ভালোবাসা কারে কয়,০৩,০৪
শবনম মারিয়া
পর্ব ৩
তূর্ণ ভোরবেলা বাসায় ঢুকেই তাড়াহুড়ো করে চন্দ্রার রুমের দিকে গেল। চন্দ্রার রুমের লকের এক কপি চাবি সবসময় তূর্ণর কাছে থাকে। সে এটা চন্দ্রার নিরাপত্তার জন্যই কাছে রাখে। লকের চাবিটা পকেট থেকে বের করে লকটা খুলতে গিয়ে থেমে গেল। ডাক দিল ঘরের কাজে সাহায্যকারী আমিনা খালাকে। আমিনা খালা এই বাড়িতে অনেক বছর ধরে কাজ করে আসছে। তূর্ণর শৈশবের অনেকটা সময় আমিনা খালার সাথে কেটেছে। তূর্ণর বাবা মা তাকে ছোটবেলা বেশি একটা সময় দেয়নি। তুর্ণকে খাবার খাইয়ে দেওয়া, গোসল করিয়ে দেওয়া এগুলো আমিনা খালাই করতেন৷ ঠিক যখন চন্দ্রা একেবারের জন্য এই বাড়িতে আসলো, তখন চন্দ্রার সব দায়িত্বও আমিনা খালার উপর আসলো। এই দুই ভাই বোন আমিনাকে মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করে। পরিবার, সন্তান ছাড়া আমিনার সবটা জুড়েই যেন তূর্ণ আর চন্দ্রা রয়েছে।
ভোর বেলায় তূর্ণের ডাক পড়তেই বুক কেঁপে উঠে আমিনার। আমিনা বিড়বিড় করতে লাগল,
“কালকে রাইতে আবার এই বাড়িতে চিল্লা পাল্লা হইসে। চন্দ্রা মা রাইতে খায় নাই। দরজা লাগায় দিসে। আবার বুঝি….. আল্লাহ রহম করো মাইয়াডারে।”
তূর্ণ আবার ডাক দিলো, “আমিনা খালা।”
সে একটু নিচু স্বরেই ডাকলো। দাদা দাদি ফজরের নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়েছেন নিশ্চয়ই। আমিনা দৌড়ে আসলো। তূর্ণ বলল,
“চন্দ্রা কি আমি যাওয়ার পরেই দরজা লাগিয়ে দিয়েছিল আমিনা খালা?”
“হ।”
তূর্ণ কিছু বলে না। আমিনা বলেন,
“বাবা আমি ডাকছিলাম৷ চন্দ্রা মা তো শুনেনা।”
তূর্ণর বিষন্নতায় ঘেরা চেহারায় এক চিলতে জোর করা তাচ্ছিল্যের হাসি আনলো। এই হাসিটায় যে শত কষ্ট লুকিয়ে আছে তা বোঝা যায়।
সে বলল,
“এটা আর পুরোনো কি খালা। ওকে বললে কি ও শুনবে?”
“শুনে তো না বাবা। কিন্তু আর কত? মাইয়াডা নিজেরে এমনে শ্যাষ কইরা ফেলতেসে। ও কি ঠিক হইবো না?”
