মন_কেমনের_বৃষ্টি #পর্ব_৩১(সিজন ২)

0
680

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩১(সিজন ২)
পুষ্পিতা_প্রিমা

বারান্দার গ্রিল পেড়িয়ে সকালের স্নিগ্ধ নরম আলো এসে পড়েছে মেয়েটির মুখে। পাখির কিচিরমিচির ডাক শোনা যাচ্ছে। কিছুটাদূরে বকুল ফুলের গাছটি স্পষ্টয়মান। তাজা বকুল ফুলের সুগন্ধ ভেসে আসছে গাছটি থেকে। গতরাতের ঝড়বাতাসে বকুল ফুল ঝড়ে পড়েছে অনেক। দেখে মনে হচ্ছে মাটিতে সাদা শুভ্র মেঘের টুকরো পড়ে রয়েছে। দুহাতে দিয়ে নরম রোদ মুখে মাখল মেয়েটি। শাঁড়ির আচঁলটা মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে মনে হতেই মেয়েটি শাড়ির আচঁল তুলে নিল। গুটিগুটি পায়ে হাঁটা ধরল নিজের ঘরের দিকে। বিছানায় কাত হয়ে ঘুমানো ছেলেটিকে দেখে মৃদু হাসল। কাছে গিয়ে ছেলেটির পাশে বসে ছেলেটিকে গলা উঁচিয়ে দেখতেই টের পেল ছেলেটি ঘেমে একাকার। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। পিহু ছেলেটিকে ফেরানোর চেষ্টা করল। শাড়ির আঁচল দিয়ে ছেলেটির কপাল, মুখ মুছিয়ে দিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে ডাকল,
‘ জাতির ভাই?
মাহিদ কপাল কুঞ্চন করল কিন্তু চোখ খুলল না। বিড়বিড় করে বলল,
‘ শালার বউ। ঘুমের মাঝে আইসা ডিস্টার্ব করে।
পিহু হেসে ফেলল৷ মাহিদের মুখের উপর ফুঁ দিয়ে বলল,
‘ শালার জামাই। অ্যাই ব্যারিস্টারের বাচ্চা?

মাহিদ পিটপিট করে চোখ খুলল৷ চোখ বড় বড় করে তাকালো পিহুর দিকে। ঢোক গিলল। এদিকওদিক তাকিয়ে নিজেকে উদাম গায়ে দেখে নিজে নিজে কাঁথার ভেতর ডুকে পড়ল। মুখের উপর কাঁথা দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘ এত শরম করে ক্যা বাপ?
পিহু আওয়াজ করে হেসে দিল। হাসতে হাসতে ঢলে পড়ল কাঁথায় মোড়ানো ছেলেটির গায়ের উপর। ছেলেটি কাঁথাটি আর ও শক্ত করে ধরে রাখল।
পিহু জোরে টান দিয়ে সরিয়ে ফেলল কাঁথাটি। ছেলেটির মুখের উপর শ্বাস ফেলে বলল,
‘ কি শরম। বাপরে বাপ!
মাহিদ চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলল,
‘ বাপ মইরা গেলাম। বেয়াদব বউ আমার। এমন করে ক্যা? আমার শরম করে না বাপ?

পিহু আর ও জোরে হাসল। ছেলেটির গলার কাছে নাক ঘষতে ঘষতে কামড় বসিয়ে বলল,
‘ শরম পাইলে বিয়া করছেন কিল্লাই?
মাহিদ ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল তাকে। হনহন পায়ে হেঁটে গলার পাশ ম্যাসাজ করতে করতে ওয়াশরুমে ডুকে ধপ করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল,
‘ বেয়াদব বউ। মইরা গেলাম বাপ৷ কামড়ায় আমারে খায় ফেলল।
পিহু হাসতেই থাকল। গুটিগুটি পায়ে ঘুমুঘুমু চোখ নিয়ে হেঁটে ঘরে ডুকে এল একটি বাচ্চা ছেলে৷ পিহুকে হাসতে দেখে কোমরে হাত দিয়ে রাগীসুরে বলল,
‘ পিহু এভাবে হাসে কেন? ছিকুর রাগ হয় কেন?
পিহু হাসল। হাত টেনে ডাকল,
‘ এদিকে এসো আব্বা। আসো।
ছিকু মুখ মোচড়ে ডাকল।
‘ মিহি কুথাই। কুথা বুলেনা কেন?
পিহু হেসে দিল। বলল,
‘ মিহি পুঁচা।
ছিকু বলল,
‘ পিহুকে বরকে এভাবে বুলে কেন?
পিহু বলল,
‘ এত প্রশ্ন করেন কেন বাপ? ভাল্লাগেনা।
ছিকু প্রশ্ন করল আবার।
‘ ভাল্লাগেনা কেন?

