#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_১০(সিজন ২)
#পুষ্পিতা_প্রিমা
আদি, ইশা আর পিহু পরীর রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল। দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে গুনগুন কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। পিহু দরজায় টোকা দিয়ে বলল,
‘ দিদিয়া আববা ডাকছে। দরজা খোলো।
পরী কোনো আওয়াজ করল না। ইশা দরজা ধাক্কাল। আদি ধাক্কাল। কোনো আওয়াজ হলোনা। ইশা বলল,
‘ আপনি ডাকুন না । ভালো করে ডাকুন। খুলবে।
আদি বলল, ভালো করে কিভাবে ডাকে মিষ্টি? তুমি শিখিয়ে দাও। আমি ডাকি।
ইশা বলল, আমি পারিনা তাই আপনাকে বলছি। ডাকুন। আমি অনেক ডেকেছি।
পিহু বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ তোমরা এসময় ঝগড়া করছ মাম্মা? দিদিয়া তো দরজা খুলছেই না।
মাহিদ আসল হেলেদুলে। আদি বলল,
‘ মাহি তোমার দিদিয়াকে ডাকো।
মাহিদ ভ্রুকুঞ্চন করে তাকিয়ে রইল। বলল,
‘ কি হয়ছে আবার?
পিহু বলল,
‘ তোমার বাচ্চা হয়ছে একটা। দিদিয়া দরজা খুলছেনা তুমি দেখছ না?
আদি চোখ বড় বড় করে তাকাল পিহুর দিকে।
‘ পিহু ঝগড়া ও জানে?
পিহু জিভে কামর দিয়ে মাথা নিচু করে বলল, সরি পাপা। আমি আসলে,,,,,
ইশা রেগে বলল, আগে দরজা খুলতে হবে। তারপর বাকি কথা।
মাহিদ দরজায় টোকা দিতে দিতে বিড়বিড় করে বলল,
‘ তুই শালীরে আমি পরে দেইখা নিমু।
মাহিদ জোরে জোরে দরজা ধাক্কাল। পরীকে অনেক ডাকল। তারপর দরজায় জোরে জোরে লাতি দিয়ে দরজাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ হিরোসাহেব এত লাতি দিতাছে তোরে। তুই বাপ খুলছ না ক্যান? সিনেমায় তো ফট কইরা খুইলা যাস। এখন আমার সাথে রং তামাশা করস??
এত চিন্তার মাঝে আদি ইশা খিক করে হেসে দেয়। পিহু বলল,
‘ তুমি ভুয়া হিরো তাই।
মাহিদ দরজায় আর ও জোরে লাতি দিয়ে বলল,
‘ তুই শালীরে যদি এমন একটা দিতে পারতাম।
বেশকিছুক্ষণ পর মাহিদ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বলে, ইয়ামপসিবল। এই পিহুর বাচ্চি দেখ আমি ঘাইমা গেছি। আমার লাগি শরবত লইয়্যা আয়। যাহ।
পিহু পিটপিট করে চোখের পলক নড়ায়। অন্যদিকে মুখ করে বলে, পারব না।
মাহিদ তাকে ঠেলে দিয়ে বলে, যাহ না বাপ। এত ঘাড় ত্যাড়া কেন তোর। তোর জীবনে ও বিয়া হইব না শালী।
আদি বলল,
‘ পিহু যাও। ও অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বড় ভাইয়ের একটু সেবা করো।
পিহু হঠাৎ কেমন করে যেন তাকাল। আদি বলল, কি হয়েছে?
