#সায়র
#পর্ব_০৮
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–
ডাইনিংয়ে আহযান, উজান, জাওভান আর ইয়ানা এসে বসেছে। আহযানকে উজানই রেখে দিয়েছিল জোর করে। আহযান তো থাকতেই চাইছিল না। আর বাকি সবাই রাত হলেই চলে যায় ইয়ানা ছাড়া। আহযান আর উজান তাদের প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলছিল। ইয়ানা দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে চেয়ারে। গত রাতে তার সাথে করা কিরণের কাজটার উপর ক্ষোভ কীভাবে মিটাবে সেই ছক মনে মনে কষছে সে। জাওভান টেবিলে এক হাত রেখে, হাতের উপর গাল ঠেকিয়ে কিরণকে দেখছিল শুধু। কিরণ ব্যস্ত রান্নাঘরে, ভ্রূ কুঁচকানো তার, নিচের ঠোঁট মুখের ভেতর ঢুকিয়ে একমনে ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছে। ব্লু স্কার্ট, সাদা টপ আর মাথার দুপাশে দুটো উঁচু খোঁপাতে কিরণকে বাচ্চা বাচ্চা লাগছিল জুভের কাছে। এখন যদি এখানে সে একা থাকতো তাহলে কিরণের সাথে একটু দুষ্টুমি করা যেতে পারত।
কিরণ ব্রেকফাস্ট এনে টেবিলে রাখল। নিজের প্লেটে রুটি আর সবজি বেড়ে নিতে নিতে বলল,
‘জুভ আমার বোধহয় সামনের সপ্তাহে কক্সবাজার যাওয়া হবে না।’
জাওভান ব্রেড চিবোতে চিবোতে বলল, ‘কেন?’
‘বস ছুটি দেবেন না। জানো তো উনি খুব কড়া।’
‘ছুটি কেন দিবে না? এই মাসে তো তুমি কোনো ছুটিই নেওনি। তাহলে এক সপ্তাহের জন্য ছুটি তো দিতেই পারেন।’
কিরণ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আড়চোখে উজানের দিকে তাকাল। উজান যদি সত্যিটা জানিয়ে দেয় যে সে সপ্তাহখানেক ছুটি নিয়ে অলরেডি ঘুরেও এসেছে! কিন্তু নাহ! উজানের মধ্যে তেমন কোনো হাবভাব দেখা গেল না। উল্টো সে যেন তাদের কথা শুনেইনি এমন ভাব ধরে আহযানের সাথে কথা বলছে। কিরণ চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে,
‘গত মাসেও তো কয়েকদিন ছুটি নিয়েছিলাম, এবার অফিসে কাজ এমনিতেও বেশি। অনেক কো-ওয়ার্কার ছাঁটাই করেছে তো, তাই চাপটাও বেশি।’
‘বসের বাসার ঠিকানাটা দিও।’
কিরণ গমগম করে বলল, ‘হ্যাঁ, বসের ঠিকানা দেই আর তুমি তাকে সাইজ করে আসবে? তা আর হচ্ছে না?’
জাওভান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘কিরণ, তুমি ঐ চাকরিটা ছেড়ে দাও।’
কিরণ চমকিত গলায় বলল, ‘কিজন্য?’
‘আমি চাইছি না তাই। তোমার ঐ চাকরিটার কি প্রয়োজন আমি বুঝতে পারছি না।’
‘তাহলে আমার পরিবারের কি হবে? আমার ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা, মায়ের ঔষধপত্রের কি হবে?’
‘আমার যা আছে তাতে তোমার আরো চৌদ্দ গোষ্ঠী চালানো যাবে কিরণ। তুমি তোমার ফ্যামিলিকে আমাদের সাথেও রাখতে পারবে। তুমি জাস্ট চাকরিটা ছেড়ে দেও।’
জাওভানের টাকার গরমটা এবার যেন কিরণে আত্মসম্মানে আঘাত হানে। কন্ঠে খানিকটা রাগের মিশ্রণ ঘটিয়ে, ভ্রূকুটি কুঁচকে বলে,
‘আমি তোমার টাকায় কেন চলব জাওভান? আর তোমার কি মনে হয়? আমার মা তোমার টাকা সহজে গ্রহণ করবে? মা আমাকে এত কষ্ট করে লেখাপড়া করিয়েছে অন্যের টাকায় খাওয়ার জন্য?’
