ভালোবাসা কারে কয়,২১,২২
শবনম মারিয়া
পর্ব ২১
তূর্ণকে বাসায় দেখে চন্দ্রা জিজ্ঞেস করলো,
“কই ছিলে এতোক্ষণ ভাইয়া? মানে প্রণয় ভাইয়া তো আমার আর প্রণয়িনীর সাথে ছিলেন৷ তাহলে তুমি এতোক্ষণ একা একা কই ছিলে?”
“আমার একটু কাজ ছিল এক জায়গায়। সেখানে গিয়েছিলাম। আর তারপর পরশির সাথে দেখা হলো। কথা হলো। উনি বাসায় ডাকলেন চায়ের জন্য। কথা হলো। এই আর কি।”
“ওহ্৷ পরশি আপুর বাসায় ছিলে।”
“হুঁ। তুই কি মাত্র আসলি?”
“হ্যাঁ। প্রণয়িনী এটা সেটা বায়না করে তাই দেরি হয়ে গেল। অসুবিধা নেই প্রণয় ভাইয়া আমাকে নিচ পর্যন্ত দিয়ে গিয়েছে।”
“তা আমার ভালো করে জানা। প্রণয় কখনো দায়িত্বহীনের মতো তোকে একা ছেড়ে দেওয়া মানুষ না।”
“হুঁ। তো ভাইয়া পরশি আপুর সাথে সময় কাটাতে কেমন লাগলো?”
“ভালোই। তবে…”
“তবে কি?”
“কথায় কথায় জিজ্ঞেস করে ফেলেছিল আমার মা কোথায় থাকে। এসব প্রশ্ন করার পর আমার মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল। জানি আমার ভুল হয়েছে। ও অনেক অপরাধবোধ করছে জিজ্ঞেস করার জন্য। কিন্তু ভুল তো ওর না।”
“কিছু বলেছো? মানে রিঅ্যাক্ট করে বসেছো?”
“নাহ্। জাস্ট চলে এসেছি।”
“হয়েছে। আপু কিছু মনে করবেন না। আর ভাইয়া তুমি সব কিছু এতো সুন্দর করে হ্যান্ডেল করে নিতে পারলেও মামা মামির কথায় কেন রিঅ্যাক্ট কর? হ্যাঁ, তাঁদের উপর তোমার অনেক রাগ। তাই বলে সবসময় রিঅ্যাক্ট করার কি দরকার? এসব বাচ্চা মানুষ করলে মানায়। তোমার কি কম বয়স হয়েছে?”
“ওহ্, রিয়ালি চন্দ্রা তুই বলছিস এসব কথা? তুই নিজে কি করিস? তোর বয়স কি একেবারেই কম? বোধবুদ্ধি হয় নি? তারপরেও তো।”
ঠিক এমন সময় তোহরাব সাহেব চলে আসেন। চন্দ্রা তূ্র্ণ দুজনেই চুপ হয়ে যায়।
“সরি চন্দ্রা, সরি।” এই বলে তূর্ণ নিজের রুমে চলে যায়।
তোহরাব সাহেব ব্যাপারটা বুঝে চন্দ্রাকে বলে,
“চন্দ্রা, মা তোর ভাইকে বুঝাতে যাস না। ওকে বুঝাতে গেলে সময় নষ্ট। শুধু শুধু ঝাড়ি খাওয়া লাগবে তোর।”
চন্দ্রা আর কিছু বলল না।
.
প্রণয় বাসায় যেতে যেতে প্রণয়িনী গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রণয় ওকে কোলে করে বাসায় নিয়ে গেল। বাসায় যেতেই প্রণয়িনী উঠে গেল। প্রণয় মেয়ের দিক তাকিয়ে হেসে বলল,
“উঠে গিয়েছো বাবা?”
প্রণয়িনী কিছু বলল না। সে তার বাবার সাথে রাগ করেছে। প্রণয় প্রথমে না বুঝলেও কয়েকবার কথা বলার পর যখন দেখলো প্রণয়িনী কিছু বলছে না তখন বুঝতে পারলো মেয়ে তার অভিমান করেছে। প্রণয় প্রণয়িনীকে বলল,
“বাবা উপর দেখি ভীষণ রেগে আছে বাবার প্রাণ।”
প্রণয়িনী এবার মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। তারপর বলল,
“তোমার সাথে আমার আর কথা নেই। তুমি আমাকে বকা দিয়েছো।”
প্রণয় এবার প্রণয়িনীকে কোলে নিতে গেল। প্রণয়িনী সরে গেল। প্রণয় অবাক হয়ে বলল,
“এতো রাগ? বাবার উপর এতো রাগ করতে হয় না মা।”
“না না বাবা ভালো না। বাবা বকে।”
প্রণয় এবার নিজের দু’হাত দিয়ে কান ধরে প্রণয়িনীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“বাবা সরি মা। আর রাগ করবে না।”
প্রণয়িনী বাবার দিক কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর হাসি দিয়ে গিয়ে প্রণয়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়লো। তারপর বলল,
“সরি বললে তো রাগ চলে যেতে হয় তাই না বাবা?”
“হ্যাঁ মা।”
“আমার রাগ নেই আর। ডোন্ত বি স্যাড বাবা।”
প্রণয় মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“এই তো আমার বুদ্ধিমতি মেয়ে।”
“বাবা বাবা।”
“হুঁ।”
“একটা রিকুয়েস্ত।”
“কি?”
