#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৭ (সিজন ২)
#পুষ্পিতা_প্রিমা
ইশা আর রাইনা সবার আগে বাড়ি পৌঁছাল। বরণ করার জন্য নানারকম মিষ্টান্নের আয়োজন করল। যখন পরী রেহান গাড়ি থেকে নামল ইশা আর রাইনা সহ অনেকে নতুন বউ বরণ করে নেওয়ার জন্য ছুটে এল। পরী আড়চোখে তাকাল ইশার দিকে। হাসিখুশি ইশা চামচে করে মিষ্টি বাড়িয়ে দেয় পরীর দিকে। বলে,
‘ এ বাড়ির বউ হয়ে এসেছ পরী । নাও মিষ্টি মুখ করো।
পরী মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। মিষ্টি মুখে নেয় না। ইশার মুখের ভঙ্গি পাল্টে যায়। অন্ধকার নেমে আসে। রেহান খেয়াল করে। সে ইশার হাতে থাকা চামচের মিষ্টিটুকু খেয়ে নেয় । বলে,
‘ কাকিয়া ঝাল কিছুর আয়োজন করলে বেশ ভালো হত। ঝাল মানুষ মিষ্টি হজম করতে পারবে না।
পরী ফুলে উঠল। নাক কেঁপে কেঁপে উঠল তার। রাইনা চোখ রাঙাল রেহানকে। রেহান চুপ হয়ে গেল।
ইশার হাসি পেল রেহানের কথা শুনে। এই ছেলেটার কপালে খুব খারাপ কিছু আছে। পরী ইশার ঠোঁটের কোণায় হাসি দেখে আর ও রেগে গেল।
ইশা বরণ ডালা হাতে নিতেই পরী হাত দিয়ে তা ঠেলে দেয়। নিজেই নিজেই প্রবেশ করে চৌধুরী বাড়িতে। বলে,
‘ এটা তো আমার বাড়ি। এই বাড়ির টুয়েন্টি ফাইভ পারসেন্ট অংশীদার আমি। রেহান চৌধুরী আমাকে বিয়ে করেছেন,তার ফিফটি পারসেন্টের সাথে আমার টুয়েন্টি ফাইভ পারসেন্ট যাতে প্লাস হয়। অ্যাম আই রাইট মিঃ রেহান চৌধুরী?
বাড়িসুদ্ধ সবাই হতবাক হয়ে যায় পরীর কথায়। হাসিহাসি মুখটা হঠাৎই বিস্ময়ে পরিণত হয় রেহানের। কপালে ভাঁজ পড়ে যায় তার। আফি রেগে তাকায় রেহানের দিকে। রেহান তাকায় রাইনার দিকে। রাইনা পরীর সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে, পরী এসব কি বলছ তুমি? কে বলেছে তোমায় এসব কথা? এসব কথা উঠছেই বা কেন??
ইশা পরিস্থিতি গুমোট দেখে আদিকে ডেকে বলে ডক্টর মাহিদ এসেছে না? ও কোথায়? আসতে বলুন।
আদি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। পিহু বলে, বউয়ের সাথে আর ও একটা বউ ফ্রি এসেছে। তাকে ও অ্যাপায়ন করো মাম্মা।
মাহিদ ভ্রুকুঞ্চন করে তাকাল পিহুর দিকে। বলল,
‘ ওই তোর কি আমারে দেইখ্যা বউ বউ লাগতাছে? উল্টাপাল্টা কথা কস ক্যান বাপ?
পিহু অন্যদিকে মুখে করে রেখে বলে, ছিঃ ছিঃ ছোট মামা তোমাকে এভাবে কথা বলতে শুনলে এখন কি করত সেটা ভাবতেই ভয়ে আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।
মাহিদ ঠোঁট উল্টে বলে , যাহ। সর এইখ্যান থ্যাইকা। ভ্যা ভ্যা করিস না তো। তোর ভ্যা ভ্যা শোনার লাইগ্যা আমি এইখানে আসিনাই। আমি এখন মেহমান। সম্মান দিয়া কথা কহ। সাইড দে। সর।
পিহু মুখ মোচড় দেয়। বাকিরা অনিচ্ছাকৃত হেসে দেয় পিহু আর মাহিদের কথা শুনে। রেহান অগ্নিবর্ণ চোখে চেয়ে থাকে পরীর দিকে। পরী বাঁকা হাসে। তারপর সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। কিছুদূর এগিয়ে আবার পিছু ফিরে মাহিদকে ডাকে। বলে,
‘ মাহি আয় আমার সাথে। ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি করবি? উনারা একটু আমাকে নিয়ে সমালোচনা সেড়ে নিক,তুই একটু সুযোগ করে দে।
মাহিদ সবার দিকে একবার তাকায়। আবার পরীর দিকে তাকায়। বলে, আমার হিসাব বাকি আছে এই ডাক্তারের বাচ্চির সাথে।
মাহিদের সাথে সাথে ইশা ও জিভে কামর দিয়ে রাখে। আদি তার দিকে গম্ভীর দৃষ্টি তাকিয়ে। ইশা জিভে কামর দেওয়া অবস্থায় তাকায়। পিহু আদি আর ইশার দিকে তাকিয়ে খিক করে হেসে দেয়। মাহিদ তাড়াহুড়ো করে পরীর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে, দিদিয়া চলো চলো।
ইশা মাহিদের কান্ড দেখে বলে,
‘ রিপদার এরকম বিচ্ছু ছেলে কি করে হলো? মাইর ও তো কম খাইনা।
ইশা ঘাড় ঘুরিয়ে আবার আদির দিকে তাকায়। আদি ভ্রুকুঞ্চন করে তাকিয়ে আছে ইশার দিকে। খানিকক্ষণ সময় নিয়ে বলে, তুমি দেখেছ মাহি আবার ও আমাকে টেনেই গালি দিচ্ছে।
ইশা হাতে থাকা প্লেটটা থেকে একটি মিষ্টি নিয়ে টুপ করে আদির গালে পুড়ে দেয়। হাসতে হাসতে বলে,
‘ এইগুলা কোনো ব্যাপার না ডাক্তারসাহেব। ও ডাক্তারের বাচ্চিকে গালি দিচ্ছে,ডাক্তারকে নয়।
আদি গাল থেকে মিষ্টি ফেলে দিল। বলল, আই হেইট সুইটস। আমার মেয়েকে গালি দেওয়া যেই, আমাকে গালি দেওয়া একি কথা।
ইশা চোখ বড় বড় করে তাকাল। বলল, কি বলেছেন? আপনি মিষ্টি,,,,,,???
