বৃষ্টিময়_প্রেম #অন্তিম পর্ব

0
1050

#বৃষ্টিময়_প্রেম
#অন্তিম পর্ব
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

শুভ্ররাঙা রুমজুড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। পাশাপাশি চুপচাপ বসে আছি আমি ও পূর্ণ। একটু আগেই ডক্টর এর রিপোর্ট এসেছে, অবশেষে যা ধারণা করছিলাম তাই হলো। রিপোর্ট পজিটিভ। আমার মাঝে আমাদের দুজনের একটি অংশ বেড়ে উঠছে। বাসায় এ খবর জানানোর পর থেকে খুশিতে হৈহৈ কলরব চারদিকে। সবচেয়ে এক্সাইটেড প্রিয়া ও প্রান্ত ভাইয়া। এখন থেকেই প্ল্যান করছেন বেবির জন্য কি কিনবেন! বড়াব্বুও ভীষণ খুশি, অভিনন্দন জানিয়েছেন আমাদের দুজনকে। বড়াম্মু এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বারকয়েক চুমু খেয়ে দোয়া দিয়ে গেছেন। আবেগপ্রবণ হয়ে এটাও বলেছেন,

“আমাদের পরিবারে ও আমার ছেলের জীবনে ফিরে এসে আমাদের এই উপহার দেওয়ার জন্য আল্লাহ তোকে সবসময় সুখী রাখুক, মা। ”

বাসায় সবার রিয়েকশন জানা হলেও নির্বিকার আছি শুধু আমরা দুজন। বিবিধ অনুভূতির মিশ্রণে ভারী হয়ে আছে হৃদয়! রঙ-বেরঙের সুখের প্রজাপতি বিচরণ করছে তন-মন জুড়ে! মুখে না বললেও আমি স্পষ্ট বুঝতে পাচ্ছি, পাশে বসে থাকা পূর্ণর-ও একি অবস্থা। একটু আগে রিপোর্ট আসার আগপর্যন্ত ছটফট করতে থাকা লোকটা হঠাৎ করেই কেমন শান্ত হয়ে আছেন, অতিরিক্ত আবেগে স্তব্ধ হওয়া যাকে বলে আর কি! উত্তেজিত ভঙ্গিতে একটু পরপর ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছেন। ডান পাশে তাকাতেই তার সাথে অক্ষিদ্বয় মিলিত হলো, আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন গভীরভাবে। অতঃপর নীরবতা ভেঙে কিছু বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতেই দুজনের কণ্ঠস্বর প্রতিফলিত হলো,

“আমাদের বেবি আসছে?”

একসাথে কথাটি বলে উঠতেই চমকে উঠলাম দুজন। কিছুক্ষণ পর একত্রেই হেসে উঠলাম। পূর্ণ কাছে এগিয়ে এসে আমার পেটে হাত রেখে মাথা ঝুকিয়ে ফিসফিসিয়ে কোমল গলায় বলে উঠলেন,

—আমার জানবাচ্চাটা, তাড়াতাড়ি দুনিয়াতে এসো। বাবা তোমার জন্য এক বুক ভালোবাসা নিয়ে তোমার আগমনের অপেক্ষা করছে।

অতঃপর সোজা হয়ে আমার দুই গালে হাত রেখে কপালে গভীরভাবে স্পর্শ করলেন। বুকপিঞ্জিরায় শক্তভাবে আবদ্ধ করে আবেগী কণ্ঠে বলে উঠলেন,

—বাবা হওয়ার অনুভূতি কি সত্যিই এত সুখের হয়? নাকি শুধু আমারই এমন লাগছে? বুকের মাঝে উত্তেজনায় ঢিপঢিপ করছে আমার ছোট্ট তুলতুলে পুতুলটাকে ছোয়ার জন্য, ওকে চোখের সামনে দেখার জন্য। আই লাভ ইউ, তুর পাখি। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ গিফট দিয়েছো তুমি আমায়। বার্থডে তে এর চেয়ে বড় সারপ্রাইজ হতে পারতোনা! ভালোবাসি, বউ। তোমাদের দুজনকেই ভীষণ ভালোবাসি।

পূর্ণর এত জোরে চেপে ধরায় শ্বাস নিতে কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে। বুঝলাম অতি আবেগে উৎফুল্ল আছেন। বুক থেকে মাথা উঠিয়ে ধীর কণ্ঠে বললাম,

—একটু আস্তে ধরুন। দম বন্ধ হয়ে আসছে।

—ওহ সরি সরি। আসলে খুশির চোটে ফিলিংস কন্ট্রোল করতে পাচ্ছিনা তাই এক্সাইটমেন্টে এসব করছি। আমার তো মন চাইছে তোমায় কোলে তুলে ঘুরাতে! এসব পাগলামি একটু সহ্য করে নেও, কেমন? এখন ঠিক আছো?