“প্লিজ বলো শুনবে।”
“আগে বলবি তো বাবা।”
“চন্দা আন্তিকে ফোন দাও প্লিজ।”
“তাকে ফোন দিয়ে কি হবে শুনি।”
“প্লিজ বাবা।”
“একদম না প্রণয়িনী। তোমাকে কতবার বুঝিয়েছি না আন্টিকে ডিস্টার্ব করা যাবে না। আন্টি বিরক্ত হবে।”
“হবে না আন্তি বিকর্ত। আন্তি ভালো।”
প্রণয় হেসে দিয়ে বলল,
“আবার বিকর্ত! বলো বিরক্ত।”
প্রণয়িনী বলল,
“প্লিজ তুমি ফোন দাও৷ আমি ঠিক করে বলব।”
প্রণয় এবার একটু বিরক্ত হয়ে বলল,
“প্রণয়িনী কথা বললে শুনতে হয়। দেওয়া যাবে না ফোন। চুপচাপ বসো এখানে। আমি ড্রেস এনে চেঞ্জ করিয়ে দিচ্ছি। ফ্রেশ হয়ে নিবে তারপর।”
এই বলে প্রণয় উঠে চলে গেল। প্রণয়িনী মন খারাপ করে খাটে বসে রইলো। প্রণয় আলমারিতে গিয়ে প্রণয়িনীর জামা বের করতে গিয়ে থমকে গেল। ড্রয়ারটা খুলল। ড্রয়ার থেকে চন্দ্রার একটা ছবি বের করলো। তারপর সেটা কতক্ষণ দেখল। তারপর আয়না দিয়ে প্রণয়িনীর দিক তাকিয়ে দেখল মেয়েটা মন খারাপ করে বসে আছে। ছবিটা জায়গায় রেখে আবার ফিরে এলো প্রণয়িনীর কাছে। খাটে এসে বসলো৷ তারপর ফোনটা হাতে নিল।
মনে মনে নিজেকে বলল,
“বাবা আর মেয়ের দুর্বলতা একদিকে কেন? বাবাও যেমন মেয়েটাও তেমন। দুজনেই চন্দ্রার সাথে কথা বলতে চাই। চন্দ্রার সাথে সময় কাটাতে চাই। কিন্তু বাবার তো দূরে থাকতে হয়। মেয়ে না হয় দূরে না থাকুক। যেটুকু কাছে পায় পাক। মেয়ের মাধ্যমে না হয় একটু নিজেও কথা বলে নিতে পারব। মেয়েটার মুখেও হাসি ফুটবে আর বাবার মনটাও শান্ত হবে।”
আর কিছু না ভেবে প্রণয় ফোন করল চন্দ্রাকে। চন্দ্রা প্রণয়ের ফোনটা পেয়েই সামান্য বিরক্ত হয়ে বলল,
“উফ আবার কি হলো। এখন আবার কল করছে কেন?”
পরক্ষণেই মনে পড়লো প্রণয়িনীর কথা। তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করে নিল।
“হ্যালো চন্দ্রা।”
“হুম।”
“আই এ্যাম সরি আবার ডিস্টার্ব করার জন্য। কিন্তু আসলে প্রণয়িনী জোর করলো। জানোই তো আমি রাগ করেছিলাম দেখে সে আকাশসম অভিমান করে বসে ছিল৷ অনেক কষ্টে অভিমান ভাঙানোর পর এখন আবার আবদার করে বসেছে তার চন্দ্রা আন্টিকে ফোন দাও৷”
“আর তারপর আপনি আবার রাগ করেছেন মেয়েটাকে৷ আবার অভিমান করেছে মেয়ে। এইজন্য কল দিয়েছেন। তাই তো?”
