#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩৮ (সিজন ২)
#পুষ্পিতা_প্রিমা
সকাল দশটা পার হতে না হতেই চিন্তিত বিমর্ষ মুখে হসপিটালের করিডোরে বসে থাকা মানুষগুলোর প্রাণ ফিরল । সবার অপেক্ষার অবসান ঘটল। সবার মুখে হাসি ফুটল। সারাদিন মেয়ের পাশে মাথা ফেলে শুয়ে থাকা মা মেয়ের মুখে মা ডাক শুনতেই খুশিতে আত্মহারা হলো। মেয়ের মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে চুপটি করে থাকল। বহুক্ষণ পর মেয়ের মুখে মমতা স্নেহের পরশ দিয়ে বলল,
‘ মা। আমার মা। এখন কেমন লাগছে? শরীর বেশি খারাপ লাগছে?
পিহু বিদীর্ণ চেহারায় হাসল। নিস্প্রভ চাহনি দিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে খানিকটা হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ আম্মা তুমি কাঁদছ?
ইশা তাড়াতাড়ি নিজের চোখ মুছে, গাল মুছে। বলে,
‘ না না কাঁদছিনা। তোমার খিদে পেয়েছে? কিছু খাবে? কি খাবে?
পিহু উঠে বসার চেষ্টা করল। নীরা মুনা এসেই পিহুকে বসতে সাহায্যে করল। পিহুর নিজেকে ভারহীন মনে হতেই নিজের শরীর দেখে চমকে তাকাল সবার দিকে। ইশা পিহুর চোখ দেখে তাড়াতাড়ি গিয়ে জড়িয়ে ধরে নিল। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘ ও আছে মা। তোমার দিদিয়ার কাছে।
পিহু কৌতূহলী চোখে তাকাল নীরার দিকে। মুনার দিকে। নীরা মৃদু হেসে পিহুর গালে হাত বুলালো। বলল,
‘ একটা ছোট্ট পিহু এসেছে।
পিহু ঠোঁট এলিয়ে হেসে ফেলল। চোখ ভর্তি পানি দেখা দিল। পরক্ষণে চেহারাটা আবার মলিন হয়ে গেল।
‘ মাহিদ ভাই? মাহিদ ভাই কোথায়? এখনো আসেনি? ওকে কোলে নেয়নি?
নীরা ইশা মুনা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। নীরা হেসে পিহুর মাথা চেপে ধরল নিজের বুকে। মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ তোমার বর আছে। বাইরে আছে। অনেক আগেই এসেছে। মন খারাপ করোনা আর। পিহু চুপটি মেরে বসে থাকল।
‘ মাহিদ ভাই এসেছে! রাগ কমেছে?
কেবিনের বাইরে থেকে ভেসে এল খ্যাঁচখ্যাঁচে কান্নার কন্ঠস্বর। পিহু কান খাঁড়া করে যেন শুনল সেই কান্না। বুকের ভেতর অজানা অচেনা কারণে ধুকপুক ধুকপুক করে উঠল। পিহু ইশার দিকে তাকাল। ইশা হাসল। সায় দিল।
মা চোখ মেলেছে তা যেন জানা হয়ে গিয়েছে বাচ্চাটির। হাত পা ছুড়ে বিরতিহীন কাঁদছে। পরী অনেক সামলিয়েছে। পিহুর জ্ঞান ফিরেছে শুনে সে ছুটে এল। পিহুর বিস্ময় চোখকে উপেক্ষা পরী হাসিহাসি মুখ করে পিহুর দিকে কোলে থাকা ছোট্ট বাচ্চাটিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ মায়ের আদর অনেক খেয়েছেন। এবার ইনাকে একটু দিন। খিদে পেয়েছে বড্ড। তার মা টা বড্ড পাজি। এখনো খেতে দেয়নি।
পিহু পরীকে জিজ্ঞেস করল,
‘ আমি?
পরী বলল,
‘ তো কি আমি? তুমি মা হয়ে গেছ না? আদর খেতে নয় দিতে শেখো।
পিহু হাত বাড়িয়ে বলল,
‘ আমাকে এখন দেবে?
