#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_৩৫,৩৬
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা
৩৫
সকাল সকাল পিহু চৌধুরী বাড়িতে চলে এল। রিপ নিয়ে এসেছে। পিহু মেডিক্যালে যাবে তাই। নীরা যদিও আসতে দিচ্ছিল না। কিন্তু পিহু আর থাকতে চাইলো না। অনেক বেড়ানো হয়েছে। ইশা রিপকে বলল
‘ রিপদা তুমি দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে যেও।
‘ সম্ভব না ইশু। কোর্টে যেতে হবে। আমি পিহুর সাথে সেজন্য বেরিয়ে পড়েছি। ওকে একা ছাড়তে মন সায় দিচ্ছিল না। আমি আবার আসবো। ভালো থাক।
‘ কিন্তু তুমি আর কবে আসবে। খেয়ে যাও না। কোর্টকাছারি তো সারাবছরই করছ। প্লিজ প্লিজ।
‘ এগুলো কেমন আবদার ইশু? এভাবে বললে তো যেতে পারিনা। কিন্তু যেতে হবে। শোন তোর হাতের রান্না খাওয়ার অনেক সুযোগ আসছে সামনে। তখন মনভরে খাব। চিন্তা নেই।
ইশা রহস্যময় হাসলো। রিপ বলল
‘ এখন ছাড়। পরে আসবো। আসবো যখন বলেছি তখন আসবো। নইলে এক কাজ কর না। তুই গিয়ে বেড়িয়ে আয়। যাবি যাবি করে আর গেলি না।
‘ যাব কিছুদিন পর। তুমি থাকো না।
‘ আর বলিস না। আসি। ভালো থাকিস৷ পরী আর ছিকু কিছুদিন থাক। মাহির সাথে চলে আসবে। ভালো থাকিস। যাস। হ্যা?
ইশা দু পাশে মাথা দুলালো। বলল
‘ তুমি ও এসো। নইলে আমি ফোন করে করে খুব জ্বালাবো।
রিপ হেসে বলল
‘ আচ্ছা।
_________
ঘুম থেকে উঠে মাহিদ শুনলো ডাক্তারের বাচ্চি চইলা গেছে। সকাল সকাল মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার। কিছুদিন পর তার ইসতিরি হইবো অথচ তারে না কইয়্যা চইলা গেছে। শালীরে পাইলো এমন মারা মারবো বাপের নাম ভুইলা যাইবো।
ছিকু এসে মাহিদের কোলে উঠার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ মিহি কুলে কুলে।
মাহিদ কোলে তুলে নিয়ে বলল
‘ শালা বুইড়া। তোর লাগি কিছুদিন পর বউ আনতে হইবো। তোর এখনো কোলে চড়ার ঢং গেল না। বুইজ্জা বেডা।
ছিকু বোকাসোকা গলায় প্রশ্ন করলো
‘ কেন? ছিকু বুজজা বিডা কেন?
‘ ধুর হ শালা। কিছুদিন পর তোর দাঁড়ি উঠবো আমার মতো। আমার ব্যারিস্টার বাপ তো আমারে দাঁড়ি রাখতে দেয়নাই। কিন্তু তোরে তোর বাপ মানা করতে পারবো না। কারণ তোরে আমি হিরো বানামু শালা। তুই সুন্দরসান্দর আছোস।
‘ কেন? ছিকু হিরু হুবে কেন? কেন বাপ কেন?
‘ ওরেব্বাপ কেন কেন বন্ধ কর। নইলে তোরে এক আছাড় দিমু এহন।
ছিকু মাহিদের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা ফেলে রেখে বলল
‘ ছিকু গুড বয় কেন? মিহি ব্যাড বয় কেন?
নীরা তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে এল। বলল
‘ মাহি তোরে কি নিনিত ফোনটোন দেয়নাই?
‘ টোন দিছে।
‘ ধুর মজা করিস না। আমি সিরিয়াস।
‘ আমি ও সিরিয়াস। পিহুনির জামাই মোরে ফোন দেইনাই।
নীরা কেমন করে তাকিয়ে চলে গেল। ছিকু নীরার যাওয়া দেখে মাহিদকে প্রশ্ন করলো
‘ মিহি নিনিকে ফুনটন দিনাই কেন?
মাহিদ হো হো করে হেসে উঠলো৷
____________
পিহু মেডিক্যালে মাত্রই পা দিয়েছে। নিনিতকে সে দেখেছে। নিনিত তাকে এখনো দেখেনি। পিহু সরে গেল। ক্লাসে যাওয়ার আগেই নিশিতা এল। বলল
‘ ফার্মাকোলজির শিটগুলো তোর কাছে আছে?
‘ হুহ।
নিশিতা বলল
‘ আমাকে দিস।
‘ নিস।
‘ তুই কি আমার উপর কোনো কারণে রেগে আছিস?
