সায়র #পর্ব_১০

0
177

#সায়র
#পর্ব_১০
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

উজান বসে আছে বারান্দায়। আজ সূর্য উঠেনি। সফেদ কুয়াশার কুণ্ডলী মাকড়সার জালের মতো বিছিয়ে আছে ধরণী জুড়ে। দুপুরে তারা সায়মন বীচ রিসোর্টে উঠেছে। সবার জন্য আলাদা রুম বরাদ্দ শুধু আয়াত আর কিরণের জন্য একটি। দুপুরের লাঞ্চ করে উজান সোজা তার রুমে চলে এসেছে। বিকেলে তাদের হাঁটতে বের হওয়ার কথা থাকলেও জাওভানের অসুস্থতায় কেউই যেতে পারেনি।

উজান চেয়ারে বসে সমুদ্রের দিকে চেয়ে আছে। যদিও কুয়াশার বিচরণে দূরের সমুদ্রের কিছুই দেখা যায় না। হাতে তার সিগারেট। সে কখনোই এসব সিগারেট খায়নি। ইন্ট্রোভার্ট হওয়ায় স্কুল কলেজে কোনো ফ্রেন্ড বানাতে পারেনি। বিকেলে মাঠে ছেলেরা খেললেও সে যায়নি। তার এসব ভালো লাগে না। একা থাকতে ভাল্লাগে। সকালে উঠে স্কুল যাওয়া, ফিরে এসে আর্ট নিয়ে বসা এই ছিল তার দিনকার রুটিন। তবে জাওভান ছিলো সকলের মধ্যমণি। স্কুল কলেজের প্রতিটা মেয়ে ছেলের সাথে তার ভাব ছিল। কোনো খেলা তাকে ছাড়া ভাবা যেত না। সারাদিন সে ঘরের বাহিরে থাকত। সন্ধ্যা হলে ভাইয়ের কাছে আসতো। তখন উজানও ফ্রি থাকত। সেসময় দুইভাই মিলে গল্প, লং ড্রাইভ, ঘোরাঘুরি করত। ছোটোবেলায় উজানের একমাত্র বন্ধু বলতে জাওভানই ছিল এবং আছে।

জাওভানের হাজারো ফ্রেন্ড থাকলেও সে কাউকেই নিজের প্রায়োরিটির লিস্টে রাখেনি। চলার মতো করে চলেছে। শুধুমাত্র স্বল্পভাষী, ইন্ট্রোভার্ট উজানকেই নিজের বেস্টফ্রেন্ড বানিয়েছে। তার নানা ধরনের ফ্রেন্ড থাকায় ভালো খারাপ সব অভ্যাসই রপ্ত করেছে সে। এসব সিগারেট মদ নতুন কিছু না। কিন্তু উজানের কাছে নতুন। প্রথম মদ খেয়েছিল উচ্চমাধ্যমিকে থাকতে। কৌতুহল থেকেই। তবে সিগারেট সে ছুঁবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল। তার এই প্রতিজ্ঞার কথা জেনে জাওভান ইচ্ছে করে ছলে বলে কৌশলে উজানকে সিগারেটও খায়িয়ে ছেড়েছে। একটান দেয়ার পর উজানের দমে সয় না। সে ফেলে দেয়। ওটাই প্রথম আর শেষ ছিল। এরপর আর ভুলেও সে এসব ধরেনি।

আজ লাগেজ নামানোর সময় জাওভানের লাগেজের কোণায় এই সিগারেটের বাক্স পেয়েছে। ট্রিজার্স অ্যালুমিনিয়াম গোল্ড। সবচেয়ে এক্সপেন্সিভ সিগারেট। সিগারেট অবশিষ্ট ছিল একটা। তার মানে জাওভান এখনো লুকিয়ে সিগারেট খায়! অথচ সে কিরণকে প্রমিস করেছিল সিগারেট ছুঁয়েও দেখবে না। কিরণ সবচাইতে ঘৃণা করে এই সিগারেট খাওয়াকে।

