#সায়র
#পর্ব_০৭
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–
উজান শাওয়ারে। চোখ বন্ধ করে বাথটাবে হেলান দিয়ে আছে সে। বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঝরনার গরম পানি আছড়ে আছড়ে পড়ছে তার সারা মুখে। গালের কাঁটা দাগ বেয়ে পানিগুলো ঘাড় অবধি পৌঁছে মিলিয়ে যাচ্ছে। বাথটাবের একহাত দূরত্বে কাঁচের স্লাইড। এখান থেকে নদী দেখা যায়। তবে কুয়াশার কারণে তা ঢেকে আছে। চারিদিকে কুয়াশার বিচরণে মনে হয় যেন এখন মেঘের দেশে সে ভেসে বেরাচ্ছে।
কিরণের রাগী মুখ তার চোখে ভাসতেই চোখ খুলে উজান। তাকে পানিতে ফেলে দেয়ার আনন্দ, প্রতিশোধ, রাগ সবটা তখন ফেইরী লাইটের আলোতে জ্বলজ্বল করছিল কিরণের সারামুখে। উজান ভেবে পায় না, দু’টাকার একটা মেয়ের বুকের পাটা কতটুকু যে উজানের সাথে লাগতে আসে। যার দয়ায় সে বেঁচে আছে, তার পেটেই লাথি মারছে। কিরণের উচিত ছিল উজানের বশ্যতা স্বীকার করা, উঠতে বললে উঠা, বসতে বললে বসা, কিন্তু কিরণ তো তার সম্পূর্ণ উল্টো। ব্যাপারটা এমন হলো না যে ‘আমার বিড়াল আমাকেই বলে ম্যাও।’ হাহ! এখানে কি তার কোনো ভুল আছে? কিরণের থেকেও বেশি? আছে অবশ্য, তবে সে সেটা তার ইহজনমেও স্বীকার করতে নারাজ, অন্তত কিরণের মতো একটা মেয়ের সামনে। যা-ই করুক না সে, হোক ভুল হোক ঠিক- তার সবই ঠিক, শুধু কিরণ ভুল, শুধুই কিরণ। উজান আবার চোখ বন্ধ করে উষ্ণ পানিতে মাথা ডুবাল, শান্তিতে।
শাওয়ার শেষে নিয়ে নিজের পেইন্টিং রুমে ঢুকতেই কিছু একটা কপালে এসে লাগে। রুম অন্ধকার ছিল। সে গিয়ে সুইচ অন করে দেখল জাওভান তার টুলে বসে আছে। নিচে তাকিয়ে দেখল রঙের কৌটো। জাওভানের চোখমুখ লাল। চোখ দুটো হালকা ভেজাও। উজানকে দেখতে পেয়ে জাওভান ব্যস্ত হয়ে তার কাছে আসলো। কপালে হাত রেখে বলল,
‘ব্যথা লেগেছে ভাই? সরিরে, ভুল করে লেগে গিয়েছে।’
বলছে ঠিকই কিন্তু তার চোখেমুখে কোথাও অনুতপ্তর ছাপ পেল না উজান। উল্টো যেন জাওভান উজানকে মেরে খুবই মহৎ কাজ করে ফেলেছে। উজান ঝাড়ি মেরে জাওভানের হাত সরাল। শীতল চোখে তাকিয়ে বলল,
‘নাটক কম করবি আমার সামনে।’
প্রত্যুত্তরে জাওভান হাসলো হো হো করে। উজান চারপাশে চোখ বুলাতেই চোখে বিষাদ এসে ভর করল। তার সবগুলো আর্টে কালো রঙ মাখানো। একটা আর্টও বাদ নেই। ছোট্ট একটা টুলের উপর ছিল দুটো হাতের মিলনের ভাস্কর্য। এটা সে স্কাল্পচার ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্টদের নিকট উপস্থাপন করবে বলে বানিয়েছিল। সেটার টুকরো টুকরো ভাঙা অংশগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিচে পড়ে আছে। সে কঠিন চোখে জাওভানের দিকে তাকালে জাওভান নিষ্পাপ চোখে তাকায়, বলে,
‘উপস, আমি তো জাস্ট একটু আর্ট শিখতে চেয়েছিলাম তোর মতো। ভাবলাম আর্ট করে তোকে তাক লাগিয়ে দেব, কিন্তু দেখ না, একটুও সুন্দর হলো না।’