পিহু গটগট করে হেঁটে চলে গেল। মাহিদ চিল্লিয়ে বলল,
‘ ওই পায়ের আওয়াজ করে হাটস ক্যান। মাইয়্যা মানুষের এইভাবে হাঁটতে নাই তুই বাপ জানস না।
পিহু যেতে যেতে বলল, হইছে তোমাকে আর জ্ঞান দিতে হবেনা।
পিহু আসতে না আসতে পরী দরজা খুলল। মুখটা থমথমে। ফোলা ফোলা চোখ। জ্বলজ্বল করছে নাকের মাথা।
আদি বলল,
‘ এরকমটা কেউ করে? আমরা কত ভয় পেয়েছি।
মাহিদ বলল,
‘ বিয়ার আগে ও তুমি আমারে শান্তি দাওনাই দিদিয়া। বিয়ার পরে ও শান্তি দিলানা। তোমারে সামলাইতে আমারে ছুইটা আসতে হয়। এই ভাই না থাকলে তোমার কিতা হতো?
ইশা পরীর গাল মুছে দিয়ে বলল,
‘ তুমি ছোট নও পরী। কি হয়েছে কিছু না বলে, কখন থেকে না খেয়ে দরজা বন্ধ করে বসে আছ। রিকদা কতবার ফোন দিচ্ছে। তুমি কারো কথা ভাবছ না পরী।
পরী চোখ কচলে বলে,
‘ ওই ছেলেটা আমাকে ইনসাল্ট করেছে। বড়মার সাথে দেখা করতে দেইনি।
আদি বলল,
‘ কোন ছেলেটা। ওর নাম নেই।
ইশা বলল, আপনি থামেন। ও যা বলছে তা শুনন।
পরী বলল,
‘ আমি আর কখনো যাব না ওই ছেলেটার কাছে। আর যেতে বলবে না। কথায় কথায় শুধু ধমকায়। আর আজ তো ডিভোর্স পেপারে সাইন দিয়েই দিচ্ছিল।
আদি সাথে সাথে বলে, ডিভোর্স??
ইশা কথা ঘুরিয়ে ফেলল। ‘ কিছুনা। আমি দেখছি ।
আদি ইশাকে পাত্তা না দিয়ে গর্জে বলল,
‘ ডিভোর্স মানে কি পরী?
পরী আদির ধমকে কেঁপে উঠল। বিড়বিড় করে বলল,
‘ ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলেন উনি।
আদি আর দাঁড়াল না। গটগট করে হেঁটে চলে গেল। পরী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বলল, এখানে আমার কি দোষ আমমা?
ইশা পরীকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসাল। পরীর পাশে মাহিদ গিয়ে বসল। পরীর সামনে মুখ এনে বলল,
‘ তুমি কি চাইতাছো এখন? তোমার কি বর, লাগব নাকি লাগব না। লাগলে আমারে কও লইয়্যা আসি গা। কোলে কইরা নিয়া আসুম। না লাগলে কান্দো ক্যান???
পরী বলল, ইননা আমার লাগবে না। আমার ভালো লাগছেনা কিছু। আমমা আমি ঘুমোবো। তোমরা যাও। ভাই তুই ও যাহ।
মাহিদ খাটের উপর পা তুলে বলে,
‘ যাইবার পারতাম না। আমি অনেক কেলানতো। আমার ও ঘুম দরকার। ওই পিহুর বাচ্চা কি মইরা গেছে? শরবত আনতে এতক্ষণ লাগে। ফুপী আমি যদি তেষ্টায় আজ মইরা টইরা যায় তোমার ছেড়ির দোষ। কইয়া গেলাম।
ইশা বলল, চুপ থাক। সবসময় উল্টাপাল্টা কথা বলিস কেন?
