আজ_রিক্তার_মৃত্যুবার্ষিকি #পর্বঃ- দুই (০২)

0
336

#আজ_রিক্তার_মৃত্যুবার্ষিকি
#পর্বঃ- দুই (০২)

‘ সাজু ভাই ‘ নামটা আমি রিক্তার মুখে অনেকবার শুনেছি। রিক্তা বলতো সাজু নামের একটা ছেলে আছে তাদের এলাকায়। যিনি সবসময় রহস্যের গন্ধ শুঁকে দেশের প্রতিপ্রান্তে ঘুরে বেড়ান৷ এমনকি ঢাকা থাকতে সে একবার এই লোকটার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।

বাদল বললো,
– কে খবর দিছে জানি না, আমাকে বললো বাদল চাচি আম্মা কোথায়?

বাদল আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু রিক্তার বাবার হাতের ইশারায় চুপ করে রইল। পরক্ষণেই তার পিছনে সাজু ভাই এসে দাঁড়ানোর শব্দ পেল। বাদল বুঝতে পারলো সাজুকে দেখেই তাকে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে।

সাজু ভাই এসে বললো,
– চাচা আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন?

– ওয়া আলাইকুমুস সালাম, আমি ভালো আছি। তোমার কি খবর, হঠাৎ এই অসময়ে?

– চাচির জন্য আসলাম, চাচি আমাকে অনেকবার কল দিছিল।

রিক্তার বাবার ভ্রু কুচকে গেল। তিনি এ পলক বাদলের দিকে তাকিয়ে আবার সাজু ভাইয়ের দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন,

– তোমার চাচি কল করেছে অনেকবার?

– হ্যাঁ চাচা, আমি আবার এশার নামাজের সময় মোবাইল মিউট করে তারপর মসজিদে গেছিলাম। কিন্তু নামাজ পড়ে বের হয়ে মোবাইলে আর হাত দেওয়া হয় নাই। বাজারের মধ্যে কতক্ষণ ঘুরলাম, তারপর বাজার থেকে বাড়িতে গেলাম, ডিনার শেষ করে দাদুর কাছে বসলাম। তারপর যখন বাবার কাছে কল দেবো তখন মোবাইল বের করে দেখি চাচির এতগুলো কল।

একদমে কথাগুলো শেষ করে একটু থামলো সাজু ভাই। রিক্তার বাবা বললেন,

– তারপর তোমার চাচি কি বললেন?

– চাচির সঙ্গে তো কথা হয় নাই যে চাচি আমাকে কিছু বলবে। আসলে এতগুলো কল দেখে আমি তো অবাক হয়ে গেছি। ভাবলাম বিশেষ জরুরি কিছু কথা নিশ্চয়ই আছে নাহলে চাচি আম্মা তো এতবার কল দিবে না। কারণ চাচি একবার কল দিলেই আমি রিসিভ করতে না পারলেও পরে অবশ্যই কলব্যাক করি।

সাজু ভাই আর রিক্তার বাবার কথোপকথন চলছে। আমি শুধু সাজু নামের লোকটার দিকে তাকিয়ে আছি। এই লোকটাকে অছিলা করে আল্লাহ হয়তো আমাকে বাঁচিয়ে দিতে পারেন। আর সাজু ভাইকে আমার শাশুড়ী কল দিয়েছে সেটা শুনেই বুঝতে পরলাম যে আমাকে বাঁচানোর জন্যই তিনি হয়তো সাজু ভাইকে ডেকেছে।

সাজু ভাই আবার বললেন,

– ভাবলাম সরাসরি বাড়িতেই চলে আসি। তাছাড়া বিকেলে শুনলাম রিক্তার হাসবেন্ড এসেছে তাই তার সঙ্গেও একটু দেখা করে যাবো।

রিক্তার বাবা বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন। তবে হাত দিয়ে আমার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বললেন,

– এর নাম সাজু, আমি চেয়ারম্যান হবার আগে ওর দাদুই আমাদের এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন।
আর সাজু, এই হচ্ছে আমাদের রিক্তার স্বামী শেখ সাব্বির।

সাজু ভাই আমার দিকে তার হাতটা বাড়িয়ে দিল। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। তার হাতে হাত রেখে তাকিয়ে রইলাম।
সাজু ভাই বললেন,

– আশা করি ভালো আছেন, রিক্তার মৃত্যুর চার বছর পর এলেন। দেখে ভালো লাগছে।

আমি বললাম,
– আপনি কেমন আছেন?