___________________

সকালে নাশতার টেবিলে সব ছেলেমানুষরা বসেছে । পরী আর নীরা সবাইকে খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। মাহিদের পাশের চেয়ারে বসা রাহি। মাহিদ মাথা নিচু করে গলাঃধকরণ করছে কোনোমতে। রাহি চেয়ারে বসা অবস্থায় খেতে পারল না। তাই রেহান তাকে দাঁড় করিয়ে দিল। মাহিদ গ্লাস টানার একপর্যায়ে রাহি গ্লাসটা হাতে নিয়ে নিল। ছোট্ট ছোট্ট দুহাত দিয়ে পানি ভর্তি গ্লাসটা কোনোমতে তুলে মুখ ডুবিয়ে দিল গ্লাসে। লাল টকটকে ঠোঁট দুটো ডুবিয়ে তপাস তপাস করে পানি খেতে খেতে শ্বাস নিল রাহি। পড়নের শার্টের সামনের অংশ ভিজে গেল। মাহিদ তাকাল চেহারা কুঁচকে। মনে মনে গালি দিল,
‘ শালার রাক্ষস, তোর মতো রাক্ষসরে জীবনে ও মাইয়া দিতাম না আমি। দেইখা লইস বাপ।

রাহি পানি খেয়ে শ্বাস নিতেই মাহিদকে ওভাবে তাকাতে দেখে বলল,
‘ ওভাবে দিখো কেন? হাসোনা কেন?
সবাই তাকালে মাহিদ আবার মাথা নামিয়ে ফেলল। রাহি আবার ও গ্লাসে মুখ চুবানোর পর, মুখ তুলে বলল,
‘ আমি মিহিকে কামড় দিইনি কেন?
রেহান বলল,
‘ কামড় দিয়েছ?
রাহি মাথা দুলালো। মাহিদ তাড়াতাড়ি গলার পাশে হাত দিল।
‘ শালার জামাই তুই শ্বশুড় শ্বাশুড়ির প্রেমপিড়িতি দেখবি কিল্লাই? শালার ভিলেন।
রাহি দাঁত দেখিয়ে হাসল।
‘ আঙুল দিয়ে মাহিদের গলা দেখিয়ে বলল,
‘ মিহিকে কামড় দিয়েছে কেন? মিহি কান্না করেনা কেন?
রেহান জিজ্ঞেস করল,
‘ কে কামড় দিয়েছে?
পিহু সোফায় বসা অবস্থায় মিটিমিটি হেসে ফেলল। কানবন্ধ করে রাখল রাহির মুখে কথা না শোনার জন্য।
রাহি কিছু বলার আগে মাহিদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। গর্জে রাহিকে বলল,
‘ চুপ থাক শালা। এত কথা কস কিল্লাই? তুই কামড় দিয়া আবার কথা কস? দাঁত সব এক এক করে খুইলা ইদুঁর বাপরে খাওয়ামু। রাহি পানি এক ঢোক খেয়ে বলল,
‘ মিহি বকে কেন? মিহি পুঁচা কেন? পিহু কামড় দিয়েছে বুলেনা কেন? মিহি মিছি বলে কেন?
মাহিদ আর দাঁড়াল না। গটগট আওয়াজ তুলে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
‘ তুই আমার ছেড়ির দিকে তাকালেই তোরে খাইছি শালা। বেয়াদব।
পিহু চুপিচুপি চলে গেল উপরে। পরী, ইশা,নীরা, মুনা পিহুর যাওয়ার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে কাজ করতে মনোযোগ দিল। খাবার টেবিলে খেলে গেল একপ্রকার নৈঃশব্দ্য। রাহি গলা উঁচিয়ে সবার মুখের দিকে তাকায়। তারপর বলে,
‘ কিউ কুথা বুলেনা কেন?
টেবিল কাঁপিয়ে হেসে উঠে সবাই। রিপ আর আদি তাড়াতাড়ি উঠে চলে যায়। রিক আর আফি থেকে যায়। আফি রিককে বলে,
‘ এরা হাসল ক্যান ভাই?
রিক পানি খাওয়া শেষে হেসে জবাব দিল,
‘ কি জানি?
রেহান রাহিকে হাসতে হাসতে নিয়ে যেতে যেতে বলে,
‘ শেষ করে দিলেন সব। মিহি আজ আপনাকে হাতের কাছে ফেলে খাইছে।
রাহি বোকাবোকা চেহারায় প্রশ্ন করে,
‘ মিহি ছিকুকে খাইছে কেন? মিহি রাক্ষুসী কেন?

__________________________

আদি বেরোনোর সময় ইশা পিছু ডাকল। বলল,
‘ বেরোনোর আগে পিহুর সাথে কথা বলুন ডক্টর।
আদি রাগীসুরে বলল,
‘ বলব।
ইশার মন খারাপ হয়ে গেল। বলল,
‘ কথাটা অন্যভাবে ও বলা যেত।
আদি ফিরে তাকায় ইশার দিকে। বলে,
‘ সরি মিষ্টি।
ইশা বলল,
‘ ঠিকাছে ডক্টর।
আদি ফিরল। ইশার মুখ দুহাতে আগলে ধরে বলল,
‘ মিষ্টি আমি সেই মিষ্টিকে ভালোবেসেছি যে আমার রাগের আড়ালে ভালোবাসাটা বুঝে নেবে।
ইশা আদির মুখপানে তাকায়। কন্ঠে একরাশ অভিমান নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ এখন কি আমি বুঝিনা?
আদি বলল,
‘ এখন যে রাগ করার অভিনয় করলাম, বুঝোনি তো?
ইশা বলল,
‘ আপনি রাগ করলে আমার ভালোলাগেনা ডক্টর। সেই শুরু থেকে আপনার রাগগুলোকে আমি বড্ড ভয় পাই ডক্টর। রাগ করে যদি হারিয়ে যান সেই আগের মতো?
আদি হেসে দিল। ইশার কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বলল,
‘ মিষ্টি আমি তোমার চোখের সামনে হারালেও যাতে মন থেকে না হারায়। আর ভয় কিসের আমি আছি তো। তুমি ও থেকো মিষ্টি। যাতে শেষ থেকে আবার শুরুটা হয়।