‘অন্যের টাকা কোথায়? আ’ম ইওর উডবি হাজব্যান্ড।’
‘এখনো হওনি তো। যখন হবে তখনেরটা তখন দেখা যাবে।’
কিরণ এটা বলে কথোপকথনের ইতি টানতে চাইছিল। কিন্তু জাওভান যেন এখান থেকেই শুরু করল। সে হাতের ব্রেডটা প্লেটে রেখে সিরিয়াস হয়ে বলল,
‘লিসেন কিরণ। তুমি চাইলে আজকে, এই মুহুর্তেই তোমার হাজব্যান্ড হতে পারি। তুমি জাস্ট বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলো।’
কিরণ এবার চুপ করে রুটি ঘাটতে লাগল। জাওভান থামলো না,
‘বিয়ে করতে সমস্যাটা কোথায়? এখানে তো কোনো বাঁধা দেখছি না।’
জাওভানের প্রশ্নের উত্তর কিরণ দিতে পারল না। তার জীবনের চরম একটি সত্য সে জাওভানকে এখনো বলেনি। মা ছাড়া বাহিরের কোনো মানুষ যদি সেই সত্যটা জেনে থাকে তাহলে তা হচ্ছে উজান। এছাড়া তার যত ক্লোজ ফ্রেন্ড থাকুক না কেন কেউই এই সত্য সম্পর্কে জানে না। অথচ দুইদিনের পরিচয়ে তার জীবনের এই ধ্রুব সত্যটির প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছিল উজান। কিরণ হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এখন যেই অবস্থা দেখছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে জাওভান থেকে এই জীবনেও তার নিস্তার নেই। মানে তাকে জাওভানকেই বিয়ে করতে হবে। তাহলে তো জাওভানকে তার এই সত্যটি জানিয়ে দেয়া উচিত। কিন্তু জাওভান কি রিয়েক্ট করবে! অবশ্যই তাকে ছেড়ে চলে যাবে না, বরং তাকে রেখেই এরচেয়ে বাজে এবং ভয়ানক রিয়েক্ট করবে বলে কিরণের ধারণা। তাই জাওভানকে কিছুই বলেনি সে।
কিরণের এই নিশ্চুপ থাকাটা জাওভান মেনে নিতে পারেনি। তার রাগ বাড়ে যদি কিরণ তার কথার ঠিকঠাক মতো উত্তর না দেয়। সে শক্ত কন্ঠে কিছু বলতে যাবে তার আগেই উজান বলে উঠে,
‘খাওয়ার টেবিলে পার্সোনাল আলাপ না করাই উত্তম।’
কিরণের এতক্ষণে খেয়ালই ছিল না যে তার আশেপাশে মানুষ আছে। সে চোখ উঠিয়ে দেখল আহযান ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। একজন বাইরের মানুষের সামনে এসব কথা বলায় নিজেকে নিজে কিছুক্ষণ গালি দিলো কিরণ। সে খাবারে মনোযোগী হলো। কিন্তু জাওভান সন্তুষ্ট হলো না। তার প্রশ্নের উত্তর চাই-ই চাই। সে খাবার রেখে উঠে দাঁড়াল। কিরণ তখন দ্বিতীয় লোকমা মুখে পুরছিল। জাওভান কিরণের হাত থেকে খাবার ঝটকা মেরে নিয়ে পাতে ফেলে দিলো। সকলের দৃষ্টি তাদের উপর ছিল উজান ছাড়া। খাওয়ার মাঝ থেকেই কিরণের হাত ধরে টেনে উঠিয়ে নিলো। কিরণের এত লজ্জা লাগল! সে গত রাতে কিচ্ছুটি খায়নি। সে এখন প্রচুর ক্ষুধার্ত। জাওভান সবসময় সেল্ফিশের মতো নিজের চিন্তাটা করে। এই যেমন জাওভান জানতো কিরণ গতরাত থেকে কিছু খায়নি তাও জুভ সে কথা চিন্তা না করেই উঠিয়ে নিয়ে গেল! এই ধরনের সেলফিশকে বিয়ে করা যায়?
