মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_৩০(সিজন ২)

0
767

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩০(সিজন ২)
®পুষ্পিতা_প্রিমা

সকাল থেকে তোড়জোড় শুরু হলো আইমির। দুপুর গড়াতেই স্যুটকেস রেডি করে বের হলো নিনিতের মায়ের ঘরের উদ্দেশ্যে। ওইদিনের পর থেকে তিনি দেখা ও দেননি আইমি কিংবা জাবিরকে৷ জালিশা দেখতে চাইলে চিল্লিয়ে বলেছেন,
‘ ওমন মেয়েকে আমি দেখতে ও চাইনা।
নিশিতা বের হলো মায়ের ঘর থেকে। বাইরে এসে আইমিকে দেখে সে খানিকটা কৌতূহল মিশিয়ে বলল,
‘ আন্টি আপনি?
আইমি বলল,
‘ কিছুক্ষণ পর এয়ারপোর্টে রওনা দেব। তোমার মায়ের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম।
নিশিতা বলল,
‘ এ করে হয় আন্টি? মায়ের উপর রাগ করে চলে যাচ্ছেন?
আইমি হাসল। বলল,
‘ না না রাগ আমি কেন করব? রাগ তোমার মায়ের করা উচিত। ভুল আমার হয়েছে, জালিশাকে চোখে চোখে না রেখে।
যাইহোক কোথায় এখন ভাবী?
নিশিতা বলল,
‘ এইতো এইমাত্র ঘুম থেকে উঠল। যান।
আইমি গেল। নিকিতা বেগম পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে মাত্রই গ্লাসটা রেখেছেন। আইমিকে দেখার সাথে সাথে বলে উঠল,
‘ চলে যাচ্ছ নাকি?
আইমি বলল,
‘ জ্বি। উনি চলে আসলে এক্ষুণি বের হবো।
রাগ করে থাকিয়েন না আমার মেয়ের উপর? দোয়া করিয়েন। এখান থেকে গিয়ে ভালো ছেলে পেলে বিয়ে দিয়ে দেব।
নিকিতা বেগম চোখের চশমাটা লাগিয়ে নড়েচড়ে বসলেন। বললেন,
‘ মেয়ের বিয়ে দিবে ভালো কথা। আমরা দাওয়াত পাবো না?
আইমি হেসে বলল,
‘ এটা কেমন কথা? দাওয়াত তো দেব,কিন্তু আপনারা কি যাবেন?
নিকিতা বেগম হেসে বললেন,
‘ আমার ছেলের বিয়ে খেয়ে যেও। তোমার মেয়েরটা তো খেতে পারবোনা।
আইমির একটু খারাপ লাগল।
‘ এই মহিলাটা কি মন বুঝেনা? তার ছেলেকে জালিশা ভালোবাসেই বলেই কি এমন আচরণ? জালিশা কি তার ছেলের যোগ্য নয়?
আইমি উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘ আচ্ছা যায় তাহলে। দোয়া করবেন। ওর উপর রাগ করে থাকবেন না ভাবি।
নিয়াজ সাহেবের সাথে দেখা হলো আইমির। নিয়াজ সাহেব সোজা বলে দিল,

‘ আজ যদি চলে যাস তাহলে বুঝব, আমার বোন বলতে আসলেই কেউ নেই।
আইমি বলল,
‘ এটা কি ধরণের কথা ভাই? আমরা তো এমনিতেই থাকতে আসিনি এখানে। নিনিতের বিয়ে উপলক্ষে এসেছি।

নিয়াজ সাহেব ক্ষিপ্র গলায় বললেন,
‘ জালিশা বউ একবার সেজেছে, একবারই সাজবে। বিয়েটা শরিয়ত মতে হয়নি তো কি হয়েছে? আবার হবে। এতে এত ঝামেলার কি আছে। এমন তো না যে কেউ কারো সাথে যায়না।
আইমি বলল,
‘ যার হাতে আমি ছেলেকে তুলে দেব, সে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার আদরে আদরে অন্য রকম পরিবেশে বড় হয়েছে। তার হাজারটা ভুলত্রুটি হবে,সেসব হজম করার সামর্থ্য ও থাকতে হবে নিনিতের। তাকে বুঝতে হবে। বুঝাতে হবে। একটি সম্পর্ক শুধু সম্মানের উপর নির্ভর করে ঠিকেনা, আন্ডারস্ট্যান্ডিং না থাকলে সে সম্পর্ক বেশিদিন টিকেনা। আমি চাই, আমার মেয়ের জীবনটা এমন কারো সাথে জুড়ুক, যে আমার মেয়েকে বুঝবে। তারভুলগুলো শুধরে দিয়ে নতুন পথ দেখাবে। আমি নিনিতের মাঝে এমন কিছু দেখতে পায়নি ভাই।