_________________

আদি বেরোবে এমন সময় পিহু আর পরী আসল। পরী বলল,
‘ আব্বা হসপিটাল থেকে আবার এখানে চলে এসো। আম্মা আর বড়মা আর দুদিন থেকে যাক। আমরা সবাই একসাথে ফিরব। পিহুকে ও নিয়ে যাব।
আদি কিছু বলল না। হাতে সাদা এপ্রোনটি নিতেই পিহু ধীরপায়ে হেঁটে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল তাকে। বাবার বুকে মাথা রেখে বলল,
‘ পাপা আসবেনা?
আদি চোখ নিচু করে মেয়েকে দেখল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। পিহু বলল,
‘ কথা বলছ না কেন?
আদি মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘ আসব।
পরী, ইশা খুশি হলো। পিহু হেসে মাথা তুলে আদির কপাল নিচে নামিয়ে চুমু খেয়ে বলল,
‘ বেস্ট পাপা ইন দ্য ইউনিভার্স। পাপা আসার সময় আইসক্রিম এনো।
আদি হাসল। বলল,
‘ আচ্ছা।
রাহি লম্বা লম্বা পা ফেলে আসল। কোমরে হাত দিয়ে বলল,
‘ আমাকে কিউ আদল করেনা কেন? ডকতর ছিকুর জন্য আইসকিম আনবেনা কেন?
ইশা আদি হেসে দিল। আদি তাকে কোলে তুলে মাথা দিয়ে পেটে সুড়সুড়ি দিয়ে বলল,
‘ আইসকিম খেলে আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে তাই। আর এত আদর খাচ্ছেন, তারপর এত আদরের অভাব কেন?
রাহি মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘ কিউ পাপ্পি দেয়না কেন?
আদি রাহির গালে জোরে কষে চুমু বসালো। বলল,
‘ এই যাও দিলাম।
রাহি দাঁত দেখিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল,
‘ রাহির বউ নাই কেন? বউ আদল করেনা কেন?
পরী মাথায় হাত দিল। বলল,
‘ দেখেছ? সারাদিন বউ বউ করবে। মাহি এসব কি শেখালো তাকে?
ইশা হেসে বলল,
‘ মাহি ও এমন বউ বউ করত? এখন রাহি করে। মামা, ভাগিনা দুইজনই সেম। কারো থেকে কেউ কম না।
পিহু মুখ মোচড়ালো।
‘ কচু বউ বউ করে। বউ ছুঁলেই চিল্লিয়ে উঠে।