বলার পর জাওভান হেসে ফেলে আবার। উজান সবগুলো আর্ট ভালো করে দেখল, কালো রঙের জন্য সবগুলো আর্টের সৌন্দর্য ঢাকা পড়েছে। যেন আর্টে নয়, উজানের মনে জাওভান এই কালো রঙা বিষ ঢেলে দিয়েছে। রাগে, দুঃখে উজানের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। এই সবগুলো আর্ট তার বড় সাধনার। মনের মাধুরী মিশিয়ে এইগুলো সে এঁকেছে। এগুলো সে কখনো প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করেনি। এগুলো একান্ত, যা দেখলে তার মনের সকল খারাপ লাগা কর্পূরের মতো উবে যায়।
উজান আগে গিয়ে ড্রয়ার খুলে একটা ক্যানভাস বের করল। তাতেও কালো রঙ! এবার যেন উজানের দুঃখ আকাশসম হলো। এই ক্যানভাসে তার সবচেয়ে প্রিয় একটি আর্ট ছিল। যেখানে গোলাপ ফুলের গাউনে মোড়ানো একটি মেয়ে বাগানের গোলাপে হাত ছোঁয়াচ্ছে। চুলগুলো কোমড় সমান। তার ঠিক অদূরে, একটি বটগাছের নিচে একটি ছেলে তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। অথচ ছেলে এবং মেয়েটির কারো চেহারাই অঙ্কিত নয়। তাদের চেহারা আঁকতে পারেনি উজান। কেন জানে না! তবে এই আর্টটি যতবারই মনে এসেছে ততবারই ছেলেটির এবং মেয়েটির চেহারা সে অস্পষ্ট দেখেছে। একদম ধোঁয়াশা। তবে সে অনুভূতি খুব গাঢ়ভাবে উপলব্ধি করতে পারছিল। ছেলেটির চাহনি ছিল গভীর, বহুকাল অন্ধকারে থাকার পর এক টুকরো আলো চোখে পড়লে মানুষ যেমন সেই আলোটির জন্য মরিয়া হয়ে উঠে, তেমন মরিয়া হয়ে উঠেছিল সেই ছেলেটি, মেয়েটিকে পাওয়ার জন্য। আর মেয়েটি খিলখিল করে হাসছে, চোখে মুখে অন্যরকম উজ্জ্বলতা, প্রাণবন্ত।
তার এই প্রিয় আর্টের উপর জাওভান কালো রঙ দিয়ে মেয়েটির চেহারা বিকৃত করে দিয়েছে। ছেলেটির উপর ক্রস চিহ্ন আঁকা, পেছনের নীল আকাশ লাল রঙ দিয়ে রক্তের মতো ঢেলে দেওয়া হয়েছে। উজান তাকাল জাওভানের দিকে। চোখ রক্তিম তার। জাওভান তা দেখে অবাক আর ভয় পাওয়ার ভান করল,
‘ও মাই গড উজি! এভাবে তাকাবি না প্লিজ। আমি খুব ভয় পাচ্ছি। দেখ আমার হাত পা কাঁপছে।’
বলেই মুখ চেপে হাসল জাওভান। তার হাসি পাগলের মতো।
‘কেন এমন করলি তুই?’ উজানের গলার স্বর কাঁপছিল।
এবার জাওভান হাসি থামিয়ে সেও কঠিন করে ফেলল চোখমুখ। বলল,
‘যেমনটা তুই করেছিস, তেমনটাই ফেরত পেয়েছিস।’
‘তুই জানিস আর্ট আমার কি? কি করে করতে পারলি এটা? যেটার মধ্যে আমি নিজের জীবন খুঁজে পাই সেটাই তুই ধ্বংস করে দিলি? কি এমন ক্ষতি করেছিলাম তোর?’ উজান শান্ত গলাতেই বলল।
‘আরেহ উজি, তুই এখনো রাগছিস না কেন? আমি তো তোর রাগ দেখার জন্য ওয়েট করছি। তখন কিরণ সামান্য একটা কথা বলায় তুই যেমনটা রেগে গেলি! আর এখন আমি তো তোর জীবনের অনেক বড় ক্ষতি করে ফেললাম, তাও তুই রাগছিস না? স্ট্রেঞ্জ!
