মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_৩৫,৩৬

0
608

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩৫,৩৬
#পুষ্পিতা_প্রিমা
৩৫

সেদিন ইশা চলে এসেছিল আদির কাছ থেকে। আদিকে শুনিয়ে এসেছিল তিক্ত কথা। আদি তার জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখেছিল ইশার চলে যাওয়া। সে আর আটকায় নি। যে চলে যেতে চায় তাকে যেতে দেওয়া উচিত। ইশা খান বাড়িতে ডোরবেল বাজানোর সাথে সাথে দরজা খুলে দেয় একটি ছেলে। তার পড়নে শাড়ি দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,

‘ এটা তোর বাড়ি নয়। এখানে কি চাই। কেন এসেছিস? তোর এখন স্বামীর ঘরে থাকা উচিত। মিথ্যেবাদী।

ইশাকে কিছু বলতে না দিয়ে রিপ তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়। ভেবে রাখে যে, কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দেবে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পার হলে ও দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ আসেনা। রিপ তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলে দেখে কেউ নেই। লাল শাড়ি পড়া মেয়েটি কোথাও নেই। রিপ চেঁচিয়ে ডাকে, ইশা…….
সেদিন হাজার ডেকে ও ইশা আসেনি। হুট করে একটা মেয়ে কোথায় যাবে। রিপ সেদিন বাইক নিয়ে এদিকওদিক ঘুরেছিল সারারাত। চৌধুরী বাড়ি গিয়েছিল। খোঁজ নিয়ে আদির ফ্ল্যাটে ও গিয়েছিল। কিন্তু দেখা মিলল না। বরঞ্চ আদি নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছে। কোথায় যেতে পারে মিষ্টি?
সারা শহরময় খুঁজল ইশাকে আদি আর রিপ মিলে। কোথাও পেল না। এমন কোনো আত্মীয় ও নেই যেখানে ইশা গিয়ে থাকতে পারে। প্রায় তিন চারদিন হয়ে গেলে ও ইশার খোঁজ যখন পাওয়া গেলনা তখন থানায় মিসিং ফাইল করা হলো। ইশার নিখোঁজ হওয়া নিয়ে রিপ নিজেকেই দোষারোপ করল। সে যদি দরজা বন্ধ করে না দিত,তাহলে কিছুই হতোনা। ইশা হারাত না। পরী সারাঘরময় একা একা হাঁটল। নীরাকে ছুঁতে দিল না। কোলে নিতে দিল না। গুনগুন করে কেঁদে কেঁদে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলতে লাগল,
‘ নাই ইশআআা নাই। আমমমমা নাই।
আদি নিয়ে গেল পরীকে। সারাটা দিন সারাটা রাত মেয়েকে তার কাছে রাখল। রিক কোনোকিছু বলল না। সে বুঝতে পারে আদির কষ্ট। আদি মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ঘুমায়। পরী মাঝরাতে ঘুম থেকে লাপিয়ে উঠে কাঁদে। ইশআআ নাই,আমমমা নাই। নাই নাই।
আদি চেয়ে থাকে দেয়ালে টাঙানো ইশার ছবিটার দিকে। তার দেখাদেখি পরী ও তাকায়। আদির গালে গাল লাগিয়ে ইশার ছবিটার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকে, ইশআআ আয় আয়,আমমমা আয় আয়।
আদি কাঁদে হাসে। মেয়ের গালে স্নেহের স্পর্শ দিয়ে বুকে চেপে ধরে বলে,তুমি যেওনা আমমি আমাকে ছেড়ে। আমি খুব একা।
পরী মুখ তুলে তাকায় আদির দিকে। মাথা দুলিয়ে আদির গালে লালা লাগিয়ে দিয়ে বলে, নান না দাবো না দাবো না।
পরে ঠোঁট টেনে কেঁদে কেঁদে বলে, আমমমমা নাই, নাই নাই।

