বাসি_ফুলের_সুবাস #পর্ব_১২,১৩

0
300

#বাসি_ফুলের_সুবাস
#পর্ব_১২,১৩
#মাসুরা_খাতুন
১২

অবশেষে রাশেদ কে ছেড়েই আমায় স্বামীর ভিটে ছাড়তে হলো।আমার পিছুটান বলতে শুধু আমার ছেলেটায় ছিলো।আর স্বামী? বিয়ের পর থেকে সে মানুষটার যে আচরণ সহ্য করে আসছি তাতে ভালোবাসা বলতে কিছু জন্ম নিয়েছিলো কি না জানিনা।তবে হ্যাঁ,একটা মায়া কাজ করতো সবসময় মানুষ টার প্রতি।যতো যাই হোক,উনি আমার স্বামী ছিলেন, জীবনের প্রথম পুরুষালি ছোঁয়া টা আমি উনার কাছ থেকেই পেয়েছি,কিশোরী বয়সের প্রথম অনূভুতি আমার উনিই ছিলেন, অথচ মানুষটা কতোটা বিপ*দগামী। উনি বা উনারা যেই নোংরা কাজ টা করে যাচ্ছেন তার জন্য পরকালে না জানি কতোটা ভয়া*বহ শা*স্তি অপেক্ষা করছে! অনেক বার চেষ্টা করেছি মানুষ টাকে ঐ পাপ থেকে ফিরিয়ে আনতে।যেহেতু আমি তার স্ত্রী, তাই লজ্জা শরমের বালাই না করে সাজ গোজ করে নিজে থেকেই উনাকে আবেদন করেছি,তাও যাতে আমার স্বামী শুধু আমাতে সন্তুষ্ট থাকুক। জানি হয়তো আমাকে বেহায়া বলবে,কিন্তু আকাশে থাকা ঐ রবের কাছে আমি জবাব দিতে পারবো,হ্যাঁ আমি চেষ্টা করেছিলাম।কিন্তু কথায় আছে , হাজার নারীর সংস্পর্শ পাওয়া পুরুষ কখনও এক নারীতে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না।যাদের মন মানসিকতা বাজে,তাদের ঘরের বউ যদি জান্নাতের হুরের মতো সুন্দরী ও হয়,তবুও ঠিক বাইরের কুৎসিত নারীটার জন্য ও তাদের মনে ছুঁকছুঁক করবে।এদের সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয়। অবশেষে হেরে গেলাম আমি,হেরে গেলো আমার নারীত্ব। আফসোস! ঐ মানুষ টাকে তো পেলামই না,সাথে আমার কলিজার টুকরা আমার রাশেদ টাকেও হারালাম। যে আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।

ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ভাবছিলাম আমি, কোথায় যাবো এখন আমি? কার কাছে যাবো?মানুষের একটা নির্দিষ্ট গন্তব্য থাকে,আমার যে তাও নেই।আবির ভাই! বেচারা নিজেই অসুখি,ভাবি আমাকে সহ্য করতে পারে না। তার মধ্যে আবার আমি গিয়ে উনাদের ঝামেলা বাড়াতে চাই না।আর খালাম্মাদের বাড়িতেই বা যাবো কি করে? বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত উনারা একটা খোঁজ পর্যন্ত কোন দিন নেন নি।কোন মতে বিয়ে টা দিয়ে বড় বাঁচা বেঁচে গেছেন,সেখানে আবার আমি গিয়ে উনাদের বিরক্ত করতে চাই না।আর ওখানে গেলেও আমার পরিচয় হবে আবার ও কাজের লোক,বছর জুড়ে খাটো,বিনিময়ে একটু পেটের ভাত কাপড় পাও।সারাটা জীবন কি আমার এমন ভাবেই কা*টবে? আর এভাবে কা*টলে তো আমি কোনদিন আমার রাশেদ কে কাছে পাবো না।আমার যে করেই হোক নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে,নিজের ছেলের অধিকার নিয়ে সামনে যাওয়ার শক্তি,সাহস জোগাড় করতে হবে। রেমি আপু! রেমি আপু বলে গেছিলো যে কোন দরকারে যেন উনার সাথে যোগাযোগ করি। কিন্তু আপুর সাথে যোগাযোগ করার জন্য আপুর ঠিকানা দরকার। আপু যেই ঠিকানা টা দিয়েছিলো ওটা তো আমি ও বাড়িতেই ফেলে এসেছি। ওটা সাথে নেওয়ার অবস্থা, সুযোগ কোনটায় ছিলো না আমার। এখন আপুর ঠিকানা পেতে হলে আপুর বাবার বাড়িই যেতে হবে আমাকে।চুপিচুপি আমি পা বাড়ালাম আবারও আবির ভাইয়াদের বাড়ির ওদিকে।ভিষণ লজ্জা লাগছিলো,এতোদিন পর এমন পরিস্থিতিতে এ বাড়ির দিকে আসতে।পাড়ার লোকজন দের দেখলেও ভিষণ লজ্জা লাগবে।তাই তো আঁচল টা দিয়ে খুব লম্বা করে ঘোমটা দিলাম,যাতে হুট করে আমায় দেখলেও কেউ চিনতে না পারে।ভয়ে ভয়ে এগোচ্ছিলাম, যেন আবির ভাইয়াদের বাড়ির কারও চোখে না পারি।অনেক টা সকলের অগোচরেই রেমি আপুদের বাড়িতে ঢুকে গেলাম। ততোক্ষণে সকলে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমোতে গেছে। আমি এ বাড়ির ও সকলের ঘর মোটামুটি চিনি। খালাম্মাদের দরজায় কড়া নাড়লাম। ভেতর থেকে দরজায় কে জিজ্ঞেস করলে আমি উত্তর দিলাম আমি রাবু।আমার নাম শুনেই যেন তড়িঘড়ি বেড়িয়ে এলেন খালাম্মা। এতোদিন পরে আমায় এ অবস্থায় দেখে ভিষণ অবাক হলেন। খালাম্মা কে দেখে আমার চোখে আবারও জলে ভরে গেলো।এতোক্ষণ ধরে একটা বুক খুজছিলাম আমি,জীবনের সব থেকে বড় সম্পদ নিজের সন্তান কে রেখে, নিজের সংসার ভেঙে কি করে আমি হেঁটে এতোটা পথ এলাম নিজেই জানি না।কতোটা ঝড় গেছে আমার ওপর দিয়ে তা শুধু আমিই জানি,কিন্তু এতোটা কঠিন পরিস্থিতিতেও আমায় সান্ত্বনা দিয়ে মাথায় হাত রাখার মতো একটা আপনজন ও আমার ছিলো না।এতোক্ষণে পুরনো পরিচিত মানুষ টাকে দেখে আমার ভিষণ আপন মনে হলো।খালাম্মা কে জড়িয়ে খুব কাঁদলাম আমি,বুকের সব ব্যথা উগরে দিয়ে ইচ্ছে মতো কাঁদলাম। আমার কান্নার আগামাথা কিচ্ছু বুঝতে না পেরে খালাম্মা একের পর এক প্রশ্ন করেই গেলেন,

“কি হয়েছে রাবু,বল আমায়? কতোদিন পর এলি,তাও আবার তোর এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে মা, বল আমায়।”

মন হালকা করে কেদে আমি পুরো ঘটনা খুলে বললাম খালাম্মা কে।শুনে উনিও খুব অবাক হয়ে গেলেন।এই পরিস্থিতিতে এতোদিন আমি ছিলাম বলে বারবার আফসোস করতে লাগলেন,

“কতোবার আমার রেমি আবিরের মাকে শহরের ঐ ছেলেটার সাথে তোর বিয়ের কথা বলেছে।ওরা শুনলে তো! আহারে ফুলের মতো মেয়ে টার কি অবস্থা হয়েছে! কতো বাজে ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছে। এরা কি সত্যিই মানুষ! তোদের ভালো লাগে না,তোরা বিয়েই দিবি,তো রেমি বলল ঐ শিক্ষিত চাকরি করা ছেলেটার সাথে দিলে কি হতো? আসলে যেমন শাশুড়ী, তেমন বউ টাও এসেছে বাবা! ”