“হ্যাঁ।”
চন্দ্রা হেসে বলল,
“আপনাকে না বলেছি প্রণয়িনী যখন কথা বলতে চাবে তখন ফোন দিয়েন। শুধু শুধু মেয়ের মন খারাপ করে দেন কেন? আপনি লোক ভালো না।”
“আচ্ছা সরি। এবার তোমরা কথা বলো। প্রণয়িনী আর ওয়েট করতে পারছে না।”
“দিন।”
প্রণয় প্রণয়িনীকে ফোন দিয়েই বলল,
“বেশিক্ষণ কিন্তু ডিস্টার্ব করবে না আন্টিকে। তাড়াতাড়ি কথা শেষ করবে।”
চন্দ্রা প্রণয়ের কথা শুনে মনে মনে ভাবলো,
“ইশ!৷ নিজে ডিস্টার্ব করে তার বেলায় কিছু না৷ মেয়েকে আসছে বলতে।”
প্রণয়িনী কানে ফোন নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রণয় বলল,
“উঁহু, বাবুরা কানে ফোন নিয়ে কথা বললে ক্ষতি হয় মা। স্পিকারে দিয়ে দিচ্ছি কথা বলো।”
প্রণয় ফোনটা স্পিকারে দিয়ে দিল। প্রণয়িনী আর চন্দ্রা তাদের আলাপ শুরু করল। প্রণয় মূলত চন্দ্রার কন্ঠ শোনার জন্যই ফোনটা স্পিকারে দিয়ে দিয়েছে। প্রণয়িনী যতক্ষণ কথা বলল প্রণয় পাশে বসে বসে চন্দ্রার কথা শুনলো। চন্দ্রা আর প্রণয়িনী যখন একসাথে হাসে তখন কি মিষ্টি শোনা যায় দুজনের হাসি একসাথে! প্রণয়ের কাছে চন্দ্রার কন্ঠ নেশার মতো লাগে।
প্রণয়িনী আর চন্দ্রার কথা শেষ হয়। প্রণয়ের যেন ঘোর কেটে শেষ হয়।
গভীর রাতে যখন সকলে ঘুম। তখন প্রণয় চোখ খুলে বসে আছে। ফোনটা নিয়ে রেকর্ডিংটা অন করে নিল। প্রণয়িনী আর চন্দ্রা যখন কথা বলছিল প্রণয় প্রণয়িনীর হাতে ফোনটা দেওয়ার আগেই কল রেকর্ডিংটা অন করে দিয়েছিল। এটা করেছিল প্রণয় পরবর্তীতে যেন চন্দ্রার কন্ঠ বারবার শুনতে পারে। এখনও সেই রেকর্ডিংটাই শুনছে। প্রণয়ের দুটি প্রাণের কন্ঠ। একটা প্রণয়িনী অন্যটা চন্দ্রা। চন্দ্রা কি সুন্দর প্রণয়িনীর সাথে মিশলে বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়৷ প্রণয়িনী যখন খিল খিল করে হাসে। চন্দ্রাও ঠিক ওভাবেই হাসে।
প্রণয় চোখটা বন্ধ করে চন্দ্রার হাসি শুনছিল আর চন্দ্রার মুখটা কল্পনা করছিল। ঠিক এমন সময়ই চন্দ্রার সেই মিষ্টি হাসি বন্ধ হয়ে ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো।
ফোনের স্ক্রিনে চন্দ্রার নাম দেখেই প্রণয়ের মনে পড়ে গেল। প্রণয় অসহায়ের মতো ফোনের স্ক্রিনের দিক তাকিয়ে বলল,
“কেন চন্দ্রমল্লিকা? কেন? তোমার কন্ঠ শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকি। কিন্তু তোমার এমন ফোন পেয়ে আঁতকে উঠি। ছোট্ট রঙিন চন্দ্রমল্লিকাকে এসবে মানায় না। কেন বুঝো না চন্দ্রমল্লিকা?”
ফোনটা কেটে গেল। চন্দ্রা বিরক্ত হয়ে উঠলো। কাজের সময় এই লোকটা ফোন রিসিভ করে না৷ চন্দ্রার রাগ হচ্ছে। সে আর অপেক্ষা করতে পারছে না৷ এখন ফোন রিসিভ না করলে দেরি হয়ে যাবে। যেটা চন্দ্রা চায় না। চন্দ্রা আবার ফোন দিল। এবার ফোনটা রিসভ না করলে টেক্সট দিবে ভেবে নিয়েছে সে। সে আবার ফোন করল। এবার প্রণয় ফোন রিসিভ করল।
ফোন রিসিভ করার সাথে সাথেই চন্দ্রা ব্যাকুল হয়ে বলল,
“হ্যালো। আপনি কি ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন? ফোনটা কেন রিসিভ করছিলেন না? উফ! জানেন না কাজ আছে৷”
“সরি। ভুলে গিয়েছিলাম।”
“ভুললেন কিভাবে?”
“শুনো চন্দ্রমল্লি…,” বলে থেমে যায়৷ এখন চন্দ্রার মাথা খারাপ। এই সময় চন্দ্রমল্লিকা বললে আরো রেগে যেতে পারে। তাই প্রণয় বলল,
“সরি চন্দ্রা, প্লিজ আজকে বাদ দাও। ছেড়ে দাও।”
“কিহ্? বাদ দিব মানে কি? সত্যি করে বলুন তো আপনি শ’য়’তা’নটাকে ছেড়ে দেন নি তো?”