তড়িঘড়ি করে হাতের বন্ধন বেশ খানিকটা আলতো করে চোখের দিক তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি। তার মুখে চিন্তা, চোখে আবেগ। এদিকে তার অনুভূতিগুলো জেনে আমার ঠোঁটে হাসি, চোখে পানি। মাথা নাড়িয়ে নিজ হতেই তাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে মিস্টি হেসে বললাম,

—আমারও ঠিক একি অনুভূতি হচ্ছে, জানেন? যতবার ভাবছি ততবার শিহরিত হচ্ছি মনে মনে! আমি চাই আমাদের ছেলেটা ঠিক আপনার মতো হোক। সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব দুটোতেই পরিপূর্ণ।

—ছেলে? আমার তো মনে হয় আমাদের মেয়ে হবে।

—আচ্ছা। কিন্তু কেন?

—তা জানিনা। তবে আমি চাই আমাদের জীবনে ছোট্ট একটা পুতুল আসুক। যার চঞ্চলতায় মুখরিত থাকবে আমাদের জীবন। আধো আধো বুলিতে আদুরে গলায় আমায় ‘বাবা’ বলে ডাকবে।

—কিন্তু আমাদের ছেলে…

—শুস। আর কোনো কথা না, তুর পাখি। আল্লাহ যেটাই দিক সুস্থসবল বাচ্চা দিক, এটাই আমাদের একমাত্র চাওয়া। তাই না? ছেলে হোক বা মেয়ে হোক আমাদেরই তো।

এবার উনার কথায় ও যৌক্তিকতায় মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম। এটার উপর আসলেও কোনো কথা নেই। আবারো সুখপাখিরা বিচরণ করলো আমাদের হৃদয়জুড়ে। ইশ! এ পৃথিবীতে মা-বাবা হওয়ার অনুভূতিগুলো এতটা সুখের কেন?

__________________________

আজ রায়হান ভাই ও প্রিয়ার বিয়ে। সকাল থেকে ব্যস্ততায় দিন কাটছে। বিয়ে পড়ানো শুরু হবে কিছুক্ষণের মাঝেই। কাজী সাহেব এসে গেছেন। বধূরুপে বসা প্রিয়াকে ভীষণ সুন্দর লাগছে দেখতে। রায়হান ভাই অনেকক্ষণ থেকেই তাকিয়ে আছেন ওর দিকে, বেচারা যেন চোখের পলক-ই ফেলতে পারছেনা আজ! এসব নিয়েই প্রিয়াকে ক্ষেপানো হচ্ছে, বেচারি লজ্জায় চুপ মেরে আছে শুধু। শীঘ্রই সবার কথাবার্তা থেমে গেলো কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করার সাথে সাথে। ক্রন্দনরত প্রিয়া বেশ সময় নিয়েই রায়হান ভাইকে স্বামীরুপে স্বীকার করলো। অপরদিকে রায়হান ভাই যেন বসেই ছিলেন কবুল বলার জন্য। তাকে কিছু বলতেও হলোনা, সাথে সাথেই প্রিয়তমাকে স্ত্রীরুপে স্বীকাত করে নিলেন।

এভাবেই “কবুল” শব্দটার দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হলো দুটো হৃদয়, আরেকবার সম্বন্ধী হলো দুটো পরিবার। বোনকে রায়হানের হাতে তুলে দিলেন দুই ভাই। প্রান্ত ভাইয়ার চোখ ইতিমধ্যে ছলছল করছে। বাদ যায়নি গম্ভীর পূর্ণ-ও। সর্বদা অনুভূতি গোপন রাখা মানুষটা আজ বেশ সাবলীলভাবেই রায়হান ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

—ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত আমরা কখনো কোনোকিছুর কমতি হতে দিইনি আমাদের বোনের। আদর-যত্ন, ভালোবাসা-শাসন সবটাই করেছি সমানভাবে। অনেক ভরসার সাথে তোমার হাতে ওকে তুলে দিচ্ছি। আমার ছোট বোনটাকে আজীবন যত্নে রেখো, সুখে থেকো।