পরী আবার তার দিকে টেনে নিয়ে বলল,
‘ না দেবনা। তুমি এখনো বাচ্চা। বড় হয়ে যাও তো। মা হও তারপর।
পিহু হেসে ফেলল। বাচ্চাটি জোরে জোরে কাঁদল।
কেবিনের বাইরে পায়চারি করা ছেলেটা হাত দিয়ে অন্য হাতের মুঠিতে কিল দিয়ে বলল,
‘ সবাই আমার ছেড়িরে কাঁদায় ক্যা? রাগ উঠতাছে বাপ।
ইশা নিচে হাত রেখে পিহুর কোল দেয় বাচ্চাটিকে। পিহুর কপাল ঘেমে উঠে। হাত কাঁপে তরতর করে। মুখ দিয়ে বিড়বিড় করে অস্ফুট স্বরে কি যেন বের হয়৷ পিহু কম্পিত কন্ঠে বলে
‘ আম্মা আমাকে মা ডাকবে?
ইশা হেসে দেয়। বলে,
‘ ডাকবে তো। কেন ডাকবেনা?
পিহু তার দুঠোঁট ছোঁয়ায় ছোট্ট বাচ্চাটির গালে। ছোট্ট নাকে। মা হওয়ার অনুভূতি এতটা ও প্রখর হয়?
বাচ্চাটি শান্ত হয়ে যায় মায়ের স্পর্শে । মায়ের বুকে ঠাঁই পেতে না পেতেই যেন সে স্বস্তি পেল। শান্তি পেল। আরাম পেল। এই মা টা এতক্ষণ কোথায় ছিল তাকে ছেড়ে?
ইশা যেন নিজের প্রতিচ্ছবি দেখল আজ। এমন একটা মুহূর্ত তার জীবনে ও এসেছিল। মামির হাত থেকে ছোট্ট পরীকে সে প্রথম কোলে নিয়েছিল। নরম তুলতুলে শরীরের বাচ্চাটি গোলাটে চোখগুলো দেখিয়ে তাকে মন করে দিয়েছিল সে ডক্টর আর মিষ্টির মেয়ে। সেইদিন ইশা কেঁদেছিল খুশিতে,দুঃখে, যন্ত্রণায়। ডক্টরকে সেদিন সে খুব মিস করেছিল। ইশার পাশে সেদিন ডক্টর ছিলনা। ছোট্ট পরীর ছিলনা বাবা। না পরিবার। কিন্তু আজ এই বাচ্চাটি মায়ের ছোঁয়া পাওয়ার আগেই বাবার পেল। তার বাবা তার আগমনে খুশিতে কাঁদল। কতটা ভাগ্যবতী সে।
পরী পাশ ফিরে তাকাল মায়ের দিকে। ইশার টলমলে চোখ দেখে ডাকল,
‘ আম্মা?
কত ভালোবাসাময় ডাকটি!
ইশা পরীর কাছে গিয়ে গালদুটো আঁকড়ে ধরল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মেয়ের কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
‘ মা, আমাদের উপর তুমি আর রেগে নেই তো?
পরী অনেক্ক্ষণ পর বুঝল ইশার কান্নার কারণ। ইশার গাল মুছে দিয়ে পরী বলল,
‘ আম্মা আমি আদি মিষ্টির মেয়ে। রিক আর মুনার মেয়ে। রিপ আর নীরার মেয়ে। আফি চৌধুরী আর রাইনা চৌধুরীর ও মেয়ে। আমি সবার ভালোবাসা পেয়ে বড় হয়েছি আম্মা। আমার কষ্ট নেই আম্মা। আমার কেনো দুঃখ নেই। কারো উপর কোনো রাগ নেই। তুমি কেন অযথা পুরোনো কথা ভাবো বলোতো? আব্বার চোখে আমি আমার জন্য অগাধ ভালোবাসা দেখি আম্মা। আব্বার কাছে, সবার কাছে আমি এখনো সেই ছোট্ট পরীই আছি। তোমরা বড় হতে দিলে কই?