– জ্বি আলহামদুলিল্লাহ। আপনার কি জরুরি কোন কাজ আছে? যদি না তাহলে আমার সঙ্গে যেতে পারেন। চাচি আম্মার সাথে কথা শেষ করে আমি একটু নদীর পাড়ে যাবো।

আমি বেশ উত্তেজিত হয়ে বললাম,
– না না কোনো কাজ নেই, আপনার সঙ্গে কথা বলতে পেরে অনেক ভালো লাগছে। তাছাড়া সেই বিকেল থেকে একা একা বসে আছি, কারো সঙ্গে গল্প করার মতো সুযোগ হচ্ছিল না।

রিক্তার বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন,
– এখন এই রাতে নদীর পাড়ে কেন সাজু? কালকে সকালে এসে তারপর নাহয় নিয়ে যাবে। সাব্বির এখন বিশ্রাম করুক।

আমি বললাম,
– আব্বা আমার কোনো সমস্যা নেই। আপনি চিন্তা করবেন না। তাছাড়া শহরে বসে আমি তো রাত তিনটার আগে কখনো ঘুমাইনা।

– এটা শহর নয় গ্রাম। কখন কোন অঘটন ঘটে যায় বলা যায় না। আমরা রাজনীতির সাথে জড়িয়ে মানুষ। চারিদিকে আমাদের শত্রুর অভাব নেই।

– মাঝে মাঝে দুরের শত্রুর চেয়ে নিজেদের মধ্যে কিন্তু শত্রু কম থাকে না আব্বা। তাই শত্রুর ভয় করে আরে কি হবে, মৃত্যু কপালে থাকলে কেউ তো আটকাতে পারবে না তাই না?

আমার কথা শুনে রিক্তার বাবা আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তখন আমার মনে হলো হয়তো একটু বেশি বলে ফেলেছি। সাজু ভাই বললেন,

– ভাই আপনি বসুন আমি বরং চাচি আম্মার সঙ্গে কথা বলে আসি। কেন ডাকলেন সেটা শুনে আসি।

বাদল পিছন থেকে বললো,
– চাচিমা ঘুমিয়ে গেছে। সন্ধ্যা থেকে তার শরীরটা খারাপ তাই সকাল সকাল ঘুমিয়ে গেছে।

– কি বলো, তাহলে তো দেখতেই হয়। চলো আমার সঙ্গে, আমি ডাকলে উঠবে সমস্যা নেই।

– আহ সাজু, কেন রাতদুপুরে এরকম করছো বলো তো? একজন অসুস্থ তাকে ডেকে কথা বলতে চাইছো। আরেকজন ক্লান্ত তাকে নিয়ে নদীর পাড়ে যেতে চাইছো, কি ব্যাপার বলো তো।

– কোনো ব্যাপার নেই, আপনি রাগ করছেন চাচা?

– না না রাগ করবো কেন? এমনিতেই নিজের ছেলের মতো করে বললাম।

– তাহলে ছেলেকে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে দিতে চাইছেন না কেন?

বাদল বললো,
– সাজু ভাই চলেন আমার সঙ্গে। চাচা আপনি কি চা খাবেন আরেক কাপ?

– নাহ।

সাজু ভাই ও বাদল চলে গেল। আমিও ভিতরে যাবার জন্য পা বাড়ালাম। রিক্তার বাবা বললো,

– বাবা তুমি বসো, সাজু তোমার শাশুড়ীর সঙ্গে কথা বলে আসুক তারপর যেও একসঙ্গে।

আমি আবার বসলাম। সাজু ভাই কাছারি ঘর পেরিয়ে বাড়ির ভিতর চলে গেলেন। আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। নিজের বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছি।

আমার শশুর বললো,
– বেশি দেরি করবে না। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। সাজু ছাড়া অন্য কেউ হলে কিছুতেই তোমাকে যেতে দিতাম না। সাজু খুব ভালো একটা ছেলে, ওর অনুরোধ যে কেউ রাখতে চায়। তাছাড়া আমি যখন চেয়ারম্যান হলাম তখন সাজুর দাদা বোরহান কাকা আমাকে সাহায্য করেছেন। তিনি না হলে আমি কোনদিনই পরপর দুবার চেয়ারম্যান হতে পারতাম না।

ভাবলাম আমার কিছু বলা দরকার।
বললাম,
– এখন বর্তমান চেয়ারম্যান কে? আপনি এবার নির্বাচন করেন নি?

– করেছিলাম কিন্তু হেরে গেছি। স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিল আরেকজন, তার কারণেই হেরে গেছি। আচ্ছা তোমার শাশুড়ী কি তোমাকে কিছু বলেছে?

– কোন বিষয়?