পিহু চুপ থাকলো। হয়ত রাগ অভিমান ছিল। কিন্তু এতটা দূরে সরে আসবে পিহু ভাবতে পারেনি। নিজ থেকে সেটা স্বীকার ও করতে পারছেনা। নিজেরই কষ্ট হচ্ছে। যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে পড়ার চেষ্টা করলো পিহু। নিশিতা তার পেছনে গিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো। বলল
‘ আমি আমার আগের বান্ধবীকে মিস করছি। আমার ভুল থাকলে শাস্তি দে। কিন্তু এমন করিস না।
পিহুর গলা ভার হয়ে থাকলো। নিশিতা তার সামনে চলে এল। বলল
‘ দেখ, তুই আমার বেস্টি। তুই কতদিন আমার সাথে আগের মতো কথা বলছিস না, হাসছিস না। আমার কষ্ট হচ্ছে রে বিশ্বাস কর।
পিহু মাথা নিচে নামিয়ে নিল। নিশিতা তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। বলল
‘ এই আমাকে ও একটু জড়িয়ে ধর তো। মান অভিমান একটু ঘুচিয়ে ফেলি। তুই আমার ভাইয়ের বউ হবি তো।
পিহু কিছু বলতেই যাচ্ছিল শেষ কথাটা শুনে আটকে গেল কথা। বলা হলো না। তবে নিশিতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো৷ ফুঁপিয়ে উঠলো। যার মানে এই, আমি তোর এই আশা কখনো পূরণ করতে পারব না রে।
_________
নিনিত মাত্রই ছবিগুলো হাতে নিয়েছে। সামান্য কৌতুহল কাজ করছিল মাইশার হাতের ছবিগুলো দেখার জন্য। ছবিগুলো দেখার সাথে সাথে আগ্রহ মিটেনি বরঞ্চ হাজার ও প্রশ্ন এসে জমা হলো মনে। মাইশা দিব্যি বাবোলগাম চিবিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর বলল
‘ বুঝেছেন কিছু?
নিনিত বোকাসোকা চোখে চাইলো। বোবামুখে চেয়ে থাকলো। মাইশা হাসলো। ছবিগুলো কেড়ে নিয়ে বলল
‘ এবার বলুন তো আমি ভালো ফটোগ্রাফার না? ক্যামেরা ছাড়া এত সুন্দর ছবি নিলাম।
নিনিত এখনো চুপ।
‘ কি মিন করতে চাইছেন আপনি?
‘ কেন? আমার তোলা ছবি তো কথা বলে।
নিনিতের হাঁসফাঁস লাগলো। মাইশা বলল
‘ দেখুন আমার মনে হলো এই বিষয়টা আপনার জানা দরকার। বিয়ে একটা জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক। এটাকে নিয়ে হেলাফেলা করা উচিত না। যেটা আপনি এবং মিঃ মাহিদ করছেন। আপনি জালিশাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন আর মিঃ মাহিদ পিহুকে। কেন সেটা আমি জানিনা। কিন্তু এটা ভুল৷ এই মানুষগুলো কিন্তু আমাদের জীবনে সবচাইতে সঠিক মানুষ। আমি আপনাকে জ্ঞান দেওয়ার কেউ না,তারপর ও বলছি জালিশাকে একটু বুঝতে শিখুন। ও কোনোদিক দিয়ে আপনার চেয়ে কমতি না। ও যতটা সুন্দর ওর মনটা তার চাইতে ও বেশি সুন্দর। আমি ওর সাথে অল্প মিশেই বুঝতে পেরেছি। যেমনটা মিঃ মাহিদ আর পিহুকে। আপনি মিঃ মাহিদকে আমার নামটা বলবেন না। উনি আমাকে অনেক বিশ্বাস করে। এবং ভালো বন্ধু মনে করে। আমি ওনার বিশ্বাস ভাঙতে চাই না। ওনার কথাবার্তায় যা বুঝলাম ওনি আপনাকে কিংবা পিহুকে বলার সুযোগটুকু পায়নি। ওনাকে কেউ সুযোগটা দেয় নি। তারপর এতসব হয়ে গেল। আপনি ও ওর পাশে ছিলেন না। এইবার তো সব জানলেন।
নিনিত হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। মাইশা তারপর চলে গেল৷ নিনিত কতক্ষণ একিভাবে বসে ছিল তার জানা নেই। সব যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ভীষণ রকম রাগ, আর জেদ হচ্ছে। কেন হচ্ছে তা জানা নেই।
হসপিটাল থেকে সোজা রাস্তায় চলে এল সে। পথে নেমে মেডিক্যাল গেইট পার হয়ে কলেজ গেইট ধরতেই মাহিদকে দেখা গেল রাস্তার বিপরীতে। যেখানে বেশিরভাগ সময় ও দেখা যায় তাকে। নিনিতকে দেখে সবাই মিলে কি কি যেন বলে হেসে উঠলো। নিনিত তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। মুখটা থমথমে। মাহিদ তার পিঠ চাপড়ালো। বলল
‘ তোর আবার কিতা হয়ছে বাপ? মুখটা অমন কইরা রাখছোস ক্যান? বিয়া করবি, তাই চিল থাকবি।
নিনিত হাত সরিয়ে বলল
‘ একা আয়। কথা আছে।
মাহিদের সাথে সাথে সবাই হাসলো। মাহিদ হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ একা একা ক্যান? সবার সামনে বল বাপ। একা যাইতে পারুম না।
নিনিত তার হাত ধরলো। বলল
‘ চল। কথা আছে।
মাহিদ হেসে উঠে নিনিতের পেটে হালকা ঘুষি মারলো। বলল
‘ আরেহ বইলা ফেল যা বলার। লজ্জা পাইতাছোস ক্যান?
‘ লজ্জা কেন পাব? চল কথা আছে।
মাহিদ গেল না। নিনিত বলল
‘ ভীষণ জরুরি কথা আছে তোর সাথে চল। আরিশার ব্যাপারে।
মাহিদের হাসিহাসি চেহারা নিভু নিভু হয়ে গেল। পরক্ষণে হেসে উঠে বলল
‘ ওরে নিয়ে কি কথা? তোর বউ কি আমারে দিয়া দিবি নাকি?