তারপর পা দিয়ে একটা চেয়ার উজানের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল,
‘বসে কথা বলি চল।’
উজান ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো চেয়ারটা। জাওভান দরজা আটকে দিতে দিতে বলল,
‘কুল ব্রো, কিরণ ঘুমোচ্ছে। তোর চিৎকার চেঁচামেচিতে আমার জানটার ঘুম ভেঙে যাবে।’
জাওভান নিজেই চেয়ারে বসলো। বলল,
‘আজ তোর ঠিক কি হয়েছিল রে উজি! তোর যে এত রাগ তা তো জানতাম না? ইদানীং কি হয়েছে তোর বলতো? রাগ এত বেড়েছে কেন? আগে তো এমন ছিলি না।’
‘আগে তো তুইও এমন ছিলি না।’
জাওভান দুহাত মাথার পেছনে নিয়ে হেলান দিলো। বড় একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,
‘আজ কিন্তু তুই বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিস উজি। কিরণকে তুই একদমই দেখতে পারিস না, দ্যাটস ফাইন। ওকে তুই বাজে বাজে কথাও বলেছিস, মুখ বুজে সহ্য করে নিলাম একমাত্র ভাই বলে। কিন্তু কিরণকে আঘাত করার সাহস পেলি কোত্থেকে? তোর নখের দাগ বসে গিয়েছে ওর গলায়। ইউ নো, কিরণের গায়ে একটা আঁচড় লাগলে আমি কতটা ডেসপারেট হয়ে যাই! কেউ ওর দিকে হাত বাড়ালে তাকে জ্যান্ত রাখি না, তেমন তুইও বাড়িয়েছিস। তোকে তো আর আঘাত করতে পারি না বল। আমার জানের জিগারের বেস্টফ্রেন্ড তুই। তাই তোর আর্টগুলোতেই নাহয় নিজের ক্ষোভ মিটিয়ে নিলাম।’
বলেই জাওভান ঘাড় কাত করে তাকায় উজানের দিকে। মুখে তার পৈশাচিক হাসি।
উজানের আসলে কি করা উচিৎ সেটা সে নিজেও ভাবতে পারছে না। জাওভান, যে কিনা তার পেইন্টিং রুমে তার পারমিশন ছাড়া ঢুকতো না আজ সে-ই তার সন্তানসম আর্টগুলোকে নষ্ট করেছে। উজানের তখন না রেগে উপায় ছিল না। কিরণ কি বলেছিল? সে নাকি কিরণকে অনুরোধ করেছে! এমনকি কিরণের পা পর্যন্তও ধরতো! সিরিয়াসলি! কিরণ নিজেকে ভেবেছেটা কি? তার ভাইয়ের সাথে প্রেম করে বলে তারও মাথায় চড়ে বসবে? এটা সে কিছুতেই মানতে পারছিল না। আর সেই সময় কিরণের জন্য জাওভানের করা সমস্ত অপরাধগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল। যেগুলো তার রাগকে বাড়িয়ে দিয়েছিল মুহুর্তেই। তার রাগ কন্ট্রোল করার ক্ষমতা চমৎকার! কিন্তু যেখানে কিরণের জন্য জাওভান বাবা মায়ের সাথে একমাস কথা বলেনি সেই বিষয়টা একদম মেনে নিতে পারেনি উজান। জাওভানকে শতবার বুঝিয়েছিল। সেই পাগল বুঝেনি। তাও উজান চুপচাপ কিরণকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তবে আজ কিরণের হেয় করে বলা কথাগুলোতে উজানের পুরোনো রাগ সাপের ফণা তুলে ফুঁসে উঠেছিল। তাইতো সে রাগের মাথায় কি কি করে ফেলেছিল! দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো উজান। আজ এমনটা না করলে তার আর্টগুলো বেঁচে যেত। জাওভানের করা এই কান্ড ছিল তার ভাবনাতীত। তার এই কাজে উজানের ভেতরে ঠিক কতটা কষ্টের জোয়ার বইছে সেটা সে কাউকেই বোঝাতে পারবে না।
জাওভান বলল, ‘আমি এখন তোর সাথে কোনো ঝামেলা করতে চাই না। শুধু চাই তুই গিয়ে কিরণকে সরি বলবি। ব্যস শেষ।’
‘বলবো না।’ উজানের দৃঢ় জবাব।
জাওভান বিরক্তির আওয়াজ তুলল।
‘এত ইগো প্রবলেম কেন তোর? ভুলটা আজ তোর বেশি ছিল উজি। তুই কিরণকে রাস্তার মেয়ে, ক্লাসলেস, বস্তির মেয়ে বলেছিস। হার্টও করেছিস। সেই হিসেবে কিরণ তোকে তেমন কিছুই বলেনি। তাই ও’কে গিয়ে সরি বলবি।’
উজান চুপ করে রইল। তার চুপ থাকায় জাওভান বুঝে নিলো উজান কিছুতেই সরি বলবে না। জুভ ওয়ার্নিং দিলো এবার,
‘তুই যদি কিরণকে সরি না বলিস তাহলে তোর সাথে আমার সম্পর্ক এখানেই শেষ।’
উজান বাহিরে স্বাভাবিক থাকলেও তার ভেতরটা বিদ্যুতের মতো চমকে উঠল। সাতাশ বছর ধরে যেই ছেলে কিনা তাকে ছাড়া একমুহুর্তও দূরে থাকতো না সেই ছেলেটা দুদিনের মেয়ের জন্য সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইছে! উজানের বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হলো যে এটা তার জুভ। জাওভান যা বলে তাই করে, যেমনটা বাবা মায়ের সাথে করেছিল। তার মানে এখন সত্যি সত্যি তার সাথে সম্পর্ক শেষ করে দিবে! কিন্তু সে তার ভাইকে ছাড়া থাকবে কি করে? নিজের খুশির কথা না ভেবে যে কিনা সারাটাজীবন ভাইয়ের খুশির কথা ভেবেছে, তার কথা অনুযায়ী সব করেছে, সেই ভাই চলে গেলে তার কি হবে! এই পৃথিবীতে একমাত্র আপন বলতে জুভই আছে তার। আর এই দুর্বলতার সুযোগ জুভ কাজে লাগাচ্ছে!
‘তুই এর আগেও মম ড্যাডের সাথে এমন করেছিলি।’
‘করতে বাধ্য হয়েছিলাম। তারা কিরণকে যদি সহজে মেনে নিতো তাহলে এমনটা হতো না। কিরণকে তারা অপমান করেছে।’
‘আর মম-ড্যাড যে কষ্ট পেয়েছ তা কিছু না? দুদিনের মেয়েই সব?’
‘বাবা মা আমাকে ভালোবাসলে কিরণকে মেনে নিতো। কিরণকে মেনে নেয়নি তারমানে তারা আমাকে ভালোওবাসেনা।’
‘আমিও তো কিরণকে মেনে নেইনি। তারমানে কি আমি তোকে ভালোবাসি না?’
