#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৯(সিজন ২)
#পুষ্পিতা_প্রিমা
পরী দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। ইশা আর পিহু এসে রাইনাকে ধরে। কপালে আঘাত পেয়েছে রাইনা। বেহুশ হয়ে গিয়েছে। আদি হসপিটালে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিচে নামতেই ভড়কে গেল।
পরী দরজা খুলে আর কাউকে দাঁড়ানো দেখতে পেলনা। দরজার সামনে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
আদি ধরাধরি করে কোনোমতে গাড়িতে তুলল রাইনাকে। আফির দিকে বিতৃষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ তোমার সাথে পরে কথা বলছি আমি।
আফি বলল,
‘ আরেহ হেতির ডং। তার আদরের ছেলেরে ধমক ও দেওয়া যাবেনা। মাথায় তুলে তুলে রাখতে হবে। ফেলে রাখ। কিছুক্ষণ পর দেখবি আপনাআপনি উঠে যাবে।
পিহু গলার স্বর খানিকটা উঁচু করে ডুকরে উঠে বলে,
‘ তুমি কথা বলোনা বড় পাপা। সব তোমার জন্য হয়েছে। দাভাইকে তুমি মেরেছ কেন? দিদিয়া আর দাভাই কথা বলছে,সেখানে তুমি ডুকতে গেলে কেন? বড়মার কিছু হলে তোমাকে ছাড়ব না।
আফি চুপ হয়ে যাই পিহুর ধমকে। হেঁটে হেঁটে সোফায় গিয়ে বসে থাকে চুপচাপ। রাইনাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো। কপালের পাশে চোট লেগেছে। হাত পা ঠান্ডা শীতল হয়ে গেছে।
পরী রাইনাকে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকিয়ে রইল। তার রাগ লাগল। সব রাগ গিয়ে পড়ল আফির উপর। পরী ছুটে গেল। আফির পায়ের কাছে হাটুমুড়ে বসল। সোফায় কয়েকবার মাথায় ঠোকা লাগাল। আফি হায় হায় করে বলল,
‘ কি হয়েছে মা? আমি তো সব তোমার জন্য করেছি। এখন তুমি আমায় বকো না। ওই হারামির বাচ্চার বেশি বাড় বাড়ছে। তোমার পেছনে পাবলিকরে লাগায় দিছে না?
পরী হাউমাউ করে কেঁদে বলল,
‘ বড়মার যদি কিছু হয়? বড়মা কষ্ট পেয়েছে। তুমি কেন এমন করলে? তোমাকে আমি কি বলেছি? আগে আগে মাস্টারি দেখাতে কে বলেছে??
আফি চোখ বড় বড় অসহায় হয়ে তাকায়। যাহ বাবা যার জন্য চুরি করল সেই বলে চোর। পরী বলল,
‘ যাও তোমার ছেলেকে নিয়ে আসো। যাও। বড়মা হসপিটালে জানলে তোমাকে খুন করবে উনি। যাও আগে আগে গিয়ে দোষ স্বীকার করো। যাও। যাও না?
আফির রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। বলে, যাব না। কোথাও যাব না। যে মরার মরুক। আমার কি? আমি কারো কাছে যাব না। তুমি জোর করবে না পরী।
পরী আর কোনোকিছু বলল না। রুমে চলে গিয়ে রেহানের ফোনে ইচ্ছেমত কল দিল। কিন্তু সুইচডঅফ।
ইশা তার রুমে এসে দরজা বন্ধ করল। পরী ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ আমমা আমার দোষ নেই। আমি বড় পাপা এমন করবে জানলে কিছুই বলতাম না। আমি তো এমনটা চাইনি। রেহান চৌধুরী আমাকে দয়া দেখাতে গিয়ে আমার ক্ষতি করেছে আর ও।
ইশা চাপা রাগ মেয়ের সামনে দেখাতে পারেনা। কতদিন পর মেয়েটা আমমা ডাকছে। একটু হাসিখুশি থাকছে। ইশা বলল,
‘ রেহান তোমার কে হয় পরী?
