মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা |১|

0
1227

মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

|১|

ময়মনসিংহে ভোর হচ্ছে। ময়মনসিংহে ভোর আসে খুব আয়োজন করে। ধপ করে সূর্য উঠে যায় না। তরুর অবশ্য ভোর হওয়া নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তার জীবনে ভয়াবহ একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে। প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় সে দুই সাবজেক্টে ফেইল করেছে। দুই সাবজেক্টে ফেইল করার ব্যাপারটা বাবাকে এখনও জানানো হয়নি। তরুর বাবা সাদিকুল সাহেব মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। মেয়ের ফেইল করার ব্যাপারে তিনি কী রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবেন ধারণা করা যাচ্ছে না। এখন ঘড়িতে ছয়টা বাজে। ঠিক নয়টা বেজে দশ মিনিটে সাদিকুল সাহেব টেলিফোন করবেন। টেলিফোন তুলতেই দরাজ কন্ঠে রেজাল্ট জানতে চাইবেন। তরুর রেজাল্ট নিয়ে খুব একটা মন খারাপ হচ্ছে না। তার ধারণা পরীক্ষায় ফেইল করাটা খুব ভয়াবহ কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু বাবার ভয়ে তাকে মন খারাপের কঠিন অভিনয় চালিয়ে যেতে হচ্ছে। তরুর মন খারাপের অভিনয় খুব একটা ভালো হচ্ছে না। মন খারাপ হলে ঘুম পাওয়ার কথা না। আশ্চর্যের বিষয়, এমন একটা টেনশনের সময়েও তরুর দু-চোখ বোজে ঘুম আসছে। তরু দু-চোখ ভর্তি ঘুম নিয়ে বাবার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছে। বাবাকে কনভেন্স করার জন্য পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা স্ক্রিপ্টও লিখে ফেলেছে। যেখানে যেখানে কাঁদো কাঁদো ভাব প্রয়োজন সেখানে নীল কালি দিয়ে লিখে রেখেছে ‘মুখভঙ্গি- কাঁদো কাঁদো’। তবুও, তরুর কেন জানি মনে হচ্ছে, এসব স্ক্রিপ্ট ফিপ্ট দিয়ে কোনো কাজ হবে না। বাবা রেজাল্ট শোনার সাথে সাথে তরুকে কঠিন কঠিন কিছু কথা বলবেন। বাবার কঠিন কথা শুনে তরুর ভয়ংকর মন খারাপ হয়ে যাবে। তরুর মন খারাপের ধরন খুব বাজে। একটুখানি মন খারাপ হলেই ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। অথবা, হাতের শিরা বরাবর ধারালো ব্লেডের আঁচড় বসাতে ইচ্ছে হয়। যদিও তরু এই দুটোর একটিতেও কোনোদিন সফল হয়ে উঠতে পারেনি; উচ্চতা আর রক্তে তার প্রচন্ড ভয়। কিন্তু কোনো একদিন যে করে ফেলবে না সে ব্যাপারেও নিশ্চিত হওয়া যায় না। তরুর ধারণা, বাবার বকাবকির ভয়েই সে একদিন ভয়াবহ একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে। বাবাকে বড়োসড়ো একটা চমক দেওয়াই তার ইচ্ছে।

তরু বাবাকে চমক দিতে না পারলেও সাদিকুল সাহেব তরুকে অবিশ্বাস্য এক চমক দেখালেন। ঘড়ির কাটা নয়টা দশ পেরিয়ে বিশের ঘরে চলে যাওয়ার পরও টেলিফোনের ঘন্টী বাজলো না। বাবার মতো পাঞ্চুয়াল মানুষ যে এমন একটা বেনিয়ম করে ফেলবেন, তা যেন তরুর বিশ্বাসই হতে চাইলো না। ছোটবেলা থেকেই তরুর বিপদজনক এক রোগ আছে। তরু কিছুতেই মিথ্যা কথা বলতে পারে না। মিথ্যা কথা বলতে হলে তাকে খুব পরিশ্রম করতে হয়। এই পরিশ্রমের প্রথম ধাপ হলো, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেওয়া। তরু খুব ভেবে আবিষ্কার করেছে, পেটে ক্ষুধা থাকলে মিথ্যা বলা সহজ। তরু কাল রাত থেকে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে মিথ্যা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাবাকে জবরদস্ত কিছু মিথ্যা কাহিনি শুনিয়ে ফেলার পর সে খেতে বসবে। তরু বাংলার ছাত্রী। ডিপার্টমেন্টের স্যার বলেছেন, সাহিত্যে মিথ্যা বলে কিছু হয় না। উপন্যাসিকের রচনা মাত্রই সত্য। তরু বাবাকে বলবে বলে প্রস্তুতকৃত মিথ্যাটাকে সাহিত্য হিসেবে ধরে নিয়েছে। এই মিথ্যায় পাপ নেই।

