ভালোবাসা কারে কয়,৫১,৫২
শবনম মারিয়া
পর্ব ৫১
জাহানারা বেগম চন্দ্রাদের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে সে যা করতে এসেছে তা প্রণয় জানলে অনেক রাগ করবে। কিন্তু সে এটাও জানে সে ভুল কিছু করছে না। জাহানারার সাথে প্রণয়িনী ও এসেছে। সে বলল,
“দাদু দরজায় বেল বাজাও।”
জাহারানা বেল বাজালেন। চন্দ্রা এসে দরজা খুলল। চন্দ্রা জাহানারা আর প্রণয়িনীকে দেখে ভীষণ খুশি হলো। জাহানারাকে সালাম দিয়ে ভিতরে আসতে বললেন। জাহানারা ভিতরে ঢুকলেন। চন্দ্রা তাকে বসতে দিলো। তারপর জিজ্ঞেস করল,
“কেমন আছেন আন্টি?”
“এই তো ভালো মা। তুমি কেমন আছো? তোমার নানা নানু কোথায়? কেমন আছেন তারা?”
“সবাই ভালো আছে আন্টি। নানা নানু তাদের রুমে আছেন। আমি ডেকে আসছি।”
“ঠিকাছে বাবা।”
চন্দ্রা তার নানা নানুকে গিয়ে বললেন জাহানারা এসেছেন। তাদের সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন। রোকেয়া আর মিরাজ উঠে গেলেন। রোকেয়া জাহানারাকে জিজ্ঞেস করলেম সে কেমন আছে। জাহানারা জানালেন তিনি ভালো আছেন। তারা কিছুক্ষণ কথা বলল। চন্দ্রা চা পাঠালো। আর সে প্রণয়িনীর সাথে ব্যস্ত হয়ে গেল। জাহানারা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অনেক কথা বলছেন। সব কথাই চন্দ্রা আর প্রণয়িনীকে নিয়ে।
“চন্দ্রা আর প্রণয়িনীর খুব মিল। দুজন দুজনের জন্য একেবারে পাগল। প্রণয়িনী তো চন্দ্রাকে ছাড়া কিছু বুঝেই না। চন্দ্রাও প্রণয়িনীর জন্য পাগল। প্রণয়িনী যখন অসুস্থ হলো তখন চন্দ্রা চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। পুরোটা সময় প্রণয়িনীকে সামলেছে। প্রণয়িনীর খুব খেয়াল রাখে চন্দ্রা। প্রণয়িনী কারো সাথে এখন পর্যন্ত এতোটা মিশে যেতে পারেনি যতটা চন্দ্রার সাথে মিশে গিয়েছে।”
এসব শুনে রোকেয়া আর মিরাজ খুশিই হচ্ছেন। কিন্তু হঠাৎ করে জাহানারা একটা প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। যেটার জন্য কেউ প্রস্তত ছিল না। জাহানারা হুট করে বলে ফেললেন,
“কাকা-কাকিমা একটা কথা বলতাম।”
মিরাজ সাহেব বললেন,
“হ্যাঁ, বলো মা।”
“চন্দ্রার তো বিয়ের বয়স হয়েছে। ওকে বিয়ে দিবেন না?”