“থাক না খালাম্মা, ওটা আমার ভাগ্যে লেখা ছিলো।খালি আমার আফসোস, আমার ছেলেটাকে পেলাম না খালাম্মা। রাশেদ টার বয়স কেবলই দুই বছর।ছেলেটা এখনও আমার বুকের দুধ খায়।না জানি এখন কতো কানতেছে।আমি আসার সময় ও মা মা করে কান্না করে।বড় ভাবি জোর করে ওকে ঘরের মধ্যে আট*কে রেখেছে খালাম্মা। ”

“শোন মা,তুই যা বললি তাতে বুঝলাম খলিল ও রাশেদ কে খুব ভালোবাসে।আবার ঐ বেয়াদব মেয়ে টাও খলিলের মন রাখার জন্য রাশেদকে খুব স্নেহ করে।তাই আমার মন বলছে রাশেদের কোন অযত্ন ওরা করবে না। তুই শান্ত হো,মনে পাথর বাঁধ। লড়া*ই করতে শেখ।জানি, মা হয়ে ছেলেকে ছেড়ে থাকা কতোটা কষ্টের।কিন্তু এই মুহুর্তে তোর নিজের জন্য কিছু করতে হবে। তুই ঢাকা যা,ওখানে গিয়ে গার্মেন্টসে কাজ কর।উপার্জন কর,নিজের পায়ে দাঁড়া। ”

“তুমি ঠিকই বলেছো খালাম্মা, আমার নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, আমার কলিজার মানিকের জন্য হলেও আমায় বাঁচতে হবে।সে একদিন ঠিক বুঝবে,তার মায়ের কোন দোষ ছিলো না।তার মা লড়া*য় করেও ওদের সাথে টিকতে পারে নি।সেদিন সে নিজেই ওদের লাথি মে*রে রেখে আমার কাছে চলে আসবে তাই না খালাম্মা? ”

“হ্যাঁ মা হ্যাঁ।তুই মনে হয় সারাদিন কিছু খাসনি।যা গোসল করে নে,গোসল করে খেয়ে নে।”

“আমি খাবো না খালাম্মা। খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না।ওখানে আমার ছেলে আমার জন্য কাঁদছে, চিৎকার করছে এখানে মা হয়ে আমি কি করে খাবো বলতো? আমি কিচ্ছু খাবো না খালাম্মা, তুমি খালি আমায় রেমি আপুর ঠিকানা টা দাও, আমি আজই ঢাকায় চলে যাবো।”

“এখনই বললি নিজের পায়ে দাঁড়াবি, আবার এখনই বলছিস খাবি না।এমন বললে কি করে হবে বলতো রাবু?বেঁচে থাকার জন্য হলেও তোর খেতে হবে , আর তোর ছেলের জন্য হলেও তোর বাঁচতে হবে তো।না খেলে কি করে লড়া*য় করবি বলতো?”