__________________________

রান্নাঘরে নীরা হাত কেটে ফেলল। হাতে ব্যান্ডেজ করে দিল পিহু। নীরা হাতটা ঝাড়তে ঝাড়তে রিপের কাছে এসে বলল,
‘ অ্যাই ব্যারিস্টার?
রিপ টেবিলে বসে পেপারে কিছু কিছু লিখতে জবাব দিল,
‘ হু।
নীরা বলল,
‘ আমি হাত কেটে ফেলেছি। রিপ বলল,
‘ ভালো কাজ করেছ।
নীরা মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘ আপনি এভাবে বললেন?
রিপ লিখতে লিখতে জবাব দিল,
‘ তো কিভাবে বলব?
নীরা কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
‘ আমি কত ব্যাথা পেয়েছি জানেন?
রিপ মাথা তুলল। বলল,
‘ ব্যাথা পেয়েছ তাই তো পিহুকে গিয়ে বললাম ব্যান্ডেজ করিয়ে দিতে। তোমার ছেলের বউ ডাক্তার। তারপর ও যদি তোমার ব্যাথা লাগে?
নীরা বলল,
‘ আপনি আমার খেয়াল রাখেন না ব্যারিস্টার। আমার কষ্ট হয়। আমি আপনার কত খেয়াল রাখি। আপনাকে কত ভালোবাসি। আপনি আমায় একটু ও ভালোবাসেন না?
রিপের কলম চলা বন্ধ হয়ে গেল। সে উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘ কি বলেছ? আরেকবার বলো। নীরা ভয় পেয়ে গেল। বলল,
‘ বলেছি, আপনি খুব ভালো ব্যারিস্টার । আপনি ভালো। আপনার বাচ্চা ও ভালো। আপনার বাচ্চার বউটা ও ভালো। আপনার বাচ্চার মা টা খারাপ শুধু।
রিপ বলল,
‘ এদিকে এসো। হাত কেন কেটেছ? কাজ করার সময় এত বকবক করলে হাত তো কাটবেই
নীরা বলল,
‘ এভাবে বলছেন কেন? কষ্ট হয় তো।
রিপ বলল,
‘ তোমাকে কিছু বলা যায়না। সবকিছুতে তোমার কষ্ট হয়।
নীরা মুখ ফুলিয়ে খাটে বসে রইল। বলল,
‘ পোড়াকপাল আমার। দিনশেষে এই শক্তমনের মানুষটাকে নাকি আমি এতটা ভালোবাসি। যে আমাকে একটু ও ভালোবাসেনা। সে পায়ে ব্যাথা পেয়েছিল তখন আমি কতকিছু করেছি? কত কাঁদা কেঁদেছি। কত মলম মালিশ করেছি। নির্ঘুম রাত কেটেছি। আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়ে তিনি নাক টেনে ঢুসে ঢুসে ঘুমাতেন। আমার জন্য একটু মায়া ও হতোনা।
রিপ মনে মনে হেসে ফেলল। চেয়ার ছেড়ে উঠে গেল। নীরার পাশে বসে হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
‘ তুমি একাই আমায় ভালোবাস? আর আমি বাসিনা?
নীরা চোখ মুছতে মুছতে বলল,
‘ কচু বাসেন। আমি যতক্ষণ বলি ততক্ষণ।
রিপের মন খারাপ হয়ে গেল । নীরা মনে মনে হেসে বলল,
‘ ওহ মাই বাচ্চার ব্যারিস্টার বাপ , মাই জামাই লও ঠ্যালা।
রিপ বলল,
‘ আচ্ছা।
নীরা বলল,
‘ কি আচ্ছা?
রিপ বলল,
‘ কিছুনা।
নীরা বলল,
‘ ভালোবাসেন। নেন হাতটার উপর চুমু দেন। আর ভালেবাসি বলেন।
রিপের ভ্রুকুঞ্চন হলো। বলল,
‘ বলেছি না?
নীরা বলল,
‘ আরেকবার বললে কি হয়? এত কিপ্টামি করেন কেন?
রিপ বলল,
‘ আর কত বাচ্চামো করবে নীর?
নীরা ঝাপটে পড়ল। রিপকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ সবসময় এভাবে ডাকবেন। ডাকেন না কেন? এই ডাকটি আমি কত মিস করি জানেন?
রিপ বলল,
‘ ডাকি। তুমি শুনোনা। আমি কি করব?
নীরা হাসল। বলল,
‘ ভালোবাসি বলেন।
রিপ হেসে ফেলল৷ বলল,
‘ আবার বাচ্চামো??
কিছুদিন পর ঘরে বাচ্চা আসলে তার সাথে তোমাকে খেলতে দিতে হবে।
নীরা বলল,
‘ সত্যি? বাচ্চা আসবে? আমাদের?
রিপ ধমক দিল।
‘ কি আশ্চর্য কথাবার্তা নীর?
নীরা কাঁচুমাচু করে বলল,
‘ আমাদের বাচ্চার বলতে চেয়েছি ব্যারিস্টার? রাগ করেছেন?
রিপ দুহাতের বন্ধনে আগলে নিল নীরাকে। বলল,
‘ না। ব্যারিস্টার তোমার উপর রাগ করে বেশিক্ষণ থাকতে পারবে?
নীরা চোখ বুজল। বলল,
‘ শুধু পাম্প দিতে থাকে। সারাক্ষণ। ভালোবাসি বলেনা!
রিপ হেসে ফেলল আওয়াজ করে। আরো শক্ত করে নীরাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ আমি ভালোবাসি নীর। সত্যি। আমার বাচ্চার বাচ্চামো মা টাকে আমি ভীষণরকম ভালোবাসি। এই তুমি ছাড়া এই ব্যারিস্টার একদম অসহায় নীর। আমি যেন আমার জীবনের শেষ পর্যন্ত তোমাকে ভালোবেসে যেতে পারি। তুমি শুরু থেকে শেষপর্যন্ত আমার হয়ে থেকো। এই ব্যারিস্টারকে কখনো ভুল বুঝোনা প্লিজ। আমি তোমার হয়ে গেছি। একদম পুরোটা।
নীরা প্রশান্তির হাসি হেসে বলে,
‘ আমি আপনাকে কখনো ভুল বুঝিনি ব্যারিস্টার। আমি কথা দিয়েছিলাম আপনাকে, জীবনের যেরকম পরিস্থিতির স্বীকার হইনা কেন, আপনার উপর থেকে বিশ্বাস আমার কখনো উঠবেনা। আমি আপনাকে বিশ্বাস করে এসেছি ব্যারিস্টার। ভালোবেসে এসেছি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভেসে যাব। আপনি আমার জীবনের অনেক বড় পাওয়া। আমি শেষপর্যন্ত আপনাকে জয় করতে পেরেছি। আমি ধন্য। আমার ভালোবাসা স্বার্থক। আমি ভুল মানুষকে ভালোবাসিনি। প্রচুর ভালোবাসা যায় এমন একটা মানুষকে ভালোবেসেছি। আমি এই মানুষটাকে ভালোবেসে একটু ও ক্লান্ত হইনা। আমি আপনাকে যুগ যুগ ধরে আপনাকে ভালোবেসে যেতে চাই ব্যারিস্টার। আপনি ও আমায় যুগ যুগ ধরে ভালোবেসে যাবেন। কথা দেন।
রিপ হেসে অর্ধাঙ্গিনীর চুলের ভাঁজে ঠোঁট ছুঁয়ালো। বলল, কথা দিলাম।

বিয়ে, জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন বোধহয় একে বলে। বিয়ে নামক পবিত্র সুঁতোর বন্ধনে আটকা পড়লে ভালোবেসে ফেলতে হয়। ভালোবেসে যেতে হয়। ভালোবাসা নামক দুর্বোধ্য শব্দটা তখন সহজ হয়ে যায়, তার জালে আটকা পড়তে হয়। একেবারে ফেঁসে যেতে হয় । সেই ফেঁসে যাওয়াতে ও এক আকাশ প্রশান্তি আছে। একঝাঁক মুগ্ধতা আছে। সবার সেই মুগ্ধতা উপলব্ধি করার সুযোগ কিন্তু হয়না। হয়না।