পরী চমকায় এমন প্রশ্নে। বলে, কেন আমমা? তুমি তো জানো।
ইশা বলল, তোমার মুখ থেকে শুনতে চাইছি।
পরী তোতলাতে তোতলাতে বলে, বর ।
ইশা বলল, তুমি আমার আর তোমার আববার সম্পর্কটা দেখেছ?
পরী মাথা নাড়ায়। বলে, কিন্তু…
ইশা তাকে বলতে না দিয়ে বলে,
‘ তুমি তো কথাটা রুমে বলতে পারতে। ড্রয়িংরুমে কেন বলতে গেলে? তোমাদের অনেক ঝামেলা হতে পারে,আবার অনেক তর্ক হতে পারে। কিন্তু দিনশেষে তোমারা স্বামী স্ত্রী তো। তোমাদের ঝগড়া যদি বাইরে টেনে আনো তাহলে তো সমাধানের বদলে জটিলতা বেড়ে যাবে আর ও। তুমি আর ছোট নেই পরী। তুমি সব বুঝতে পারো। তোমার সব বুঝা দরকার। রেহানকে বুঝা দরকার। তোমাকে যদি কেউ ফকিরের বাচ্চা বলতো তোমার কেমন লাগত? রেহানের কেমন লেগেছে ভেবে দেখো। তুমি রেহানকে কেন বুঝোনা পরী?
পরী মাথা নামিয়ে রাখে। ইশা বলল,
‘ রেহান তোমাকে ভালোবাসে পরী। কিন্তু তুমি কি করছ ? বারবার ওকে আঘাত করে যাচ্ছ। গুড।
পরী ঠোঁট টেনে কান্না আটকায়। বলে, আমমা তুমি রাগ করেছ? আমি কি করব এখন? কি করলে সব ঠিক হয়ে যাবে?
ইশা রেগে বলল,
‘ কি করলে মানেটা কি? তুমি বুঝতে পারছ না আমি কি বলতে চাইছি?
পরী মাথা দুলাল। মাথা নামিয়ে বলল
‘ আমি রেহান চৌধুরীকে কখনোই ভালোবাসতে পারব না আমমা। এসব আমার দ্বারা হবেনা। আমি ভালোবাসতে জানিনা। পারিনা।
ইশার কেন জানি হাসি পেল। ইশা বলল,
‘ ভালো নাই বা বাসলে , ভালো তো রাখতে পারো । ভালো বাসার আগে ভালো রাখা জানতে হয়। তুমি আগে ভালো রাখাটা নাহয় শিখে নাও।
পরী বোকার মতো প্রশ্ন করল ইশাকে।
‘ ভালো কিভাবে রাখব আমমা? আমাদের তো চুক্তি হয়েছে ডিভোর্সের।
ইশা চুপ মেরে যায়। চোখ কপালে তুলে বলে,
‘ ডিভোর্স ? পাগল হয়ে গেছ পরী? ডিভোর্সের মানে বুঝো তুমি??
পরী ঠোঁট বাকিয়ে কেঁদে দিয়ে বলে,
‘ আমি কিছু বলিনি আমমা। সব রেহান চৌধুরী বলেছে।
ইশা মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে।
_______________
পরী আর ইশা যায় হসপিটালে। রাইনার জ্ঞান ফিরেছে কিছু আগে। কিন্তু শরীর প্রচন্ড দুর্বল। পরী, ইশা পিহু বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। রিক আর মাহিদ আসে। মাহিদ আসার সাথে পিহু মুখ ভেঙিয়ে বলে,
‘ ওমা পটানো হিরোসাহেব ও দেখছি আসছে। ওলেবাবা।
মাহিদের বিশ্রী গালাগাল করতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু রিক আর ইশা থাকায় কিছু বলল না। যখন দেখল রিক ইশার সাথে চলে গেল। পিহুকে পরীর সামনে চটাস করে চড় মেরে বলল,
‘ আমি হিরোর মতো দেখতে বইলাই তো মাইয়্যা মানুষ আমাগো পেছনে ঘুরে। তোর জ্বলে নাকি?
