মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_২২ ( 2ND PART )

0
547

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_২২ ( 2ND PART )
#পুষ্পিতা_প্রিমা

দেখতে দেখতে নেমে এল সন্ধ্যা। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা বাইক আর একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। মেয়েটির বুকের উপর আধশোয়া হয়ে একটি ছোট্ট মেয়ে মেয়েটির মুখে আঁকিবুকি করে ডাকছে, আমমমা, আমমমাহ, রিইইইইই, মিননননি।
মানুষজন দৌড়ে এল। পড়ে থাকা একটি খাঁচায় একটি টিয়ে পাখি ডানা ঝাপটে বলল,
‘ রিইইই, মিষ্টি, প্রিন্সেস।
লোকজন জড়ো হলো। বেশি আঘাত পেয়েছে ছেলেটি। মেয়েটি কপালের পাশে সামান্য আঘাত পেয়েছে, হাতে,পিঠে পেয়েছে। ছেলেটি কপালে,নাকে,মুখে সবখানে আঘাত পেয়েছে। ভাগ্য ভালো প্রাণটা একেবারে যাইনি। লোকজনের কোলাহলে ইশার জ্ঞান ফিরল। দূরে পড়ে থাকা ছেলেটিকে দেখে সে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল। পরী ও তার কান্না দেখে কেঁদে দিল। একজন মহিলা এসে কোলে নিল পরীকে। শান্ত করতে চাইল। ইশা দৌড়ে গেল রিপের কাছে।
‘ রিপের মাথা তার কোলে নিল। এলোমেলো ভাবে কাঁদার জন্য কথা বলতে ভুলে গেল। যখনি কথা স্পষ্ট হলো,তখন সে মুখ ধরে ডাকল,
‘ রিপদা উঠো। এই রিপদা। শুনতে পাচ্ছ আমায়। এই রিপদা। রিপদা। আমার জন্য সব হয়েছে রিপদা। ওই শয়তানগুলো আমাকে মারতে চেয়েছিল,তুমি আঘাত পেলে। আমি তোমাকে আর কত আঘাত দেব রিপদা? তুমি উঠো, এবার আমি তোমাকে সব বলে দেব। তুমি আমার পাশে থাকবে আমি জানি রিপদা। চুপ করে থেকোনা রিপদা। উঠো প্লিজ। এই দেখো ইশু কাঁদছে। তোমার জন্য কাঁদছে। তুমি চোখ খোলোনা? বন্ধ করে কেন রেখেছ? এই রিপদা।
তার কান্নার আওয়াজে ভারী হয় পরিবেশ। কয়েকজন এসে রিপকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার তাড়া করে। ইশার হাতে লেগে যায় রক্ত। সে সেই রক্ত দেখে রিপের সেই রক্তাক্ত চেহারা দেখে জোরে জোরে কাঁদে। কতবছর পর সে এভাবে কাঁদছে। কতবছর পর। সে রিপের যাওয়া দেখে। কেঁদে কেঁদে বলে, রিপদা আমি অপরাধী। আমি অন্যায় করেছি। তোমাকে না জানিয়ে আমি অনেক বড় ভুল কাজ করে ফেলেছি। ইশা দাঁড়াতে পারল না। কি আশ্চর্য! তার পা নাড়াতে পারল না। ব্যাথায় ঠনঠন করে উঠল। সে আবার কেঁদে দিল। পরী চেঁচিয়ে কাঁদল। ডাকল, আমমমাহ রিইইই………
ইশার কাছে কয়েকটা মহিলা এগিয়ে এল। বলল, তোমাকে ও হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। তোমার বাচ্চাটা ও কপালে সামান্য চোট পেয়েছে।