পিহু শরবত আনল। ধপ করে টেবিলের উপর রেখে বলল,
‘ নাও। খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো।
মাহিদ হাতে নিল গ্লাস। ঢকঢক করে দুই চুমুক খেয়ে কুলি করে দিল পিহুর গায়ে। নাক ছিটকে গ্লাসটি টেবিলের উপর ধপ করে রেখে বলল,
‘ ওরেব্বাপ তুই লবণ দিয়া শরবত বানাইছস? তোরে আমার খুন করতে মন চাইতাছে। ওরেব্বাপ তুই যাহ আমার সামনে থাইকা। নাইলে তোরে খুন কইরা আজ জেলে যামু।
পিহু রেগে বলল,
‘ কুলি করে দিলে? তুমি অসভ্য মাহিদ ভাই।
মাহিদ মাথা দুহাতে চেপে ধরে পরীর পাশে বসল। বলল,
‘ ফুপী ওরে যাইতে কও।
ইশা পিহুকে বকল।
‘ তোমাকে ও মারে,,, ভালো করে। লবণ দিয়ে কেউ শরবত বানায়? যাও এখান থেকে।
পিহুর নাক কেঁপে কেঁপে উঠল। চোখের উপর হাত দিয়ে রাখল। সবার চোখের আড়ালে টপটপ চোখের জল গড়াল। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে কেটে পড়ল সে। মাহিদ আড়চোখে তাকাল। তারপর পরীকে বলল,
‘ তুমি এইভাবে কাইন্দো না। তোমার বর লাগলে আইনা দিমু। না লাগলে তোমার বরকে আরেকটা বিয়া কইরা দিমু। বেচারা তো থাকতে পারব না বউ ছাড়া। তোমার জামাইর দরকার নাই কিন্তু তার তো বউ লাগব। বউ ছাড়া তাহন বড়ই কষ্ট। তা আমার চাইতে বেশি কে জানে??
পরী ইশা একসাথে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। ইশা বলল,
‘ তুই যাবি এখান থেকে? কতটুকু হয়েছিস বউ বউ করিস? সময় হলে তোর জন্য লাল টুকটুকে বউ নিয়ে আসব আমরা। এখন মন দিয়ে পড়। মাহিদ হেসেখেলে বলল,
‘ এই বউয়ের জন্য পড়তাছি। নাইলে কে পড়বো? মাহি এত কাঁচা কাজ করেনা।
ইশা মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকল।
‘ এই ছেলেটা কার মতো হলো??
রিপদার মুখে তো সে কোনোদিন এসব বউ টউ উচ্চারণ কোনোকালেই শুনিনি।
_________________
রাইনা তখন রেহানের জন্য খিচুড়ি বসিয়েছে চুলায়। শরীরটা অসুস্থ হওয়ায় রেহান কোনো কাজ করতে দেইনা তাকে। আজ তাকে একটু বের হতে হবে বলে শুধু বলেছে মা আজ খিচুড়ি খাব তোমার হাতে। রাইনার হাত পা কাপঁতে লাগল মৃদুমৃদু। কিছুদিন ধরে মানসিক অসুস্থতা শারীরিক অসুস্থতা বাড়িয়ে দিয়েছে। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। তারমধ্যেই ফোন বেজে উঠল আচমকা। রাইনা ফোন ধরতে না ধরতেই আদি বলল,
‘ ফিরছ কখন?
রাইনা বলল,
‘ তোর ভাইয়ের সাথে একবাড়িতে থাকার কোনো রুচি নেই আমার। তাই ফিরছি না।
আদি চাপাস্বরে বলল,
‘ রেহান কোথায়?
‘ বাইরে গিয়েছে। কেন?
আদি বলল, ‘ উকিলের কাছে গিয়েছে???
রাইনা অবাক হয়ে বলল, উকিলের কাছে ওর কি কাজ?
আদি বলল,
‘ ডিভোর্স পেপার রেডি করার জন্য?
রাইনা দ্বিতীয় দফা অবাক হলো। বলল,
‘ ডিভোর্স। কার ডিভোর্স?
আদি বলল, তুমি কি সত্যি কিছু জানো না? নাকি জেনে ও না জানার ভান করছ?
রাইনা বলল, আমি সত্যি কিছু জানিনা। তুই পরী আর রেহানের কথা বলছিস?
আদি বলল, হ্যা। রেহান ডিভোর্স দিয়েই দিচ্ছিল পরীকে। কাউকে না জানিয়ে রেহান এতবড় সিদ্ধান্ত কি করে নিতে পারে? দাভাইয়ের উপর থাকা রাগ পরীর উপর দেখাচ্ছে ও?