উজান সিগারেট ধরিয়ে হাতে ধরে বসে রইল। মুখে নিলো না। আগুনের হল্কাগুলো কীভাবে সিগারেটের কাগজ ধীর গতিতে পুড়িয়ে অদৃশ্য করে দেয় সেটাই মনোযোগ দিয়ে দেখছিল সে।

মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে দরজায় কড়া নাড়া শব্দে। দৃষ্টি ফেরায় উজান। হাত থেকে সিগারেট না ফেলেই দরজার দিকে এগোয়। দরজা ভেজানোই ছিল। তবে বাহিরের মানুষটি ভদ্রতাস্বরূপ নক করল। দরজা খুলে দেখে কিরণ দাড়িয়ে আছে। কিরণের পেছনে আরেকটা মেয়েও উঁকি দিচ্ছে। উজান চিনতে পেরেছে মেয়েটাকে। কিরণের বাড়িওয়ালার মেয়ে নাকি। নামটা ভুলে গিয়েছে সে। মনে রাখার চেষ্টাই বা করেছে কবে? তার জীবনে এসব গুরুত্বহীন জিনিসের প্রতি অনীহা ছাড়া আর কিছুই কাজ করে না।

‘তুমি যে ফার্মেসি থেকে ঔষধ কিনলে ঐ প্যাকেটটা কি তোমার কাছে?’ কিরণের তড়িঘড়ি প্রশ্ন।

‘হুম।’

‘ওটা তাড়াতাড়ি দাও। জুভের জ্বর বেড়েছে।’

উজান দ্রুত পায়ে লাগেজ থেকে ঔষধের প্যাকেট বের করল। হাতের সিগারেট অ্যাশ ট্রেতে রাখল। দৃশ্যটা দৃষ্টিগোচর হলো না কিরণ কিংবা আয়াতের। কিরণ কিছুটা নাক ছিটকালো। উজান যে সিগারেট খায় সে সেটা জানতো না। উজানকে সে পিওর ভেবেছিল। তার পেছনে আয়াতের চোখও বড় বড় হয়ে গেল।

উজান প্যাকেট হাতে কিরণের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। একটা কথাও বলল না। কিরণ অবাক না হলেও আয়াত যারপরনাই অবাক হলো। উজান বড় বড় পা ফেলে চলে গেছে। কিরণ আর আয়াত জুভের রুমের দিকে হাঁটা শুরু করলো। আয়াত তার ডাগর ডাগর চোখ গোল গোল করে বলে,

‘এটা কি হলো? আমাদেরকে না দেখার ভান করে নিজেই প্যাকেট নিয়ে চলে গেল? এত বড় অপমানস! কিরণ, এই লোকটা তারমানে তোমাকে এভাবেই সবসময় ইগনোর করে?’

কিরণ তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,

‘এই লোকের পাত্তা আমি জীবনে চেয়েছি নাকি যে ইগনোর করবে। এই লোক যাকে ভালো লাগে না তাকে এমনেই ইগনোর করে।’

‘তুমি তো তার ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড। তোমাকে ভালো লাগে না কেন?’

‘ভালো লাগবেই বা কেন? ভাবে তার জানের জিগারের ভাইকে আমি হাত করে নিয়েছি। যত্তসব। বাদ দাও এসব আজাইরা মানুষের কথা।’

আয়াত কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

‘উনি সিগারেটও খায় দেখলে?’

‘দেখলাম তো।’

‘সিগারেটটা দেখেছো, ব্র্যান্ডের সিগারেট। আমার বাপির কাছে দেখেছিলাম। কিন্তু এত এক্সপেন্সিভ যে বাপি দ্বিতীয়বার এটা কেনার কথা ভাবেনি। আর উজান সিগারেট খায় ভাবতেই মন খারাপ হয়ে গেল।’

