#বাসি_ফুলের_সুবাস
#পর্ব_১৪,১৫
#মাসুরা_খাতুন
১৪
সময় নদীর স্রোতের মতোই বহমান। জীবন ও সময়ের মতোই গতিশীল।জীবনে সুখ হোক আর দুঃখ , সে কিন্তু তেমন ভাবেই বয়ে যাবে।আজ সুখ বলে কিছু সময় আটকে রেখে,জীবন টা ওখানেই ঐ সুখের মুহুর্তেই কা*টিয়ে দেওয়া যাবেনা।ঠিক তেমনই দুঃখের সময় টাকে ও ডিলিট বাটনে স্প্রেস করে জীবনের পাতা থেকে বাদ দেওয়া যায় না।সবকিছু নিয়েই আমাদের জীবন।
গত দুই মাস থেকে আমি গার্মেন্টস এ কাজ করছি।একটা স্কুলে ও ক্লাস এইটে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে আপু,যেহেতু আমার একাডেমিক কোন সার্টিফিকেট নেই, তাই এইটের বেশী উপরের ক্লাসে ভর্তি করানো যায় নি।বিশ বছর বয়সে এইটের ছাত্রী! বিষয় টা একটু হাস্যকর না? কিন্তু সবার জন্য হাস্যকর হলেও আমার জন্য তা পরম আনন্দের, পরম পাওয়ার। জীবনের অনেক বড় স্বপ্ন আমিও শিক্ষিত হবো,বড় বড় বই পড়বো।ভালো কোন কাজ ও পাওয়া যাচ্ছিল না আমার জন্য, পরে রেমি আপুর বর মানে সোহেল ভাইয়ার এক বন্ধুর গার্মেন্টসে আমায় চাকরী দেওয়া হয়।ভাইয়া সুপারিশ করেছিলেন আমার জন্য। তারপর থেকে দুইমাস হয়ে গেলো আমি গার্মেন্টসে কাজ করছি।প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হলেও এখন অনেক টা মানিয়ে নিয়েছি।যতো কষ্টই হোক না কেন,তারপরেও একটা আনন্দ আছে, আর তা হলো নিজে কিছু উপার্জন করার আনন্দ! নিজের উপার্জন করা টাকায় শাকভাত খেয়ে হলেও স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকার আনন্দ! সারাদিন কাজ করে এসে একটু খানি রান্না করে কারো কোন বাঁকা কথা ছাড়াই ওটা খেয়ে নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে পড়ার আনন্দ। হ্যাঁ,আজ আমার নিজের একটা ঘর হয়েছে। হোক সেটা ভাড়ায়,কিন্তু এই ঘরের পুরো আধিপত্য আমার,এই ঘরে আমার একটা সংসার,সেই সংসারে আমিই সব! তবে এখানে যদি আমার রাশেদ কে আনতে পারতাম, তবে আমরা মা ছেলে মিলে খুব আনন্দে থাকতে পারতাম। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়, আমি সারাদিন কাজে থাকি,এখানে আনলে ছেলেটা আমার থাকতো কার কাছে সারাদিন। আমার ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে আটটা নয়টা বাজে,আমার দু বছরের ছোট্ট রাশেদ কি করে থাকতো মা ছাড়া,কাউকে ছাড়া এতোক্ষণ? আর আমি কাজে না গেলেও বা ছেলেটালে নিয়ে থাকতাম কোথায়? খেতাম কি? কতোদিন আর রেমি আপুর বাসায় থেকে থেকে খেতাম? তার থেকে ছেলেটা আমার ওখানে আছে,ওটায় ভালো আছে।