আদি তাড়াতাড়ি বলল, না না তুমি মিষ্টিকে বলিনি। এই খাবার মিষ্টিকে বলেছি।
ইশা গাল ফুলিয়ে রাখল। রেহান আর পিহু একসাথে হেসে উঠল। দুইজন চলে যেতেই আদি ইশার পিছু হেঁটে হেঁটে উপরে উঠতে উঠতে বলে,
‘ এই মিষ্টিকে আমি খুব ভালোবাসি। ওই খাবার মিষ্টিকে না।
ইশা কোনোরূপ কথা না বলে উপরে উঠতে থাকে। আদি ইশার হাতে থাকা প্লেট থেকে স্বেচ্ছায় একটি মিষ্টি তুলে খেতে খেতে বলে,
‘ এই খাবার মিষ্টিকে আমি বেশি ভালোবাসি মানুষ মিষ্টির চাইতে ও। এবার খুশি??
ইশা এবার থমকে দাঁড়ায়। আবার হাঁটা ধরে। এক পা এক পা হেঁটে রুমে ডুকে টেবিলের উপর দুম করে রাখে প্লেটটা। আদি অসহায় মুখে বলে,
‘ আরেহ এত রাগ কেন? কি বললে খুশি হবে?
ইশা মনে মনে হাসে। পাগল ডাক্তার কিছু বুঝেও না।
আদি ইশাকে টেনে ধরে। দু হাতের বাহু বন্ধনী দিয়ে পিষ্ট করে বলে, মাইর চলবে মিষ্টি। প্রচুর মাইর। তুমি আমাকে প্রচুর জ্বালাও। এখন তোমার বজ্জাত মেয়ে ও চলে এসেছে। দুইজনই জ্বালিয়ে মারবে দেখতে পাচ্ছি।
_______________
মাহিদ পিহুকে চেঁচিয়ে ডাকল। কয়েকটা মেয়ের সাথে হেসেখেলে পিহু আসল। বলল, এটা বিয়ে বাড়ি। আমার নামটা সুন্দর করে ডাকবে। বিদ্রূপ করে তোমার বউকে ডেকো। মাহির রেগে তাকাল। পিহুর পাশে মেয়ে দুই তিনজন হাসাহাসি করতে লাগল। মাহিদ বলল,
‘ হেইইই চোপপ । এত হাসাহাসি কিসের? আমারে দেইখ্যা কি জোকার মনে হয়? দাঁত বত্রিশ পাটি দেখিয়ে হাইস্যা আমারে পটাইতে চাইতাছো? এগুলো হবেনা মামা। মাহিদ পটে না। মাহিদ পটায়।
পিহু হা করে তাকিয়ে থাকে। বলে,
‘ তুমি কি অসভ্য মাহিদ ভাই। সারাক্ষণ শুধু পটানোর তালে থাকো। তোমার মুখে আর কোনো কথা নাই।
মাহিদ ধমক দিল।
‘ একদম চোপ। তুই এত ফটরফটর করিস ক্যান বাপ? আমি কি তোরে কইছি? তোর এত জ্বলে কেন? আর মুখে মুখে কথা ফিরায় দেস ক্যান? বেয়াদবি শিখছস? বড় ছোট মান্যিগন্যি নাই তোর। আমার সামনে কথা কইবি মাথা নিচু কইরা। আমি তোর বড় ভাই।
পিহু জিহ্বা দেখিয়ে ব্যঙ্গ করে বলে, হুহহহ ভলো ভাইইই। কচুর ভাই।
মাহিদ চটাস করে চড় মারল পিহুর মাথায়। বলল, হারামির বাচ্চি একদম চুপপ থাক। এত মাইর কেমনে খাস বাপ? তোর মা বাপে ও তো তোরে এত মাইর দেইনায়। তুই বাপ আমার সামনে থ্যাইকা যাহ। তোরে দেখলে খালি মারবার মন চায়। যাহ। যাহ।
পিহু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। পাছে কেউ শুনে ফেলে সেই ভয়ে জোরে কাঁদেনা। মাথার পাশে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
‘ আমি কোনদিক দিয়ে তোমার বাপ লাগি মাহিদ ভাই? সারাক্ষণ বাপ বাপ করো কেন? ছোট মামাকে ও তো কখনো এমন বাপ ডাকতে শুনিনি।
মাহিদ পিহুর হাত ধরে ঠেলে সরিয়ে দিল তার সামনে থেকে। বলল, তুই যাহ না রে বাপ। মাথা গরম করিস ক্যান। তুই শালীরে আমি শ্বশুড়বাড়ি পাঠামু। তোর টাকওয়ালা জামাইরে কমু, এই বান্দিরে বাইন্দা রাখ বাপ। কলিজার ভেতর ডুকায় রাখ। আমি পাইলে তোর ও খবর আছে। তোর সোহাগের বউয়ের ও খবর আছে।
পিহু কান্না ভুলে লজ্জা পেয়ে যায়। মাথা নিচু করে কাঁদতে কাঁদতে খিক করে হেসে দেয়। চোখে জল ঠোঁটে হাসি। মাহিদ ঘাড় ঘুরিয়ে পিহুকে সেই অবস্থায় দেখে আর ও রেগে যায়। ধমকে বলে,
‘ ওইই তুই এখন না কাঁদছিলি আবার হাসোস ক্যান বাপ?
পিহু কাঁদতে চাই। কিন্তু কান্নার বদলে খিক করে হাসি চলে আসে। মাহিদ বলে,
‘ ওই তোর চোখে জল, ঠোঁটে হাসি কেন বাপ? তুই হাসোস ক্যান কইতাছি? তুই হাসলে হাস। না হলে শুধু কাঁদ। কতক্ষণ হাসোস আবার কতক্ষণ কাঁদোস? তুই আমার মাথা গরম কইরা দিতাছস। আমার মাথা হেব্বি গরম হইতাছে। তুই যাহ না। ওরেব্বাপ, যাহ না।
মেয়ে তিনটা অনেক আগেই পালিয়েছে। পিহু আর ও একটি মাইর খাওয়ার আগে দৌড়ে পালিয়ে যায়। মাহিদ চেঁচিয়ে ডাকে,ইশাকে। ফুপী ও ফুপী????
ইশা যখন আওয়াজ করল না । মাহিদ ডাকল,
‘ ডাক্তারের বউ কোথায়? ডাকছি না? ধুরর সব্বাই কি পটল তুলতে গেছে???
ইশা তড়িঘড়ি করে নেমে আসল। বলল, কি হয়েছে মাহি?
মাহিদ সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল, আমার মাথা গরম হয়ে গেছে ফুপী। তোমার ছেড়িডা খালি আমার মাথা গরম করে।
ইশা হেসে দেয় কিন্তু মাহিদকে তা দেখায় না। বলে, কেন পিহু কি করেছে? এখন কি করলে মাথা ঠান্ডা হবে?