কলপাড়ে গিয়ে গোসল করে নিলাম। খালাম্মা নিজের একটা শাড়ি দিলেন ওটা পড়ে নিলাম আমি।খাবো না বললেও খালাম্মা ছাড়লেন না।দু মুঠো ভাত খেয়ে নিজের জীবন রক্ষা করলাম। তারপর খালাম্মা আমার হাতে পায়ের দাগ গুলো দেখে একটা ব্যথার ঔষুধ ও দিলেন খাওয়ার জন্য। তারপর বললেন আজ এই শরীরে আর নয়,আগামীকাল সকাল বেলায় ট্রেনে আমি রেমি আপুর বাসায় যাবো।এর মধ্যে রেমি আপু একবার ফোন করেছিলো খালাম্মার কাছে,উনার মুখে সবটা শুনে আপুও বলল আমাকে উনার কাছে পাঠাতে। খালাম্মা আমায় ঘুমাতে বলে বাইরে এলেন,রেমি আপুর ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম আমি। বিকেল ভর আর বাইরে যাই নি।ভিষণ কান্না পাচ্ছে আমার,জানি না আমার রাশেদ এখন কি করছে।এখনও কি মা মা বলে কাঁদছে? বড় ভাবি কি ওর কান্না দেখে বিরক্ত হয়ে খুব বকা দিচ্ছে ওকে? গায়ে হাত তুলছে না তো? ছেলেটা কে আমার খেতে দিচ্ছে তো? বালিশ টা জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলাম আমি,চোখ দুটো আমার লাল টকটকে হয়ে ফুলে গেছে । খুব করে ইচ্ছে করছে একবার দৌড়ে গিয়ে ছেলেটাকে দেখে আসি,একটু খানি জড়িয়ে ধরে চুৃুমু দিয়ে ভরিয়ে আসি ওর গাল।সেও আধো আধো বুলিতে আমায় মা মা বলে ডাকবে।কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে গেছি।

হটাৎ স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় আমার।স্বপ্ন গুলোও যেন কেমন নি*ষ্ঠুর হয়ে গেছে। আমায় কষ্ট দিতে যেন ওদের ও আনন্দ।

স্বপ্নে দেখি আমার রাশেদ খেলছে,আমি কোলে নিয়ে ওকে নিয়ে খেলছি।হটাৎ একটা জোরে ঝড় এলো,আমার কোল থেকে ছিটকে পড়লো রাশেদ। দমকা বাতাস রাশেদকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমার কাছ থেকে। আমি দৌড়াচ্ছি পিছু পিছু, কিন্তু ধরতে পারছি না আমার ছেলেটাকে।রাশেদ শুধু অনবরত মা মা করেই যাচ্ছে।

ঘুম থেকে উঠেই ভিষণ কাঁপুনি এলো আমার।খেয়াল করলাম ভিষন জ্বর এসেছে। জ্বরের ঘোরে কাঁদলাম আমি,কিন্তু চোখ গুলোও যেন আগুন হয়েছে। সারাদিন থেকে কেঁদে কেঁদে ফুলে ওঠা চোখ গুলো একদম লাল টকটকে হয়ে গেছে, সেই সাথে প্রচন্ড জ্বর আসায় জ্ব*লে যাচ্ছে চোখের ভেতর টা।

সন্ধ্যার দিকে রাতের খাবার জন্য ডাকতে খালাম্মা আসলেন।এসেই আমার অবস্থা দেখে উনি ভিষণ ভয় পেয়ে গেলেন।ডাক দিয়ে আমায় তুলে জ্বরের বড়ি খাইয়ে দিলেন।মাথায় কিছু ক্ষণ পানিও দিয়ে দিলেন মানুষ টি।

আসলে আগে থেকেই রেমি আপুর মা খালাম্মা আমায় স্নেহ করতেন।কিন্তু খালাম্মার ভয়ে কিছু বলতে পারতেন না।লুকিয়ে চুরিয়ে যতোটুক পেরেছেন এটা ওটা খেতে দিয়েছেন আমায়।কিন্তু নিজের বড় ভাসুর, জায়ের মুখের ওপর কিছু বলার সাহস উনার ছিলো না।

সকাল বেলা উঠেই খালাম্মা আমায় খাবার খেতে বললেন। সেই সাথে আটটায় ট্রেন আমায় তাড়াতাড়ি প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে বললেন।

আমিও বলে দিলাম যে আজ আমি সত্যিই যাবো,যাবো নিজের জীবনের আরেক অজানা গন্তব্যের দিকে। যেখানে জানি না আমার ভবিষ্যতে কি লেখা আছে, ,,,