নিয়াজ সাহেব বললেন,
‘ জালিশা কি বলছে?
আইমি বলল,
‘ জালিশা কিছু বলছেনা কানাডা ফেরার ব্যাপারে। বিয়ে দেব, বলেছিলাম তাই বলেছিল বিয়ে নাকি করবেনা।
নিয়াজ সাহেব কিছু বললেন না। নিকিতা বেগম আসতেই আইমি সরে গেল। নিয়াজ সাহেব বললেন,
‘ এসব কি হচ্ছে নিতা? জালিশাকে যেতে দিচ্ছ তুমি?
নিকিতা বেশকিছুক্ষণ পর বললেন,
‘ জালিশা নিজেই চলে যেতে চাইছে। সেখানে আমি আটকানোর কে?

____________________

খয়েরী রঙের শাড়ি পড়ল পিহু। বিছানায় আলুথালু হয়ে ঘুমানো বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে ডাকল,
‘ আব্বা আর কতক্ষণ ঘুমোবেন? এই আব্বা
ছিকু নড়ল। ঠাসস করে চড় বসাল পিহু নাকে। বলল,
‘ পিহু ঘুম যেতে দেয়না কেন? ছিকুর কান্না পায় কেন?
পিহু হাসল। রাহির গালের সাথে গাল লাগিয়ে বলল,
‘ মেরেছেন। আমি মিহিকে বলে দেব।
ছিকু চোখ বড় বড় করে তাকালো। বলল,
‘ মিহি বর?
পিহু বলল,
‘ হ্যা, আমার বরকে বলে দেব।
ছিকু চোখ কচলে কচলে বলল,
‘ তুমার বর পুঁচা কেন? মিহি পুঁচা কেন?
পিহু হাসল। বলল,
‘ আসলেই পুঁচা। কই যে গেল আর এলোনা।
মিহিকে বউ মিস করে বুঝেনা কেন?
ছিকু মাথা দুলিয়ে বলল,
‘ কেন বাপ কেন? বউ মিস করে কেন?

রিপ আসল। পিহু তাকে দেখে গাল এলিয়ে হাসল। ছিকুকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে রিপের কাছে দৌড়ে গেল। ঝাপটে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ লাভ ইউ মামা।
রিপ হেসে দিল। পান্জাবীর পকেট থেকে বের করল কয়েকটা কাগজের ছোট ছোট নৌকা। পিহুর হাতের মুঠোয় দিয়ে বলল,
‘ চিঠিগুলো ও তোমাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। তখন ও বুঝোনি, আজ ও না। নিহাকে নয় চিঠিগুলো সে তোমাকে দিত। ও জানত নিহাকে দেওয়ার আগে চিঠিগুলো তুমি পড়ো।
পিহুর দুচোখ ছলছল করে উঠে। সেই নৌকাগুলো, যেগুলো সে মাহিদ কানাডা চলে যাওয়ার দিন ছাদে ছাদে বসে বানিয়েছিল। মামা এগুলো যত্নে রেখে দিয়েছে?
ছিকুর অবাক চাহনি দেখে রিপ হেসে ফেলল আবার। পিহুর কপালে চুম্বন এঁকে বলল,
‘ আমি কিন্তু শ্বশুড়আব্বা। তাই আব্বা ডাক শুনতে চাই আজ থেকে। মামা টামা চলবে না।
পিহু হেসে আর ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রিপকে। ডাকল,
‘ আব্বা!

রিপ তৃপ্তির হাসি দিল। এত সুখ কেন এই ডাকটিতে?
রিপ বলল,
‘ তোমার বর কোথায়? তোমার সাথে কথা টথা বলেছে?
পিহু বলল,
‘ না দেখিনি তো।
রিপ হাসি আটকে রাখতে পারল না।
পিহু লজ্জা পেয়ে গেল। রিপ বলল,
‘ লজ্জা পেতে হবেনা। গাধাটা একটু অমন। মানিয়ে নিতে পারবে।
রিপ চলে গেল। পিহু হাসল,
‘ মানিয়ে নিতে পারবে মানে? মানিয়ে নিতে না পারলে ও তার মাহিদ ভাইকেই চাই। পাগল বরটাকে ৷ চাই চাই।
__________________

