মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা |৩|

0
569

মেঘের দেশে প্রেমের বাড়ি
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

|৩|

তরু সর্বদা হাসিখুশি তরুণী। তার কখনো মেজাজ খারাপ হয় না। ‘হয় না’, বললে ভুল হবে। হয়। তবে চট করে ধরে ফেলা যায় না। যাবতীয় রাগ, দুঃখ, বিরক্তি চেপে রাখার আশ্চর্য ক্ষমতা তাকে দেওয়া হয়েছে। তরুর ধারণা, তার চোখে-মুখে বিশেষ একটা বৈশিষ্ট্য আছে। যে বৈশিষ্ট্যটার জন্য তার মেজাজ খারাপটা ঠিক মেজাজ খারাপ বলে মনে হয় না। মেজাজের পারদ যত বাড়ে তার মুখভঙ্গি হয় তত হাসি হাসি। তরু হাসপাতালের করিডোরে হাসি-হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। মেজাজের পারদ বহু আগেই ডেথ ভ্যালির তাপমাত্রাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। কিছুতেই মেজাজ ধরে রাখা যাচ্ছে না। তরুর মেজাজ খারাপের পেছনে অবশ্য একটা কারণ আছে। কারণটা স্বয়ং মাহবুব। মাহবুব তরুর ভাবনার বাইরে গিয়ে একটা অপকর্ম করে ফেলেছে। তরুর সাথে দেখা না করেই ডিউটিতে ফিরে গিয়েছে। এইযে তরু একটা ফোন পেয়েই বেহায়ার মতো নাচতে নাচতে হাসপাতালে চলে এলো? তার কোনো দাম মাহবুব দেয়নি। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে তরুর সাথে দেখা করাটা তার কাছে জরুরি বলে মনে হয়নি। মাহবুব চলে যাওয়ায় তরুর অবশ্য সেরকম মন খারাপ হয়নি। তার কেবল নিজের গালে শক্ত করে দুটো চ-ড় মারতে ইচ্ছে হয়েছে। প্রথম চ-ড়, বাবার কথায় নিজের দাম কমিয়ে এই ডিউটিওয়ালার মতো গরুকে বিয়ে করে ফেলার জন্য। দ্বিতীয় চ-ড়, শাশুড়ির টেলিফোন পেয়েই হাসপাতালে ছুটে আসার জন্য। তরু দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। সিঁড়ির গোড়ায় সরবকে দেখা যাচ্ছে। সরব হাসপাতালে এসেছে থেকে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কখনো ঔষধ, কখনো ফলমূল, জুস অথবা কোনো আত্মীয়কে পথ দেখিয়ে কেবিন পর্যন্ত আনার সকল দায়িত্ব ছুটোছুটি করে তাকে একা পালন করতে হচ্ছে। কেউকে ওয়াশরুমে যেতে হলেও সরবকে সাথে গিয়ে ওয়াশরুমের বাইরে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এই সকল কাজই সরব করছে প্রচন্ড আনন্দ নিয়ে। পড়াশোনার ব্যাপারে লম্বা লম্বা বক্তৃতা শুনেও বিনয়ে গলে গলে পড়ছে। তরুর মনে হলো, এই মুহূর্তে এই হাসপাতালে সব থেকে ব্যস্ত মানুষ হলো সরব। তার ব্যস্ততা ডাক্তারদের ব্যস্ততাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। উঁহু, আরও একজন মহা ব্যস্ত লোক অবশ্য আছে। সেই গরু মাহবুবের ব্যস্ততার কাছে সরবের ব্যস্ততা কিছুই নয়। সে তাবৎ দুনিয়ার ব্যস্ততাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। এই পৃথিবীতে সে-ই একমাত্র পুলিশ অফিসার; সে ডিউটিতে জয়েন না হলে পৃথিবী ধ্বংস হয়েও যেতে পারে। তরু বিড়বিড় করে বললো, মাহবুবুল হাসান নীরব, ইউ আর আ কাউ। গরু, গরু গরু! তরুকে করিডোরের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো সরব। হাত উল্টে হতাশ কণ্ঠে বললো,

‘তোমার সাথে তো ভাইয়ার দেখা হলো না। শুনলাম, ভাইয়া ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়েছে।’

তরু হাসলো,

‘ সমস্যা নেই। আমিও একদিন ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবো। তবে তোমার ভাইয়ার মতো ফুড়ুৎ না। অন্যরকম ফুড়ুৎ। মাহবুবুল হাসান নীরব ফুড়ুৎ-এর ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন কিন্তু ধরতে পারবেন না।

যে পাখি ঘর বুঝে না,
উড়ে বেড়ায় বনবাদাড়ে।
ভোলা মন মিছে কেন
মনের খাঁচায় রাখিস তারে?’