“জানি না খালা। ও ছোটবেলা থেকে মনের মধ্যে যে আঘাত নিয়ে বড় হয়েছে, সেই আঘাতগুলো ওকে ঠিক হতে দিবে নাকি জানি না। আপনি গিয়ে সব ঠিক করেন। আমি এখানেই দাড়িয়ে আছি।”
আমিনা ঢুকে গেল রুমে। রুমে গিয়েই দেখল সব কিছু সরিয়ে ছিটিয়ে ফালানো। মাটিতে লুটিয়ে অর্ধ ন`গ্ন অবস্থায় পরে আছে। হাতে ব্লে`ড। শরীরের আবৃত স্থানগুলোতে ব্লে`ডের আচর। র`ক্তের ছোপ। এলোমেলো চুল। ফর্সা শরীর। স্নিগ্ধ চেহারা। ঘুমিয়ে আছে।
মেয়েটার এই অবস্থা দেখে যে কেউ ভয় পাবে। প্রথম প্রথম আমেনা ভীষণ ভয় পেতেন। কান্না করতেন। চন্দ্রার বয়র তখন পনেরো। রাতের বেলা অনেক চিৎকার করে কান্না করেছিল দরজা লাগিয়ে। দাদা দাদি দরজার কাছে এসে অনেক ডেকেছিল৷ শুনেনি চন্দ্রা। এরপর তূর্ণ বলেছিল থাক কান্না করুক। চন্দ্রার মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল সেদিন। ঐ দিনের আগে দীর্ঘ একটা বছর চন্দ্রা কান্না করেনি। পাথর হয়ে গিয়েছিল। ঐদিন কান্না করাতে তূর্ণর মনে হলো, অনেকদিন পর মেয়েটা কাঁদলো। কান্না করলে কষ্ট কমে। দোয়া করতে থাকলো চন্দ্রার কষ্টও যেন কমে। সকাল বেলা যখন তূর্ণ দরজা নক করেছিল৷ তখন চন্দ্রা উঠে দরজা খুলেছিল। চন্দ্রার অবস্থা দেখে তূর্ণ ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তখন বাড়ির সবাই জেনেছিল। চন্দ্রা মূলত নিজের মনের ভীতর লুকিয়ে থাকা কষ্টগুলোকে কমানোর জন্য নিজের শরীরে আঘাত করে। একটা ব্যাথা আরেকটা ব্যাথার কথা ভুলাবে এই ভেবে।
সেবার দাদা দাদিসহ ঘরের সকলে চিন্তিত হয়ে গিয়েছিল। এরপরেও কয়েকবার এমন হয়েছে। এরপর চন্দ্রা পরিবারের কাউকে জানতে না দেওয়ার জন্য শুধু শরীরের যে অংশ আবৃত থাকে সেখানে আঘাত করে। যেন জামার আড়ালে ঢেকে যায় ব্যাথাগুলো। কিন্তু চন্দ্রার এমন অবস্থা হয়ে যায় যে সে নিজেকে সামলে নিতে পারে না। এই জন্য তাকে তার ভাইয়ের সাহায্য নিতে হয়। এই জীবনে চন্দ্রা যা করেছে তার কোনো কিছু সে তার তূর্ণ ভাইয়ার কাছ থেকে লুকাতে পারে নি। বরং তার ভাইয়াই তাকে সামলেছে। তূর্ণ সবসময় চন্দ্রার কাছ থেকে ব্লে`ড, ছু`রি এগুলো সরিয়েছে। কিন্তু লাভ হয় নি।
সবসময় চন্দ্রা এভাবে নিজের শরীরে আঘাত করে। তূর্ণ বাড়ি এসে আমিনা খালাকে ডাকেন। তিনি গিয়ে চন্দ্রার কাটা জায়গাগুলো পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে তাকে জামা পরিয়ে দেয়। এরপর তূর্ণ রুমে ঢুকে।
আজ আমিনা চন্দ্রার কাটা জায়গায় ওষুধ লাগাতে দিয়ে দেখল পেটে একটু বেশিই কেটে গিয়েছে। ঘা গভীর হবে। তিনি ভয় পেয়ে গেলেন৷ তাড়াতাড়ি চন্দ্রাকে জামা পরিয়ে দিয়ে তূর্ণকে ঘরে ডাকেন৷ আমিনার চেহারার এই অবস্থা দেখে তূর্ণ ভয় পেয়ে যায়। তূর্ণ কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“খালা, কি হয়েছে?”
“বাবা তাড়াতাড়ি ভীতরে আসো। চন্দ্রার ব্যাথা গাঢ়।”
তূর্ণ তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকলো। চন্দ্রার চেহারাটা দেখেই তূর্ণ চিন্তা বেড়ে যায়। তূর্ণ তাড়াহুড়ো করে চন্দ্রাকে বিছানায় তুললো। চন্দ্রার ঘুম ভাঙে। চুপচাপ শুয়ে আছে। তূর্ণ ব্যান্ডেজ করে দেয়। ব্যাথায় কাতরায় চন্দ্রা। চন্দ্রা ব্যাথায় কাঁতরিয়ে বলে উঠে বলে,
“ভাইয়া অনেক ব্যাথা করছে। আর পারছি না। মরে যাব।”
তূর্ণ ধমকে বলে,
“চুপ। কি সব বলিস। এটুকুতে কিছু হবে না৷ নিতে যখন পারিস না কেন করিস এসব বাবা?”