“না। সেরকম না। বলছিলাম সবসময় নিজের হাত ময়লা করার কি দরকার? রফিকুল আছে। ও একটা ব্যবস্থা করে দিবে।”
“না। যা করার আমি করব৷ না হলে আমি শান্তি পাব না৷ নিজের হাতে করব৷ নিজের হাতে। হা হা হা।” বলেই চন্দ্রা খিলখিল করে হেসে ফেলল।
প্রণয় বলল,
“আচ্ছা ঠিকাছে। আমি আসছি। তবুও নিজেকে কিছু করো না। আমি এখুনি আসছি। চুপচাপ নিচে নেমে থাকো। আমি পৌঁছানোর আগে একা একা এক পা-ও বাড়াবে না কিন্তু।”
“আচ্ছা। তাড়াতাড়ি আসুন৷ দেরি যেন না হয়।”
প্রণয় গাড়ির চাবিটা আর ফোন পকেটে ভরে নিলে। তারপর ঘুমন্ত প্রণয়িনীর দিক তাকিয়ে একটু হেসে বলল,
“রাত দুপুর বেলা না ঘুমিয়ে তোর বাবাকে এখন যেতে হচ্ছে তোর চন্দ্রা আন্টির পাগলামি পূরণ করতে। না যেয়েও উপায় নেই। এগুলো সব সহ্য করে নিতে হয়। কারণ তোর চন্দ্রা আন্টি তার এই পাগলামি পূরণ না করতে পারলে নিজেকে আ’ঘা’ত করে। আর এই ব্যাপারটা সহ্য করতে পারি না।”
প্রণয় বের হয়ে গেল চুপচাপ। রাতের বেলা কখনো প্রণয়িণী ঘুম থেকে উঠে না৷ আর বাসার কেউও প্রণয়ের রুমে আসে না৷ কেউ দেখেও না৷
প্রণয় চন্দ্রার বাসার নিচে পিছনের দিকের রাস্তায় গাড়ি রেখে গেইটের কাছে এলো। দারোয়ান ঘুমাচ্ছে। প্রণয় ফোন করল চন্দ্রাকে।
চন্দ্রা ফোন রিসিভ করল। প্রণয় জিজ্ঞেস করল,
“কোথায়? আমি বাসার নিচে।”
“আসছি।”
“সাবধানে।”
“হুম।”
চন্দ্রা প্রথমে রুমের দরজা হালকা ফাঁকা করে দেখে নিল কেউ উঠেছে কি না৷ তারপর বের হলো। প্রতিটা পদক্ষেপ খুব সাবধানে অতিক্রম করছে চন্দ্রা। দরজার কাছে এসে দরজা খুলতে যাবে। ঠিক এমন সময় দরজা খোলার আওয়াজ শুনতে পেল। আওয়াজটা তোহরাব সাহেবের দরজার। চন্দ্রা দ্রুত সরে গেল তূর্ণর রুমের দিকে। মেইন দরজার থেকে তূর্ণ রুমটাই কাাছে। তাড়াহুড়োতে চন্দ্রা ছিটকে পড়ে গিয়ে দেওয়ালের সাথে কপালে বাড়ি খেতে গেল। এমন সময় একটা হাত এসে চন্দ্রার কপালে আঘাত লাগা থেকে বাঁচালো।
চলবে….
ভালোবাসা কারে কয়
শবনম মারিয়া
পর্ব ২২
চন্দ্রা চোখ বন্ধ করেছিল। দেয়ালে বাড়ি খেয়ে মাথা ফে`টে যাবে এমন কিছুই ভেবেছিল। কিন্তু হাতটা বাঁচিয়ে দিয়েছে। চন্দ্রার বুঝতে বাকি নেই হাতটা কার। যার হাত তার বকা খাওয়ার ভয়েই চন্দ্রা আস্তে আস্তে চোখ খুলল। চোখ খুলে তূর্ণর দিকে তাকিয়ে মুখে একটু হাসি আনলো। ততক্ষণে তূর্ণ ইশারা দিয়ে চন্দ্রাকে নিজের রুমে আসতে বলল। চন্দ্রা ভাইয়ের আদেশ মতো রুমে ঢুকে গেল।
তোহরাব সাহেব ততক্ষণে ডাইনিং রুম থেকে পানি নিয়ে চলে গিয়েছেন৷ তিনি কিছুই টের পাননি৷
চন্দ্রার উপর চরম আকারে ক্ষেপে আছে তূর্ণ। তূর্ণ ওকে বলল,
“কোথায় যাওয়া হচ্ছিল?”
“মানে ভাইয়া, আসলে,… ”
তূর্ণ ধমকে বলল,
“বল।”
চন্দ্রা এবার কিছুটা শক্ত কন্ঠেই বলল,
“আমাকে যেতে হবে। প্রণয় ভাইয়া নিচে ওয়েট করছেন এতক্ষণ ধরে। দেরি হচ্ছে।”
“যখন তখন এসব কিন্তু ঠিক না চন্দ্রা। তোকে সাবধান হতে হবে। আজ ধরা খেলে কি করতি? কি বলতি?”
“আমি বুঝতে পারিনি মামা এই সময় উঠে তার রুম থেকে বের হবেন।”
“এরকম অনেক কিছুই বুঝা যায় না। কখন কি হবে আমরা আগে থেকে কখনো বুঝতে পারি না৷ দূর্ঘটনা বলে ঘটে না৷ হঠাৎই ঘটে। আমরা ভাবতেও পারি না সেটা যে ঘটবে।”
“জি, বুঝেছি।”
“বুঝেছো যেহেতু, চুপচাপ রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”
চন্দ্রা অগ্নিদৃষ্টিতে তূর্ণের চোখ বরাবর তাকায়। সে বলল,
“ভাইয়া!”