সাদিকুল সাহেব অবশ্য তরুর সত্য-মিথ্যার ভেলকিতে ধরা দিলেন না। মিথ্যা বলার এতো সব প্রস্তুতিতে জল ঢেলে টেলিফোন করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেলে পৌঁছালেন। তরুর তখন জঠরজ্বালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত অবস্থা। ক্ষুধায় ক্ষুধায় সত্য-মিথ্যা গুলিয়ে সবই অলিক জল্পনা। তরু ঠিক তখনই আবিষ্কার করে ফেললো, মিথ্যা বলতে ক্ষুধা প্রয়োজন। কিন্তু অতিরিক্ত ক্ষুধা নিয়েও মিথ্যা বলা যায় না। মিথ্যা বলার জন্য ক্ষুধা লাগবে পরিমিত পরিমাণ। এর থেকে বেশি-কম হলেই সব প্রস্তুতি ব্যর্থ। সাদিকুল সাহেব টেলিফোনের লাইন পেয়েই মেয়েকে গম্ভীর কন্ঠে ধমক দিলেন,

‘ তুমি কী চাচ্ছো তোমার বাবা অশান্তিতে পতিত হোক? সালাম দিলে না কেন? সালামের অর্থ জানো না? এটা কোন ধরনের বেয়াদবি?’

তরু সালাম দিয়ে বিষণ্ণ কন্ঠে বললো,

‘ টেনশনে টেনশনে সালাম দিতে ভুলে গেছি বাবা। মানুষ টেনশনে থাকলে মাঝে মাঝে নিজের নামও ভুলে যায়।’

‘ তোমার নিজের নাম মনে আছে?’

‘ জি, বাবা। মনে আছে।’

‘ গুড। এখন বলো, এতো টেনশন কীসের জন্য? আবার কোন অপকর্ম করেছো?’

‘ কোনো অপকর্ম করিনি। তুমি ফোন দিচ্ছিলে না বলে টেনশন হচ্ছিলো।’

সাদিকুল সাহেব গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘ জন্মদাতা পিতার জন্য টেনশন করা উচিত। বেশি বেশি টেনশন করবে। টেনশন করতে করতে ময়মনসিংহ মেডিকেলে চলে আসো। তোমার টেনশন কেটে যাবে।’

তরু অবাক হয়ে বললো,

‘ মেডিকেল কলেজে কেন যাবো বাবা?’

‘ আমি এখানে আছি এজন্য আসবা। জলদি আসো। অযথা প্রশ্ন করবে না।’

বাবার নিষেধ সত্ত্বেও তরুর কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার সাধ ছিলো। সাধ পূরণ হলো না। সাদিকুল সাহেব তরুকে কোনোরকম প্রশ্ন করার সুযোগ দিলেন না। কথা শেষ করেই খুট করে লাইন কাটলেন। তরু কিছুক্ষণ হতাশ মুখে বসে থেকে চিন্তিত হওয়ার চেষ্টা করলো। বাবা হাসপাতালে ব্যাপারটা নিশ্চয় খুব চিন্তার বিষয়। তরুর উচিত চিন্তায় চিন্তায় দিকবিদিক ভুলে উড়ে উড়ে মেডিকেলে গিয়ে উপস্থিত হওয়া। কিন্তু তরু তার কিছুই করলো না। সে খেয়েদেয়ে ধীরেসুস্থে মেডিকেলের পথে পা বাড়ালো। মেডিকেলে গিয়ে সাদিকুল সাহেবকে একেবারে সুস্থ তবিয়ত আবিষ্কার করলো তরু। সাদিকুল সাহেব আইসিইউ-এর সামনে একটা চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছেন। হাতে তসবি। ঝিমাতে ঝিমাতেও তসবিতে হাত চলছে। তরু আশেপাশে পরিচিত কাউকে না দেখতে পেয়ে কিছুটা বিভ্রান্ত হলো। বাবার কাছাকাছি গিয়ে সাবধানি কন্ঠে ডাকলো। সাদিকুল সাহেব চোখ মেলে মেয়েকে দেখে অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করলেন। পাশে বসতে বলে ফিসফিসিয়ে বললেন,