________________________

বেশ জোরে নিকিতা বেগমের মুখের উপর জবাব দিল নিনিত। আমি বিয়ে করব না। যখন ইচ্ছে হয় তখন তোমাদের জানাবো। এখন আর কোনো বিয়ে নিয়ে কথা চলবে না এই বাড়িতে।
নিকিতা বেগম হা করে শুনলেন ছেলের কথা। বলল,
‘ ওমা এত রাগ কেন? আমি তোর মা। আমি তোর বিয়ে নিয়ে ভাবব না তো কে ভাববে?
নিমিত মাত্রই হসপিটাল থেকে ফিরেছে। নিকিতা বেগম প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,
‘ এয়ারপোর্ট থেকে আর বাসায় ফিরলি না কেন? আশ্চর্য! কত চিন্তায় ছিলাম আমরা।
নিনিত বলল,
‘ কত চিন্তায় ছিলে বুঝতেই পারছি।
গটগট করে পায়ের আওয়াজ তুলে চলে গেল নিনিত। নিশিতা বলল,
‘ ভাইয়ার সাথে এটা অন্যায় হচ্ছে মা।
নিকিতা বেগম হেসে বললেন,
‘ হলে হোক। ওকে বিয়ে করিয়েই তবে আমি শান্তি। এবার সব ভালো ভালো হলেই হলো। আমার একটা মাত্র ছেলে আমি চাই ও ভালো,থাকুক৷ ওকে কেউএকজন ভালো রাখুক৷ সুখী হোক তারা।

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমাতে গেল নিনিত। আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে। সারাদিন খুব প্রেশার গেল হসপিটালে। বাইরে মন কেমনের বৃষ্টি নামার তাড়া চলছে। পকেটে হাতপুড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকল সে অনেকক্ষণ। আজ বৃষ্টি নামার জন্য এত আয়োজন কেন? আজ কি খুব বিশেষ দিন?

খুব বড় এক অন্যায় হয়ে গেছে জালিশার সাথে। ফোনে সরি বলার ও কোনো অপশন রাখেনি জালিশা। সবদিক দিয়ে ব্লক। কথা বলতে ইচ্ছে না করলে ইগনোর করত, ব্লক কেন দিলো। আশ্চর্য মেয়েমানুষ?
কারো অনুভূতি নিয়ে খেলা মোটে ও উচিত নয়।
অনুভূতি ভালোবাসা দিয়ে রাঙিয়ে দেওয়ার জিনিস। অনুভূতি খেলনার জিনিস নয়।
জালিশার অনুভূতি নিয়ে সে খেলা করেনি। দাম দেয়নি। এতে নিনিতের ও দোষ নেই। সে জালিশাকে বুঝার চেষ্টা করেনি তাই। জালিশা আর একবার সুযোগ দিতে পারত।

অন্ধকার বারান্দায় গুটিগুটি পা ফেলে নিনিতের পেছনে হেঁটে আসে একটি মেয়ে। গায়ে জড়ানো লম্বা ওড়নাটা মাটিতে সামান্য করে লুটোপুটি খাচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়ায় নড়ে উঠেছে মেয়েটির সামনের একগাঁছি চুল, আর কানের দুল। পা টিপে টিপে মেয়েটি নিনিতের পেছনে এসে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে নিনিতের চোখ দুটি বন্ধ করে নেয়।
নিনিত ঠান্ডা নরম হাতের স্পর্শ চোখের উপর পেয়ে চমকায়। মেয়েটির হাতের উপর নিজের হাত রেখে গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে
‘ কে?
চিকনসুরে ভেসে আসে
‘ বউ।
নিনিত মেয়েটির হাত সরিয়ে সামনে ফিরতেই চোখ বড় বড় হয়ে যায় নিনিতের। সে হয়ে পড়ে বাকহীন, স্তব্ধ। তার বিড়বিড় করে বলা কথা মেয়েটি কানখাড়া করে শোনে।
‘ তুমি? কানাডা যাওনি?.
মেয়েটির সাবলীল উত্তর।
‘ বর রেখে একটু ও যেতে ইচ্ছে করছিল না।
নিনিত আমতাআমতা করে বলল,
‘ কিন্তু? আমি?
মেয়েটি কিছু বলতে না দিয়ে শক্ত করে দুহাত দিয়ে আগলে জড়িয়ে ধরে ছেলেটিকে। বলে,
‘ কাল আমাদের বিয়ে ডক্টর শেখওয়াত। এবার আমি আপনাকে পুরোপুরি বর হিসেবে পাব। আজ আসলেই খুব বিশেষ দিন। আমার জীবনের বিশেষ দিন। আপনাকে ভালোবাসার সুযোগ পেয়েছি আমি। আর ছাড়ছিনা আপনাকে। আপনি ও আমায় একটু ভালোবাসবেন প্লিজ। কথা দিচ্ছি, আপনার একটুর বিনিময়ে আমি আপনাকে এক আকাশ ভালোবাসা ফিরিয়ে দেব। আমি আমার কথা রাখব। রাখবই।।