বাড়ি ফেরার পথে মাহিদের ফোন বেজে উঠল। জালিশার নাম্বার স্ক্রিনে।
‘ মাহিদ ফোন কানে দিতেই জালিশার ফুঁপানোর আওয়াজ ভেসে উঠল৷
মাহিদ বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ কিতা হইছে বাপ?
জালিশা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ স্যার আমি চলে যাচ্ছি।
মাহিদ অবাক হলো। কিন্তু দেখালো না। বলল,
‘ হানিমুন করতে যাইতাছো?
জালিশা বলল,
‘ স্যার কেন ইয়ার্কি করছেন?
মাহিদ হাসল। বলল,
‘ আমি কিতা করবার পারি বাপ?
জালিশা বলল,
‘ আমি আপনার বাপ নয় স্যার? আর কথাগুলো বুঝতে কষ্ট হচ্ছে আমার।
মাহিদের গালি দিতে ইচ্ছে হলো বিদেশী ছেড়িটাকে৷
কিন্তু দিল না। বলল,
‘ এখন ঝামেলা করতাছো ঠিকআছে, রাতে টাতে ডিস্টার্ব কইরোনা।
জালিশা বোকাবোকা প্রশ্ন করল,
‘ রাতে কেন? স্যার।
মাহিদ ধমক দিল,
‘ চুপ একদম। আমি আইতাছি খাঁড়াও।
জালিশা কেঁদে দিয়ে বলল,

‘ স্যার আমি এয়ারপোর্টে, কিছুক্ষণ পর ফ্লাইট।
মাহিদ গর্জে বলল,
‘ তোমার মাথা খারাপ জালিশা? নিনিত কোথায়?
জালিশা বলল,
‘ উনি হসপিটালে।
‘ ফ্লাইট কখন?
জালিশা উত্তর দিল
‘ সন্ধ্যা ছয়টায়।
মাহিদ বলল,
‘ খাঁড়াও আমি ওই নিনিতরে আজ ডক্টর থেকে রোগী বানামু। শালা বউ চইলা যাইতাছে তার খবর নাই।

_______________________

মাহিদ যখন হসপিটালে পৌঁছালো তখন সাড়ে পাঁচটা। এয়ারপোর্টে পৌছাতে লাগবে আর ও একঘন্টার মতো৷ মাহিদ নিনিতকে খুঁজে ঘাড়ে জোরে কিল বসালো। বলল,
‘ তুমি এখানে রংতামাশা করো মামা? তোমার বউ পালাইতাছে।
নিমিত কপট রাগ নিয়ে বলল,
‘ তো আমি কি করব? যাচ্ছে যাক না।
মাহিদের রাগ চেপে গেল। গর্জে বলল,
‘ এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলি না? তোরা কি মানুষ?। নিনিত সোজা উত্তর দিল,
‘ বাবা গিয়েছে। মা ও।
মাহিদ বলল,
‘ তোর মা?
নিনিত বলল,
‘ হ্যা।
মাহিদ বলল,
‘ যাহ। জালিশাকে যেতে দিস না। নিয়ে আয়। কানাডার এতগুলো মেয়ে ছেড়ে আমার সাথে ওর কেন বন্ধুত্বটা হলো সেটা জানতে চাইলে আমি বলব,
‘ ওর মনমানসিকতা অনেক সুন্দর নিনিত। আমার সব স্টুডেন্ট থেকে আমি ওকে বেশি প্রায়োরিটি দিতাম। আমাদের মাঝে ছাত্রী শিক্ষকের সম্পর্কটা কম, কিন্তু বন্ধুত্ব বেশি।
নিনিত বলল,
‘ আমি কি করব? জালিশা নিজেই চলে যেতে চাই। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কাল।
মাহিদ জোরে চড় বসালো নিনিতের পিঠে। হাত জ্বলে উঠল তার। নিনিত বলল,
‘ এভাবে মারিস ক্যান শালা?
মাহিদ বলল,
‘ যাও না মিয়া। ওই ছেড়ি তোমারে ভালোটালো বাসে বাপ। যাও, অতিসুন্দরী বউ আর পাইবানা বাপ। একটা তো মিস গেল। এটারে মিস হতে দিওনা বাপ।
নিনিত মাহিদের পিঠে একটা বসিয়ে বলল,
‘ তুমি মামা তলে তলে টেম্পু চালাও তাই মিস গেল আরকি। যাইহোক, আমি যাই, চলে গেলে আর নাই।
মাহিদ বলল,
‘ নাই মানে। জালিশা চইলা গেলে তোরে আমি আর জীবনে বিয়া করতে দিতাম না বাপ। কই দিলাম। আজ লইয়া আইবি,আজ বিয়া কইরা লইবি।
নিনিত বলল,
‘ না আসলে নাই। আমি ও তার চাইতে কম না।

