সেই তুমি?
পর্ব -৩৭
Samira Afrin Samia(nipa)
রিহা কোন ভাবে ইশিতা কে একা একাই হসপিটালে নিয়ে আসে। হসপিটালে আনতে আনতে ইশিতা সেন্সলেস হয়ে যায়। ইয়াশ এই শহরের একজন সুনামধন্য বিজনেসম্যান। তাকে এক নামে সবাই নিচে। রিহা ইশিতা কে ইয়াশের ওয়াইফ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার সাথে সাথে সব ডক্টর রা ইশিতা কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। ইশিতা কন্ডিশন ভালো না তাই ইমিডিয়েটলি অপারেশন করাতে হবে। দেরি করলে আরো মারাত্মক কিছু হতে পারে।
একজন ডক্টর এসে খুব তাড়াহুড়ো করতে করতে রিহা কে জিঙ্গেস করলো
— আপনি পেশেন্ট এর কে হন?
— আমি ইয়াশ চৌধুরীর ছোট ভাই ইফান চৌধুরীর স্ত্রী। উনি আমার ভাবী হন।
— আপনাদের সাথে আর কে এসেছে?
— আসলে ডক্টর আমার শাশুড়ি নাজমা চৌধুরী বাসায় নেই। ইয়াশ চৌধুরী বিজন্যেসের কাজে দেশে বাইরে গেছে। ইফান বাসায় আছে তাকে ফোনে পাচ্ছি না।
— পেশেন্ট এর সাথে কি শুধু আপনি ই এসেছেন?
— হ্যাঁ।
— তাহলে আপনাকে কিছু ফর্মালিটি পূরণ করতে হবে।
মিসেস চৌধুরীর অবস্থা ভিষণ কিটিক্যাল। ইমিডিয়েটলি উনার অপারেশন করতে হবে।
— ইশিতার কিছু হবে না তো?
আর ওর বাচ্চা?
— দেখুন আমরা এখন কিছুই বলতে পারছি না। পেশেন্টের এমনিতেই অনেক ব্লিডিং হয়েছে। উপুড় হয়ে পড়ায় পেটে প্রচন্ড আঘাত লেগেছে। অপারেশন করতে হবে।
— ডক্টর যা করার আপনারা তাই করুন। টাকা নিয়ে কোন চিন্তা করবেন না। ইয়াশ চৌধুরী চাইলে মুহূর্তের মধ্যে এমন কয়েকটা হসপিটাল কিনে নিতে পারে। উনি যদি শুনেন আপনাদের অবহেলার জন্য উনার ওয়াইফ বা উনার বাচ্চার কিছু হয়েছে। তাহলে উনি আপনাদের কি হাল করবে তা বুঝতেই পারছেন।
— দেখেন ম্যাম আমাদের কাজ ই পেশেন্ট কে সুস্থ করে তুলা। হোক সে ধনী বা গরীব। ডক্টর রা কোন রোগী কে ই অবহেলা করে না। আর আমরা ইয়াশ চৌধুরী কে খুব ভালো করে চিনি। আমরা আমাদের সাধ্য মত চেষ্টা করবো। যাতে মিসেস চৌধুরী আর উনার বাচ্চার কিছু না হয়।
— প্লিজ ডক্টর যা করার তাড়াতাড়ি করুন।
— আমরা পেশেন্ট কে অপারেশন থিয়েটারে শিফট করছি। আপনি ফর্মালিটি গুলো পূরণ করুন। আর বাড়ির কাউকে খবর দেন।
রিহা অপারেশন থিয়েটারের বাইরে চিন্তিত মুখে পায়চারি করছে। ইফান কে অনেক বার ফোন করেছে। প্রথমে কয়েক বার রিং হলেও কিছুক্ষণ পর ফোন সুইচ অফ বলছে। রিহা চিন্তায় মরে যাচ্ছে।
— কি করে কি হয়ে গেল। ইশিতা পড়ে গেল কি করে? কি হয়েছিল?
আমি প্রথমেই যদি ইশিতার ডাক শুনতে পেয়ে চলে যেতাম তাহলে আর এমন টা হতো না।
রিহা পায়চারি থামিয়ে স্থির দাঁড় হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। হাত পা থরথর করে কাঁপছে।
— মা তো আজ ফিরে আসবে। মা’কে ফোন করে জানাবো কি?