মাহিদ ইশার হাত তার মাথায় লাগায় বলে,
‘ এই দেখ, মাথা দিয়ে গরম গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে।
ইশা ও তাল মিলায়।
‘ হ্যা তাইতো।
মাহিদ ইশার হাত তার কানে লাগায়। বলে,
‘ এই দেখ কান দিয়ে ও গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে।
ইশা অবাক হওয়ার মতো চোখ বড় বড় করে বলে,
‘ হ্যা তাইতো। এখন কি করতে হবে?
মাহিদ সাথে সাথে তার মাথায় ঠান্ডা কিছু অনুভব করতে পারল। রেহানকে দেখে ইশা হেসে দিল। রেহান হেসে বলল,
‘ আইসপ্যাক। বউয়ের ও মাথা গরম। এদিকে শালার ও মাথা গরম। সবার মাথা গরম হলে কি করে চলবে????
মাহিদ মাথায় আইসপ্যাক দিয়ে বসে থাকল সোফায়। হুট করে চোখ গেল উপরে। সিড়ির রেলিং ধরে হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে পিহু। মুখ মোচড় দিল মাহিদ তাকানোর সাথে সাথে । মাহিদ আইসপ্যাক ছুড়ে মারল আচমকা। গর্জে বলল,
‘ ওরেব্বাপপপ,,, তুই আমার সাথে কি লাগাইছিস? তোরে আমি জবাই করুম ডাক্তারের বাচ্চি।
পিহু হেসে দিল। বলল, পাগল একটা। ভাষা দেখো কত জঘন্য?? তুমি ব্যারিস্টারের বাচ্চা না???
ইশা আর রেহান উপরে তাকাল। পিহুকে দেখার সাথে সাথে ইশা চোখ রাঙাল।
‘ এই মেয়েটাকে দেখছি মাহিদ এমনি মারে না। সরে সরে না থেকে আর ও মাহিদের আশেপাশে ঘুরঘুর ঘুরঘুর করে। মাহিদ মারবে না তো কি করবে। ডক্টর নিজের মেয়ের দোষ দেখে না??
পিহু আরেকদফা তার লম্বা জিহ্বাটা দেখিয়ে দেয় মাহিদকে। হেসে হেসে চলে যায়।
মাহিদ পিহুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, তোর বাড়িতে আইছি বইল্যা দেমাক দেখাস? তুই এই বাড়ি থেকে বাইর হ। দেইখ্যা লস আমি কি করি?
_______________
রাইনার ভাইয়ের তিন মেয়ে রেহানকে দাঁড় করিয়ে রাখল রুমের সামনে। দরজার সামনে তারা দাঁড়িয়ে থাকল। পিহু লজ্জায় আগে আগে কেটে পড়ল। রেহান অভাগার মতো দাঁড়িয়ে থাকল দরজার সামনে। পেছনে দুহাত দিয়ে সাহেবের মতো দাঁড়াল। হাতের আঙুল দিয়ে কান চুলকে বলল,
‘ কি চাই??
রিনা,লিনা,মিনা একসাথে হাত বাড়িয়ে সমস্বরে বলে উঠল,
‘ আগে টাকা তারপর ভেতরে যেতে পারবে। তার আগে নয়। এত কিপ্টামি না করে চুপচাপ বের করো।
রেহান এদিকওদিক তাকাল। রিনা বলে উঠল,
‘ এদিকওদিক তাকিয়ে লাভ নেই। ফুপী,ইশা আন্টি কেউ আর এদিকে আসবেনা। মেয়েগুলোর পেছনে এসে দাঁড়াল পরী। গলা উঁচিয়ে কি হচ্ছে দেখার চেষ্টা করল। রেহান অগত্যা টাকা বের করে দিল। বলল, টাকাগুলো চুরি হলে আমার দোষ দিবিনা।
মেয়েগুলো হেসে চলে গেল। রেহান তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাঁফ নিঃশ্বাস ছাড়ল। আজ মাহিদ ব্যাটা তার বন্ধুরাসহ তার পকেট খালি করে ছাড়ল। আর এখন এই বিচ্চুগুলো। অসহ্য।
রেহান ঘাড় ঘুরাতেই খুব পরিচিত মুখটার সাথে দেখা। বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে মুখ বের করে তাকিয়ে আছে পরী। ভ্রু উঁচিয়ে রেহানকে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি চাই?
রেহানের ভ্রুকুঞ্চন হলো। সে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে বলল,
‘ বউউউউ।
পরী আওয়াজ করে হেসে দিল। রেহান দরজায় হাত দিলে পরী আর জোরে চেপে ধরে বলে,
‘ এইটা আমার ঘর। আপনি আপনার পথ দেখুন।
রেহানের কপালে ভাঁজ পড়ল। এই নাটকগুলো দেখতে তার মোটেও ভালো লাগছেনা। রেহান দরজা ঠেলল,বলল
‘ আমি ইয়ার্কির মুডে নেই পরী। সরো, আমার ঘুম পাচ্ছে। পরী আওয়াজ করে হেসে দিল।
বলল,
‘ বাসর রাতে কেউ ঘুমোয় নাকি? হাসালেন।
রেহান দরজা আবার ঠেলল। বলল,
‘ পথ ছাড়ো পরী। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে আমার। সারাদিন আমি একটু রেস্ট নিতে পারিনি।
পরী আওয়াজ করে আবার হেসে উঠল। ডুকতে দিল রেহানকে। রেহান কিছু বুঝে উঠার আগে পরী বের হয়ে এল। খট করে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর দরজায় মুখ লাগিয়ে বলল,
‘ গুড নাইট মিঃ চৌধুরী। আপনি ঘুমোন। টা টা।
রেহান চিৎকার করে ডাকে।
‘ পরী কোথায় যাচ্ছ??
পরী খিলখিল করে হাসে। বলে,
‘ জাহান্নামে। আপনি যাবেন?
রেহান বলল,
‘ আমি চিৎকার করে কাকিয়াকে ডাকব। তাড়াতাড়ি দরজা খোলো। মেহমান আছে।
পরী মুখ মোচড় দিল। বলল,
‘ চুপ করেন তো। আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমি শুধু এই ঘরে থাকব না। আপনার সাথে বাসর করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।
রেহান চিৎকার করে ডাকল,
‘ পিহু। মাহিদ। তাড়াতাড়ি এসো।
পরী কারো আসার আওয়াজ পেয়ে খট করে দরজা খুলে রুমে ডুকে পড়ে। ধাক্কা দেয় রেহানকে। কোমরে হাত দিয়ে বলে,
‘ আপনি কি পাগল? এভাবে কেউ চিল্লায়। চিল্লিয়ে কি প্রমাণ করতে চাইছেন? বাসর রাতে বউ আপনাকে টর্চার করছে?