রিপ ইশার রুমের প্রত্যেকটা জিনিস তন্নতন্ন করে কোনো ক্লু পাওয়া চেষ্টা করে। পুরো ঘরের প্রত্যেকটা জিনিস ছুড়ে মারে এদিকওদিক। বেহাল দশা বানিয়ে ফেলে। নীরা এসে আটকালে রিপ তাকে ধমক দেয়

‘ খবরদার নীরা। তুমি এখানে নাক গলাবে না।

নীরা ভয়ে চুপসে যায়। সরে পড়ে। রিপ ইশার আলমারি থেকে কাপড়চোপড় বের করে সবকিছু দেখে। তার কষ্ট সফল হয় অবশেষে। দুইটি মেডিক্যাল রিপোর্ট হাতে পায় সে। একটি পরীর ডেলিভারি অপারেশনের। অন্যটি?
রিপের দুচোখ চকচক করে উঠে। তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ফুসফুসের ক্যান্সার? ইশু বেশিদিন বাঁচবে না? তার ইশু মরে যাবে?
রিপ বসে পড়ল খাটে। অনেকক্ষণ পায়ের উপর ভর দিয়ে সে দাঁড়াতে পারল না। তার হাত পা কাঁপাকাঁপি বন্ধ হলো না। এখন উপায় একমাত্র আদি।
পাগলের মতো হন্য হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়া রিপকে দেখে কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারেনা। যখন সে দৌড়ে যায় আদির বাসায়,তখন আদির বুকের উপর শুয়ে থাকা পরী। বাবা মেয়ে বাইরের লনে শুয়ে আছে। অপেক্ষার প্রহর গুনছে কবে ফিরবে মিষ্টি। কবে ফিরবে পরীর আমমা। পরী মাথা ফেলে রাখে আদির বুকের উপর। ডাকে, আবব্বে আববব্বে আববব্বে।
রিপ ছুটে যায়। পরীকে কোলে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। বলে,মা কোথায় তোমার মা????
আদি বিস্ময় নিয়ে বলে,
‘ কি হয়েছে রিপ?
রিপ পরীকে বুকের সাথে চেপে ধরে কাঁপাকাঁপা হাতে উপরে তুলে দেখায় সেই রিপোর্ট। আদি একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখে সেই রিপোর্ট। তার গাল বেয়ে কখন যে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়ল কেউ বুঝতে পারল না। কেউ দেখল না। পরী মাথা তুলে একবার রিপের মুখ দেখে, একবার আদির মুখ দেখে। দুজনকেই প্রশ্ন করে,,, রিইইই দিইইই আমমমমা নাইই???

রিপ তার দুচোখ চেপে ধরে পরীর বুকের কাছে। বলে, আছে আমমা আছে। পরী রিপের চুল নিয়ে খেলা করে, বলে
‘ নাই নাই আমমা নাই। আমমা নাই।

আদি তন্নতন্ন করল পুরোটা শহর। পুরোটা কলোনি। পাগলপারা হলো রিপ আর সে। ইশার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। আদি ক্লান্ত হলো। রিপ মাথার দুপাশে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল অতীতের সেই ইশুর সাথে তার কাটানো মুহূর্ত গুলো। যেদিন সে পড়াশোনার জন্য লন্ডনে চলে যাচ্ছিল,সেদিন ইশু চিৎকার করে কেঁদেছে। তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। কেউ তাকে ছাড়াতে পারেনি । কয়েক মিনিট পর সে নিজে নিজে ছেড়ে দিতে দিতে বলেছিল,
‘ রিপদা আমাকে এভাবে একা করে চলে যাওয়ার শাস্তি তুমি পাবে। এখন যাচ্ছ। যাও।
রিপ এত কষ্টের মাঝে ও হাসল একটুখানি। বলল, তুই আমাকে সেই শাস্তি ঠিকই দিয়েছিস ইশু। এত বড় শাস্তি দিলি আমায়!