ইশিতার ব্যাপারে এসব জানতে পারলে মা তো টেনশন করেই শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া মা’কে সব কিছু এখন না জানিয়ে শুধু হসপিটালে আসতে বলি।রিহা নাজমা চৌধুরী কে হসপিটালে আসতে বলে তবে কি হয়েছে কারণ টা বলে না। নাজমা চৌধুরী অনেক বার জিঙ্গেস করেছে কারো কিছু হয়েছে কিনা। কিন্তু রিহা নাজমা চৌধুরী কে কিছু ই জানালো না।
প্রায় এক ঘন্টার মত সময় পাড় হয়ে গেল। আরো বেশিও হতে পারে। কোন ডক্টর ই এখনও অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হচ্ছে না। ভেতরে কি হচ্ছে না হচ্ছে রিহা তা কিছুই জানে না। শেষ পর্যন্ত ইশিতা আর ওর বাচ্চা ঠিক থাকবে তো। রিহা ইশিতার জন্য ও তার বাচ্চার জন্য সমানে আল্লাহর কাছে দোয়া চেয়ে যাচ্ছে।
— আল্লাহ আমি অনেক অন্যায় করেছি ইশিতার সাথে অনেক কষ্ট দিয়েছি ওকে। জীবনে এতো কষ্ট সহ্য করে মেয়েটা একটু সুখের মুখ দেখার আগেই কি তুমি তার সুখ কেড়ে নিবে?
তুমি তোমার বান্দার প্রতি এতটা নিষ্ঠুর হইয়ো না আল্লাহ। তুমি তাদের দু’জন কে ই সুস্থ রাখো।
এই বাচ্চা টার জন্য ইশিতা সমাজের সবার সাথে একা লড়াই করেছে। কত অপমান কত লাঞ্ছনার স্বীকার হয়েছে। এখন এই বাচ্চা টার কিছু হয়ে গেলে ইশিতা মরে যাবে।
বলতে বলতেই নাজমা চৌধুরী এসে গেল। রিহা নাজমা চৌধুরী কে দেখে উনার কাছে যায়।
— কি হয়েছে রিহা তুমি আমাকে হসপিটালে আসতে বললে কেন?
কার কি হয়েছে?
— মা ইশিতা।
নাজমা চৌধুরী ভয়ে ভয়ে বললো
— ইশিতা?
কি হয়েছে ওর। ইশিতা ঠিক আছে তো? আর ওর বাচ্চা?
— মা আসলে আজ দুপুরে আমি রুমেই ছিলাম। ইশিতা ও ওর রুমেই ছিল। হঠাৎ আমার মনে হলো ইশিতা আমাকে ডাকছে। ইশিতা কেন আমাকে ডাকছে তা স্পষ্ট করে বুঝতে না পারলেও আমি ওর রুমে যাই ওকে দেখার জন্য। ওর রুমে গিয়ে দেখি ইশিতা ওয়াশরুমে ফ্লোরে পড়ে পেটে হাত দিয়ে চিৎকার করছে। কি হয়েছে জানতে চাইলে ইশিতা শুধু আমার বাচ্চা আমার বাচ্চা এইটুকু ই বললো।
বাসায় কেউ ছিল না আমি কি করবো কিছু বুঝতে না পেরে কোন ভাবে ইশিতা কে এখানে নিয়ে আসি। আর আপনাকে আসতে বলি।রিহার মুখে পুরো কথা শুনে নাজমা চৌধুরী ধপ করে নিচে বসে পড়ে। নাজমা চৌধুরী মুখে হাত দিয়ে কান্না শুরু করে দিয়ে বলতে লাগলো
— সব শেষ হয়ে গেল।
রিহা নাজমা চৌধুরী কে তুলে দাঁড় করিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে
— শান্ত হন মা কিছু হবে না ইশিতার। আপনি দেখবেন ইশিতার বাচ্চার ও কিছু হবে না। ও’রা দু’জনেই ঠিক থাকবে।
— আর কিছুই ঠিক থাকবে না রিহা। মেয়েটার সব শেষ হয়ে গেল। ইয়াশ জানে ইশিতার কথা?
— না মা আমি ইয়াশ ভাইয়া কে কিছু জানাই নি।
ডক্টর অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে এসে রিহা কে ডাকলো।
— মিসেস রিহা।
রিহা ছুটে গেল ডক্টরের কাছে
— হ্যাক বলুন। ইশিতা কেমন আছে? আর ওর বাচ্চা?
ডক্টর চোখ থেকে চশমা খুলে মুখ গম্ভীর করে নিচের দিকে তাকিয়ে
— দেখুন আমরা আমাদের সাধ্য মত চেষ্টা করেছি। আমাদের হাতে যেটুকু ছিল তার বেশি তো করতে পারবো না।
— ইশিতা ঠিক আছে তো?