‘ রোগী আইসিইউতে। থার্ড টাইম স্টোক। মরে যাওয়ার সম্ভবনা ৮০%।’

কেউ আশি পার্সেন্ট মৃত্যু সম্ভবনা নিয়ে শুয়ে আছে, ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। সাদিকুল সাহেবের উচিত দুঃখী বিমর্ষ মুখে বসে থাকা। মেয়েকে দেখেই আনন্দিত হয়ে যাওয়াটা কতটা যুক্তিসংগত তরু বুঝতে পারছে না। তরুও বাবার মতো ফিসফিসিয়ে শুধালো,

‘ রোগীটা কে বাবা? আমাদের কোনো আত্মীয়? আশেপাশে পরিচিত কাউকে দেখছি না তো!’

সাদিকুল সাহেব এবার গম্ভীর হলেন। বললেন,

‘ আত্মীয় নয়। তবে তুমি রাজি হলে হয়ে যেতে পারে।’

তরু অবাক হয়ে বললো,

‘ মানে? কীসে রাজি হবো?’

সাদিকুল সাহেব মেয়ের সাথে গোপন বৈঠক করার মতো নিচু স্বরে বললেন,

‘ শুনো মা, যিনি আইসিইউতে আছেন তার দুটো পুত্র সন্তান আছে। তোমার বিয়ের জন্য আমরা তার বড়ো সন্তানের খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। ছেলের সাথে দেখা করেছি। সকল খোঁজখবর নিয়েছি। ভালো পরিবার। তারা একটা মধ্যবিত্ত ঘরের লক্ষ্মী মেয়ে চায়। আমি কাল উনাদের সাথে দেখা করতেই ময়মনসিংহ এসেছিলাম। কথাবার্তা ভালোই চলছিলো। খাওয়া-দাওয়ার পর হঠাৎ এই ভদ্রলোক স্টোক করে বসলেন। আমি কাল রাত থেকে হাসপাতালে আছি। ভদ্রলোকের জ্ঞান ফিরেছে। ভদ্রলোকের অবস্থা আপস্ এন্ড ডাউনের উপর চলছে। যেকোনো সময় ইহলোক ত্যাগ করতে পারেন। ভদ্রলোক মৃত্যুর আগে আপাতত একটি পুত্রবধূর মুখ দেখে যেতে চান। ভদ্রলোকের স্ত্রী তোমার সম্পর্কে যতটুকু খোঁজ নিয়েছিলেন তার ভিত্তিতে তোমার জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন। তুমি রাজি হলে এই মুহূর্তে বিবাহ কার্য সম্পন্ন হবে। বলো মা, রাজি?’

তরু বিস্ফারিত চোখে চেয়ে বললো,

‘ তোমরা আমাকে না জানিয়েই আমার জন্য পাত্র ফাত্র দেখে ফেলেছো বাবা?’

সাদিকুল সাহেব স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,

‘ দেখে ফেলেছি না। দেখছি। এখনও দেখা শেষ হয়নি। আরও কিছু পাত্র হাতে আছে। সবগুলোই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবো। তবে তুমি এখানে রাজি হয়ে গেলে আর কোনো ঝামেলা করতে হয় না।’

তরু দুই মিনিটের জন্য কথা বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। হতবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। সাদিকুল সাহেব কোমল কন্ঠে বললেন,

‘ একটা পরিবারের এমন বিপর্যয়ের সময়ে আমাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া কর্তব্য। তুমি রাজি হয়ে যাও মা।’

‘ তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তারা আমার কাছে টাকা পয়সা চাচ্ছে। এখানে বিয়ের কথা চলছে বাবা। আমার সারা জীবনের প্রশ্ন! এভাবে কীভাবে রাজি হয়ে যাবো? চিনি না, জানি না?’

সাদিকুল সাহেব শুধালেন,

‘ তারমানে তুমি চেনা-জানার মাঝে বিয়ে করতে চাইছো? তোমার পছন্দের কেউ আছে?’