রোকেয়া বললেন,
“অবশ্যই বিয়ে দিবো। কিন্তু চন্দ্রাই তো রাজি হয় না।”
জাহানারা বললেন,
“কাকিমা জানেনই তো প্রণয়ের বয়স কম। ওকে অনেক বলেছি বিয়ের কথা। কিন্তু ও রাজি হয় না। কিন্তু প্রণয়িনীর তো একটা মায়ের দরকার। আর অন্য কোনো মেয়ে প্রণয়িনীকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসবে না। যেরকম চন্দ্রা ভালোবাসে প্রণয়িনীকে। চন্দ্রা প্রণয়িনীকে নিজের মেয়ের মতো দেখে। প্রণয়িনী অসুস্থ হলে ঠিক মায়ের মতো করেই চন্দ্রা চিন্তিত হয়ে পড়ে। ওর সেবা করে। প্রণয়িনীর অনেক খেয়াল রাখে। যা আর কেউ পারবে না। প্রণয়িনীও চন্দ্রাকে ছাড়া অন্য কাউকে পছন্দ করে না। আমার মনে হয় চন্দ্রাও প্রণয়ের সাথে সুখে থাকবে। আমার প্রণয়ও চন্দ্রার সাথে সুখে থাকবে। আপনারা যদি রাজি হন তাহলে আমি চন্দ্রাকে আমার প্রণয়ের বউ করে নিতে চাই।”
রোকেয়া মিরাজ দুজনেই একে অপরের দিক তাকালেন। তারা কি বলবে বুঝতে পারছেন না। কতক্ষণ পিনপতন নীরবতা বিরাজ করল সেখানে। মিরাজ সাহেব বললেন,
“দেখো মা, প্রণয় নিঃসন্দেহে ভালো ছেলে। ওর মতো ছেলে হয় না। ও চন্দ্রাকে সুখে রাখবে। কিন্তু বোঝার চেষ্টা করো, আমাদেরও তে আমাদের নাতনির বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন আছে। তারপরে প্রণয় আর ওর বয়সের পার্থক্য বেশি। প্রণয়ের আগে বিয়ে হয়েছে আর একটা মেয়েও আছে।এসব সহজে কোনো মেয়ে মেনে নিবে না। আর তার পরিবারের কেউও মানবে না। আমরা চন্দ্রার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিবো। আমরা তোমাকে কিছু বলতে পারছি না এই নিয়ে। তবে আমরা জানাবো। চন্দ্রা, তূর্ণ, তোহরাব এদের সাথে কথা না বলে আমরা কিছু বলতে পারছি না।”
“জি বুঝতে পারছি। আমার হঠাৎ মনে হলো আমার ছেলে আর নাতনি আর আপনাদের নাতনি একসাথে অনেক ভালো থাকে। প্রণয় আর চন্দ্রাকে একসাথে মানায়। তাই বললাম। আমি প্রণয়িনীর জন্য মা খুঁজছি। আর চন্দ্রা আর প্রণয়িনীকে দেখলে মনে হয় প্রণয়িনী চন্দ্রার নিজের সন্তান। ও ওকে এতোটাই ভালোবাসে। তাই বললাম। ভুল হলে ক্ষমা করবেন। আজ বরং আমি আসি।”
এই বলে জাহানারা প্রণয়িনীকে নিয়ে চলে আসলেন।
রোকেয়া ও মিরাজ প্রথমে চন্দ্রা আর তূর্ণকে ডাকলেন। তারপর বললেম জাহানারা তাদের কি প্রস্তাব দিয়েছেন। শুনে তূর্ণ আর চন্দ্রা দুজনেই অবাক হলো। চন্দ্রা চুপচাপ হয়ে গেল। সে গভীর ভাবনায় চলে গেল। জাহানারা প্রণয়ের সাথে চন্দ্রার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে! কিন্তু কেন? প্রণয় কি সত্যিই ভালোবাসে চন্দ্রাকে? প্রণয়ই কি বলেছে ওর মা কে? চন্দ্রা এখন কি করবে?
তূর্ণ এগুলো শুনে বিস্মিত হয়ে বলল,
“কিহ্! আন্টি এরকম প্রস্তাব দিয়েছে? আন্টি এটা কিভাবে পারলো? এটা কি করে হয়? দাদু তুমি মানা করে দাও। আর এসব প্রণয় আমাকে বলেনি কেন? ও এগুলো কিভাবে করতে দিল আন্টিকে?”
তূর্ণ কিছুটা রেগেও গেল। চন্দ্রা কিছু বলল না।ও শুধু ভাবতে থাকলো। ও বিশ্বাস করতে পারছে না এগুলো কি হচ্ছে!
রাতের বেলা চন্দ্রা বসে বসে ভাবলো। প্রণয়ের কথাগুলো মনে করতে থাকলো। প্রণয়কে নিয়ে ভাবতে থাকলো। চন্দ্রা খেয়াল করল সে আজকাল প্রণয়কে নিয়ে ভাবে। আগে যেমন প্রণয়ের উপর বিরক্ত হতো, আজকাল আর হয় না। বরং প্রণয়কে ভালো লাগে। প্রণয় সবসময় চন্দ্রার পাশে থাকে।
প্রণয়কে নিয়ে গভীর ভাবনায় বুদ হয়ে গেল চন্দ্রা।
.
তূর্ণ প্রণয়কে ফোন করে বলল,
“প্রণয় এসব কি হচ্ছে? জাহানারা আন্টি এসেছিল। তোর সাথে চন্দ্রার বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে গিয়েছে।”
“কি?”
“হ্যাঁ। প্রণয় তুই থাকতে এগুলো কিভাবে হয়? তুই তো জানিস চন্দ্রার অবস্থা। তোর মনে হয় ওর বিয়ে দিবো?”