রেহান একগাল হাসল। বলল, তুমি আমাকে টর্চার করতে পারবে? জীবনে ও তো না।
পরী ফুঁসে উঠল।
‘ হয়েছে? ডং করিয়েন না। আমার লাইফটা পুরো হেল করে দিলেন। আপনাকে আমি ছাড়ব না। মেরে ফেলব।
রেহান বিজ্ঞদের মতো বলল,
‘ আমি তোমার অনেক বড়। রেসপেক্ট দিয়ে কথা বলো।
পরী মুখ ভাঙাল। বলল,
‘ তো বুড়া হয়ছেন বুড়া বউ বিয়ে করতেন। আমাকে কেন করেছেন? লোভী?
রেহান আর ও একগাল হাসল। বলল, না না এই বউটাকে ছোট থেকে পছন্দ করি। সে থাকতে বুড়া বউ কেন বিয়ে করব?
পরী বলল,
‘ হুহহ, ছোত থেকে পদন্ত করি। ডংয়ের শেষ নেই। আমি আপনাকে কখনো দেখিইনি।
রেহান হো হো করে হাসল। বলল, তুমিই সেই মেয়ে যে বলতো, নেআন মাববো। আমার কত চুল ছিড়েছ তুমি। কত কামর দিয়েছ। আজ সেগুলোর শোধ তুলব।
পরী ভয় পেয়ে গেল। এই ছেলেটা চূড়ান্ত অসভ্য। পরী বলল,
‘ শোধ তুলবেন মানে কি? আমি কোন দুঃখে আপনাকে কামড়াতে যাব? মিথ্যে কথা বলবেন না। আমি ঘুমোবো সরেন। আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না।
রেহান পেছনে হাত দিয়ে হেঁটে হেঁটে বলল,
‘ আহঃ ফুলের কি সুগন্ধ! শালার এই বাসর ঘরে ডোকার জন্য পকেট খালি করতে হলো। আর সেখানে বউ এরকম করলে ভালো লাগে নাকি?
পরী বলল,
‘ আমি চেন্জ করব। আপনি বাইরে যান। আমি এসব ভারী শাড়ি আর সামলাতে পারছিনা।
রেহান বলল,
‘ আমি কোন দুঃখে বাইরে যাব? চেন্জ করার কি দরকার? আর করতেই হলে এখানে করো।
পরী রেগে গেল। বিছানার চাদর একটান দিল। সব ফুল টুল ঝেড়ে ফেলে দিল। বলল, আপনি এক্ষুণি বের হন। নাহলে আমি চিৎকার করব।
রেহান অবাক হলো। পরীর একহাত শক্ত করে ধরে টান দিল। পরী এসে পড়ল তার বুকের উপর। পরী চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল। নাকের নথে টান পড়ায় ব্যাথা পেল। বলল, বেয়াদব, অসভ্য লোক।
রেহান একগাল হাসল। বলল, আজ রাতটাই চরম অসভ্য। যা কথা হবে চরম অশ্লীল হবে। যা কাজ হবে, তা ও চরম অশ্লীল হবে।
পরী রেহানকে ঠেলে দিল। বলল, বেয়াদব লোক কোথাকার। আমাকে ছুঁলে ও খবর আছে। আপনি বলেছিলেন যে আমার উপর অধিকার দেখাতে আসবেন না। ভুলে গিয়েছেন না?
রেহান মুখের ভঙ্গি পাল্টে বলল,
‘ কখন বলেছি? যাহ আমি কেন এমন কথা বলব? সত্যি বলেছি? কখন বলেছি?
রেহানের ভনিতা দেখে পরীর আর ও রাগ হলো। সে ঝরঝর করে কেঁদে দিল। নাকের ডগা লাল হয়ে এল। চোখদুটো ও লাল হয়ে এল। রেহান হেসে বলল, ‘ উফফ বউটা কি রাগী? কি সুন্দর? নেআনের বউ পরী।
পরী আর ও জোরে কাঁদল। বলল, বেয়াদব।
রেহান পরীর কান্নার সাথে তাল মিলিয়ে আর ও জোরে হাসল। চাদর বিছিয়ে দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে বলল,
‘ গুড নাইট মিসেস চৌধুরী। প্রচুর টায়ার্ড আমি। আপনার আদর লাগলে কাল বলবেন। কাল দিতে কিপ্টামি করব না। আজকে দিতে বললে ও দেব না।
পরী রেগেমেগে তেড়ে যায় রেহানের দিকে। বালিশ হাতে নিয়ে রেহানের মুখ বরাবর চেপে ধরে বলে,
‘ আমি চুপ করতে বলেছি। এসব কথা আমার সহ্য হচ্ছে না।
রেহান বালিশ সরানোর জন্য যুদ্ধ করে। পরী আর ও চেপে ধরে বলে,
‘ মেরে ফেলব বলেছি না। একদম মাটির নিচে ডুকিয়ে দেব।
রেহান আচমকা পরীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। পরী চোখবন্ধ করে ফেলে বলে, ছুঁলে একদম মেরে ফেলব। রেহান হাঁপাতে হাঁপাতে পরীর মুখের উপর শ্বাস ছাড়ে। ধমক দিয়ে বলে,
‘ কেউ এমনটা করে? আমার মা সন্তানহারা হতো। বউ বিধবা হতো। কি করছিলে তুমি?
পরী রেহানের কথা কানে না নিয়ে বলে,
‘ আপনি সরুন। আমার দমবন্ধ লাগছে।
রেহান ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পেরে হো হো করে হাসে। বলে, সরব কেন? পাখি নিজ থেকেই খাঁচায় ডুকে পড়েছে। ছাড়ার প্রশ্নই আসেনা।
পরী ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলে, আপনাকে মেরে আমি জেলে যাব। রিইই আছে না আমাকে ছেড়ে আনবে। আপনি চরম অসভ্য একটা লোক। আমাকে ছুঁলে আমি আপনাকে মারব নয়ত নিজে নিজে মরব। সরুন।
রেহান হা হু করে হেসে বলল,
‘ এখনো ছোঁয়ার কথা বলছ? ছুঁয়ে তো ফেলেছি। এখন মেরে ফেল, মরে যাও। আমি তার আগে একটু আদর দেই। আসো। আসো।
পরী এলোমেলো সুরে কেঁদে ফেলে। বলে, ইনননননা।
রেহান পরীর নাকের নথটা খুলে দিয়ে টুপ করে চুমু বসায় নাকের ডগায়। বলে, রাগী বউটা।
পরী চোখবন্ধ করে কাঁদে। নাকের ডগা হাত দিয়ে ঘষে দেয়। বলে, মেরে ফেলব।
রেহান হেসে বলে, না না হচ্ছেনা। বলো মাববো। আরেহ ছোটবেলায় কত আদর করেছি এই মুটুনিকে। তখন তো খিলখিল করে হাসত। ইশ কত ভালো ছিল সে।
পরী রেগে গেল। কান্নার মাঝে বলল, আমি মুটুনি? আমাকে মুটুনি বলেছেন?