চলবে,,,,,,

#বাসি_ফুলের_সুবাস

#পর্ব_১৩

#মাসুরা_খাতুন

সকাল আটটার ট্রেনে করে ঢাকায় এলাম আমি। জীবনের প্রথম বার একা একা এতোটা দূরে আসা আমার।একা একা একটু ভয় ভয় ও করছিলো,কিন্তু তার থেকেও বেশি ছিলো আমার মনে সন্তান হারানোর বিষাদ! তাই তো ভয়, জড়তা কোনটাই বেশি মনে হয় নি। আমার শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে আজ আমি অসহায় বলে,আমার পরিচয় নেই বলে, নিজের সন্তান কে কাছে নিতে পারলো না।ওরা তো ভালোই থাকবে,কিন্তু আমার রাশেদ মা হারা হলো।ট্রেনে উঠার আগে একবার মনে হয়েছিল গিয়ে শেষ বারের মতো একবার রাশেদ কে দেখে আসি,ছেলেটাকে আমার একটু খানি বুকের মধ্যে নিয়ে শেষ বারের মতো মায়ের দুধ খাইয়ে আসি।চোখ মুখ ভরে কয়েকটা চুৃুমু খেয়ে নিজের মাতৃত্ব অনুভব করে আসি,কিন্তু পারিনি। কি করে কালকেই তাড়িয়ে দিয়েছে, ওখানেই আজ আমি যাবো? আজকে আবার যদি লোকজন ডেকে অপমান করে বের করে দেয়,শেষ বারের মতো ছেলেটা কে আমার দেখতে না দেয়! তাহলে আজ আবারও যে গতকাল কের মতো কাঁদবে রাশেদ! আর তা যে আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারবো না! তারচেয়ে বরং ও মাকে ভুলেই থাকুক,ও আমার নাড়ী ছেঁড়া ধন! একদিন ঠিক বুঝবে,কেন মা ওকে ছেড়ে এসেছিলো। সেদিন আমার রাশেদ কে চাইলেও ওরা আটকাতে পারবে না।ও ঠিক আমার কাছে ছুটে আসবে।

কমলাপুর রেলস্টেশনে নামলাম আমি,ট্রেন থেকে নেমেই চমকে গেলাম, এতো মানুষ! কোন দিকে যাবো আমি? কাকে জিগ্যেস করবো? সারাজীবন বাড়ির কোণেই কা*টিয়ে দেওয়া জীবন আমার,এতো লোকজন, এতো গাড়ি কোনটাই তো আগে দেখিনি আমি! ব্যাগ টা হাতে নিয়ে ভাবছিলাম কোন দিকে যাবো, আর কাকে প্রশ্ন করবো।এমন সময় এক পরিচিত কণ্ঠস্বর কানে এলো আমার।কে যেন আমার নাম ধরে রাবু রাবু বলে ডাকছে।পেছন ফিরে দেখি ভির ঠেলে এগিয়ে আসছে রেমি আপু। এতোক্ষণে যেন আমার স্বস্তি মিলল! চির পরিচিত প্রিয় মুখ টা দেখে অনেক টা সাহস এলো আমার। কাছাকাছি আসতেই রেমি আপু কে জড়িয়ে ধরলাম আমি।অনেক টা ভরসায়,আনন্দে, প্রিয় মানুষ কে কাছে পেয়ে দুচোখ ভরে জল এলো আমার। অনেক টা কেঁদে দিলাম আমি, কিন্তু রেমি আপু বরাবরের মতোই শক্ত, সাহসী।আমায় ভরসা দিয়ে বললেন,

“আর কাঁদতে হবে না তোকে,অনেক কেঁদেছিস।জীবনে এখনও অনেক কিছু বাকী রাবু।তুই শক্ত হো,আর চোখের পানি মুছে ফেল।”