_________________________

মাহিদ ঘরে ফিরল। বাইক দাঁড় করিয়ে বাড়িতে ডুকল। রিক,রিপ আর আদি, আফি মিলে তখন টিভিতে নিউজ দেখছে। রিপের পাশে বসা পিহু। তার কোলের উপর বসা ছিকু। মাহিদকে দেখে আফি লাফিয়ে উঠল,
‘ কই গেলি ব্যাটা? আমরা কি যামুনা?
মাহিদ বলল,
‘ না যাবেনা। নাইওর করো। থাকো। সেখানে গিয়ে কি করবে?
আদি হেসে ফেলল। বলল,
‘ জামাই বাবাজি পালায় পালায় থাকেন কেন আজকাল?
মাহিদ লজ্জা পেয়ে গেল।
‘ শ্বশুরআব্বা আর কথা পাইলোনা বাপ।
পিহু আড়চোখে তাকালো। ছিকুকে কোলের উপর ভালো করে বসিয়ে বলতে বলল,
‘ টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার!
রাহি মাথা নিচু করে গাড়ি নিয়ে খেলতে খেলতে বলল,

‘ তুয়িংকোল তুয়িংকোল লিতোল এচতার।

পিহু বলল,

হাউ আই ওয়ানডার, হুয়াট ইউ আর?

রাহি বলল,

‘ আউ আই ওয়ানদার, য়ুআত ইউ আর।

‘ আফ এভোব দ্য অলসো হাই।

‘ আব এভুব দা অুলসো হায়।

লাইক এ ডায়মন্ড ইন দ্য স্কাই।

‘ লাক এ দায়মন্ড ইন দা এচকাই। মিহি এভাবে তাকায় কেন?

মাহিদ চট করে চোখ সরিয়ে নিল৷ পিহু চোখ তুলল। মাহিদ হাঁটা ধরল। পিহু হেসে দিল। মাহিদ যেতে যেতে বিড়বিড় করল,
‘ রেহাইন্নের বাচ্চা ছিকু,তুই আমার বউয়ের উপর এইভাবে বইসা আছস ক্যান বাপ? মাইরা ফেলতাছোস।