আমি যে সত্যিই অক্ষম, ব্যর্থ মা! ওখানে তাও পুতুল আছে,ও ওর ভাইকে সত্যিই ভালোবাসে। আমার ননদ আছেন,উনিও রাশেদ কে খুব ভালোবাসেন।আমার ও বাড়িতে থেকে চলে আসার দিন উনি খবর পেয়েছিলেন অনেক টা দেরিতে, উনি আসতে আসতে সবকিছু শেষ হয়ে গেছিল।ততোক্ষণে আমি খলিলের বউ থেকে বাদ গিয়ে শুধু রাশেদের মা হয়ে গেছিলাম। উনি এসে কেঁদেছিলেন,ভাইকে অনেক বকেছিলেন,বড়ভাবি কেও অনেক বাজে বাজে কথা শুনিয়েছিলেন।কিন্তু আর তো কিছু করার ছিলো না।আমি চলে এসেছিলাম।উনি নিশ্চয়ই আমার রাশেদ কে দেখাশোনা করেন।আর তারপরে ও ঐ লোকটি,রাশেদের বাবা! তিনিও রাশেদ কে ভালোবাসতেন।ছেলেটায় উনার সব, চোখের মণি ছিলো।কিন্তু ছেলের জন্ম দেওয়া মা টা উনার কাছে বড্ড অবহেলার ছিলো।আমি যেন ছিলাম একটা ছেলে সন্তান জন্ম দেওয়ার মেশিন। জন্ম দেওয়া শেষ, ব্যস আমার আর দরকার নেই। সব কিছু মিলিয়ে এখন আমার মনে হচ্ছে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। ওখানে অবহেলায়,অপমানে পঁচার চাইতে এখানে নিজে সারাদিন পরিশ্রম করে টাকা রোজগার করে দু বেলা দুমুঠো ভাত খাওয়াটাও সম্মানের।এ সমাজ ডিভোর্সিদের খারাপ বলে,ছোট করে,অপয়ার তকমা দেয়,কিন্তু যখন একটা মেয়ে দিনের পর দিন লা*ঞ্ছিত হয়,শরীরে বেদম প্রহার সহ্য করে তখন এ সমাজ কোথায় থাকে? তখন সমাজ বলে মানিয়ে নাও,মানিয়ে নাও।কিন্তু এ মানিয়ে নেওয়াটাই কি যথেষ্ট, একটা নারীর ভালো থাকার জন্য? সব সময় মানিয়ে নিলেই কি সব কিছুর সমাধান হয়? শরীরে যে আঘাত গুলো পড়ে,গায়ের ওপরে কখনও লাঠি,কখনও ঝাটা, কখনও বেল্টের এমনকি স্যান্ডেলের আঘা*,তের যে কালো কালসিটে দাগ পড়ে তা কি মানিয়ে নিলেই উঠে যায়? নাকি ওই দাগ গুলোর ব্যথা দূর হয়ে যায়? না, যায় না।বরং ঐ দাগ না শুকাতেই আবারও আরো দাগ দেওয়ার জন্য জায়গা তৈরি হয়ে যায়। শোসকের জন্য আরও একটা উপায় বের হয়ে যায় দাগ বসানোর। কখনও সখনও মানিয়ে নিলেও ভালো থাকা যায়,তবে সেটা মাত্রার মধ্যে, কারণ মাত্রাততিরিক্ত কোন টায় ভালো না।না মানিয়ে নেওয়া, না সহ্য করা,আর না প্রহার করা।
আমি চাকরি পাওয়ার কয়েকদিন পরই রেমি আপুর বাসা থেকে চলে এসেছি। যদি ও উনারা আমায় চলে আসতে বলেন নি।এমনকি রেমি আপু চেয়েছিলেন আমি আর কিছু দিন ওখানেই থাকি,কিন্তু কারও ওপর বোঝা হয়ে কতোদিনই বা থাকতাম? উনারা ভদ্রতার খাতিরে যতোই থাকতে বলুন না কেন,তাই বলে একজনের বাসায় এতোদিন থাকা উচিত নয়।এতে আমার আত্মসম্মানে বাঁধে। তাই তো আমার সাথেই কাজ করে রাফিয়া নামের একটি মেয়ের সাথে আমার খুব ভালো পরিচয় হয়।আর ওর রুমের সাথে একটা রুম ফাঁকা আছে বলে জানায়।আমিও ঐ ঘরটা ভাড়া নিয়ে রেমি আপু কে বলে ঐ ঘরে চলে যায়। তারপর থেকে আমি ওখানেই থাকছি,এমনিতেও রেমি আপুদের কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ, তাতে আরও দিন থেকে আমি ঋণের বোঝা বাড়াতে চাই না।