“আজ আর কোথাও যাবে না।”
“প্রণয় ভাইয়া সব রেডি করে রেখেছে। কিচ্ছু হবে না ভাইয়া৷ প্লিজ।”
“আমি না করেছি চন্দ্রা।”
“ভাইয়া আরেকবার ভেবে নাও। আমি কিন্তু নিজেকে আ`ঘাত করব৷ তুমি ভালো করেই জানো জা`নো`য়ারদের র`ক্ত হাতে না মাখতে পারলে নিজের র`ক্ত মাখতে হয় আমাকে।”
“যা খুশি করো। তোমাকে প্রশ্রয় দিতে দিতে সীমা পার করে ফেলছো। আর না।”
“ঠিকাছে। তবে তাই হবে।”
এই বলে চন্দ্রা নিজের ঘরে যাওয়া ধরলো। তূর্ণ ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
“চন্দ্রা গায়ে যেন একটাও আঁ`চ`ড় না লাগে।”
চন্দ্রা এবার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
“তাহলে প্লিজ ভাইয়া যেতে দাও। প্লিজ। আমি ঘুমাতে পারব না। ঐ জা`নোয়ারটা ঐ মেয়েটার সাথে কেমন করছিল! ছিহ্! এগুলো আমার মাথায় ঘুরবে ভাইয়া। আমি ভুলতে পারব না৷ আমি ভুলতে পারব না৷ আমার দম আটকে আসবে। ভাইয়া প্লিজ।”
প্রণয়ের ফোন আসে। চন্দ্রা ফোনের দিক তাকায় একবার৷ তূর্ণও তাকায়। তারপর ফোনটা চন্দ্রার হাত থেকে নিয়ে নিজে রিসিভ করে। চন্দ্রা চোখে অশ্রু নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
ফোন রিসিভ হওয়ার সাথে সাথেই প্রণয় বলল,
“হ্যালো। কোথায় তুমি? এখনো নামো নি কেন?”
তূর্ণ বলল,
“নামবে না।”
“তূর্ণ?”
“হ্যাঁ।”
“সব ঠিকাছে তো?”
“ঠিক কিভাবে হয় প্রণয়? ও বলে আর তুই রাজি হয়ে যাস কিভাবে? ওর এই নে`শা কমানো লাগবে। ওকে দূরে রাখতে হবে এসবের থেকে। তুই দেখি উল্টা নিজেও এই নে`শায় জড়িয়ে গিয়েছিস। ও বলে আর তুইও ওর কথামতো করিস এগুলো।”
প্রণয় বিরক্ত হয়ে যায়।
“আমার কিছু করার আছে? তোর বোনকে কতবার বুঝিয়েছি। কিন্তু লাভ কি? থামবে না। আর আটকালে নিজের অবস্থা কি করে জানিস না? আজও দেখেছি হাত কা`টা। নিজেকে কষ্ট দেওয়ার থেকে ভালো জা`নোয়ার গুলোকে মা`রুক। সমাজও পরিশুদ্ধ হয়ে যাবে।”
তূর্ণ প্রণয়ের কথা শুনে চন্দ্রার হাত দেখে। তারপর রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আর প্রণয়ের সাথে কথা বলে।
“কি সব বলিস প্রণয়? তোর মাথাও দিন দিন যাচ্ছে। তোকে আর চন্দ্রাকে সমাজ পরিশুদ্ধ করতে হবে না। ঐ দুই একটাকে সরিয়ে দিয়ে কি লাভ? পৃথিবীটাই নিকৃ`ষ্টতায় ভরে গিয়েছে। চন্দ্রার কোনো কথা আর শুনবি না। যেটার ব্যবস্থা করেছিস, রফিকুলকে দিয়ে বাকি ব্যবস্থা সেরে ফেল। চন্দ্রাকে রুমে আটকে রাখব আমি।”
“তোর মাথা খারাপ তূর্ণ? তুই ওকে আটকে রাখবি? ওকে আটকে রাখা সম্ভব নয়। আর এখন ওকে এভাবে আটকে রাখলে পরে ও সুযোগ পেলে আমাদের না জানিয়েই বোকার মতো কি না কি করে বসবে। তখন আরও বড় সমস্যায় পড়তে হবে। তাই বলছি যা হচ্ছে হতে দে। ও শান্ত থাকুক।”
“কতদিন হতে দিব?”
“জানি না। এটাও জানি না ওকে কিভাবে থামাবো। কিন্তু মেয়েটা নিজের ক্ষ`তি করবে এটা মানুষ হয়ে আমি তুই মেনে নিতে পারব?”
তূর্ণ কিছুক্ষণ চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে চন্দ্রার দিকে। দেখতে পায় চন্দ্রার ছটফটানি। তারপর তূর্ণ বলে,
“মেনে নেওয়া যায় না। কিছুই মেনে নেওয়া যায় না। আচ্ছা রাখছি। আমি ওকে দেখি। আর তুই ঐদিকটা সামলে নে।”
“আচ্ছা।”
তূর্ণ ফোন কেটে দিয়ে চন্দ্রাকে নিয়ে বসায়। তারপর হাতের কা`টা অংশে ওষুধ লাগিয়ে দেয়। চন্দ্রা কান্না করছে। সে জানে তূর্ণ আজ যেতে দিবে না যখন একবার বলেছে তখন আর যেতে দিবে না। অথচ চন্দ্রা কিভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবে জানে না। দম আটকে আসছে ওর। তূর্ণ চন্দ্রার দিক তাকিয়ে বলল,
“এটা কিসের জন্য শুনি?”
“কোনটা?”
“এই যে আজকে কে`টেছেন যে?”