রিপ হাতের কব্জিতে চেপে ধরল নিজের দুচোখ। তুলল না মাথা। তাকাল না কারো দিকে। আদির দিকে সে তাকাতে পারল না। আজ বেশি কষ্ট তার আদির জন্য হচ্ছে। হিসাব করতে গেলে তার প্রাপ্তির খাতা শূন্য।

__________

যখন চারদিকে রিমঝিম বৃষ্টি, নির্জন,নির্মল বাতাস বইছে তখন আদি বেরিয়ে পড়ল তার মিষ্টির খোঁজে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সে হাঁটল। তার কোলে যে পরী আছে তা তার মাথায় থাকল না। পরী দুহাত মেলে নেচে নেচে বলল, ওহ ওহহহ দিইইই বৃতততি। ওয়াহ না।
আদি হাঁটল। পরী তার ঠান্ডা হওয়া গাল লাগিয়ে রাখল আদির গালে। বলল, আবববব্বে দুক্কু।
আদি তারপর ও জবাব দিল না। আদি পৌঁছে গেল আহমেদ বাড়ির কাছাকাছি। ঠিক যেটাই ভাবল সেটাই হলো। দাঁড়িয়ে আছে দুজন মেয়ে পাশাপাশি। আইমি আর একজন?
পরী আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল তার মাকে, ওতততো আমমমা।
আদিকে দেখেই মেয়ে দুজন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আদি যেতে যেতে বলল,
‘ অসাধারণ। যাকে পুরো শহর আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি সে তো আমার আশেপাশেই আছে। আমি কি অন্ধ?
আদি পরীকে নিচে নামিয়ে দেই। পরী দৌড়ে যায় ইশার কাছে। ঝাপটে জড়িয়ে ধরে ইশাকে। ডাকে, আমমমা।
ইশা পরীর ছোঁয়া পেয়ে কেঁদে দেয়। আবার হাসে। পরীর দুগালে অসংখ্য চুমু খেয়ে বলে, মা তুমি ভালো থেকো। খুব ভালো থেকো। তোমার আব্বাকে দেখে রেখো।
পরী ইশার দুগাল আগলে ধরে আদুরে স্বরে ডাকে, আমমমা আয়। আয়।
ইশা জড়িয়ে ধরে তাকে। বলে, এভাবে ডেকো না মা। আমি আসতে পারব না।
পরী ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে, আয়, আমমা আয়।
ইশা আদর দেয় তার ঠোঁটে,মুখে,কপালে। বলে, আসব মা। এইরকম বৃষ্টি হয়ে। আমার মাকে ছুঁয়ে দিতে। আদর করে দিতে। সত্যি আসব।
ইশা কোলে নিল পরীকে। আবার ও আদর করে দিয়ে আইমির কোলে তুলে দিল। বলল, ওঁকে কাপড় চেন্জ করে দিতে হবে। ঠান্ডা লেগে যাবে। আইমি তাকিয়ে থাকে ইশার মুখের দিকে। বলে,
‘ আদিকে আমি ডেকে এনেছি।
ইশা তাকায় ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেটির দিকে। বলে, ডক্টর,,,,
আদি ধীর পায়ে এগিয়ে আসে তার দিকে। বলে, সব অন্যায় অবিচার আমার সাথেই কেন হয়?
ইশা পিছু হাঁটে। বলে, ডক্টর সত্যিটা মেনে নেওয়ায় ভালো। আপনি ভালো থাকুন আইমিকে নিয়ে। নতুন করে সংসার সাজান। মনে করুন মিষ্টি খানিকক্ষণের জন্য আপনার জীবনে এসেছিল। প্লিজ ডক্টর পাগলামি করবেননা। আইমিকে আপনাকে ভালোবাসে, ও ভালো রাখবে আপনাকে।
আদি তার অবিশ্বাস্য চাহনি দিয়ে তাকিয়ে থাকে মিষ্টির মুখপানে।
ইশা একবার চোখ মুছে আবার কাঁদে। বলে, ডক্টর আমাকে যেতে হবে। আপনি প্লিজ পরীর খেয়াল রাখবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন। আইমিকে সুখী করবেন। আমার শেষ ইচ্ছেটুকু রাখবেন ডক্টর। মিষ্টির চাওয়া এটুকুই। প্লিজ ডক্টর।
আদি কিছু বলতে যায়। ইশা হাত দেখিয়ে বাঁধা দেয়। ইশা হেঁটে দৌড়ে অনেকদূর চলে যায়। পরী হাত বাড়িয়ে ডাকে, আমমমা আয় আয় আয়। আমমা আয়।
আদি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আইমির দিকে। পরী দৌড়ে আসে। দুজনের পাশে দাঁড়িয়ে ওই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বলে, তা তা আমমা তা তা।