রেহান বলল,
‘ ছোটবেলার কথা বলছি। ছোটবেলায় ইয়া মোটা ছিলে, আর আমার কোলে নিতে কেয়ামত হতো। কি ভারী বাপরে বাপ।
পরীর নাক কেঁপে কেঁপে উঠল। বলল, আমি সত্যি সত্যি মেরে ফেলব আপনাকে। আপনি মজা নিচ্ছেন?
রেহান হেসে দিল। ব্যঙ্গ করে আবার ডাকল, ‘ ‘ মুটুনিটা এখন বউ।
_________________
পিহু মাথার দুপাশে দুই বেণী করল। গায়ে লাল রঙের টপস। মাথার দুপাশের বেণি নাড়তে উপর থেকে উঁকি দিল নিচে। কেউ একজনের গায়ে মেরুন রঙের শার্ট দেখল। পা টিপে টিপে আবার রুমে গেল। মেরুন রঙের জামা গায়ে দিল। আয়নায় নিজেকে দেখে দেখে হাসল। বলল,
‘ মাহিদ ভাইয়ের চাইতে আমাকে বেশি সুন্দর লাগছে। হুহহ।
পিহু নিচে নেমে এল। বৌভাতের আয়োজন চলছে। মাহিদ সোফায় শুয়ে শুয়ে গেমস খেলছে। পিহুর রাগ লাগল। এই ব্যাটা তাকিয়ে সুন্দর লাগছে বলে না কেন? ধুরর।
পিহু বেণী দুটো নাড়তে নাড়তে ডাকল, মাহিদ ভাই।
মাহিদ কথা বলল না। গেমসে মগ্ন সে। পিহু আবার ডাকল, মাহিদ ভাই।
মাহিদ মারেবাপরে গালি দিয়ে বলে উঠে, এই তুই ডাক্তারের বাচ্চির সমস্যা কি? নষ্ট কইরা দিলি সব।
পিহু মুখ মোচড় দিল। মাহিদ ঠাসস করে মারল পিহুর মাথায়। বলল, তুই বাপ আমার সামনে আইস্যা ডং করতাছোস ক্যান?
পিহু মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, এভাবে তোমার বউকে মারলে তোমার বউ পালায় যাবে একরাতে।
মাহিদ হাত চুলকাতে চুলকাতে বলল,
‘ লাগত না অমন বউ। মাইর খায়, থাকলে থাকবে। না থাকলে নাই।
পিহু ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, আমি ছাড়া কেউ সইবে না তোমার এত অত্যাচার।
মাহিদ ও পিহুর মতো ঠোঁট উল্টালো। বলল,
‘ তোর ফালতু কথা শোনার টাইম নাইরে বাপ। যাহ দূরে গিয়া খাঁড়া।
ইশা এসে বলে, আবার ঝগড়া হচ্ছে? এত ঝগড়া কি নিয়ে হয়?
মাহিদ বলল, ‘ তোমার এই ছেড়িডারে বিয়া কবে দিবা ফুপী? এই হারামিরে বিয়া দিমু টাকাওয়ালারে। আমি তোরে কঠিন শাস্তি দিমু বাপ। কিল্লাই আমার সাথে লাগতে আসোস তুই। তোর মাইর খাইতে ভালালাগে।
পিহু রেগে বলল, আমি বিয়ে করব না মাহিদ ভাই। উল্টাপাল্টা কথা বলবে না।
মাহিদ ব্যঙ্গ করে বলল,
‘ একশবার বলব। আমার সামনে থেকে যাহ। কয়বার বলছি আমার সামনে আসবি না। তোরে দেখলেই আমার খালি মারতে মন চাই। তারপর ও তুই আসোস।
পিহু মুখ ফুলিয়ে রাখে। ইশা হেসে দেয়। বলে, মাহি তো ঠিকই বলেছে। তুমি ওর সামনে আসবে না। সরে সরে থাকবে। তাহলে আর ঝগড়া ও হবেনা।
মাহিদ আবার সোফায় শুয়ে পড়ল। পিহু রেগেমেগে জামাটি পাল্টে আসল। মাহিদ দেখে বলল, ওই তুই এত ঘনঘন কাপড় পাল্টাস ক্যান? তোর কাপড় বেশি সেগুলো সবাইকে দেখাইতাছোস?
পিহু মুখ গোমড়া করে রাখল। বলল, আমি তোমার সাথে কথা বলিনা মাহিদ ভাই।
মাহিদ আবার গেমসে মন দিল।
কিছুক্ষণ পার হতে না হতেই পিহু এবার হনহন পায়ে হেঁটে চলে গেল মাহিদের সামনে থেকে। মাহিদ দেখলই না। পিহু আর মাহিদের সামনে আসেনি। ইচ্ছে করে আসেনি। মাহিদ ও পিহুকে খোঁজেনি।
বৌভাতের অনুষ্ঠানে পরীকে সাজগোছ করাতে ঝামেলা পোহাতে হলো ইশা আর রাইনার। পরী সেজেগুজে আয়নার সামনে দাঁড়াল। ইশা সুন্দর করে ঘোমটা পড়িয়ে দিল। পরী কেন যেন আজ ইশার সাথে কোনো উচ্চবাচ্য করল না। ইশা ঘোমটা পড়িয়ে দিয়ে আয়নায় পরীকে দেখে বলল,
‘ পরী। ওয়াহ না????
পরী ছলছল চোখে তাকাল ইশার দিকে। আজ অবুঝ অবচেতন পরীর মনটা খুব করে চাইল আমমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু খোলস ভাঙেনা। ইশা টের পায় পরীর নীরব আর্তনাদ। মা তো।
ইশার কন্ঠ এতটাই বসে যায় যে কোনোকথা সে উচ্চারণ করতে পারেনা। তারপর ও অনেক কষ্টেসৃষ্টে বলে,
‘ আমার ইচ্ছে পূরণ হলো। পরীকে আজ আমি নিজ হাতে সাজিয়েছি। আমার মেয়েকে ঘোমটা পড়িয়েছি নিজ হাতে। পরীকে বউ সাজিয়েছি। আমমা ডাক শোনার কি একটু সৌভাগ্য হবে আজ???
পরীর দুচোখ টলমল করে উঠল। সে শক্ত করে জবাব দিল, নাআআ।
ইশার চোখের জল গড়াল সাথে সাথেই। সাথে পরীর ও। কিন্তু পরী সাথে সাথে তা লুকোয়। বলে, আপনি চলে যান। আমি একটু একা থাকব।
রেহান আসল। বলল, মা ডাকো নয়ত আমি যেভাবে কাকিয়া ডাকি সেভাবে ডাকো।
পরী ত্যাড়া জবাব দিল। কোনোটাই ডাকব না।
রেহান বলল, তাহলে আমি ও আমার কথা রাখব না। প্ল্যান ক্যান্সেল।
পরী সাথে সাথেই ডাকল, কাকিয়া। হয়েছে???