পিহু মাথার একপাশ চেপে ধরে বলে, কথায় কথায় হাত নাড়ো কেন? আমার ভালো লাগেনা। আমার মাথার এই পাশটাই পুরা ব্যাথা হয়ে গেছে। আমার রাতে ঘুম হয়না ব্যাথায়।
পরী দাঁড়িয়ে চুপচাপ দুজনের ঝগড়া দেখে। মাহিদ বলে,
‘ ধুরর,, তুই বাপ কোন টাকওয়ালার পিরিতে পড়ছস কে জানে? এল্লেগা তোর ঘুম হারাম হইয়্যা গেছে। আর তুই বাপ আমার দোষ দিস কিল্লাই। খুন কইরা কুচি কুচি করে কাইট্যা মরা নদীতে ভাসায় দিমু শালী।
পিহু মুখ মোচড় দিয়ে বলে, উল্টাপাল্টা কথা বলবে না মাহিদ ভাই। আমার বর খুব সুন্দর হবে। টাকওয়ালা কেন হতে যাবে?
মাহিদ হাত দিয়ে বলে,
‘ যাহ তো। মনে হইতাছে তুই তোর টাকাওয়ালা জামাইরে কয়বার দেখছস?
যাহ তো বাপ মাথা খারাপ করিস না।
পিহু পরীকে খেয়াল না করে বলল,
‘ আমি তো রোজ দেখি। আহা কি সুন্দর সে! কি হ্যান্ডসাম! কি কিউট! ইশশ!
মাহিদ ভ্রু কুঞ্চন করে তাকিয়ে থাকে।
পরীকে টের পেল পিহু। লজ্জায় মুখটা বাংলা পাঁচের মতো করে বলল,
‘ দিদিয়া আসলে আমি ওই,,,,,,
পরী নাকে কেঁদে বলল,
‘ উহু উহু আববা কোথায়? আমমা কোথায়? ভালো লাগছেনা কিছু।
পিহুর হাসি পেল।
‘ ধুরর দিদিয়া তো এসব বোঝেইনা। যাইহোক পিহু দিদিয়ার চাইতে একধাপ এগিয়ে। সে সব বুঝে।
পরী নাকি সুরে বিরক্তির শিষ দিতে দিতে ইশা আর রিকের কাছে কেবিনের দিকে চলে গেল।
মাহিদ বলল, তোর টাকওয়ালা জামাইয়ের সব ভালা গুণ না??
খারাপ কিচ্ছু নাই। বাপরে বাপ তুই মিছা কথা কস ক্যান বাপ?
পিহু সামনের থাকা চুলগুলোতে আঙুল পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘ খারাপ অভ্যাস একটাই। সারাক্ষণ বাপ বাপ করে। আর মারে।
মাহিদ ধমক দিয়ে বলে, শালী জোরো কহ। তোর এত মিনমিনে মার্কা কথা আমি বুঝিনা।
পিহু বলল, বুঝবা কেমনে? তুমি তো সারাক্ষণ বাপ বাপ ছাড়া আর কিছু কইতে ও পারোনা।
মাহিদ পিহুর গাল দুই আঙুল দিয়ে শক্ত করে টান দিল। বলল,
‘ আজ তোরে চিমডা দিছি, তুই বাপ আমার মুখে মুখে যদি আর কথা কস তাইলে তোরে ঠাসস ঠাসস মাইরা গাল কইরা ফেলুম।
পিহু গাল ঘষতে ঘষতে বলে,
‘ আমার গাল ধরবানা তোমার ওই পঁচা হাতে। আমার গালগুলা কি তোমার চিমডা খাওয়ার জন্য? এগুলা অনেক মূল্যবান।
মাহিদ ইয়াক করে থুতু ফেলার মতো করে বলল,
‘ তোর ইয়া মোটা মোটা ফোলা ফোলা পেটমার্কা গাল দুইটা দেখলে সারাক্ষণ চিমডাইতে ইচ্ছা করে। তোর টাকওয়ালা জামাইয়ের কাছে এগুল্লা মূল্যবান ফূল্যবান হতে পারে। আমার কাছে না। আমার কাছে তোর তবলামার্কা গাল শুধু পেটানোর জন্য। বুঝলি? শুধু তবলার দুরুমদারুম পিটামু। সারাক্ষণ পিটামু। চিমডাই লাল বানায় ফেলমু।
মাহিদ উচ্চস্বরে হাসল কোমরে হাত দিয়ে। পিহু দুইগাল তার হাতের তালু দিয়ে চেপে ধরল। বলল,
‘ ওমাগো মাহিদ ভাই তোমার মুখের শুনেই আমার গালটা জ্বলতেছে। তবলামার্কা মানে কি হ্যা? আমার গালদুটো অনেক সুন্দর এন্ড কিউট। তুমি বুঝো নাকি কিছু??