______________

ছোট্ট একটি বাচ্চা মেয়ের আবোলতাবোল বকবকানি শুনে আদির ঘুম ভেঙে যায়। বাচ্চা মেয়েটি কোথায় খেয়াল করতেই সে বুঝতে পারে মেয়েটি বারান্দায় দাঁড়ানো। বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বের করে বাচ্চা মেয়েটি আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাকছে, বৃততততততি আয় আয় আয়।

আদি ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ায় মেয়েটির পিছু। কোনো শব্দ ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকে। পরী বকবক করতেই থাকে, আয় আয় বৃতততি আয়। আয় আয়। বৃতততি আয়।
আদির রুম থেকে ভেসে আসে একটি মেয়েলি কন্ঠস্বর।
‘ পরী খেতে এসো। আজকে তোমার পাপপার কাছে যাওয়ার পালা। এসো।
পরী শুনে ও শোনেনা। আকাশের দিকে তাকিয়ে অবিরত ডাকতে থাকে,
‘ বৃতততি আয় আয়।

চলবে,,

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩৬
#পুষ্পিতা_প্রিমা

মেয়েটির কথা শোনে না এরা বাপ মেয়ে। মেয়েটির রাগ হয়। অভিমান হয়। সে সারাক্ষণ বকবক করলে ও কেউ কানে নেয় না। না বাবা না মেয়ে। তার দোষটা কোথায়?
অভিমানে তার কান্না পায়। প্রচুর কান্না পাচ্ছে এই মুহূর্তে ও । খেতে ডাকছে তা ও আসছেনা। কিভাবে বললে আসবে।
মেয়েটি ধীরপায়ে হেঁটে ছেলেটির পিছু এসে দাঁড়ায়। ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটি ডাকছে হাত বাড়িয়ে, বৃততি আয় আয় আয়।
আচমকা মেয়েটির দুচোখ জলে টলমল করে উঠল। কিন্তু সে কিছু বুঝে উঠার আগে ছেলেটি ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে নিয়ে নেয়। তার পাশ কেটে চলে যায়। বাচ্চা মেয়েটি যেতে যেতে বলে, বববো না কুথা বববো না। তা তা। তা তা। আমমমা নাই। নাই। নাই। বৃততি নাই।
মেয়েটি দাঁড়িয়ে থাকে তার জায়গায়। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দুফোটা জল অভিমানে, অবহেলায়। তার দোষটা কোথায়?
সে আজ শাড়ি পড়েছে খুব সুন্দর করে কিন্তু ছেলেটি একবার ও ঘাড় ফিরিয়ে দেখল না তার দিকে। সে কি খুব অসুন্দর? অসুন্দর হলে বিয়ে করল কেন?