রাইনা কপালে হাত দিল। অসুস্থ অনুভব হচ্ছে। শরীর কাঁপছে। রেহান তাকে না জানিয়ে এতবড় সিদ্ধান্ত নিল? রেহান তাকে একটু ও আপন ভাবে না? সে পেটে ধরেনি বলে কি এখনো মা হয়ে উঠতে পারল না?
আদি বলল, রেহান এটা ভালো করেনি? রেহানের অভিভাবক ও আমরা। পরীর ও। আমাদের জানানো দরকার ছিল। যাইহোক ডিভোর্স দিতে চাইলে তখন আর কি করার আছে। দিয়ে দিতে বলো।
রাইনার হাত থেকে কুন্তি পড়ে গেল। হাত কেঁপে উঠল ঠকঠক করে। ফোনটা কিচেন রেক এ রেখে দুইপা বাড়ানোর আগে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। যেন পৃথিবীটাই ঘুরল মাথার উপর। ঝিমঝিম আওয়াজ হতে হতে থেমে গেল। হাত পা তড়পাতে তড়পাতে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মুখ দিয়ে অস্ফুটভাবে বের হলো, রেহানননননন।
রেহান বাড়ি ফিরল প্রায় সন্ধ্যা নাগাদ। ফিরতে দেরী হয়েছে তাই মা আজ খুব বকবে ভেবে সাবধানে পা টিপে টিপে সে বাড়িতে ডুকল। মৃদুমৃদু কন্ঠে ডাকল, মাআআআ।
কারো সাড়াশব্দ নেই। রেহান আওয়াজ করে ডাকল, মা ফোন রিসিভ করোনি কেন? আমি কতটা টেনশনে পড়ে গিয়েছি। ফিরতে দেরী হবে সেটা বলার জন্য ফোন দিয়েছি আর তুমি ফোন তুললে না। মাআআ কোথায় তুমি?
রেহান ডেকে গেল। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রুমে গেল। ছাদে গেল। শেষমেশ না পেয়ে দৌড়ে কিচেনে গেল। গিয়ে দেখল তার পৃথিবীটা সেখানেই থমকে গেছে। তার বাকশক্তি ক্ষয় হয়ে গেছে। পা দুটো চলা থামিয়ে দিয়েছে। চোখের পলক পড়া ও থেমে গিয়েছে। পুরো কিচেনরুম কাঁপিয়ে রেহান ডেকে উঠল,
‘ মাআআআ?
রাইনার নিথর দেহ পড়ে রইল। ছেলেকে চোখ খুলে সে দেখল না। ছেলের মা ডাক শুনল না।
আদি বাড়ি ফিরে খেয়েদেয়ে বিছানায় শুতে পারল না। নিচে কারো গলার আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে গেল। পরী,পিহু ইশা নিচে নেমে এল। পরী এককোণায় দাঁড়িয়ে থাকল। রেহান এদিকওদিক তাকিয়ে পা বাড়াতেই আফি জিজ্ঞেস করল,
‘ কি হয়েছে?
রেহান উত্তর দিল না। আলিয়া নেমে এল ধীরপায়ে লাঠি হাতে। রেহানকে দেখে চোখ জুড়াল তার। বলল,
‘ দাদুভাই ফিরে এসেছ? মা কোথায়?
রেহান পড়নের শার্টের হাতা দিয়ে মুখ মুছে তোতলাতে তোতলাতে বলল,
‘ চাচ্চু, চাচ্চু মা। আমার মা। আমার মাকে বাঁচাও চাচ্চু। মা ছাড়া আমার কেউ নেই। মাকে ফিরিয়ে দাও আমার কাছে।
আদি দৌড়ে আসল। রেহানকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ কি হয়েছে মায়ের? শান্ত হও। এভাবে কথা বলছ কেন?