এখানে আমার দিন ভালোই যেতে লাগলো।এখানকার আমার ঘরের আশেপাশের প্রায় সব ঘরের মেয়েরাই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। প্রতয়েকেরই একই রুটিন,রোজ সকালে রান্না করে খেয়ে দুপুরের নামে বক্সে করে নিয়ে নিজ কর্মসংস্থানে ছোটা।আমি বেশির ভাগ সময় ফজরের আগেই উঠি,তারপর পড়তে বসি।ভোর পর্যন্ত পড়ে তখন রান্না করি।যেহেতু ক্লাসে যেতে পারিনা তাই চেষ্টা করি প্রতিদিনই পড়তে বসার।
এভাবেই মাস ছয়েক কে*টে গেলো।আমি মাঝে মাঝে শুক্রবারে রেমি আপুর বাসায় যাই।আপু ও এখন চাকরি করে।একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে বাচ্চাদের পড়ায়। সব কিছু মিলিয়ে ভালোই যেতে লাগলো দিন।মাঝে মাঝে রাশেদের কথা মনে করে খুব কাঁদি,খুব ইচ্ছে হয় ছেলেটাকে একবার দেখতে,একবার বুকে জড়িয়ে আদর করতে।একবার ওর মুখ থেকে মা ডাক শুনতে।এতোদিন আমার রাশেদ হয় তো অনেক টায় বড় হয়ে গেছে।
এর মাঝে আমার একজনের সাথে পরিচয় হয়।ছেলেটা রাস্তায় একটা ছোট খাটো মুদি দোকান করে।আমি রোজ যে রাস্তা টা দিয়ে যাওয়া আসা করি ওখানেই ওর দোকান। দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ই রোজ মনে হয় কে যেন আমায় দেখছে,কারো দুটো চোখ যে নির্লিপ্ত ভাবে আমার দিকে চেয়ে থাকে তা আমি বুঝতে পারি।একটি অস্বস্তি ও হয় আমার ঐ রাস্তা টুকু পার হতে।কোন কিছু না বোঝার ভান করে ছেলেটার তাকিয়ে থাকা দেখেও না দেখার ভান করে আমি চলে যাই,কারণ এসব চোখাচোখি প্রণয় আমার জন্য না।কিন্তু আমি যতোই এড়িয়ে যাই না কেন একদিন ঠিক ছেলেটার সামনে পড়তে হয়।মাথা নীচু করে যাওয়ার সময় হুট করে সামনে তাকিয়ে দেখি দোকানের ছেলেটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অন্তরাত্তা কেঁ*পে ওঠে আমার! শুনেছি, ঢাকা শহরে বেশির ভাগ ছেলেরাই নাকি ভিষণ বাজে হয়। ভয়ে খানিকটা পিছিয়ে এলাম আমি,ছেলেটা একদৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে আমার মুখপানে। বয়স সাতাশ কি আটাশ হবে।দেখতে ও গায়ের রং যথেষ্ট উজ্জ্বল আর যথাসম্ভব সুন্দর। পোশাক পরিচ্ছদ ও মার্জিত,রুচিশীল। কিন্তু তারপর ও আমার খুব ভয় করছে!