ইশা বলল, আমার ফোন কোথায়? রিপদার ফোন? ফোন পাওয়া গেল। কিন্তু ফোন তুলল না কেউ। রিপের ফোন ভেঙ্গে গেল। পরী আওয়াজ করে কাঁদল।
ইশা ভেবেচিন্তে বলল, আমার বাচ্চাটাকে একটু বাসায় পৌছে দিতে পারবেন। আপনি তো আমার মায়ের মতো। বাচ্চাটা আর এই পাখিটাকে এই ঠিকানায় পৌছে দিন দয়া করে। আমাকে একটু সাহায্য করুন প্লিজ।
মহিলাটি অভয় দিয়ে বলল, মা যখন ডেকেছ তখন আমি আমার কাজ করব। কিন্তু তোমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। অবস্থা করুন।
ইশা অ্যাম্বুলেন্সে তোলা রিপকে দেখে আবার কেঁদে দিল। ডাকল, রিপদা উঠো। ইশুর কাছে ফিরে এসো। প্লিজ ফিরে এসো। এতবড় শাস্তি আমায় দিওনা। আমার আর কেউ নেই। আমাকে অত ভালোবেসে আগলে রাখার মতো কেউ নেই। আমাকে এতিম করে যেওনা। যাওয়ার কথা ভেবোনা। আমি অসহায় রিপদা। খুব অসহায়। তুমি ছাড়া আমি অসহায় রিপদা।
__________________
মানসিক অশান্তি তার উপর ডক্টর ইমদাদের দেওয়া প্রত্যেকটা টেস্টের জন্য ভীষণ ব্যস্ত আদি। সময়টা নিজেকে দিচ্ছে। কোনোকাজেই মন বসাতে পারছেনা। এত রোগীর লাইন পড়ে গেছে। অন্য ডক্টরদের উপর কাজের চাপ বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। আদির অসুস্থতার কথা জানায় তাকে কয়েকদিনের জন্য ছুটি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজ সে নিজের একটি কাজের জন্য হসপিটালে আসল।
পুরো হসপিটাল বোধহয় ঝাড়ু দিচ্ছে মেয়েটির শাড়ির আঁচল। কপালে আর হাতে,পায়ে মেয়েটির ব্যান্ডেজ। ভালো করে হাঁটতে পারছেনা। তারপরে ও মেয়েটি দৌড়ানোর চেষ্টা করছে। আদির রাগ লাগল। সে শক্ত গলায় ডাক দিল, আর ইউ মেনটালি সিক? এভাবে কেউ কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে? হসপিটালের বদনাম রটানোর চেষ্টা?
কেন যেন মেয়েটির চেহারা সে দেখল না। কিন্তু চিনতে পারল। মেয়েটির সেদিকে হুশ নেই। সে ছুটে গেল। দুই জন নার্স তার পিছু নিল। মেয়েটি শুনল না কারো বারণ। ডুকে পড়ল অন্য একটি কেবিনে। জাপটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল বেডে শুয়ে থাকা ছেলেটিকে। ছেলেটির মুখের অক্সিজেন মাস্ক সরে গেল। মেয়েটি অনবরত কাঁদতে কাঁদতে ডাকল,
‘ রিপদা,,,,, উঠো না। আর কতক্ষণ এভাবে শুয়ে থাকবে? আর কতক্ষণ? আমাকে আর কত কাঁদাবে। নার্স এসেই তাকে সরানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সরাতে পারছেনা। প্রায় অনেকক্ষণ পর যখন নার্স একজন বলল, ওনি মরে যাবে। এমন করলে?