মাহিদের কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো। নিনিত ঘুষিটা একদম নাকঠোঁট বরাবর বসিয়েছে বোধহয়। সবার হাসি বন্ধ হয়ে গেল। মাহিদ কয়েক পা পিছিয়ে গেল মুখে হাত দিয়ে। সবাই চরম অবাকের পর্যায়ে। তপু বলল
‘ এটা কি করলি দোস্ত? ও তো মজা করে বললো। তোর বউকে নিয়ে খারাপ কিছু তো বলেনি৷
মাহিদ শুধু অবাক চোখে নিনিতের দিকে চেয়ে থাকলো। নিনিত রক্তাক্ত চোখে তাকালো তার দিকে। আঙুল তুলে বলল
‘ তোর বন্ধু দরকার নেই আমার। বন্ধুত্বের সংজ্ঞাটা শিখে নিস ভালো করে।
গজগজ করে কথাটুকু বলে চলে গেল সে৷ মাহিদের ঠোঁটে ভীষণ জ্বালা করছে। ফুঁলে ছিঁড়ে গেছে। লাবীব বলল
‘ ওকে কি পাগল হয়ে গেছে নাকি রে? কি হলো? দাঁড়া আমি পানি আনি। ঠোঁট তো ফুলে গেছে দোস্ত৷ রক্ত দেখা যাচ্ছে।
মাহিদ ঠোঁট মুছে বলল
‘ চলে যাবে। বাসায় যাহ। কথা হবে।
তপু আর লাবীবকে বিদায় দিয়ে মাহিদ বাড়ি ফিরে এল। নীরা তাকে দেখে হায়হায় করে উঠলো। বলল
‘ এই অবস্থা কেন মাহি? কার সাথে ঝগড়া করেছিস? কি হয়েছে?
মাহিদ কোনোটারই উত্তর দিল না। সোজা ঘরে চলে গেল। মুনা বলল
‘ জোরাজোরি করিস না। যা বলার এমনিতেই বলবে। এক কাজ কর নিনিতকে ফোন দে। ও ভালো জানবে।
নীরা তাই করলো। নিনিত ফোন তোলার সাথে সাথে বলল
‘ আমি ওই নামের কাউকে চিনিনা। আমার কাছে কোনো খবর নেই আন্টি।
নীরা তার কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো। এসব কেমন কথা? তারমানে তার আর মাহির মাঝে কোনো ঝামেলা হয়েছে?
_____
ছিকু বি অক্ষরটা লিখে পিহুকে দেখিয়ে বলল
‘ বিটিফুল কেন?
পিহু বলল
‘ সি লিখেন।
‘ কেন চি লিখবু কেন?
‘ মাথার জন্য।
ছিকু সি লিখলো। ডি লিখলো। তারপর বলল
‘ ছিকুর মুনে নাই কেন?
পিহু বলল
‘ ডি’ র পরে ই হয়।
‘ কেন? ই হয় কেন?
পিহু হেসে তার গাল টেনে দিয়ে বলল
‘ আমার কলিজা।
ছিকু পিহুর গাল টেনে দিল। তখনি পিহুর ফোন বেজে উঠলো। নিশিতা ফোন করেছে। পিহু ফোন তোলার সাথে সাথে সে বলল
‘ মাইশা কয়েকদিনের মধ্যে তোর এত আপন হয়ে গেল? তাকে মনের কথা সব বলে দিতে পেরেছিস আর আমি? বাহ!
ভালোই। আমার ভাইকে বিয়ে করবি না সেটা সোজাসাপ্টা বলে দিতে পারিসনাই? মেয়ে কি কম পড়েছে আমার ভাইয়ের জন্য? কি দরকার ছিল এত ঢং করার? আমাকে বলে দিলে তো হতো। একেবারে না করে দিতাম।
পিহু বলল
‘ তুই এভাবে কথা বলছিস কেন?
‘ তো কিভাবে বলব? অনেক তো করেছিস। এবার একটু অফ যাহ না। শুরুতেই বলে দিলে আজ এতকিছু হতো না। নাকি তোকে আমার ভাই জোর করেছিল? কাজটা তুই ভালো করিসনি।
‘ আমার সাথে তুই এভাবে কথা বলতে পারিস না নিশু।
‘ পারি কারণ এখন আমি যার সাথে কথা বলছি তার সাথে এককালে আমার বন্ধুত্ব ছিল। এখন নেই। আমার বান্ধবী মরে গেছে। আমু তোর বন্ধু হতে পারলাম কই? আমি তোকে নিয়ে যতটা ভাবি তুই তার দু আনা ও ভাবিস না। ভালো থাক। সুখী হ।
নিশিতা ফোন কেটে দিল। পিহু ফুঁপিয়ে উঠে ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকলো। ছিকু ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকলো। ঠোঁট টেনে বলল, পিহু কাঁদে কেন?
ইশা এসে বলল
‘ পিহু তোমার ফোনে কি ব্যালেন্স আ,,,,,,
ইশা থামলো। বলল
‘ কি হয়েছে সোনা? পিহুকে মেরেছেন?
‘ পিহুকে ফুন বুকা দিচে কেন? পিহু কাঁদে কেন? ছিকুর দুক্কু লাগে কেন?
পিহু তাড়াতাড়ি গাল মুছে নিজেকে সামলে বলল
‘ ফোনে ব্যালেন্স আছে আম্মা। নিয়ে যাও।
ইশা ফোনটা তুলতে তাকিয়ে থাকলো পিহুর দিকে। ছিকুকে কোলে নিয়ে চলে গেল।
ইশা যেতেই পিহু আবার মুখ ঢেকে নিল ওড়নায়।
রাতে খাবার দাবার খেয়ে ঘুমাতে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে তখন। পিহুর ফোনে মাহিদের কল এল৷ পিহু ফোন তুললো খানিক্ষন পরে। মাহিদ বলল
‘ এতক্ষণ লাগে ক্যান?