জাওভান এ প্রশ্নের জবাবে চুপ করে গেল। বাবা মায়ের থেকেও উজান তাকে বেশি ভালোবেসেছে এ কথা সে কখনো অস্বীকার করতে পারবে না। তার কোনো কাজ যদি অন্যায়ও হয় তাহলে উজান তাকে প্রথমে বোঝাবে, যখন দেখবে জাওভান অন্যায় করে আনন্দ পাচ্ছে তখন সে আর বাঁধা দেবে না। তার কাছে জাওভানের প্রায়োরিটি সবার আগে।
জাওভানের উত্তর না পেয়ে উজান কিছুটা তাচ্ছিল্য করে বলল,
‘এখন তো তোর কাছে টাকা আছে, তাই বাবা মাকে মূল্য দিচ্ছিস না। অথচ যখন তুই ছোট ছিলি তারাই কিন্তু কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিল। তোকে ভালোবেসেছিল। তার প্রতিদান হিসেবে তুই তাদের ফোনকল তোলা বন্ধ করে দিলি। মা ফোন করে কত কান্না করে জানিস? তোর সাথে একবার কথা বলার জন্য। তুই তো পাত্তাই দিতি না। সারাক্ষণ কিরণ কিরণ করিস।’
তারপর ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘এই যে তুই যার জন্য সবার সাথে সম্পর্ক শেষ করছিস, যার নাম হাজারবার নিচ্ছিস, ভালোবাসি ভালোবাসি করছিস, সে কিন্তু তোকে ভালোবাসে না।’
এবার জাওভানের ভ্রু কুঁচকে এলো। বলল,
‘ওকে তোর থেকে বেশি আমি চিনি। ও আমাকে ভালোবাসে কি ভালোবাসে না সেটাও জানি।’
‘তুই ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিস তাই ভাবছিস তোর চারপাশের সবাইও তোকে ভালোবাসে। এটা কিন্তু ভুল। কিরণ তোর একটু কেয়ার করে, তোর সাথে মিশে, মুখে ভালোবাসি বলে তারমানে এই না যে তোকে সে ভালোবাসে। ওর চোখের দিকে ভালো করে একবার তাকিয়েছিস? ওর চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা দেখেছিস? কিরণ তোকে ভালোবাসে না। যা করে সবটাই মায়ার বশে।’
‘কিরণ যেদিন নিজ মুখে বলবে ও আমাকে ভালোবাসে না সেদিন হবে ওর জীবনের শেষ দিন। আমাকে ভালোবাসি না বললে ওর মুখ থেকে অন্য কারো জন্য ভালোবাসি বলাটা তো আমি মেনে নেব না।’
বিদ্রুপ কন্ঠে উজান বলল, ‘কেমন ভালোবাসা তোর? জোর করে ভালোবাসিয়ে নিবি? আর ভালো না বাসলেই মেরে ফেলবি? কিরণ কি চায় না চায় সেটা তো কখনো বুঝতে চেষ্টা করিস না। সবসময় নিজের পছন্দ অপছন্দ চাপিয়ে দিতে জানিস শুধু।’
জাওভানের ভেতরে ক্রোধের আগুন জ্বলতে লাগল। কিরণ তাকে ভালোবাসে না এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। পরক্ষণেই মনে হলো, কিরণ তো তাকে কখনোই বলেনি যে সে তাকে ভালোবাসেনা। উজান শুধু তাকে রাগানোর জন্য এমনটা বলছে। কারণ উজান তো কিরণকে দেখতে পারে না, তাই কিরণের নামে মিথ্যা বলছে। ভাবতেই আগুনে পানির ছিটা লাগল। সে শান্ত হয়ে বলল,
‘এসব ফাউল কথা বাদ দে এখন। কিরণ ভালোবাসলে কি, না বাসলে কি, ওকে আমার সাথেই থাকতে হবে। এ বিষয়ে আমি আর একটা ওয়ার্ডও বলতে চাই না। তুই কিরণকে সরি বলবি কিনা বল? ব্যস একটা সরিই তো। এই একটা শব্দই কিন্তু সব ঠিক করে দিবে। তোর, আমার সম্পর্ক।’
উজান মনে মনে কিছু ভাবল। জাওভান যখন জানতে পারবে কিরণ তাকে সত্যি ভালোবাসে না তখন জাওভান নিজেকে সামলাতে পারবে না। সেই উজানকেই সামলানো লাগবে। কিন্তু এখন সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলে উজানের কাছে জাওভান আর কখনোই আসবে না। আর সেটা সে চায় না। তাই বলল,
‘ডান।’
উজানের এত সহজে রাজি হওয়ায় জাওভান মনে মনে কিছুটা হাসল। উজানের যতই ইগো থাকুক না কেন, জাওভানের কথা আসলেই সে সব মেনে নেয়। জাওভান হালকা হেসে উজানকে জড়িয়ে ধরে। পিঠে চাপড় দিয়ে বলে,
‘এই নাহলে আমার ভাই!’
