সায়র #পর্ব_০৪

0
240

#সায়র
#পর্ব_০৪
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

ফ্রন্ট সিটে জাওভান আর উজান বসে আছে। উজান ড্রাইভ করছে। আয়াত আর কিরণ পেছনের সিটে বসে সেলফি তুলছে, খাচ্ছে। লুকিং গ্লাসে জাওভান বারবার কিরণকে চোখ রাঙাচ্ছিল, আয়াত মেয়েটার থেকে এক হাত দূরত্বে বসতে। হু কেয়ারস? জাওভানর চোখ রাঙানি দেখে কিরণ ভেংচি কাটে, নয়তো চোখ টিপ মারে। ব্যাপারটায় কিরণ খুব মজাই পাচ্ছে।

আর আয়াত আড়চোখে বেশ কয়েকবার উজানকে দেখছিল। এই যে পেছনে তারা এতো হৈ হুল্লোড় করছে এতে উজানের যেন কোনো মাথা ব্যথা নেই। সে একমনে গাড়ি চালাচ্ছে। এই লোকটা এত নিরামিষ কেন? পেছনে যে একটা সুন্দরী মেয়ে আছে সেই খেয়াল একদমই নেই। সুন্দরীর কথা মনে করতেই আয়াত একটু লাল হলো। তার পৃথিবীতে সে নিজেকেই বিশ্বসুন্দরী মনে করে। আর করবেই না কেন? স্কুল কলেজ লাইফে সে দিনে কয়টা প্রপোজ পেত তা গুণেও শেষ করা যেত না। সে ছিল প্রত্যেকের ক্রাশগার্ল। রাস্তা দিয়ে গেলে ছেলেদের চোখ তার থেকে সরতো না। আবার কলেজের টিচাররাও যে কতবার প্রপোজ করেছিল! বলতে নেই, এইজন্য সে মনে মনে প্রচুর অহংকার করে। তবে তাই বলে সে তো কখনো কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। তার আচরণ ছিল অমায়িক। তাহলে এই ছেলেটার এত অহংকার কেন? নিজেকে বিশ্ব হ্যান্ডসাম মনে করে দেখে কি সামান্য ভদ্রতা দেখানোও পাপ? ঢং যতসব! আয়াত উজানকে জিভ বের করে ভেংচি কাটলো একটা।

গাড়ি থেকে নামার পর জাওভান গিয়ে কিরণের পাশের দরজা খুলে দিলো। কিরণ বেরোলে জাওভান তাকে গাড়ির সাথে চেপে ধরে। কন্ঠে ক্রোধ ঢেলে চাপা গলায় বলে,

‘বারণ করেছি না যার তার সাথে এত মিশতে? আমার বারণ উপেক্ষা করে আবার আমাকেই ভেঙাচ্ছিলে? এত সাহস কোথ থেকে আসে তোমার?’

কিরণ দুপাশ থেকে জাওভানের হাত সরিয়ে দেয়। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,

‘আপনার সবকিছু নিয়েই সিনক্রিয়েট করা লাগে? বললাম না এটা আপু হয়। বাড়িওয়ালার মেয়ে।’

‘ওর পুরো ডিটেইলস আমাকে দিবে। পাই টু পাই।’

কিরণ গুরুত্বহীন গলায় বলল,

‘আচ্ছা আচ্ছা দিবো দিবো। এখন সরো।’

‘ওয়েট।’

বলেই জাওভান কিরণের কপালে চুমু এঁকে দিলো। কিরণ বিরক্তি নিয়ে তাকায়। তারপর জাওভানকে ঠেলে দিয়ে সরে আসে।

আয়াত অপেক্ষা করছিল কখন গাড়ির মানুষটা বেরিয়ে এসে বায় বলবে। অন্তত এই ভদ্রতাটুকু আয়াত আশা করছিল। যখন দেখল তার আশায় পানি ঢেলে উজান বেরোচ্ছে না, তখন সে নিজেই গাড়ির জানালায় গিয়ে বলল ভদ্রতার খাতিরে বলল,

‘লিফট দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আসুন না, আজ আমাদের সাথে ডিনারটা করে যান।’

