মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_৫ (সিজন ২)

0
925

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৫ (সিজন ২)
#পুষ্পিতা_প্রিমা

বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হলো। পরী তারপর দিন থেকেই সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল। না কথা বলল মুনার সাথে, না বলল রিকের সাথে। রিপ নীরার সাথে ও বলল না। পুরোটা সময় চুপচাপ। কিছু জিজ্ঞেস করলে ও উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। রিক যেটা বলছে সেই কাজ কোনো আওয়াজ ছাড়াই করছে। টু শব্দ করছেনা। এমনকি বন্ধু-বান্ধবদের আয়োজন করে দাওয়াত দিয়েছে। রিক মনে মনে ভয়ে ভয়ে থাকল। ঝড় আসার পূর্বাভাস নয়ত। ইশা সেদিন একগাদা কথা শোনাল রিককে। পরীর ভালো চাইতে গিয়ে রেহানের ক্ষতি হচ্ছে না তো? রেহান কি ভালো থাকবে পরীর সাথে?
এ প্রশ্ন আদি করেছিল রেহানকে। রেহান আদির মুখে অমন প্রশ্ন শুনে ভড়কে গেল। আদি জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি মন থেকে রাজী হয়েছ বিয়েটাতে?
রেহান আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে লজ্জা পেয়ে গেল। যাহ বাবা ছেলেদের আবার লজ্জা ও আছে নাকি? রেহান মাথা চুলকাতে চুলকাতে চলে গেল। উত্তর দিল না আদির প্রশ্নের। আদি ইশাকে বলল তোমার রাগী মেয়ে এই ছেলের মাথা খেয়েছে মিষ্টি। তোমার মেয়েকে দেখলে আমার নিজের ভয় লাগে। ইশা রেগে গেল। এভাবে বলছেন কেন? আমার পরী খুব ভালো। ওর রাগের আড়ালে অনেক ভালো একটা মন আছে।
আদি ভেংচি কাটল। পুরোটা মায়ের মতো হয়েছে মেয়েটা। যেমন মা তেমন তার বাচ্চি।
ইশার এবার প্রচন্ড রাগ হলো। সে শপথ নিল কথা বলবেই না ডক্টরের সাথে। এমন কথা যদি কখনো হুটহাট পরীর সামনে বলে ফেলে তখন কি হবে? পরী বউ হয়ে এলে সারাক্ষণ তো সামনে সামনে থাকবে। আদি বুঝতে পারল মিষ্টির রাগ। বলল,
‘ মিষ্টি তোমাকে রাগলে আর ও বেশি ভালো লাগে। যেমন পিহুসোনাকে লাগে। পিহু একদম তার মায়ের কার্বনকপি। আর পরী আমার। যেমন তার রাগ। তেমন তার ভালো একটা মন ও আছে। কি ঠিক বলিনি?
ইশা ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল আদিকে। ভালোই পাম্প দিতে জানে এই ব্যাটা । এখন সে আর পরী ভালো হয়ে গেল। হুহহ।

ইশা আঙুল দেখিয়ে বলল,
‘ একদম আমাকে গলানোর চেষ্টা করবেন না ডক্টর। আপনাকে আমি চিনে গেছি।
আদি হো হো করে হাসল। একেবারে কাছে গিয়ে মিষ্টিকে কোলে তুলে নিল। বিস্ময়ে ইশার মুখ হা হয়ে গেল। বলল, চরম বেয়াদব আপনি। কেউ দেখলে কি হবে? পিহু আছে। রাইনা ভাবী, মা। আরেহ কি করছেন ছাড়ুন।
আদি হো হো করে হাসল। বলল, প্রেম জেগেছে মনে।
ইশা হাত ছুড়ল। আদির বুকে দুমদাম মারল। বলল, হুহহ বুড়ো হচ্ছেন সেদিকে খেয়াল আছে। প্রেম জেগেছে?হুহ!
আদি আবার ও হাসল। ইশার থুতনির উপর টুপ করে চুমু খেয়ে বলল, প্রেমিক মন কখনো বুড়ো হয়না মিষ্টি। দেখি যেটা দিয়েছি সেটা ফিরিয়ে দাও তো। কুইক। কুইক।
পিহু দৌড়ে এল। বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল, পাপা মাম্মার পায়ে কি হয়েছে? মাম্মা কোথায় ব্যাথা পেয়েছ? বেশি ব্যাথা পেয়েছ।
ইশা লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। ছিঃ এই বেয়াদব লোকটা তাকে চরম অস্বস্তিতে ফেলে দেয় সবসময়। আদি পিহুকে বলল,

‘ পিহুসোনা তোমার মা আমার কোলে চড়ার জন্য সবসময় পায়ে ব্যাথা পেয়ে বসে থাকে। তুমিই বলো এটা কি ঠিক? এই মহিলাকে কোলে নেওয়ার কারণে আমার কত এনার্জি লস হচ্ছে এই মহিলা কি সেটা জানে?

পিহু হেসে দিল। বলল, পাপা মাম্মাকে একদম রুমে গিয়ে ছেড়ে আসবে। তারপর আমি পায়ে মালিশ করব।
ইশা চাপাস্বরে বলল, আপনাকে আমি দেখে নেব। সুযোগ পাই একবার।
আদি হা হু করে হাসল। পিহু ও তার সাথে সাথে বোকা বোকা হাসল। প্রশ্ন জাগল মনে, মাম্মা পায়ে ব্যাথা পেয়েছে কিন্তু পাপা হাসছে কেন? পাপার তো রেগে বলা উচিত, মিষ্টি তুমি কি চোখে দেখোনা হাঁটার সময় কিংবা ধমক জাতীয় কিছু একটা বলা উচিত। কিন্তু পাপা তা বলল না। কেন বলল না তা ও ভাবতে ইচ্ছে করল না পিহুর। সে আজকাল বড্ড খুশিতে আছে। তার দিদিয়া শেষমেশ এ বাড়ির বউ হয়ে আসছে। সে বোন প্লাস ননদিনী হবে। আহা কি খুশি!!!

____________________

নীরার বাড়ি থেকে তার মা এল। মাহিদ নানুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে গেমস খেলতে খেলতে বলল, নানু আমার একটা মেয়ে হেব্বি পছন্দ হইছে। শীঘ্রই বিয়ে করব।
নীরার মা হাফছা বেগম বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন। বললেন,
‘ তুই কত বড় হইছস যে বিয়ে করার কথা বলছিস? এখনো মায়ের আচল ধরে ঘুমোনোর অভ্যাস। তোর মুখে এসব কথা শুনলে তোর বাপ তোরে জেলে পুড়ে দেবে। এত মাইর বকা কেমনে খাস তুই। তোর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ও তো ভালো হয়ে যেতে পারিস।
মাহিদ গেমস খেলতে খেলতে জবাব দিল , শালার তোরে আজ জবাই করুম। হাফজা বেগম ভড়কে গেলেন।
‘ তুই এসব কাকে বলছিস মাহি? আমি তোকে কি বলছি শুনতে পাচ্ছিস?
মাহিদ গেমস খেলতে খেলতে চেঁচিয়ে বলল,
‘ বড়ো মা দিদিয়ার বিয়েতে আমার কয়টা গার্লফ্রেন্ডকে ইনভাইট করতে পারব?
মুনা মাহিদের কথা শুনে দৌড়ে এল। ফিসফিস করে বলল,
‘ তোর বড় আব্বা উপরে আছে,শুনলে লাঠি নিয়ে বেধরম পেটাবে। এইদিনই তো রিপের হাতে মাইর খেলি।
মাহিদ ভয় পেল না। বলল, ধুরর বলোনা বড় মা। কয়জনকে দাওয়াত দেব? তাদের জন্য কিন্তু স্পেশাল স্পেশাল ডিশ রান্না করতে হবে। বুঝতেই পারছ তোমাদের ছোট ছেলের বউ বলে কথা।
মুনা কপাল চাপড়াল। তোর বাপ শুনে কিনা দেখ।
মাহিদ আওয়াজ করে হাসল। তালহা বেগম এসে হাফছা বেগমের পাশে বসলেন। মাহিদ উঠে গিয়ে তালহা বেগমের কোলে শুয়ে পড়ল। তালহা বেগম চেঁচিয়ে উঠল। মাহিদ উঠে গিয়ে আবার হাফছা বেগমের কোলে শুয়ে পড়ল। তালহা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল, দাদিরে দাদি। ওরে দাদি।
তালহা বেগম রেগে গেলেন। লাঠি হাতে নিয়ে বললেন,
‘ বেয়াদব তোর বাপা জ্যাঠা কোনোদিন আমার সাথে চোখ তুলে কথা বলেনি।
মাহিদ তাকে শেষ করতে না দিয়ে বলে, ওমা কি বেয়াদবি করলাম। তোমার কোলে শুতে গেলাম তুমি চ্যানচ্যান করে উঠলে। এখানে বেয়াদবির কি হলো? আমার নানু খুব ভালো। তুমি বজ্জাত বুড়ি।
তালহা বেগম লাঠি নিয়ে উঠলেন। মাহিদ চিৎপটাং খেয়ে হাফছা বেগমের কোল থেকে সরে পড়লেন। তালহা বেগম তাকে পুরো ঘর দৌড়ালেন লাঠি নিয়ে। মাহিদ শেষমেশ নীরার পেছনে গিয়ে লুকোলো। বলল, মা, বুড়ি দেখোনা আমাকে দৌড়াচ্ছে কেমন করে ।