আমি শুধু রাহির কাছেই বড়। রাহির কাছেই তার মা।
ইশা হাসল।
____________
পিহু তার পাশের বাচ্চাটিকে দেখল। ডাগর ডাগর চোখগুলো নিচে নামিয়ে রেখেছে। কি দেখছে কে জানে? পিহু ছোট্ট নাকটাতে আঙুল দিয়ে টিপে দিয়ে বলল,
‘ এদিকে তাকান। তাকান তো।
বাচ্চাটি তার মতই আছে। পিহু ছোট্ট ঠোঁটদুটোর উপর তার আঙুল রাখল। বলল,
‘ কামড় দেন তো। দাঁত তো নেই।
বাচ্চাটি ধীরে ধীরে তার ছোট্ট জিহ্বাটি বের করল। পিহুর জিহ্বাটির স্পর্শ পেয়ে হেসে কুটিকুটি হয়। বাচ্চাটি জিহ্বা দিয়ে পিহুর আঙুল খেতে চায়। পিহু বলল,
‘ দেব না।
সে আঙুল নিতেই বাচ্চাটি চিল্লিয়ে কেঁদে উঠে। পিহু ধীরেসুস্থে উঠে বসে। কোলে তোলার জন্য নড়েচড়ে বসতেই কেবিনের দরজা ঠেলে চলে আসে একটি ছেলে। বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে দুলিয়ে শান্ত করাতে করাতে বলে
‘ মেরিমা কাইন্দো না আর। তোমার বাপজান চইলা আইছে। আর চিন্তা নাই বাপের নাতনী। চিন্তা নাই৷ কাইন্দো না আর। তোমার মার মতো প্যা প্যা করা শিখলে তোমার সাথে মেলা রাগ করুম আমি। বাপের মতো হইবা। বুঝলা?
পিহু বালিশে হেলান দিয়ে বসে থাকে। চেয়ে থাকে ওই বকবক করা ছেলেটার দিকে। বকবক করার এক পর্যায়ে মাহিদের পিহুর দিকে চোখ পড়ে যায়। সে থেমে যায়। চোখ নামিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
‘ নতুন বাপের মেলা শরম করে। বউডা এভাবে দেখে ক্যান?
পিহু হেসে ফেলল৷ হেসে চোখ বন্ধ করে ফেলে। বালিশে হেলান দিয়ে মাহিদের দিকে তাকায়। মাহিদ ধীরপায়ে হেঁটে আসে। বসে পিহুর পাশে। বাচ্চাটি শান্ত, নীরব। হয়ত আড়চোখে পৃথিবীর আলোর সাথে নিজেকে একটু একটু করে পরিচিত করে নিচ্ছে। পিহু সেই অপলক দৃষ্টি সরালো না। হয়ত ছেলেটি ও। পিহু নিস্পৃহ গলায় বলল,
‘ রেগে আছ?
মাহিদ বিস্মিত চোখে চেয়ে রইল। প্রশ্নটি সে করতে চেয়েছিল।
পিহু বলল,
‘ কি দেখছ?
মাহিদ মাথা নিচু করে মেয়েকে দেখল। আবার চোখ তুলে পিহুর দিকে তাকাল।
পিহু হেসে ফেলল। বলল,
‘ সবার চোখে এই দূরন্ত ছেলেটা কিন্তু আমার সামনে ভারী গম্ভীর।
আমি যখন খুব একান্তে তাকে দেখি, তখন সে খুব শান্ত একজন প্রেমিক। খুব ভালোবাসার একজন মানুষ। আমি কিন্তু সেই দূরন্ত,ছটপটে, চঞ্চল ছেলেটাকেই ভালোবেসেছি। ভালোবাসি। ভালোবাসব। কিন্তু সে আমার সামনে কেন এত গম্ভীর সাজতে যায়? তার জানা উচিত তার এই রূপে আমি ভড়কাই না। চমকাই না। একটু ও ভয় পাইনা। একটু ও লজ্জা পাইনা। তার জানা উচিত, আমি তাকে একটু বেশিই বুঝি। তার জানা উচিত, তার হাতের মারের চাইতে ও তার গাম্ভীর্যতা আমাকে বেশি কষ্ট দেয়। খুব বেশি।
মাহিদ মিনমিনে গলায় বলে,
‘ আমি ফেরার সময় একটা মলম এনেছি। ভুলে বাসায় রেখে এসেছি। বাসায় ফিরে গালের পাশে লাগিয়ে দিলেই হবে।
পিহু হাসল আর ও একবার। মাহিদ চোখতুলে তাকিয়ে বলে,
‘ হাসছিস কেন? হাসার কি বললাম?
পিহু বলল,
‘ আমি ব্যাথা পাইনি তো। মলম লাগাবো কোথায়?
মাহিদ বলল,
‘ নে তোর মেয়েকে। ঘুমিয়ে গেছে।
পিহু হাসল। বলল,
‘ তার বাপজানকে চিনে ফেলেছে ভালো করে। বাহ।
মাহিদ বলল,
‘ আমি তোর আগে কোলে নিছি। চিনবে না?