ইশা ডুকরে কেঁদে দিল সাথে সাথেই। তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। রুমে ডুকে দরজা বন্ধ করে কেঁদে উঠতেই না উঠতেই দেখল আদি হাতে কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনে।
‘ কি হয়েছে বলার সাথে ইশা ঝাপিয়ে পড়ল আদির বুকে। হু হু করে কেঁদে বলল,
‘ ডক্টর পরীইইইই,,,,
আদি বলল,
‘ কি হয়েছে? পরী কি বলেছে? কি করেছে? এভাবে কেন কাঁদছ মিষ্টি??
ইশা আর ও জোরে আওয়াজ করে কেঁদে দিল। ইশা বলল,
‘ আমার কেন এত কষ্ট হচ্ছে ডক্টর? মনে হচ্ছে আমি মারা যাচ্ছি। আমি পরীর মুখে ওই ডাক শুনতে পারব না ডক্টর।
আদি কিছুই বুঝল না। ইশা কেঁদেই গেল। আদি সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
‘ মিষ্টি পরী কি ডেকেছে তোমায়? পরীর কথায় তুমি কাঁদছ? তুমি ও কি ওর মতোই হয়ে গেলে???
ইশা কাদঁল কিন্তু মাথা তুলল না। বলল, ছোট্ট পরীকে আমি খুব মিস করছি ডক্টর। যে আদুরে স্বরে বলত, আমমাল আমমা। আমি কবে ফিরে পাব আমার পরীকে। আমার খুব করে ওই ডাকটি শুনতে ইচ্ছে হয়।
পরী কেন ডাকেনা ডক্টর??
____________
বৌভাত ভালোই ভালোই মিটে যায়। রিক,রিপ,মুনা,নীরা সবাই আসলে পরী তাদের কাছে যায় না। কথা বলেনা। কাঁদে ও না। সবাই বুঝে পরীর অভিমান। পরী পুরোটা সময় চুপচাপ থাকে। আড়চোখে দেখে রিককে। মুনাকে। তাদের মলিন চেহারা দেখে তার কান্না পায়। কিন্তু তারপর ও সে কাঁদেনা।
মাহিদ চলে যাওয়ার আগে কোথা থেকে দৌড়ে এসে পরীকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। অনেক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখে। কোনোকথা বলেনা। পরী ও চুপ করে থাকে। বলে, ভাই তুই যাস না প্লিজ। তুই ও কি সবার মতো হবি?
মাহিদ বলল, আমি দুদিন পর পর আসব। সামনে আমার পরীক্ষা না? পড়তে হবে।
সবাই চলে যাওয়ার পর পরী পুরো বাড়ি মাথায় তুলে কাঁদে। চিৎকার করে কাঁদে। সবাই নীরব চোখে দেখে পরীর কান্না। পরী কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘ আমি কারো আপন নয়। কারো না।
ইশা ছুটে যেতে চায়। আদি আটকায়। বলে, কাঁদুক। কাঁদলে মন হালকা হয়।
পিহু পরীর সামনে গিয়ে বলে, দিদিয়া এভাবে কেঁদোনা। সবাই তোমাকে ভালোবাসে। তুমি বুঝতে পারছ না।
পরী কান্না থামিয়ে তাকায় পিহুর দিকে। বলে,
‘ তুমি সব কেড়ে নিয়েছ আমার থেকে। আমার আমম,,,
পিহু পরীকে জড়িয়ে ধরে। বলে, দিদিয়া আমি তোমার বোন। আমার যা। তোমার ও তো। মাম্মা পাপা তোমার ও। তোমাকে ওরা খুব ভালোবাসে। তুমি কেন বুঝোনা?
পরী পিহুকে দূরে ঠেলে দেয়। পিহু রেহানের কাছে এসে পড়ে। রেহান বলে, ঠিক আছো?
পিহু মাথা নেড়ে বলল, হ্যা দাভাই।
রেহান রেগে তাকাল পরীর দিকে। বলল,
‘ তোমার সবাই থেকে ও তুমি তাদের মূল্য বোঝোনা পরী। আমি জানি তুমি বুঝবে ও না। কারণ তোমার মতো পাষাণরা কারো দুঃখ কষ্ট বোঝার ক্ষমতা রাখেনা।
পরী দুর্বল জায়গায় যেন আঘাত পড়ল। অসীম আক্রোশে ফেটে পড়ল সে। বলল,
‘ কেউ আমারগুলো বোঝেনা, আমি বুঝে কি করব?
______________
মাহিদের ফোনে পিহুর কল এল। মাহিদ ঘুমোচ্ছে তাই রিপ ফোন রিসিভ করল। ওপাশ থেকে পিহু বলে উঠল,
‘মাহিদ ভাই নিহাকে চিঠিটা দেইনি। ও স্কুলে আসেনি এই কয়দিন। তোমাকে আগে আগে বলে রাখছি কারণ তুমি যাতে রেগে না যাও। আমাকে দেখলে তো তোমার হাত চলে বেশি।
রিপ ফোন কেটে দিল। পিহু অবাক হলো। মাহিদ ভাই কোনোকথা বলল না কেন?
রিপ মাহিদকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। পরীক্ষার মার্কশিট দেখিয়ে বলল,
‘ পড়ালেখা লাঠে উঠিয়ে প্রেমিক সাজা হচ্ছে? চিঠি দিয়ে প্রেমকাহিনী রটাচ্ছেন? নিহা কে?
মাহিদ ঘুম ঘুম চোখে বলে,
‘ আমি কিছু শুনতে পাইনি পাপা।
রিপ ধমক দিয়ে বলল,
‘ একদম চুপপ। তোর রেজাল্টের এই অবস্থা কেন?
নীরা আসল। বলল, ওকে এভাবে ধমকাচ্ছেন কেন? মাত্রই ঘুম থেকে উঠল।
রিপ গর্জে উঠে চুপ করিয়ে দিল নীরাকে। মার্কশিট ছুড়ে মেরে বলল, ছেলে কি করে খবর রেখেছ? পড়ালেখা না করে কি করে তোমার ছেলে? তোমার কাছ থেকে সরালেই ও ঠিক হয়ে যাবে। তোমার প্রশয় পেয়ে পেয়ে ও বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে।
নীরা বলল, এই বয়সে সব ছেলেরাই এক আধটু ওরকম করে।
রিপ বেডসাইড টেবিল জোরে লাতি দিল। বলল, ফাইনাল এক্সাম যদি এরকম হয় তাহলে ওর খবর আছে। বাড়ি থেকে বের করে দেব আমি তাকে। খাইয়ে খাইয়ে আমি বাদঁড় পুষতে পারব না।
নীরা ভয়ে একদম চুপসে গেল। নীরা সেদিন সারাটাদিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। মাহিদের সাথে কথা বলল না রেগে। যা ও একবার বলল। তখন স্পষ্ট করে জানিয়ে দিল, ভালো রেজাল্ট করলে আমার সাথে কথা বলতে আসবি। তোরা বাপ ছেলে কি পেয়েছিস আমাকে?