তরু জানালো, নেই। সাদিকুল সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন,

‘ পছন্দের কেউ না থাকলে তুমি যাকেই বিয়ে করবে সে-ই তো তোমার অপরিচিতই হবে। তাহলে এই অপরিচিতকে বিয়ে করলে সমস্যা কোথায়? তাছাড়া, আমি খোঁজ নিয়েছি। ছেলের মা-বাবা খুব ভালো মানুষ। মেয়ে নেই, ছেলের বউকে মেয়ের মতো আদর করবেন। ননদ-ননাশের ঝামেলা নেই। একটা দেবর আছে। নির্ঝঞ্জাট পরিবার। আজকালকার যুগে এমন পরিবার পাওয়া যায়? বিয়েশাদির ব্যাপারে বংশ পরিচয় খুব বড়ো ব্যাপার। আগেকার যুগে বংশ, পারিবারিক ইতিহাস দেখে বিয়ে দিতো দেখোনি? তার পেছনে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে? পছন্দের কেউ না থাকলে তোমার উচিত ছেলের পরিবার, চাকরি, চরিত্র, বংশ দেখে বিয়ে করা। তোমার থেকে মানুষ আমি ভালো চিনি। আমি নিশ্চয়ই তোমাকে অপাত্রে দান করবো না?’

তরু অসহায় চোখে চাইলো। বাবার কথায় কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে বললো,

‘ তাই বলে হাসপাতালে বিয়ে করে ফেলতে হবে? কোনো অনুষ্ঠান হবে না? বন্ধু-বান্ধব জানবে না? তাছাড়া বড়ো মামা, আপা, দুলাভাই কেউই তো এখানে নেই।’

সাদিকুল সাহেব গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘ তোমার বড়ো মামার সাথে আমার কথা হয়ে গেছে। পাত্র পক্ষের ইচ্ছে, এখন শুধু বিয়ে পড়ানো হবে। পরিস্থিতি অনুকূলে এলে, মানে, এই ভদ্রলোকের এসপার-ওসপার কিছু হয়ে গেলে সুযোগ বুঝে ধুমধাম করে বউ তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। তোমার মামা সম্মতি দিয়েছেন। তখন তুমি তোমার বেয়াদব বন্ধুবান্ধবদের ডেকে এনে তাদের কোলে চড়ে বসেও থাকতে পারবে। কোনো সমস্যা নেই। চারু আর তার বরেরও কোনো আপত্তি থাকার কথা না।’

তরু অসন্তুষ্টি নিয়ে বললো,

‘ তাই বলে একদম অপরিচিত লোককে বিয়ে করা সম্ভব নয় বাবা। আমি তো সেই লোকের নামটা পর্যন্ত জানি না। ছেলের চাকরি কী? কী করে? নাকি কোনো কাজ-কর্ম করে না?’

সাদিকুল সাহেব মৃদু কন্ঠে বললেন,

‘ ছেলে পুলিশ।’

তরুর চোখ এবার বেরিয়ে আসার উপক্রম। বিস্ময়ে পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছে চোখ। কিছুক্ষণ স্থির বসে থেকে উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠে বললো,

‘ পুলিশ! সিরিয়াসলি বাবা! তুমি বলেছিলে পড়াশোনা না করলে আর্মি-পুলিশ দেখে বিয়ে দিয়ে দিবে। তুমি কী সেই চেষ্টাই করছো বাবা? শেষমেষ পুলিশ? তোমার না পুলিশ অপছন্দ? আমি কোনো পুলিশ-ফুলিশ বিয়ে করবো না।’

সাদিকুল সাহেব শান্ত কণ্ঠে বললেন,

‘ মূর্খ মহিলা, অযথা চেঁচামেচি করবে না। ছেলে তোমার মতো টেনেটুনে বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠা ছাত্র নয়। সে বিসিএস দিয়ে পুলিশ হয়েছে। ট্যালেন্টেড বয়। এমন ট্যালেন্টেড বয়কে তুমি বিয়ে করবে না?’

তরু হতাশ কন্ঠে বললো,

‘ পুলিশদের লাইফ রিস্ক থাকে বাবা। যদি ফট করে মরে যায় তখন?’