আপুর একটা কথায় যেন অনেক টা সাহস পেলাম আমি “জীবনে অনেক কিছু করা বাকী,শক্ত হো,আর চোখের পানি মুছে ফেল।” হ্যাঁ,আমি শক্ত হবো। আর কাঁদবো না আমি,আর কখ্খনো কাঁদব না।ওখানে আর দেরী না করে আপুর সাথে গাড়ি করে আপুর বাসায় এলাম। খুব একটা বিশাল বড় না হলেও খুব সুন্দর গোছানো একটা বাসা।ভাইয়া সম্ভবত অফিসে গেছে। বাসায় গিয়েই রেমি আপু আমায় গোসল করতে বলে খাবার রেডি করলেন।পুরনো কথা আর কিচ্ছু টি উনি শুনতে চাইলেন না।খাওয়া দাওয়া শেষে আপু আর আমি বসলাম। রাশেদের ব্যাপারে উনিও দুঃখ প্রকাশ করলেন। ছেলেটার কথা মনে পড়তেই দু চোখ ভেঙে কান্না এলো আমার। আপু আর কথা না বাড়িয়ে আমায় কাঁদতে দিলেন। একা ঘরের মধ্যে খুব কাঁদলাম আমি। যতোই বলি আর কাঁদব না,কিন্তু আমি যে মা! কোলের ছেলেটাকে রেখে এসে কান্না কি করে আটকাবো আমি?উনার সামনে না হয় বড় ভাবি রাশেদ কে খুব আদর দেখাবেন, কিন্তু উনি যখন কাজে যাবেন তখন! তখন রাশেদ আমার কথা বলে কাঁদলে কি বড় ভাবি খুব বকা দেবে? গায়েও হাত তুলতে পারে ছেলেটার।আমি কতোটা অসহায় মা!

টানা দুই দিন আমার এভাবেই কাটলো,আপু ও খুব একটা বাঁধা দিলেন না আমার কান্নায়।তারপর দুই তিন দিন পর সন্ধ্যায় আপু আমাকে নিয়ে বের হলেন,আপুর বাসা থেকে খুব একটা দূরে নয়।পাঁচ মিনিটের রাস্তা গেলেই একটা সুন্দর পার্কে আপু আমায় নিয়ে গেলেন। এতো সুন্দর জায়গা আমি এর আগে জীবনে ও কখনো দেখিনি। একপাশ বাচ্চারা খেলা করছে,আবার অনেক বয়ষ্ক মানুষ রাও মনে হয় বিকালের হাটাহাটি শেষে বাড়ই ফিরছেন।অনেক অল্প বয়সী তরুণ তরুণী ও আছে নিজেদের মতো মত্ত। এদের দিকে তাকালে সত্যিই আফসোস হয়,কি জীবন আমার! আর এদের কতো উজ্জ্বল! কোন কষ্ট, কোন না পাওয়া, যন্ত্র*ণা যেন এদের ছুঁতেই পারে না। একমনে এসবই দেখে যাচ্ছিলাম আমি। এখানে কতো মেয়ে বেশির ভাগই বয়সে আমার থেকে বড় হবে,অথচ ওরা এখনও বিয়েই করে নি।কলেজ,বন্ধুবান্ধব নিয়ে সময় কাটাচ্ছে।অথচ আমি? বিশ বছর বয়সেই একটা দু বছর বয়সী সন্তানের মা,তিন বছর সংসার করা একজন তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী! জীবন সত্যিই বড্ড রহস্যময়, নিয়তি হলো আরও বড় খেলোয়াড়। কখন কার সাথে কি খেলা খেলে তার কোন ইয়াত্তা নেই।

“কি দেখছিস তো,তোর জীবনে এখনও কতো কিছু বাকী? কতোটুকু বয়স হয়েছে তোর,আর এই বয়সেই হেরে নিজেকে হেরু বানিয়ে বসে আছিস।দেখ,এইসব মেয়েদের দখ,এরা বয়সে তোর থেকে অনেক বড়।অথচ বন্ধুবান্ধব,আড্ডা, পড়াশোনা নিয়ে সময় কাটাচ্ছে,আর তুই? জীবনে একটা দূর্ঘ*টনার জন্য পুরো জীবন টায় বৃথা মনে করছিস।”