_____________

নীরা মাহিদের পিছু পিছু ঘরে ডুকল। বলল,
‘ আব্বা সারাদিন কই ছিলি? নতুন বউ রাইখা এদিকওদিক ঘুরোস ক্যান? বইয়ের লগে দু চারটা কথা কইবি। মাহিদ বলল,
‘ আমার শরম করে।
নীরা বড় বড় চোখ করে তাকালো।
‘ ও মাগো, আমার বাচ্চাটার আবার ও লজ্জা ও আছে। ও আল্লাহ আমি এটা কি শুনলাম আব্বা?
মাহিদ বলল,
‘ মেরি মা পেটে ইঁদুর বাপ লাফাইতাছে। হেতের শান্ত করানোর দরকার।
নীরা হেসে ফেলল। বলল,
‘ তারে শান্ত করায় দিমু আব্বা। আমি সব ব্যবস্থা কইরা লইছি। আয় তোরে নিজ হাতে খাওয়ামু।
মাহিদ বলল,
‘ নিচে যামুনা বাপের বউ। ওখানে সবাই কেমন কইরা তাকায়, আমার শরম করে। বুঝোনা?
নীরা বলল,
‘ আইচ্ছা আমি এইহানে লইয়া আয়। তুই দাঁড়া।
মাহিদ ফ্রেশ হতে গেল। ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই নীরা দৌড়ে আসল। বলল,
‘ আব্বা আয়। আয়। খাইয়ে দিই।
মাহিদ বলল,
‘ আহো আহো। বইসা জিরাও আগে। খাবার খুঁজলে আমি এমব করো ক্যান?
নীরা বলল,
‘ আমার বাচ্চাটা খাবার চাইলে মেলা খুশি লাগে আমার। তুই বুঝবি না আব্বা।
মাহিদ বলল,
‘ এত বড় বড় করে দিওনা বাপের বউ। আমার গলায় গিয়া আটকায় যায়। বুঝোনা?
নীরা বলল,
‘ আইচ্ছা দিমুনা আব্বা। ছোট ছোট কইরা দিমু।
নীরা খাওয়ানো শেষ করে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ছেলের মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলে,
‘ আমার বাচ্চাটা নাকি বিয়া কইরা ফেলছে। আমার এখনো বিশ্বাস হয়নাই বাপ। মনেহয় এইদিন আমি তোরে কোলে নিয়া আদর করতাছি।
মাহিদ নীরাকে টেনে ধরল। নীরাকে বসিয়ে কোলে মাথা রেখে বলল,
‘ মেরি মা কোলে চড়া ও।
নীরা হাসল। ছেলের চুলে বিলি কাটতে কাটতে কপালে চুমু দিয়ে বলল,
‘ আমার আব্বা।
মাহিদ হাসল। নীরার কপালে ভালোবাসা দিয়ে ডাকল,
‘ মেরি আম্মা। তোমার ব্যারিস্টার বর আমাকে বকা টকা দিছেনি?
নীরা বলল,
‘ না দেইনায়। তোর মা আছে না? তোর বাপ তোর মারে ডরাই। বুঝোস না?
মাহিদ হা হু করে হেসে উঠল। রিপ বাইরে থেকে ডাক দিল,
‘ নীরা????
নীরা শুকনো ঢোক গিলল। মাহিদকে বলল,
‘ তুই আমারে ফাঁসাই দিলি বাপ।
মাহিদ হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খেল।
নীরা ডাকল,
‘ অ্যাই ব্যারিস্টার ডাকলেন কেন?
রিপ কড়া চোখে তাকালো। নীরা আমতাআমতা করে বলল,
‘ ভয় পাচ্ছি তো।
রিপ বলল,
‘ আমি পাচ্ছি ভয়। খুব ভয় লাগছে।
নীরার সাহস হলো। শাড়ির আঁচল ভালো করে গায়ে টেনে গিন্নির মতো করে বলল,
‘ ওকে ওকে, আর বেশি ভয় পেতে হবেনা। আপনি আমার বর,আপনাকে আমি কিছু করবনা। হয়েছে আর ভয় পাইয়েন না।
রিপ জোড়াল কন্ঠে ধমক দিল,
‘ একদম চুপপপ।
নীরা কাঁদোকাঁদো হয়ে গেল। রিপ বলল,
‘ এদিকে এসো। চলে এসো। পিহু তোমার জন্য ঘরে আসতে পারছেনা। আসো।
নীরা দৌড়ে আসল। বলল,
‘ আপনি খুব ভালো ব্যারিস্টার। আমার ভালো বর। নীরার বর।
রিপ মাথা নাড়িয়ে চলে যেতে যেতে হাসল। সে নিজেই অবাক, বিস্মিত,
‘ এই পাগল মেয়েটাকে সে শেষপর্যন্ত ভালোবেসে ফেলল?

মাহিদ পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল পিহুর চুড়ির ঝুনঝুন শব্দ শুনে। পিহু কাউকে না দেখার মতো করে ঘরে ডুকে পড়ল। আড়চোখে বিছানার দিকে তাকাতেই দেখল বিছানার চাদরটা এলোমেলো। অসভ্য ছেলে, হাসতে হাসতে এলেমেলো করে ফেলেছে। পিহু বিছানার চাদরটা ঠিক করতে মনোযোগ দিল। ভাবল মাহিদ বোধহয় ওয়াশরুমে। মাহিদ পর্দার আড়ালে থেকে মুখটা দুই পর্দার মাঝখানে দিয়ে বের করে পিহুকে দেখল। পিহু চট করে ঘাড় ঘুরালো। মাহিদ আবার আড়াল হয়ে গেল। পর্দা নড়ে উঠায় পিহুর ভ্রুকুঞ্চন হলেও বেশিক্ষণ ভাবল না সে। মাহিদ আবার মুখ বের করে দিয়ে মনে মনে বলল,
‘ ওরেব্বাপ ডাক্তারের বাচ্চি শাড়ি পড়ছে। মেলা সুন্দর লাগতাছে। চোখ ঝলসে গেল বাপ।
পিহু পিছু আর তাকালো না। আয়নায় তাকালো। হেসে ফেলল মনে মনে। পিছু হেঁটে হেঁটে চট করে পর্দাটা সরালো। মুখোমুখি চোখাচোখি একে অপরের। মাহিদ চট করে চোখ নামিয়ে ফেলে মনে মনে বলল,
‘ ডাক্তারের বাচ্চি এমন কইরা তাকায় ক্যা? লজ্জা করে তো বাপ? বুঝেনা ক্যা?
পিহু ঠোঁটের কোণায় হাসি ধরে রাখল। মাহিদ একবার তাকিয়ে আবার মাথা নামিয়ে ফেলল। পিহু তার দিকে একটু ঝুঁকে ফুঁ দিল মুখ বরাবর।
মাহিদ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আবার মাথা নামিয়ে ফেলল। তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বের হতে হতে বলল,
‘ আমি মইরা গেলাম বাপ। মইরা গেলাম।
পিহু হাসতে হাসতে বিছানায় ঢলে পড়ল।