“মায়ের শাড়ীটা দেখে মায়ের কথা মনে পড়েছিল তাই।” বলেই চন্দ্রা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
তূর্ণ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বোনের দিক। তারপর জিজ্ঞেস করল,
“ফুপির শাড়ী কোথায় পেলি? সব তো দাদীর কাছে।”
চন্দ্রা এবার কান্না পরিমাণ বাড়িয়ে অনুরোধ করে বলল,
“প্লিজ ভাইয়া প্লিজ৷ মায়ের কিছু রাখতে দাও নি আমার কাছে। ঐ একটা শাড়ী, মা ওটা দিয়ে একবার আমাকে বউ সাজিয়ে দিয়েছিল। ওটা আমি দাদীর রুম থেকে লুকিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। সত্যি বলছি ওটা আমার আড়ালেই থাকে। আজ একটু বের করে দেখেছিলাম৷ প্লিজ সরিয়ে নিও না৷ আমার কাছে মায়ের কিছু নেই ওটা ছাড়া। আমি এরপর থেকে আর ঐ শাড়ী দেখে নিজেকে আ`ঘাত করব না। সত্যি বলছি। প্লিজ ওটা নিও না৷”
চন্দ্রার কথা শুনে আর ওর কান্না দেখে তূর্ণর ভীষণ কষ্ট হয়। তূ্র্ন চন্দ্রার মাথায় হাত রেখে বলে,
“একদম কান্না করবি না৷ ভাইয়া শাড়ী সরাবো না। ওটা থাকবে তোর কাছে। তবে হ্যাঁ, এরকম করতে পারবি না একদম।”
“আচ্ছা।”
“হ্যাঁ, এবার কান্না থামাও না হলে ভাইয়া রাগ হবো।”
চন্দ্রা কান্না থামায়। তূর্ণ ওকে বলে,
“যা। এখন গিয়ে চুপচাপ লক্ষী মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়ো।”
“আমি আজ আর ঘুমাতে পারব না ভাইয়া।”
তূর্ণ চন্দ্রাকে একটা ঘুমের ঔষধের অর্ধেক দিয়ে বলল,
“পুরোটা দিলাম না। সকালে তো ক্লাস আছে। এটুকু খেয়ে শুয়ে পড়।”
“তাও পারব না।”
আচ্ছা চল। যতক্ষণ না ঘুমাবি তোর পাশে বসে থাকব।
চন্দ্রাকে নিয়ে তূর্ণ ওর রুমে যায়। চন্দ্রা শুয়ে পড়ে। তূর্ণ ওর মাথায় কাছে বসে থাকে। মাথায় বিলি কেটে দেয় যতক্ষণ চন্দ্রা না ঘুমায়। তারপর চন্দ্রা ঘুমিয়ে পড়লে চলে আসে নিজের রুমে। অনেক ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। তারপরেও একবার প্রণয়কে ফোন করে আবার।
প্রণয় ফোনটা রিসিভ করে।
“হ্যালো তূর্ণ! বল।”
“কি করেছিস? ছেড়ে দিয়েছিস নাকি মে`রে ফেলেছিস।”
“যদিও ছেড়ে দেওয়া রিস্ক। কিন্তু কিড`ন্যাপ করার সময় তো চোখ মুখ বেঁধে করেছি। কিছু জানে না। কাউকে দেখওনি। চোখ মুখ বাঁধা ছিল। ঐ অবস্থায়ই যেখান থেকে উঠিয়ে আনা হয়েছিল সেখানে ফেলে এসেছি। তবে মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছি। বুঝতে পেরেছে মেয়েদের সাথে এমন করার জন্যই করা হয়েছে৷ মা`রও খেয়েছে। মনে হয় না আর কোনোদিনও কোনো মেয়ের দিকে তাকানোরও সাহস পাবে।”
“আচ্ছা।”
“চন্দ্রার কি অবস্থা? সুস্থ আছে।”
“হুম। ঘুমিয়েছে অনেক কষ্টে।”
“ওহ্।”
“প্রণয়!”
“হুম।”
“আমি আমার বোনটার কষ্ট দেখতে পারি না রে। আর সহ্য হয় না। জানিস হাত আজ কে`টেছে কেন?”
“কেন?”
“ফুপির একটা শাড়ী নিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল নিজের আলমারিতে৷ সেটা দেখেই। আবার এতে রিকুয়েষ্ট করেছে যেন আমি শাড়ীটা না সরাই। ওর চোখের পানি দেখে সত্যিই আমার আর ঐ শাড়ীটা সরানোর ক্ষমতা নেই। আচ্ছা বাচ্চা মেয়েটার সাথে এমন হলো কেন বল তো? কিছু তো করেনি ও। কোনো অপরাধ নেই ওর। তাও কেন?”