“তূর্ণ আমি জানতাম না মা এগুলো কখন করেছে কেনো করেছে। আই এ্যাম সরি। আমি মায়ের সাথে কথা বলছি।”
প্রণয় ফোন রেখে তার মায়ের ঘরে গেল। প্রণয় প্রচন্ড রেগে আছ তার মায়ের উপর। প্রণয় ওর মাকে বলল,
“তোমাকে মানা করেছি না এসব না করতে। তুমি এগুলো করলে কেন মা? একবার ভেবেছো এতে তূর্ণ আর আমার সম্পর্ক নষ্ট হবে?”
জাহানারা বললেন,
“আমার যা ভালো লেগেছে আমি তাই করেছি। আমি মনে করি আমি ভুল কিছু করিনি।”
প্রণয় চিৎকার করে বলল,
“হ্যাঁ, ভুল তুমি না আমি করেছি।”
এই বলে প্রণয় রুম থেকে বের হয়ে গেল। সে কি দিয়ে কি করবে বুঝতে পারছে না। প্রণয়ের মাথা কাজ করছে না। প্রণয়ের ভয় হচ্ছে অনেক৷ যদি চন্দ্রা প্রণয়কে ভুল বুঝে ওর থেকে আরও দূরে সরে যায়? চন্দ্রা কি ভাবছে ওকে? খুব খারাপ ভাবছে নিশ্চয়ই। তূর্ণর সাথে কিভাবে কথা বলবে প্রণয়? তূর্ণ কি সব ভাবছে। প্রণয় তূর্ণকে ফোন করে বলল,
“তূর্ণ, আই এ্যাম সরি। আমিও কিছু জানতাম না। মা এগুলো ভুল করেছে। মা বুঝতে পারেনি। মা চন্দ্রা আর প্রণয়িনীকে বেশি ক্লোজ দেখে ইমোশনাল হয়ে এমনটা করে ফেলেছ। প্লিজ আমাকে মাফ করে দিস। আমি আর বেশি ক্লোজ হতে দিবো না প্রণয়িনীকে চন্দ্রার সাথে। সব দোষ আমার। সরি।”
তূর্ণ বলল,
“ইটস ওকে প্রণয়। এতো অস্থির হওয়ার দরকার নেই। সব ঠিক আছে। আন্টিকে বুঝিয়ে বলিস।”
“হ্যাঁ, আর সমস্যা করবে না, মা।”
“আচ্ছা রাখি তবে।”
চন্দ্রা পরেরদিন অনেক ভাবনা চিন্তা করে তূর্ণর কাছে গেল। তূর্ণকে বলল,
“ভাইয়া একটা কথা বলার ছিল।”
“বল।”
“ভাইয়া নানা-নানু, জাহানারা আন্টি আর প্রণয় ভাইয়াকে বলে দিও আমি বিয়েটা করতে রাজি আছি।”
তূর্ণ চন্দ্রার কথায় ধাক্কা খেল। সে চন্দ্রার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। তূর্ণ চন্দ্রাকে বলল,
“কি বলছিস তুই? মাথা ঠিক আছে?”
“হ্যাঁ, আমি ভেবেচিন্তেই বলেছি।”
“চন্দ্রা এটা সম্ভব না।”
“কেন?”
“তুই পাগল হয়ে গিয়েছিস? তুই বিয়ে করবি? তাও প্রণয়কে!”