নীরা হাত সরিয়ে দিল মাহিদের। বলল, সবসময় তোর দুষ্টুমি ভালোলাগেনা মাহি। ছাড়, দূরে গিয়ে দাঁড়া। তোর পাপাকে বলে আবার মাইর খাওয়াবো।
মাহিদ মুখ কালো করে ফেলল। সোফায় ধপ করে বসে বলল,
‘ মা ওই পিহুর বাচ্চা আমার ফোন ধরেনা ক্যান? নিহা চিঠিটা দিল কিনা কে জানে। নাম্বারটা পাইলেই কাম শেষ।
নীরা তেড়ে এল। বলল, এই নিহাটা আবার কে? তুই কি সত্যি সত্যি ওইসব প্রেমপিরিতি শুরু করলি নাকি রে?
তালহা বেগম রেগে কটমট করে বলল, এইটুকুনি একটা ছেলে পিরিতি ও জানে। আমার দুইছেলের মুখ দিয়ে কখনো এসব কথা আমি শুনিনি।
মাহিদ বলল, তোমার দুইছেলের যুগ নেই এখন। বুঝলে? ব্যাকডেটেড মানুষজন। আমার আর আমার বউয়ের জন্য হলে ও একটু মর্ডান হও। দেখবে আমার বউ তোমাদের দেখলে নাক সিটকাবে। ছ্যাহঃ দাদিটা এমন জল্লাদ কেন?
পরী নিচে নেমে এল। মাহিদকে বলল, কি হচ্ছে এখানে। মাহিদ বলল,
‘ দিদিয়া দেখোনা ওরা কেউ আমার কথা শুনছেনা। তোমার তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তো এ বাড়িটা খালি খালি হয়ে যাচ্ছে। তাই বলছিলাম আমার জন্য একটা বউ এনে ফেললে খালিস্থানটা পূরণ হতো। কিন্তু কে শোনে কার কথা? এ বাড়ির ছোটসাহেবের কথার কি কোনো দাম আছে?
হাফছা বেগম হেসে দিলেন উচ্চস্বরে। বললেন, ওই তুই এখনো কতটুকু হয়েছিস যে বিয়ের কথা বলছিস? বউকে খাওয়ানোর পড়ানোর ক্ষমতা আছে?
মাহিদ আয়েশ করে সোফায় শুয়ে বলল, আমার বাপের এসিসট্যান্ট হয়ে যাব। পেছন পেছন ঘুরে কাগজে দুই তিনটা সই করে দিলেই আমার মাইনে জুটে যাবে। সেই মাইনে আমি হাতে নেব না। পাপাকে বলব, পাপা তুমি তোমার বউ আর আমার বউ দুইটাকেই একসাথে খাওন পড়নের খরচ দিও। আমি তোমার এসিসট্যান্ট হয়ে আছি সবসময়।