নিনিত তার দুই হাত দিয়ে মেয়েটিকে আগলে ধরতে গিয়ে কেন যেন আটকে গেল। আগলে ধরতে পারল না। খানিকটা নিচুস্বরে সে বলল,
‘ আমি ভালোবাসতে জানিনা জালিশা।
জালিশা হাসল। একটু নড়েচড়ে প্রশান্তির হাসি হেসে বলল,
‘ ভালোবাসতে জানিনা বলা মানুষগুলো একসময় বেশিই ভালোবাসে। আমি সেই সময়টার অপেক্ষায় থাকব। যেদিন মনে হবে আপনি আমায় ভালোবাসেন, সেদিন বলবেন কিন্তু। দিনটি আজকের দিনের চাইতে খুব স্পেশাল আমার কাছে।

_________________________

” মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকে যদি ভালোবাসার প্রমাণ দিতে হয়, তাহলে আমি বলব আমি ভালোবাসতে জানিনা। কথায় কথায় ভালোবাসি বলে বলে যদি আওড়াতে জানতে হয়, তাহলে বলব আমি ভালোবাসতে জানিনা। চোখের ভাষার চাইতে ও যদি মুখের ভাষাটা উত্তম হয়, তাহলে বলব আমি ভালোবাসতে জানিনা। আমি সত্যিই কি ভালোবাসতে জানিনা? ”

ছয়বছর আগের কাগজ হওয়ায় লেখাগুলো ঝাপসা দেখাচ্ছে। পিহু কাঁপা-কাঁপা হাতে অন্য কাগজটি খুলল। দুরুদুরু বুক নিয়ে কাগজটিতে চোখ দিতেই মনে হলো এই লেখাগুলো সে কতবার পড়েছে। তখন কেন মনে হয়নি, এই কথাগুলো তার প্রেমিকপুরুষ তাকে ঘিরে লিখেছে। কত প্রেম উঁপচে পড়ছে লেখাগুলো দিয়ে। পিহু কি তখন অন্ধ ছিল?

” মিষ্টি কথায় কি প্রেম হয়?
তিক্ত কথায় কি প্রেম নয়?
মনের কথা বুঝাতে কি অন্যভাষা জানা লাগে?
মনের কথা কি বুঝানো যায়না শাসন আর রাগে? ”

” সবার কাছে ভালোবাসার ধরণ আর মর্মার্থ এক নয়।
তারপর ও তো ভালোবাসা ভালোবাসাই হয়।
ভালোবাসতে কি কোনো কারণ লাগে?
যদিই লাগে, ভালোবাসা কেন অকারণে জাগে?”

ঘরের জানালাটা খোলা। বাইরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। অথচ ভ্যাপসা গরম। সেই হাওয়ায় উড়ছে মৃদুমন্দ অন্ধকারে চিরকুট হাতে নিয়ে বসে থাকা মেয়েটির চুল। গরম লাগায় এই দ্বিতীয়বার শাওয়ার নিল সে। বৃষ্টি নামলে আজ খুব ভালো হতো। শাড়ি পড়তে না জানায় এলোমেলো শাড়িটা পড়ে হাঁটতে তার বেশ অসুবিধা। চুল থেকে টপটপ পানি পড়ে ভিজে গেল শাড়ি। একগাছি চিকন চুল লেপ্টে রয়েছে গলার সামনের দিকে। বাইরে শুরু হয়েছে বাতাসের তান্ডব। গাছগাছালি বোধহয় ভেঙ্গে পড়ছে। মেয়েটি আঁতকে উঠল বেশ জোড়াল আওয়াজে। ভয় পেয়ে দরজা খুলে বারান্দার কাছাকাছি যেতেই দেখা মিলল একটি ছেলের। কালো টিশার্ট পড়া ছেলেটি পকেটে হাতপুড়ে বাইরের তান্ডব দেখছে। মাথার চুলগুলো তার এপাশ-ওপাশ করছে। চওড়া কাঁধের দীর্ঘকায় ছেলেটি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে। দেখল অর্ধভেজা ভালোবাসার অর্ধাঙ্গিনী।

স্নিগ্ধ, শান্ত, সরল মুখটির দিকে তাকাতেই ফাঁকা ঢোক নেমে গেল গলার নিচ দিয়ে। ঢোক গিলতে গিয়ে ও ছেলেটি এদিকওদিক তাকালো আড়ষ্টতায়। আবার তাকালো সামনেই। চোখ হলো এবার স্থির।

মেয়েটি চোখ স্থির করতেই তার সচল মস্তিষ্ক জানান দিল ছেলেটি চেয়ে আছে অন্য নজরে। কৌতূহল উড়ে গিয়ে তাকে ঘিরে ধরল লজ্জা আর ভয়ে । বারান্দার গ্রিল ভেদ করে বাতাসের ঝাপটা ফেলে দিল বারান্দায় সাজিয়ে রাখা ফুলের টব। কেঁপে উঠল পিহু। কেঁপে উঠল তার শিরা উপশিরা। বাতাসের জোড়াল ঝাপটায় নড়ে উঠল এলোমেলোভাবে পড়া শাড়ি, চুল,মন, মস্তিষ্ক। বাতাস নয়ত অন্যকিছুর আভাসে বন্ধ করা চোখ ধীরে ধীরে খুলতে ছেলেটি পা টিপে টিপে চলে এল খুব কাছাকাছি। একদম দূরত্ব কমিয়ে দাঁড়াল ছেলেটি। অর্ধভেজা প্রেয়সীর কাঁপতে থাকা ঠোঁট আর চোখের পাতা দেখে মনে হলো এই মেয়েটাকে সে আজকের মতো করে কোনোদিন দেখেনি। অথচ সে মেয়েটিকে ভালোবেসেছে, সেই যখন থেকে সে ভালোবাসা বুঝতে শিখেছে।