“কেন করব না? প্রণয় ভাইয়ার মধ্যে কি সমস্যা? লোকটা বিবাহিত ছিল? তার একটা মেয়ে আছে এটাই? ভাইয়া বিশ্বাস করো, এই জীবনে যদি আমি কারো সাথে সুখে থাকি সেটা প্রণয়িনী আর তার বাবা। এই মানুষ দুইটা আমার জীবনে অনেকটা পরিবর্তন এনেছে ভাইয়া। তোমার মনে আছে? আমার জন্মদিনের দিন আমি ভালো ছিলাম।আমি হেসেছি। আমি নিজেকে আঘাত করিনি। শুধু প্রণয় ভাইয়া আর প্রণয়িনী সাথে ছিল বলে। খেয়াল করেছো আমি কতদিন আর নিজেকে আঘাত করি না? কেন জানো? আমার মন খারাপ থাকলে প্রণয় ভাইয়া আমার সাথে কথা বলে। আমি ভুলে যাই দুঃখগুলো। প্রণয়িনীর সাথে থাকলে আমি আলাদা একটা শান্তি পাই। ভাইয়া আমি অনেক ভেবেই বলছি।”
তূর্ণ চুপ হয়ে রইল। চন্দ্রার কথাগুলো তাকে ভাবাচ্ছে। চন্দ্রার প্রতিটা কথা সঠিক। প্রণয় যেভাবে চন্দ্রাকে আগলে রাখে অন্য কেউ সেভাবে আগলে রাখতে পারে না। প্রণয়িনীর জন্য চন্দ্রা হাসিখুশি থাকে। হ্যাঁ, শুধু প্রণয়ই পারবে চন্দ্রাকে ভালো রাখতে। চন্দ্রাকে আগলে রাখতে। এমনটা তো তূর্ণও চায় চন্দ্রা ভালো থাকুক। অতীত ভুলে নতুন জীবন শুরু করুক। তূর্ণ চন্দ্রাকে বলল,
“আরেকবার ভাব চন্দ্রা?”
“আমি অনেক ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
“প্রণয় যদি না মানে?”
“সে কেন মানবে না? সে কি আমায় ভালোবাসে না?”
তূর্ণ কপালে ভাজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,
“কি?”
চন্দ্রা বলল,
“আমি জানি না ভাইয়া। কিন্তু উনি আমার জন্য যেসব করে তা এমনি এমনি করার কথা না। সে আমার জন্য কি না করে? এগুলো কি শুধুই দায়িত্ব?”
এই বলে চন্দ্রা চলে যায়। তূর্ণ প্রনয়কে ফোন করে। প্রণয় ফোন রিসিভ করছে না। প্রণয় ঐ দিনের পর থেকে আর তূর্ণকে ফোন করেনি। তার সাথে কথাও হয় নি। তূর্ণ অনেকবার ফোন করেও প্রণয়কে না পেয়ে তার বাসায় গেল। কিন্তু প্রণয় বাসায় নেই। তূর্ণ প্রণয়কে ম্যাসেজ দিল,
“কোথায় তুই জানা। আমার তোর সাথে জরুরি কথা আছে।”
প্রণয় তূর্ণর ম্যাসেজ দেখে চিন্তায় পড়ে গেল। কি করবে সে? কোনো সমস্যা হয়েছে?
প্রণয় রিপ্লাই দিল,
“অফিসে আছি। দরকার হলে আসতে পারিস।”
তূর্ণ প্রণয়ের অফিসে গেল। সেখানে গিয়ে সে প্রণয়কে পেয়েছে। তূর্ণ প্রণয়কে বলল,
“এসব কি হচ্ছে প্রণয়?”
“আবার কি হয়েছে?”
“চন্দ্রা বিয়েতে রাজি।”
প্রণয় এটা শেনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এটা শুনে সে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তূর্ণ বলল,
“ঠিকই শুনেছিস। চন্দ্রা বিয়েতে রাজি।”
“কিন্তু কেন?”
“কারণ চন্দ্রা মনে করে ও তোর সাথে আর প্রণয়িনীর সাথে ভালো থাকবে। তোর সাথে বিয়ে হলে ও সুখে থাকবে।”
“পাগল নাকি?”
“প্রথমে আমিও ভেবেছিলাম প্রণয়। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম চন্দ্রা সত্যিই তোর সাথে সুখে থাকবে। তুই ওকে বুঝিস। তুই ওকে যেভাবে আগলে রাখতে পারিস আর কেউ পারবে না।”
“তূর্ণ কি বলছিস এসব!”
“হ্যাঁ, ঠিক বলছি। চন্দ্রা তোর সাথে ভালো থাকবে।”
“আমি ওকে কিভাবে ভালো রাখবো!”
“কেন ভালোবাসিস না তুই ওকে?”
প্রণয় চুপ হয়ে যায়। সে তূর্ণর দিক তাকাচ্ছে না। তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। তূর্ণ বলল,
“কি হলো, বল? আমার চোখে চোখ রেখে বল প্রণয়। ভালোবাসিস না চন্দ্রাকে?”