ইশা তখনি চুপচাপ সরে গেল। এলোমেলো কন্ঠে বলল, না না রিপদা মরবে না। আমার জন্য রিপদাকে বাঁচতে হবে। আমাকে আগলে রাখার জন্য। আমাকে প্রটেক্ট করার জন্য।
কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনাটা পর্যবেক্ষণ করল আদি। ইশা দেখার আগেই চুপচাপ সরে পড়ল।
তালহা বেগম ছুটে এল। রিক ছুটে এল। মুনা ও ছুটে এল। তালহা বেগমের আহাজারিতে ভারী হলো পরিবেশ। সব দোষ ইশার? ওই মেয়েটা শেষ করল সব।
ইশা অসুস্থ শরীর নিয়ে বসে রইল হসপিটালের করিডোরে। সুনামধন্য ডক্টর আদি চৌধুরী শুধু লুকিয়ে দেখল মেয়েটিকে। সে তো সুস্থ, সবল দেখেছিল সবাইকে। কখন এতসব হলো?
আদি এগোনোর সাহস পেলনা।
বাইরে তুমুল বৃষ্টি। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।সময়টা মাঝরাত। রিপের জ্ঞান ফিরল। পিটপিট করে চোখ খুলতেই ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে তার দিকে ঝুঁকে পড়ল ইশা। কেঁদে ডাকল, রিপদা…..
রিপ ব্যান্ডেজে মোড়ানো ঠোঁট নেড়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে হাসার চেষ্টা করল। ইশা তার মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘ রিপদা সবাই ছিল এতক্ষণ। তুমি আরেকটু আগে জেগে উঠতে পারো নি?
রিপ অবশ কন্ঠে বলল,
‘ তুই আঘাত পেয়েছিস?
ইশা কেঁদে কেঁদে বলল, ‘ এখনো ও আমার কথা ভাবছ তুমি? নিজের কথা ভাবো।
‘ আমার জন্য তো তুই আছিস? এই কেঁদেছিস তুই? এভাবে?
ইশা মাথা নাড়ল কেঁদে কেঁদে। বলল,
‘ তুমি আমাকে কাঁদালে। আমি ও তোমায় কাঁদাব। যাইহোক,
এখন বলো তুমি কি খাবে?
রিপ চোখবন্ধ করে আবার খুলে ইশাকে বলল,
‘ কিচ্ছু খাব না। একটা আবদার আছে তোর কাছে। যদি কিছু চেয়ে বসি তুই দিবি? এই মুহূর্তে।
ইশা তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে নিল। বলল, বলো বলো কি চাও?
‘ দিবি? সত্যি?
ইশা মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘ না দেওয়ার কি আছে। আমার প্রাণটা দিয়ে হলেও তোমার আবদার আমি পূরণ করব বলো কি চাও।
রিপ মুগ্ধ চোখে তাকাল ইশার দিকে ক্লান্ত দুর্বল চোখে। উত্তেজনায় ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে লাগল তার। কাঁপাকাঁপা হাত তুলে ছুয়ে দিল ইশার গালের একপাশ। সেই হাত দিয়ে ইশার একপাশ ধরল সে। বলল, তুই কি আমাকে মারবি তখন? আসলে আমি তোকে কিছু বলব। কিভাবে বলব?
ইশা কৌতূহল নিয়ে বলল, কি রিপদা। বলো?
রিপ তার কাঁপাকাঁপা হাত দিয়ে ধরল ইশার গালের আরেকপাশ। তার দিকে সামান্য টেনে এনে বলল,ইশু তুই তোর মন থেকে,হৃদয় থেকে ভেবে বল তো আমি তোর কে? তুই কে হস আমার? আমি কে হয় তোর?
ইশা কিছুক্ষণ চুপ থাকল। প্রায় অনেকক্ষণ সময় পর রিপের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে আবার তাকাল। বলল, তুমি আমার অনেককিছু। এই এতিম মেয়েটার অভিভাবক। তার মাথার উপরের ছাদ। তার ছায়া। তুমি আমার জন্য উপরওয়ালা প্রদত্ত নেয়ামত। তুমি আমার ভরসাস্থল। তুমি আমার মায়ের পেটের ভাই না হলে ও আমার ভাইয়ের চাইতে ও বেশি। তোমাকে নিয়ে আমার গর্ব হয় রিপদা। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি রিপদা। তোমার এই ইশুর কাছ থেকে কখনো তুমি মুখ ফিরিয়ে নিওনা রিপদা। কখনো দূরে ঠেলে দিওনা।
ইশা বকবক করতে করতে রিপের বুকে মাথা রাখে। বলে, তুমি সুস্থ হয়ে উঠো। তোমার একটা ছোট্ট সাজানো সংসার আমি দেখতে চাই। তোমার সব আবদার আমি রাখব। তুমি ও রাখবে কিন্তু রিপদা। ছোটবোনের আবদার। বলোনা রাখবে তো? বলো? বলো?