নীরা বেত নিয়ে আসল। মাহিদ দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পরী না চাইতে ও হেসে দিল। মুনা নীরাকে বলল, বাপের সামনে বলার তো সাহস নেই। কিন্তু দেখ আমাদের সামনে এলেই তার কথা ফুরোয় না। তোর বড়দা শুনলে ছিঃ ছিঃ করবে, সারাক্ষণ বউ বউ করে ছেলেটা। নীরা বলল,
‘ বউ মানে কি বুঝে ও? মুখে সারাক্ষণ বউ বউ আওড়ালে হবে?

_____________

পরী প্রাকটিসে গেল তারপরের দিন। সবাই তাকে দেখে করতালি দিল। সবাই একে একে বিয়ের জন্য কনগ্রেস জানাতে লাগল। পরীর রাগ লাগল খুব। সব রাগ গিয়ে পড়ল রেহানের উপর। তিনা আর জুলিরা হাসাহাসিতে মেতে উঠল। পরী তাদের হাসি দেখে আর ও রেগে গেল। তারকাছে কোনো জবাব না থাকায় সে চুপটি মেরে থাকল। কিন্তু তাদের পিঞ্চমার্কা কথা আর সইতে না পেরে বলল, আমি চ্যালেঞ্জে জিতে গিয়েছি। এই বিয়েটা ও চ্যালেঞ্জের একটা অংশ।

তিনা আর জুলি চুপ হয়ে গেল। বলল, মানেটা কি? এটা চ্যালেঞ্জরই অংশ?

পরী হেসে জানাল, হ্যা। রেহান চৌধুরীকে আমি নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করছি না। জাস্ট চ্যালেঞ্জ এটা। বিয়ের দিনই আমি ফুড়ুৎ। পালিয়ে যাব।

জুলি আর তিনা বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল। তারা এতক্ষণে বুঝতে পারল সবকিছু। না হলে পরীর মতো একটা অসভ্য মেয়ে যেখানে, সেখানে রেহান চৌধুরীর পরিবার কি করে রাজী হয়? তারা নিশ্চয় রেহানের জেদের কারণে মত দিয়েছে।
তিনা আর জুলি ঠিক করল পরীর বিয়েতে তারা এটেন্ড করবে। এত ভালো একটা সিংগার তার বিয়ের আসর থেকে পালাবে এটা যদি ভাইরাল হয়ে যায় তাহলে তো কেল্লাফতে। পরীকে আর রেহান চৌধুরীকে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর সময় এসে গেছে।

পরী সবার মুখের উপর জবাব দিতে পেরে বেজায় খুশি। কিন্তু মনে মনে ওই বজ্জাত ছেলেটাকে অনেকবার খুঁজল। আজ তার বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে পরী। রেহানের বন্ধুদের দেখা গেল। সবাই পরীকে দেখে ফুসুরফাসুর শুরু করল। পরী রাগ আর ও বাড়ল। আজ ওইই ছেলেটাকে দেখলে জবাই করে দেবে ভেবে নিল। কিন্তু রেহানকে সে কোথাও দেখল না।

প্রাকটিস শেষে পরী হনহন পায়ে হেঁটে চলে এল। বাইরে রাস্তায় রিকশার অপেক্ষা অপেক্ষা করতে সামনে এসে দাঁড়াল এক বাইকওয়ালা। মাথায় কালো হেলমেটটি খুলে ছেলেটি সামনের মিররে চুল ঠিক করতে করতে বলল, উঠবেন নাকি চলে যাব। প্রচুর বিজি আমি। বিয়ে নিয়ে।