— হ্যাঁ উনি ঠিক আছেন তবে উনার বেবী
ডক্টর এইটুকু বলার পর ই রিহা মুখ চেপে ধরে কয়েক পা পিছনে যায়।
নাজমা চৌধুরী চেয়ার থেকে উঠে এসে ডক্টরের সামনে দাঁড়ালো।
— উনার কন্ডিশন ভালো ছিল না। বাচ্চা টা কে কোন ভাবেই বাঁচানো সম্ভব হতো না।
— ইশিতা এখন কেমন আছে?
— উনি মোটামুটি ভালোই আছে। এখনও জ্ঞান ফিরে নি। আর উনি জানেন না যে উনার বাচ্চা টা আর নেই।
জ্ঞান ফিরলে উনাকে তো জানাতে হবে। আর স্বভাবতই এমন কথা জানার পর কেউ ঠিক থাকতে পারে না উনি ও নিজেকে ঠিক রাখতে পারবেন না। আপনারা উনার আপন জন আপনারা একটু উনাকে সাপোর্ট করবেন। এই সিচুয়েশানে উনাকে সামলাতে না পারলে উনার ও হ্মতি হয়ে যেতে পারে।
এই বলে ডক্টর চলে গেল। নাজমা চৌধুরী মুখ চেপে কান্না করছে। আর মনে মনে নিজেকে দোষ দিচ্ছে।
— আমি বাসায় থাকলে হয়ত এসব কিছু হত না। আমি ইশিতা কে দেখে রাখতাম। এই অবস্থায় ওর খেয়াল রাখার দায়িত্ব আমার ছিল। আমি আমার দায়িত্ব ঠিক মত পালন করতে পারিনি। ইয়াশ কে আমি কি করে এসব জানাবো। আমার ছেলেটা তো পাগল হয়ে যাবে। কত স্বপ্ন সাজিয়েছিল এই বাচ্চা টা কে নিয়ে।
রিহা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
— আমি ইশিতার সাথে থাকার পরও ওর এতো বড় একটা হ্মতি হয়ে গেল। আমার দরকার ছিল সব সময় ওর পাশে থাকা। ইশিতা কে একা ছাড়া আমার ঠিক হয়নি।
দুই ঘন্টার মত হয়ে গেল। ইশিতা কে ক্যাবিনে শিফট করা হয়েছে। কিন্ত এখনও ইশিতার জ্ঞান ফিরে নি।নাজমা চৌধুরী ইশিতার পাশে বসে ইশিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রিহা পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।
— মা আপনি আজই এতো জার্নি করে ফিরলেন বাসায় ও যান নি। হসপিটালে চলে আসছেন। এখন তো ইশিতার জ্ঞান ফিরে নি। আপনি বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন ততক্ষনে আমি ইশিতার পাশে থাকছি। বেশি সমস্যা হলে ডক্টর রা তো আছেন ই।
— আমি এখন কোথাও যাবো না রিহা। জ্ঞান ফিরে এসব শুনলে না জানি মেয়েটা কি করে। নিজেকে যদি সামলে নিতে না পারে তখন?
না না আমি ইশিতার কাছেই থাকবো।
ইশিতার জ্ঞান ফিরছে। ইশিতা মিটমিট করে তাকিয়ে মাথার উপর দাঁড়ানো রিহা কে দেখে চোখ নামিয়ে নাজমা চৌধুরী কে দেখলো। ইশিতার মনে পড়লো ওর সাথে কি হয়েছিল। সাথে সাথে পেটে হাত দিয়ে আমার বাচ্চা বলে চিৎকার দিয়ে উঠে বসে চাইলে নাজমা চৌধুরী ধরে নিলো।
— কি করছিস তুই? এভাবে উঠিস না মা।
ইশিতা কাঁদতে কাঁদতে
— আমার বাচ্চা ঠিক আছে তো মা?
ওর কিছু হয়নি তো?
ইশিতার মুখে প্রথমেই ওর বাচ্চার কথা শুনে নাজমা চৌধুরী ও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
নাজমা চৌধুরী কে কাঁদতে দেখেই ইশিতা বুঝে গেল ওর বাচ্চা ঠিক নেই।
ইশিতা পেটে শক্ত করে চেপে ধরে জোরে চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে।
— তুই আমাকে ছেড়ে চলে গেলি। তোর মাম্মাম কে একা করে দিয়ে চলে গেলি। আমি কি বলবো তোর বাবা কে?