“ভালো লাগে করতে।”
কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যের হাসির রেখা চন্দ্রার ঠোঁটে। আর তূর্ণের মুখে বিরক্তির ছাপ।
তূর্ণ বলল,
“চন্দ্রা আই এ্যাম সরি।”
“তুমি কেন সরি বলছো ভাইয়া? পৃথিবীটা কি এমনই? যাদের সরি বলা উচিত, পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত, তারা দিব্যি সুখে থাকবে। আর যে কোনো ভুল করবে না তারা শুধু শুধু সরি বলে যাবে?”
চন্দ্রার চোখের কার্নিশে পানি। তূর্ণ বলল,
“চন্দ্রা প্লিজ নিজেকে সামলাতে শিখে নে।”
“এখনও নিজেকে সামলে নেওয়া বাকি আছে ভাইয়া?”
“নিজেকে সামলানোর মানে এসব পাগলামি করা নয়। সুন্দরভাবে জীবনযাপন কর এগুলো থামিয়ে। বন্ধ কর নিজেকে কষ্ট দেওয়া। নিজেকে ভালো রাখা শিখে নে।”
“আমি এভাবেই ভালো থাকি ভাইয়া। এভাবেই শান্তি পাই৷”
“নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মাধ্যমে কিসের শান্তি চন্দ্রা?”
“শান্তি নেই কি? তাহলে কি তুমি বলতে চাচ্ছো তুমি নিজেকে কষ্ট দাও না?”
চুপ করে জানালার বাহিরে তাকিয়ে থাকে তূর্ণ। কিছুক্ষণ পর বলে,
“কে বলেছে আমি ভালো নেই? আমি তো ভালো আছি। আমি নিজেকে কখন কষ্ট দিলাম?”
“নিজেকে কষ্ট দাও না? তাহলে কেন একা থাকো? সবসময় চুপচাপ থাকো?”
“কোথায়? আমি একা নই। আমার দাদা দাদি আছে, তুই আছিস। তোদের সাথে কত কথাই তো বলি। এরপরেও চুপচাপ কিভাবে? রোগীদের সাথে কথা বলতে বলতে দিন রাত পার করে দেই। তারপরেও চুপ করে থাকি?”
চন্দ্রা তূর্ণের দিক তাকিয়ে হাসে। চন্দ্রার দিক তাকিয়ে তূর্ণ আবার বলল,
“সরি। আমি কাল রাতে দাদা দাদির সাথে রাগ হয়ে বলতে বলতে এমন কিছু বলে ফেলেছি, যার কথা আমার বলা উচিত হয় নি চন্দ্রা। আমার মাথা একদম ঠিক ছিল না। তোর কথা মনে থাকলে আমি ঐ কথাটা বলতাম না। কিন্তু আমি এই ফ্যামিলির সাথে ঘটে যাওয়া ব্যাপারগুলো মেনে নিতে পারি না। আমার মনে হয় না মানুষ বিয়ে করে সুখী হয়। তাই আমি চাই না বিয়ে করতে। এই জিনিসটা দাদা দাদি বুঝতে৷ চায় না।”
“ভাইয়া এসবের জন্য তুমি সরি বলো না। আমি পাগল। আমি এসব করবই।”
“না চন্দ্রা। তুই কেন এমন করিস? এইবারের ব্যাথাটা কত গাঢ় হয়েছে দেখেছিস? ঘা ঠিক হতেও কয়েকদিন লেগে যাবে।”
“থাক না। থাক। এই কয়টা দিন এই ব্যাথাটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলে আগের ব্যাথাগুলো ভুলে যাব সহজেই।”
“চন্দ্রা!”
“উফ প্রিয় ভাইয়া আমার, এতো কষ্ট পাও কেন? এতো রেগে যাও কেন? নানা, নানুর বয়স কত! নানা এসব নিতে পারে না। তাদের সাথে রাগটা কম করলে হয় না? মাথাটা ঠিক রাখলে হয় না?”