_________________________

গাড়ির উপর নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে রইল নিনিত। তখন প্রায় রাত সাড়ে এগারটা। জালিশা সেই কখন চলে গিয়েছে, অথচ সে এভাবে বসে রয়েছে কয়েকঘন্টা প্রায়। শহরের রাস্তা আলোকিত ল্যাম্পপোস্টের আলোয়। গাড়ির উপর বসা অবস্থায় সে মাথা ঝুঁকিয়ে রাখল। ফোন বেজে উঠল। নিয়াজ সাহেব ফোন দিয়েছে। নিনিত ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে তিনি কাঠ কাঠ গলায় জবাব বললেন,
‘ বাসায় আয়।
নিনিতের চাপা রাগ দেখিয়ে বলল,
‘ ফিরব৷ চিন্তার কিছু নেই।
নিনিত ফোন কেটে দিল । চলে আসার সময় অজানা অচেনা কারণে বারবার পিছু ফিরে তাকাল।

___________________

রাহি বিছানার উপর উঠে দাঁড়ালো। চারদিকে এত ফুল আর ফুল দেখে খুশিতে সে উরুধুরা নাচল। পিহু হেসে কূল পেলনা। রাহি কোমরে হাত দিল। কালা চশমাটা পড়ে কালো টিশার্টের হাতা গুটিয়ে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে গাইল,
‘ ওহহ কাল চশমা।
গোরে গোরে মুখড়ে পে কালা কালা চশমা।
পিহু হাসতে হাসতে ঢলে পড়ার অবস্থা হলো। পরী আসল। বলল,
‘ ছিকুসোনা এসো,আমরা চলে যাই। এসো।
পিহু বলল,
‘ না ও থাকুক। তুমি যাও।
পরী বলল,
‘ তোমার বর আসবে ও না। ততক্ষণ আমরা মা ছেলে বসে থাকতে পারব না। রাহি আসো ঘুমিয়ে যাবো।। রাহি চশমা দিয়ে এদিকওদিক তাকিয়ে গাইল,
‘ গোরে গোরে মুখড়ে পে কালা কালা চশমা।
পরী বলল,
‘ হয়েছে। আর গান গাইতে হবেনা।
রাহি চশমা খুলে টিশার্টের সামনে ঝুলিয়ে রাখল। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
‘ ছিকুর গান বিটিফুল বুলেনা কেন?
পরী বলল,
‘ আচ্ছা বলেছি। এবার এসো।
রাহি বলল,
‘ ছিকুর এখানে থাকতে মন চায় কেন? যেতে ইচ্ছে করেনা কেন?
পরী,পিহু হাসল। পরী রাহিকে কোলে নিয়ে নিল। বলল,
‘ আজকে গপ্প শোনাবো।
রাহি দাঁত দেখিয়ে হাসল। বলল,
‘ ছিকু গপ্প শুনবে কেন?
পরী বলল,
‘ এত প্রশ্ন করেন কেন?
পরী রাহিকে নিয়ে গেল। রেহানের গায়ের উপর ছেড়ে দিয়ে বলল,
‘ আমরা মা ছেলে চলে এসেছি। আপনি সাইড চাপেন মশাই।
রাহি রেহানের গায়ের উপর উঠে বসে। হাত দুটো বাড়িয়ে গাড়ি চালায়। ভুউউউ ফিপফিপ।
রেহান ঘুম চোখে বলল,
‘ কি করছ রাহি। পাপা ঘুমোচ্ছে তো।
রাহি চোখ পিটপিট করে তাকালো। বলল,
‘ রেহান পরীকে ছাড়া ঘুমোয় কেন?
পরী হেসে দিল। বলল,
‘ রেহান পুঁচা।
রাহি ও পরীর মুখে মুখে বলল,
‘ রেহান পুঁচা। ছিকুর পাপা পুঁচা কেন? পরীর বর পুঁচা কেন?
রেহান রাহিকে বিছানায় ফেলে দেয়। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে পেটে সুড়সুড়ি দিয়ে বলে,
‘ পরীকে বলো একটা বোন লাগবে।
রাহি মাথা নাড়িয়ে খিলখিল করে হেসে বলে,
‘ না বউ লাগবে। বোন লাগবেনা কেন?
রেহান বলল,
‘ ধুরর।
রাহি বলল, ধুরর কেন?
রেহান জোরে চুমু বসাল রাহির গালে। বলল,
‘ আসো ঘুমায়। পরীকে গুড নাইট বলো।
রাহি গাল ঘষে ঘষে বলে,
‘ পরীকে আদল করোনা কেন?
রেহান ডাকল।
‘ পরী এসো, আদল কলি। আসো।
রাহি বলল,
‘ রেহান এভাবে বুলে কেন?
রেহান রাহির মুখ চেপে ধরল।
‘ আমাকে ঘুমাতে দে বাপ আমার। বকবকানি বন্ধ কর।
রাহি কাঁদোকাঁদো উঠে বসে রেহানের চটাস করে চড় মেরে বলল,
‘ আমি ইখানে সুসু করে দেব,মেরেছ কেন?
রেহান ধমক দিল৷
‘ একদম চুপ রাহি। চুপচাপ ঘুমাও।
রাহি হাত টেনে পরীকে ডাকল।
‘ পরী আসেনা কেন? ছিকু ভয় পাই কেন?
পরী গেল। কাত হয়ে শুয়ে পড়ল রাহির পাশে। রাহি মায়ের বুকে গুজে গিয়ে ডাকে,
‘ রেহান পুঁচা। পরীর বর পুঁচা কেন? ছিকুর পাপা পুঁচা কেন?