মাহিদ দাঁত দেখিয়ে হাসল। বলল, তোর পেটের খাবার সব মনে হয় এই পেটমার্কা গাল দুইটা হজম করে ফেলে। কি ফোলা বাপরে বাপ। তুই বাপ আমার সামনে আসলে এই গাল দুটো দেখলেই পিটাইতে ইচ্ছা করে। ঠাসস মাইরা বলতে ইচ্ছা করে,
‘ হেইইই তুই এত মোটা ক্যান।
পিহু কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
‘ মাহিদ ভাই। আমার গাল মোটা কিন্তু আমি মোটা না।
মাহিদ কোমরে হাত দিয়ে আবার হাসল। বলল,
‘ ধুরর তুই বেটি আস্ত একটা লইট্যা শুটকি। শুটকি মাছ যেমন গন্ধ, তুই তার চাইতে বেশি ইয়াকক।
পিহু কেঁদে দিল। কিন্তু চোখে পানি নেই । মাহিদের ভাষায় যার নাম,ডংগী কান্না,ন্যাকা কান্না। মাহিদ বলল,
‘ ওরেব্বাপ তোর এই প্যা প্যা আমার সামনে করিস না। তোর প্যা প্যা ভ্যা ভ্যা শোনার লাইগ্যা আমি এইখানে আসিনাই। আমি ভালা মানুষ, ভালা কাজ করতে আইছি। তোর বড়মারে দেখতে আইছি। তুই বাপ আমার লগে ঝগড়া লাগায় দিছস।
পিহু চোখ কচলাতে কচলাতে বলে,
‘ হুহহ ক্যান ভালা মানুষ। ডংয়ের শেষ নাই। নাটক। তোমার মতো ভালা মানুষরে ধরে আমি ঠাসসস ঠাসস চড়ায়।
মাহিদ এবার আশপাশ দেখল না। পিহুর গালে মাথায় পিঠে দুমাদুম ঠাসঠুস মারল। চুলগুলো টেনে দিয়ে দৌড় লাগাল। বলল,
‘ বেয়াদব মাইয়্যা আমারে মারার কথা ভাবলে ও তোর খবর আছে। শালী।
পিহু বেশি ব্যাথা পেল। হুহু করে কেঁদে দিল। নাকমুখ লাল হয়ে গেল। পিঠে ব্যাথা পেল। ঠোঁট টেনে টেনে কেঁদে কেঁদে বলল, আমি ছোট মামাকে ফোন করে সব বলে দেব। আমি ব্যাথা পেয়েছি মাহিদ ভাই।
পিহু কান্নায় ভেঙে পড়ল।
মাহিদ কি যেন ভেবে দৌড়ে আসল। পকেট থেকে দুইটা চকলেট বের করে পিহুর হাতে দিল। পিহু আর ও ফুঁপিয়ে উঠল। মাহিদ পিহুর গালের একপাশে আলতো করে ধরল। পিহু কান্না থামায় কিছুমুহূর্তের জন্য।
মাহিদ তার গালে আস্তে আস্তে তবলা বাজিয়ে বাজিয়ে বলল,
‘ সোনা পাখি, রূপা পাখি,টিয়া পাখি, ময়না পাখি কাইন্দো না। কাইন্দো না।
পিহু মাহিদের কথা শুনে খিক করে হেসে দেয়। মাহিদ চোখ কপালে তুলে হা হু করে হেসে বলল,
‘ দেখছস। তুই দেখছস মাহি কিভাবে পটায়? ওহহো তুই আইজ সামনাসামনি দেখছস। মাহি এইভাবে সোনা ময়না টিয়া পাখি ডেকে ডেকে পটায়। দেখছস মাহি কত ট্যালেন্ট!