“তাঁরাও তো চুপচাপ থাকতে পারে। আমাকে আমার মতো থাকতে দিতে পারে। তা তো দেয় না। শুধু বিয়ে বিয়ে করে।”
“ভাইয়া এক কাজ করতে পারো। একটা কন্ট্র্যাক্ট ম্যারেজ করতে পারো। একটা মেয়ে দাদা দাদির সামনে তোমার বউ হয়ে নাটক করবে। তুমি তাকে পে করবে এইজন্য।”
“উফ! তোর মাথায়ই এসব উদ্ভট চিন্তা ভাবনা আসে।”
“আরে বাবা তোমার কথা বলেই ভাবলাম।”
“দেখ আমার বিয়ে হলে কিন্তু দাদা দাদি তোকেও বিয়ে নিয়ে তাড়া দিবে।”
“করলাম না হয় বিয়ে।”
“সিরিয়াসলি? হা হা হা।”
“হ্যা, বিয়ে করব। তবে তাকে আমাকে ভালোবাসতে হবে। সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে হবে। আর যদি ভালো না বাসে তাহলে তার কপালে সোজা মৃত্যু।”
“ফালতু কথা বলিস না। এই ওষুধটা খেয়ে নে। ব্যাথা কমে যাবে।”
তূর্ণ ওষুধ আর পানি দিল চন্দ্রার হাতে। চন্দ্রা ওষুধ নিয়ে খেয়ে নিল। তূর্ণ বলল,
“আচ্ছা। তুই রেস্ট নে আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। অনেক টায়ার্ড।”
“কেন? ইভাআপু এসে যত্ন নেয় নি?”
“উফ, ওর কথা আর বলিস না। মেয়েটা আমাকে জাস্ট জ্বালিয়ে খেলো। আজ সকালেও আমি ঘুমাচ্ছিলাম এসে আমার চশমা খুলে সরিয়ে রাখছিল। অসহ্য লাগে নারীরা আমার কাছ ঘেঁষলে। আর এই মেয়ে গায়ে পড়া স্বভাবের।”
“বেচারি তোকে সত্যিকারে ভালোবাসে। তোর ওকেই বিয়ে করে ফেলা উচিত। ইভাপুও শান্ত হবে আর দাদা দাদিও। এমনিও মেয়েটা এতোদিন তোর জন্যই একা হয়ে আছে। সেই মেডিকেল কলেজে পড়া অবস্থায় তোকে পছন্দ করেছে। তুই ওকে সব শেয়ার করিস। বেস্ট ফ্রেন্ড ভাবিস। এমনিও পরিবার ছাড়া, বাবা মা হারা মেয়ে এই শহরে একা থাকে। ওর বিয়ে করা উচিত। কিন্তু তোর জন্য করে না। তোকে সত্যিই ভালোবাসে ভাইয়া।”
“সত্যিকার অর্থে ভালোবাসা বলতে এই পৃথিবীতে কিছু নেই। শুধু ভালোলাগা আছে। আর ভালোলাগা ক্ষনিকের জন্য, চিরস্থায়ী নয়।”
“কিন্তু মেয়েটা তোর জন্য পাগল।”
“ওর শুধু আমাকে ভালো লাগে। কয়েক বছর পর আর লাগবে না। যখন মানুষ একটা সংসারে জড়িয়ে যায়, নিত্যদিনকার ঝামেলা আর ভালো লাগবে না। তখন মানুষ দুটো আলাদা হতে চাইবে। তাই বলছি কি দরকার? আর আমি ইভাকে ভালোবাসা দিতে পারব না। সি ডিজার্ভস বেটার। আই এ্যাম নট পারফেক্ট ফর হার। তাই সকালেও ওকে বুঝিয়েছি। ও ভালোবাসাতে বিশ্বাস করে। ও নিশ্চয়ই তেমন কারো সাথে সুখী থাকবে যে ভালোবাসায় বিশ্বাস করে। আমার সাথে নয়।”
চন্দ্রা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“হুম।”
তূর্ণ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে ভীষণ। সে বলল,
“একটু রেস্ট নিব। ঘন্টাখানিক ঘুমিয়ে নেই। আবার হসপিটাল আছে। আমি গেলাম৷ তুইও রেস্ট নে। পারলে ঘন্টাখানিক পর একটু ডেকে দিস যদি না উঠি।”
“আচ্ছা।”
তূর্ণ চলে যাওয়া ধরলে চন্দ্রা আবার পিছন থেকে ডেকে বলল,
“ভাইয়া!”