প্রণয় কিছু বলতে পারে না তূর্ণের কথার পিঠে। প্রণয় নিজেই তূর্ণের কথাগুলো শুনে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তূর্ণ জানে না চন্দ্রার জন্য ও যতোটা কষ্ট পাচ্ছে তার থেকেও অধিক কষ্ট প্রণয় পাচ্ছে। ভালোবাসার মানুষের কষ্ট সহ্য করা যায় না। ভিতর থেকে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে প্রণয়। কিন্তু এটা তো কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না৷ তাই সে নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই বলল,
“জানি না রে তূর্ণ। মেয়েটার জন্য খারাপ লাগে। কিন্তু কি আর করার? তুই নিজেকে সামলা। এভাবে ভেঙে পরিস না৷ শক্ত হ।”
“হুম।”
এই একটুকরো কথার সাথে একরাশ বিষন্নতা ছাড়ে তূর্ণ।
প্রণয় বলল,
“আচ্ছা, তুই ঘুমিয়ে পড়। রেস্ট নে। বেশি টেনশন করিস না।”
এই বলে প্রণয় ফোনটা কেটে দিল। এতক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল প্রণয়। ফোনটা রেখে খোলা অন্ধকার আকাশের দিক তাকালো। ইচ্ছে করছে জোরে চিৎকার করুক ‘চন্দ্রমল্লিকা’ বলে। কিন্তু পারছে না। রাগ হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে।
শুধু আকাশের দিক তাকিয়ে বলল,
“চন্দ্রমল্লিকা কেন তুমি এতো কষ্ট পাও? তোমাকে যদি বোঝাতে পারতাম তোমার পাওয়া কষ্টগুলো সহস্রগুণ অধিক হয়ে এসে আমার বুকে জমে! তাহলেও কি তুমি এভাবে কষ্ট পেতে? চন্দ্রমল্লিকা আমি সহ্য করতে পারি না তোমার কষ্ট৷ খুব মন চায় তোমাকে নিজের করে নিই। নিজের করে নিয়ে বলি, তুমি আমার চন্দ্রমল্লিকা। তোমার কোনো কষ্ট নেই। তোমাকে আর কষ্ট পেতে দিব না। হয় তো যেসব থেকে তুমি বঞ্চিত হয়েছো তা আমি তোমায় দিতে পারব না। কিন্তু তোমায় আমার ভালোবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ করে রাখব। ভুলিয়ে দিব তোমার কষ্টগুলোর কথা।
কিন্তু আমি তো তা পারব না। তোমাকে এগুলো বলার মতো সাহস আমার নেই। তুমি কখনোই আমাকে মেনে নিবে না আমি জানি।”
.
রাতে তূর্ণর ঘুম হয় নি। ভোর হয়েছে। ফজরের পর ভাবলো একটু খোলা বাতাস খেয়ে আসা যাক। মাথা যন্ত্রণা করছে ভীষণ। তাই সে ছাদে উঠলো। পরশি আগে থেকেই ছাদে ছিল। পরশি তূর্ণকে দেখে বলল,
“আরে আপনি?”
“হ্যাঁ, ভোরের আকাশ দেখতে এসেছিলাম।”
“আজ হঠাৎ? মানে আপনি তো রাতের বেলা আসেন। আর ভোরে চন্দ্রা আসে। আজ চন্দ্রাকে দেখছি না যে।”
“ওর একটু মাথা ব্যথা হয়েছিল কাল। তাই ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে। আর আমার না ঘুমিয়ে মাথা ব্যথা হয়েছে। তাই ভাবলাম একটু ঘুরে আসি।”
“ওহ্। আচ্ছা। আপনারও উচিত ছিল মেডিসিন নিয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া।”
“অসুবিধা নেই। অভ্যাস আছে রাত জাগার।”
“হুম। ডাক্তার মানুষ৷ রাত জাগা আপনার কাছে ব্যাপার না।”
“হুম।”
পরশি আর তূর্ণ বেশ কিছুক্ষণ হাঁটে আর গল্প করে। পরশির হঠাৎ আবার মনে পড়ে ওর জন্য হয় তো তূর্ণর একটু মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পরশি বলল,
“আই এ্যাম সরি এগেইন।”
“কেন?”
“কাল হয় তো আমি আপনাকে আপসেট করে দিয়েছিলাম।”
“আরে না। এই নিয়ে আপনি আপসেট হবেন না প্লিজ।”
“আমি আপসেট হই নি। বরং আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।”
তূর্ণ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“কেন বলুন তো?”
“কাল আপনার সাথে গল্প করে আমার মন ভালো হয়ে গিয়েছিল।”
“কেন মন খারাপ ছিল?”
পরশি আর তূর্ণ দুজনেই ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাড়িয়ে আছে চুপচাপ। তূর্ণ উত্তরের অপেক্ষায় পরশির দিক তাকিয়ে আছে। আর পরশি প্রকৃতির দিক। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ছিল।”
“ওহ্।”
পরশি নিজেই বলল,
“তা কেন মন খারাপ তা জানতে চাইলেন না ডাক্তার সাহেব?”
“আপনার পারসোনাল ম্যাটার হতে পারে।”
“পারসোনাল তো। কিন্তু আপনি তো ডাক্তার। সব রকমের অসুস্থতাও দূর করেন৷ মনের অসুখ। মনের অসুখের কথা জানতে চাইবেন না?”
তূর্ণ বলল,
“রোগীর যদি মনে হয় তার ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন তবে জানতে চাইতে পারি।”
“চলুন নিচে যাই। ফ্রিতে ডাক্তার দেখাতে রাজি নই। এক কাপ চা দিয়েই না হয় পে করলাম।”
তূর্ণ হেসে বলল,
“কৌশল ভালো জানেন অফিসার। কোনো ভাবে ঋণ রাখবেন না।”
পরশি হাসে। তূর্ণ আর সে চলে যায় নিচে। পরশি গিয়ে চা বানায়। চা বানিয়ে নিয়ে বসে তূর্ণর সাথে। দুজন আবার কতক্ষণ গল্প করে। তারপর তূর্ণ বলে,
“আচ্ছা যেই জন্য আসলাম। রোগীর রোগটা তো জানা হলো না৷ ট্রিটমেন্ট কিভাবে করব?”
