প্রজাপতির_ডানায়_আঁধার_নামে (পর্ব ৪)

0
234

#প্রজাপতির_ডানায়_আঁধার_নামে (পর্ব ৪)

১.
‘আমার একজন নতুন সঙ্গী হয়েছে, আমিরুননেসা। ওনার বয়স নাকি ৬০ বছর, ব্যাংকে চাকরি করতেন। ওনারও নাকি আমার মতো অসুখ হয়েছে। এসব কথা অবশ্য আমাকে উনি বলেননি, নার্স তানিয়া আপু আমাকে বলেছে। ওনার ছেলেমেয়েরা সপ্তাহে একদিন করে দেখতে আসে, আম্মুর মতো কেউ ওনার সাথে সারাক্ষণ থাকে না। অবশ্য উনি যেমন সব কিছুতেই বিরক্তি দেখান, ওনার সাথে কেউ থাকার কথাও না।
সেদিন আমি ওনাকে দাদু বলাতে কেমন খরচোখে তাকিয়েছিল, বলেছিল আমাকে আন্টি বলবে। খুব হাসি পেয়েছিল, ওনাকে তো আমার দাদুর মতোই লাগে। অবশ্য আমিরুননেসা এখনও চুল কালার করে রাখেন, আমি চুপিচুপি পর্দা সরিয়ে দেখেছি চুল কালার করতে। আমাদের এই কেবিনটা আগেরটার চেয়ে বড়, মাঝে একটা পর্দা আছে। আমিরুননেসা যখন পর্দাটা টেনে দেন তখন আমি চুপিচুপি দেখেছি উনি সাজগোজ করে মোবাইলে সেলফি তোলেন, ফেসবুকে পোস্ট করেন (এটা অবশ্য আমার ধারণা)। একবার অবশ্য চোখাচোখি হয়ে গিয়েছিল, উনি তখন রাগ রাগ চোখে তাকিয়ে ছিলেন।

আজ এগারো দিন হলো এই শেয়ারিং কেবিনে এসেছি। বুঝতে পারছি বাবার কষ্ট হছে। সিংগেল কেবিনের খরচটা অনেক বেশি। অবশ্য আমার জন্য ভালোই হয়েছে, একজন সঙ্গী হয়েছে, যদিও ওনার সাথে আমার এখনও ভাব হয়নি। উনি থাকাতে আম্মু অবশ্য একটু ভরসা পান। যে সময়টুকু আমি একা থাকি সে সময়টুকু অন্তত আমিরুননেসাকে আম্মু বলে যান খেয়াল রাখতে। তখন উনি শুধু গম্ভীরমুখে মাথা নাড়েন। মাঝের পর্দাটা তখন সরিয়ে রাখেন, আড়চোখে আমার খেয়াল করেন। একটা জিনিস ভেবে আমার খুব কষ্ট লাগে, আমার এই অসুখটা আমিরুননেসা আন্টির বয়সে হলে কী ক্ষতি হতো? আমার যে কত স্বপ্ন ছিল ভালো একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ব, বিদেশে যাব, পিএইচডি করব। বাবার এক বন্ধু আছে, একবার উনি বাসায় এসেছিল। বাবা বলেছিল উনি ড. রশিদ আংকেল। আমি ভেবেছিলাম ডাক্তার। পরে বাবা আমাকে বুঝিয়ে বলেছিল ব্যাপারটা। আমারও খুব ইচ্ছে করে পড়াশোনা করে মস্ত একজন মানুষ হতে। কিন্তু আমি কি আর ভালো হব? ইঞ্জেকশনগুলো যখন দেয় তখন কী যে কষ্ট! বমি করতে করতে জীবন শেষ হয়ে যায়। আর সারা মুখে ঘা হয়ে যায়, কিছুই খেতে পারি না। সারা শরীরের কী অসহ্য ব্যথা হয়! কালশিটে পড়ে গেছে সারা শরীরে। আমি কি আবার আগেরমতো বাবার প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়াতে পারব?…’

এটুকু লিখে প্রজাপতি ওর ডায়েরিটা বন্ধ করে। বিকেল হয়ে গেছে, আম্মু আজ ওর প্রিয় চিকেন স্যুপ নিয়ে আসবে।