পিহু হাসল। বলল,
‘ এখন আমাকে ডাক্তারের বাচ্চি ডাকতে পারবেনা আর। আমাকে ডাকলে তোমার মেয়ে রেগে যাবে।
মাহিদ পিহুর অপর পাশে শুয়ে দিল মেয়েকে। পিহুর হাত তুলে হাতের উল্টোপাশে ঠোঁট, নাক,মুখ ঘষতে ঘষতে বলল,
‘ তুই ডাক্তারের বাচ্চি। আর সে ডাক্তারণীর বাচ্চি। ডাকবই ডাকব। হাজার বার। কোটিবার ডাকব। তুই কি করবি?
পিহু হাসে। মাহিদের দুহাত তার গালের দুপাশে চেপে ধরে বলে,
‘ আমি কিছুই করব না। সত্যি। আমি ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই পারিনা। আমি এই ছেলেটাকে ভালোবাসতাম না। যদি জানতাম, এই ছেলেটাকে ভালো না বেসে থাকা যায়না। এই ছেলেটাকে ভালোবাসতে হয়। রোজ রোজ একটু একটু করে তার জন্য ভালোবাসা জমাতে হয়। তার সাথে সাথে একটুখানি অভিমান। তুমি জানো?
একটুখানি অভিমান ভালোবাসাকে রঙ দান করে।
আবার সেই অভিমান প্রখর হলে ভালোবাসাকেই রঙহীন করে দেয়।
আমার কিন্তু একটুখানি অভিমানের সাথে প্রখর ভালোবাসার উত্তাপ চাই। একটুখানি ভালোবাসার মাঝে প্রখর অভিমানের জায়গা আমি চাই না। কখনোই না।
পিহুকে সন্ধ্যায় রিলিজ দেওয়া হলো । নীড়ে ফিরল সবাই একটা ছোট্ট সদস্য নিয়ে। আর ও একটা প্রাণ নিয়ে। হাসিতেখুশিতে কেটে গেল অনেকগুলো দিন। অনেকগুলো মাস। প্রায় এক, দেড় বছর। মাহিদ ভার্সিটিতে চাকরি নিল। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে হয়ে উঠল একজন দায়িত্ববান সন্তান, স্বামী, বাবা।
ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে হঠাৎ নিত্যদিনের মতো দেখা হয়ে গেল নিনিতের সাথে। নিনিত মেডিক্যালে, মাহিদ ভার্সিটিতে কর্মরত। টং দোকানে দাঁড়িয়ে দুজনকে চা খেতে দেখে লোকজন আড়চোখে দেখে দুজনকে। চা খাওয়ার তালে মাহিদ প্রশ্ন করে বসে নিনিতকে
‘ জালিশারে লইয়্যা আসিস বাসায়। ডাক্তারণী বলছিলো।
নিনিত চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
‘ তোর খাটাইশ মার্কা কথা শুনে দোকানদার হা করে আছে মামা।
মাহিদ হাসল। বলল,
‘ শালার স্টুডেন্টদের সাথে লেকচার মারতে মারতে মুখটাই বরবাদ হইয়্যা গেছে। তাই এহন একটু শান্তিতে কথা কয়।
নিনিত হাসল। বলল,
‘ তোর মেয়ে হাঁটা শিখছে। আর আমার ছেলে এখনো ভ্যা ভ্যা করা ও শিখেনাই। সারাক্ষণ তার পেছনে লেগে থাকতে হয়। জালিশা এজন্য কোথাও বেরোতেই চাইনা। তুই আসিস আরিশাকে নিয়ে।
মাহিদ চায়ের কাপ শেষ করল। বাকিটুকু মাটিতে ফেলে দিতে দিতে বলল,
‘ ধুরর শালা তোর বউরে আসতে কে কইছে? যাহহ৷
নিনিত হেসে দিল। বলল,
‘ রাগস ক্যান বাপ?
মাহিদ টাকা দিয়ে চলে এল রাস্তায়। নিনিত তার পিছু পিছু। রিকশা ডেকে দুজনই এক রিকশায় উঠল। মাহিদ তার গন্তব্যে নেমে গেল। রিকশাওয়ালকে যেতে যেতে বলল,
‘ মামা এর কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে নিয়েন। নিনিত মামারে আজ আর বিশ টাকা বাড়তি দিস ভাই।
নিনিত হাসল। বলল,
‘ শালা ধোঁকাবাজ।
__________
বিছানার উপর বাচ্চা মেয়েটির গায়ে অলিভওয়েল মাখতে মাখতে ছেলেটি বলে,
‘ তোমার মা তোমার সেবা করেনা?