“আআমার রাস্তা ছাড়ুন,দেখুন আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। ”
“আমি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই,”
“কিকিন্তু আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই না।দয়া করে আমার রাস্তা ছাড়ুন। ”
“দেখুন আপনি মনে হয় ভয় পাচ্ছেন,কিন্তু আপনি এতো ভয় পাবেন না প্লিজ একটু ফ্রী হোন,আর আমার কিছু কথা শুনুন।”
ছেলেটা খুব শান্ত মেজাজে আমায় বোঝাতে লাগলেন যে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু আমি গ্রামের মেয়ে, ভাগ্যের সন্ধানে এ শহরে আসলেও এখনও এতোটাও আধুনিক হতে পারিনি যে মাঝরাস্তায় একটা অপরিচিত ছেলের সাথে নিঃসংকোচে কথা বলবো।
“দেখুন এই মুদি দোকান টা আমার,আমি কিছু দিন ধরেই লক্ষ্য করছি আপনি এ রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছেন।বিশ্বাস করুন,এ শহরে আমি এই রাস্তা দিয়ে অনেক মেয়েকেই যাতায়াত করতে দেখি,কিন্তু সেভাবে কাউকে কখনও ভালো লাগে নি।অনেকে দেখতে অনেক সুন্দর, কিন্তু তাদের চরিত্র আমার কাছে সুন্দর মনে হয় না।কিন্তু কিছু দিন ধরে লক্ষ্য করে দেখছি আপনি যেন সবার থেকে আলাদা! সত্যি বলতে আমার আপনাকে ভালো লাগে, আপনার লাজুকতা কে ভালো লাগে, আপনার শালীনতা আমায় বড্ড টানে।তাই তো আজ সাহস নিয়ে বলতে এলাম।এবার আপনি কিছু বলুন,প্রয়োজন হলে সময় নিন,আমরা কি আমাদের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি পারি?”
“দেখুন আপনি যা ভাবছেন,বা বলছেন তা একেবারেই সম্ভব না।দয়া করে আমায় যেতে দিন,আর আমার সামনে হুটহাট আসবেন না।”
“কিন্তু কেন? কেন আপনার এতো অনীহা? আমি কি সত্যিই এতোটা বিরক্তিকর? আমি কবীর। সমাজ বিজ্ঞানে অনার্স কমপ্লিট করেছি। চারদিকে চাকরির যেই বাজার, তা দেখে রাগ করে আর মাস্টার্স টা করিনি। এখন এই ছোট খাটো একটা মুূদি দোকান করেছি।বাড়িতে আমার বড় ভাই,ভাবি আছেন।বাবা মা অনেক আগেই মা*রা গেছেন।সবটায় বললাম, এবার আপনার ব্যাপার,আপনি ভাবুন আমায় একটা সুযোগ দেবেন কি না।আমি কিন্তু সত্যিই আপনার প্রতি দূর্বল ফিল করি,ভালোলাগে আপনাকে আমার।”
একনিশ্বাসে ছেলেটি নিজের সম্পর্কে বলে সুন্দর একটা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে, কিন্তু আমি যে উত্তর টা দিলাম তাতে ওর ঠিক কি প্রতিক্রিয়া হবে এটায় দেখার,
“আপনি বলছেন আপনি অনার্স পাস,কিন্তু আপনি কি জানেন আমি সবে এইটে ভর্তি হয়েছি।শিক্ষাগত যোগ্যতা আমার শুন্য।আপনি কি জানেন আমার তিন বছরের একটা সংসার ছিলো,এবং সেই সংসারের একটা আড়াই বছরের ছেলেও আছে।আর পরিচয় দেওয়ার মতো তেমন কোন পরিচয় ও আমার নেই। ছোট বেলা থেকেই পরের বাড়িতে মানুষ আমি।তাই তো বলছি আপনি দয়া করে আমার থেকে দূরে থাকুন,আর আপনি যা বলছেন তা সম্ভব নয়।কারণ আমিই আপনার যোগ্য নই।”