‘ সবসময় ফোনের কাছে বসে থাকবো নাকি? কেন ফোন করেছ? কি চাই?
‘ এমন খ্যাঁকখ্যাঁক করে কথা বলতেছস কেন? সব বিরক্ত শুধু আমার উপর ঝাড়িস কেন?
‘ সবকিছুর মূল তুমি তাই। এই যে এতকিছু হচ্ছে সব তোমার জন্য।
‘ আমি?
‘ হ্যা তুমি। লজ্জায় তো আমি মুখ দেখাতে পারব না। নিশি আমাকে ভুল বুঝলো। আন্টি ভুল বুঝলো। স্যার হয়ত দেখলেই পাশ কাটবে। আমি কি করব তুমি বলতে পারো?
‘ পাশ কাটতে দিচ্ছিস কেন? পাশাপাশি হাঁট। সমস্যা কি? আমি যখন এতই সমস্যা তখন সরে যাচ্ছি। তোরে ফোন ও আর কেউ দিত না। যাহ থাক তুই তোর মতো। খবরদার যদি আমার খোঁজখবর নিস তোরে জিন্দা খবর দিমু। খোঁজখবর নিবিনা। মরলে ও নিবিনা। রাখ। তোরে ছাড়া আমার বেশ চলবো।
চলবে,
#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_৩৬
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা
মাহিদের মুখ ফুলে গেছে ঠোঁটের ব্যাথায়। গায়ে জ্বর ও এসেছে। মাথা ভার হয়ে আছে। সকাল সকাল নীরা এসে পরপর অনেকবার দেখে গেল। মাহিদ উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে। নীরা এতগুলো প্রশ্ন করলো একটার ও উত্তর দিল না। নীরা শেষমেষ বলল
‘ তোর বাপকে ডেকে আনি?
মাহিদ নড়লো। বলল
‘ কেন?
‘ কেন মানে? তুই এভাবে চিত হয়ে পড়ে আছিস কেন সেই তখন থেকে? কি সমস্যা? নিনিতের সাথে কি নিয়ে ঝামেলা হয়েছে? ও তোকে মেরেছে তাই তো? আমি বোধহয় ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। ভালোই হয়েছে। ঝামেলার বিষয় কি পিহু?
মাহিদ শক্ত হয়ে শুয়ে থাকলো এবার। নড়লো ও না।
নীরা পিঠে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিল। বলল
‘ উঠ। উঠতে বলেছি। উঠ মাহি। মাইরা খাস না। আমার হাতের বাইরে যাসনি এখনো। উঠতে বলেছি।
মাহিদ উঠে বসে বলল
‘ উফফ কি সমস্যা তোমাদের? আমি কিছু জানিনা। আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন?
‘ তো কি তোর বাপকে জিজ্ঞেস করব বেয়াদব? নিনিতের সাথে কি হয়েছে? আমার দিকে তাকা।
মাহিদ তাকালো। নীরা বলল
‘ কি হয়েছে?
‘ কিছুই হয়নি।
দায়সারা ভাবে কথাটা বলল মাহিদ। নীরা বলল
‘ আমি কি পিহুকে ফোন দেব?
‘ আমি কি জানি?
নীরা চলে গেল। পিহুর ফোনে কল দিল। পিহু ফোন তুললো। স্বাভাবিক গলায় বলল
‘ কোনো সমস্যা মামি?
‘ নিনিত আর মাহিদের কি হয়েছে জানো? নিনিত বোধহয় রেগে গায়ে হাত তুলেছে।
পিহু চমকালো। গায়ে হাত তুলেছে? মেরেছে?
‘ হ্যা।
পিহু আর কথা বললো না। নীরা বলল
‘ এখন আমার কি করা উচিত?
‘ আমি কি বলব ? সব তোমার ছেলের দোষ। একদম ভালো হয়েছে মার খেয়েছে। আমি খুব খুশি হয়েছি। এরকম হওয়ারই ছিল।
‘ তুমি ওর সাথে আর ফোনে কথা বলেছ?
‘ না। কেন বলব? আমি ফোন দিতে বারণ করেছি। দরকার নাই আমার। কাপুরুষ তোমার ছেলে। সব তোমার ছেলের জন্য হচ্ছে। মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতে বলো আর ও। আমি করব সব সমাধান।
বলেই জেদ করে ফোনটা কেটে দিল পিহু। নীরা রিপের কাছে গেল। বলল
‘ আপনি কি এভাবে বসে থাকবেন? এদের একটা বিহিত করুন না। আমার এসব আর ভালো লাগছেনা।
‘ আমি ইশুকে বলেছি।
‘ কি বলেছেন?
‘ বলেছি আর কি। আমার বেয়াইন হবে না কি?
নীরা অবাক গলায় বললেন
‘ সত্যি? কখন? আমাকে বলেননি।
‘ আহা রাগ করার কি দরকার? বলতাম তো।
‘ ইশু কি বলেছে?
‘ কিছুই বলেনি। হঠাৎ করে সারপ্রাইজ পেল তো, কথা বেরোচ্ছে না। আমি বলেছি পিহুকে জিজ্ঞেস করতে। ওর মত থাকলে তাড়াতাড়ি বিয়ে নামিয়ে ফেলব।
‘ আবার পিহুর মতামতের কি দরকার? মাইশা কি বলল শুনেননি?
‘ তারপর ও। পিহুর মত দরকার। মাহি কোথায়?
‘ এখনো শোয়া থেকে উঠছেনা। গায়ে জ্বর ও এসেছে।
‘ ডাক্তার আনার ব্যবস্থা করে ফেলো। জ্বর পালিয়ে যাবে।
‘ কিন্তু নিনিতের সাথে যে সমস্যা হলো।
‘ হওয়ারই কথা। আমি নিনিতের জায়গায় থাকলে আরও বেশি রাগতাম। বিয়ে, সম্পর্ক এগুলো হেলাফেলায় ফেলে রাখার বিষয় না নীরা। তাছাড়া বন্ধুত্বে বিশ্বাস, ভরসা, আশ্বাসের একটা ব্যাপার থাকে। যখন কেউ আমাদের বন্ধু ভাবে, আমাদের সাথে সব শেয়ার করে কিন্তু আমরা তার সাথে করিনা, মনের কথা বলিনা, সেই বন্ধুটি যখন সেটা জানতে পারে তখন তার খারাপ লাগবেই। এটাকে বলে বন্ধুর প্রতি বিশ্বাসের ঘাটতি। তোমার ছেলে বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখতে পারেনি। এটাই তার প্রাপ্য।
‘ তো? ও তো কিছু বলছেই না।
‘ না বলুক। ওর কথা শুনছে কে?
নীরা বলল
‘ ধুর আপনি ও মজা করেন ব্যারিস্টার।
______________
নিনিতের মেজাজ চটে ছিল বিধায় কেউ ডাকাডাকি করতে যায়নি। নিকিতা বেগম ও যায়নি। ও সহজে রাগেনা। কিন্তু রাগলে রাগ কমানো অনেক দুষ্কর। নিশিতা ঘরে কয়েকবার উঁকি দিয়েছিল৷ কথা বলার সাহস করে উঠতে পারেনি। জালিশা তা দেখে বলল
‘ কোনো সমস্যা?
‘ হ্যা রে। ভাইয়া সকাল থেকে গম্ভীর হয়ে আছে। তুই কি কফিটা দিয়ে আসতে পারবি। আমাকে যদি বকা দেয়, ভয় লাগছে।
জালিশা বলল
‘ না। আমি যাব কেন?
‘ যা না। তোর উপর রাগারাগি করবে না।
‘ হুহ দেখা যাক। যদি কিছু বলে বলব আমাকে তুই পাঠিয়েছিস।
‘ ঠিক আছে।
জালিশা নিশিতার দেওয়া কফিটা নিয়ে ঘরে পা রাখলো। নিনিত চোখ তুলে চাইলো। জালিশা বলল
‘ কফি।
‘ টেবিলে রেখে চলে যাও।
‘ চলেই যাচ্ছি, থাকতে আসিনি।
জালিশার তেজী গলা। নিনিত রুক্ষ দৃষ্টিতে তাকালো। বলল
‘ আমি আজেবাজে কথা পছন্দ করিনা জালিশা। বেরোও ঘর থেকে।
‘ বেরোবো না।
নিনিত তেড়ে গিয়ে হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে দিতেই জালিশা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল
‘ হাতটা এভাবে ধরেছেন কোন সাহসে? এত সাহস কোথাথেকে পেলেন?
‘ যথেষ্ট সাহস আমার আছে।
জালিশা হাতটা ছাড়িয়ে নিল। বলল
‘ ভুল কথা। আপনি একটা ভীতুর ডিম। সাহসিকতার ছিঁটেফোঁটা ও নেই আপনার মাঝে।
নিনিত রেগে চেয়ে থাকলো। জালিশা রসিকতা করে বলল
‘ ভীষণ ভয় পাচ্ছি। ওভাবে তাকাবেন না প্লিজ।
নিনিত চেঁচিয়ে বলল
‘ মা, নিশু কোথায়?
জালিশা বলল
‘ কেউ আপনার কথা শুনবে না।
নিনিত মহাবিরক্ত হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল
‘ কি চাইছো টা কি তুমি?
‘ আপনাকে তো চাইছিনা। এত মেজাজ দেখাচ্ছেন কেন?
‘ তো কি চাও?
‘ আমি যা চাই তা আপনি কি দিতে পারবেন? জেনে কি লাভ?
‘ জেনে কোনো লাভ নেই। লাভ লোকসান দেখে চলিনা আমি। দয়া করে এখান থেকে যাও।
‘ চলে যাব। আগামী মাসেই ফ্লাইট। আপনাকে জ্বালানোর জন্য আমি থেকে যাব না।
নিনিত এবার চুপ হলো। কিছুক্ষণ পর বলল
‘ তাহলে ঠিক আছে।
_______
পরী মহাখুশি। ইশার মুখ থেকে খুশির সংবাদ শুনে সে আর ছিকু খুশিতে আত্মহারা। ছিকু কোমর দুলিয়ে নাচলো। ডিংকাছিকা ডিংকাছিকা। মিহি পিহুর বিয়ে! ওহ মুজা মুজা।
রাইনা বলল
‘ কি আশ্চর্যের কথা। কথায় ঝগড়া আর মারপিট করা দুজন বউ জামাই হবে? সংসার করবে? তোদের মাথা কি গেছে? মারপিঠ তো লেগে থাকবে দুজনের মধ্যে।
ইশা মিটমিট করে হাসলো শুধু।
পিহু সব শুনে যাচ্ছে। সন্ধ্যার দিকে আদি ইশা তার ঘরে আসতেই সে চেঁচিয়ে বলল, কোনো বিয়েশাদি করব না আমি। কেউ যদি ভুলেও ওসবের নাম তুলে খবরদার আমি বের হয়ে যাব ঘরে থেকে।
ইশা বলল
‘ একি কথা? আমি রিপদাকে হ্যা বলে দিয়েছি। আকদটা সেড়ে ফেলব তাড়াতাড়ি। নিনিত আর জালিশার বিয়ের কথা ও পাকাপোক্ত হোক।
পিহুর কৌতূহলী প্রশ্ন।
‘ কখন?