“হু, বল।”
“নানা নানুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিস। কথা বলিস। নিশ্চয়ই বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবে।”
“তা তো অবশ্যই। কথা তো বলবই। দাদার জন্য ভয় হয়। দিন দিন অনেক অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।দাদির সাথে এখন হুইলচেয়ারটাও তার নিত্যদিনকার সঙ্গী হয়ে উঠেছে।”
“হুম।”
তূর্ণ চলে যায়। চন্দ্রা উঠে ওজু করে ফজরের নামাজ কাজা পড়ে নেয়। দেরি হয়ে গিয়েছে। নামাজটা কখনো বাদ দেয় না চন্দ্রা। এক মাত্র নামাজে বসেই মেয়েটা কান্না করে সব বলে আল্লাহকে। চন্দ্রা শুধু জায়নামাজে কান্না করে। আর তূর্ণর সামনে কান্না করে। আর একা বদ্ধ ঘরে কান্না করে। অন্য কারো সামনে কাঁদে না মেয়েটা। তার কঠিন জীবন তাকে অন্যের সামনে কান্না করতে শেখায়নি।
চলবে….
ভালোবাসা কারে কয়
শবনম মারিয়া
পর্ব ৪
ঢাকার নামী দামী একটা ফাইভ স্টার হোটেলে একটু আগে সবকিছু ভাঙচুর হয়েছে। গোলাগুলি হয়েছে। ইতোমধ্যে নিহত হয়েছে পাঁচজন৷ আহতরা জিম্মি হয়ে আছে। পুলিশ, র্যাব অনেক চেষ্টা করছে জঙ্গিদের হাত থেকে দুইশত লোককে বাঁচাতে। হোটেলের অনেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সবাই বের হতে পারে নি। অনেক প্ল্যান পরিকল্পনা করেছে ডিফেন্সের টিম। অবশেষে মিশনে নেমেছে। হোটেলের কিচেনের দিক দিয়ে চুপচুপি প্রবেশ করেছে ইন্সপেক্টর পরশি ও তার টিম। অন্যান্য টিমের সদস্যরা অন্যান্য দিক থেকে ঢুকে এ্যাটাক করছে। কিচেনে কেউ নেই। তবুও সাবধানতার সাহায্যে আগাচ্ছে পরশি। হাতে পিস্তল। কপালে জমে আছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। একটা ভুল হলেই জান শেষ। নিজের জানের থেকেও দুইশত মানুষের জানের চিন্তা। পুলিশ আর র্যাব বাহিনী হোটেলে ঢুকেছে শুনলেই গুলি করে দিবে একে একে সবাইকে। পরশি এগিয়ে যাচ্ছিলো, এমন সময়ই গুলির আওয়াজ। সবাই থমকে দাঁড়িয়ে যায়। সাথের চার জন নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে পরলো পরশির আদেশে। পরশিও দু পা পিছিয়ে গেল। আস্তে আস্তে বলল,
“রেডি হয়ে যান সকলে। গুলির আওয়াজ পাশেই। এখানেই লুকিয়ে থাকবেন। কেউ আসলেই সোজা এ্যাটাক করবেন৷ দেয়ালের আড়ালে থেকেই গুলি করবেন। যার যার পজিশনে চলে যান।”
আদেশ মতো সবাই যার যার পজিশনে। আরও গুলির আওয়াজ। একজন লোক রক্তাক্ত অবস্থায় দৌড়ে কিচেনে ঢুকলো। কিন্তু পিছুন থেকেই গুলি করলো জঙ্গিদের মধ্যে একজন। লোকটা পড়ে গেলো জায়গায়। এরই মধ্যে পুলিশদের মধ্যে একজন গুলি করলো। পিছনে জঙ্গিদের আরও দুইজন ছিল। পুলিশ দেখেই হামলা শুরু করলো। পুলিশদের মধ্যেও একজন আহত হয়ে পড়ে গেল। আরও লোক এসে হামলা চালাতে শুরু করলো পুলিশের উপর। পুলিশের দলের বাকি লোকেরা শুরু করলো গোলাগুলি।
পরশি সামনে না গিয়ে দেওয়ালের আড়াল থেকেই খুব চতুরতার সাথে গুলি করতে থাকলো। এভাবে পরশির সাথে আসা চারজন পুলিশের দুইজন আহত হয়ে পড়ে আছে। নিহত হয়েছে একজন। এরকম ব্যর্থতা পরশি প্রথম দেখছে। তার সামনে কি করে মানুষের জান চলে যাচ্ছে! কিছু করার নেই। আরও প্রাণ বেঁচে আছে। তাদের আগে বাঁচাতে হবে। পরশি গুলি করে। গুলিতে পড়ে যায় বিপক্ষ দলের লোক।