রায়হান ভাই পূর্ণর হাতের উপর হাত রেখে ভরসার আশ্বাস দিলেন, কেননা উনি নিজেও জানেন এ মুহুর্তে একটা ভাইয়ের অনুভূতি কেমন! বাবা-মা এর পর দুই ভাইকে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছুক্ষণ কাদলো প্রিয়া। প্রকৃতির নিয়মে নিজ বাড়ি ছেড়ে যে স্বামীর ঘরে চলে যেতে হয় প্রতিটি মেয়েকে! বিদায়ঘণ্টা বেজেই গেলো অবশেষে।

গাড়িতে বসে আছে প্রিয়া। কান্নার দমকে একটু পরপর হিচকি তুলছে সে। পাশ ফিরতেই একটা পানির বোতল চোখে পড়লো তার, হাতের মালিক রায়হান। গাড়িতে বসেই বোতলটা ওর দিক এগিয়ে দিয়েছে। সেদিক চেয়ে লাজুক হেসে পানি খেয়ে নিলো প্রিয়া। রায়হান সযত্নে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে চুমু খেলো। বুকে টেনে নিয়ে বললো,

—যত ইচ্ছা কেদে নেও এখন। কারণ কাল থেকে তোমার কাঁদার সুযোগ চিরদিনের জন্য বন্ধ!

প্রিয়তমের বুকে মাথা রেখে পরম সুখে স্বস্তির শ্বাস নিলো প্রিয়া। এ দিনটার স্বপ্ন সে এক বছর ধরে দেখে আসছে! স্বপ্নগুলো হুট করেই সত্যি হয়ে যায় বটে!

________________________

কথায় আছে, সুখের সময় খুব দ্রত কাটে। আমাদের ক্ষেত্রেও হলো ঠিক তাই। দেখতে দেখতেই পেরিয়ে গেলো সময়। চোখের পলকে কেটে গেছে প্রায় তিনটে বছর। আমার ও পূর্ণ-র ঘর আলো করে এসেছে আমাদের সন্তান। প্রেগন্যান্সির পুরো সময়টা পরিবারের বাকি সবাই ও পূর্ণর জন্য বেশ ভালোভাবেই কেটেছে আমার। প্রচুর মুডসুইং হতো যেকারণে এমন কোনো আবদার ছিলোনা যেটা আমি করিনি, কখনো মাঝরাতে উঠে এটা সেটা খেতে মন চাইছে বলে তাকে জ্বা/লিয়েছি। আবার কখনো মন ভালো না থাকলে হুটহাট তাকে ফোন দিয়ে অফিস থেকে বাসায় আসতে বলেছি। সর্বদা গম্ভীর ও সিরিয়াস লোকটাও কেমন অদ্ভুতভাবে আমার পাগলাটে চাওয়াগুলো পূরণ করতেন সবসময়। বরাবরই কেয়ারিং পূর্ণ যেন আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিলেন এক্ষেত্রে। সবসময় আমার প্রতিটা দিকে খেয়াল রাখতেন। বলতে গেলে আমার আট মাসের সময় থেকে পূর্ণ বাসাতেই থাকতেন প্রায় সময়, কখন কোন প্রয়োজন পড়ে না পড়ে সেজন্যে। যার ফলশ্রুতিতে প্রেগ্ন্যাসির নয় মাসের পুরোটা সময়জুড়ে তাকে নিজের খুব কাছে পেয়েছি আমি, যেটা প্রত্যেকটা মেয়েরই সবচেয়ে বড় চাওয়া।

তখন ছিলো বর্ষাকাল। আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। বাহিরে ভীষণ বৃষ্টি, আমার নয় মাস অতিক্রম করেছে। পূর্ণও বাসাতেই ছিলেন। ফোনে কথা বলছিলেন অফিসের কারও সাথে। জানালা দিয়ে বহমান বৃষ্টির পানি ছুয়ে দেখার বড্ড লোভ হচ্ছিলো, পূর্ণ ফোনে কথা বলায় তাকে আর ডিস্টাব দিতে ইচ্ছে হয়নি। বালিশে ভর দিয়ে খাটের কোণ ধরেই ফুলে উঠা বড়সড় পেট নিয়ে উঠে দাড়ালাম জানালার কাছে যাওয়ার জন্য। জানালার কাঁচ খুলে বৃষ্টির পানি ছুয়ে অনুভব করছিলাম চোখ বুঝে। এমন সময় হঠাৎ প্রচন্ড ব্যথা শুরু হলো পেটে। কি হতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে আওয়াজ দিতেই এগিয়ে এলেন পূর্ণ। সেই তুমুল বৃষ্টির মাঝেই আমায় নিয়ে যাওয়া হলো হসপিটালে। বৃষ্টির সাথে পৃথিবীর বুক আলো করে জন্ম নিলো আমাদের ফুটফুটে রাজকন্যা। জ্ঞান ফেরার পর সবার প্রথমে চোখে পড়ে অস্থিরমুখে পায়চারি করা পূর্ণকে। এক প্রকার হুড়মুড়িয়েই আমার কেবিনে ঢুকেছিলেন। তাকে দেখতে ক্লান্ত মুখে মলিন হাসি দিতেই আমার ঘর্মাক্ত মুখে ঠোঁট এলিয়ে ঠোঁট ছুইলেন কপালে। তৃপ্ত কণ্ঠে স্নিগ্ধ হেসে বলেছিলেন,