তারপর সে গুড নাইট বলে চলে যায় পাশের রুমে। আজ তারা উজানের বাংলোতেই থাকবে। কিরণ নিচের রুমে।
আহযান এসেছিল উজানের সাথে একটু জরুরী বিষয়ে কথা বলতে। সে রুমে যাওয়ার পর দেখল পেইন্টিংগুলোর নষ্ট অবস্থা। একজন আর্টিস্ট হিসেবে সে জানে, কষ্টের করা শ্রম যখন কেউ নিমিষে নষ্ট করে দেয় তখন কতটা খারাপ লাগে! আর এটাও জানে যে এসব জাওভানের কাজ, সে বাহির থেকে তাদের কথাবার্তা শুনেছে। উজানের সবগুলো আর্ট দেখে আহযানের কতটা কষ্ট লাগছে সে নিজেও বলতে পারবে না। তাহলে উজানের মনের অবস্থাটা কেমন হবে?
আহযান দেখল উজান নির্নিমেষ চেয়ে আছে হাতে ধরা একটি ক্যানভাসের দিকে। আর্টটাতেও কালো রঙ। আহযান বুঝতে পারল না আর্টটা। তবে বুঝল যে পেইন্টিংটা উজানের খুব প্রিয় ছিল। আহযান নিঃশব্দে সেখান থেকে চলে যায়। এখন উজানের স্বাভাবিক কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।
.
.
সকাল সকাল দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে কিরণের ঘুম ভেঙে যায়। আড়মোড়া ভেঙ্গে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে থাকে। রাতের বেলায় খুব চমৎকার ঘুম দিয়েছে সে। একরোখা উজানকে শাস্তি দিতে পেরে তার বড্ড আনন্দ হচ্ছিল। রুমে এসে সে নিজেকে নিজেই বাহবা দিচ্ছিল নিজের সাহসিকতার জন্য। তারপর নিজে নিজেই গুনগুনিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
জানালার সাদা পর্দা ভেদ করে সকালের মিষ্টি কুয়াশাচ্ছন্ন রোদ এসে লুটোপুটি খাচ্ছে মেঝেতে। দেয়ালে আর ছাদে আঁকা নীল আকাশ। পেঁজা তুলোর মতো কোমল মেঘ আর তার মধ্যে এক জোড়া পাখি উড়ে উড়ে যাচ্ছে। যেন কিরণ আকাশের নিচেই শুয়ে ছিল। নিজেকে খুব সতেজ লাগল। উজানের আর্টের প্রশংসা না করে পারা যায় না। উজানের আর্ট দেখলে কেউই বলবে না যে আর্টিস্টটা কত্ত গম্ভীর এবং কঠিন।
কিরণ উঠে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দিলো। তৎক্ষণাৎ এক ফালি সোনালী রোদ্দুর হুড়মুড় করে লাফ দিয়ে পড়ল তার রুমে। রুম সোনালী আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল চকিতেই। কিরণ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শীতের মিষ্টি রোদ গায়ে মাখালো। সামনে ঘন জঙ্গল। গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্যের নরম আলো। গাছের লাল লাল শুকনো পাতা ঝরে আছে সবুজ ঘাসের উপর। মনে হয়, লাল পাতার গালিচা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ছোটোখাটো উঠোনের মাঝখানে আছে বেতের চেয়ার টেবিল। তাতে শোপিস হিসেবে রাখা চায়ের কাপ ভর্তি ট্রে, কেটলি। কিরণ কিছুক্ষণ মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকলো সেদিকে। তার মন না চাইতেও উজানের অভিজাত রুচির প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