আয়াতের মনটা সত্যি সত্যি খারাপ হয়ে গেল। সে যদি দেখে তার খুব কাছের বা প্রিয় মানুষ সিগারেট খায় তাহলে তাদের সাথে সে জীবনেও মিশে না। তার বাবার কাছ ঘেঁষতে চাইতো না যতদিন না বাবা সিগারেট ছাড়ে। ক্রাশের সময়ও সেম। ক্রাশ যতই সুন্দর আর হ্যান্ডসাম হোক না কেন, যদি তাদের একটা খারাপ গুণ সে পেয়ে যায় তাহলে তার কাছে ঐ ব্যক্তিটা সবচেয়ে নিকৃষ্ট শ্রেণীর মানুষ মনে হয়। আর ঐ খারাপ গুণটা যদি সিগারেট হয়ে থাকে তাহলে তো কথাই নেই। এটা আসলে তার ভালো দিক নাকি খারাপ দিক সে নিজেও বুঝতে পারে না। এখন চোখের সামনে তার হার্টবিট বাড়ানো ক্রাশকে সিগারেটের সাথে দেখে ক্রাশ নামক বাশ হাওয়ায় উড়ে গেছে। উজানকে দেখে দ্বিতীয়বারের মতো ফিলিংস আসবে কিনা সন্দেহ।

‘কি হলো আপু, মুখটা অমন পাংশুটে হয়ে গেল কেন?’

‘উজান বাদ। লিস্ট থেকে ক্রস করে দিলাম তাকে।’ আয়াত মর্মাহত গলায় বলল। আয়াতের কথার বলার ধরণে কিরণ হেসে ফেলল।

.

.

ধরণীতে সাঁঝ নেমেছে। সমুদ্রের শোঁ শোঁ আওয়াজ রুম থেকেই শোনা যাচ্ছে। কিরণ রুমে ফোন হাতে শুয়ে আছে। মা আর ভাইয়ের সাথে কথা বলছিল। তার ছোট ভাই সামনে এসএসসি পরীক্ষার্থী। নাম কিয়াদ। তার ভাইয়ের স্বপ্ন পাইলট হবে। দেশে বিদেশে আকাশযান নিয়ে চলবে। ভাইয়ের এই স্বপ্ন দেখাটাকে কিরণ সমর্থন করে। সে কিয়াদের স্বপ্ন অপূর্ণ রাখতে দেবে না।

কিরণ রুমে আলো জ্বালায়নি। বালিশে মাথা রেখে শুয়ে ছিল। আয়াত এসে জ্বালিয়ে দিলো। হুট করে চোখে আলো পড়ায় কিরণ চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ মুখ কুঁচকে বলল,

‘লাইট বন্ধ করো আপু। ভাল্লাগছে না।’

আয়াত এসে কিরণের হাত ধরে টানাটানি করে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে,

‘ঘুরতে এসে কার না ভালো লাগে। চলো চলো, সমুদ্র দেখতে যাব।’

‘যাবো না। এই ঠান্ডায় কিসের সমুদ্র! ভালো লাগে না যেতে।’

‘কি যাবে না হুম? তোমার মতো আজিব মেয়ে খুব কম দেখেছি। সমুদ্র নাকি তার ভাল্লাগেনা! আরে মেয়ে, একবার আসোই তো। এই বরফ শীতল পানিতে একবার পা না ভেজালে জীবনটাই অপরিপূর্ণ। আমাদের সাথে আহযানও যাবে।’

কিরণ চোখ খুলল এবার। আয়াতের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক।

‘ওহ এবার বুঝলাম কেন এত তাড়া তোমার।’

কিরণের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে আয়াত লজ্জা পেল। তা দেখে কিরণ ঠাট্টার হাসি হেসে বলল,

‘তুমি আর ভালো হবে না আপু। যাকে দেখো তাকেই ভাল্লাগে।’

‘একটা গেলে কি হয়েছে? এরকম হাজারটা আসবে যাবে। তবে আহযানও কিন্তু অনেক সুদর্শন।’

‘উজির থেকেও বেশি?’