আমার উত্তর শুনে ছেলেটা মনে হয় থমকায়,ভিষণ ভাবে থমকায়।অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়।
“তিন বছরের সংসার ছিলো মানে? “,,,
চলবে,,,,,,,
#বাসি_ফুলের_সুবাস
#পর্ব_১৫
#মাসুরা_খাতুন
“তোমার তিন বছরের সংসার ছিলো মানে? ”
“হ্যাঁ ছিলো।আমার একটা আড়াই বছরের ছেলেও আছে। আর আমি পরিচয়হীন। কে বাবা, কে মা কিছুই জানি না আমি। আর আমি, আমি তো এটাও জানি না আমি হিন্দু নাকি মুসলিম! আমি আসলে হিন্দুর ঘরের সন্তান, নাকি মুসলমানের ঘরের,তার কিছুই জানি না। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি ঠিক কতোটা অযোগ্য। এখন নিশ্চয়ই চাইবেন না,একটা ডিভোর্সি, এক সন্তানের মা একটা মেয়ে কে বিয়ে করতে! আপনার পরিবার নিশ্চয়ই চাইবে না একটা পরিচয়হীন মেয়ে কে ঘরের বউ করতে! আর সবথেকে বড় কথা,আমি নিজেও চাইনা দ্বিতীয় বার কোন সম্পর্কে জড়াতে।আমি আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ তৈরী করতে চাই, বড় হয়ে যেন আমার সন্তান কেও আমার মতো অসহায় হতে না হয় সেটা নিশ্চিত করতে চাই।আর তাই দয়া করে অযথা আমায় বিরক্ত করবেন না।”
এতোক্ষণ মনে হয় ছেলেটি গভীর মনোযোগে আমার কথা শুনল,তার চোখে মুখে ও খানিকটা আশ্চর্যের ছাপ।এবার সে নিজের মতামত জানালো,
“হুম।এতোক্ষণ আপনি যা বললেন আমি শুনলাম। আমি সত্যিই বিস্মিত, একটা মেয়ের জীবনের এতো গল্প, এতো লুকনো ব্যথা থাকতে পারে। এতো কিছুর পরেও আপনি যেভাবে নিজের সন্তানের জন্য ভবিষ্যৎ তৈরীর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন,যেভাবে মনোবল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমি স্যালুট জানাই আপনাকে! কিন্তু এবার আমার মতামত শুনুন, জন্ম হোক যথা,তথা কর্ম হোক ভালো।আপনি যে ঘরেই জন্ম নিন না কেন,আপনার এ বোরকার লেবাস বলছে বর্তমানে আপনি একজন মুসলিম মহিলা।আপনি ইসলাম ধর্ম পালন করেন,আর একজন মুসলমান ছেলে হিসেবে আমার এতোটুকুই যথেষ্ট। দ্বিতীয়ত,আপনার একটা সন্তান আছে, তাতে কি? সন্তান একটা নারীর অহংকার। আপনার সততা,আপনার সত্যবাদীতা দেখে আমি মুগ্ধ! যেখানে এই ঢাকা শহরে মা হয়ে সন্তানের পরিচয় গোপন রেখে,স্বামীর কথা গোপন রেখে অন্য পুরুষের সাথে পর*কীয়া করে বেড়াচ্ছে, আর সেখানে আপনি গর্ব করে নিজের সন্তানের কথা তুলে ধরেছেন, এজন্যই তো আপনি অন্যদের থেকে আলাদা! আপনার খারাপ অতীত ছিলো বলেই যে ভবিষ্যৎ ও খারাপ নিয়ে যেতে হবে তার তো কোন মানে নেই। আপনি ভবিষ্যৎতে ভালো থাকতেই পারেন।প্রত্যেকটি মানুষই চাই ভালো থাকতে। আপনার এসব কিছুতে আমার কোন সমস্যা নেই। ”
