বেদনার_রঙ_নীল পঞ্চাশতম পর্ব

0
352

#বেদনার_রঙ_নীল
পঞ্চাশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

স্নিগ্ধ সকাল। রাইফা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ভেজা চুলে রোদ মেখে নিচ্ছে। এমন সময় দরজায় খটখট শব্দ হলো। রাইফার মনে হয়, অনেকক্ষণ ধরেই দরজায় এই শব্দটা হচ্ছিল৷ সে এতোক্ষণ বাথরুমে ছিল বিধায় টের পায়নি। দ্রুত পায়ে হেঁটে দরজা খুলতে যাওয়ার সময় বিছানায় ঘুমন্ত অবস্থায় রিসবকে দেখা গেল। খালি গায়ে বুকের উপর ভর দিয়ে বিভোর হয়ে ঘুমাচ্ছে সে। এক চিলতে রোদের আলোয় তাকে খুব নিষ্পাপ দেখাচ্ছে৷ রাইফার ইচ্ছে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেয়ে থাকতে। দরজা খোলার তাড়া না থাকলে সে তাই করতো।

মিষ্টি হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। রাইফা স্তব্ধ প্রায়। মিষ্টির চেহারা অশ্রু ভেজা। চোখ দু’টি ফুলে লাল। মনে হচ্ছে সে ভয়ংকর কোনো দুঃসংবাদ শুনে এসেছে। একটু ধাতস্থ হতেই বলল,” রিসব কোথায়? রাইফা, রিসব কোথায়?”

থতমত খাওয়া কণ্ঠে রাইফা উত্তর দিল,” ঘুমাচ্ছে, আপু। কেন?”

মিষ্টি রুদ্ধশ্বাসে বলল,” ওকে ঘুম থেকে তোলো৷ আমাদের এখনি বের হতে হবে।”

” কোথায়?”

” হসপিটালে।”

রাইফা অস্থিরচিত্তে জিজ্ঞেস করল,” অজান্তা আন্টির কিছু হয়েছে?”

” না। ছোটমা ঠিকাছে। কিন্তু প্রণয় আর তুলি কালরাতে বাড়ি ফেরেনি।”

রাইফা আৎকে উঠল। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে উচ্চারণ করল,” কি? ওরা কোথায় ছিল?”

” জানি না। হসপিটাল থেকে ফোন এসেছে। প্রণয়কে হোটেলের বাথরুমে আহত অবস্থায় পাওয়া গেছে।”

রাইফা যেন দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলল। কপালে হাত রেখে স্তব্ধচিত্রের মতো বলল,” ওহ মাই গড।”

চেতনা ফিরে পাওয়ার পর থেকে ডাক্তার, নার্স সকলকে একটি প্রশ্ন করেই পাগল করে তুলছে প্রণয়। তার প্রশ্নটি হলো,” তুলি কোথায়?”

হোটেলের বাথরুমে তাকে ছাড়া অন্যকাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই বিষয়ে তাকে অসংখ্যবার অবগত করার পরেও সে মানতে নারাজ। মিষ্টিরা হাসপাতালে এসে প্রণয়কে খুঁজে পেল না। কারো অনুরোধ তোয়াক্কা না করেই সে বহু আগে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেছে। তার প্রধান উদ্দেশ্য তুলিকে খুঁজে বের করা। সবাই অস্থির হয়ে উঠল দুশ্চিন্তায়। অসুস্থ শরীর নিয়ে প্রণয় কোথায় চলে গেল? তুলিটাই বা কোথায়?
____________
তিনদিন কেটে গেছে। এই তিনদিনে এমন কোনো মুহূর্ত নেই যে মুহূর্তে তুলি চোখের পানি ফেলেনি। শেফালী নামের একজন রুক্ষভাষী মহিলা তুলিকে দেখা-শোনার জন্য চব্বিশ ঘণ্টা পাশেই থাকছে। তুলিদের গ্রামেরই সে। অতীতে একবার তার চোখে ধুলো দিয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছিল তুলি। সেই ঘটনার প্রতিশোধ এখন সে নিচ্ছে ভিন্নভাবে। তুলিকে সর্বক্ষণ কড়া পাহারায় রেখেছে। তুলি বাথরুমে গিয়ে পাঁচমিনিট দেরি করলেও শেফালী দরজা ভাঙার ব্যবস্থা করে। যদি আবার ভেন্টিলেটর দিয়ে পালিয়ে যায়! এই পর্যন্ত অনেক বার তুলি শেফালীর হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করেছে। বলেছে,” শেফালী আপা, আমায় ছেড়ে দাও। আমার কষ্টটা কি তুমি বুঝতে পারছো না? তুমিও তো একজন মেয়ে।”