পরশির পিস্তলে আর একটা গুলি আছে। এটা নিয়ে চলা কঠিন। যে দুজন মারা গিয়েছে পরশি আত্ম রক্ষার জন্য সেগুলো তুলে নিল। হঠাৎ করে একটা শব্দ হলো কোণার দিকে। পরশি বুঝতে পারলো সেখানে কেউ আছে। কে আছে? কোনো ভিক্টিম নাকি কেউ ট্র্যাপে ফেলছে? ভাবতে ভাবতে সতর্কতার সাথে পরশি আগালো। কিচেনের ঐদিক টায় বিভিন্ন সরঞ্জাম রাখা। পরশি সাবধানতার সাথে এগিয়ে গেলো। একটু ভয়ে ভয়েই ছিল। পিস্তলটা রেডি রেখেছে।
ওদিকটায় এগিয়ে গিয়ে পরসি অবাক! একটা ছোট্ট বাচ্চা এখানে লুকিয়ে আছে। লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাচ্চাটা ভীষণ ভয়ে আছে। এতোটুকু বাচ্চা! বয়স আট কি দশ হবে। এতোটুকু বাচ্চার এসব ঘটনায় এমন অবস্থাই হওয়ারই কথা।
পরশি একজন পুলিশ হিসেবে অনেক শক্ত। কিন্তু এতোটুকু বাচ্চার এই অবস্থা দেখে অনেক মায়া হলো। বাচ্চাটা অনেক ভয় পেয়ে আছে। পরশি কেও ভয় পাচ্ছে। পরশি আস্তে আস্তে করে বলল,
“বাবা আমাকে ভয় পেও না। আমি তেমার কোনো ক্ষতি করব না। আমরা তোমাদের বাঁচাতে এসেছি।”
বাচ্চাটা যেন একটু বিশ্বাস করল পরশিকে। বাচ্চাটা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
বাচ্চাটা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
“ওরা আমার আব্বু আম্মুকে আটকে রেখেছে। আব্বু আমাকে এখানে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল। আব্বু আমাকে ওদের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যেতে বলেছিল। বলেছিল আমাকে খুঁজে ঠিকই নিতে আসবে। কিন্তু এখনও আসেনি৷ ওরা কি করেছে আমার আব্বু আম্মুর সাথে? আমি আব্বু আম্মুর কাছে যাবো।”
বলেই কেঁদে দিল বাচ্চাটা। পরশি বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আব্বু, আম্মু ঠিকাছে। তুমি কেঁদো না বাবা।”
“আন্টি প্লিজ তুমি আমাকে আমার আব্বু আম্মুর কাছে নিয়ে চলো।”
“বাবা নিয়ে যাবো তো। কিন্তু এখন এখান থেকে বের হলে দুষ্টু লোকেরা আমাদের উপর অ্যাটাক করবে।”
“কিন্তু আমি আম্মুর কাছে যাবো।”
“হ্যাঁ, যাবে তো। ধরো এটা একটা খেলা। তোমার আব্বু আম্মুর সাথে দেখা করতে হলে তোমাকে এই দুষ্টু লোকদের থেকে লুকিয়ে থাকতে হবে যাতে এরা তোমাকে এ্যাটাক করার সুযোগ না পায়। এরপর যখন এদের আমরা ধরে ফেলব তখন আব্বু, আম্মুর কাছে যাবে। তখন গেইমে জিতে যাবে। ঠিকাছে? আমাকে প্রমিজ করো তুমি এখানে চুপচাপ লুকিয়ে থাকবে। যত যা-ই হোক না কেন এখানে চুপচাপ থাকবে। কাঁদবে না। শব্দ করবে না। আমি তোমাকে তোমার বাবা মায়ের কাছে নিয়ে যাবো। তুমি এখানেই থেকো, আমাদের টিম এসে তোমাকে বাহিরে সেফ জোনে নিয়ে যাবে। প্রমিস।”
বাচ্চাটা চুপচাপ বসে রইলো। পরশি মনে মনে দোয়া করল,
“আল্লাহ বাচ্চাটার বাবা মাকে ভালো মতো রেখো। বাচ্চাটার বাবা মাকে যেন বাঁচাতে পারি।”
পরশি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে আবার কাজে লেগে গেল। এই এক কিচেনে আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না৷ এখান থেকে বের হতে হবে। ওয়াকিটকিতে এখানের অবস্থা সম্পর্কে জানালো। বাচ্চাটার কথাও জানালো। যত দ্রুত সম্ভব বাচ্চাটাকে এখান থেকে সেফ জায়গায় নিতে হবে।