ও তো তোর দায়িত্ব আমাকে দিয়ে গেছিল। আমি তোর খেয়াল রাখতে পারিনি।বলতে বলতে ইশিতা কান্নায় ভেঙে পড়লো।নাজমা চৌধুরী ইশিতা কে বুকে টেনে নিয়ে
— চুপ কর মা। চুপ কর। আল্লাহ যা করেন তা ভালোর জন্যেই করেন। কাঁদিস না মা।
ইশিতা নাজমা চৌধুরীর বুকে মুখে গুজে কাঁদছে
— কি করে চুপ হবো মা। আমার যে আর কিছুই হইলো না। যার জন্য আমি সমাজের সবার সাথে একা একা লড়াই করেছি। আজ সে ই আমাকে ছেড়ে চলে গেল।
ইয়াশ কে আমি কি বলবো মা?
— তুই এভাবে কাঁদিস না। তাহলে তোর ও হ্মতি হবে। তুই নিজেকে সামলা। আমি জানি তুই ভেতর থেকে অনেক টা শক্ত। তুই একদম ভেঙে পড়বি না।
কাঁদতে কাঁদতে ইশিতা আবার জ্ঞান হারালো।
অনেকক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে ইশিতা আর কোন কথা বলে না। পাথর হয়ে বসে আছে। চোখ দু’টো শান্ত হয়ে স্থির হয়ে আছে। ইশিতা আর কাঁদছে না। আর চিৎকার চেচাঁমেচি ও করছে না। একেবারে শান্ত হয়ে গেছে। শুধু পেটে হাত দিয়ে চুপ করে বসে আছে।
নাজমা চৌধুরী রিহা ইশিতা কে কত কিছু বলছে ইশিতা তার কোন উত্তর দিচ্ছে না।
ইশিতা কে এমন অবস্থায় দেখে নাজমা চৌধুরীর বুক ফেটে যাচ্ছে।
— ইশিতা তো কোন ভাবে সত্যি টা মেনে নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়েছে। কিন্তু ইয়াশ কি সত্যি টা মেনে নিতে পারবে? পারবে কি নিজেকে সামলে নিতে?
রিহা ইশিতার পাশে বসে ইশিতার হাতে হাত রেখে
— এই ইশিতা এভাবে আছো কেন?
কিছু তো বলো। কি হলো তোমার?
ইচ্ছে হলে জোরে চিৎকার করো। কান্না করো তবুও এভাবে চুপ থেকো না।তোমার এভাবে দেখে সত্যি ই আমার খুব ভয় হচ্ছে।
ইশিতা পাথরের মত বসে আছে। মনে হচ্ছে রিহার কোন কথা তার কানে যাচ্ছে না
রিহা এবার সত্যি ই ভয় পেয়ে ইশিতা কে ধাক্কা দিয়ে জোরে জোরে বলে উঠলো
— এই ইশিতা তোমার কষ্ট হচ্ছে না। এভাবে শান্ত হয়ে বসে আছো কি করে?
কি হলো কথা বলো।
ইশিতা এক নজর রিহার দিকে তাকিয়ে রিহা কে জড়িয়ে ধরে নিজের ভেতর চেপে রাখা কষ্ট গুলোকে চোখের জলের মাধ্যমে প্রকাশ করতে লাগলো। ইশিতা নিজের ভেতর আর কান্না চেপে রাখতে পারলো না।
— কি হয়ে গেল রিহা? আমার সাথেই কেন এমন হয় বলো তো। আমি তো আগের সব কষ্ট গুলো ভুলে গিয়ে নিজেকে আবার নতুন করে তৈরি করেছিলাম। নিজের বাচ্চা কে আঁকড়ে ধরে আবার বাঁচতে চেয়েছিলাম।
এখন তো আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বল টুকু ও আমার থেকে হারিয়ে গেল। আমার কপালে কেন সুখ সয়না?
রিহা ইশিতা কে বাঁধা দিচ্ছে না। কান্না করলে কষ্ট কম হবে। নিজেকে হালকা লাগবে। ইশিতার কান্না দেখে রিহা ও কাঁদছে। রিহা কখনও ভাবে নি যাকে সে এক সময় ঘৃণা করতো। যার হ্মতি করার কত চেষ্টা করেছে। আজ তার কষ্ট নিজের ও কষ্ট হবে।
চলবে…..
( n,f, next এগুলো কি ভাই? ? আপনারা নেক্সট না চাইলে ও আমি নেক্সট পর্ব দিব তাই নেক্সট নেক্সট না করে নিজেদের মতামত জানিয়ে গঠনমূলক কমেন্ট করুন। ভুল হলে তা ধরিয়ে দিবেন এতে আমি ও খুশি হবো। ধন্যবাদ ?)