প্রজাপতি ডায়েরিটা রেখে আশেপাশে তাকায়, তুষি কই গেল? আজ তুষিকে ও জোর করে রেখে দিয়েছে। আমিরুননেসা বিড়াল একদম পছন্দ করেন না, কড়া গলায় বলেছিল, ‘আমার এপাশে যেন তোমার বিড়াল না আসে।’

প্রজাপতি আশেপাশে তুষিকে দেখতে না পেয়ে এবার শংকিত চোখে আমিরুননেসার বিছানার দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে। তুষি আরাম করে আমিরুননেসার কোল ঘেঁষে শুয়ে আছে। সর্বনাশ, একবার যদি উনি টের পান, তুলকালাম করবেন।

প্রজাপতি পা টিপে টিপে কাছে যেয়ে ফিসফিস করে ডাকে, ‘তুষি’, এই ‘তুষি’। নাহ, দুষ্টটা এমন আরাম করে ঘুমিয়ে আছে যে চোখ মেলেই তাকাচ্ছে না। প্রজাপতি এবার সতর্কতার সাথে বিছানার কাছে গিয়ে ঝুঁকে হাত বাড়াতেই হঠাৎ করে আমিরুননেসা পাশ ফেরেন, আধো চোখে তাকাতেই প্রজাপতির বুকে ড্রাম বাজে। আমিরুননেসা ভ্রু কুঁচকে প্রজাপতির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকান। তারপর হঠাৎ তুষির দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে ওঠেন, চিৎকার করে ওঠেন, ‘হুশ হুশ, এই পাজি বিড়ালটা এখানে কেন? এই মেয়ে তোমাকে না বলেছি বিড়াল যেন এদিকে না আসে। আমার সর্বনাশ করে ফেলল।’

তুষি ততক্ষণে ভয় পেয়ে ‘মিয়াঁও’ বলে এক লাফে প্রজাপতির কোলে এসে পড়ে। প্রজাপতি তুষিকে একহাতে আগলে ধরে বলে, ‘সরি দাদু, ওহ, আন্টি। তুষি একটু আরাম পেয়ে আপনার কাছে এসে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু ও কি সর্বনাশ করল আপনার?’

আমিরুননেসা ভ্রুকুটি করে বলে, ‘তুমি তো ছোট্ট মানুষ, তাই জানো না। বিড়াল গা ঘেঁষে শুয়ে মানুষের হায়াত কেটে নেয়।’

প্রজাপতি চোখ বড় বড় করে বলে, ‘বিড়াল মানুষের হায়াত কাটবে কী করে? এটা তো কুসংস্কার দাদু।’

আমিরুননেসা রাগের গলায় বলে, ‘আমাকে দাদু বলবে না। আর তোমার বিড়াল যদি এদিকে আসে আমি কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানাব।’

প্রজাপতি মন খারাপ করে তুষিকে নিয়ে নিজের বেডে গিয়ে বসে।

একটু পরেই মা আসে, হাতে এক গাদা জিনিস। প্রথমেই বড় ফ্লাস্কটা রেখে একটা কাপে স্যুপটা ঢালতে ঢালতে বলে, ‘কি রে, মন খারাপ?’

প্রজাপতি মাথা নাড়ে। গরম ধোঁয়া উঠছে স্যুপ থেকে, ক্ষুধাকে চনমনে করে দেওয়া একটা ঘ্রাণ ছুটছে। আমিরুননেসা নাক টেনে ঘ্রাণটা নেয়, ভীষণ লোভ হয় একটু চেয়ে খেতে। ওর বাসা থেকে কেউ এমন খাবার নিয়ে আসে না। ছেলে একটা আয়া রেখে দিয়েছে, সেই দেখাশোনা করে। ওরা সপ্তাহে একবার করে আসে। আমিরুননেসার খুব ইচ্ছে হয় বাড়ির খাবার খেতে।

প্রজাপতি স্যুপে চুমুক দিতে যেয়েও থমকে যায়, ফিসফিস করে বলে, ‘মা, আরেক কাপ স্যুপ হবে?’