“এদের জীবন আর আমার জীবন যে এক নয় আপু,এরা কতোটা হাসিখুশি, এদের কোন কষ্ট নেই কিন্তু আমার যে আলাদা! আমার জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে কষ্ট দিয়েই লেখা।”

“কে বলেছে তোকে,এদের কোন কষ্ট নেই? জানিস,এদের মধ্যে অনেকেই নিজে ইনকাম করে পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছে। আবার কেউ বা বিভিন্ন ভাবে ইনকাম করে নিজের পরিবারেই খরচ চালাচ্ছে। অনলাইনে কতো কাজ করা যায় এখন জানিস?কত টাকা ইনকাম করা যায়। কিন্তু তারপর ও তারা,দিনশেষে নাম নিজেদের জীবন উপভোগ করছে।”

“কি বলছো আপু? এদের ও দুঃখ আছে? এদের ও আমার মতো কাঁদতে হয়?”

“দুঃখ সবারই থাকে রাবু,কঁাদে সবাই ই।কিন্তু হয়তো প্রত্যেকের দুঃখ গুলো আলাদা,প্রত্যেকের কান্নার কারণ ও ভিন্ন। প্রত্যেকের প্রকাশ ভঙ্গি ও আলাদা।কেউ বা কষ্ট পেয়ে বুক উজাড় করে হাউমাউ করে কাঁদে, আবার কেউ বা আকাশসম দুঃখ বুকে চাপা রেখে গুমরে গুমরে ম*রে।চাপা নিশ্বাস ছাড়া আর প্রকাশ করতে পারে না। ”

“তোমার কথাগুলো বড্ড কঠিন আপু।তবে এতোটুকু বুঝেছি সবাই যে হাসিখুশি চেহারা সবার সামনে প্রকাশ করে, ভেতরে ভেতরে পুরোটায় ভিন্ন। প্রত্যেকেরই একটা করে কষ্টের গল্প থাকে,থাকে না পাওয়ার কিছু কথা।কিছু ওপরের এই হাসিখুশি চেহারা টা,এটা অনেকটায় লোক দেখানো। মেকি।তাই না আপু?”

“হ্যাঁ রে,তুই ঠিকই বুঝেছিস।তাই তো নিজের কষ্ট টা নিয়ে ভেঙে না পড়ে,তোর পাশেই আরেকজনের দিকে তাকিয়ে দেখ,সে হয় তো তোর থেকে বেশি ব্যথায় পু*ড়ছে।সেখান থেকেও শিক্ষা নে,বেঁচে থাকার শিক্ষা। ”

“আমি বুঝেছি আপু।কিন্তু আমার একটা চাওয়া ছিলো তোমার কাছে, রাখবে তো?”

“হ্যাঁ বল।”

“তুমি তো আগে কতো গল্প, কবিতা কতো কিছু লেখতে,আমায় শুনাতে,তেমন করে একটা গল্প লেখবে? একটা দুঃখী মেয়ের জীবনের গল্প। যার জীবনের পুরোটায় না পাওয়াতে ভরা।পরিচয়হীন এক অনাথ মেয়ের গল্প! সন্তানহারা,সংসারহারা এক ব্যর্থ নারীর গল্প! লিখবে তো আপু? যেটা সবাই পড়বে,সবাই জানবে তার দীর্ঘ নিশ্বাসের কারণ।”

“রাবু! ”

“হ্যাঁ আপু,এই আমার জীবনের একটা গল্প লিখে দেবে তুমি? ”