—ভয় পেয়ে দিয়েছিলে, স্টুপিড। না বলে উঠতে কে বলেছিলো? আমি না দেখলে কি হতো বলো?

—আমাদের মেয়ে কোথায়?

আকুল কণ্ঠে নিজের ছোট্ট প্রাণকে দেখার কথা বলতেই মৃদু হেসে “এইতো, আসছে” বলে আমার গাল টেনে দিলেন পূর্ণ। ঠিক সে সময় নার্স কোলে করে নিয়ে এলেন আমাদের বাবুকে। আমার পাশে শুয়ে দিতেই শব্দ করে কেদে উঠলো সে। বাচ্চার কান্না শুনে অশ্রুসিক্ত চোখে একে-অপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি ও পূর্ণ। জীবনটা হঠাৎ করেই যেন পরিপূর্ণ লাগছে!

মেয়ের নাম কি রাখা হবে এ নিয়ে বেশ ক’দিন ভাবাভাবি চললো। অতঃপর কিছু একটা মাথায় আসতেই ফিসফিসিয়ে আমার কানে বললেন পূর্ণ। উনার কথায় বিস্মিত হয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম আমি। অতঃপর মেয়েকে পরম স্নেহে কোলে নিয়ে আদুরে কণ্ঠে তিনি বললেন,

“যার আগমনে বৃষ্টিময় দিনে আমাদের জীবন পরিপূর্ণ হলো, আমাদের সংসারে এলো ‘পূর্ণতা’। তার জন্য এর চেয়ে যথাযথ নাম আর কিছু আছে?”

পূর্ণর কথায় ঘুমের মাঝেই হঠাৎ অবুঝ মনে হেসে উঠলো পূর্ণতা। মেয়েকে কোলে নিয়েই প্রশান্তির হাসি হাসলেন। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

—দেখেছো তোমরা? আমার মেয়ের ওর নাম পছন্দ হয়েছে। বাবার মেয়ে বাবার পছন্দেই খুশি!

পূর্ণতার আগমনে প্রকৃত অর্থেই আমাদের জীবনে বেশ কিছু পরিবর্তন এলো। পূর্ণকে এখন আর সচারাচর আগের মতো গম্ভীর দেখা যায়না, গেলেও সেটা অফিসে। বাসায় সুযোগ পেলেই তাড়াতাড়ি চলে আসেন, মেয়ের সাথে সময় কাটান। মেয়েটাও বাবাভক্ত হয়েছে। পূর্ণকে পেলে সব ভুলে যায়। পরিবারের সবাই এভাবে পূর্ণকে এতটা হাসিখুশি থাকতে দেখে দারুণ প্রফুল্ল, বিশেষ করে বড়াব্বু ও বড়াম্মু। যেই খুশি তাদের চোখেমুখে বেশ স্পষ্ট। বাচ্চাদের সান্নিধ্য পেয়ে এখন বছরের সবদিন-ই পুরো বাড়িটা ভরা ভরা লাগে!

সামনের মাসে পূর্ণতার তিন বছর হবে। এই ছোট্ট বয়সেই আধো আধো কথায় বাড়ি মাতিয়ে রাখে মেয়েটা। পূর্ণ আজ কাজ বেশি না থাকায় হাফ ডে করে বাসায় এসেছেন। ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে গেছেন, আমি মেয়েকে খাইয়ে দিয়ে বিছানায় বসে ওর সাথে খেলছিলাম। পানি খাওয়া শেষে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে খেলছিলো পূর্ণতা, ওর হাত থেকে নিতে গেলেই কেদে উঠছে সে। এমন সময় পূর্ণ বেরিয়ে এলেন ফ্রেশ হয়ে। মেয়েকে কাদতে দেখে এগিয়ে এসে কোলে তুলে বললেন,

—কি হয়েছে, মা? কাঁদছো কেন? আম্মু বকা দিয়েছে?