____________________

মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। খান বাড়িতে লোকজনের সমাগম। ভীড় করেছে মানুষ ইশা নামের মেয়েটির চিরযাত্রা দেখতে।পরিবেশ থমথমে। থেকে থেকে ভেসে আসছে কান্নার আওয়াজ। সবাই দেখছে ছোট্ট একটি বাচ্চা মেয়ে হাঁটছে গুটিগুটি পায়ে। মাথার চুলগুলো উসকোখুসকো। টান টান ভাব পুরো মুখে। কাঁদছে তাই। একটা মহিলা তাকে ডাকল,
‘ বাবু এদিকে এসো। কাঁদছ কেন?
অন্য একটি মহিলা বলে উঠল।
‘ এ মেয়েটির মা বোধহয় সে।
পরী তার মুখ নিয়ে চেয়ে রইল মহিলাগুলোর মুখের দিকে। মহিলাটি তার তাকানো দেখে বলে, মা নেই তাই কাঁদছ। এদিকে এসো।
পরী হাত দেখিয়ে বলে, আমমা নাই। আমমা নাই।
মহিলাটি বলেন, আমমা কাঁদিয়েছে?
পরী মাথা উপর নিচ করে জানান দেয়। আমমমা দুক্কু। আমমা নাই। নাই।
খান বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে হুড়মুড় করে ডুকে পড়ে একটি ছেলে। পরী তাকে দেখার সাথে চেঁচিয়ে কেঁদে দেয়। উপরের তলা দেখিয়ে বলে, আমমমা নাই, রিইইই আমমমা নাই! আমমা ঘুমমম।
রিইইই শক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। পরী গিয়ে শক্ত করে তার পা দুটো জড়িয়ে ধরে। কোলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে বলে, রিইইই আমমমা নাই?
রিপ কোলে তুলে নেয় মেয়েটিকে। শক্ত করে চেপে ধরে। মেয়েটির ঘাড়ের কাছে চেপে ধরে নিজের চোখ। চাপা আর্তনাদে ভেসে গেল পুরো বাড়ি। দুজন বৃদ্ধ লোক কাঁদে। রিক বসা এলোমেলো, মুনা আর নীরা সামলাতে ব্যস্ত সবাইকে। মেঝেতে উত্তর দক্ষিণ করে শোয়ানো সাদা কাপনে মোড়ানো একটি লাশ। মুখটা খোলা। নাকে গুজা তুলো। মেয়েটির মাথার কাছাকাছি মেয়েটির মাথার কাছে শুয়ে আছে একটি ছেলে। ছেলেটির চুলগুলো এলোমেলো। কেউ একজন এসে হঠাৎ ছেলেটিকে বলল,
‘ আদি ওকে নিয়ে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। উঠে পড়।
আদি উঠে। কিন্তু ওই কাফনে মোড়ানো মেয়েটির হাত খুঁজে নেয়। নিজের হাতের মুঠোয় ঠান্ডা হাতটি নিয়ে বলে, না আমি কোথাও যাব না। মিষ্টি ও কোথাও যাবে না।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। সবাই তাকে ছাড়িয়ে নেয়।
রিপ আর রিক ডুকতে চায় সেই রুমে। অনুরোধ করার মত করে কয়েকটা মহিলাকে বলে, একবার শেষ দেখা?
বলা শেষ করতে না করতেই বৃদ্ধ মহিলাটি চেঁচিয়ে উঠে।
‘ স্বামী ছাড়া আর কেউ দেখতে পাবে না।
রিপের কোল থেকে নেমে যায় পরী। দৌড়ে যায় শুয়ে থাকা মেয়েটির কাছে। মুখের উপর থেকে সাদা কাফন সরিয়ে টুপ করে চুমু খেয়ে ডাকে, আমমা আয়।
আমমা উঠে না। শোনে না তার মায়ের ডাক। বাচ্চা মেয়েটি শুয়ে থাকা মেয়েটির চোখদুটো আঙুল দিয়ে খুলে ফেলার চেষ্টা করে । চোখদুটো এতটা ঠেসে আছে,খুলছেই না। তখন আমমা দুষ্টুমি করে যখন চোখ বন্ধ করে থাকত তখন পরী আঙুল দিয়ে খুলে ফেলার চেষ্টা করত। তখন একটু একটু চোখ খুলত,আমমা খিক করে হেসে চোখ খুলে ফেলত। কিন্তু আজ কেন খুলছে না? পরী দুমদুম বাড়ি খায় মেঝেতে কপাল ঠেকে। ডাকে, আমমা পরররী নাই? নাই? আমমা পরীইই দুক্কু। দুক্কু।
কিছুক্ষণ পর খাটিয়ার উপরে তুলে নেওয়া হয় মেয়েটির নিথর দেহ। খাটিয়ার উপরে দিয়ে দেওয়া হয় তার লাল টকটকে বিয়ের শাড়ি। খাটিয়া কাঁধে তুলে নেয় দুইভাই এক মামা। আর স্বামী।