পরীর চিৎকার করে ছেলেটিকে গালি দিতে ইচ্ছে হলো। ঘাড় মটকাতে ইচ্ছে হলো। ছেলেটার সব চুল কেটে কুচিকুচি করতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সে কোনোকিছুই করল না। রেহান পিছু না ফিরে,পরীর দিকে না তাকিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি উঠুন ম্যাডাম। সময় খুব কম। পরী নড়ল না। রেহান গুনল

ওয়ান,

টু,

ত্রি

ফোর

ফাইভ

সিক্স

ব্যস। পরী তাড়াহুড়ো করে উঠতে গেল। কিন্তু রেহান তার আগেই ছুটে গেল বহুদূরে। পরী ধপাস করে পড়ে গেল। আশেপাশের কয়েকজন তাকে দেখে অট্রহাসিতে ফেটে পড়ল। পরী রেগেমেগে বসে থাকল সেভাবে। উঠে বসার চেষ্টা করল না। নিজের চুল নিজে টানল। শপথ নিল,ওই ছেলেটার জীবন যদি সে ত্যানাত্যানা না বানিয়েছে তাহলে তার নাম পরী নয়।

____________

রাতে বিয়ে পড়ানোর কথা। দিনের বেলায় সব অনুষ্ঠান শেষ করে রাতে পরীকে তুলে দেওয়ার কথা ছিল। রিকের প্ল্যানমাফিক সব হচ্ছে। আত্মীয় স্বজনে ভরপুর হলো পুরো খান বাড়ি। পরী একটা শব্দ ও করেনি কারো সাথে। মনে মনে প্ল্যান করে রাখল,সে পালাবে সুযোগ ফেলে। কাউকে তাই হাত করতে হবে। মনে মনে মাহিদকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোথাও মাহিদের দেখা পাওয়া গেল না। রিক বারবার এসে শুধু পরীকে দেখে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে পরী চিৎকার করে কেঁদে উঠছে। পাপা বলে ডেকে বুকে ঝাপিয়ে পড়ছে। বিয়ে করবে না বলে জেদ করছে। কিন্তু না পরী তার কোনোটিই করছে না। চুপচাপ শান্ত। পরীকে গোল্ডেন কালারের চকচকে ঝলমলে পাথরের ভারী শাড়ি পড়ানো হলো। মাথায় মেরুন রঙের ঘোমটা পড়ানো হলো। সাজার পর যখন রিপ আর রিক দেখল তারা অবাক হয়ে দেখে হেসে দিল। পরী তাদের হাসি দেখে কিচ্ছু বলল না। রিপ বলল, পরী মায়ের বিয়ে। পরী মা আজ বলবে না বর নাই। নাই নাই।

পরী মাথা নিচু করে বসে থাকল। রিক তার পাশে গিয়ে বসল। বলল, পরীকে তো পরীর মতো লাগছে। ছোট্ট পরী আজ সত্যি সত্যি বউ সেজেছে। আজ মা চলে যাবে পাপাকে ছেড়ে।

পরী ফুঁপিয়ে উঠল কিন্তু তাকালো না রিকের দিকে। রিপ আসল। পরীকে একহাতে আগলে ধরে জড়িয়ে ধরল। বলল, পরী তো নিজের বাড়ি যাচ্ছে। তাই না? হেসে হেসে যাবে পরী। একটু ও কাঁদবে না তাইনা?

পরী রিপের দিকে তাকাল। বলল, কোনো বাড়িই আমার বাড়ি না। পরীর বাড়ি বলতে কিচ্ছু নেই। পরীর পাপা বলতে কিচ্ছু নেই।পরীর আপন বলতে কিচ্ছু নেই। কেউ পরীর আপন না। পরী কেউ হয়না তোমাদের। আমার চাওয়া পাওয়ার মূল্য নেই কারো কাছে। তাই আমি কিছুই আশা করিনা তোমাদের কাছ থেকে। তোমরা আমার সাথে কথা বলতে আসবে না। আমি চলে যাওয়ার সময় তোমরা কেউ আমার সামনে আসবেনা। মাম্মা ও যেন না আসে। আমি বোঝা হয়ে গেছি তোমাদের জন্য। আমাকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছে তোমাদের। তাই অন্যের কাঁধে আমাকে সামলানোর দায়িত্ব দিচ্ছ। আমি এতটাই উটঁকো যে আমাকে সরাতেই হবে। ছোটবেলা থেকেই আমি সবার জন্য বোঝাসরূপ। নাহলে নিজের জন্মদাতা জন্মদাত্রী আমাকে নিজেদের কাছে রাখেনি কেন? আমি সবার কাছে এতটাই বোঝা যে আমাকে কিছুদিন এখানে,কিছুদিন ওইখানে। কিছুদিন পর দেখা যাবে রেহান চৌধুরী ও ছুড়ে ফেলবে। সত্যি বলতে, এই আমার আপন বলতে কেউ নেই। আমি চিনে গেছি সবাইকে। সবাইকে চেনা হয়ে গেছে আমার।