‘ সেটা এখনো ঠিক করা হয়নি। নিনিতের বাবা তোমার পাপাকে বলেছে এমনি।
‘ আমি কিছু জানিনা। আমাকে বিয়ে টিয়ের ব্যাপারে কিছু বলতো এসোনা। আমি বিয়েশাদি করব না। আমার অনেক পড়াশোনা বাকি আছে। যাও তোমরা।
আদি বলল
‘ কিন্তু?
‘ কোনো কিন্তু না।
পরী এসে বলল
‘ ওভাবে বলছ কেন পিহু? ভাই তো,,
‘ তোমার ভাই সম্পর্কে কোনো কিছু জানার আগ্রহ নেই আমার। আমি বিয়ে করব না মানে করব না।
আদি ইশার পিছুপিছু বেরিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ মিষ্টি কি হবে এখন?
‘ জানিনা ডক্টর। রিপদাকে বলে দেখি।
‘ হ্যা ঠিক বলেছ। রিপকে বলো। ও ম্যানেজ করে নেবে।
______________
বাইরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে আজ ভালো করে। মাহিদের ঘর অন্ধকার। নীরা লাইট জ্বালালো। দেখলো মাহিদ নেই। বারান্দায় যেতেই দেখলো মাহিদ দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। নীরা বলল
‘ নিনিতের সাথে কথা হয়েছে তোর ? এই মাহি?
মাহিদ তার দিকে ফিরলো। মাথা নাড়ালো দুপাশে।
‘ তুই ফোন দিস নি?
‘ দিয়েছিলাম। তুলেনি।
‘ তাহলে দেখা করে আয়।
‘ নাহ।
‘ তো? নিজে দোষ করবি তা স্বীকার ও করবি না। একদম ভালো কাজ হয়েছে। পিহু একদম বেঁকে বসেছে। ও তোকে বিয়ে করবে না। তোর মতো ছেলেকে কোনো মেয়েই বিয়ে করতে চাইবেনা গাঁধা। এবার থাক দেবদাস হয়ে।
‘ কেন?
নীরা রসিকতা করে বলল
‘ কেন আবার? আপনি যে মহান, আপনাকে দেখে ধেইধেই করে নেচে যে কেউ বিয়ের পিঁড়িতে বসে যাবে এমন ভেবেছেন? মেয়েদের মন পেতে অনেক খাটাখাটুনি করতে হয়। আপনি তা আগেভাগে পেয়ে গেছিলেন তো তাই ধরে রাখতে জানেন নি । এবার বুঝেন ঠ্যালা। নিনিতের বিয়ের জালিশার সাথেই হবে। ও বউ পেয়ে গেছে। কিন্তু তুই? তুই তো আর বউ পাবিনা।
আমি তো তোর বাপকে বলেছি, ভালো একটা পাত্র যোগাড় করতে পিহুর জন্য। ও খুব ভালো একটা ছেলে ডিজার্ভ করে। কম জ্বালা তো জ্বালাসনি মেয়েটাকে। এবার একটু ভালো থাকুক।
মাহিদ নীরার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো। বলল
‘ কি বলছে পিহু?
‘ বলছে তোরে বিয়া করবে না। যারে পাইবে তারে করবে কিন্তু তোরে করবে না।
‘ কেন? রাগ করে বলছে।
‘ যে করেই বলুক। ও তোকে বিয়ে করবেনা বলছে।
মাহিদ হনহনিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা চৌধুরী বাড়ি হাজির। সবাই তাকে দেখে হতবাক। সবাই কতকিছু জিজ্ঞেস করলো মাহিদ বলল, সে ছিকুকে দেখতে এসেছে। পিহু একবার ও সামনে আসেনি। মাহিদ পিহুর ঘরে যেতে চাইলো। ছিকুর কারণে গেল না। শালা কিছু দেখলেই চিল্লায়।
আফি, আদি আর রেহান মিলে মাহিদের বারোটা বাজিয়ে ফেলল। সেই এক এক গা জ্বলানো বেয়াদব বেয়াদব কথা। ছিকু তো আছেই। পা তুলে তুলে কোমর দুলিয়ে নেচেনেচে বলল
‘ কেন? মিহি পিহুর বিয়ে কেন? মুজা মুজা লাগে কেন?
মাহিদের ইজ্জৎ সম্মান সব শেষ। ওই বেয়াদব বেডির লগে তার আসতে হয়ছে নইলে মানসম্মান নিয়ে টানাটানি পড়তো না। যে যা বলে গেল মাহিদ কানে ইয়ারফোন গুঁজে চুপচাপ বসে ছিল।
রাতের খাবার খাওয়ার সময় ও পিহুকে দেখতে পেল না মাহিদ। ছিকু তার সাথে খেয়েছে। সোফা উপর বসে আফির আঙুল নিয়ে খেলছে। মাহিদ তাকে ইশারায় ডাকলো। ছিকু তার কোলের উপর উঠে বসলো। মাহিদ তার তুষ্টুপুষ্ট গালে আদর বসিয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বলল
‘ পিহুর বাচ্চি কি করছে, কোথায় আছে দেখে আয়।
‘ ছিকু কিছু বলে উঠার আগেই মাহিদ তার গাল চেপে ধরলো। বলল
‘ মানইজ্জত আর খোয়াইস না বাপ। সব গেছে আমার। যাহ দেখে আয়।
ছিকু চলে গেল। পরী বলল
‘ কোথায় যাচ্ছেন আব্বা?