মেরিনা মাথা নাড়ায়। পিটপিট করে বাবার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
‘ নান নান না।
মাহিদ হাসে৷ বিছানার উপর পা তুলে উঠে বসে আর ও একটি বাচ্চা ছেলে। মেরিনার গাল টেনে দিয়ে বলে,
‘ বাবু তুমি ছিকুর সাথে কথা বলোনা কেন?
মাহিদ চেয়ে থাকে৷ মেরিনা হেসে কুটিকুটি হয়। রাহি গালে হাত ছুড়তে ছুড়তে বলে,
‘ না-না-নাহি।
রাহি হাসে। বলে,
‘ তুমি আমাকে মারো কেন?
মাহিদ রাহিকে টেনে ধরে। বলে,
‘ শালা তুই শ্বশুরের সামনে প্রেম করতাছোস? লজ্জা কর একটু বাপ।
রাহি বলল,
‘ মিহি বকো কেন?
মাহিদ চাটি মারল রাহির মাথায়। বলল,
‘ তুই পড়ালেখায় ফাঁকিবাজ। তোর মতো ফাঁকিবাজরে আমি মাইয়া দিতাম না।
রাহি হাত দেখিয়ে বলে,
‘ রাহির বিমানে চড়তে মন চায় কেন? বিমান চালাতে মন চায় কেন?
মাহিদ হা হু করে হাসল। হাসল মেরিনা ও। রাহি বলল,
‘ সব্বাই হাসো কেন?
মাহিদ মেরিনাকে কোলে তুলে নেয়। গালের সাথে গাল লাগিয়ে রেখে বলে,
‘ তুমি হাসো কিল্লাই মেরিমা। তুমি কি বুঝছো?
মেরিনা জিহ্বা দেখায়। সামনের দুটো দাত দেখায়। বলে,
‘ আম-আম-আমমমা।
মাহিদ হাসে। বলে,
‘ তোমার ডাক্তার মা বড় চালাক। সুযোগ পাইয়্যা আইজ মেডিক্যালে চইলা গেছে।
মেরিনা ডাকে,
‘ আফ-আফ-ফা।
মাহিদ বলে,
‘ আব্বা কইবা।
মেরিনা হাসে। রিপ রুমে ডুকে মেরিনাকে কোলে নিয়ে নেয়। মাহিদকে বলে,
‘ পিহুকে গিয়ে নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি। মেরি আমার কাছে থাকুক।
রিপ মেরিনাকে জিজ্ঞেস করে,
‘ থাকবে না আমার সাথে?
মেরিনা রিপকে দাঁতদুটো দেখিয়ে হাসে। আঙুল দিয়ে রিপের চোখ ছুঁতে চাই। তারপর বলে,
‘ ব্যা-ব্যা-
রাহি কোমরে হাত দিয়ে বলে,
‘ ব্যারিসটার। ব্যারিসটার বলবে মিরি। মিরি কথা বলতে পারেনা কেন?
মাহিদ আর রিপ একত্রে হাসে। রিপ বলে,
‘ মিরি এখনো ছোট তাই।
_____________
মাহিদ রিকশায় উঠে। পিহু হাত বাড়িয়ে বলে
‘ টেনে তুলো।
মাহিদ পিহুর হাত টেনে ধরে তুলে। মিনমিন করে বলে,
‘ তোমার সোহাগ রাস্তায় পড়ে লুটোপুটি খাইতেছে ডাক্তারণী৷
পিহু হাসে। মাহিদের এক বাহু আঁকড়ে ধরে মাথা রেখে হাসে। বলে,
‘ আমার মেয়েকে খাইয়েছ?
মাহিদ বলল,
‘ না। উপোস রাখছি।
পিহু মন খারাপ করে বলে,
‘ মায়া হয়না?
মাহিদ হাসে। বলে,
‘ মায়ের মায়া হয়না। আমার কি?