ইশশ মেয়েটি যদি একবার,,
শুধু একবার ছেলেটির চোখের দিকে স্থির হয়ে দেখত তবে দেখতে পেত তার চোখ থেকে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়েছে। অশান্তিতে মাথার রগ দপদপ করছে। গরম গরম দুফোঁটা চোখের জল কানের কাছে গড়িয়ে পড়েছে। মেয়েটি দেখল না। ছেলেটি আজ আবার ও হেরে গেল। আজ আবার তার একবুক অব্যক্ত ভালোবাসারা প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ পেলনা। বলা হলোনা আর। জানানো হলোনা। মেয়েটি ও বুঝল না।
ফোনকলের আওয়াজে দুজনের হুশ ফিরল। ইশা ফোন রিসিভ করল। সাথে সাথে ভেসে এল পুরুষালী কন্ঠে একটি ভয়ানক বার্তা। মেয়েটি বড়দা বলে ডাকার আগেই। শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্বের বড়দার কন্ঠে কান্নার আভাস পাওয়া গেল।
ইশা দুরুদুরু বুক নিয়ে আবার জানতে চাইল।
‘ কি হয়েছে বড়দা? আমার পরী মা……..
রিক অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ ইশুরে পরীকে নিয়ে গেল দুজন বোরকা পড়া ডাকাত। গুলি দেখিয়ে বলল তারা নাকি মেরে ফেলবে আমার মাকে। পুলিশকে না জানাতে বলেছে। কোথায় নিয়ে গেল পরীকে। কোথায়?
ইশার হাত থেকে ফোন পড়ে গেল। সে আবার কুড়িয়ে নিয়ে দৌড় লাগাল। রিপ কিছু বুঝতে পারল না। ঘুমের ঔষধ দেওয়ায় তার ঘুম ভর করল দুচোখের পাতায়। চোখ বন্ধ করার সাথে একফোঁটা জল গড়াল কানের কাছে। সাদা স্বচ্ছ শুভ্র ভালোবাসারা প্রকাশিত না হওয়ার খুশির জল। কি সুন্দর!
ইশা ছুটে গেল কাঁপাকাঁপা পায়ে। ফোন বাজল তার। ওপাশ থেকে আওয়াজ এল হাসির। ইশা বুঝে গেল সব। চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল। বলল, মারবেন না। মারবেন না। আমার পরীকে মারবেন না। সব দোষ আমার।
আমার কলিজাটাকে মারবেন না।
আজিজ চৌধুরী হো হো করে হাসলেন। বলল,যতদিন না আদি আর আইমির বিয়েটা কমপ্লিট হচ্ছে ততদিন এই মেয়েটা আমার কাছে থাকবে। তোমাকে নাচানোর সুতো এই মেয়েটা। পরীর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে । সে আওয়াজে ভয় মেশানো। মনে হয় তাকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে।
ইশা গর্জে উঠে।
‘ আমার পরীকে আলোতে রাখুন। আঁধার ভয় পায় ও। ওকে খেলতে দিন। আমার মা টা ব্যাথা পেয়েছে কপালে। ওর আদর,যত্ন দরকার। একটা বাচ্চাকে কেন এত কষ্ট দিচ্ছেন। কেন? আমি তো সরে গিয়েছি। তাহলে কেন এত অবিচার? কেন?