পিহু হা করে তাকিয়ে থাকল। মাহি চকলেট পিহুর গালে ডুকিয়ে দিয়ে দৌড় লাগাল। হাত নাড়িয়ে বলল,
‘ টা টা ডাক্তারেরর বাচ্চি। মাহির ফিউচার বউ অপেক্ষা করতাছে। যাই একটু টাংকি মাইরা আসি।
______________
পরী ইশা রিকের সামনে দিয়ে হুড়মুড় করে দৌড়ে গেল একটি ছেলে। ভীষণ চিন্তিত চেহারা। অন্যদিকে দুচোখ মেলে কাউকে দেখার সময়টুকু ও নেই। কেবিনের এই নাম্বার ওই নাম্বার দেখতে দেখতে একটি নার্সকে জিজ্ঞেস করল,
‘ মিসেস চৌধুরী কোন কেবিনে আছে?
নার্স জিজ্ঞেস করলেন,
‘ আপনি কি পেশেন্টের ছেলে।
রেহান দ্রুত মাথা নাড়িয়ে জবাব দিয়ে বলে,
‘ জি, কোন কেবিনে উনি?
নার্স এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
‘ তিনশ চারে দেখুন প্লিজ। পেশেন্ট আপনাকে ছাড়া আর কারো সাথেই কথা বলতে চাইছেনা।
রেহান দৌড়ে গেল। মায়ের জন্য উৎকন্ঠায় তার গলা শুকিয়ে এল। দৌড়ে কেবিনের কাছাকাছি গিয়ে হুড়মুড় করে ডুকে পড়ল। আশেপাশে কাউকে দেখার চেষ্টা করল না। রেহান কেবিনে ডুকেই হাঁপাল। রাইনার চোখ বন্ধ ছিল। ছেলের জোড়াল নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনে পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাল। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল একদৃষ্টে। অপলক ছেলের মুখের দিকে। কখন যে দুফোটা জল কানের পাশ বেয়ে গড়াল বুঝাই গেল না। রেহান ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে মায়ের মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। হাঁটুভেঙে বসে পড়ে। মায়ের কপালের ব্যান্ডেজের উপর একটুখানি হাত ছুয়ে ভরাট কন্ঠে ডাকল,
‘মাআআ
গলার ভেতর থেকে অদ্ভুত আওয়াজ বেরোলো রাইনার। কাঁপাকাঁপা হাতটা ছেলের মুখে ছুঁয়ে বলল,
‘ আমার রেহান। তুই শুধু আমার, আমার,,,,,, ছেলে।
রেহান মায়ের হাত নিজের হাতের দুমুঠোয় নিল। চুমু দিল। বলল,
‘ তুমি ছাড়া আমি অসহায় মা। আমার আর কেউ নেই। তোমার মতো করে রেহানকে কেউ ভালোবাসবে না। আমি তোমাকে খুব খুব ভালোবাসি মা। আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভুলে ও ভেবো না মা। আমরা অনেকদূরে চলে যাব। চৌধুরী বাড়িতে তোমায় থাকতে হবেনা।
রাইনা ডুকরে উঠে কাঁদে। বলে,
‘ আমার উপর কত অত্যাচার হয়েছে। আমি মুখ বুজে সহ্য করে নিয়েছিলাম শুধু তোরজন্য। কারণ তোর একটা ভালো পরিবার দরকার। যাতে তোর গায়ে কেউ আঁচড় না দেয় কিন্তু আজ তোর গায়ের উপর হাত তুলেছে। তোকে আমার মতোই মানসিক অত্যাচার করা হচ্ছে। সেই বাড়িতে তো আমি থাকব না। আফি চৌধুরীকে তুই আর কখনো বাবা ডাকবিনা। আমার দোহাই লাগে। কখনোই ডাকবিনা।
রেহান রাইনার চোখ মুছে দিয়ে বলে,
‘ মা এসব বাদ দাও। আমরা সবকিছু নতুন করে শুরু করব। আমার এক ফ্যানের নতুন রিসোর্টে উঠব আমরা। আমার চাকরির অভাব হবেনা। আমি আর তুমি খুব ভালো থাকব। আমাদের আর কারো প্রয়োজন নেই মা।
রাইনা বলল, গান গাইবি না?