রেহান বলল, মা শুয়ে আছে। ওই ওখানে শুয়ে আছে।
ইশা বলল, কোথায় শুয়ে আছে। কি বলছ রেহান? ভাবির কি হয়েছে?
রেহান বলল, মাকে আমি সন্ধ্যায় এডমিট করিয়েছি হসপিটালে। কিন্তু কোনো আপডেট পাচ্ছিনা। মা উঠছেনা। কথা বলছেনা।
আদি বলল, তুমি আমাকে বলোনি কেন? আমি তো হসপিটালেই ছিলাম। রেহান চুপ করে থাকল।
আদি বলল, এতটা অভিমান ভালো না রেহান। আমি কখনোই তোমার খারাপ চাইনা।
রেহানের গলা কেঁপে কেঁপে উঠল। বলল,
‘ চাচ্চু মাকে যেকরেই হোক বাঁচাও। আমি মাকে ছাড়া থাকতে পারব না।
আদি তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়ল। রেহান বেরোনোর আগে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল পেছনে। পরী সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিল। রেহান বেরোতেই সিড়ির কাছে ধপ করে বসে পড়ল সে । কেঁদে দিয়ে বলল,
‘ সব আমার জন্য হয়েছে। বড়মা এখানে থাকলে এসব কিছুই হতো না।
_______________
আদি হসপিটালে পৌছে দেখল রাইনার অবস্থা গুরুতর। বলল, তুমি অনেক দেরী করে ফেলেছ রেহান।
রেহান গিয়ে রাইনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। বলে, এভাবে বলোনা চাচ্চু। এরকম হবে জানলে আমি কখনোই মাকে ছেড়ে যেতাম না।
রাইনাকে ক্লিনিকে ভর্তি করানো হলো। অক্সিজেন দেওয়া হলো। চৌধুরী বাড়ি থেকে ইশা আর পিহু এল। আর ও একজন এল, তবে সে আড়ালেই থেকে গেল। বাইরে পড়ছে ভারী বৃষ্টি। চারপাশ ঘোর অন্ধকার। রেহান হাতে কতগুলো ঔষধপত্র নিয়ে আসল। ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। মাথার চুল থেকে টপটপ পানি পড়ছে। ইশা গিয়ে ঔষধগুলো হাতে নিল। বলল, ওদিকে বসো। চুল মুছে দেই। চিন্তা করোনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। রেহান বলল, কিচ্ছু হবেনা কাকিয়া। আমার কিচ্ছু হলে কারো কিছু যায় আসবেনা। কিন্তু আমার মায়ের কিছু হলে, আমার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। মা আমার সাথে কথা না বলা অব্ধি আমি আমার কথা ভাবতে পারছিনা। ইশা কিছু বলতে পারল না। রেহানকে ভেতরে যেতে দিলনা নার্সরা। রেহান একটিবার রাইনাকে দেখার জন্য ছটপট করতে লাগল। ভেজা মুখটা হাত দিয়ে মুছে দুরুদুরু বুক নিয়ে উঁকি দিল ক্লিনিকের ছোট্ট কাচের জানালায়। অক্সিজেন মুখে দেখা যাচ্ছে রাইনার নিথর দেহ। রেহানের মন কেঁদে উঠল। অস্ফুটভাবে তার মুখ দিয়ে বের হলো, মা!!! মা উঠো। প্লিজ মা। আমার কাছে আসো মা। আমি খুব অসহায় তোমাকে ছাড়া। তোমার শরীর খারাপ লাগছে তুমি আমায় কেন বলোনি মা? তুমি না বললে আমি কি করে বুঝব? তুমি কেন এতটা স্বার্থপর মা। আমার কথা ভাবোনা তুমি।