রিক আর রিপ বিস্ময় চোখে চেয়ে রইল পরীর দিকে। কথাগুলো বড্ড তিক্ত। এমন কথা কি করে বলতে পারল পরী? তার বুক কাঁপেনি? পরী তার পাপাদের কাছে বোঝা?

রিক কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলল, আজ আমার ভুল ভেঙেছে পরী। তুমি যে কোনোদিনই আমাকে মন থেকে পাপা ডাকোনি সেটা তুমি আজ প্রমাণ করে দিলে। ঠিক আছে বিয়ে তোমাকে করতে হবে না। তোমার যেহেতু মনে হচ্ছে আমরা তোমাকে বোঝা মনে করে বিয়ে দিয়ে ফেলছি সেহেতু তোমাকে বিয়ে করতে হবেনা। আমি মানা করে দিয়ে আসি তাহলে। একটু কথা কাটাকাটি হবে ঠিক কিন্তু আহামরি কিছু হবেনা। পরের মেয়ের উপর নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার আমি কে?

রিক বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। রিপ অবাক হলো। পরীকে বলল, কি বলেছ এসব? পরী তোমার কি অন্য পছন্দ আছে???
পরী দুপাশে মাথা নাড়ায়। রিপ বলে, আমি যাচ্ছি। বড়দাকে আটকাতে হবে। তুমি বসো। আমি আসছি।
রিপ তাড়াহুড়ো করে চলে যায়। রিককে ডেকে বাইরে নিয়ে যায়। বলে, তুমি ও কি তোমার মেয়ের মতো পাগল হয়ে গেছ?
রিক বলল, ও আমার মেয়ে নয়। তুই শুনিস নি ও কি বলল?
রিপ মাথা চেপে ধরে দুপাশে। বলে,
‘ তুমি মাথা ঠান্ডা করো বড়দা। ওর জায়গায় নিজেকে ভেবে দেখো। ও ছোট মানুষ কতকিছু বলবে। রেহানের চাইতে ও ভালো অপশন যদি তোমার কাছে থাকে তাহলে বিয়ে ভেঙে দাও। যাও।
রিক বলল,
‘ নেই।
রিপ এবার ভাইয়ের সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়াল। বলল, তাহলে যা হচ্ছে তা হতে দাও। দেখবে পরী ঠিক একদিন না একদিন রেহানকে আপন করে নেবে। ইশা আদির উপর রাগটা কমে যাবে।

__________

কিছুক্ষণের মধ্যে বর এসেছে, বর এসেছে চিৎকারে মুখোরিত হলো পুরো বাড়ি। পরীর বুক ধুকপুক করে উঠল। সে ভালো করেই জানে পাপা বিয়ে ভাঙবে না। তার উপর রাগ দেখিয়ে বলেছে। সে রুমের বাইরে উঁকি দিল। কাউকে দেখা গেল না। পরী এই ফাঁকে ছাদে চলে গেল। ছাদ থেকে রেলিং ধরে নিচে তাকাল। কি করে নিচে নামা যায়। পরী দেখল ছাদের সাথে ঘেষে একটি সুপারি গাছ রয়েছে। কিন্তু তা কিছুটা নিচে। নামা সম্ভব নয় সেটা বেয়ে। পরীর মাথায় চিন্তা বাড়ল। পালাতে হবে তাকে এইমুহূর্তে। যেকরেই হোক। সে ভাবতেই পারছেনা বিয়েটা সত্যি সত্যি হচ্ছে। রেহান চৌধুরীর সাথে সে জড়িয়ে যাচ্ছে। চৌধুরী বাড়িতে তাকে পা রাখতে হবে আবার। সারাক্ষণ আদি,ইশা চৌধুরীর আশেপাশে থাকতে হবে। আর স্বপ্ন????
পরী দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো সে পালাবেই। মাথায় হাত দিয়ে এপাশওপাশ ঘুরতে লাগল সে। কি করা যায়? কি করা যায়?