কিছুক্ষণ পর পুলিশের আরেকটা টিম একই জায়গা দিয়ে প্রবেশ করলো বাচ্চা টিকে বাঁচাতে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত এতোক্ষণে জঙ্গিরা সবটা টের পেয়ে গিয়েছে। তারা ক্ষুব্ধ হয়ে আরও কয়েকজনকে গুলি করেছে। ডিফেন্সের সকলে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
পুরো চার ঘন্টার অভিযানের পর অবশেষে পরিকল্পনা মোতাবেক পরিস্থিতি কিছুটা পুলিশের হাতে এসেছে৷ জঙ্গিদের আটক করতে পেরেছে পুলিশ। পনেরো জনের মধ্যে ছয় জন নিহত হয়েছে। কিন্তু একজনকে এখনও পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ টিম দুই রুমে যে কয়জন আটক ছিল তাদেরকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে। এখনও অনেকে হয় তো পুরো হোটেলে কেথাও না কোথাও আহত হয়ে পড়ে আছে অথবা লুকিয়ে আছে। তাদের সন্ধান করে নিয়ে আসতে হবে। সাথে জঙ্গিদের মধ্যকার একজনকে এখনও পাওয়া যায় নি।
পরশি আবার কিচেনের দিকে এসেছে টিমের একজনকে নিয়ে। জঙ্গিদের মধ্যকার একজনকে খুঁজছে। তারা সফল হলো। এখানেই আছে সে। তার উপর হামলা করার আগেই অফিসার রিফানের দিকে গুলি করলো লোকটা। একটুর জন্য গুলিটা শুধু হাতে লেগেছে। এই দেখে কেঁপে উঠলো পরশি৷
পরশিকে দেখে বাচ্চাটা বেড়িয়ে আসলো৷
“আন্টি বলে চিৎকার করে উঠলো।”
আঁতকে উঠলো পরশি। বাচ্চাটাকে তখনও সরাতে পারেনি পুলিশ ফোর্স। সে এখানেই লুকিয়ে ছিল এতোক্ষণ। বাচ্চাটা পরশিকে দেখেই বেরিয়ে এলো। সে হয়তো ভেবেছে পরশি তাকে নিতে এসেছে।
বাচ্চাটাকে বের হতে দেখেই লোকটা হিংস্র হয়ে ওর দিকে পিস্তল ধরলো। বলল,
“কেউ এদিকে আগাবি না। তাইলে এই বাচ্চারে শেষ করে দিবো।”
পরশি বুঝতে পারছে না কি করবে। বুঝতে পারছে রিফানও। তার হাতে প্রচুর যন্ত্রণা করছে। রক্তের স্রোত বেয়ে যাচ্ছে। হাতটা চেপে ধরে আছে। তবুও বাচ্চাটার জন্য চুপচাপ দাড়িয়ে আছে তারা।
পরশি কাঁপা কন্ঠে বলল,
“বাচ্চাটাকে ছেড়ে দাও। তোমার কোনো ক্ষতি করব না। আত্মসমার্পণ করে নাও সময় থাকতে।”
“তোরা আগে পিস্তল নামা। নাইলে এই বাচ্চার লাশ নামবে।”
বাচ্চা চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে সে বের হয়ে অনেক বড় একটা ভুল করেছে।
পরশি কথা বলছিল ওর সাথে। এর মাঝেই সে রিফানকে ইশারায় গুলি করতে বলে। রিফান হাত ব্যথ্যা নিয়ে বেশ কষ্টে গুলি করে। গুলি গিয়ে লাগে লোকটার হাঁটুতে। সাথে সাথে চিৎকার লোকটা বসে পরে। পরশি দৌড়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দৌড় দেয়। ঠিক এমন সময়ই পিছন থেকে লোকটা তার বন্দুক দিয়ে পরশির দিকে গুলি করে। গুলি গিয়ে পরশির পিঠে লাগে। পড়ে যার পরশি।
পরশিকে গুলি করার সাথে সাথেই রিফান একাধারে গুলি করে লোকটাকে। লোকটা নিহত হয়। রিফান আহত হাতে তাড়িতাড়ি ওয়াকিটকিটা নিয়ে রিপোর্ট করে। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় পরশিকে।
পরশি জ্ঞান হারানোর আগে রিফানকে বলে,
“অফিসার, প্লিজ বাচ্চাটাকে ওর বাবা মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়েন।”
.