জাওভান কিরণকে নিয়ে পশ্চিম দিকে চলে এলো। এখানে ছোট একটি বাগিচা। বাহারী রঙের ফুল গাছের পাশে দোলনা। কিরণকে তার সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,
‘দেখো সোনা। অনেক ওয়েট করিয়েছ আমাকে। এখন বলো বিয়েতে তোমার কি আপত্তি?’
এবার মুখ খুলে সে, ‘আমার সময় লাগবে জুভ। বিয়ের জন্য মানসিক প্রস্তুতি থাকা দরকার যা আপাতত আমার নেই।’
অধৈর্য জাওভান বলে, ‘আশ্চর্য! কিসের মানসিক প্রস্তুতি? আই লাভ ইউ, অ্যান্ড ইউ অলসো লাভ মি। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?’
‘তুমি বুঝতে পারছো না জুভ।’
‘কি বুঝার কথা বলছো? উফ!’ জাওভান একহাত কপালে ঠেকিয়ে গভীর শ্বাস নিলো। শান্ত হয়ে কিরণের দু’কাঁধ ধরে জাওভান সতর্কতার সাথে নরম স্বরে প্রশ্ন করল,
‘তুমি আমাকে ভালোবাসো তাই না সোনা? বলো কিরণ ইউ লাভ মি!’
কিরণ ধরতে পারল যে জাওভান তার মুখ থেকে কথা আদায় করতে চাচ্ছে। কিন্তু কিরণ সাবধানে প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়ে বলল,
‘জাওভান, দেখো, বিয়েটা হবে তো, কোনো না কোনো একসময় ঠিকই হবে। এটা তো তুমি জানোই। তার আগে আমার কি উচিত না নিজেকে সেই অনুযায়ী প্রস্তুত করা? আমি আগে নিজেকে প্রস্তুত করতে চাই। সব দিক থেকে জাওভান। সবার আগে নিজেকে এস্টাবলিশ করার ইচ্ছা আছে। আমার একটা নিজের পরিচয় দরকার। আমার পরিবারের মুখ দেখে নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে যেকোনো একটা জব করে সংসার চালাই, কারণ আমার স্বপ্নের দিকে চেয়ে থাকলে তো আর পরিবার চলবে না। আগে নিজের পরিবারকে একটা ভালো অবস্থানে নেই, নিজের স্বপ্নটাকে পূরণ করি, তারপর নাহয় বিয়ের কথা…’
জাওভান চোখ বন্ধ করে রাগ নিয়ে বলল,
‘বারবার সেই ফাকিং স্বপ্ন।’
‘আমার স্বপ্নের দাম কোনোদিনই তোমার কাছে ছিল না জুভ। শুধু স্বপ্ন কেন, আমার কোনো কিছুরই দাম ছিল না তোমার কাছে।’ কিরণের গলা ভেজা, কন্ঠস্বর ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছিল।
‘কারণ তোমার সবকিছুই ইউজলেস আমার কাছে।’ জাওভানের কথায় চাপা রাগ।
‘তাহলে আমাকে ভালোবাসার মানেইটা কি যদি এই আমিটাই ইউজলেস হই? আমি যখনই একটু অবসর হই কাজ থেকে, যখনই একটু নিজেকে টাইম দেয়ার কথা ভাবি, তুমি এসে সবসময় বাগড়া দেও। নিজেকে সময় দিতে পারি না তোমার জন্য কারণ আমার জন্য বরাদ্দকৃত সবটুকু সময় তুমি ছিনিয়ে নেও। আমার অবসরে আমি কি করব না করব সবটাই তোমার কথা মতো হয়। কেন?’ কিরণ চেঁচিয়ে উঠল এবার। চোখে জল, অন্তরে তার বিষাদ জ্বালা। যেন এতদিনকার ক্ষোভ কিছুটা হলেও প্রকাশ করতে পারছে সে।
জাওভানের উপর কিরণের এই রাগ হওয়াটা সে মেনে নিতে পারল না। একহাতে কিরণের গাল চেপে ধরে নিজের কাছে আনল। আরেক হাতে কিরণের খোঁপা ছাড়িয়ে চুলের মুঠি শক্ত করে ধরল। কিরণ ছাড়ালো না নিজেকে। চোখে তার অসম্ভব ক্রোধ, ঘৃণা।