ঠকঠক ঠকঠক। আবারো কড়া নাড়ার শব্দে কিরণের মুগ্ধতায় ব্যাঘাত ঘটে। ‘চ’ কারান্ত বিরক্তিকর শব্দ তুলে গুটিগুটি পায়ে গেল দরজা খুলতে।
দেখল উজান দাঁড়িয়ে আছে পকেটে হাত পুরে। পরনে পার্পল কালার টিশার্ট আর ট্রাউজার। এলোমেলো চুল কপালে ছড়িয়ে আছে। লাল লাল চোখের চারপাশ কালো হয়ে আছে কেমন, মনে হয় রাতটা নির্ঘুম কেটেছে উজানে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে জাওভান। জাওভানের মুখটা হাসি হাসি। সে ব্ল্যাক গেঞ্জি উইথ থ্রি কোয়াটার পরে আছে। ভাবটা এমন যেন সে খুশির সংবাদ নিয়ে এসেছে।
কিরণকে দেখেই জাওভান একটা হার্টবিট মিস করল। কিরণের ঘুমঘুম চোখ, ফোলা ফোলা গাল দেখে জাওভানের চোখের দৃষ্টি পাল্টাতে লাগল। সে গিয়ে কিরণের গাল টেনে কপালে চুমু দিলো। পাশে যে তার ভাই দাঁড়িয়ে আছে, সেটা বোধহয় সেই মুহুর্তের জন্য সে ভুলে গিয়েছে।
‘গুড মর্নিং।’
কিরণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল জাওভানের কান্ডে। অপ্রস্তুত হেসেই বলল, ‘মর্নিং। সকাল সকাল হঠাৎ কি দরকারে?’
‘সরি।’ ভেসে আসে উজানের দিক থেকে।
কিরণ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় উজানের দিকে? কি বলল উজান? ঠিকঠাক শুনতে পেল না যেন। নিজের কানকে বিশ্বাস করানোর জন্য সে প্রশ্ন করল,
‘সরি?’
‘সরি।’ উজানের নির্বিকার জবাব।
কিরণের মনে হলো, পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য কোনো ঘটনা তার চোখের সামনে এইমাত্র ঘটলো। উজান আর সরি? তাও আবার তাকে? যাকে কিনা গতকাল বাজে বাজে কথা বলেছিল? কিরণের মুখ হা হয়ে গেল সবিস্ময়ে।
উজান তা পাত্তা না দিয়ে বলল,
‘গতকাল তোমার সাথে যেই ব্যবহার করেছিলাম তার জন্য সরি। আমার এমনটা করা উচিৎ হয়নি। আমি মন থেকে অনুতপ্ত। সামনের সপ্তাহে একটা কাজে কক্সবাজার যাবো। সেই হিসেবে তুমি আর জুভও যাবে। তুমি তোমার যেকোনো ফ্রেন্ডকে ইনভাইট করতে পারো। ইটস আ সরি ট্রিট।’
রোবটের মতো কথাগুলো বলে উজান চলে গেল। কিরণ এখনো বিশ্বাসই করতে পারছে না। জাওভান ও’কে ঝাঁকাল।
‘কি হলো? উজান তো সরি বলেছে। সরি এক্সেপ্ট করেছো তো?’
কিরণের হুশ ফিরে। সে সরি এক্সেপ্ট না করলেই বা কি? উজান তো চলেই গিয়েছে। আর এমন যন্ত্রের মতো কথাগুলো বলল যেন সে রিডিং পড়ছিল। সামান্য একটু অনুভূতির লেশমাত্রও ছিল না কথাগুলোতে!
.
.
চলবে…
[কার মনে কি প্রশ্ন চলে বলেন, উত্তর দিয়ে দেই-_-]