শেফালী রুক্ষ গলায় বলেছে,” আগের বার আমার পাছায় লাথি মেরে পালায় গেছিলা। তখন কম অত্যাচার সহ্য করি নাই। ওহন তুমি আবার পালাইলে আমি খতম হয়া যামু।”

” কেন এদের সাথে কাজ করো তুমি? ভালো কাজ করতে পারো না?”

” ভালো কইরা কি হইবো? আগে তো ভালো কামই করতাম। কিন্তু ভালো চলতে পারতাম না। এখন খারাপ কাম করলেও ভালোমতো চলি।”

” আমি কথা দিচ্ছি, আমি তোমাকে ভালো কাজ দিবো। অনেক টাকা দিবো। জানো, আমার স্বামী অনেক বড়লোক।”

” জানি সবই। কিন্তু কিছু করার নাই। তোমারে পালাইতে দিলে আমার মরণ নিশ্চিত। আমারে এসব অনুরোধ কইরা লাভ নাই। আমি কিছু করতে পারুম না।”

তুলি সারাদিনই কপাল চাপড়ে কাঁদে। খাওয়া-দাওয়া সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু তাতে দয়া হয়নি কারো। অন্ধকার গহ্বরের মতো বাড়িটিতে আর কিছুদিন এভাবে বন্দী থাকলে হয়তো দম আটকেই মরে যাবে তুলি। শারীরিক দূর্বলতার কারণে সে বিছানা ছেড়েও উঠতে পারে না। ভাবতে অবাক লাগে, এভাবেই কি শেষ হবে জীবন? তার মৃত্যুটা কি তবে এই বিছানাতেই হবে? শেষ বারের মতো প্রণয়কে দেখতেও কি পারবে না সে? হায়, কত কথা বলার ছিল তাকে। কত স্বপ্ন দেখার ছিল তার সাথে। কত সময় কাটানোর কথা ছিল তাকে নিয়ে। সব অপূর্ণই থেকে গেল। কখনও মুখ ফুটে তুলি বলতে পারল না, সে প্রণয়কে কি ভীষণ ভালোবাসতো!

মাঝরাতে আজমীর এলো। তুলি বিছানায় শুয়েছিল। ধরাম শব্দে দরজা খুলে যায়। তুলি আৎকে উঠে। শোয়া থেকে উঠে বসতে চায়। কিন্তু নড়তেও পারে না। মাথা চক্কর দিচ্ছে। অন্ধকারেও চোখে ঝাপসা দেখতে পায়। অজস্র কিছু ধোঁয়াটে রেখা যেন জমাট বেঁধে আছে দৃষ্টিসীমায়। তুলি বিছানার চাদর খামচে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদল। নেশাগ্রস্ত আজমীরকে অবচেতন দেখায়। হেলে-দুলে সে তুলির সামনে এসে বসল। তুলি আর্তনাদ করে বলল,” আমাকে ছেড়ে দাও। প্লিজ, যেতে দাও আমাকে। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও।”

তুলির আর্তনাদ আজমীর কানে তোলে না। তার বুকভাঙা কান্না দেখেও দেখে না। সে কেবল তাকিয়ে থাকে তুলির ছিপছিপে নরম দেহের ফরসা ভাঁজে। চকচক করে তার চোখের দৃষ্টি। তীব্র কামনার আকর্ষণে শরীরে শিহরণ তৈরী হয়। আজমীরের দানবীয় হাতের স্পর্শ পেতেই শিউরে উঠল তুলি। তার চিৎকারে কেঁপে উঠে দালানের প্রতিটি কণা। সীমাহীন এই বর্বরতার বিরুদ্ধে যেন আন্দোলন করছে সারা ভবন।