পিহু হাসে। বলে,
‘ তুমি আজ বাসায় আছো তাই রেখে গিয়েছি। নইলে নিয়ে যেতাম। আর মা আমাকে নিয়ে যেতে দেয়না। মেরি ওদের সাথে থাকে।
মাহিদ বলল,
‘ থাকবে না। তুই নিয়ে যাবি। নইলে আমি নিয়া যামু৷
পিহু হাসল। বলল,
‘ আচ্ছা। মাহিদ বলল,
‘ মুখে মুখে কথা কইবিনা বাপ। ধাক্কা দিয়া ফালাই দিয়ুম।
পিহু হাসতে হাসতে ঢলে পড়ে মাহিদের গায়ে।
_______________
নাবিদকে কোলে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ানো ছেলেটির হঠাৎ মনে হলো গা বেয়ে গরম গরম তরল কিছু পড়ছে। নিনিত জোরে ডাকল,
‘ জালিশা? এই জালিশা?
জালিশা দৌড়ে এল। নিনিত বলল,
‘ তোমার ছেলে তো শেষ করে দিল সব।
জালিশা হেসে গড়াগড়ি খেল যেন। মুখে হাত দিয়ে বলল,
‘ আব্বু হাগু করে দাওনি কেন?
নিনিত বলল,
‘ তাড়াতাড়ি কোলে নাও জালিশা। আমাকে চেন্জ করতে হবে।
জালিশা মুখ ভাঙায়। বলে,
‘ এজন্যই মা, মা ই হয়।
নিনিত রেগে তাকালো। বলল,
‘ আচ্ছা। আমি পরিষ্কার করতে পারিনা?
জালিশা হাসে। বলে,
‘ দেখান।
নিনিত ছেলেকে নিয়ে যেতে যেতে বলে,
‘ আপনি এটা কি করলেন নাবিদসাহেব? সুসু করার আর জায়গা পাইলেন না?
নাবিদ শুধু তাকিয়ে থাকে। নড়াচড়া করে চেন্জ করিয়ে দেওয়ার জন্য। মাত্রই পাঁচ মাস বয়স তার।
নিনিত তাকে চেন্জ করিয়ে দেয়। নাবিদ বিছানায় শুয়ে হাত পা নেড়ে খেলা করে। জালিশা হা করে তাকিয়ে দেখে নিনিতকে। বলে,
‘ সত্যি সত্যি চেন্জ করিয়ে দিয়েছেন?
নিনিত হাসল। বলল,
‘ তুমি করো তাই আমি করিনা। আমি সব পারি। ছেলেটা কিন্তু আমার ও।
জালিশা হাসল। বলল,
‘ জানি। মাঝেমধ্যে আমি কিন্তু এই মানুষটাকে একদম চিনে উঠতে পারিনা। কিন্তু মাঝেমধ্যে খুব বেশিই চিনে ফেলি। নিনিত হাসে। বলে,
‘ আমি তোমার কাছে তেমনটা, তুমি আমার কাছে যেমনটা৷
_______________
মধ্যরাত। হঠাৎ আচমকা বাতাস বইতে শুরু করল। খোলা জানালা দিয়ে শাঁ শাঁ বাতাস বইতে শুরু করল। ইশার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে ঘুমঘুম চোখে উঠে দাঁড়াল।
জানালার কাছে গিয়ে ডাকল,
‘ ডক্টর, এই ডক্টর ? এদিকে আসুন। তাড়াতাড়ি আসুন। আমি জানি আপনি এখনো ঘুমোননি। তাড়াতাড়ি আসুন না ডক্টর। প্লিজ।
আদি ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,
‘ আসছি। এভাবে কেউ ডাকে? ভয় পেয়েছি না?
____________
কোর্টের সব পেপারে চোখ বুলিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেওয়ার সাথে সাথে ঝড়ো হাওয়ায় পড়ে গেল বারান্দার ফুলের টব। ধুপধাপ আওয়াজ হলো। মাহিদের গলার আওয়াজ শোনা গেল। রিপ তাই রুম থেকে বের হলোনা। বন্ধ জানালা খুলল, বাইরে কি হচ্ছে তা দেখার জন্য। লম্বা লম্বা পা ফেলে রিপ নীরার কাছে চলে এল। ঘুমে ঢুলঢুল নীরাকে বলল,
‘ নীর,উঠো। এই শুনছ? উঠো। এখন ঘুমানোর সময় আসেনি নীর। ওঠো,দেখো।
নীরা বলল,
‘ কি হয়েছে ব্যারিস্টার? কি দেখব?