এবারও চুপ রইলে প্রণয়। কিছুক্ষণ পর তূর্ণর দিক তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, ভালোবাসি। কিন্তু চন্দ্রা কখনো আমার হবে এটা ভাবি না। চন্দ্রা আমার থেকে ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে। আমি চন্দ্রার জন্য পারফেক্ট না। আমি চাই চন্দ্রা নিজেকে সুধরে নিক। নতুন কারো সাথে নতুন জীবন শুরু করুক। ওর জীবনের এই অন্ধকার অধ্যায়ের অবসান ঘটুক। চন্দ্রা কখনো আমার হবে এটা আমি ভাবতে পারিনি। চন্দ্রা ভালোবাসায় বিশ্বাস করে না৷ চন্দ্রা আমাকে পছন্দ করে না।”
“চন্দ্রা নিজে বলেছে ও তোর সাথে থাকলে ভালো থাকে। চন্দ্রাও তোকে ভালোবাসে প্রণয়।”
প্রণয় কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর বলল,
“যদি চন্দ্রা চায়, তবে আমি ওকে বিয়ে করব।”
চলবে…..
ভালোবাসা কারে কয়
শবনম মারিয়া
পর্ব ৫২
প্রণয় চুপচাপ বসে আছে নিজের রুমে। তূর্ণ নিজে বলেছে প্রণয়কে জাহানারার সাথে কথা বলতে বিয়ে নিয়ে। আর তূর্ণ ওর দাদা দাদিকে বলবে কথা আগাতে। কিন্তু প্রণয় ভাবনায় পড়ে গিয়েছে। চন্দ্রাকে প্রণয় অনেক ভালোবাসে। হ্যাঁ, ভালোবাসার মানুষকে সবাই পেতে চায়। কিন্তু চন্দ্রা তো ওকে ভালোবাসে না। চন্দ্রা কোনোদিনও কাউকে ভালোবাসবে না এটাও প্রণয় জানে। চন্দ্রা তো আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক না। তার মধ্যে কারো জন্য ভালোবাসার অনুভূতি জন্মাবে না। এইজন্যই নিজের মধ্যে থাকা সকল অনুভূতি লুকিয়ে রেখেছিল। চন্দ্রা কিভাবে বিয়েতে রাজি হলো? চন্দ্রা তো প্রণয়কে পছন্দ করতো না। তাহলে? হ্যাঁ, এটা ঠিক সে প্রণয়িনীকে অনেক বেশি ভালো। তবে কি চন্দ্রা শুধুই প্রণয়িনীকে ভালোবেসে প্রণয়কে বিয়ে করছে? এমনটা হলে প্রণয় চায় না চন্দ্রা তাকে বিয়ে করুক। প্রণয় চায় চন্দ্রা কাউকে ভালোবাসতে শিখুক। চন্দ্রা বুঝতে পারুক প্রেম কি, ভালোবাসা কি। কিন্তু প্রণয়ের মেয়েকে ভালোবেসে তাকে বিয়ে করলে সেটা চন্দ্রা নিশ্চয়ই পারবে না। অন্যদিকে তূর্ণও বলেছ প্রণয়ের কাছে চন্দ্রা ভালো থাকবে। সত্যিই চন্দ্রাকে পেলে প্রণয় অনেক ভালো রাখবে। প্রণয় চন্দ্রার কোনোরকম ক্ষতি হতে দিবে না। কিন্তু চন্দ্রা নিশ্চয়ই বিয়ে করে প্রণয়ের স্ত্রী হয়ে আসতে চাইছে না৷ সে আসতে চাইছে প্রণয়িনীর মা হয়ে। চন্দ্রার নিজের একটা জীবন আছে। সে কেনো অন্য কারো সন্তানের মা হবে? সে তার নিজের গর্ভের সন্তানের মা হওয়ার অধিকার রাখে। এমনটা হলে কি প্রণয়িনী মেনে নিবে? প্রণয় কি সক্ষম হবে ভবিষ্যতে এমন কোনো কিছু হলে প্রণয়িনী আর চন্দ্রা দুজনেরই মন জুগিয়ে রাখতে? চন্দ্রা আর প্রণয়িনী দুজনেই প্রণয়ের জন্য জরুরি।
প্রণয় কিছু বুঝতে পারছে না৷ তার কি করা উচিত? প্রণয় কপালে হাত দিতে চোখ বন্ধ করে বসে ছিল। প্রণয়িনী তার দাদুর রুম থেকে বাবার রুমে এসে বাবাকে এভাবে দেখে বুঝতে পারল বাবার মন খারাপ। বাবার মন খারাপ দেখে প্রণয়িনী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তারও মন খারাপ হয়ে গেল। তারপর ভাবলো বাবার মন ভালো করে দিবে। প্রণয়িনী আস্তে আস্তে খাটে উঠে বাবার কাছে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বাবার গালে চুমু দিলো।
প্রণয় মেয়ের উপস্থিতি টের পেয়ে তাকালো। প্রণয়িনীকে দেখে মৃদু হাসলো। তারপর বলল,
“কি হয়েছে আমার বাবার?”
