাথে দেখা করতে? আবির ভাইয়া যখন বাড়ি এসে জানবেন উনার রাবুর বিয়ে হয়ে গেছে, তখন কি করবে ভাইয়া? একটু খানি যাবে?
কেন জানি মনে হচ্ছে এটায় আমার এ বাড়ি থেকে শেষ যাওয়া। আর কখনও হয়তো আসা হবেনা এখানে।খুব কান্না পাচ্ছে, কিন্তু মজার ব্যাপার হলো জড়িয়ে ধরে কাঁদার মতো কেউ নেই আমার। আচ্ছা আমার যেমন এ বাড়ির ইট পাথরের প্রতি মায়া জন্মে গেছে, আর আমি তো জ্যান্ত মানুষ! আমার প্রতি কি এতোটুকু মায়া ও জন্মেনি এবাড়ির মানুষের?
বিদায়ের সময় শুধু খালাম্মা এলেন কাছে।এসে আমার হাত টা উনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন আমায় যেন সুখে রাখেন।এতোটুকুতেই কেমন মায়া মনে হলো আমার,খালাম্মা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদা শুরু করলাম।
অবশেষে বেরিয়ে এলাম ও বাড়ি থেকে,,,,,,
চলবে,,,,,,,,,