মিতুর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে যায়, আজ মেয়েটা খেতে চাইছে। খুশি গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, আছে তো। তুই এই কাপটা খেয়ে শেষ কর দিচ্ছি।’

প্রজাপতি তৃপ্তি নিয়ে স্যুপটা শেষ করতেই মিতু আগ্রহের সাথে আরেকটা কাপ স্যুপ ঢেলে দেয়। প্রজাপতি স্যুপটা নিয়ে একবার মায়ের দিকে তাকায়, তারপর বিছানা থেকে নেমে আমিরুননেসার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, নরম গলায় বলে, ‘স্যুপ খাবে দাদু? আমি সরি, বিড়ালটা আর জ্বালাবে না।’

আমিরুননেসার খুব ইচ্ছে হচ্ছে খেতে, কিন্তু গোমড়া মুখে বলেন, ‘না, খাব না।’

মিতু অবাক হয়ে প্রজাপতির কান্ডকারখানা দেখছিল। এবার উঠে গিয়ে আমিরুননেসার পাশে গিয়ে বসে হাতটা ধরে বলে, ‘আন্টি, আমি বানিয়ে নিয়ে এসেছি, খান না একটু। এমনিতে তো কিছুই খেতে পারেন না। আমার প্রজাপতি যে আপনার মতোই অসুস্থ।’

আমিরুননেসার মনটা হু হু করে উঠে, কতদিন পর কেউ এমন আদর করে খেতে বলল। কষ্ট করে উঠে বসে, তারপর প্রজাপতির হাত থেকে স্যুপটা নিয়ে বাচ্চাদের মতো খেতে থাকে। প্রজাপতি পাশেই বসে গল্প জুড়ে দেয়। মিতু সস্নেহে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ একটা কথা মনে হয়, একজন জীবনের শেষ প্রান্তে, আরেকজন সবে জীবন শুরু করতে যাচ্ছে। আমার প্রজাপতির জীবন শুরু হবার আগেই কেন এমন নিভে যাবে? ভাবতেই বুকটা হু হু করে ওঠে।

২.
ডাক্তার তৌফিক এলাহির রুমে হাসান আর মিতু বসে আছে। বুকটা ধুকপুক করছে, কি একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবেন সেজন্য ডেকেছেন। ডাক্তার তৌফিক গম্ভীরমুখে সামনে রাখা রিপোর্টগুলো দেখছিলেন। এবার মুখ তুলে হাসিমুখে বলেন, ‘প্রজাপতির ব্লাড রিপোর্টগুলো ভালো এসেছে। হেলদি ব্লাড সেলের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। তার মানে আমাদের কেমোথেরাপিটা কাজ করছে। এখন আমরা দ্বিতীয় পর্যায়ের চিকিৎসায় যেতে চাই। ওর যেখান থেকে এই ক্যানসার সেলগুলো তৈরি হচ্ছে সেখানটায় নতুন স্টেম সেল দিয়ে দেব, মানে যেটাকে আমরা বলি বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট। আমরা প্রজাপতির বোন ম্যারো থেকেই স্টেম সেলটা নেব। পুরো পদ্ধতিটা করতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে। হাসপাতালেও থাকতে হবে এরপর এক দু’মাস। এটা যদি ঠিকঠাক কাজ করে আপনার মেয়ে একদম সুস্থ হয়ে যাবে আশা করি।’

এটুকু বলে ডাক্তার সাহেব থামেন। মিতু আকুল গলায় বলেন, ‘ডাক্তার সাহেব, প্লিজ তাড়াতাড়ি করে ফেলুন এটা। আমার প্রজাপতি সুস্থ হয়ে যাবে এর চেয়ে বড় আর কি হতে পারে।’

হাসান মিতুর হাতটা শক্ত করে ধরে বলে, ‘হ্যাঁ, ডাক্তার সাহেব, প্লিজ আপনি শুরু করুন।’