প্রণয়িনী বলল,
“বাবা তোমার মন খারাপ? আমি বাবার মন ভালো করে দিই?”
প্রণয় প্রণয়িনীকে চুমু খেয়ে বলল,
“বাবার মন খারাপ তুমি বুঝতে পারো?”
“ইয়েস।”
“তাহলে তো আমার প্রণয়িনী অনেক বুদ্ধিমতী।”
“চন্দা আন্তিও বলেচে।” বলেই প্রণয়িনী হাসলো।
প্রণয় বলল,
“তোমার চন্দ্রা আন্টি তোমাকে অনেক ভালোবাসে তাই না?”
“ইয়েস। আন্তি অনেক ভালো।”
“তুমি আন্টিকে ভালোবাসো?”
“হুউউউম।”
“কতোটা?”
“অনেকটা।”
“আমাকে?”
“তোমাকেও অনেকটা।”
“আচ্ছা বাবা যদি কখনো এমন হয় যে তোমার চন্দ্রা আন্টি আমাদের বাসায় একেবারের জন্য চলে আসে তাহলে কি তুমি খুশি হবে?”
“অনেক খুচি হয়ে যাবো আমি। আমি, চন্দা আন্তি, তুমি, দাদা, দাদু মিলে অনেক মজা করব।”
“যদি চন্দ্রা আন্টিকে আমি তোমার মা করে আনি?”
“চন্দ্রা আন্তি আমার মা হবে কি করে?”
“ধরো চন্দ্রা আন্টির আমার সাথে বিয়ে হলো। তখন তো সে তোমার মা হবে।”
“বাবা, তুমি আন্তিকে বিয়ে করবে?”
“জানি না রে বাবা।”
বলে প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। প্রণয়িনী বলল,
“বাবা আমার চন্দা আন্তিকে ভালো লাগে। প্লিজ তুমি আন্তিকে বিয়ে করো।”
“সত্যি বলছো?”
“হুম।”
“কিন্তু বাবা, আন্তিকে কষ্ট দেওয়া যাবে না।”
“আন্তিকে আমি কখনো কষ্ট দিবো না বাবা। আমি আন্তিকে অনেক আদর করব। আন্তি যেভাবে আদর করে।”
প্রণয় প্রণয়িনীকে বুঁকের ভিতর নিয়ে জড়িয়ে ধরে। প্রণয়িনীও চুপচাপ বাবার বুকে শুয়ে থাকে। প্রণয় বলে,
“বাবার একটা কথা রাখবে? আমাদের মধ্যকার কথা কাউকে বলবে না ঠিক আছে?”
“আচ্চা বাবা।”
.
তূর্ণ বাসার সবার সাথে কথা বলেছে। তূর্ণর দাদা দাদি রাজি হয়েছেন। তাদের প্রণয়কে অনেক পছন্দ। আর চন্দ্রা নিজে থেকে যেহেতু রাজি হয়েছে তাদের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা করছেন তোহরাব সাহেব। তিনি এটা শোনার পর থেকেই রেগে আছেন। তিনি একদমই মানতে চাচ্ছেন না। মিরাজ সাহেব বলেছেন চন্দ্রাই চায় প্রণয়কে বিয়ে করতে।
তোহারাব সাহেব বললেন,
“বাবা চন্দ্রা ছেলে মানুষ। ও এসব বুঝে না। ওর ভালো লাগতেই পারে। কিন্তু এই বিয়েতে ও ভালো থাকবে না। প্রণয় চন্দ্রা থেকে দশ বছরের বড়। তার উপর সে আগে বিবাহিত ছিল। তার একটা বাচ্চা আছে। এমন ছেলের সাথে কেন বিয়ে দিবো আমাদের চন্দ্রাকে? সে কি কোনোকিছুতে কম নাকি? আমাদের চন্দ্রার জন্য ভালো ছেলে পাবো। এই বিয়েতে আমি একদমই রাজি না।”
তূর্ণ বাবার কথায় রেগে গেল। সে বলল,