– না কিছু না। আচ্ছা এবার বলো তো আলফাজ নামের যে ছেলেটাকে নিয়ে তোমার আর রিক্তার মধ্যে ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই আলফাজ কে? তোমার বন্ধু নিশ্চয়ই, কিন্তু কেমন বন্ধু?

আমি খানিকটা নড়েচড়ে বসলাম। আলফাজের কথা উঠে এসেছে, তারমানে রিক্তার বাবা অনেক কিছু জেনে ফেলেছে।

– আব্বা আলফাজ সাহেব রিক্তার বান্ধবী সুরমা নামের একটা মেয়ের বড়ভাই।

– খুলনার খালিশপুরের সেই মেয়েটা?

– জ্বি বাবা।

– তার সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব কীভাবে হলো? তুমি কি তাকে আগে থেকে চিনতে নাকি?

– না চিনতাম না না। তার সঙ্গে আমার সেরকম কোনো সম্পর্ক ছিল না। রিক্তাই তার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিছিল।

– সেটা কি তোমরা নাটোর থেকে ঢাকা আসার পর না আগে?

– ঢাকা আসার পর।


” স্যার ”

ডায়েরির পাতা থেকে দৃষ্টি উঠালেন মাহবুব আলম। পরপর দুবারের নির্বাচিত সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ জুলফিকার মৃধার একমাত্র মেয়ের হাসবেন্ড সাব্বির শেখের খুনের তদন্ত মাহবুব আলমের উপর।

দারোগা মাহবুব আলম বললেন,
– কি হয়েছে রমজান?

– সাজু এসেছে, আপনার সঙ্গে দেখা করতে।

– আজ কতো তারিখ রমজান?

– ২৩ অক্টোবর, কেন স্যার?

– তারমানে চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়ের হাসবেন্ড এই ডায়েরি লিখেছেন যেই রাতে সে মারা গেছে সেই রাতেই।

– মারা গেছে নাকি ওই চেয়ারম্যান খুন করেছে?

– এখন পর্যন্ত যতটুকু লেখা পড়লাম তাতে তো চেয়ারম্যানের উপরই সন্দেহ আছে।

– তাহলে স্যার আমাদের সন্দেহ ঠিক আছে।

– কিন্তু আমার তো মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে।

– কেন স্যার?

– বোরহান সাহেবকে চিনো না তুমি?

– জ্বি স্যার চিনি তো।

– ওনার নাতি সাজু সেই রাতে চেয়ারম্যানের বাড়িতে গিয়েছিল। তাহলে তারপরও কীভাবে ছেলেটাকে খুন করলো সে?

– স্যার চলেন সাজুর সঙ্গে কথা বলেন।

মাহবুব আলম সাজুকে প্রথম যে প্রশ্নটা করলো সেটা হচ্ছে,
” আপনার সঙ্গে সেই রাতে চেয়ারম্যানের মেয়ের হাসবেন্ড সাব্বির কিছু বলেছিল? কেউ তাকে মারতে চায় বা এরকম কিছু বলেছে? ”

– না তো, কেন কি হয়েছে?

– আপনাকে একটা ডায়েরির কথা বলেছিলাম না? যেটা সাব্বির যে ঘরে খুন হয়েছে সেই ঘরের মধ্যে আমরা পেয়েছিলাম।

– হ্যাঁ মনে আছে, পড়েছেন আপনি?

– হ্যাঁ পড়লাম, সেখানে সাব্বির লিখেছে তার শশুর তাকে খুন করতে চায়। আর সে পালানোর জন্য পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে।

– সেটা কীভাবে সম্ভব? আমি তো সেই রাতে তাকে আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে যাবার জন্য বারবার অনুরোধ করলাম। কিন্তু সে রাজি হচ্ছিল না। সে ইচ্ছে করেই চাচার বাড়িতে চলে গেলে। যদি সেরকম কিছু হতো তাহলে আমি আমার সঙ্গে যাবার প্রস্তাব দেবার পরও কেন গেল না?

– বুঝতে পারছি না।

– সাব্বিরের সাহেবের লাশের ছবিগুলো একটু আরেকবার দেখান তো আমাকে।

– আরেকটা কথা সাজু সাহেব।

– জ্বি স্যার বলেন।

– নদীর পাড়ে যাবার আগে চেয়ারম্যান সাহেবের স্ত্রীর সঙ্গে যখন কথা বলতে গেলেন তখন তিনি কিছু বলেছেন?

– না তো।

– আশ্চর্য, তিনিও বলেন নাই যে সাব্বিরকে খুন করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।

– না বলে নাই, কেন চাঁচি কি জানতো নাকি।

– আপনার চাচির সঙ্গে কথা বলতে হবে। মহিলার মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে।
.

.
চলবে…

লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here