______________
তারপরের যে দিনটি এল রেহানের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। রাইনার তখন ও হসপিটালে চিকিৎসা চলছে। রেহান খাওয়াদাওয়া ছেড়ে মায়ের সেবায় লেগে গেল। কিন্তু বিকালের দিকে গা কাঁপিয়ে জ্বর এল তার। রাইনার পাশে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেল তাকে। আদি অনেক জোর করে চৌধুরী বাড়িতে পাঠিয়ে দিল রেহানকে। ইশাকে বলল,রেহানকে দেখে রাখতে।
অন্ধকার রুমে ইজি চেয়ারে বসে দুলাতে দুলাতে বিড়বিড় করে মা মা ডাকতে লাগল রেহান। মা কি করে আজকের দিনটাই এভাবে শুয়ে থাকতে পারে? আজকের দিনটা মা কি করে ভুলে গেল? আজকের দিনে ওর যে মায়ের হাতে পায়েস খাওয়ার কথা ছিল। খুব আয়োজন করে জন্মদিন পালন করার কথা ছিল। কিন্তু না মা তো চোখখুলে একবার তার ছেলের দিকে তাকায়নি। জ্বর ক্রমশ বাড়তে লাগল তার। মাথা ভার হয়ে এল। চোখদুটো জ্বলতে জ্বলতে অসম্ভব লাল হয়ে এল। তার তো বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর কথা। রাত কতদূর হয়েছে সেদিকে ও তার খেয়াল নেই। লাইট জ্বালাতে ভালোলাগছেনা। তাই জ্বালায়নি। অন্ধকারেই ভালো লাগছে। জ্বর বাড়তে লাগল। তার সাথে বিড়বিড় করে বকবকানি। সেই বকবকানি আবার বেশিদূরে যাচ্ছেনা।
হঠাৎই অন্ধকার রুমটা দেখা গেল মৃদুমৃদু আলোকিত হচ্ছে। দরজা ঠেলে খালি পায়ে নিঃশব্দে তার দিকে এগিয়ে আসছে এক রমণী। পড়নে তার লাল শাড়ি। হাতের তালুতে খুব সাবধানে ধরা একটি মোমবাতি। সামনে ফেরানো লম্বা বেণিবন্ধন থেকে উটকো কতগুলো চুল হাওয়ায় উড়ছে। এমুহূর্তে তার এদিকওদিক তাকানোর জো নেই। মোমবাতিটি পড়ে যাওয়ার তাগিদে মেয়েটি চোখ তুলে তাকাল না। এগোতে এগোতে থেমে গেল। চেয়ারে বসা মানবটির দিকে চোখ তুলে তাকাল। মোমবাতির নরম আলোয় চার চোখ চোখাচোখি হলো। উজ্জ্বল মুখবর্ণ জ্বলজ্বল করল সেই আলোয়। সাথে দুচোখ। রেহান জ্বরের ঘোরে বোধহয় উল্টাপাল্টা দেখল। তাই চোখ বন্ধ করে আবার খোলার সাথে সাথে তার মুখের ঝুঁকে আসল খুব প্রিয় একটি মুখ। দুজনের মুখের মাঝখানের সেই বস্তুটি মোমবাতি। মেয়েটি তার বন্ধ চোখ খুলে ফিসফিস করে বলল,
‘ শুভ জন্মদিন।
ছেলেটি বিস্মিত হলো না। প্রিয় মুখটি অন্ধকারে তলিয়ে যাবে বলে মোমবাতি নেভাতে ইচ্ছে করল না তার। তারপরে ও নেভাতে হলো। অন্ধকার নামার সাথে প্রিয় মুখটি ও দেখা গেল না। কিন্তু নিঃশ্বাসের মৃদুমধুর দোলা এসে পড়ল মুখের উপর। চোখের উপর। ললাটের উপর। তাপ হয়ে থাকা ললাটটাই আচমকা ঠান্ডা অনুভূত হয় ছেলেটির। মেয়েটি আর দাঁড়াল না তারপর পরই। দৌড়ে পালাল লজ্জায় ।
ভালো লাগাটা তখন থেকেই শুরু হলো হয়ত ভালোবাসা ও।
চলবে,,,