বাপের আহ্লাদ পেয়ে যেন আরেকটু লাই পেলো মেয়ে। কেদে কেদে বাবার কোলে মাথা রেখেই বিচার দিলো আমার নামে,

—আম্মু খেয়তে দিততেনা, বাবা। আমি এতা নিয়ে খেয়বো।

—তাই নাকি? তোমার আম্মু গ্লাস নিয়ে খেলতে দিচ্ছেনা? দাড়াও দেখছি। এই তুরফা, তুমি আমার মেয়েকে খেলতে দিচ্ছোনা কেন? আমার মেয়ে বাবার সাথে খেলবে, তাই না প্রিন্সেস?

পূর্ণতার দিকে চেয়ে ওর গালে টুপ করে চুমু খেয়ে কথাগুলো বলতেই মাথা নেড়ে বাবার সাথে খেলতে রাজি হয়ে গেলো মেয়েটা। মুহুর্তেই ওর ছোট্ট মুখের গোলগাল গালে মধুর হাসি ফুটে উঠলো। টোল পড়া মুগ্ধ হাসি দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো নিমিষেই। বাবা-মেয়ের পিরিত দেখে আমি খাবারের প্লেট নিয়ে রুম থেকে যেতে যেতে বললাম,

—বাবা-মেয়ে খেলবে ভালো কথা। কিন্তু গ্লাস থেকে পানি যেন আমার বিছানায় না পড়ে। মনে থাকবে?

—আরে পড়বেনা। আমি থাকতে চিন্তা করো কেন, তুর পাখি? আমি আছি না? তুমি নিশ্চিন্তে যাও।

মেয়েকে কোলে নিয়েই বেশ ভাবের সাথে বললেন পূর্ণ। রুম থেকে বেরিয়ে দরজার আড়াল হতে এক পলক তাদের দেখলাম আমি। দুরন্ত মেয়েটা বাবার সাথে খুনসুটিতে মত্ত। গ্লাসে হাত চুবিয়ে পানি নিয়ে উনার মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছে, পূর্ণ চোখমুখ কুচকে ফেলতেই বাবাকে দেখে সে খিলখিলিয়ে হাসছে! এটাই হচ্ছে তার খেলা। পূর্ণতার খেলার ধরন দেখে পূর্ণ বেশ বিপাকে পড়েছেন। যেকোনো মুহুর্তে বিছানা ভিজে যাওয়ার আশংকা থাকায় বারবার মেয়েকে বলছেন,

—মা, পানির গ্লাসটা এবার আমাকে দেও। অনেক খেলেছো। এভাবে বিছানায় রাখলে পানি পড়ে ভিজে যাবে তো। তখন আম্মু বকা দিবে কিন্তু।

—কিততু হবেনা, বাবা। একানেই রাকবো। আরো খেয়বো তোমার সাতে।

মেয়ের আধো আধো বুলির আদুরে কথায় নিমিষেই গলে গেলেন পূর্ণ। মেয়ের আবদারে খেলতে বসে গেলেন বিছানায় তার সাথে। কিছুক্ষণ পর পূর্ণতার হাত লেগে বিছানায় পানি পড়তেই ভড়কে গেলো বাবা-মেয়ে দুজনই। সেসময় প্লেট রেখে রুমে প্রবেশ করলাম আমি। আমায় দেখে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো ওরা দুজনে।

—বিছানায় পানি কিভাবে পড়লো, পূর্ণতা?

আমার কথায় ভারী অক্ষিপল্লব ঝাপটিয়ে কিছুক্ষণ পিটপিটিয়ে বাবার দিক তাকালো সে। অতঃপর পূর্ণ কিছু বলার আগেই বললো,

—আমি কিতু করিনি, আম্মু। বাবা পানি ফেলতে। আমার খেয়া থেত। আমি বাইয়ার কাতে যাবো।

কথাটি বলেই পূর্ণর কোল থেকে নেমে প্রান্ত ভাইয়ার রুমের উদ্দেশ্যে দৌড় দিলো পূর্ণতা। সেদিক চেয়ে এতক্ষণ চেপে রাখা হাসিটা বের হয়ে এলো আমার। হুহা করে হেসে উঠতেই থমথমে মুখের পূর্ণর দিক নজর পড়লো। মাথা চুলকে বিষন্ন মুখে বললেন,

—মেয়েটা যে এমন হলো কেন? শেষ মুহুর্তে এভাবে পল্টি মারবে আমি ভাবতেও পারিনি। কি আশ্চর্য!