আয়াতকে অপমানের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে উজান তার দিকে ফিরল পর্যন্তও না, উত্তর তো কোন ছাড়। কিরণ এসে বাঁচিয়ে দিলো ও’কে।

‘ওদের ডিনার অনেক আগেই কমপ্লিট হয়েছে আপু।’

আয়াত জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘ওহ আচ্ছা। তাও, একবার আসলে ভালো হতো…’

জাওভান গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে শুধু এইটুকু বলল,

‘নো থ্যাংকস।’

তারপর কিরণকে ইশারা দিলো ভেতরে যাওয়ার জন্য। কিরণ যতক্ষণ না ভেতরে যাবে ততক্ষণ জাওভান দাঁড়িয়েই থাকবে।

আয়াত আর কিরণকে বাসায় দিয়ে জাওভানরা চলে গেল। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে আয়াত কিরণকে বলল,

‘আচ্ছা কিরণ! তোমার বয়ফ্রেন্ডের ভাইটা আছে না?’

‘হুম, উজান।’

‘হ্যাঁ ঐ উজানই। এই ছেলের এত ভাব কিসের। কেমন যেন অহংকারী অহংকারী লাগে।’

‘ওকে মোটেও অহংকারী লাগে না। ও আসলেই অহংকারী।’

‘এমন কেন? একটু ভালো করে হাই-হ্যালোও করল না। ইভেন বায়টাও বললো না।’

‘ও এমনই। জন্ম থেকেই নাকি এমন, কারো সাথে মিশে না।’

‘অদ্ভুত!’

কিরণ চোখ ছোট ছোট করে বলল,

‘তুমি হঠাৎ ওর কথা জানতে চাইছ কেন? পছন্দ-টছন্দ হলো নাকি?’

আয়াত চমকে উঠল, ‘ইশ! যাও, পছন্দ করতে যাবো কেন? ওনার ব্যবহার আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছে তাই বললাম।’

‘একদম মিথ্যা কথা বলবে না। ওরা দুই ভাই-ই প্রথম দেখায় পছন্দ হওয়ার মতো। তোমার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে উজিকে পছন্দ হয়েছে।’

আয়াত বলল, ‘সুন্দর জিনিস কার না-ই বা পছন্দ হয়?’

কিরণ ফট করে বলে ফেলল, ‘আমার ভাবী হওয়ার ইচ্ছা আছে?’

আয়াত ভাবতেও পারেনি কিরণ এমন একটা কথা বলে ফেলবে। আসলে কিরণের মুখে কিচ্ছু আটকায় না। যা মাথায় আসে তাই বলে ফেলে, কখনো চিন্তা ভাবনা করে না।

আয়াত লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ল। কপট রাগ দেখিয়ে কিরণের পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,

‘আমি কিন্তু তোমার বড় কিরণ। এই ধরনের ফাজলামি করবে না।’

কিরণ আর আয়াত দুষ্টুমি করতে করতে আয়াতদের ফ্লাটে চলে যায়। রাত বারোটা বাজলে কিরণ ফিরে যায় নিজের ফ্লাটে। রুমে ঢুকেই দেখে মীরা চিন্তিত মুখে বসে আছে। কিরণ মীরার মাথায় ঠুয়া মেরে বলে,

‘বয়ফ্রেন্ড আবার ছ্যাঁকা দিলো নাকি? এমনে বসে আছিস ক্যান?’

কিরণকে দেখে মীরা লাফ দিয়ে উঠে কিরণের কাছে গেল।

‘এতক্ষণ লাগে আসতে? আয়াত আপুকে কতবার ফোন দিলাম। একবারও ধরল না।’

কিরণ ব্যাগটা টেবিলে রেখে সোফায় গা এলিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করে এক হাতে মাথা টিপতে লাগল,

‘আরে কচু, ব্যস্ত ছিলাম আমরা। বাকি দুটো কই?’

মীরা এসে কিরণকে টেনে উঠালো। বলল,

‘বাকি দুটোর কথা বাদ দে। তুই খবর পেয়েছিস?’

কিরণ বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকাল,

‘কচু! কি খবর?’

‘সাদমান যে মারা গিয়েছে?’