আয়াত কেশে বলল, ‘তা নয়, তবে এখন তো আমার চোখে উজানকে আর ভালো লাগে না। তাই এখন আহযানকেই বেশি সুদর্শন লাগছে।’

‘তো তুমি যাওনা তোমার ঐ সুদর্শনের সাথে। আমাকে ডাকছ কেন?’
বলেই কিরণ বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল।

কিন্তু আয়াত গোঁ ধরল সে কিরণকে ছাড়া যাবে না। অগত্যা কিরণকে সাধের বিছানাকে বিদায় জানাতে হলো। হুডির উপরে আরো একটা জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে বের হলো সে। যাওয়ার আগে জাওভানের রুমে গিয়ে একবার চেক করে আসলো। জাওভানের গায়ে মোটা মোটা দুইটা ব্ল্যাংকেট, সে ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে। ঘুম পাড়াতেও যত ঝামেলা হয়েছিল। কিরণকে জাওভানের হাত ধরে ঘুমানো অবধি এক ঘন্টা বসে থাকতে হয়েছে। জাওভানের চোখ মুখ জ্বরের কারণে ফ্যাকাশে হয়ে আছে। নাক কান লাল। আহারে বেচারা!

নিচে দাঁড়িয়ে ছিলো আহযান। কিন্তু আহযানের সাথে উজানকে দেখেও কিরণ চমকালো। আয়াতকে ফিসফিস করে বলল,

‘এই অহংকারী এখানে কি করে?’

আয়াত ঠোঁট উল্টে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,

‘কি জানি। আহযান তো বলেছিল সাথে আর কেউ যাবে না। এখন আবার এই মালটাকে কেন আনলো কে জানে। থাক, আমরা আমাদের মতো থাকবো।’

‘হুম।’

আয়াত আর কিরণ কাছে আসলে আহযান চওড়া হেসে হাই বলল। উজান তাদের দেখলোও না এমন ভান করে নিজের চশমা ঠিক করে হাঁটতে থাকল। তার পুরুষালী চেহারা ভরা গাম্ভীর্যতা। তারা পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। গাঢ় নীল আকাশে তখন সন্ধ্যাতারারা হীরের টুকরোর মতো ঝিলমিল করছে। হিম বাতাস বয়ে যাচ্ছে সমুদ্র তটে। নির্জন তীরে মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে। এই সন্ধ্যাতেই যেন রাতের নিস্তব্ধতা ঝুপ করে নেমে এসেছে। সমুদ্রের ক্ষীণ গর্জন আর শীতের ঠান্ডা ভারী নিঃশ্বাস ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই।

আয়াত নিজের ভাব বজায় রেখে আহযানের সাথে কথা বলছে। এখনি গদগদ হলে তো তার দাম কমে যাবে। আহযানের কাছে নিশ্চয়ই তার মতো অসম্ভব সুন্দরী মেয়েকে সস্তার মতো উপস্থাপন করবে না।

সমুদ্রের কিছুটা কাছে আসলে কিরণ পা থামায়। আয়াতকে বলে,

‘আমি যাবো না আপু। তোমরা যাও।’

আয়াত কিরণের হাত ধরে টানে, ‘কোনো না নেই। চলো পা ভেজাব।’

‘না আমার মন চায় না। আমি এখানেই দাঁড়িয়ে আছি। তোমরা যাও না, আমি এখানে অপেক্ষা করব।’

‘পাগল নাকি এই মেয়ে। এখানকার মানুষ ভালো না। একা একা থাকা চলবে না। তুমি চলো তো।’

‘চলুন মিস কিরণ। এমন ঠান্ডায় একটু সাগরের পানিতে পা না ভিজালেই নয়। সমুদ্র দেখেই তো লোভ লাগছে। মনে হয় আমাদেরকে বলছে আমাদের পা ধোয়া জল তাকে দান করতে।’ আহযান মুচকি হেসে বলে।

‘আরে আসো। এত ভয় পাচ্ছ কেন ঠান্ডা পানিকে? তোমার ভয় আজ ভাঙাব চলো।’

উজান সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে আছে। ফেনা তোলা হিম ঢেউ তার পা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। হাত ভাজ করে সে পেছনের বাকি সদস্যদের কান্ড দেখছে। চোখ মুখ সমুদ্রের ন্যায়ই শান্ত।