জাওভান অগ্নিঝড়া কন্ঠে বলল,
‘এত কথা কিসের তোর? আমার সাথে গলা নামিয়ে কথা বলবি নাহয় একদম মেরে ফেলব। তোর সময় আবার কিসের? তোর সময় আমার। তোর সবটুকু আমার, তুই নিজেই আমার। আমার কথাই তোর শেষ কথা। আমি তোকে ভালোবাসি শুধু নিজের জন্য, এটাই তো তুই বলতে চাস তাই না? ঠিকই বলছস, তোকে আমি আমার জন্যই ভালোবাসি। তুই কাছে থাকলে আমি শান্ত থাকি, তোকে দেখলে আমার মন শান্ত হয়, এই নিজের ভালো থাকার জন্যই তোকে ভালোবাসি। এতে তোর লাশ দেখেও যদি আমার মন ভালো থাকে তাহলে তোকে মরতেই হবে। কিন্তু কি বলতো, তোর এই মরার কথা ভাবলেও আমার কষ্ট লাগে,, এই যে নিজের কষ্ট লাগে, এই কষ্টের জন্যই তোকে মারি না। তুই আমার, মৃত হলেও আমার, জীবিত হলেও আমার। তুই চাইলেও কিছু করতে পারবি না। সারাজীবনেও না।’
রাগে জাওভানের শরীর কাঁপছিল। কিরণ শান্ত হয়েই ছিল। সে এসব আগে থেকেই জানে। জাওভান যে তাকে ভালোবাসে শুধু নিজে ভালো থাকার জন্য এটা সে প্রথমেই বুঝেছিল। তাই বোধহয় জাওভানের জন্য ভালোবাসা নামক অনুভূতির ছোঁয়া তার হৃদয়ে লাগেনি।
জাওভানের আঙুলের ছাপ কিরণের গালে দেবে যাচ্ছিল। তা দেখেই বোধ করি জাওভানের হুশ ফিরল। কিরণের চোখে তার জন্য ঘৃণা কিছুতেই মেনে নিতে পারল না সে। সে শুধু ভালোবাসা চায় কিরণের চোখে, শুধু তার জন্য। সে হাত সরিয়ে হাঁটু গেড়ে নিচে বসে পড়ল। দুহাত দিয়ে মুখ মুছল। বড় বড় শ্বাস ফেলল। কিরণের দিকে তাকিয়ে তার হাত ধরে কিরণকে দোলনায় বসাল। কিরণের গালে হাত রেখে অস্থির হয়ে বলল,
‘সরি জান। কি বলতে কি বলেছি। তুমি তো জানো ডিয়ার, রাগ উঠলে মাথা ঠিক থাকে না। কি যে বলি নিজেও জানি না। আ’ম সরি সোনা। প্লিজ রাগ করো না। আচ্ছা তুমি সময় নেও বিয়ের জন্য, আমি কিছু বলব না। তাও প্লিজ রাগ করো না আমার সাথে। প্লিজ কিরণ, মন খারাপ করো না। প্লিজ… ‘
জাওভান এক নাগাড়ে আকুতি করেই যাচ্ছে ক্ষমা করার জন্য। কিরণ জানে, ক্ষমা না করা পর্যন্ত জাওভানের পাগলামী বাড়বে বৈ কমবে না। কিন্তু এই পাগলামীও তো নিজের জন্য করে। জুভের এই দুমুখো রূপের সাথে কিরণ পরিচিত। তাই জাওভানের অশান্ত থেকে শান্ত হয়ে যাওয়াটা কিরণকে অবাক করল না মোটেও। কিরণের গালে ব্যাথা লাগছে। জাওভানের নখের কারণে আগেই ব্যাথা পেয়েছে। তার উপর এখন গাল ধরে ঘষাঘষি করছে। ক্ষমা না করলে জাওভানও ছাড়বে না। এখন ক্ষমা না করে আর উপায় কি? আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। চোখ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু জাওভানের আঙুলে এসে ঠেকল।
.
.
চলবে…
[এই গল্পটা নিয়ে আমি টানাহেচড়া মোটেও করব না। প্রতিটি পর্বে মেইন কাহিনী উল্লেখ করেই কাহিনী আগাবো। সেই হিসেবে পর্বটি ১৮-২০ পর্বের মধ্যে শেষ হতে পারে বলে ধারণা।]