রেহানের মুখ তখনি মলিন হয়ে এল। তারপর ও হাসিমুখে সে বলল,
‘ গাইব। শুধু তোমার জন্য।
রাইনা সুখে হাসল। বলল, আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল। আমি থাকব না এখানে।
আদি এসেই রিপোর্ট দেখল। রেহানকে সব দেখাল। বলল, বাসায় নিয়ে যাও।
রেহান কিচ্ছু বলল না।
কেবিন থেকে বেরোনোর সময় রেহান রাইনাকে সাবধানতা অবলম্বন করে কোনোমতে রাস্তায় নিয়ে এসে গাড়িতে বসাল। পরী কাঁদোকাঁদো মুখ করে তাকিয়ে থাকল রাইনার দিকে। রাইনা তাকাল না। পিহু বলল,
‘ বড়মা আমরা সবাই একসাথে বাসায় যাই? এক গাড়িতে। দাভাই তুমি ও চলো।
রেহান চুপ থাকল। রাইনা ও। বিনিময়ে পিহুর সাথে একটুখানি মুচকি হাসল রাইনা।
পরী রাত পর্যন্ত থমকে থমকে পা ফেলে ফেলে হাটল পুরো ঘরময়। দরজার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পর ইশার কাছে গিয়ে অভিযোগ দিল।
‘ আমমা বড়মা আসেনি। কোথায় গিয়েছে?
ইশা বলল, চলে আসবে। চিন্তা করোনা।
প্রায় তিনদিন কেটে গেল কোথাও কোনো চিহ্ন নেই রেহান আর রাইনার। আফি বলল,
পালাইছে পালাইছে। ভাগছে মা ছেলে। ভালোই হয়েছে।
পরী ইশাকে এসে এসে বলে,
‘ কচুর ভালোবাসে। খোঁজ ও নেয়না। আমি ভালোবাসি না ঠিক করেছি একদম।
ইশা বলল,
‘ সব তোমার জন্য হয়েছে পরী। তোমার বড়মা কষ্ট পেয়েছে। ছেলের উপর আঘাত আসলে কোনো মা ই সেটা সহ্য করতে পারেনা। উনি ও পারেননি। আমি ও পারতাম না।
পরী বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ উহু। তো আমাকে ডিভোর্স দিয়ে যাইনি কেন?
ইশার কেন জানি আচমকা প্রচন্ড রাগ উঠল। জোরে চড় বসাল আদরের মেয়ের গালে। যার গায়ে ছোটবেলা থেকে কোনোদিন হাত তুলেনি। পরী দূরে ছিটকে পড়ল। আদি দৌড়ে এসে ধরল পরীকে। বুকের সাথে আগলে ধরে বলল,
‘ তুমি পরীর গায়ে হাত তুলেছ মিষ্টি?