“বাবা প্রণয়ের খারাপ শুধু এটাই সে এক বাচ্চার বাবা? এইজন্যই চন্দ্রা ভালো থাকবে না? হ্যাঁ, হয় তো প্রণয়ের থেকে ভালো ছেলে আছে। কিন্তু চন্দ্রা প্রণয়ের সাথে যেরকম ভালো থাকতে পারবে আর কারো সাথে পারবে না। চন্দ্রা প্রণয়িনীকে অনেক্ল ভালোবাসে। প্রণয়িনীও তাকে অনেক ভালেবাসে। চন্দ্রাকে প্রণয় আগলে রাখবে বাবা। আমি প্রণয়কে চিনি। অন্য কেউ হলে আমি চন্দ্রার বিয়েতে রাজি হতাম না। না রাজি হতো চন্দ্রা। শুধু প্রণয় বলেই আমি ভরসা পাচ্ছি। প্রণয়ের সাথে চন্দ্রা ভালো থাকবে।”
তোহরাব সাহেব আর কিছু বললেন না৷ তিনি বললেন,
“ঠিকাছে, তোমাদের যা ভালো লাগে করো। তবে চন্দ্রা যেন ভালো থাকে।”
এই বলে তোহরাব সাহেব উঠে গেলেন। তূর্ণ জানে বাবাকে আরেকটু বুঝালেই তার বাবা বুঝবে। তাই এই নিয়ে আর কথা বাড়ালো না। তূর্ণ তার দাদাকে বলল বিয়ের কথা আগাতে।
প্রণয় তূর্ণকে ফোন করল। তূর্ণ ফোন রিসিভ করল। প্রণয় জিজ্ঞেস করল,
“চন্দ্রা আমার কল রিসিভ করছে না কেন?আমি ওর সাথে জরুরি কথা বলতে চাই।”
তূর্ণ বলল,
“আমি দেখছি।”
প্রণয় বলল,
“আমি ওর সাথে দেখা করতে চাই। তুই একটু ওকে পাঠানোর ব্যবস্থা কর।”
“আচ্ছা।”
তূর্ণ চন্দ্রাকে পাঠালো। চন্দ্রার সম্মুখে বসে আছে প্রনয়। চন্দ্রা কোনো কথা বলছে না। এমনকি সে প্রণয়ের দিক তাকাচ্ছেও না। প্রণয় কিছুক্ষণ চন্দ্রার দিক তাকিয়ে থাকলো। তারপর জিজ্ঞেস করল,
“বিয়েতে কেন রাজি হলে?”
চন্দ্রা এবার প্রণয়ের চোখে চোখ রেখে বলল,
“কেন আমাকে বিয়ে করতে আপনার কোনো আপত্তি আছে?”
“চন্দ্রা প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করো না।”
“আমি শুধু জানতে চাচ্ছি, আমার সাথে বিয়েতে আপনার কি আপত্তি। আপনার বাবা মায়ের আপত্তি নেই৷ তারা প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রণয়িনীরও আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। তাহলে আপনার কিসের আপত্তি? আমাকে পছন্দ না? আমাকে ভালোবাসেন না? তাহলে আমার জন্য এগুলো কেন করলেন? এই যে আমার জন্য এতো কিছু করেন, আমার ভালো লাগা খারাপ লাগা সবকিছুর খেয়াল রাখেন, আমার ক্ষতি হতে দিতে চান না, এসব কেন করেন বলেন?”
চন্দ্রার মাথা ঠিক নেই। সে মনে যা আসলো বলে দিল। প্রণয় চুপ হয়ে গেল। তার কাছে উত্তর নেই। কি বলবে সে? প্রণয় চন্দ্রার চোখের দিক তাকালো। চন্দ্রার চোখ শীতল। ঠোঁট কাঁপছে। প্রণয় হঠাৎ করে বলল,
“হ্যাঁ, ভালোবাসি। তোমায় ভালোবাসি চন্দ্রমল্লিকা।”
চন্দ্রা স্তব্ধ হয়ে গেল। যেন এটা শোনার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু সে তো এটাই শুনতে চাইছিল। তাহলে এখন এরকম লাগছে কেন? প্রণয় বলল,
“আমি তোমাকে অনেক ভালেবাসি আমার চন্দ্রমল্লিকা। তোমায় আমি কষ্টে দেখতে পারি না। আমি চাই তুমি ভালো থাকো।”
“ভালোবাসেন তাহলে বিয়ে করতে চাচ্ছেন না কেন?”
“ভয় হয়, যদি তোমাকে ভালো না রাখতে পারি।”
“এই ধারণা ভুল। আপনি জানেন না, আমি আপনার আর প্রণয়িনীর সাথে ভালো থাকি?”