স্বামীর দুচোখ স্থির। হোঁচট খাচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর। ছোট্ট একটি বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে তার দাদার পা। কেঁদে কেঁদে মাথা নেড়ে নেড়ে বলে,
‘ না না না না। আম্মা দাবে না না। আম্মা আমমমাল। আমমমাল। আমমা আয়। আমমমাল আমমমা। ইনননা আমমমাল।
যখন দেখল দাদা শুনছেনা। তখন গেল রিকের কাছে। পা আঁকড়ে ধরল শক্ত করে। কেঁদে কেঁদে ডাকল,
‘ পাপপপা আমমমা আমমমাল। দাবে না। দাবেনা। আমমা দাবে না। আমমা আমমমাল।
বাচ্চা মেয়েটির গলার স্বর ধরে যায়। ভেঙে যায়। বসে যায়। রিক ও কাঁদে মেয়ের সাথে সাথে। রিপ ও কাঁদে। অন্য ছেলেটি কাঁদে না। বাচ্চা মেয়েটি দৌড়ে যায় রিপের কাছে। পা জড়িয়ে ধরে মাথা এলিয়ে দিয়ে ডাকে,
‘ রিইইই আমমাল আমমমা। আমমা আমমাল। আমমমা পরররীর।
রিপ ফুঁপানোর জন্য কথা বলতে পারেনা। হাত দুটো দিয়ে খাটিয়া ধরা। তাই বাচ্চা মেয়েটিকে সরাতে ও পারছে না।
বাচ্চা মেয়েটি চোখ তুলে দেখে রিইইই ও কাঁদছে তাই সে ছেড়ে দেয় রিইইইকে। দৌড়ে যায় ওই স্থির চাহনির ছেলেটির কাছে। শত অভিযোগ, অভিমান,অবহেলার কষ্টের বাণী শোনায় তার আবববাকে। বলে,
‘ আববা রিইই দুক্কু। পাপপা দুক্কু। দাদ্দা দুক্কু। আমমমা ও দুক্কু।
ছেলেটি শুধু তাকিয়ে থাকে কিছুটা দূরে মাটির দিকে। মেয়েটি তার পা ঝাকিয়ে বলে,
‘ আবববা আমমমা আমমমাল। আমমা পরীররর। আমমমা দাবে না। আমমমা আমমাল। আববা আমমা নাই?
একটা লোক এসে কোলে নিয়ে নেয় মেয়েটিকে। মেয়েটি চিৎকার করে ডাকে, আমমমমা আয়।
মেয়েটির কান্নায় কাঁদে চারপাশ। কাঁদে আশেপাশের লোকজন।
মেয়েটির হাত পা ছুড়ে ডাকে।
‘ আবববা আমমা আমমমাল। পরীর আমমমা। ইশআআা আয়। আমমমা আয়। আমমাল ফিপি। আমমমাল আমমা।
তাকে কোলে নেওয়া ছেলেটির হাতে কামড় বসিয়ে দেয় সে। বৃষ্টি জলে ভেজায় আর কথা বলতে পারছেনা। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ডাকছে, আমমমি দাবো। আমমমা আমমমি দাবো।
ছেলেটি নামিয়ে দেয় তাকে। ততক্ষণে খাটিয়া চলে গিয়েছে বহুদূর। আমমা চলে গিয়েছে। আমমমা চলে যাচ্ছে। পরী দৌড়ে বৃষ্টি জলে ভিজে ভিজে। পরী তার মিনমিনে গলায় বৃষ্টির উপর রাগ দেখিয়ে বলে,
‘ বৃততি যাহ। আমমমা আয়। আমমমা আয়।
আচমকা পাথরের উপর হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে পরী। রক্তে লাল হয়ে যায় সেই পাথর। রক্ত ধুয়ে মিশে যায় মাটিতে। পরী মাথা এলিয়ে দেয় পাথরের উপর। হাত বাড়িয়ে ডাকে, আমমা আয়য়।
আমমমা আমমমা ডাকতে ডাকতে পরী অজ্ঞান হয়ে যায়। আমমা তাকে কোলে নিতে আসেনা। আমমা তাকে আদর করতে আসেনা। আমমা কোলে নিয়ে গালে আদর দিয়ে বলেনা ,
‘ মা টা কি বেশি দুক্কু পেয়েছে?
বলেনা কেউ। আসেনা কেউ। কোলে নেয়না কেউ।
চারপাশ নিস্তব্ধ। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ শুধু। আজ খুব একা পরী। আজ পরী এতিম। আজ আমমমা নেই আর তার।
ছোট্ট পরীর জ্ঞান ফিরতে ফিরতে তা মা চলে গেল মাটির নিচে। আর ছোঁয়া যাবেনা। মারা যাবে না। লালা লাগিয়ে দেওয়া যাবে না। আদর করা যাবে না। রাগ দেখানো যাবে না।