ছিকু ব্যস্ত মানুষের মতো জবাব দিল
‘ ছিকু পিহুর কাছে যায়।
পরী হেসে বলল
‘ আচ্ছা সাবধানে।
ছিকু পিহুকে দেখে ফিরে এল। মাহিদের।কোলে উঠে বসলো। মুখোমুখি বসে বলল
‘ পিহু ঘরে নাই কেন? পিহু ছাদি কেন?
‘ ছাদে গেছে? তাইলে চল। নাহ তোরে নিয়া যাইবো না। তুই এইহানে থাক।
ছিকু রেগে তাকালো। মাহিদ তার গালে আদর করে বলল
‘ তোরে চকলেট দিমু। চিপস দিমু। আইসকিরিম দিমু। আমার মাথা দিমু। তোর মাথা দিমু। কান্দিস না কেমন?
ছিকু কপাল কুঁচকে চেয়ে রইলো। মাহিদ তাট গাল জোরে টেনে দিয়ে চলে গেল। ছিকু ভয়ানক রেগে গিয়ে বলল
‘ মিহি ডগ কেন? ক্যাট কেন? মাংকি কেন?
আফি বলল
‘ মাহিদ্দে তোমারে চ্যাঁতায় দিছে? চেতাইওনা। আসো কোলে আইসা বসো। তোমারে আদর করি। আসো ভাই।
‘ কেন? ছিকুকে আদর কেন? ছিকু বড়ো কেন?
‘ ওমা বড় হইয়্যা গেছ? কিতা কও? তোমারে দেখলেই তো আদর করতে মন চায়।
‘ কেন মন চায় কেন? মন পুঁচা কেন?
‘ বুড়া হইতাছি তাই বোধহয়।
রাইনা এসে ছিকুকে কোলে তুলে নিয়ে বলল
‘ ছেলেটার সাথে ফালতু কথা বলতে বারণ করছি। কিসব হাবিজাবি কথা শিখাচ্ছে ওকে।
ছিকু রাইনার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল
‘ কেন দাদাই হাজুবুজি বুলে কেন?
রাইনা তার প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল। রাইনাকে হাসতে দেখে ছিকুও খিকখিক করে হেসে ফেলল।
______
পিহু হাঁটতে হাঁটতে ছাদে এসেছে। হাতে ফোন। নিশিতার ফোনে একের পর এক ফোন দিয়েই যাচ্ছে। রিং পড়ছে কিন্তু নিশিতা ফোন তুলছেনা। পিহু ফোন দিচ্ছে আর পায়চারি করছে। করতে করতে একসময় ক্লান্ত হলো। রাগে, জেদে হাতের মুষ্টিকাঘাত করতে লাগলো রেলিঙে।
মাহিদ ততক্ষণে পিহুর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। পিহু তাকে দেখে অবাক হলো না৷ বরঞ্চ ছাদের কর্ণিশে দুজন পাশাপাশি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল তার হিসেব নেই। পিহু যখন সরতে চাইলো৷ মাহিদ ওড়নার কোণা ধরে রাখলো। পিহু ওড়না ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল
‘ যত্তসব নোংরামি।
মাহিদ ওড়না ছেড়ে দিল সাথে সাথে। কথাটাই ভীষণ খারাপ লাগলো তার। পিহু চলে যেতেই মাহিদ পথ আটকে দাঁড়ালো। বলল
‘ তুই নাকি আমাকে বিয়ে করবি না বলেছিস৷
‘ হ্যা।
‘ কেন?
‘ সব কেন’র উত্তর নেই আমার কাছে ।
‘ কিন্তু আমার জানা দরকার।
‘ আমি তোমাকে বলতে বাধ্য নই। পথ ছাড়ো।
মাহিদ পথ ছাড়লো না। বরং পথ আরও ভালোভাবে আটকে দাঁড়ালো। বলল
‘ বন্ধু আমার গেছে। মার আমি খাইছি। সব ক্ষতি আমার হয়ছে। তুই এত রাগ দেখাস কেন? তোর তো কোনো ক্ষতি হয়নি।
‘ বন্ধু আমার ও গেছে। মার খাইনি। তবে বিষবাক্য শুনেছি। আর সব হয়েছে তোমার জন্য।
মাহিদ তার হাত খামচে ধরে বলল
‘ তাতে আমার দোষ কি?
‘ তোমার দোষ না? নিজের দোষ তো নিজে দেখবে না ৷ শুধু আমার দোষ দেখো। আর গজগজ করতে আসো। আমাকে কি খেলনা পেয়েছ? ছাড়ো।
মাহিদ ছাড়লো না, কথা ও বললো না। শুধু তীর্যক চোখে চেয়ে রইলো। পিহু হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল
‘ উফফ ছাড়ো। আমার ব্যাথা লাগছে।
‘ শেষপর্যন্ত এসে উল্টে যাচ্ছিস কেন তুই?
‘ তো কি করব? তুমি জানো নিশি আমাকে কাল কি বলেছিল? আমি এই মুখ নিকিতা আন্টির সামনে দাঁড়াতে পারব? তোমার লজ্জা না থাকতে পারে, আমার আছে। উফ ছাড়ো।
‘ তুই চাইছিসটা কি?