বাতাস আর জোড়ালভাবে বয় । ছেলেটির একঝাঁক চুল এপাশ থেকে ওপাশ হয়ে যায়। ছোট ছোট চোখ করে তাকাতে তাকাতে সে ঝুঁকে পড়ে মেয়েটির দিকে। মেয়েটি সেভাবে দাঁড়িয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় অন্যদিকে। অনুভব করে প্রাণপুরুষের তপ্ত নিঃশ্বাস। ছেলেটি ঝুঁকে পড়ে মেয়েটির কাঁধের কাছে। গলার কাছে।ভেজা চুল থেকে পড়া পানিতে ভিজে যায় তার মুখ, ঠোঁট। উন্মাদের মতো শ্বাস টানে সে কাঁধের কাছটাই। ভেজা মুখ, ঠোঁট দিয়ে এই প্রথম নরম এক কাঁপানো ছোঁয়া দিয়ে সে বিড়বিড় করে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল,
‘ লাল শাড়িটা কোথায়?
কম্পমান কন্ঠে পিহু উত্তর দিল।
‘ আছে।
ছেলেটি আর ও গভীরভাবে কম্পিত স্পর্শ দিতে দিতে উচ্চারণ করলল,
‘ পড়া উচিত।
পিহু তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে বিশাল আকৃতির শ্বাস ফেলে বলল,
‘ আচ্ছা।
পিহু রুমে চলে গেল দৌড়ে। চেপে গেল দেওয়ালে ঠেস দিয়ে। জোড়াল শ্বাস নিয়ে কাঁপাকাঁপা পায়ে হেঁটে আলমারি থেকে বের করল লাল টকটকে বেনারসি। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পড়ে নিল কোনোমতে ছেলেটি আসার আগে। এলোমেলো কুঁচি ধরে শাড়ি কাঁধে তুলতেই ছেলেটি চলে আসল। আবার ও দৃষ্টি স্থির হলো দূরে দাঁড়ানো মেয়েটির কাছে গিয়ে। মেয়েটির কায়ার প্রত্যেকটা খাদে খাদে আজ চাওয়াগুলো খুব করে ফুটে উঠল।

ছেলেটি যত এগোয় মেয়েটি ততই পিছু হাঁটে। মেয়েটি কাঁপা-কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘ কি,,,,,কি চাই?
স্থির দৃষ্টির ছেলেটির সাবলীল জবাব,
‘ তোকে চাই।
পিহু আবার ও পিছু হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করে,
‘ আর,,, আর কি চাই?
আবার ও উত্তর এল,
‘ তোকে চাই।
পিহু কন্ঠরুদ্ধ হয়ে এল এবার। তারপর ও জিজ্ঞেস করল,
‘ আর????
ছেলেটি হেসে এগোতে এগোতে বলল,
‘ খুব করে তোকে চাই। আমার হবি?
মেয়েটি আটকে যায় পেছনে কিছু একটার সাথে। উল্টে পড়ে যেতে গেলেই ছেলেটি তার এক আঙুল ধরে ফেলে চট করে। পিহু সেভাবে ঝুলে থেকে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে,
‘ পড়ে যাচ্ছি তো?
ছেলেটি হেসে জবাব দেয়,
‘ পড়ে যেতে দিলাম না তো।
পিহু চোখ খুলে ছেলেটিকে দেখার চেষ্টা করে বলে,
‘ ছেড়োনা প্লিজ। পড়ে যাবো।
ছেলেটির আবার একই দৃষ্টি বজায় রেখে বলল,
‘ ছেড়ে দেওয়ার জন্য তো ধরিনি।
পিহু আরেকহাত এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘ ধরোনা?
ছেলেটি মাথা নেড়ে বলল,
‘ উহুম।
পিহু কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
‘ এই পাষাণটাকে আমি এতটা ভালোবাসি সেই শুরু থেকেই।
ছেলেটির হাসিহাসি মুখ পরিণত গাম্ভীর্যতায়। মুখ দিয়ে বেরোলো।
‘ আমি পাষাণ হলে, তুই বড্ড হৃদয়হীন।
পিহু কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে,
‘ তুমি কানাডা যাওয়ার সময় আমার খোঁজ নাওনি৷ গিয়ে ও নাওনি। ছয় ছয়টা বছর। কম না।
ছেলেটি পিহুর আঙুল ছেড়ে দিতে গিয়ে আবার শক্ত করে ধরে। বলে,

‘ তুই নিয়েছিস? আমি তো রোজ তোর নামে চিঠি লিখতাম, তুই লিখেছিস?

তোকে দেখার ইচ্ছায় আমার পাখি হতে ইচ্ছে হতো? তোর কি হতো?

তোর কন্ঠ শোনার জন্য আমি রোজ দিদিয়াকে ফোন দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা এইসেই কথা বলায় ব্যস্ত থাকতাম। তুই পাশে এসে ফোন কেড়ে নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিস?
পিহু বলল,
‘ কেউ আমার কথা জিজ্ঞেস না করলে আমি কেন তার সাথে কথা বলতে যাব?
ছেলেটি হাসে গলা কাত করে। বলে,
‘ মাকে কখনো জিজ্ঞেস করেছিস? আমি তোর কথা জানতে চেয়েছি কিনা? করেছিস?