___________

মাসের পর মাস কেটে যায়। কিন্তু তুলির হদিশ মেলে না। আজমীরও লাপাত্তা। প্রথমদিকে প্রণয় দিন-রাত এক করে হন্যি হয়ে তুলিকে খুঁজতো। তবে আজ-কাল সে বড় অসাড় হয়ে পড়েছে। দিনের বেশির ভাগ সময়টা বাইরেই কাটায়। কিন্তু ঘরে এলে নিশ্চুপ মূর্তির মতো হয়ে যায়। কারো সঙ্গে কথা বলে না। তার আচরণ গম্ভীরের চেয়েও গম্ভীরতর। রাইফাও বিষয়টা লক্ষ্য করেছে। ইদানীং প্রণয়ের সাথে কথা বলতে তার ভয় লাগে। প্রণয়ের সামনে দাঁড়াতেও ভয় লাগে। তুলির হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি সে নিজেই এখনও মেনে নিতে পারেনি। সেখানে প্রণয়ের কি অবস্থা হওয়ার কথা? এসব ভাবতেও রাইফার হাহাকার লাগে। আজ সকালেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। প্রণয়ের ঘরের পাশ দিয়ে রাইফা যাচ্ছিল। তখন খেয়াল করল প্রণয় কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। রাইফা অবাক হয়ে ঘরে ঢুকতেই প্রণয় রেগে বলল,” আপনি কে?”

রাইফার হাউমাউ করে কান্না পেয়ে গেল। মুখ চেপে এক দৌড়ে সে নিজের ঘরে চলে এলো। রিসব তার অবস্থা দেখে অবাক। প্রশ্ন করতেই রাইফা বলল,” প্রণয় খুব অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। একা একা কার সঙ্গে যেন কথা বলছিল। আমি ঘরে ঢুকতেই আমাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করল। আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না রিসব।”

রিসবকে আশাহত এবং ক্লান্ত দেখায়। রাইফার মাথাটা বুকে নিয়ে সে সান্ত্বনার সুরে বলল,” প্রণয়ের সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে কথা হয়েছে। তার কাউন্সিলিং প্রয়োজন। কিন্তু মা আর মিষ্টি আপু তো ওকে হাসপাতালে দিতে রাজিই হচ্ছে না।”

রাইফা রাগী গলায় বলল,” আমিও রাজি না। তুলি এলে প্রণয় এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। ওকে হাসপাতালে পাঠানোর কোনো প্রয়োজন নেই।”

” আর যদি তুলি কখনোই না আসে?”

রিসবের নিষ্ঠুর প্রশ্নে রাইফা ক্ষেপে গেল। রিসবকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল,” কেন আসবে না? তুলি নিশ্চয়ই আসবে। ওর কোনো ক্ষতি হয়নি। বুঝেছো তুমি? ওর কিছু হয়নি। ও আবার ফিরে আসবে।”

রিসব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” আচ্ছা স্যরি, তুলি আবার ফিরে আসবে।”

রাইফা একদিন প্রণয় আর তুলির ঘর গোছাতে এসে তুলির ব্যবহৃত ওয়্যারড্রোব আর পড়ার টেবিল ঘেঁটে কিছু ব্যক্তিগত জিনিস উদ্ধার করল। কিছু জিনিস সে নিজের কাছে রাখে। আর কিছু জিনিস প্রণয়কে দিবে বলে ঠিক করে। তার মধ্যে বিশেষত একটা ডায়েরী ছিল। সেই ডায়েরীতে তুলির প্রায় একশোটির মতো অপূর্ণ ইচ্ছের কথা লেখা। রাতে প্রণয় বাড়ি ফিরলে রাইফা সেই ডায়েরীটা প্রণয়ের হাতে তুলে দেয়। প্রণয় ঘরে এসে দরজা আটকেই ডায়েরী খুলে বসে। পর্যায়ক্রমিকভাবে ভেসে ওঠে তুলির ফেলে যাওয়া অপূর্ণ ইচ্ছেগুলোর কথা।