তৌফিক সম্মতিসূচক মাথা নাড়েন, তারপর বলেন, ‘কিন্তু এটা অনেক ব্যয়বহুল। সব মিলিয়ে প্রায় বারো তেরো লক্ষ টাকা লেগে যাবে। এটার জন্য আসলে ১৫ লাখ টাকা লাগে। আপনাদের আর্থিক অবস্থাটা আমি জানি। কিন্তু আমি এতটুকুই করতে পেরেছি। আপনারা যদি টাকাটা যোগাড় করতে পারেন তাহলে আমি প্রস্তুতি নিতে পারি।’

হাসান ঢোঁক গেলে, এমনিতেই প্রভিডেন্ট ফান্ডের সব টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখন আরও দশ বারো লাখ টাকা যোগাড় করতে হবে! মিতুর মুখটাও চুপসে যায়। হাসানের অবস্থা তো ও জানে।

হাসান সামলে নিয়ে বলে, ‘স্যার, আমাকে ক’টা দিন সময় দিন। আমি দ্রুতই টাকার ব্যবস্থা করব।’

তৌফিক মাথা নাড়েন, মনটা খারাপ হয়ে যায়। প্রজাপতি মেয়েটা একটা অদ্ভুত মেয়ে, এই কঠিন অসুখেও মেয়েটা স্কুলের পরীক্ষা দিয়েছে। মেয়েটাকে সুস্থ করে তোলার জন্য নিজেও মনের ভেতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করেন।

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে মিতু হাসানের বাহু খামচে ধরে, পাগলের মতো বলে, ‘হাসান, যেভাবেই হোক টাকার ব্যবস্থা করো। আমি প্রয়োজনে সবার কাছে হাত পাতব।’

হাসানের বুকটা মুচড়ে ওঠে, নিজেকে আজ একজন অসহায় বাবা মনে হয়। কেন এমন হয়, বুকের সবটুকু ভালোবাসাও তুচ্ছ হয়ে যায় আর্থিক দীনতার কাছে। তাহলে কী টাকার কাছে হেরে যাবে ওর প্রজাপতি!

সেদিন বাসায় এসে মিতু আলমারির লকার খুলে। একে একে বিয়ের সব গহনাগুলো বের করে। খুব বেশি কিছু নেই, সব মিলিয়ে তিন সাড়ে তিন ভরি হবে। দুজনে মিলে হিসেব করে। প্রভিডেন্ট ফান্ড, গহনা সব মিলিয়ে টেনেটুনে পাঁচ লাখ টাকার মতো হয়। আরও সাত লাখ টাকা, কে দেবে? হাসানের বাবা মা নেই। আর মিতুর বাসার অবস্থাও ভালো না। তাহলে?

মিতু শুন্য চোখে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে, মনের ভেতর হেরে যাওয়াটা টের পেতে থাকে।

৩.
আমিরুননেসার আজ সকাল থেকেই মন খারাপ। একটা সমস্যা হয়েছে, কিন্তু কাউকে যে বলবেন তাও বলতে পারছেন না। এদিকে সমস্যাটা সমাধান না হলে যে সারাটা দিন অশান্তি।

প্রজাপতি ব্যাপারটা খেয়াল করে। দাদু আজ কেমন যেন ছটফট করছেন। বার বার মোবাইলের দিকে তাকিয়ে কি যেন করছেন আর একটু পর পর বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে উঠছে। প্রজাপতি ভয়ে ভয়ে কাছে গিয়ে বলে, ‘দাদু, কোনো সমস্যা?’

আমিরুননেসা বিরক্ত গলায় বলে, ‘আমার সমস্যা তুমি সমাধান করতে পারবে?’

প্রজাপতি এবার কাছে গিয়ে বসে, বলে, ‘আমার মাথায় অনেক বুদ্ধি, তুমি বলেই দেখো।’

আমিরুননেসা এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, ‘আমার ফেসবুকের পাসওয়ার্ড ভুলে গেছি। ঢুকতেই পারছি না কিছুতে।’

প্রজাপতি ফিক করে হেসে ফেলতে যেয়েও হাসিটা গিলে ফেলে। এই দাদুটা সারাদিন ফেসবুকে ডুবে থাকে, সেল্ফি তুলে পোস্ট করে।

প্রজাপতি গম্ভীর গলায় বলে, ‘ফোনটা দাও, আমি ঠিক করে দিচ্ছি। তোমার এই মোবাইল নাম্বার দিয়েই তো ফেসবুক একাউন্ট খুলেছিলে?’