“অনেক দিন লিখি নারে।তবে অবশ্যই আমি কাউকে দিয়ে তোর জীবনের গল্প টা লিখিয়ে নেব,তবে সেটা এখনই না।যখন গল্পের নায়িকা রাবুর জীবনের দুঃখ গুলো মুছে গিয়ে সুখের দেখা মিলবে তখন।যখন নায়িকা রাবু ব্যর্থটা কা*টিয়ে সফলতার চূড়োয় আরোহণ করবে তখন।যাতে,তখন সবাই গল্প টা পড়ে শেষাংশে গিয়ে রাবুকে বাহবা দিতে পারে। গল্প টা পড়ে সবাই চোখের পানি মুছে নয়,বরং ঠোঁটে এক চিলতে প্রাপ্তির হাসি নিয়ে রাবুর মতোই ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে উঠতে পারে। বুঝলি?তখন ঠিক কোন এক লেখক কে দিয়ে আমাদের রাবুর কাহিনী টা আমি লিখিয়ে নেব,আর সেটা বই করে উপহার হিসেবে দেব আমাদের রাবুকে।তখন কিন্তু সামান্য ক্রেডিট এই রেমি আপু কেও দিস,বুঝলি?”

“আমি কি সত্যিই পারবো আপু? ”

“অবশ্যই পারবি।”

“তাহলে আমায় আর বসিয়ে রেখো না,তাড়াতাড়ি আমার জন্য কাজের ব্যবস্থা কর।আমি কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকতে চাই।”

“আমি তোর ভাইয়ার সাথে কথা বলেছি।এখন প্রশ্ন হলো,যেহেতু তোর কোন একাডেমি সার্টিফিকেট নেই,তাই তো ভালো কোন কোম্পানি তেও জব মিলবে না।আর তোর ভাইয়ার অফিসে ও আপাতত অল্প পড়াশোনার কোন পোস্ট ফাঁকা নেই। তোকে যদি গার্মেন্টস সেক্টরে কোথাও লাগিয়ে দেওয়া যায়, তুই কি পারবি? সাথে একটা স্কুলে ও নাইনে ভর্তি করিয়ে দিলাম।”

“হ্যাঁ আপু,আমি পারবো।তুমি শুধু ব্যবস্থা করো,সম্মানের সাথে যেকোনো কাজই আমি করতে পারবো।আর আমি পড়াশোনা ও করতে চাই।”

“আচ্ছা আমি তাহলে তোর ভাইয়াকে বলছি,ওর এক বন্ধুর গার্মেন্টসে কাজ ঠিক করা যায় নাকি।তুই শুধু সাহস হারাস না।”

“তোমাদের ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবো না আপু।”

“আরে পারবি পারবি,প্রথম মাসের বেতন পেলেই আমার তেনাদের জন্য একটু বিরিয়ানির ব্যবস্থা করিস, তাহলেই হবে।তেনারা আবার একটু ভালোমন্দ খেতে পছন্দ করেন কিনা!”

“তুমি এখন ও ভালো হলে না আপু।সেই আগের মতোই আছো।”

“হাহাহা,,,আরেকজন থাকলে আমাদের আড্ডা টা ভালো জমতো, তাই না রে রাবু? ”

“তা জমতো।কিন্তু সেও হয় তো ভালো নেই আপু”

“কেন বলতো? ”

“পৃথিবীর দুই মেরুর দুটি মানুষ এক জায়গায় কখনও ভালো থাকতে পারে না আপু। পায়েল ভাবি কক্ষনো ভাইয়ার মতো ভালো মানুষের কদর করতে পারবে না আপু।সে কখনও বুঝবেই না ভাইয়া কে।”

“কি পায়েল এমন কেন? কেন ওরা মানিয়ে নিতে পারছে না?”

“জানি না আপু।কিছু কিছু মানুষ হিরে পেয়ে ও কাচ ভেবে অযত্ন করে।তাই তো ভাবি আবির ভাইয়ার মতো ভালো মনের মানুষ কে অবহেলা করে কষ্ট দেয়।”

“চল ঘরে ফিরি।সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো।”

“আচ্ছা আপু।চলো।”

জীবনের আরেক টা নতুন পণ নিয়ে ঘরে ফিরলাম আমি,আর তা হলো প্রাণ র*ক্ষা করে বেঁচে থাকা নয়,হাসিখুশি ভাবে বেঁচে থাকা,নিজের জন্য বেঁচে থাকা।নিজের সন্তানের জন্য ভবিষ্যৎ গড়ার বেঁচে থাকা।,,,,

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here