পিহু কেঁদে দিল আওয়াজ করে। বলে,
‘ না। তুমি, তুমি?
ছেলেটি বলল,
‘ যাহ এবার পড়ে যাহহ।
পিহু ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ায়।
‘ না, না ব্যাথা পাব। তুমি কেন আমায় কাঁদাও।
ছেলেটি বাঁকা হাসে। বলে,
‘ তোকে কাঁদালে আমি তৃপ্তি পায়। সুখ পায়। তোকে কাঁদতে হবে। প্রচুর কাঁদতে হবে। তুই আমার জন্য কাঁদবি।
পিহু ঢোক গিলে বলে,
‘ কেঁদেছি তো। কেঁদেছি। তোমার জন্য আমি ছয়টা বছর অপেক্ষা করেছি। রোজ কেঁদেছি। একটু একটু করে অভিমান জমিয়েছি। ওই আকাশের পাখিগুলোকে তোমার খোঁজ এনে দিতে বলেছি। আমি ছয় ছয়টা বছর তোমাকে খুব খুব মিস করেছি। আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। সত্যি ভেসেছি। কিন্তু তোমার মুখ থেকে আমি আজও সেই শব্দটা শুনিনি। আমার খুব লোভ হয় ওই শব্দটি শুনতে। খুব লোভ হয়। তুমি এখনো কষ্ট দিয়ে যাচ্ছ।
ছেলেটির চোখের দৃষ্টি শান্ত। বলে,
‘ ছেড়ে দিলাম। তুই ব্যাথা পা। কষ্ট পা। আমার দ্বিগুন পা।
পিহু ঘনঘন মাথা নাড়ায়।
‘ না এমনটা করোনা। আমার খুব লাগবে।
ছেলেটি আঙুলটি ছেড়ে দিতে দিতে আবার ও ধরে। বলে,
‘ আমার লাগেনি?
বিয়ে ও তো করে নিচ্ছিলি। তোর ভালোবাসাগুলো এতটাই ঠুনকো যে তুই অন্য কারো সঙ্গে জীবন কাটানোর কথা ও ভেবেছিলি। আর আমি? আর আমি, সেই তোর জন্য সূদুর কানাডা ছেড়ে চলে এসেছি।
এই হৃদয়হীনের জন্য। শুধু এই হৃদয়হীনের জন্য।

পিহু ডুকরে কেঁদে উঠল। বলল,
‘ শাস্তি দেবে?
ছেলেটি শান্ত চোখে চেয়ে বলল,
‘ তোকে শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল। অন্য কারো সঙ্গে বাকি জীবন চলার কথা ভেবে। কিন্তু এত বড় দুঃসাহস আমার হয়নি। আমি ও ভুলে ও ভাবতে পারিনি।
পিহু কেঁদে কেঁদে বলে,
‘ আর শাস্তি দিওনা। ছয়বছর ধরে দিয়েছ তো। দাওনি?
ছেলেটি হাসে। বলে,
‘ না।
পিহু হতাশ হয়ে বলে,
‘ আজ দেবে?
ছেলেটি মাথা নেড়ে বলে,
‘ না। আর না। আর না।
ছেলেটি তার আঙুল ছেড়ে দেই ধীরে ধীরে। ধীরে ধীরে। পিহু ভয়ার্ত চোখে বলে,
‘ না না না। এমন করোনা।
ছেলেটি ছেড়ে দেয় পিহুর হাত।

পিহু চিৎকার করে বেডসাইড টেবিল সহ নিয়ে পড়ার আগেই মাহিদ তার আঙুল টেনে টান দেয় তার দিকে। পিহু একেবারে এসে পড়ে ছেলেটির কাছে। ছেলেটির গলা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে এলোমেলো সুরে কেঁদে দেয়। ছেলেটি মেয়েটির মাথার পেছনে একহাত দিয়ে চেপে ধরে বলে,
‘ তুই কাঁদবি। আমার জন্য কাঁদবি। আমার মার খেয়ে কাঁদবি। যেদিন আমি হারিয়ে যাব তোর জীবন থেকে, সেদিন থেকে তুই কাঁদা ও ভুলে যাবি। তোর চোখের জল শুকিয়ে যাবে।
পিহু কেঁদে উঠে ছেলেটির মাথার চুল হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। বলে,
‘ এভাবে বলো কেন? এখন আবার মারবে?
ছেলেটি হেসে দেয়। মেয়েটির কানের কাছে চুল সরিয়ে নিজের ঠোঁট, মুখ চেপে ধরে বলে,
‘ নাহহহহহ। আজ আগের মারগুলোর প্রতিদান দেব৷ নিবি?
পিহু চুপ হয়ে যায়। ছেলেটি জিজ্ঞেস করল,
‘ কথা বলছিস না কেন বাপ ?
মেয়েটি মিনমিন করে বলে,
‘ আমি নাই। মইরা গেছি বাপ। ইন্নালিল্লাহ পড়ো। মাহিদ ধমক দিল।
‘ তাকা? চোখ তোল?
পিহু তার গলার কাছে মুখ গুজে দিয়ে বলে,
‘ না, আমার শরম করে।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here