আমিরুননেসা মাথা নেড়ে সায় দেয়।

তারপর প্রজাপতি মোবাইলটা নিয়ে কি কারিকুরি যেন করে, নতুন একটা সহজ পাসওয়ার্ড ঠিক করে সেটা লিখে দেয়। তারপর বলে, ‘এই নাও দাদু, এখন দেখো, ঢুকতে পারবে। আর এই কাগজে পাসওয়ার্ড লিখে দিলাম, এটা হারিও না।’

আমিরুননেসা অবাক চোখে প্রজাপতির দিকে তাকিয়ে থাকেন, তারপর এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘তোমার মাথায় আসলেই অনেক বুদ্ধি।’

আমিরুননেসা এবার আগ্রহের সাথে ফেসবুকে ঢোকেন। প্রজাপতি খেয়াল করে মানুষটার মুখে একটা ছেলেমানুষী আনন্দ।

প্রজাপতি হঠাৎ করেই বলে, ‘আচ্ছা দাদু, তোমার আর আমার তো একই অসুখ। যদি আমরা ভালো না হই?’

আমিরুননেসা একটা ছবি আপলোড করছিলেন। প্রজাপতির প্রশ্নে মুখ তুলে তাকান, তারপর সহজ গলায় বলেন, ‘মরে যাব, এটাই সত্য। তাতে কোনো আফসোস নেই। আসলে মানুষের জীবনের যোগফল হলো একটা বিশাল ‘শুন্য’। এই যে আমাকে দেখ, জীবনে কত কি করেছি। পড়াশোনা করেছি, চাকরি করেছি। জীবনপাত করে ছেলেমেয়ে মানুষ করেছি। কিন্তু দেখ, কেউ কাছে নেই। না বন্ধুরা না সন্তান। সবাই সবার কাজে ব্যস্ত। এটাই নিয়ম, যতক্ষণ শ্বাস আছে ছুটে যাও, যে ছুটে যাওয়ার কোনো শেষ সীমা নেই। আরও অর্থ, আরও ধনসম্পদ, আরও সুখ। কিন্তু মরে গেলেই সব শেষ, এই পুরো ছুটোছুটি একটা বিশাল ‘শুন্য’ ছাড়া আর কিছু না।’

প্রজাপতি তন্ময় হয়ে দাদুর কঠিন কঠিন কথাগুলো শুনছিল। সবটা যে বুঝতে পারছে তা না। কিন্তু আবছা একটা ধারণা হয়, দাদুর কথায় কোথাও একটা ফাঁক আছে।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘কিন্তু দাদু, আমি বেঁচে থাকতে চাই। পড়াশোনা করে এই কঠিন অসুখটার একটা ভালো চিকিৎসা আবিষ্কার করতে চাই যাতে আমাদের মতো এত কষ্ট কেউ না পায়। এই যে চুল পড়ে যাচ্ছে, এত বমি পায়, শরীর ব্যথা, মুখে ঘা হয়ে যায়, কিছুই খেতে পারি না। আর কত কত টাকা লাগে। বাবা মা আমাকে কিছু বলে না, কিন্তু আমি বুঝতে পারি। আমি সুস্থ হয়ে উঠলে আমাদের মতো অসহায় মানুষের জন্য কিছু একটা করবই। যদি তাই করতে পারি তখন কি আমার জীবনের যোগফল ‘শুন্য’ হবে দাদু?’

আমিরুননেসা কেঁপে ওঠেন, হঠাৎ করেই মনে হয় সামনে বসে থাকা ছোট্ট এই মেয়েটা ওর সারাজীবনের একটা ভুল ধারণা ভেঙে দিল। আসলেই তো, মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কিছু করলে সেটাই যে জীবনের হিসেবের খাতায় সত্যিকারের যোগ হয় তা এই মেয়েটা ওকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here