মাহিদের মনমস্তিষ্কে ডুকে গেল। তাকে পড়তে হবে। মায়ের জন্য হলে ও পড়তে হবে। বেশি বেশি পড়তে হবে।
রিপ তারপরের দিন বলেছিল, ফাইনাল পরীক্ষায় আগের মতো ভালো মার্কস আনলে একটা সুখবর আছে।
মাহিদ সেই সুখবর শোনার জন্য হলে ও ভালো ছেলের মতো পড়ালেখা মন বসাল। পিহু মাহিদকে আর স্কুলের আশেপাশে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল না। ফোনেও পেল না। যতবার কল দেয় ততবার রিপ ফোন ধরে। রিপের সচল মস্তিষ্ক কিছু একটা বুঝে ফেলে। সে মাহিদকে কড়া নজরে রাখে।
কয়েকদিন পার হতে না হতেই পরীর সাথে সাথে পিহু ও চলে আসে। ভয়ে ভয়ে মাহিদের রুমে যায় না। যখনি একবার উঁকি দিল, মাহিদকে পড়ায় ব্যস্ত দেখল। তাই সামনে গেল না। চলে আসার সময় কোথা থেকে মাহিদ দৌড়ে আসল। পিহুর হাতে একটি কাগজ গুজে দিয়ে বলল,
‘ আরিশ এটা নিহাকে দিস।
পিহু তো মাহিদের হাতের সব চিঠি আগে নিজে পড়ে নেয়। তারপর নিহাকে ইচ্ছে হলে দেয় নাহলে দেয় না। এই চিঠিটা সে পড়ল না অভিমানে। সোজা গিয়ে নিহার হাতে দিয়ে আসল। মাহিদ চুপিচাপি নীরার ফোন থেকে ফোন দিয়ে পিহুকে থ্যাংকস জানাল। মাহিদের এইচএসসি পরীক্ষা আসল। পরীক্ষা ভালো হলো তার। নিজের প্রতি কনফিডেন্স থেকে সে রিপকে গিয়ে বলল,
‘ পাপা আমি এবার পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করব। তুমি আমার সারপ্রাইজটা কখন দেবে???
রিপ জানাল। পরীক্ষার রেজাল্ট শোনার পর।
মাহিদ খুশি হলো। নীরাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। বলল,মা তুমি আমার সাথে আর রাগ করে থেকোনা। আমি সত্যি খুব ভালো করে পরীক্ষা দিয়েছি।
পরী সবকিছু মেনে নিয়েছে মত করে চলল। কিন্তু স্বাভাবিক হতে পারল না। রাইনা তাকে দেখে দেখে রাখল এই কয়েকমাস। দুতিনটা কাজ করার জন্য রুটিন ও বেঁধে দিল। পরী চুপচাপ সব সহ্য করে নিল। ইশা যখন খাইয়ে দেয় পিহুকে তা আড়চোখে দেখে খাওয়া রেখে উঠে চলে যায়। আদি হসপিটালে যাওয়ার আগে পিহুকে আদর করে যায় তা দেখে ও জ্বলপুড়ে মরে। রুমে ডুকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। রেহানের দিকে যা তা ছুড়েমারে। রেহান তার সাথে স্বাভাবিক একটি সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইলে ও সেই সুযোগ পরী দেইনা। একেবারে নাহ না বললে ও মন থেকে রেহানকে গ্রহণ করেনা। রেহান কাছে আসলে দূরে ও ঠেলে দেয়না। আপন ও করে নেয়না। সবকিছুতেই তাকে নির্বিকার দেখে রেহান দিশেহারা হয়ে পড়ে। এভাবে তো চলে না।
এই সম্পর্কের পরিণতি কি জানতে চাইলে পরী কিছুই বলেনা। গানের সেমিফাইনাল অডিশনে রেহানের জয়ধ্বনি তার কানে আসল। চুপচাপ সব মেনে নিল সে। নিজের হার মেনে নিল। রেহান ভয়ে ভয়ে থাকল পরী কি করে এত শান্ত?
রেহান তাকে পিছু ডাকলে ও পরী শুনল না। হনহন পায়ে হেঁটে আসতে আসতে হঠাৎই তার ওড়নায় ভারী টান পড়ল। রেহান লোহার পেরেক থেকে ওড়নাটা টান দিয়ে ছাড়িয়ে নেওয়ার পরেই পরী ঘাড় ফেরাল। পরী তার হাতের মুঠোয় ওড়না দেখে রেগে গেল। বলল,
‘ চার দেওয়ালের মাঝে করেন সেটা তো মেনে নিয়েছি। বাইরে ও এসব করতে ইচ্ছে করছে।
গায়ের ওড়না পুরোটা খুলে নিয়ে রেহানের হাতে ধরিয়ে দিল পরী। বলল, ওড়না পড়েছি তাই ভালো লাগছে না তাইনা? ঠিকআছে আজ থেকে আর পড়ব না। রেহান তার হাতের উপর ওড়না দেখে বলল,
‘ তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? যা তা বলছ। কোনসময় আমি তোমাকে জোর করেছি?
পরী একদম তার শার্টের কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত ঘষে বলে, একদম ভালো সাজতে আসবেন না আমার সামনে। আমার সব শেষ হয়ে গেল,পুরো লাইফটাই হেল হয়ে গেল আমার। তিল তিল করে গড়া স্বপ্নগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আর সবকিছুর মূলে কারণটা আপনি। আপনি আমার জীবনে না আসলে এতকিছু হতোনা। আমি আমাকে নিয়ে ভালো থাকতাম।
রেহান ক্ষুদ্ধ চোখে তাকায়। বলে,
‘ সব দোষ এখন আমার না?