ইশার চোখ ভিজে উঠে রাগে, ক্রোধে, আক্রোশে। পরী টলমলে চোখে তাকিয়ে ডাকে,
‘ আমমমা।
ইশা বলল,
‘ একদম আমমা ডাকবিনা আমায়। এরকম মেয়ের মুখ দিয়ে আমি আমমা ডাক শুনতে চাইনা।
ব্যস। পরী সেদিন থেকে চুপ হয়ে যাই। আমমার উপর অভিমান, আর ওই ছেলেটার উপর রাগ থেকে সে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। একেবারে চুপচাপ,শান্ত প্রতিমা।
কিছুদিন পার হয়। ততদিনে রেহান কোথায় আছে, তা মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেল। এই নিয়ে পরীকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন ও হতে হয়েছে। পরী অবলীলায় সেগুলো এড়িয়ে গেল।
ঠিক তারকিছুদিন পর অডিশন থেকে ফেরার সময় গাড়ির সামনের সিটে আদি বসা ছিল। পরী আর ইশা পেছনের সিটে। সিটে হেলান দিয়ে সে চোখ বুজে ছিল। গাড়িতে সিগনাল পড়ায় সব গাড়ি থেমে গেল। বেশকিছুক্ষণ বিরক্তিকর সময় পার হয়ে গাড়ি ছাড়ার আগমুহূর্তেই গাড়ির পাশে থাকা বাইকের উপর বসা হেলমেট পড়া ছেলেটি গাড়ির কাচ ভেদ করে পরীর দিকে ছুড়ে মারল একটি কাগজ।
সাথে সাথেই গাড়ি ছেড়ে দিল। পরী নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকল সেই ছেলেটির যাওয়ার পানে। যখনি ছেলেটি নিরুদ্দেশ হলো পরী হাতে তুলে নিল সেই কাগজটি। উপরে ইংরেজি লেটারে বড় বড় করে লিখা, ডিভোর্স পেপার।
ইশা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল। পরী নড়েচড়ে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে রাখল মাথা। চোখ উপরে নিবদ্ধ করে রাখল। চোখ বন্ধ করল। বেশকিছুক্ষণ পার হতে না হতেই জল গড়াল কান ঘেষে।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে রেহান ব্রেকফাস্ট বানাতে গেল। আজ মাকে সে সারপ্রাইজ দেবে। কিচেনে যখন সে কুকিংয়ে ব্যস্ত দরজার বেল বেজে উঠল। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই অনাকাঙ্ক্ষিত একটি দৃশ্য সে দেখল। তার সামনে স্বয়ং আদিশা খানম দাঁড়িয়ে রয়েছে। রেহান জানতে চাইল,
‘ কি চাই?
পরী শান্ত কন্ঠে জবাব দিল।
‘ কিছুনা। দেখতে এসেছি কতটা ভালো আছেন।
রেহান দরজা বন্ধ করার জন্য তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বলল,
‘ কোনো দরকার না হলে এখন আসতে পারেন।
পরীর দুচোখ ছলছল করে উঠে। বলে,
‘ ডিভোর্স পেপারে সাইন দেন। না দিয়ে খালি পেপার কেন দিয়েছেন।
রেহান বলল,
‘ ডিভোর্স তুমি চেয়েছ তাই তুমি আগে দাও। তারপর আমি।
পরী বলল,
‘ সাহস থাকলে নিজে দিয়ে দেখান। রেহান কেড়ে নিল পেপার।
কলম নিল পরীর হাত থেকে। পেছন থেকে পরীকে ধাক্কা দিয়ে রেহানের গায়ের উপর ফেলে দিল কেউ। পরী চোখমুখ খিঁচে ফেলল। ডিভোর্স পেপারটি ওই ধাক্কা দেওয়া ছেলেটির হাতে গিয়ে পড়ল। ছেলেটি সেটি দিয়ে নাক মুছল। কপালের ঘাম মুছল। তারপর হাত দিয়ে ছিড়ে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ ওরেব্বাপ মাগার আজকালকার এমন হিরো হিরো ভাব আসছে, দৌড় শুরু করলে বোমার মতো উইড়া আসি। দৌড় থামাইতে কেয়ামত হইয়্যা যাই। ভাইবা আসছি রেহান ভাইয়ের কোলে উঠমু দৌড়ে আইসা কিন্তু এখন তো দেখছি রোমিও জুলিয়েটের ,,,,,,,
থাক আর কইলাম না।
রেহান হনহন পায়ে হেঁটে পরীর কাছ থেকে দূরে দাঁড়াল। বলল,
‘ এক্ষুণি বেরিয়ে যাও। আমার মা ঘুম থেকে উঠার আগে। যাও। আমার ভালো লাগছেনা এসব।
পরী রেগেমেগে গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ির কাচের সাথে মাথায় দুমদাম বাড়ি লাগাল।
মাহিদ পরীর কান্ড দেখে গাড়ির উপরে উঠে বসল। শুইয়ে বেহুশ হওয়ার মতো করে বলল,
আমি জ্ঞান হারাব, মরে যাব
বাঁচাতে পারবেনা কেউ
আর শুনব না রেহান ভাইয়ের ঘেউ ঘেউ
পরী সোনার ভ্যাও ভ্যাও।
চলবে,,,,