সাদিকুল সাহেব মেয়ের দিকে বিরক্ত চোখে চাইলেন,

‘ তুমি স্নাতকের ছাত্রী না হলে এই মুহূর্তে তোমার গালে ঠাস করে একটা চড় বসাতাম। পুলিশ হলেই ফট করে মরে যাবে এই কথা তোমাকে কে বললো? জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। তুমিও তো এখন ফট করে মরে যেতে পারো, তাই বলে কী সে তোমাকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে?’

বাবার উলোটপালোট যুক্তিতে মাথা ঘুরে গেলো তরুর। বাবার দিকে চেয়ে করুণ কন্ঠে বললো,

‘ তোমার ধারণা, আমার রাজি হয়ে যাওয়া উচিত বাবা?’

‘ অবশ্যই উচিত। তোমার জায়গায় আমি থাকলে রাজি হয়ে যেতাম।’

‘ এই কথাটা তুমি আপুকেও বলেছিলে বাবা।’

‘ তোমার আপু তো শুনেনি। ইডিয়টটা বেছে বেছে ওই ছাগলটাকেই বিয়ে করেছে। তোমার আপুর জায়গায় আমি হলে কখনোই তোমার দুলাভাইয়ের মতো ছাগল পছন্দ করতাম না।’

তরু অসহায় চোখে চেয়ে রইলো। দুলাভাইয়ের মতো হাসিখুশি মানুষটিকে কথায় কথায় ছাগল বলার কারণ খুঁজে না পেয়ে হতাশ নিঃশ্বাস ফেললো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

‘ আমি বোধহয় কনভেন্স হয়ে যাচ্ছি বাবা।’

সাদিকুল সাহেব গম্ভীরভাবে মাথা ঝাঁকালেন,

‘ ইউ শ্যুড। পুলিশ বিয়ে করলে তোমার লাভ বই ক্ষতি কিছু হচ্ছে না। তোমার জীবনের ছোটখাটো ঝামেলা তোমার পুলিশ বর সল্ভ করে ফেলতে পারে।’

তরু হতাশ কন্ঠে বললো,

‘ এই মুহূর্তে আমার জীবনে একটা মাত্র সমস্যাই জ্বলজ্বল করছে। সে সমস্যার সমাধান পুলিশ দিয়ে হবে না। তুমি কী আমাদের ডিপার্টমেন্টের কোনো স্যারের সাথে আমার বিয়েশাদি দিয়ে দিতে পারো না, বাবা?’

সাদিকুল সাহেব গরম চোখে চাইলেন। তরু উদাস মুখে বললো,

‘ বেশ! বিয়েটা আমি করছি। তোমার পুলিশ পাত্র কোথায়? তোমার পুলিশ পাত্রকে তোমার সাহিত্যিক কন্যার সাথে দেখা করিয়ে দাও। আমি তার সাথে কথা বলতে চাই।’

সাদিকুল সাহেব বললেন,

‘ এই মুহূর্তে দেখা করা সম্ভব নয়।’

‘ কেন নয়?’

‘ ছেলের পোস্টিং ঢাকার মেট্রোপলিটনে। ওখানে কিছু ঝামেলার জন্য আসতে পারছে না। দ্রুত আসার চেষ্টা করছে।’

‘ তার বাবা বিশ পার্সেন্ট জীবন নিয়ে ধরণি-স্বর্গ ঝুলাঝুলি করছে আর সে আসতে পারছে না?’

‘ না, পারছে না। সবাই তো তোমার মতো নাকে তেল দিয়ে অলস জীবন-যাপন করে না। এভ্রিওয়ান হ্যাজ দেয়ার ওয়ন ডিউটি।’

তরু গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

‘ তোমার ডিউটিওয়ালা পাত্র আমার পছন্দ হয়নি, বাবা। আমি বিয়ে করবো না। তোমার কঠিন ডিউটিওয়ালা পাত্র তো আমি ময়মনসিংহে মরে পড়ে থাকলেও খোঁজ-খবর পাবে না। গম্ভীর কন্ঠে বলবে, প্রিয় তরু, তুমি প্লিজ মরে যাও। আই হ্যাভ মাই ওয়ন ডিউটিস্। আমি আসতে পারছি না!’