রেহানকে এভাবে উপরে যেতে দেখে কেউ কেউ হাসি তামাশা করতে লাগল। কেউ কেউ বাঁকা চোখে তাকাল।

তিনা আর জুলির কথা কি সত্যি? পরী পালাতে চাইছে? রেহান অবাক। এই মেয়েটা কি করতে চাইছে? বিয়ে না করলে মত দিয়েছে কেন? এই মুহূর্তে এসে কি করতে চাইছে?
রেহান তাকে রুমে না পেয়ে সোজা ছাদের দিকে পা বাড়াল। পেয়ে ও গেল। ছাদের দরজা বন্ধ না করার মতো বোকা কাজ করায় পরীর নিজের উপর রাগ লাগল। সে আঙুল দেখিয়ে বলল,

‘ আমাকে ছুঁতে আসলেই ঝাঁপ দেব আমি বলে রাখলাম কিন্তু। রেহান এগোলো। পরী আর ও কয়েক পা পিছু হাঁটল। বলল, এগোচ্ছেন কেন? বললাম না ঝাঁপ দেব।

রেহান গম্ভীর চোখে চেয়ে রইল পরীর দিকে। একদম লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল পরীর কাছে। পরীর হাত ধরে টান দিল। বলল, পালাতে আমি সাহায্য করি?
পরী বিস্ময় নিয়ে তাকাল। বলল, সত্যি???

রেহান হাসল। বলল, এরকম মেয়েকে বিয়ে করতে কার মন চায়? পালাবে?

পরী মাথা নাড়ল। রেহান দরজা দেখিয়ে বলে, তাহলে চলো?

পরী বলল, ওদিকে কিভাবে??

রেহান বলল, যাবেনা?

পরী রেহানের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে দাঁড়াল। বলল, মিথ্যুক। যান এখান থেকে। আপনাকে বিয়ে করব না আমি। আমি তো রাগ করে বিয়ের সাজ সেজেছি। এই বিয়েটা কিছুতেই হওয়ার নয়। আমি করব না এই বিয়ে।

পরী দৌড় দিতে চাইল। ভারী শাড়ি গহনার জন্য পারল না। রেহান লম্বা মোটা রশি নিল ছাদঘর থেকে। রেলিং থাকা রডের সাথে রশি আটকে দিয়ে পরীকে দেখিয়ে দিয়ে বলে, যদি রশি বেয়ে নামতে পারো তাহলে চলে যাও। আর যদি না নামতে পারো তাহলে বিয়ে। মনে থাকবে। লেটস স্টার্ট।

পরী ভয়ে ভয়ে রশি হাতে নিল। নিচের দিকে তাকানোর সাথে সাথে কলিজা মোচড় দিল। বলল, আজকে মরলে মরব তারপর ও আমি আপনাকে বিয়ে করব না।

পরী রশি হাতে নিল একবার। ভয়ে আবার রেখে দিল। পেছনে রেহানকে দেখার সাথে সাথে আবার ও রশি হাতে নিল। রেলিং হাত দিয়ে ছোঁয়ার আগেই রেহান তার হাত ধরে হেঁচকা টান দিল। শাড়ির আঁচল টেনে ধরে তার হাতে পেঁচিয়ে নিল শক্ত করে। গিট মেরে দিল। হাতটা উপরে তুলে বলল, এবার যাও। আমাকে সহ নিয়ে যাও নয়ত শাড়ি খুলে যাও। কোনটা বেশি সম্মানজনক????