রিপ বলল,
‘ আসো দেখায়। নামো। আসো।
নীরা গেল। রিপ নীরাকে দাঁড় করিয়ে দিল জানালার পাশে। নীরার পেছনে দাঁড়িয়ে নীরাকে আগলে ওই দূরে বকুল তলা দেখিয়ে দিল। নীরা একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থাকল। বেশখানিক্ষণ পর রিপের দিকে ফিরে বলল,
‘ আপনার প্রিয় গাছের সব ফুল ঝড়ে যাচ্ছে। আপনি তারপর ও এত খুশি কেন ব্যারিস্টার?
রিপ হাসল। বলল,
‘ আজ ” মন কেমনের বৃষ্টি ” নেমেছে নীর। আজ সব বকুল ঝড়ে যাক। আবার নতুন করে ফুল ফুটুক।
________________
আদি ইশার পেছনে এসে দাঁড়াল। ইশার উপর ভার দিয়ে হেলে পড়ে বলল,
‘ কেন ডেকেছ মিষ্টি?
ইশা বলল,
‘ ডক্টর দেখুন। দেখুন না।
ইশা ওই দূরের বকুলতলা দেখিয়ে দেয়। বাতাসের ঝাপটায় বাল্বগুলো মিটিমিটি জ্বলছে। তারমধ্যে বকুল ফুল ঝড়ছে গাছ থেকে অবিরত।
আদি বলল,
‘ সব তো ঝড়ে যাচ্ছে মিষ্টি।
ইশা হাসল। জানালা দিয়ে হাত বের করে দিয়ে বলল,
‘ ডক্টর এই বৃষ্টি যেমন তেমন বৃষ্টি নয়। মন কেমনের বৃষ্টি। ঝড়ে তো পড়বেই। আবার নতুন করে ফুল ফুটবে।
আদি বলল,
‘ মিষ্টি সাদা শাড়ি পড়া মেয়েটি কে ওই গাছতলায়?
ইশা ফটাফট জানালা বন্ধ করে দেয়। বলে,
‘ মধ্যরাত তাই হয়ত ভুল কিছু দেখেছি ডক্টর। ভূত পেত্নী হবে হয়ত। চলুন।
আদি ইশাকে টেনে ধরে। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ হ্যা হ্যা মানুষ পেত্নী। পেত্নী ও এই বৃষ্টিকে অনুভব করুক। দরকার তো খুব।
ইশা হাসল। আদি ও হাসল।
_________________
সাদা শাড়ির আঁচলে বকুল ফুল ভর্তি করে নিয়ে মেয়েটি তাকালো কিছুটা দূরে তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা ছেলেটির দিকে। বলল,
‘ নেবেন? ফুল কুড়াবেন? প্রেম কুড়াবেন? আজ যে মন কেমনের বৃষ্টি ঝড়ছে।
রেহান হেসে দুই পা এগোয়। মেয়েটির কাছে গিয়ে দাঁড়ায় দূরত্ব কমিয়ে। পরীর শাড়ির আঁচল থেকে দুহাত ভর্তি করে নেয় বকুল ফুলে। পরীর মাথার উপর সেই ভেজা বকুল ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে বলে,
‘ আমি বলেছিলাম, আমি ফিরব। আমি ফিরেছি। আমি বলেছিলাম ভালোবাসব। ভালোবেসেছি। আমি বলেছিলাম মন কেমন করা বৃষ্টি আসবেই। আজ এসেছে। এই মন কেমনের বৃষ্টি আজ আবার ও এই রেহান আর পরীর ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে থাকুক যুগ যুগ ধরে। প্রত্যেক পরী আর রেহানের মতো করে প্রত্যেকের জীবনে মন কেমনের বৃষ্টি একবার হলেও আসুক । দিনটা হোক ভালোবাসার। রাতটা হোক ভালোবাসার। এই মন কেমনের বৃষ্টি নামুক প্রত্যেকটা ভালোবাসা বাসিদের জীবনে।
পরী মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে রেহানের দিকে। ধীরে ধীরে রেহানের দুহাতের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বুকে মাথা রেখে বলে,
‘ নামুক না। ক্ষতি কি?
_________________
ছাদে জমেছে পানি। সেই পানিতে ডুবে আছে মেয়েটির পা। মেয়েটি ছেলেটিকে টেনে নিয়ে এল। ছেলেটির গলা জড়িয়ে ধরে মুখটা আকাশের দিকে করে রেখে বলল,
‘ ডাক্তারবাবু আজ আমি খুব খুব খুব খুশি।
নিনিত বলল,
‘ এত খুশির কি কারণ?