—কার মতো হয়েছে বুঝতে পারেন নি? যেমন বাপ তেমন তার মেয়ে। পল্টিবাজি স্বভাবটা আপনার থেকেই পেয়েছে। এবার বুঝেন আপনি পল্টি মারলে আমার কেমন লাগে!

কথাটি বলে হেসে উঠতেই আমার দিক তেড়ে আসলেন পূর্ণ। উনি ধরার আগেই হাসতে হাসতে রুম থেকে বের হয়ে এলাম আমি!

_________________________

সময়ের ক্ষণে বর্ষাকালের আগমন পুনরায় ঘটেছে। ক’দিনের মাঝেই পূর্ণতার তৃতীয় জন্মদিন। রিনিঝিনি বৃষ্টির প্রভাবে ক্ষণে ক্ষণে ভিজে উঠছে প্রকৃতি। মেয়ে ও মেয়ের বাপ দুজনই ঘুমাচ্ছে। মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে ছাদে চলে এসেছি। ছুটির দিনের ক্লান্ত দুপুরে সবাই এই বৃষ্টিতে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু আমি এসেছি বৃষ্টিবিলাশ করতে! বহুদিন বৃষ্টিতে ভিজা হয়না। এ বৃষ্টি যে আমার বড্ড আপন!

দু’হাত মেলে ছাদের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে আকাশের দিক তাকিয়ে থাকতেই অনুভব হলো পেছনে কারও উপস্থিতি। চট করে পেছন ঘুরতেই বলিষ্ঠ বুকের সাথে ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে ব্যর্থ হওয়ায় পড়ে যেতে ধরলাম নিমিষেই। এর আগেই হাত বাড়িয়ে কোমড় জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিলেন পূর্ণ। কপালের সামনে আসা একগোছা চুল সযত্নে সরিয়ে দিয়ে মিহি কণ্ঠে বললেন,

—এভাবেই পাঁচ বছর আগে এক বর্ষায় প্রথম দেখা হয়েছিলো আমাদের, মনে আছে? মানুষ ঠিকই বলে, ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হয়। আজ প্রমাণ পেলাম!

—মনে তো আছেই। কিন্তু সেদিন আমি জানতাম না যে এই পূর্ণ এসে নিজের ভালোবাসা ও যত্নে আমার অপূর্ণ জীবনটাকে সুখে-শান্তিতে পরিপূর্ণ করে দিবে।

উনার গালে হাত রেখে মুগ্ধ চোখে তার দিক তাকিয়ে বলে উঠলাম আমি। তার প্রতি মুগ্ধতা আমার এ জীবনে শেষ হবার নয়! বৃষ্টির প্রকোপে ক্ষণে ক্ষণে কেপে উঠছে শরীর। পরম আবেশে কাছে টেনে নিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে পূর্ণ বললেন,

—তুমি আমায় না চিনলেও আমি ঠিকই চিনেছিলাম তোমায়। যার অপেক্ষায় এতগুলো বছর চাতক পাখির ন্যায় কাটিয়েছি, এক বৃষ্টিময় দিনে তাকে নিজের জীবনে ফিরে পাওয়ার অনুভূতি কিভাবে ভাষায় প্রকাশ করা যায় তা আমার জানা নেই, তুর পাখি।

—কিভাবে চিনেছিলেন আমায় আজ পর্যন্ত তো সেটাও বললেন না? আর কতদিন অপেক্ষা করবো আমি?

অভিমানী সুরে কথাটা বলতেই হালকা হেসে উঠলেন তিনি। দুর্বোধ্য কণ্ঠে বললেন,

—আরে বাবা বলছি শুনো। আমি চেয়েছিলাম তুমি কিছুটা অপেক্ষা করো যেভাবে আমি করেছিলাম। অনুভব করো অপেক্ষার প্রহর, যেভাবে আমি করেছি। তাই এতদিন বলিনি। তবে আজ নিজে থেকেই বলতে এসেছি তোমায়।