ইশা অন্ধকারে ছুটে চৌধুরী বাড়ির উদ্দেশ্য। সে ভুলে গিয়েছে চৌধুরী বাড়ি বহুদূর। দৌড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সে তারপর ও দৌড়াতে থাকল। ঝড়বৃষ্টির মাঝে একটা মেয়ে নির্জন রাস্তায়।
পায়ে কাঁটা বিধল। সারা শরীর ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠল। কিন্তু তারপর ও সে দৌড় থামাল না। কারো কারো গলার আওয়াজ ও ভেসে এল পেছন থেকে। কিন্তু সে তোয়াক্কা করল না। এগিয়ে চলল।
আচমকা কারো হাতের টানে সে আর এগোতে পারল না। থেমে গেল। একরাশ ঘৃণা বিরক্তি ক্রোধ ক্ষোভ নিয়ে তাকাল পুরুষটির দিকে।
আদি তার দুইবাহু ধরে ঝাকিয়ে বলল, এভাবে কেউ দৌড়াই? কোথায় যাচ্ছেন এমন সময়? কি হয়েছে?
আদির গায়ের ধূসর রঙের শার্ট গায়ে লেপ্টানো। চুলগুলো চুয়ে চুয়ে পানি পড়ছে। উদভ্রান্তের মতো আচরণ করল ইশা। আদি শার্ট সর্বশক্তি দিয়ে টান দিল। দূরে ছুড়ে মারল আদিকে। আদি অবাক হলো। নিজের বুকের কাছে তাকাতেই দেখল খসে পড়েছে কয়েকটা বোতাম। সে তারপর ও ইশার দিকে এগিয়ে গেল। বলল, পাগল হয়ে গিয়েছেন আপনি? কি করছেন এসব? কেন করছেন?এই ঝড়বৃষ্টির মাঝে এতরাতে কেউ এভাবে বের হয়? আর ইউ মেনটালি সিক?
ইশা আর চুপ থাকতে পারল না। সর্বশক্তি দিয়ে চড় বসাল আদির গালে। কিন্তু তার পরপরই সে ঢলে পড়ল আদির দিকে । আদি অবাক হওয়ার রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দেখতে পেল মেয়েটি এবার গুনগুন করে কাঁদছে। বসে পড়েছে রাস্তায়।
ইশা যে হাতে চড় মেরেছে আদিকে সে হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে কাঁদল। কোনোকথা বেরোলো না। আদির দিকে আর তাকাল না। শুধু ডাকল, আমার মা। পরী।
আদি বসে পড়ল ইশার সামনে। অনেকক্ষণ বসে বসে কাঁদল ইশা। আদি ও ততক্ষণ বসে রইল। ইশা অনেকক্ষণ পর চোখ তুলে দেখল আদিকে। আদি তার দিকে ততক্ষণে চেয়ে আছে। মুখটা ক্লান্ত, অবসন্ন, আঘাতপ্রাপ্ত। ইশা দাঁড়িয়ে পড়ল। দৌড়ে দৌড়ে এগোতে লাগল। পায়ের ব্যাথাকে পাত্তা দিল না। আদি বুঝে উঠতে পারল না কি হয়েছে মেয়েটার?
আদি এবার দৌড়ে গেল মেয়েটির পিছু পিছু। শাড়ির আঁচল টেনে ধরল। তার হাতে পেঁচিয়ে নিল। মাথায় তার যন্ত্রণা লাগল। হাতে শাড়ি পেঁচাতে পেঁচাতে ইশাকে নিয়ে আসল তার কাছে। তার বুকের কাছে। ইশা আটকে গেল তার কাছে এসে। ঘৃণাসূচক শব্দ বের করল মুখ দিয়ে, নির্লজ্জ।
আদি ইশার কথায় কান দিলনা। শাড়ি হাতে পেঁচিয়ে দেখাল ইশাকে। বলল, আপনি মিষ্টি হতেই পারেন না। মিষ্টি আমি হাতে শাড়ি পেঁচালে লজ্জা পেত। আমি কি করে আবার একই ভুল করলাম ?