‘ কিচ্ছু চাই না। তোমাকে ও চাই না। যাও আমার সামনে থেকে।
মাহিদ আর দাঁড়ালো না। সোজা চলে গেল বাড়ির বাইরে। ইশা তার খোঁজ করতেই আফি বলল, মাত্রই বের হতে দেখলাম।
‘ বের হয়েছে? কোথায় গেছে?
‘ আমি তো জানিনা। বেরোতে দেখছিলাম শুধু।
পিহু এসে আফির পাশে বসলো চুপচাপ। ইশা রেহানকে বলল
‘ এটকু বের হয়ে দেখো তো আব্বা। ও কোথায় গেল?
‘ পিহু টিভির দিকে চোখ রেখে জবাব দিল, খোঁজার কি দরকার। চলে গেছে।
ইশা কপাল ভাঁজ করলো। গলার স্বর খানিকটা উঁচু করে বলল
‘ তুমি কিছু বলেছ ওকে?
পিহু চুপ করে থাকলো। ইশা বলল
‘ কি হলো? কি বলেছ?
আফি বলল
‘ ওরে বকতেছ ক্যান? ওদের ঝামেলা ওরা মিটায় নিবো।
ইশা বলল
‘ পিহু উত্তর দিচ্ছ না কেন?
পিহু গালফুলিয়ে বসে থাকলো চুপচাপ। ইশা বলল
‘ তুমি এত বেয়াদব হয়েছ কখন থেকে?
রাইনা বলল
‘ কি হয়েছে রে?
রেহান বলল
‘ কাকিয়া ওকে বকছ কেন? তুমি তো ছোট আন্টিকে ফোন দিতে পারো। মাহি বাড়ি পৌঁছালে ফোন করতে বলো।
ইশা বলল
‘ কোনমুখে ফোন করব? ওরা কি বলবে? ছেলেটাকে এত রাতে বের করে দিয়েছি বলবে না?
পিহু কাঁদোকাঁদো চেহারায় ঘরে চলে গেল। আদি এসে বলল
‘ মিষ্টি তুমি আমার মেয়েকে কি বলেছ? ও কাঁদছে।
‘ কাঁদুক। আদরে আদরে বাঁদর বানিয়েছেন।
ছিকু রাইনার কোল থেকে বলল
‘ কেন? পিহু ছিকুর মুতো মাংকি কেন?
সবাই হেসে উঠলো। হাসলো না শুধু আদি। সে মিষ্টির উপর রেগে আছে।
মাহিদকে হঠাৎ বাড়ি ফিরতে দেখে সবাই চমকালো। রিপ নীরাকে ইশারা করলে। নীরা মাহিদের পিছু পিছু ছুটলো। মাহিদ ঘরের দরজা বন্ধ করে দিত গেল। নীরাকে দেখে আর দিল না। নীরা হেসে বলল
‘ পিহুর রাগ কমছে? শোন তোদের বিয়ে এই সপ্তাহেই। কি মজা। তোর নানু কালই চলে আসবে। কি যে খুশি হয়েছে বলার বাইরে।
‘ আমি বিয়ে করব না।
‘ নাউজুবিল্লাহ। কি আশ্চর্য কথা! কি হয়েছে? আবার পিহুর সাথে ঝামেলা হয়েছে?
‘ আমার লগে সারাক্ষণ খ্যাঁকখ্যাঁক করে । ভালা করে কথা কয় না। বিয়া করুম না শালীরে।
‘ ওহহ। এগুলা তো রাগ কইরা বলতাছে বাপ। বুঝোস না ক্যান? তুই না বুঝলে কে বুঝবো?
মাহিদ নিচে তাকিয়ে থাকলো। নীরা বলল
‘ আইচ্ছা এখন ঘুমা। টা টা বাচ্চা।
মাহিদ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। কতক্ষণ এপাশ কতক্ষণ ওপাশ করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ফোন বেজে উঠলো৷ পিহুর ফোন দেখে লাফ দিয়ে উঠে বসলো মাহিদ। আজকাল এমন হুটহাট ফোন পাওয়া ভীষণ দুষ্কর। মাহিদ ফোন তুলে বলল
‘ কি চাই?
পিহু গলায় কান্নাকান্না ভাব। সে তা যথাসম্ভব চেপে রাখার চেষ্টা চালিয়ে বলল,
‘ তোমার মাথাটা এনে দাও। সবাইকে কি খাইয়ে বশ করেছ? শোনো মাহিদ ভাই আমি তোমাকে ভালো টালো বাসিনা। আমাকে বিয়ে করে শান্তি পাবেনা তুমি। বিয়ের পর বলতো পারবানা কোনোকিছু। আগেভাগে বলে রাখলাম আমি।
‘ তোরে ও ভালো টালো বাইসা আমি উল্টায় ফেলছি। তোরে আমি ভালো টালো বাসিনা বাপ। আগেভাগে বলে রাখলাম। বিয়ার পর কিছু কইলেই তোরে খাইছি।
পিহু ফোনটা ছুঁড়ে মেরে বালিশটা ও ছুঁড়ে মারলো। হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিকু মতো করে থেমেথেমে কাঁদলো ইচ্ছেমত। রাগে, জেদে।
অন্যদিকে মাহিদ ঢুসে ঢুসে ঘুমোচ্ছে। কে জানে আর কবে শান্তিতে ঘুমাতে পারবে সে?
চলবে,
রিচেক করা হয়নি