পরী কোনোকথা বলল না। রেহান ওড়ানাটা ছুড়ে মারল পরীর দিকে। উল্টোপথে হাঁটা ধরল।
গানের ফাইনাল অডিশন আসল। দিনরাত এক করে পরী প্রেকটিস করল। তারপর ও খচখচানি থেকেই গেল। অডিশনের আগের দিন আফি চরম অপমান করল রেহানকে। পরীর কানে এসেছিল তা। সে কষ্ট না পেলে ও খুশি ও হয়নি। রেহানকে ফকিরের বাচ্চা বলে ও গালি দিল আফি। এমন ও বলেছিল,
‘ তুই আমার কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে। নিজের না। তুই পরীর সাথে কি করে পাল্লা দিস? তোর এত লোভ কেন? বিয়েটা ও করলি নাকি তার সম্পত্তি গুলো নিজে পাওয়ার জন্য। আমি খারাপ হলে ও এতটা খারাপ শিক্ষা তোকে আমি দিইনি। শালা ফকিরদের মতো হয়েছিস তাইনা? তোর মা বাপ তোকে খাওয়ানো পড়ানোর জ্বালা থেকে বাঁচতে আমার কাছে বিশহাজার টাকা দিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। আমি কিনেছি বলে,আজ তুই এই জায়গায়। নাহলে ভিক্ষা করতি। তোর এই গায়ের রঙ, চেহারা আর প্যানপ্যান মার্কা গান শুনে ও তখন কারো মায়া হতো না। সেই তুই আমার পরীর সাথে পাল্লা দিচ্ছিস? তার সাথে খেলা করছিস? ও ডিভোর্স চাইছে ডিভোর্স দিয়ে দিবি। তোর চাইতে ও হাজার গুন ভালো ছেলে ও ডিজার্ভ করে।
রেহান শুধু রেগে গিয়েছিল তাকে ফকিরের বাচ্চা বলায়। বলল, আমি সব সহ্য করব। আমার মা বাবাকে কেউ গালি দিলে আমি সহ্য করব না।
রাইনার কান্নায় সবাই চুপ হয়ে যায়। রাইনা রেহানের মুখ থেকে অমন কথা শুনে ডুকরে উঠে বলে,
‘ তোর মা বাবা তো আমিই। আর ও আছে সেটা তো জানতাম না।
পরী উপর থেকে সব শুনে। রেহান আসলে না দেখালে ও পরী ভয়ে কোনোকথা বলেনা। রেহান ও রাগ দেখায় না। পরী রাতে না খেতে চাইলে, খাবার এনে ঢেকে রাখে। বলে,খেয়ে নাও,আর ঘুমিয়ে পড়ো। কাল অডিশন।
পরী আড়চোখে রেহানকে দেখে দেখে গোগ্রাসে গিলে ভাত। রেহান চোখের উপর হাত রেখে ঘুমিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর যখন তার দুচোখ বেয়ে ঘুম নামে, পরী ধীরেসুস্থে হাতটা সরিয়ে দেয় চোখ থেকে। দেখতে পায় চোখের কোণা ঘেষে গড়িয়ে পড়া জলের চিহ্ন। যে বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে নিজের মা বাবাকে দুচোখে দেখলই না তাদের জন্য কি টান রেহানের। তাদের অপমানে তার মন কাঁদে। চোখ বেয়ে নীরবে জল গড়ায়। আর পরী? পরী কি করছে?
পরী পা টিপে টিপে চলে যায় ইশার ঘরে। আদি এখনো হসপিটাল থেকে ফেরেনি। ইশাকে রুমে না দেখে পরী পিহুর রুমে চলে যায়। দেখে, পিহু ঘুমোচ্ছে মায়ের বুকে।
পরী পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় ইশার কাছে। পিহুকে সরিয়ে গুটিসুটি মেরে সে শুয়ে পড়ে ইশার পাশে। ইশার বুকে গুজে মিনমিন করে ডাকে, আমমমমা??
পিহু পাশ ফিরে আরামে ঘুমোয়। পরী ইশাকে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে আবার ডাকে, আমমমা আমায় ক্ষমা করো। আমি তোমাকে আববাকে আর বোনকে সত্যি খুব খুব ভালোবাসি। তোমরা কেন বুঝোনা আমমা?
ইশা ঘুমের মাঝে বুকে টেনে নেয় পরীকে।মায়ের গায়ের মিষ্টি সুগন্ধ ঘুম এনে দেয় পরীর চোখে। পরী ঘুমে তলিয়ে যায়। আদি হসপিটাল থেকে ফিরে ইশাকে না দেখে পিহুর রুমে যায়। নিত্যকার ঘটনার চাইতে ব্যতিক্রম কিছু দেখে তার দুচোখ চকচক করে উঠল। আদি ধীর পায়ে হেঁটে বসে পড়ে ইশার পাশে। ইশাকে ডিঙিয়ে ছুঁয়ে দেয় পরীর কপাল। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কপালে চুমো দেয়। পরী বেঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন। কতদিন ভালো করে ঘুমোয় না।
আদি আস্তে আস্তে ডাকে ইশাকে। এতসুন্দর একটি দৃশ্য ইশা দেখলেই কি করবে তা ভাবতে না ভাবতেই ইশা নড়েচড়ে উঠল। আদি ডাকল,মিষ্টি এই দেখো। তোমার পাশে কে ঘুমোচ্ছে???
ইশা পিটপিট করে চোখ খুলতেই তার চক্ষুচড়ক। ইশার গাল বেয়ে টপটপ টপটপ জল গড়াল নিঃশব্দে। উত্তেজনায় ইশার গলা শুকিয়ে যায়। এলোপাথাড়ি চুমু দেয় মেয়ের কপালে,গালে। পিহু ও জেগে উঠে। রেহান পরীকে খুঁজতে খুঁজতে চলে আসে পিহুর দরজার সামনে। ভেতরে ডুকে দেখতে পায় হাসিখুশি তিনটি মুখ। আর একটি ঘুমন্ত মুখ । ঘুমন্ত মেয়েটিকে এভাবে এখানে ঘুমাতে দেখে যেন রাজ্যের খুশির ঢল নামল মা বাবা আর বোনের মুখে। ঘুমন্ত মেয়েটিকে হঠাৎ করে খুব সুখী মনে হলো রেহানের। পরীর সব আছে। শুধু তার নেই। সে ফকিরের বাচ্চা। লোভী।
পিহু, আদি, ইশা তিনজনই নীরবে হাসল। আর যাকে দেখে তারা এত খুশি সে বেঘোর ঘুম। ঠোঁটটা ফুলিয়ে রেখে ঘুমোচ্ছে। ইশা সেই ফুলিয়ে রাখা ঠোঁটটার উপর আদর করে ডাকে,
‘ পরী মা। এই আমমা,,,
পরী ঘুম। ঘুম।
আদি পিহু দেখার সাথে সাথে রেহান তাড়াহুড়ো করে সরে পড়ে সেই জায়গা থেকে। হাঁটতে হাঁটতে হাতের কব্জি দিয়ে মুছে নেয় ভেজা চোখ। ঘেমে উঠা কপাল। সে এটাই চেয়েছে সবমসময়। পরী ভালো থাকুক।
চলবে,,,,