কথা শেষে মিহি কণ্ঠে শিষ বাজিয়ে মিষ্টি সুরে গুনগুনালো তরু। সরব অবাক চোখে চাইলো। নির্লিপ্ত তরুর মুখের দিকে চেয়ে থেকে নিঃসংকোচে বললো,

‘ তুমি একটু অদ্ভুত।’

‘ তুমিও। এক অদ্ভুত মানুষই কেবল অন্য অদ্ভুত মানুষকে পছন্দ করতে পারে। সাধারণত মানুষ অদ্ভুত জিনিস পছন্দ করে না। নিয়ম-কানুন মেনে চলা শুদ্ধ মানুষ পছন্দ করে। আমার মনে হচ্ছে, ভাবী হিসেবে আমাকে তোমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আমি তোমাদের বাসায় থাকতে শুরু করলে তুমি বোধহয় আরও খুশি হবে। তোমার ধারণা, আমার হৃদয় তুলোর মতো নরম। আমি তোমার সকল আবদার তথাস্তু বলে এপ্রুভ করে দিবো।’

সরব চোখ বড়ো বড়ো করে চাইলো। বিস্মিত কণ্ঠে বললো,

‘ একদম ঠিক! তুমি কী করে জানলে?’

তরু হেসে ফেললো। রহস্য করে বললো,

‘ আমি সব জানি। মানুষকে দেখেই ফট করে মনের কথা বলে ফেলতে পারার ক্ষমতা আমার আছে। তবে তোমার ধারণা কিন্তু ঠিক, আমি অবশ্যই তোমার সকল আবদার তথাস্তু বলে এপ্রুভ করে দিবো। দেবর হিসেবে তোমাকে আমার চমৎকার লাগছে। তুমি কী এমনই ভদ্রসদ্র ছেলে? নাকি চূড়ান্ত দুষ্ট?’

সরব হেসে বললো,

‘ চূড়ান্ত দুষ্ট।’

সরবের নিঃসংকোচ স্বীকারোক্তির জন্যই সরবকে আরও বেশি ভালো লেগে গেলো তরুর। হেসে বললো,

‘ দুষ্ট ইন গুড ওয়ে? অর ব্যাড ওয়ে?’

‘ বুঝতে পারছি না।’

‘ ছেলে হিসেবে তুমি কেমন? খুব ভালো? নাকি খুব খারাপ?’

সরব বললো,

‘ তোমাকে আমি আগেই বলেছি, আমার সব মোটামুটি ধরনের। আমি ভালোর দিক থেকেও মোটামুটি। খারাপের দিক থেকেও মোটামুটি। আমি মোটামুটি ধরনের খারাপ কাজ করি।’

তরুর চোখে-মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। শুধালো,

‘ সেই মোটামুটি ধরনের খারাপ কাজটা কি সিগারেট খাওয়া? তুমি সিগারেট খাও?’

সরব অবাক হয়ে বললো,

‘ কী আশ্চর্য! তুমি এতোকিছু জেনে যাও কী করে?’

তরু জবাব দিলো না। সরব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

‘ তোমার ধারণা ঠিক। তবে সবসময় খাই না। মাত্র দুইবার খেয়েছি। আমার বন্ধুগুলো বাজে তো এইজন্য। আমার উচিত ওদের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দেওয়া।’

সরবের অকপট স্বীকারোক্তিতে অবাক চোখে চাইলো তরু। হাত বাড়িয়ে সরবের হালকা বাদামী চুলগুলো ঝাঁকিয়ে দিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। বললো,

‘ তোমার ভালোত্বে কোনো মোটামুটি নেই। তুমি পৃথিবীর সবথেকে ভালো ছেলে, সরব।’