“তূর্ণ, আমার মনে হচ্ছে সত্যিই আমি মানসিকভাবে অসুস্থ। আপনার কি মনে হয় না? আপনার তো বোঝার কথা। আপনি ডাক্তার।”
তূর্ণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো পরশির দিক। পরশি আবার বলল,
“আমার মনে হয় আমি অনেক বড় মানসিক সমস্যায় ভুগছি। আমার কি কাউন্সিলিং এর দরকার আছে? যদি থাকে, প্লিজ, আপনার পরিচিত কারো ঠিকানা দিন।”
“ওয়েট। আপনার কেন এমন মনে হচ্ছে? সত্যিই কি অনেকটা মানসিক সমস্যা নিয়ে আছেন আপনি? মানে সমস্যাটা কি হচ্ছে?”
“আমি জানি না। আমার একা লাগে। আমার নিজেকে দুর্বল লাগে। কথা বলার কাউকে পাই না। দম আটকে আসে। আর আপনি তো জানেনই আমার পরিবারের মানুষের সাথে আমার সম্পর্কের কথা আপনাকে প্রথমদিনই বলেছিলাম কেমন। এগুলো নিয়ে আমি আর পারি না।”
তূর্ণ কিছুক্ষণ কি যেন ভাবে। তারপর বলে,
“আপনার একজন ফ্রেন্ড দরকার পাশে থাকার জন্য। আপনার গল্পগুলো শুনার জন্য কাউকে দরকার। আপনি আপনার কোনো ফ্রেন্ডের সাথে আপনার সাথে ঘটে যাওয়া নিত্যদিনকার ঘটনা বলুন। তাহলেই হচ্ছে। আপনি একাকিত্বে ভুগে এসব ভাবছেন। আগে এটা ট্রাই করে দেখুন৷ তারপরেও যদি মনে হয় হচ্ছে না, তাহলে আমি বলব কাউন্সিলিং করেন।”
“কিন্তু আমার গল্প শুনবে, আমার সাথে গল্প করবে এতো সময় কার আছে? সবাই ব্যস্ত।”
তূর্ণ চায়ের কাপে চুমুক দিল। তারপর পরশির দিক তাকালো। তারপর বলল,
“আপনি চাইলে আমি সময় দিতে পারি।”
“আপনি?”
“হ্যাঁ। প্রথমদিন মনে আছে? হসপিটালে বসে আমাকেই বলেছিলেন কষ্টের কিছু কথা। আর তারপর আমার বলা কথাগুলো নাকি আপনার ভালো লেগেছে৷ এমন কিছুই বলেছিলেন আপনি৷ আমার যতদূর মনে পড়ে।”
পরশি বলল,
“হ্যাঁ। কিন্তু আপনি তো ব্যস্ত মানুষ।”
“তো কি হয়েছে? এই যে মাঝে মাঝে ফ্রি থাকি। কথা হয়৷ সে রকম কথা হবে। পরিমাণটা না হয় বাড়িয়ে দিলাম। আর তাছাড়া আপনিও ব্যস্ত। দুজনেই সন্ধ্যার পরে কিংবা রাতে সময় পাই। ঐ সময় কথা বললেই হয়।”
“কিন্তু আপনি আমার সমস্যাগুলো শুনে সময় নষ্ট করবেন কেন?”
“সময় নষ্ট হবে না৷ বরং একটা ভালো সময় কাটবে। আপনি একজন ভালো মানুষ। আপনার সাথে কথা বলে সময় খারাপ কাটবে বলে মনে হচ্ছে না।”
পরশি ধন্যবাদ জানালো তূর্ণকে। তূর্ণ হেসে বলল,
“ধন্যবাদ জানাতে হবে না। ইউ ক্যান ট্রিট মি এ্যাজ এ ফ্রেন্ড।”
পরশি বলল,
“ঠিকাছে। তবে এখন তো আর বলার সময় নেই। আমার অফিস আপনার হসপিটাল।”
তূর্ণ ঘড়ির দিক খেয়াল করে বলল,
“ওহ্। হ্যাঁ। আই এ্যাম সরি আমার যেতে হবে।”
“ইটস ওকে।”
“আচ্ছা আজ হয় তো আমার আসতে লেট হবে। তবে রাত এগারোটায় যদি আপনি রাতের তারা গুনতে ছাদে আসতে চান তবে আমি যেতে পারি। আপনি তারা গুনবেন আর আপনার গল্প, সমস্যা, কষ্ট শেয়ার করতে পারেন৷ আমি শুনবো।”
পরশি হেসে বলল,
“আচ্ছা।”
তূর্ণ বিদায় জানিয়ে চলে গেল। পরশি তূর্ণ যাওয়ার পর কতক্ষণ ভাবতে লাগলো সত্যিই কি লোকটাকে বলবে ওর দুঃখগুলো? লোকটা কেন শুনতে চায়? যাই হোক। কথা হবে কিছুক্ষণ একে অপরের সাথে। একা লাগবে না। সব দুঃখগুলো না হয় না বলল। সব দুঃখ তো আর বলা যায় না। কিছু দুঃখ মনের কোণে দাফন করে রাখতে হয়।
চলবে….