কিরণ মনে মনে ভয় পাচ্ছে সমুদ্রে যাওয়ার। তার একোয়াফোবিয়া আছে। মানে পানিতে ভয়। ছোটোবেলায় সে একবার পুকুরে ডুবে গিয়েছিল। তাকে নিয়ে হাসপাতালেও দৌড়াদৌড়ি হয়েছে অনেক। সেই থেকে তার পানিতে ভয়। এজন্য সুইমিংপুল কেন, বাথরুমে বাথটাব থাকলেও সে ভয়ে নামে না। এখন সামনে এই বিশাল জলরাশি দেখে ভয়টা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সে দূর থেকে দেখতেই ভালোবাসে।

কিরণ কীভাবে না করবে ভাবতে লাগল। যদি সে বলে তার পানিতে ভয় করে তাহলে কি আয়াত আর আহযান হাসবে না? আয়াতকে যতটুকু চিনে সে তো অবশ্যই হাসবে, এ নিয়ে মজা উড়াবে। যার হয় সে-ই বুঝে। আর উজান? সে ও তো বোধহয় হাসবে। প্রকাশ্যে না হোক, মনে মনে তো ঠিকই তাকে নিয়ে হাসবে, হয়তো ভাববে, অতি সাহসী মেয়েটা কিনা পানিতে ভয় পায়! ভুত না, সাপ না, শেষে কিনা পানিকে!! নিজেকে নিয়ে অন্যরা মজা করবে এটা কিছুতেই মানতে পারবে না কিরণ। তাই তার ফোবিয়ার কথা বলল না।

কিরণ চোখমুখে ভয়ের প্রলেপ লাগতে দিলো না। যথাসম্ভব সহজ থাকার চেষ্টা করল। কিন্তু আয়াত নাছোড়বান্দা। কিরণকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল। এই মুহুর্তে কিরণের ইচ্ছা করল আয়াতের এই সিল্কি চুল সব টেনে ছিঁড়ে ফেলে। এই মেয়েটা সবকিছুতেই একটু বেশি বেশি। নিজের যা ভালো লাগে মনে করে সবারও তা ভাল্লাগবে। অদ্ভুত মেয়ে মানুষ!

সমুদ্রের যত নিকটে যেতে লাগল কিরণের চোখমুখ ভয়ে নীল হতে থাকল। বুকের ধুকধুকানি বাড়তে লাগল। তার মনে হলো হাত পা অসাড় হয়ে যাচ্ছে। শান্ত সমুদ্রকে তার কাছে অশান্ত মনে হলো। এই সমুদ্র যেন মুখিয়ে আছে কখন কিরণ আসবে আর কখন তার নীল পানিতে গোগ্রাসে গিলে নেবে কিরণের অস্তিত্বকে। এখন এই সায়রকে কিরণের কাছে যম ছাড়া কিছুই মনে হলো না।

আয়াতের পা পানিতে ভিজে গেছে। পানি যতটা ঠান্ডা ভেবেছিল ততটা না। ‌সয়ে যাওয়ার মতো ঠান্ডা। কিরণকে আর এক কদম আনতে পারলেই পানিতে ভিজে যাবে। কিরণের হাত ধরে সে হ্যাঁচকা টান দিতে গিয়ে অনুভব করল কিরণের অপর হাত কেউ ধরে আছে। পেছন ফিরে দেখল সে।

কিরণ তার ডান হাতে আরেকটা হাতের ছোঁয়া পেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। দেখে জাওভান দাঁড়িয়ে আছে, তার হাত শক্ত করে ধরে। আয়াত কিরণের হাত ছেড়ে দেয়।

জাওভানের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। বড় বড় শ্বাস ফেলছে সে। জ্বরের কারণে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। তার পা নড়বড়ে কিছুটা। ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছে না। এলোমেলো চুল আর ফোলা ফোলা লাল চোখ।

ঘুম থেকে উঠে কিরণকে কাছে পায় না সে। পাগলের মতো হয়ে যায়। ঘোরে বুঝতে পারে না কিরণ কোথায়। তার মনে হয় কিরণ তার থেকে দূরে কোথাও চলে গিয়েছে। কিরণকে অনেকবার চেঁচিয়ে ডাকে। তার চিৎকারে হোটেল বয় চলে আসে। সে ছেলেটার কলার ধরে চিৎকার করতে করতে বলে, ‘আমার কিরণ কোথায় বল, আমার কিরণকে কোথায় লুকিয়েছিস?’ এমন আবোলতাবোল অনেক কথা বলে। যারা অন্যদের দেখেছে তারা বলেছে যে বাকিদেরকে সমুদ্রের তীরে যেতে দেখেছে।