________________________

রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। বারন্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বধূটির শান্ত,অচঞ্চল চোখদুটি স্থির রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টের কাছে। শাঁ শাঁ বাতাসের আওয়াজ স্পষ্ট। এই ঝড়বাদলের দিনে এত রাত করে বাড়ি ফেরার কোনে মানে আছে? পিহু ভেবে পায়না, ছেলেটি কি ইচ্ছে করেই তাকে দূরে দূরে রাখছে? কত জমা,কত আলাপ জমে আছে!
ঘড়ির কাঁটা নিজস্ব গতিতে চলছে। শাঁ শাঁ বাতাসের ঝাপটা এসে পিহুর মুখ ভিজিয়ে দিয়ে গেল৷ রাতের নিশাচর পাখিরা একদৃষ্টিতে হয়ত চেয়ে রয়েছে মলিন মুখের বধূটিকে। ঘাম, বৃষ্টির ছিটকি, নয়ত নোনাজল কিছু একটাতে ভরপুর মেয়েটির স্নিগ্ধ মুখটি। খুব কাছ থেকে দেখলেই হয়ত বুঝা যাবে।
পিহু গুটিগুটি পায়ে হেঁটে রুমে চলে আসল। ছেলেটি নিশ্চয়ই আজ বাড়ি ফিরবে না। কাল ও ফিরেনি। পিহু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গাল মুছে নিল। নাকের নথটা খুলে ফেলতেই নড়ে উঠল পেছনের পাতলা পর্দা। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সাদা ধবধবে পান্জাবী পড়া সুঠাম দেহের পুরুষের অবয়ব। পিহু দাঁড়িয়ে থাকল শক্ত হয়ে। গাঢ় অভিমানে সিক্ত হয়ে চোখ তুলল না।
বড় মামি কি কি যেন শিখিয়ে দিল। পিহুর কিচ্ছু করতে ইচ্ছে হলোনা। সে একটা কথা ও নিজ থেকে বলবে না। ছেলেটি পর্দা সরিয়ে দুকদম এগিয়ে এল৷ দুজনই মুখোমুখি হওয়ায় আড়ষ্টতায় পড়ে গেল। মাহিদ এদিকওদিক তাকিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল অভিমানিনীর চেহারায়। বাঁকা হেসে অন্যদিকে চলে গেল সে। পিহু ডুকরে কেঁদে উঠল। পরক্ষণে ছেলেটি না শোনেমত নিজেকে সামলে নিল।
ছেলেটির সামনে গিয়ে নিচু হয়ে পা ছুঁতেই ছেলেটি সরে গেল তাড়াতাড়ি। বলে উঠল,
‘ না না না।
পিহু উঠে আয়নার সামনে গিয়ে বসে পড়ল ধপ করে। হাতের কব্জি দিয়ে চোখ মুছে নিল। ছেলেটি ওই দূর থেকে আড়চোখে তাকিয়ে রইল। মেয়েটি কেঁদে কেঁদে এক এক করে খুলে ফেলল কানের দুল, নাকের নথ নেকলেস, মাথার টিকলি,হাতের চুড়ি। রেগেমেগে দূরে ছুড়ে ফেলে দেয় সেগুলো।
তারপরে আয়নার সামনে চোখ বন্ধ করে থমথমে মুখে বসে থাকে। বহুকষ্টে আটকায় চোখের জল৷ ছেলেটি এক এক করে কুড়িয়ে নেয় চুড়ি,টিকলি,নেকলেস,নাকের নথ। মেয়েটির পেছনে এসে সেগুলো রেখে দেয় ড্রেসিং টেবিলে, তারপর আয়নায় একবার মেয়েটিকে দেখে হাসে।