“আপনি বোধহয় শোনেন নি,আমি ডিভোর্সি! আমি তিন বছর সংসার করেছি অন্য কারো সাথে। আর এখন আমি নিজের সন্তানের জন্য সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ বানাতে চাই।”
“হ্যাঁ,আমি শুনেছি আপনি ডিভোর্সি। তাতে কি হয়েছে বলুন তো? আচ্ছা আমায় বলুন,আমি আপনাকে ছেড়ে একটা কুমারী মেয়ে কে বিয়ে করলাম, কিন্তু এটার একশো পার্সেন্ট নিশ্চয়তা কি যে সেই মেয়ে টি ভার্জি*ন? আমাদের আশেপাশে এখন কতো কিছু ঘটছে আপনি জানেন? সেভেন এইটে পড়া মেয়ের দু তিন টা বয়ফ্রেন্ড। আজকাল মেয়ে রা নাইট ক্লাব,লং ড্রাইভ,পার্ক ডেট,রুম ডেট নামে কতো কিছু করে বেড়াচ্ছে। বর্তমান সমাজে কয়জন মেয়ে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে হ্যাঁ আমি ভা*র্জিন। হ্যাঁ আমি নিষ্পাপ, কোন ছেলের ছোঁয়া লাগতে দেইনি আমার শরীরে। আজ পর্যন্ত কোন ছেলে কোন ভাবেই নোংরা করেনি আমায়।কতোজন বলতে পারবে বলুন? হয়তো গুটি কয়েক মেয়ে এমন আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারবে। কিন্তু বাকী গুলো? যারা রুম ডেট, পার্ক ডেটের নাম করে প্রেম নামক হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে বয়ফ্রেন্ডের দ্বারা হারাম স্পর্শ লাগিয়েছে গায়ে তারা? তাদের তো বিয়ে করলে সমাজ ধন্য ধন্য করবে।কুমারী মেয়ে বিয়ে করা বলবে,কিন্তু এরা কি আদৌও নিষ্পাপ,কুমারী? আর একটা ডিভোর্সি, যে বৈধ ভাবে বিয়ে করে স্বামীর সংসার করেছে,কিন্তু মাঝখানে কপাল খারাপ হওয়ায় ডিভোর্সির তকমা গায়ে লেগেছে তার তো কোন দোষ নেই! আর তাকে বিয়ে করলেই আমাদের সমাজ ছিহ্ ছিহ্ বলবে! বাহ্ কি সুন্দর নিয়ম! আমি এসব নিয়ম মানি না ম্যাডাম! আমি আপনার মাঝে যে শালীনতা দেখেছি,খুব কম মেয়েরই তা থাকে।আমি এমন একজন মেয়েকেই স্ত্রী হিসেবে চাই।আমার এসবে কোন সমস্যা নেই। ”
“দদেখুন,আমি আপনার সাথে তর্কে পারবো না।কিন্তু আমি এতোটুকু জানি,আমার ছেলের জন্য ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে আমি এখন ভাবতে চাই না।আপনার চিন্তা ভাবনা গুলো সুন্দর, আমি সম্মান করি আপনার যুক্তি গুলোকে।খুব কম মানুষই এমন করে ভাবে,কিন্তু আমায় মাফ করবেন।আমি এখন নতুন কোন সম্পর্কে জড়াতে চাই না”
“আরে আমি আপনাকে এখনই বলছি কখন? আমি শুধু আপনার মতামত চাই। যদি আপনি চান, আমি আপনার ছেলের দায়িত্ব নিতে পারি।আমার বড় ভাই আর ভাবিরও কোন সন্তান নেই। উনারাও আপনার ছেলেকে পেলে খুশিই হবেন।আর যদি আপনি না চান,বা এতে আপনার কোন ভাবে নিজেকে ছোট মনে হয়, তো আপনি সময় নিন।আমিও নিজের দোকান টা আর একটু বড় করি,আপনি ও আপনার সন্তানের জন্য কিছু করুন।আজ না হোক,কিছু দিন পর হলেও আমার কোন সমস্যা নেই। আমি অপেক্ষা করতে পারবো।আমার শুধু আপনার মতামত টা জানার দরকার। কি? একটু সুযোগ দেবেন তো আমায়?”