সাদিকুল সাহেব প্রচন্ড বিরক্ত চোখে চেয়ে রইলেন। তরু শুধালো,

‘ আমি রাজি না হলে কী তুমি আমাকে জোর-জবরদস্তি করে বিয়ে দিয়ে দিবে, বাবা? আমি কী তোমায় খুব যন্ত্রণা দিচ্ছি?’

সাদিকুল সাহেব স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,

‘ প্রথম প্রশ্নের উত্তর, নো। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর, ইয়েস। আমি তোমাকে বিয়ের জন্য কোনোরকম জোর-জবরদস্তি করছি না। আমি তোমাকে এডভাইস দিচ্ছি। তুমি ইচ্ছেমতো পাত্র সিলেক্ট করতে পারো। কিন্তু সেই সিলেকশন পদ্ধতি চলবে কেবল একমাস। চতুর্দিকে ঘটক ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যেভাবেই হোক, এই মাসের মাঝেই তোমার বিয়ে সম্পন্ন। তোমার যদি কোনো ছেলেকেই পছন্দ না হয় তাতেও সমস্যা নেই। সেজন্যও ব্যবস্থা নেওয়া আছে। কোনো ছেলে পছন্দ না হলে, এই মাসের শেষ তারিখে যে ছেলের সাথে দেখা হবে তার সাথেই তোমার বিয়ের কাজ সম্পন্ন করা হবে। তোমার বড়ো আপার বিয়ে সমাপ্ত। এখন তোমার বিয়ে সমাপ্ত হলে আমি চিন্তামুক্ত। চিন্তামুক্ত হয়ে আমি হজ্জে যাবো। নাও, ডিসিশন ইজ ইউরস্।’

তরু হতাশ নিঃশ্বাস ফেললো। করুণ কণ্ঠে বললো,

‘ ফেঁসে টেসে যাবো না তো আবার বাবা?’

সাদিকুল সাহেব ঠান্ডা কন্ঠে বললেন,

‘ এটা কী কাবাডি খেলা যে ফেঁসে যাবা? বিয়েতে আবার ফাঁসাফাঁসির কী আছে? বিয়ের পর তোমার মা আমাকে প্রথম দেখেন বাসর ঘরে। আমরা কী সংসার করিনি? বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্কের সাথে ফাঁসাফাঁসি ধরনের ফালতু শব্দ যুক্ত করবে না।’

তরু বাবাকে একটু চটিয়ে দেওয়ার জন্য বললো,

‘ কিন্তু মা যে বলতেন, মা তোমায় বিয়ে করে ফেঁসে গেছেন। তিনি ছিলেন বলেই রক্ষে নয়তো অন্যকোনো মহিলা সজ্ঞানে তোমার সাথে সংসার করতে পারতেন না।’

সাদিকুল সাহেব কঠিন চোখে মেয়ের দিকে চেয়ে রইলেন।তরু আর ঘাটালো না। সহজ কণ্ঠে বললো,

‘ এখন আমরা কী করবো বাবা? তোমার ডিউটিওয়ালা পাত্রের জন্য অপেক্ষা করে থাকবো? তোমার ডিউটিওয়ালা পাত্র আসতে আসতে যদি ভদ্রলোক আল্লাহ পেয়ারা হয়ে যায়, তখন কী হবে? বিয়েটা হবে নাকি হবে না? আমার বিয়ে কী তাহলে ডিউটিওয়ালার বাবার বাঁচা-মরার উপর নির্ভর করছে বাবা? বেঁচে থাকলে, কবুল। মরে গেলে, কবুল নট?’

সাদিকুল সাহেব এবারেও কঠিন চোখে চেয়ে রইলেন। মেয়েকে ধমক দিয়ে বললেন,

‘ এক থাপ্পড়ে তোমার গাল ফাটিয়ে ফেলবো ফাজিল মেয়ে। আমার সাথে ফাজলামো করবে না। আমি তোমার বান্ধবী না।’

তরু ফাজলামো করলো না। সুন্দর মুখখানাকে মুহূর্তেই নিষ্পাপ বানিয়ে ফেলে বললো,

‘ বাবা, আমার কী তাহলে হলে ফিরে যাওয়া উচিত না? ধরো, হলে গিয়ে পেটপুরে ভাত-টাত খেয়ে এলাম। বিয়ের সময় বউয়ের পেট ক্ষুধায় চুচু করবে এটা কেমন কথা? তোমার ডিউটিওয়ালা এলে আমায় টেলিফোন করলে। আমি ভাত খেয়ে, একটু সেজেগুজে চলে এলাম?’