সরব হাসলো। চোখে-মুখে ঠিকরে পড়লো উচ্ছ্বাস। আনন্দিত কণ্ঠে বললো,

‘ তুমি যে আমার ভাবী এজন্য বলছো। তবে ভাইয়াকে নিঃসন্দেহে ভালো ছেলে বলা যায়। আমার ধারণা, তুমি ভাইয়ার সম্পর্কে জানতেই আমাকে এতো এতো প্রশ্ন করছো অথচ ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করতে লজ্জা পাচ্ছো।’

কথাটা বলেই হাসতে লাগলো সরব। তরু গম্ভীর হয়ে থাকতে গিয়েও হেসে ফেললো,

‘ তোমার বুদ্ধিও তো দেখি মোটামুটি লেভেল ছাড়িয়ে যাচ্ছে সরব!’

সরব খুব মজা পাচ্ছে। হেসে বললো,

‘ ভাইয়া আমাদের থেকেও অদ্ভুত মানুষ। ভাইয়াকে তুমি যাই বলবে, ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে তাকাবে। তাকে যদি বলো, ভাইয়া ভাত খেয়েছো? তবুও সে ভ্রু কুঁচকে তাকাবে। যদি বলো, ভাইয়া আমি অঙ্কে দুই পেয়েছি। আজ থেকে পড়াশোনা বন্ধ। আমি চা-ওয়ালা হবো। আমার দোকানে তোমার জন্য চা ফ্রী। ভাইয়া তবুও ভ্রু কুঁচকে তাকাবে। আমার ধারণা, ভাইয়ার ভ্রুতে কিছু সমস্যা আছে।’

সরবের কথা বলার ভঙ্গিতে খিলখিল করে হেসে উঠলো তরু। সরব বললো,

‘ হাসপাতালের বাইরে একটা রেস্টুরেন্ট দেখে এসেছি। ভদ্র ছেলে হয়ে ফাইফরমাশ খাটার নাটক করতে করতে ভয়ঙ্কর ক্ষুধা লেগে গিয়েছে। তুমি জানো না, ভদ্র হয়ে থাকার নাটক হলো সবচেয়ে কঠিন নাটক। এর মতো পরিশ্রম আর নেই। তুমি অবশ্যই এখন আমাকে কিছু খাওয়াবে নয়তো আমি ক্ষুধায় ক্ষুধায় মরেও যেতে পারি।’

‘ তুমি ভদ্র সাজার নাটক করছো?’

সরব নির্বিকার কণ্ঠে বললো,

‘ হ্যাঁ, করছি। এটাও আমার মোটামুটি ধরনের খারাপ কাজের মধ্যে একটি। ভদ্র সাজার নাটক করাটা অনুচিত। কিন্তু কিছু করার নেই। বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে। তুমি মাকে মিথ্যা করে কিছু বলো। বাইরে খাবার খেতে যাওয়ার কথা শুনলে মা নির্ঘাত জুতো ছুঁড়ে মারবে। বৃদ্ধ বয়সে মানুষের মাথায় নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। আমার ধারণা, আম্মু বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। তার মাথায় অজস্র সমস্যা আছে। কেউ অসুস্থ থাকলে পরিবারের বাকি সবাইকে অনাহারে থেকে শোক পালন করতে হবে, এই ধারণাটা আম্মুর বার্ধক্যজনিত মানসিক সমস্যার উদাহরণ।’

তরু প্রত্যুত্তরে হাসলো। সরবকে নিয়ে শাশুড়ী মাকে খুঁজতে গিয়ে দেখা গেলো তিনি ভীষণ ব্যস্ত। আত্মীয় স্বজনে ভর্তি হাসপাতালে তার সাথে কথা বলাই দায়। শাশুড়ী মা তরুকে দেখেই মন খারাপ করে বললেন,

‘ কী একটা অবস্থা দেখো দেখি? তোমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে অথচ একসাথে বসে দুই মিনিট কথা পর্যন্ত বলতে পারছো না। আমি মাহাবুবকে খুব বকাবকি করেছি। কিন্তু ছেলেটারও কোনো দোষ নেই বুঝলে। আমার পানির মতো সরল ছেলেটা হঠাৎ অথৈ জলে পড়েছে। বিপদের তো শেষ নেই। নয়তো এই অবস্থাতেই অফিসেও কেন এতো ঝামেলা হবে বলো? একদিনের ছুটি পর্যন্ত পাচ্ছে না। ছেলেটা আমার দুই দিনেই শুকিয়ে গেলো।’