কিছুটা থেমে বললেন,

—জানো, যেদিন আমরা চাচ্চুদের এক্সিডেন্টের কথা শুনে দেশে ফিরে আসি সেদিন তোমায় দেখার জন্য কতটা ব্যাকুল ছিলাম আমি? কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস, আমরা তোমাকেই হারাই। এরপর থেকে এক সপ্তাহ কতটা পাগলের মতো খুজেছি তোমায় সেটা আমরাই ভালো জানি। এরপরে বাবা হার মেনে নিলেন, সবকিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিলেন। তোমায় খোজা বন্ধ করে দিলেন। তখন আমি সবে কলেজ পড়ুয়া এক কিশোর। মনের নতুন অনুভূতিগুলো ভীষণ টগবগে। সেদিন মশুলধারে বৃষ্টি হচ্ছিলো। আমি অনেকক্ষণ ভিজেছিলাম একা, তোমার অপেক্ষায় কিন্তু তুমি সেদিন আসোনি। তাই তোমার উপর ও বৃষ্টির উপর ভীষণ অভিমান জন্মায়। প্রিয় বৃষ্টিতে প্রিয় মানুষকে হারানোর মতো কস্ট এ পৃথিবীতে আর কিছুই নেই, বুঝেছো?
এর আগে তোমায় পছন্দ করলেও, তোমার জন্য আমার অনুভূতি ঠিক কতটা গভীর সেটা তোমায় হারানোর পর ওইদিন-ই প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম। ওইদিন প্রথমবার অনুভব করেছি, তুর পাখিকে ছাড়া পূর্ণ কতটা অসম্পূর্ণ। তবে আমার বিশ্বাস ছিলো সৃষ্টিকর্তার উপর, নিজের ভালোবাসার উপর। তোমাকে তো আমার কাছে ফিরতেই হতো, বৃষ্টিকন্যা।

পরম যত্নে আমার দু’গালে হাত রেখে ভীষণ আদুরে গলায় বলে উঠলেন তিনি। তার চোখে সদ্য প্রকাশিত অনুভূতির ঢেউ, আমার মনে এ মানুষটার প্রতি অগাধ সম্মান। এর মাঝে তিনি আবারো বললেন,

—আমি ঠিক করেছিলাম তোমায় ফিরে না পেলে আর কোনোদিন কারও প্রেমে পড়বোনা। ভালোবাসা শব্দটার অস্তিত্ব রাখবোনা জীবনে। কিন্তু সেদিন রাইসার বাসায় যেয়েই সব উলোটপালোট হয়ে যায়! বৃষ্টির মাঝে হঠাৎ তোমায় দেখে বুকের চিনচিনে ব্যথাটা জেগে উঠে মনে। ছোটবেলা থেকেই তোমার চোখজোড়া আমার ভীষণ পছন্দ, এই চোখের মায়াতেই আমি পড়েছিলাম বহুযুগ আগে। এতদিন পর পুনরায় একি অনুভূতি অন্য কারও ক্ষেত্রে হওয়ায় বেশ অবাক হই। আনমনেই তোমার চেহারার উপর থেকে চুল সরিয়ে দিতে আরেকটু চমকে যাই। চেহারা মানুষের পালটে গেলেও কিছু কিছু কখনো পাল্টেনা। তোমার গালের পাশের সেই তিলটা এখনো আগের মতোই আছে। সেটা দেখে মনের বিশ্বাস দৃঢ় হয়। এরপর ফোন বেজে উঠায় সেখান থেকে চলে যাই। বাসায় যেয়েই প্রান্তের সাথে কথা বলে রাইসার থেকে তোমার ব্যাপারে সব ইনফরমেশন নেই। এরপর তো আর সন্দেহ থাকেনা! তখন আমায় পায় কে? তোমাকে ফিরে পেয়েও এত দূর থেকে দেখা বড্ড কঠিন মনে হচ্ছিলো আমার জন্য। তাই তো রাইসার বিয়ের পর আম্মুকে বলে বাবার কানে তোমার সাথে আমার বিয়ের প্রসঙ্গ তুলি। তুমি ভেবেছিলে আমি তোমায় বিয়ে করতে চাবোনা, কিন্তু বোকা মেয়ে তুমি তো জানোনা তোমায় নিজের করে পাওয়ার জন্য আমি কতটা বছর অপেক্ষা করেছি! যে বৃষ্টির সাক্ষী শুধু আল্লাহ ও এ বৃষ্টি।

—জানিনা আপনার এতটা ভালোবাসা আমি কখনো শোধ করতে পারবো কি না? কিন্তু কথা দিন, আপনি আমায় সব সময় এতটাই ভালোবাসবেন। আমি আপনার ভালোবাসা হারাতে চাইনা, পূর্ণ। আপনি আমার জীবনকে সম্পূর্ণ করেছেন, আমার জীবনে পূর্ণতা দিয়েছেন। আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি!