কবরে মাটি দিতে দিতে আদি উচ্চারণ করে, ঘৃণা আমি তোমায়। তুমি কষ্ট দিয়েছ আমাকে। আমার সন্তানকে। তুমি পাষাণ মিষ্টি। তোমার জন্য আমি কাঁদব না। আমি ভালো থাকব। আমি ভালো থেকে তোমাকে দেখাব। তুমি দেখবে। তুমি দেখবে আমি কতটা ভালো আছি। আমি তোমার মতো না। আমি কষ্ট দেব না আমার সন্তানকে। তুমি হৃদয়হীন মিষ্টি। হৃদয়হীনদের ক্ষমা হয়না।

মিষ্টি যখন পুরোপুরি তার চোখের আড়াল হয়ে যাচ্ছে তখন আচমকা সে পাগলামি শুরু করল।
‘ এই রিপ এভাবে ডেকে দিস না। মিষ্টিকে দেখা যাচ্ছে না তো। আমি দেখব না। ওর সাথে যে আমার অনেক হিসেব বাকি। অনেক কথা বাকি। এভাবে ঢেকে দিলে আমি কথা বলব কিভাবে? এভাবে ঢেকে দিস না। এটুকু কষ্ট না দিলে কি চলে না। সব তো মেনে নিয়েছি।
রিপ হাতের কব্জি দিয়ে চেপে ধরে তার দুচোখ। বলে,
‘ এটা হয়না আদি।
আদি মাটিগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে দেয়। বলে,
‘ সব হয়। মিষ্টি সব পারে। তাহলে আমি পারব না কেন? এরকম থাক। আমি ওর সাথে কথা বলব। তোরা যাহ।
রিপ তাকে ঠেলে দেয়।
‘ পাগলামি করিস না আদি।
আদি তার হাত দিয়ে সরায় মাটি। বলে,
‘ এমন করছিস কেন? মিষ্টি ও তো এমন করে। সবাই করে। সবাই আমার সাথে এমন করে কেন?
রিক এসে টেনে নিয়ে যায় আদিকে। আদি চুপচাপ আর কিছু বলেনা। চেয়ে থাকে ওই কবরের দিকে। বৃষ্টি থামে ধীরে ধীরে। হঠাৎ করে অন্ধকার নেমে আসে চারপাশে। আদি ধীর পায়ে হেঁটে বসে কবরের কাছে। কবরের মাটিতে আঙুল দিয়ে মাটিতে দাগ বসিয়ে লিখে মিষ্টি, পরী।
ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটির ঠোঁট কেটে রক্ত ঝড়ছে। বাচ্চা মেয়েটি কাঁপা কাঁপা পা হেঁটে হেঁটে আসে কবরের কাছে। হাতের মুঠো দিয়ে চোখ কচলে কচলে। রিপ আর রিক দৌড়ে যায়। বাচ্চা মেয়েটি তাদেরকে ছুঁতে দেয় না। কবরের কাছে বসে মাটি ছুঁয়ে ডাকে, আমমমা দুক্কু। পররী দুক্কু।
নিজের ঠোঁট দেখিয়ে দেয়। বলে, আমমমা এততো দুক্কু। পরীই দুক্কু। আমমাল আমমা।
আদি পরীর দিকে চেয়ে থাকে। গর্জন করে আচমকা সে ডেকে উঠে,