হসপিটালে একটু পর পর রোগী আসছে। তূর্ণ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে পেশেন্টদের নিয়ে। এমন খুব কমই হয়। ম্যাক্সিমাম পেশেন্ট গুলিতে আহত। ইতোমধ্যে কতগুলো মানুষ হসপিটালে পৌছানোর আগেই লাশ হয়ে যাচ্ছে। তূর্ণ এই মাত্র একটা জটিল সার্জারী করে বের হলো। তূর্ণর মাথা ঠিক নেই। একের পর একটা রোগী। এরই মধ্যে হঠাৎ গুলিতে আহত একজন পুলিশ অফিসারকে নিয়ে আসা হলো।
তূর্ণ দেখেই নার্সকে ডেকে বলল, তাড়তাড়ি ওটিতে নেন। তূর্ণ ঢুকে পরলো ওটিতে। প্রস্তুত অপারেশনের জন্য। শুরু হলো অপারেশন। এতটুকু সময়ের মধ্যে অনেকখানি ব্লিডিং হয়ে গিয়েছে। হসপিটালের কিছুটা দূরত্বেই একটা ফাইভ স্টার হোটেল। সেখানেই হামলা হয়েছে। সেখান থেকে আসতে এতোটা ব্লিডিং একটু অস্বাভাবিক। ঠিক এই সময় রক্তও পাওয়া যাচ্ছে না। কম বেশি সবারই রক্তের প্রয়োজন।
তূর্ণ নার্সকে বলল,
“ব্লাড লাগবে এই মুহুর্তে।”
ব্লাড অবশ্য পাওয়া গেল। একজন পুলিশই ব্লাড দেয় পরশিকে।
অবশেষে তূর্ণ পরশির অপারেশন সম্পূর্ণ করলো। মনের মধ্যে একটা শান্তি লাগছে। তূর্ণ হাতের গ্লাভসটা খুলে হাত পরিষ্কার করছিল। উপস্থিত এক জুনিয়র তূর্ণকে বলল,
“দেখেছেন স্যার, এনাদের জীবনের মূল্য কতটা ঠুনকো। অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেদের লাইফ রিস্ক।”
“এইজনয়ই এনাদের বাঁচানো আমাদের ফরজ।”
“আরেকজন অফিসারেরও অবস্থা খারাপ ছিল। বাঁচানো যায়নি। এনার ভাগ্য ভালো। অবশ্য আপনার পেশেন্ট মানেই ভাগ্য ভালো স্যার।”
“এভাবে আসলে বলা যায় না। কার হায়াত কতটুকু এটা শুধু শুধু আল্লাহ জানেন৷ কারো কপালে মৃত্যু থাকলে তাকে আমরা অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারি না।”
“জি স্যার। তা ঠিক।”
“এনার সাথে আরেকজন অফিসার ছিলেন৷ হাতে গুলি লেগেছিল। তিনি কেমন আছেন? জানো কিছু?”
“শুনলাম তো ঠিকাছে।”
“আচ্ছা।”
চলবে….