—কথা দিচ্ছি, তুর পাখি। পৃথিবীর বুকে যতদিন বৃষ্টি থাকবে, তোমার আমার বৃষ্টিময় প্রেম ততদিন সতেজ থাকবে। আমি আজীবন তোমায় এভাবেই ভালোবাসবো।

পূর্ণর কথায় চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুজল। যা বৃষ্টির মাঝে ধুয়েমুছে মিশে গেলো নিমিষেই। তার বুকে মাথা গুজেই অনুভব করলাম তার পবিত্র ভালোবাসা বেশ কিছুক্ষণ। এমন সময় তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন,

“প্রহর শেষে বৃষ্টি ভেজা সেদিন আষাঢ় মাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ”

—ওয়াও! আপনি দেখি এ প্রবাদটাকে নতুন একটা রুপ দিলেন।

—হু! এটা আমাদের ভার্সন। তোমার আমার প্রেমটা যে বৃষ্টিময় প্রেম। আমাদের প্রণয়ে বৃষ্টি ছাড়া অন্য কিছু মানায় নাকি?

—উহু, একদম না।

এভাবেই কেটে গেলো আরও কিছুক্ষণ। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে গেলাম দুজনে। একে-অপরের চোখে চেয়ে পরস্পরের সান্নিধ্যে অনুভূতিরাও মিলিত হলো নীরবে। এমন সময় ছাদের দরজার ও-পাশ থেকে গলা খ্যাকারি দিয়ে প্রান্ত ভাইয়া বলে উঠলেন,

—এই যে, ভাইয়া-ভাবী। তোমাদের বৃষ্টিময় প্রেম শেষ হলে এবার নিচে এসো? পূর্ণি উঠে গেছে। আম্মু যাবো বলে কাদছে।

—ছাড়ুন, মেয়ে কাদছে।

প্রান্ত ভাইয়া চলে যেতেই পূর্ণকে ছেড়ে দিতে উদ্যত হলাম আমি, কিন্তু উনি তবুও ছাড়লেন না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আরেকবার পরম আবেশে জড়িয়ে ধরে ভেজা চুলে মুখ গুজে চুমু খেলেন। অতঃপর নিজেই দূরে সরে গিয়ে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,

—আহহা, তুমি দেখি অনেক দুস্টু হয়ে গেছো, তুরফা রানী। বিয়ের এতদিন হয়ে গেলো তাও আমায় একা ছাড়তেই চাওনা এখনো। এতক্ষণ ভিজলে তো ঠান্ডা লেগে যাবে। ওদিকে আমাদের মেয়েটা যে কাদছে, সেদিকে হুশ আছে তোমার? ভেরি ব্যাড, তুর পাখি!

ভেজা শরীরে হাসতে হাসতেই পূর্ণর সাথে এগিয়ে চললাম। কিছু কিছু জিনিস কখনো পাল্টায় না, পরিবর্তনশীল এ পৃথিবীর হাজারো পরিবর্তনের ভীড়ে আগের মতোই ভালোবাসায় মুড়ানো ও প্রাণোচ্ছল থাকে। ঠিক যেমন পূর্ণর ভালোবাসার বিশুদ্ধতা, আমাদের বৃষ্টিময় প্রেমের পরিপূর্ণতা!

(সমাপ্ত)

[ অবশেষে সমাপ্তি ঘটলো দীর্ঘদিনের এ যাত্রার! কল্পনাময় এ ভালোবাসার উপন্যাস অনেকের কাছেই ভালো লাগবে, আবার অনেকের কাছেই এটা নিছক এক সিরিয়াল মনে হবে। লেখালেখির জগতে আমি সবেমাত্র প্রবেশ করেছি, তাই প্রথম লেখায় অজস্র ভুল-ত্রুটি থাকবে যা খুবই স্বাভাবিক। তবুও গল্পটা এতদূর এগোতোনা যদি পাঠকরা পাশে না থাকতেন। তাই যারা ধৈর্য ধরে এতদিন গল্পটার অপেক্ষা করেছেন, আমার পাশে থেকেছেন তাদের প্রতি অজস্র ভালোবাসা। যাদের কাছেই গল্পটি ভালো লেগেছে, আজ শেষবারের মতোন গল্পটা সম্পর্কে আপনাদের অনুভূতি আমায় জানাবেন। ভালোবাসা অবিরাম ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here