কিরণ চকিতে তাকাল মীরার দিকে, বিরক্ত ছুটে গেল তার। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলে,

‘কি বলছিস তুই?’

‘তুই এখনো জানিস না? আমাকে সালেহ ফোন দিয়ে বলল এই কথা, তোকে যেন জানাই। আমি তো ভেবেছিলাম তুই জানিস।’

তারপর মীরা সাদমানের এক্সিডেন্টের পুরো ঘটনা কিরণকে বলল। কিরণ থম মেরে কিছুক্ষণ বসে রইল। এই খবরটা তার কাছে পুরোই অনাকাঙ্ক্ষিত। তখন জাওভানও সাদমানের ব্যাপারে কিছু বলছিল। তার মানে জাওভান জানতো। তাহলে তাকে কেন বলেনি? এই যে এতটা সময় একসাথে থাকলো তাও তো জাওভান কিছুই বলল না। সাদমানের জন্য একটু মন খারাপ হলো তার যেহেতু তার এক সময়কায় ফ্রেন্ডের তালিকায় ছিল। তবে সে চিন্তিত সাদমানের মৃত্যুটা এক্সিডেন্ট নাকি মার্ডার?

কিরণ তড়িৎ গতিতে ফোনটা নিয়ে রুমে চলে গেল। ফোন করল জাওভানকে। রিসিভ হলো না। তিনবার রিং হওয়ার পর জাওভান না ধরলে সে উজানকে ফোন করল, একবার রিং হওয়ার পরই উজান রিসিভ করল। রিসিভ হওয়া মাত্রই কিরণ হড়বড় করে বলল,

‘জাওভান কোথায়?

‘শাওয়ারে”

‘এত রাতে কিসের শাওয়ার?’

‘আজ সারাদিনে গোসল করেনি তাই।’

কিরণ এবার মেইন পয়েন্টে চলে গেল, ‘সাদমানের মৃত্যুর খবর তোমরা জানতে, তাও আমাকে বলোনি কেন?’

ওপাশ থেকে উজানের শান্ত কন্ঠ ভেসে আসলো,

‘আমার কাছে সাদমানের মৃত্যুর খবর অতোটাও ইম্পর্টেন্ট ছিল না তাই জানাইনি। জুভ কেন জানায়নি তা ওকেই জিজ্ঞেস করো।’

‘মানে কি? একটা মানুষ মারা গিয়েছে, এটা কি একবার জানানো যায় না? ইম্পর্টেন্ট আনইম্পর্টেন্টের কথা আসছে কেন?’

‘এখন তো জেনেছ যে ও মারা গিয়েছে। রাখলাম।’

‘দাঁড়াও, সাদমানকে জুভ মেরেছে তাই না? ওর দ্বারাই এটা সম্ভব। বলো, জাওভান মেরেছে?’

ওপাশ থেকে সাথে সাথে কোনো শব্দ আসলো না। এক মুহূর্ত চুপ থেকে উজান বলল,

‘জুভ মারেনি। এটা একটা এক্সিডেন্ট।’

‘ভাইকে বাঁচাতে মিথ্যে কথা বলবে না উজি।’

উজান এক পলক বাথরুমের দরজার দিকে তাকাল। মনে মনে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘আজ পুরোটা দিন জুভ আমার সাথে ছিল। আর তুমি কি শুনোনি সাদমান যে ড্রাংক ছিল? ড্রাংক অবস্থায় কেউ গাড়ি চালাতে পারে?’

উজানের সাথে জাওভান ছিল না আসলে। উজান নিজেই বাড়িতে এসেছিল আটটায়। তাকে আর্ট শপে যেতে হয়েছিল। সে আসার আরও আধ ঘন্টা পর জাওভান এসেছিল। এখন কোনো ঝামেলা চায় না বলেই উজানকে মিথ্যাটা বলতে হলো।

‘তুমি সত্যি বলছো তো?’

‘তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করছো না?’

‘না।’ কিরণের সোজাসাপ্টা উত্তর।

‘ফাইন, দ্যাটস আপ টু ইউ। রাখছি।’

কিরণ ব্যস্ত কন্ঠে বলে, ‘উজি, প্লিজ। তুমি সত্যি করে বলো এটা কি জুভের কাজ?’