মাথায় হাত দিয়ে আহঃ শব্দ বের করে বলল, আপনি মিষ্টি নন। কখনো না।
ইশা আর পারল না। নিজের ভার ছেড়ে দিল আদির গায়ের উপর। মিনমিন করে বলল, ডক্টর ফিরিয়ে দিন। আমার মাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন।
আদি কিছুই বুঝলনা। বৃষ্টিজল ভেসে নিয়ে গেল সেই মিনমিন করে বলা কথা। আদির বুকের কাছে এসে মুখ ঠেকল ইশার। সে চেতন হারাল। চেতন হারানোর আগেই বিড়বিড় করে বলল, মা আমার। পরী?
চোখে ভাসল ছোট্ট মেয়েটার আদুরে মুখ। কানে বাজল একটি ডাক, ‘ আমমমমমমা।
আদি তার বুক থেকে একহাত দিয়ে ইশার মুখ তুলল। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ঝড়বৃষ্টি বাদলের এক মন কেমনের রাতে আবার দেখা,সাক্ষাত, আঘাত,তার জীবনের প্রথম বৃষ্টির সাথে। চেয়ে চেয়ে থাকতে থাকতে অন্যায় বাসনা মনে জাগল আকস্মিক। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি জল জমা মেয়েটার কপালটা দেখে।
ঠোঁট কাঁপল তরতর করে। কিন্তু ছুঁয়ে দেওয়া হলোনা। এই অন্যায় বাসনা নিমেষেই নিভু নিভু হয়ে এল একটি ভাবনায়, মেয়েটি বিবাহিত। অন্যের স্ত্রী।
আদি চৌধুরী ভালোবাসতে জানে। সে চরিত্রহীন নয়। তার বৃষ্টিকে চায়না আর। বৃষ্টি নেই আর তার। তার মিষ্টিকেই চায়। যেমন সত্যি সে বৃষ্টিকে নিজের অজান্তেই ভালোবেসেছে একসময়। বলা হয়ে উঠেনি। বলার সুযোগ আসেনি।
ঠিক তেমন সে এখন মিষ্টিকে ভালোবাসে। মিষ্টিকেই চায়। তার বর্তমান মিষ্টি। ভবিষ্যৎটা ও তাকে ঘিরেই হবে। সে থাকুক বা না থাকুক। সে থেকে যাবে ডক্টরের মনে মিষ্টি হয়ে ।
আর এই মেয়েটি থাকবে হঠাৎ করে,আচমকা,আকস্মিক এক মন কেমনের সকাল,সন্ধ্যা,দুপুর,রাত হয়ে। এক মন কেমনের রোদ হয়ে। এক মন কেমনের ব্যাথা হয়ে। এক মন কেমনের হাসি হয়ে। এক মন কেমনের স্মৃতি হয়ে। এক মন কেমনের বৃষ্টি হয়ে। থেকে যাবে। চিরকাল।
আদি মন থেকে বহুকষ্টে উচ্চারণ করে। আমাকে ছাড়া দুজনই ভালো থাকুক। তারা ভালো থাকত না আমার সাথে। থাকত না।
বৃষ্টির রিমঝিম আওয়াজের তালে তালে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। দূরে কোথাও আওয়াজ করে বজ্রপাত হলো। আদির সেদিকে খেয়াল নেই।
সে বিড়বিড় করে বলল,
‘ কিন্তু আমি ভালো থাকতাম বৃষ্টির সাথে। না বৃষ্টি নয় মিষ্টির সাথে। হ্যা হ্যা মিষ্টির সাথে। কারণ মিষ্টি আমার অর্ধাঙ্গিনী। জীবনসঙ্গী।
চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here