তরু হাসি হাসিমুখে শাশুড়ী মায়ের কণ্ঠে তার বড় পুত্রের স্তুতিবাক্য শুনলো। কথার মাঝে মাঝে মাথা হেলিয়ে স্বীকারও করলো, ‘মাহবুবের মতো ভালো ছেলে পৃথিবীতে হয় না।’ একইসাথে মনে মনে টেপরেকর্ডারের মতো বাজতে লাগলো, ‘আপনার বড়ো ছেলের মতো গরু ছেলে পৃথিবীতে হয় না। হয় না। হয় না।’ সরব তরুর পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। তরুর ওড়নার যে অংশটা লম্বা হয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলো তারই এক কোণা আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে আনমনে কিছু ভাবছে। শাশুড়ী মা সরবকে দেখেই বিকট এক ধমক দিলেন,

‘ তুমি তরুর ওড়না ধরে দাঁড়িয়ে আছো কেন, বেয়াদব ছেলে? তরু কী ভাববে?’

সরব অবাক হয়ে বললো,

‘ কী ভাববে? আমি তো তোমার আঁচলও ধরে থাকি। তুমি কিছু ভাবো?’

শাশুড়ী মা গরম চোখে চাইলেন। সরব মুখ গোমড়া করে বললো,

‘ অযথা বকবে না তো! ভাবি আমাকে তার সাথে সাথে থাকতে বলেছে, আমি সাথে সাথে থাকছি। ভাবির সাথে আমার গোপন কথা আছে।’

‘ তরুর সাথে তোমার আবার কিসের গোপন কথা? ঘন্টা কয়েক হলো দেখা হয়েছে। এখনই ছেলে কেমন খাতির জমিয়ে ফেলেছে, দেখো। তরু, তুমি কিন্তু এই ছেলের কোনো আবদার শুনতে যেও না। এই ছেলের হাড়ে মাংসে বাঁদরামি।’

তরু একটু সুযোগ পেয়ে ভদ্র মেয়েটির মতো বললো,

‘ মা আমার শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। সরবকে নিয়ে হাসপাতালের বাইরে থেকে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসবো?’

তরুর শরীর খারাপের কথা শুনে বাস্তবিকই ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন শাশুড়ি মা। ভদ্র মহিলার চোখে চকিতে যে দুশ্চিন্তার রেখা খেলে গেলো সেই রেখাটা তরুর মনের গহীনে পদ্মাসন করে বসলো। এই গোলগাল চেহারার মহিলাটির প্রতি তৈরি হলো গভীর মায়া। বিয়ে বিষয়টার মাঝে ঐশ্বরিক কোনো ব্যাপার আছে নাকি এই টান মানুষের অভ্যাসগত তা তরু ধরতে না পারলেও খুব করে বুঝলো, সরব যখন তার আঁচল ধরে মায়ের আঁচলের সাথে তুলনা দিলো। শাশুড়ী মায়ের চোখে যখন এক মুহূর্তের জন্য খুব পরিচিত মা মা দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেলো। ঠিক সেই মুহূর্তে এই পৃথিবীতে অনেক কিছু পাল্টে গেলো। তরুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুইদিন আগের অপরিচিত মহিলা আর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ভ্রাতৃতুল্য কিশোরটি হুট করেই তার পরিবার বনে গেলো। তাদের প্রতি মায়ায় কেমন টলমল করে উঠলো বুক, আশ্চর্য!

সরব রেস্টুরেন্টে বসে এক গাদা খাবার অর্ডার দিয়েই বললো,

‘ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি একটা রেস্টুরেন্ট দিবো। এখনই দেওয়ার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু হবে না। ভাইয়া শুনলে ভ্রু কুঁচকে তাকাবে। তারপর কিছুই হয়নি এমন ভাব করে গালের উপর ঠাটিয়ে একটা চড় বসাবে। ভাইয়ার গায়ে এতো শক্তি! দেখা যাবে আমার গালের হাড় ভেঙে চুরচুর হয়ে আমার হাতের আঁজলে পড়ে গেলো। আমি হয়ে গেলাম গালভাঙা সরব।’

তরু হাসলো। শুধালো,

‘ রেস্টুরেন্টের নাম ঠিক করোনি?’