মেয়েটি চোখ খুলে ছেলেটির হাসি দেখার সাথে সাথে জোরে আওয়াজ করে কেঁদে দেয়। ছেলেটি আবারও হেসে মাথা চুলকায়। পিহু অসীম আক্রোশে ফেটে পড়ে দাঁড়িয়ে যায়। পিছু ফিরে ছেলেটির কলার জোরে টেনে ধরে মাথা রাখে গলার কাছে। কিছুক্ষণ আঁখিজলে ভাসিয়ে দিয়ে চলে যেতে চাইলে আর যেতে পারেনা। আটকা পড়ে গেল ছেলেটির বাহুবন্ধনে। পিহু জোরে উঠা হিঁচকি সামলাতে পারল না। ছেলেটি কোনো আওয়াজ করল না। মেয়েটিকে আয়নার সামনে ফিরিয়ে আঙুল দিয়ে আয়নায় মেয়েটির প্রতিচ্ছবি দেখিয়ে দেয়। মেয়েটি ততক্ষণে নিজেকে নয়, নিজের একহাত দিয়ে আগলে ধরা মানুষটাকে দেখতে ব্যস্ত।
পিহু ধস্তাধস্তি শুরু করল সামান্য সামান্য। ছেলেটি হেসে পকেট থেকে কিছু একটা বের করল। মেয়েটির হাত তুলে আয়নার দিকে তাকিয়ে থেকে পড়িয়ে দিল ডায়মন্ড রিং। তারপর আবার হুট করে কোথায় যেন চলে গেল। পিহু ততক্ষণে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখল আয়নায় নিজের হাতের অনামিকা আঙুলটির উপর। হুশ ফিরতেই দেখা মিলল ছেলেটির। আবার ও দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো আয়নায়। ছেলেটি তার কাঁধ ছুয়ে সরালো চুল। পড়িয়ে দিল চেইন। পিহু তরতর করে কাঁপতে কাঁপতে কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেল
এই মানুষটি একটু দুষ্টু নয়। একটু খারাপ না। বরঞ্চ একটি ভালোবাসার মানুষ, প্রেমিক, যত্নবান স্বামী। পিহুর গাল বেয়ে বোবাকান্নার নোনাজল গড়াল। ছেলেটি তার গায়ে জড়িয়ে দিল লাল টকটকে বেনারসি শাড়ি। এমন শাড়ি সে পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু রিপ মামা অন্য রঙের শাড়ি এনেছিল। ছেলেটি কিভাবে জানল? মনের মানুষ বলে?
পিহু পিছু ফিরে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাল ছেলেটির দিকে। ছেলেটির চোখ থেকে সরে দুষ্টুমির আভাস রয়ে গেল গাম্ভীর্য। পিহুর কৌতূহলী চোখ বোধহয় বুঝতে পারল ছেলেটি। একটু ঝুঁকে পড়ে পিহুর নাকের সাথে নাক ঘষে বলল,
‘ কানাডা থেকে এনেছি।
পিহুর এবার আওয়াজ করে কেঁদে দিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরল ছেলেটিকে। কতকিছু ভেবেছিল সে। ছেলেটি তার মুখ আগলে ধরল। পিহুর নাকের একপাশ তার নাকের সাথে লাগিয়ে জোড়াল শ্বাস টেনে বলল,
‘ আমি ছিলাম, আছি, থাকব বাপ। কান্দোস ক্যা? তুই কাঁদলে ও আমার শরম করে।

চলবে,
গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here