“আমি বুঝতে পারছিনা এতো এতো মেয়ের ভিড়ে আপনার আমায় কেন পছন্দ হলো।আসলে আমার একটু সময় দরকার। আমার অভিভাবক বলতে আমি যে বাড়িতে মানুষ হয়েছি সে বাড়ির আপু আছেন।উনাদের মতামত দরকার, আর উনারা যদি ভালো মনে করেন,আপনি অপেক্ষা করে থাকতে পারেন তবে হয়তো আপনি যেটা চাচ্ছেন সেটা হতে পারে। তবে তার জন্য ও সময় দরকার, আমার সন্তানের জন্য আমি কিছু করতে চাই,আগে আমি সাবলম্বী হই, আমার ছেলেকে নিজের কাছে আনি, তারপর অন্য কিছু। ”
“আচ্ছা ঠিক আছে তোমার যতো ইচ্ছে সময় নাও,আমি অপেক্ষা করবো।তবে প্লিজ উত্তর টা হ্যাঁ ই দিও।আসলে এককথায়, আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি এটা বলতে পারবো না,কারণ মুখে যতোই বলি,এতো তাড়াতাড়ি একটা মানুষ একজন কে দেখে ভালোবাসতে পারেনা, ওটা শুধু মানুষ এমনিই বলে।এতো তাড়াতাড়ি যেটা হয় সেটা হলো ভালোলাগা, আর আমার ও তোমায় খুব ভালো লাগে,সেটা হয়তো তোমার লাজুকতার জন্য, নাকি তোমার ঐ মায়াবী মুখের জন্য, তা আমি জানি না। তবে আমি জানি,তোমার মতো একটা অতি সাধারণ, লাজুকময় মেয়ে আমার প্রয়োজন । এই শহরে বহু মেয়ে আছে, কিন্তু তোমার ভেতর আমি অন্য এক ভালো লাগা খুঁজে পেয়েছি, যা অন্য কারুর মধ্যে পাইনি।”
ছেলেটির প্রতিটি কথায় কেমন যেন আমায় দূর্বল করে তুলছিলো।কিন্তু না,আমার এতো তাড়াতাড়ি দূর্বল হলে চলবে না।আমায় এগোতে হবে, অনেক দূর এগোতে হবে। আমি উনার কথা গুলো কিছু টা এড়িয়ে গিয়ে বললাম,
“আচ্ছা ঠিক আছে , আজ আমি যাই তাহলে।”
“আরেহ্ বাহ্! এতো কথা বলছি অথচ তোমার নাম টাই আমি জানি না। আর আমি কিন্তু তোমায় তুমি করেই বলবো। তো,আমি কি মহারানীর নাম টুকু জানার দাবী করতে পারি?”
উনার এমন করে বলায় ফিক করে হেসে ফেললাম আমি,আসলে জীবনে এখন পর্যন্ত কেউ আমার সাথে এমন করে কথা বলেনি।
“রাবেয়া আমার নাম,সবাই রাবু বলেই ডাকে।আপনি চাইলে রাবু বলেই ডাকতে পারেন। ”
“আচ্ছা? নিকনেম ধরে ডাকার অধিকার দিচ্ছো তাহলে?”
“সবাই ই বলে তাই বললাম। এবার আপনার ইচ্ছা। ”
“আচ্ছা রাবু শোন,এইতো আমার দোকান। তুমি ও এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসা করো,কেউ কোন অসভ্যতামি করলে আমায় জানিয়ো।আর কোন কিছুর প্রয়োজন হলে নির্দিধায় আমায় বলবে।কারণ, ভবিষ্যৎতে তো সব প্রয়োজন আমায়ই বলবে,তাইনা?”
কেমন যেন হাসি হাসি করে ছেলেটা বলল।
“এই যে দেখুন,এখনই এতো ভাববেন না।আমি কিন্তু হ্যাঁ বলি নি এখনও।আর আমার কিছু প্রয়োজন হলে আপনাকে বলতে যাবো কেন?”
“তুমি এখনও হ্যাঁ না বললেও তোমার চোখ বলছে উত্তর টা হ্যাঁ ই হবে ম্যাডাম।আর প্রয়োজনের কথা বলছো? আরে বাবা,আমি তো একজন দোকানদার,অন্তত দোকানদার হিসেবে হলেও যা কিছু লাগবে তা তো আমায়ই বলতে হবে নাকি?”