জালিশা হাসল। বলল,
‘ এই যে মন কেমনের বৃষ্টি ঝড়ছে। আমাদের নামে। প্রত্যেক প্রেমিকের নামে। প্রত্যেক প্রেমিকার নামে।
নিনিত হাসল। বলল,
‘ মন কেমনের বৃষ্টিকে আসতেই হতো। আবার নতুন করে শুরু হওয়ার আগে শেষ করাটা যে খুব জরুরি।
____________
নীরা দৌড়ে বারান্দায় চলে যায়। এদিকওদিক করে তাকাতে তাকাতে বলে,
‘ ব্যারিস্টার পিহু মনে হয় ওটা। এভাবে ভিজছে কেন? আমার মেরির জ্বর-টর বাঁধলে?
রিপ নীরাকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে,
‘ এই বৃষ্টি আর কখন নামে হিসেব আছে? আজ ভিজুক।
দুহাত মেলে চড়কির মতো ঘোরা মেয়েটি মুখ উঁচু করে রাখে। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে তার মুখে।
দূরে দাঁড়ানো ছেলেটি হাতে সুঁচের ফোঁড়া খায়। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে। মেয়েটি দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে
‘ ব্যাথা পেয়েছ?
ছেলেটি হাসে।
পিহু এবার নাক ফুলায়। বলে,
‘ মাহিদ ভাই হাসার কথা বলেছি আমি?
মাহিদ আর ও একটা ফুল গেঁথে মালাটি সম্পন্ন করে। সুঁচটা দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে শাড়ির আঁচল টেনে পিহুকে কাছে আনে। হেসে হেসে পিহুর মুখের দিকে তাকিয়ে গাঁথা মালাটি পড়িয়ে দেয় পিহুকে। পিহু নিজের গলার মালাটির দিকে তাকিয়ে হাসে। মাহিদের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ মালা গেঁথেছ কেন?
মাহিদ বলল,
‘ এই যে আজ সব ফুল ঝড়ে যাচ্ছে।
পিহু বলল,
‘ তোমাকে কি দেব আমি?
মাহিদ বলল,
‘ এই যে দিলি এমন একটা মুহূর্ত। তুই আছিস আমার সাথে, আর কি লাগে? এই মন কেমনের বৃষ্টি কি আজ আসত? যদি তুই না থাকতি আমার সাথে?
পিহু মাহিদের গলার কাছে মুখ রাখে। শুষে নেই জল। কাঁপানো গলায় বলে,
‘ আজকের মতো রোজ রোজ একটু একটু করে মন কেমনের বৃষ্টি নামুক। কপোত-কপোতীরা রোজ রোজ একটু একটু করে প্রেম কুড়াক৷ একটু একটু করে মন কেমনের বৃষ্টিকে অনুভব করুক। একটু একটু করে ভালোবাসুক। ভালোবাসায় রঞ্জিত হোক মন কেমনের বৃষ্টিরা।
মাহিদ দুবাহুর বন্ধনে পিষ্ট করে অর্ধাঙ্গিনীকে। বলে,
‘এই বৃষ্টি আয়। আজ ভিজিয়ে দিয়ে যাহ। রাঙিয়ে দিয়ে যাহ। রটিয়ে দিয়ে যাহ। রচনা করে যাহ। আবার, আবার ও লিখে দিয়ে যা একটি, হাজারটি #মন_কেমনের_বৃষ্টি ‘র গল্প।
অর্ধ-সমাপ্ত
?আজকে সব সাইলেন্ট পাঠক ও রেগুলার পাঠকদের মন্তব্য চাই।
?সিজন ৩ আসবে না। তাই কেউ এই অনুরোধ করবেন না। পারলে কোনো এক মন কেমনের দিনে হুট করে একটি বোনাস পর্ব উপহার দেব আপনাদের শুধু রাহি আর মেরিকে নিয়ে।
?এতদিন ধরে যারা পাশে ছিলেন সবাইকে অন্তরের অন্তরস্থল থেকে ধন্যবাদ, ভালোবাসা। সবাই ভালো থাকবেন। ভালো রাখবেন। আল্লাহ হাফেজ।
বোনাস পর্ব দেওয়া হয়েছে