পরী বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল। রেগেমেগে গর্জে বলল, আই হেইট ইউ।

রেহান মৃদু হাসল। তবে নিঃশব্দে। বলল, আমি ও।

পরী বলল, মানে??

রেহান তার হাতটা তার দিকে টানল। পরী তার কিছুটা কাছে এল। রেহান দাঁতের সাথে দাঁত পিষে বলল, রেহান কি অতটাই সস্তা নাকি যে তোমাকে বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে? প্রস্তাব এই বাড়ি থেকেই গিয়েছে। তাই এখন তোমার হাতে বিয়ে ছাড়া অন্যকোনো স্কোপ নেই। থাকলে ও তা বিয়ের পর দেখা যাবে। তোমাকে আমি ছেড়ে দেব। তবে আজ না। আমার রেপুটেশনে স্পট পড়ে যাবে। আজ এই বাড়িতে আমার পুরো বন্ধুমহল। বেশিরভাগ ভক্তরা ও আছে। মিডিয়া আছে। তুমি আমার এতবড় ক্ষতি করতে পারোনা পরী। বিয়ে তোমাকে করতেই হবে। আই প্রমিজ, বিয়ের পর আমি তোমাকে ছেড়ে দেব। তুমি যা বলবে তাই হবে। যেখানে ইচ্ছে সেখানে থাকবে। আমি জোর কাটাবো না।
পরী রেহানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। বলল, এটা ও প্রমিজ করুন যে, আমার উপর কখনো স্বামীর অধিকার খাটানোর চেষ্টা করবেন না।
রেহান চেয়ে থাকল আলো আধারিতে পরীর মুখের দিকে। ব্যঙ্গ করে হেসে বলল, প্রমিজ।

_________

সবার মাঝখান থেকে মাহিদ পিহুকে ডাক দিল। বলল, ওই শাঁকচুন্নি তুই এভাবে আটা ময়দা কেন মেখেছিস রে? তোকে দেখতে কেমন লাগছে । ইয়াক,,
পিহু মুখ মোঁচড়াল। বলল, তুমি দেখছ কেন?
মাহিদ পিহুর দিকে স্প্রে ছুড়ে মারল। বলল, ধুরর শালী তুই আমার মাথা গরম করিস শুধু শুধু।
পিহু বলল, কি করেছি আমি। কিচ্ছু করিনি। উল্টাপাল্টা বকবে না। তোমার মতো ছেলের সাথে আমার কোনোকথা নাই। লম্পট ছেলে একটা।

মাহিদের চেপে রাখা রাগ এবার ফুঁসে উঠল। বলল, এই কে লম্পট। তুই আমার চাইতে ও বেশি লম্পট।
আনিসাকে চিঠিতে উল্টাপাল্টা কি লিখে দিয়েছিস, আমি কি আগে এগুলো লিখেছিলাম? নিহার চিঠিতে ও এসব কি লিখে দিয়েছিস? তোকে তো আমি হাতেনাতে ধরছি। তুই চাইছিসটা কি হারামি? তুই আমার দেওয়া চিঠিগুলো না দিয়ে তুই কি উল্টাপাল্টা লিখে দিয়েছিস?
পিহু ভয়ে আতঁকে উঠল। এই ছেলেটা হাসতে হাসতে তাকে কতবড় বাঁশ দিল। পিহু ভয়ে ভয়ে কেটে পড়ার আগেই মাহিদ তার হাত ধরে টেনে বের করল বাড়ি থেকে। পিহু হাত ছাড়ানোর জন্য জোরাজুরি করতেই মাহিদ কষে চড় বসাল তার গালে। চোখেমুখে তীব্র ঘৃণ্যতা ছুড়ে বলল, তুই আমার সাথে আর জীবনে ও কথা বলবি না আরিশ। আমি তোকে ঘৃনা করি। তুই বিশ্বাসঘাতক। আমি এরকম বিশ্বাসসঘাতকগুলোকে ঘৃণা করি। যাহ আমার সামনে থেকে। দূর হ।

চলবে,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here