ইচ্ছে নাম্বার- ১: আমি একদিন অনেক বড়লোক হবো। আমার বাবার চেয়েও দ্বিগুণ টাকা থাকবে আমার।

ইচ্ছে নাম্বার- ২: বড়লোক হওয়ার পর আমার প্রথম কাজ, বাবাকে খুঁজে বের করা। তিনি কোথায় আছেন? নিশ্চয়ই সুখে আছেন। কিন্তু আমি তাকে সুখে থাকতে দেবো না৷ সে আমার মায়ের খুনী! তিলে তিলে মায়ের আত্মাকে হত্যা করেছে সে। আমার দেখা সবচেয়ে বর্বর পুরুষ, আমার বাবা।

ইচ্ছে নাম্বার- ৩: মায়ের নামে একটা বৃদ্ধাশ্রম খুলবো।

ইচ্ছে নাম্বার- ৪: আমি চাই, বাবা যেভাবে আমাকে আর মাকে অবহেলা করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ঠিক সেভাবেই একদিন তাকেও তার ছেলে-মেয়েরা বাড়ি থেকে তিরস্কার করবে। সে হয়ে পড়বে সম্বলহীন। তখন আমি তাকে মায়ের নামে তৈরী করা সেই আশ্রমে ঠাঁই দিবো। শেষ বয়সে তার মৃত্যু হবে অনুশোচনায়। এটাই তার একমাত্র শাস্তি।

প্রণয়ের দিন কেটে যায় তুলির ইচ্ছেগুলো পড়তে পড়তে। তারপর একদিন হঠাৎ করেই তার আজমীরের একজন সহযোগীর সাথে দেখা হয়। প্রণয়কে দেখেই সে উল্টোদিকে দৌড়ে পালাতে নিচ্ছিল। তাই দেখে প্রণয়ের সন্দেহ হয়৷ তারপর মনে পড়ে যায় এই ছেলেটিকে অনেকবার আজমীরের সাথে দেখেছে সে। একে ধরলেই আজমীরের কাছে পৌঁছানো যাবে। প্রণয় তাকে ধাওয়া করতে শুরু করে। তারপর শেষমেষ ধরে ফেলল। রাস্তার মাঝেই ধুমধাম তাকে মারতে শুরু করলে সে গড়গড় করে বলে দেয় সবকিছু। প্রথমেই উঠে আসে তৈমুরের নাম। তৈমুর নামের একটি লোককে বেশ কিছুদিন আগে চুরির অভিযোগ প্রণয়দের বাড়ি থেকে পুলিশে দেওয়া হয়েছিল৷ প্রণয় ভাবে এই ঘটনাটি কেবলই কাকতালীয়। কিন্তু এখন বোঝা যায়, সবই পরিকল্পিত। প্রণয় দ্রুত আজমীরের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল। ছেলেটি তখন বলল,” আজমীর বাংলাদেশে নেই। ইউরোপের একটি দেশে গা ঢাকা দেয়ার উদ্দেশ্যে পালিয়ে গেছে। ”

” তাহলে তুলি কোথায়?”

প্রণয়ের এই প্রশ্ন শুনেই ছেলেটি চুপ হয়ে যায়। প্রণয় শক্ত হাতে তার চোয়াল চেপে ধরল। তখন দম আটকে আসা গলায় সে বলল,” তুলি বেঁচে নেই।”

বাক্যটি শোনা মাত্রই প্রণয়ের বাহুর সমস্ত শক্তি ক্ষয়ে গেল৷ নিশ্চল হয়ে পড়ল শরীর। ছেলেটি ছাড়া পেয়েই ছুটে পালায়। কিন্তু প্রণয় নিথরের মতো বসে পড়ে রাস্তার মাঝে। মুহূর্তেই যেন অন্ধকারে ছেঁয়ে যায় সবকিছু। পুরো পৃথিবীটা লাগে নিস্তব্ধ, নীরব।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here