‘ হাসপাতালে বিয়ে মানে দুঃখী দুঃখী বিয়ে। দুঃখী দুঃখী বিয়েতে আবার সাজুগুজের কী কাজ? বিয়ে হবে টেলিফোনের মাধ্যমে। বিয়ে শেষে তোমাদের দু’জনকে পাশাপাশি দেখার জন্য ছেলেকে ভিডিও কল দেওয়া হবে। তোমার হলে-টলে যাওয়ার দরকার নেই। এখানের কাজ শেষ হলে আমি নিজে গিয়ে পৌঁছে দেবো।’

তরু এবারে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। নির্বাক চোখে বাবার দিকে চেয়ে রইলো। শেষমেষ কি-না টেলিফোনে বিয়ে? ব্যাপারটা কী সত্যিই ঘটছে? তরু কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না।

তরু আইসিইউ-এর সামনে বসে আছে। তাকে একরকম জড়িয়ে ধরে বসে আছেন একজন ভদ্রমহিলা। ভদ্রমহিলার গোলগাল, ভরাট মুখ। চেহারায় কেমন একটা মা মা ব্যাপার আছে। এই ধরনের মহিলার সাথে চট করে খারাপ ব্যবহার করা যায় না। ভয়াবহ গরমে দুই হাতে ঝাপটে ধরে বসে থাকলেও বিরক্ত হওয়া যায় না। তরু মনে মনে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলেও বিরক্ত হতে পারছে না। ভদ্রমহিলা শুরু থেকেই তরুর সাথে খুব আদর করে কথা বলছেন। ভবিষ্যতে তিনি যে খুব ভালো শ্বাশুড়ি হবেন বুঝা যাচ্ছে। ভদ্রমহিলা তরুর পাশে বসে থেকেই ছেলের সাথে ফোনে কথা বললেন। তরু ভুল না হলে, এই সেই ডিউটিওয়ালা পাত্র। ডিউটিওয়ালা পাত্র মায়ের সাথে খুব রাগ ঝাড়লো। ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললো,

‘ মা তোমাদের ছেলেমানুষি কখনো যাবে না, না? আমি তো বললাম, আসছি। হাসপাতালে এসেই বিয়ে করবো। তোমাদের এতোটুকু সময়ও সহ্য হচ্ছে না? টেলিফোনেই বিয়ে করে ফেলতে হবে কেন? টেলিফোনে কেউ বিয়ে করে? আশ্চর্য!’

ভদ্রমহিলা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললেন,

‘ তোর বাপ অপূর্ণ শখ নিয়েই মরে যাক। করিস না তুই বিয়ে। মানুষটা কেমন অস্থির হয়ে আছে। আমি দেখা করতে গেলেই বলছে, শাহানা আমি মরে যাচ্ছি। পুত্রবধূ দেখে যেতে পারলাম না। সে তো আর জানে না, ছেলে এখন লায়েক হয়ে গিয়েছে। কথায় কথায় ধমক দেয়। বাপ-মা মরে গেলেই তাদের কী? আসিস না তুই। আমার স্বামী আমি বুঝবো। আজ থেকে আমাদের বাবা-মা ডাকার দরকার নাই।’

ডিউটিওয়ালা ভালো ফ্যাসাদে পড়েছে। মায়ের কান্নাকাটি শুনে অধৈর্য হয়ে বললো,

‘ আমি তো বিয়ে করতে মানা করিনি মা। বেশ, টেলিফোনেই বিয়ে করবো। বিয়ের সময়সূচি আমায় জানাও। তবু, কান্নাকাটি অফ করো। প্লিজ।’

ভদ্রমহিলা কান্নাকাটি অফ করলেন। তরুকে চারশো বিশ ভোল্টের ঝটকার মধ্যে রেখে সত্যি সত্যিই টেলিফোনে বিয়েটা হয়ে গেলো। হাসপাতালে ইনজেকশন দিতে গেলে যেমন অনেক চিল্লাচিল্লির পর ফট করে একসময় ইনজেকশন দেওয়া হয়ে যায় টের পাওয়া যায় না? ঠিক তেমনই বিয়েটা যেন তরু টেরই পেলো না। কী আশ্চর্য, এভাবেও কী বিয়ে হয়?

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here