“ধুর! পারবো না আপনার সাথে তর্কে। ঝগড়ুটে ছেলে একটা! “বলেই আমি ওখান থেকে চলে আসলাম। ঠিক বুঝতে পারছিনা ছেলেটাকে কি বিশ্বাস করা যায় কি না? কিন্তু উনার কথা বলার সময় চোখের যে ভাষা আমি দেখেছি, তা কি মিথ্যে হতে পারে? উনি কতো সুন্দর করে বিষয় গুলো নিয়ে ভাবেন,এই ছেলে কি সত্যিই ভুল হতে পারে? ধুর! অতো সব জানি না।যা পারুক হোকগে।আগে আমি আমার লক্ষ্য পূরণ করি,তারপর নাহয় ভেবে দেখবো।
তারপর থেকে প্রতিদিন আমি কাজে যেতাম আর ওর দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করতাম , যতো ভিড়ই থাকুক আমি যাওয়ার সময় টা কি করে যেন ছেলেটা বুঝে যায়। ঠিক একটি বার তাকাবেই,আর সুন্দর করে একটু হাসি ফিরিয়ে দেবে।আমিও বারবার চেষ্টা করেছি এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ওর দোকানের দিকে তাকাবো না।কিন্তু ওমা! আনমনেই কি করে যেন তাকিয়ে ফেলি নিজের অজান্তেই। আর তখনই ওর চোখে চোখ পড়ে যায়। আর লজ্জায় আমি একেবারে হারিয়ে যায়। কি বলবে ছেলেটা! না জানি কি ভাববে আমায়! প্রতিদিন নিজেকে শাসন করি,কিন্তু তারপর ও কিসের মায়ায় যেন তাকিয়ে ফেলি।
এভাবে মাস ছয়েক চলে যায়। এর মধ্যে কবিরের সাথে আমার আর একবার কথা হয়েছিল , সে শুধু বলেছিলো আমি আমার আপুকে বলেছি কিনা তার কথা,আর আপুর মতামত কি।কিন্তু আমি তো আপুকে সেভাবে বলিই নি।কারণ আমি তো এখনই কিছু ভাবছিনা ওসব বিষয় নিয়ে। আমার আরও সময় চাই,সে অপেক্ষা করলে করবে,নয় তো চলে যাবে।কিন্তু আমি আমার লক্ষ্যে স্থীর। আমি তাকে জানিয়ে ও ছিলাম যে আমি এখনই আপুর সাথে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই না।আমার আরও সময় চাই। সেও চুপচাপ চলে গেছিল।
আমার পাশের রুমের রাফিয়া আপু,বয়স বড়জোড় সাতাশ আটাশ হবে। কাজের সূত্রে পরিচয় হলেও কথা একটু কমই হতো।কারণ দুজনেই কাজ করি,সেই সকালে যাই রাতে ফিরি।যেতে আসতে রাস্তায় যে টুকু কথা! বাসায় আসলে দুজনেরই রান্না বান্না আর কতো কাজ! সময় হয়না গল্প করার।
সেদিন এক শুক্রবারে কি করে যেন দুজনেরই সময় মিলে গেলো।পুরনো গল্পে দুজনেই ভাগাভাগি করে নিতে লাগলাম দুজনের দুঃখ। আমি আমার পুরনো গল্প গুলো রাফিয়া আপুর কাছে খুলে বলতে লাগলাম। কিন্তু আপু যখন শুনলেন ছয় বছর বয়সে আমি কি করে যেন হারিয়ে গিয়ে অন্যের বাড়িতে মানুষ হচ্ছি,তখন যেন আপু খানিকটা চমকে গেলেন।উনি একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলেন আমায়।ছোট বেলার কথা আমার কি কি মনে আছে? কি করে হারিয়ে গেলাম? সব, সব কিছু আপু শুনতে চাচ্ছিলেন।আমি নিজেও অবাক হয়ে গেলাম আপুর আমার অতীত জানা নিয়ে এতো আগ্রহ দেখে।তবে কি উনি আমার অতীতের কেউ,কোন পরম আত্মীয়?,,,,,,,,
চলবে,,,,,,,