‘ মিষ্টি তুমি মেরেছ আমার মেয়েকে আর এখন ঘুমোচ্ছ? আরামে ঘুমোচ্ছ তুমি? উঠো। আমার মেয়েকে আদর করে দাও। ওর চোখ মুছে দাও। ওর কষ্ট দূর করে দাও। ওর ঠোঁট কেটে গেছে। ওর কষ্ট হচ্ছে। মিষ্টি তুমি মরে গিয়েছ, শান্তিতে আছ। আর আমাকে মেরে গিয়েছ। আমাকে নরক যন্ত্রণায় রেখে গেছ। আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি ও মারা যাচ্ছি মিষ্টি। মারা যাচ্ছি আমি। পরী কবরের কাঁচা মাটির উপর কান পেতে শুনে বলে, আমমমা কুথাইইই? আমমমাল আমমমা কুথাইই। আমমমা পরীইই দুক্কু। আমমমা।
হঠাৎ আচমকা দূরে কোথাও এক বজ্রপাত ঘটে। আদি দেখে পরীর কান্না থেমে গেছে। সে দুহাতে কান চাপা দিয়ে জড়িয়ে ধরে পরীকে। চিৎকার দিয়ে উঠে।
জোড়াল শ্বাস নিতে নিতে এলোমেলো ভাবে বলে, মিষ্টি কেন চলে গেলে? কেন?

মাঝরাতে মেয়েটির ঘুম আপনাআপনি ভেঙে গিয়েছে। তাই সে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে ছিল তার পাশে ঘুমন্ত ছেলেটির দিকে। ছেলেটি আচমকা তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরবে সে ভাবতে ও পারেনি। হয়ত দুঃস্বপ্ন দেখেছে? নয়ত অন্যকিছু?
আদি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মেয়েটিকে। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। মুখ তুলে দেখে মেয়েটির মুখ। দুহাতের আগলে ধরে সেই মুখ। এলোপাথাড়ি চুমু দেয়। তারপর আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটি লজ্জায় চোখ খুলে তাকাতে পারেনা। আদি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজের দুচোখ, মুখ মেয়েটির ঘাড়ের কাছে। চোখের পানি লেপ্টে যায় মেয়েটির গলায়,ঘাড়ে।
মেয়েটি অবাক হয় তার এমন আচরণে। চুলের ভেতর হাত দিয়ে বিলি কেটে দিতে দিতে বলে,
‘ অবশেষে আমার সাধনা স্বার্থক ডক্টর আদি চৌধুরী। এবার পরীকে ছুঁতে দেবেন তো? আমাকে মা ডাকতে দেবেন ?
আদি চুপ হয়ে শোনে মেয়েটির কথা। আচমকা ডুকরে উঠে। মাথা তুলে দেখে মেয়েটিকে। হুট করে ছেড়ে দেয়। দূরে এসে বসে। তার পাশে ঘুমন্ত বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিয়ে গালে আদর দিয়ে বলে,
‘ পরী শুধু আমার আর মিষ্টির মেয়ে। তুমি মিষ্টি নও। পাষাণ। হৃদয়হীনরা কখনো মা হতেই পারেনা।
ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটি ঘুমের মাঝে নড়েচড়ে উঠে। বিড়বিড় করে বলে,
‘ আমমমমালল আমমমা। আমমমাল। পরীর।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here