বারবার নিজের ভাইকে দোষী বলায় উজানের কিছুটা রাগ হয়। শক্ত গলায় বলে,

‘লিসেন কিরণ! শুধু শুধু আমার ভাইকে ব্লেম করা বন্ধ করো, আর একবার জুভকে ব্লেম করলে ভালো হবে না। তোমার কাছে কোনো প্রমাণ আছে? নিজ চোখে দেখেছো একবারও? আন্সার মি!’

কিরণ স্তিমিত গলায় বলল, ‘না।’

‘তাহলে? তাহলে কিসের ভিত্তিতে জুভের ওপর দোষ চাপাচ্ছ? ওকে রাগাতে চাইছো কেন আবার? এসব না করলে তোমার ভালো লাগে না তাই না?’

কিরণ চুপ করে গেল। উজান বড় একটা শ্বাস ফেলল। গলার স্বর স্বাভাবিক করল,

‘লিসেন কিরণ। জুভ এখন আর এসবের মধ্যে নেই। ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে সম্পর্কটাকে খারাপ করো না।’

‘কি বলেছি শুনেছো?’

‘হুম।’

‘ওকে, বায়।’

উজান ফোনটা কান থেকে নামানোর সাথে সাথেই কিরণ আবার ডাকল।

‘আবার কি?’

কিরণ রিকোয়েস্ট করল, ‘এতক্ষণ যা কথা হলো জুভ যাতে না জানে। প্লিজ!’

‘কেন জানবে না? তুমি যে জুভকে সন্দেহ করছো তা তো জুভের জানা উচিত!’

‘প্লিজ উজি। ওকে বলো না, ও রাগ করবে নাহলে।’

উজান কিছু না বলে কল কেটে দিলো। বিরক্ত লাগছে তার। জাওভান শাওয়ার থেকে বেরোলেই উজান ডাক দেয়।

‘জুভ তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।’

জাওভান সোজা বেডের মধ্যে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল।

‘কোনো কথা নেই। আমি এখন ক্লান্ত।’

‘জুভ!’

‘গুড নাইট।’

জুভ বালিশ নিয়ে নিজের মাথার উপর দিয়ে দিলো। উজান চোখের চশমা ঠিক করে বলল,

‘সাদমানের ব্যাপারে কথা বলব।’

জাওভান বালিশ সরিয়ে উঠে বসল। বালিশটা উজানের পায়ের কাছে ছুঁড়ে মেরে বলল,

‘আমি কোনো কথা বলতে আগ্রহী নই। ডোন্ট ডিস্টার্ব মি। তুই এখন আসতে পারিস।’

বলেই সে শুয়ে পড়ল। ‘দয়া করে লাইট অফ করে যাস।’

উজান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ফ্লাটে চলে আসলো। এই দুজনের চক্করে পড়ে তার মাথা ব্যথা করছে। এখন একটাই শান্তির জায়গা আছে। কফি মেকার থেকে কফি নিয়ে সে নিজের পেইন্টিং রুমে চলে গেল। স্লাইডিং ডোর খুলতেই হুরহুর করে বাতাস প্রবেশ করলো পুরো রুমটায়। উজান প্রাণ ভরে শ্বাস নিলো। চোখের চশমাটা খুলে রেখে দিলো। এইখান থেকে পুরো শহর দেখা যায়। লাল নীল বাতি জ্বলে এখনো জীবন্ত আছে শহর, গাড়ির আওয়াজ কমে না, আর না মানুষের সমাগম। উজানের আর এই শহর ভালো লাগে না। তার নিরব, নির্জন, নিস্তব্ধ জায়গা পছন্দ। ইচ্ছে করে অদূরে কোথাও চলে যেতে যেখানে কোনো মানুষের আনাগোনা নেই, নেই কোনো জীবনের ঝামেলা। থাকবে শুধু সে আর তার স্বপ্নগুলো। আকড়ে ধরে বাঁচবে তার স্বপ্নকে। কবে এই ব্যস্ততম শহর থেকে মুক্তি মিলবে?

.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here