তা শোনামাত্রই জাওভান এলোমেলো পায়ে দৌড়ে যায়। আয়াত নামের মেয়েটা কিরণের হাত ধরে পানিতে নিয়ে যাচ্ছে দেখে তার মাথায় রাগ চেপে বসে। তার মনে হয় সবাই মিলে কিরণকে পানিতে নিয়ে মেরে ফেলবে। তার কিরণকে তার থেকে দূরে সরিয়ে ফেলবে। কথাটি মাথায় আসতে দ্রুত যায় কিরণের কাছে।

উজান জাওভানকে দেখে বিচলিত হয়। এমন জ্বর গায়ে উঠে এসেছে কেন সে! উজান এগিয়ে আসে জাওভানের কাছে। জাওভান আয়াতের দিকে তাকিয়ে হিসহিস করে বলে,

‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমার কিরণকে?’

জাওভানের হঠাৎ রেগে যাওয়ায় আয়াত কিছুটা ভড়কে যায়। আমতা আমতা করতে থাকে সে, ‘আমি..তো, মানে… আমি… ‘

জাওভানের অগ্নিঝড়া দৃষ্টির সামনে আয়াত হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। আহযান বলে,

‘ও জাস্ট ও’কে দুষ্টুমি করে পানিতে পা ভেজানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছিল।’

জাওভান কিরণের দিকে তাকায়। সে একবার কিরণকে সুইমিং পুলে নামাতে চেয়েছিল, নামাতে পারেনি, পরে কিরণই বলেছিল যে সে পানিতে ভয় পায়। তারপর থেকে ভুলেও জাওভান কিরণকে পানির ধারে কাছে নেয়নি। এমনকি কিরণকে যখন তার ফ্ল্যাটে রাখে, সেখানের ওয়াশরুমের বাথটাবও সরিয়ে ফেলে। কিরণের ভয়ার্ত দৃষ্টি জাওভানের নজরে পড়ে। কিরণকে দেখে জাওভান নরম হয়। তার ভালোবাসাকে এরা জোর করে কিরণের ভয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে! এত সাহস তাদের। জাওভান কিরণকে কাছে টেনে একহাতে জড়িয়ে ধরে। কিরণের পা তখন নিস্তেজ। তার এত নিকটে সমুদ্র যে শ্বাস উঠে যাচ্ছে। জাওভান কিরণের গাল ধরে কোমল কন্ঠে বলে,

‘ভয় পেও না সোনা। তোমার সমুদ্র নামতে হবে না। তোমার যেটা করতে ভালো লাগে না সেটা করা লাগবে না। তাও অন্যদের জোরাজুরিতে।’ শেষ কথাটা বলে সে আয়াতের দিকে রাগী দৃষ্টি ছুঁড়ে মারল। তারপর আবার কিরণের দিকে তাকিয়ে নরম হয়ে বলে,

‘চলো জান।’

জাওভান কিরণকে জড়িয়ে ধরে চলে যেতে নেয়। উজান এতক্ষণ নিশ্চুপ ছিল। কিরণের ভয় পাওয়াটা তার চোখেও পড়েছিল। কিন্তু সে চেয়েছিল কিরণ আসলে কত সাহসী তা দেখতে। তাদেরকে যেতে দেখে উজান প্রশ্ন করে,

‘এমন ভয় পেলে তো দুনিয়া চলে না। ভয় কাটাতে জানতে হয়।’

জাওভান ঘাড় পেছনে ফিরিয়ে উত্তর দেয়,
‘আমার কিরণ যেটাতে ভয় পায় তা কিরণের পায়েও মাড়াতে দেব না। কিরণকে কখনো ওর ভয় ছুঁতে পারবে না আমি থাকতে।’

জাওভান ধীর পায়ে কিরণকে নিয়ে চলে যায়।

.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here