প্রণয় মৃদু হাসলো। তারপর বলল,
“বুঝলাম। কিন্তু তুমি কি শুধু প্রণয়িনীর জন্য আমাকে বিয়ে করছো? আমি যতদূর জানি তুমি প্রণয়িনীকে ভালোবাসো। আমাকে তো ভালোবাসো না।”
চন্দ্রা প্রণয়ের দিক তাকিয়ে সামান্য হাসলো। প্রণয় এই স্নিগ্ধ হাসির মানে জানে না।
চন্দ্রা বলল,
“হুম এটা ঠিক যে প্রথমে শুধু প্রণয়িনীকেই ভালোবাসতাম৷ মিষ্টি একটা মেয়ে। এমন মিষ্টি মেয়েকে ভালো না বেসে পারা যায় না। কিন্তু পরে খেয়াল করলাম মিষ্টি মেয়েটার বাবা তার মতোই। কিভাবে যেন এরপর মিষ্টি মেয়েটার বাবার প্রেমে পড়ে গেলাম। এখন শুধু মেয়ের দিক না, মেয়ের বাবার দিক তাকিয়ে থাকতেও ভালো লাগে। এইজন্য একেবারে মেয়ের বাবাকে বিয়ে করে ফেলতে চাই।”
এই কথা বলে চন্দ্রা নিজেই লজ্জা পেয়ে গেল। আর চন্দ্রার কথা শুনে প্রণয় অবাক হয়ে গেলো। প্রণয়ের বিশ্বাস হচ্ছে না এটাই তার চন্দ্রমল্লিকা। প্রণয় হা করে তাকিয়ে আছে চন্দ্রার দিকে। চন্দ্রা লজ্জা পেয়ে উঠে রেস্টুরেন্ট থেকে দৌড়ে বের হয়ে গেল। প্রণয় ডাক দিল কিন্তু চন্দ্রা শুনলো না। সে এখন পালাতে পারলেই বাঁচে। প্রনয় চন্দ্রার যাওয়ার দিক তাকিয়ে রইল। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না চন্দ্রা মাত্র যে কথাগুলো বলল। প্রণয়ের মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে। তার চন্দ্রমল্লিকা তাকে ভালোবাসে! তার চন্দ্রমল্লিকা নাকি তার প্রেমে পড়েছে!
অন্যদিকে চন্দ্রা লজ্জায় শেষ। সে কি পাগল হয়ে গিয়েছে! না জানি প্রণয় কি ভাবছে। এভাবে কেউ বলে? চন্দ্রা নিজের মাথায় মেরে বলল,
“তুই সত্যিই পাগল। এখন এতো লজ্জা কোথায় রাখবো। প্রণয় ভাইয়াকে আর মুখ দেখাতে পারব না লজ্জায়।”
চন্দ্রা প্রণয়ের ভাবনায় ডুবে থাকলো। আর প্রণয় চন্দ্রার ভাবনায়। প্রণয় বাসায় গিয়ে নিজের রুমে গেল। সে একা একা বসে বসে হাসছে। প্রণয়িনী এসে বলল,
“বাবা, তুমি আজকে এতো খুচি হয়েছো কেন?”
“আজ তোর বাবার দিন, এইজন্য।”
প্রণয়িনী বলল,
“আজ বাবার দিন কেন?”
প্রণয়ের ইচ্ছে করছে খুশিতে প্রণয়িনীকে সব বলে দিতে। কিন্তু বাবা হয়ে মেয়েকে নিজের প্রেমকাহিনী শুনাবে কি করে। প্রণয় বলল,
“কিছু না। শুধু একটা কথা জেনে রাখো, তোমার বাবা তোমার চন্দ্রা আন্টিকে তোমার মা বানিয়ে নিয়ে আসবে।”
এটা শুনে প্রণয়িনী খুশি হয়ে “ইয়েএএএএ” বলে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।
প্রণয় চন্দ্রাকে ম্যাসেজ দিয়ে বলল,
“এই যে চন্দ্রমল্লিকা, লজ্জা পেয়ে তো চলে গেলে। সাবধানে পৌঁছিয়ে ছিলে তো?”
চন্দ্রা প্রণয়ের ম্যাসেজের রিপ্লাই করতেও লজ্জা পাচ্ছে। শুধু বলল,
“জ্বী”
এই বলে তাড়াতাড়ি অফলাইনে চলে গেল।
চলবে….