সরব গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

‘ করেছি। হুমায়ুন আহমেদের একটা উপন্যাসে হুমায়ুন আহমেদ একটা কফি শপের নাম ভেবেছিলেন কফিতা। আমি ভেবেছি, বিষণ্ণতা। আমার রেস্টুরেন্টে আসবে সব বিষণ্ণ বিষণ্ণ কাস্টমার। রেস্টুরেন্টে মৃদু লয়ে বাজবে রবীন্দ্রনাথের বিষণ্ণ গান। তুমি হবে আমার রেস্টুরেন্টের প্রধান অতিথি। তোমার জন্য সব ফ্রী। আর কাউকে ফ্রী দেওয়া হবে না।’

‘ শুধু আমি? তোমার মা, ভাইয়া, বাবা ওদের ব্যাপারেও কঠোরতা?’

সরব গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লো। তরু বললো,

‘ তোমার রেস্টুরেন্টে ফ্রী খাওয়ার জন্য কতদিন অপেক্ষা করতে হবে সরব?’

‘ বেশিদিন নয়। এই বছর আমি এসএসসি দেবো। তারপর ছয় বছরের মতো পড়াশোনা চলবে। তারপরই একটা বড়ো চাকরি। রেস্টুরেন্টের ক্যাপিটাল তো জমা করতে হবে। ভাইয়া জীবনেও টাকা-পয়সা দিবে না।’

তরু গম্ভীর মুখে বললো,

‘ রেস্টুরেন্ট করার সময় তুমি অবশ্যই আমাকে জানাবে। আমি তোমার পার্টনার হবো। ফোরটি পার্সেন্ট মূলধন আমার পক্ষ থেকে। তবে আজকের মূলধনটা পুরোপুরি তোমার ভাইয়াকেই দিতে হবে।’

সরব বুঝতে না পেরে বললো,

‘ আজকের মূলধন মানে?’

তরু টেবিলের উপর ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বললো,

‘ আমার কাছে কোনো টাকা পয়সা নেই। খাবার-দাবার খেয়ে আমাদের কাছে দুটো অপশন থাকবে। এক. টাকা না দিয়ে ভেগে যাওয়া। দুই. তোমার ভাইয়ার থেকে টাকা মেরে দেওয়া।’

সরব হতভম্ব চোখে চেয়ে রইলো। চাপা আর্তনাদ করে বললো,

‘ ভাইয়ার থেকে টাকা মারবো কী করে ভাবী? ভাইয়া তো ময়মনসিংহে নেই। এতোক্ষণে নিশ্চয় ঢাকা পৌঁছে গিয়েছে!’

তরু হাসলো। ঠোঁটের কোণে রহস্য ঝুলিয়ে রেখে মিষ্টি কণ্ঠে গুনগুন করলো,

‘একেলা পাইয়াছি হেথা পলাইয়া যাবে কোথা
চৌদিকে ঘিরিয়ারে রাখবো
সব সখী গণে।
আজ পাশা খেলবো রে শ্যাম
আজ পাশা খেলবো…….. ‘

বিস্মিত সরবের দিকে চেয়ে বললো,

‘ তোমার ভাইয়ার টেলিফোন নাম্বারটা দাও।’

রেস্টুরেন্টের এক ওয়েটারের কাছ থেকে মিনিট হিসেবে দরদাম করে একটা টেলিফোনের ব্যবস্থা করে ফেললো তরু। সরব প্রথম প্রথম কিছুটা আতঙ্কিতবোধ করলেও তরুর কাজকর্মে বেশ মজা পেলো। আগ্রহ নিয়ে বললো,

‘ তুমি কী ভাইয়ার সাথে প্র্যাঙ্ক করার চেষ্টা করছো ভাবী?’

তরু হেসে বললো,

‘ গরু মাহবুবের বুদ্ধি পরীক্ষা করে দেখা যাক। তোমার ভাই ছাগল নাকি শেয়াল জানা উচিত।’

তরুর কথায় অবাক হয়ে চেয়ে থেকে হেসে ফেললো সরব। তরু মাহবুবের ফোন নাম্বার তুলে ডায়াল করলো। ফোনের রিংটোন বাজতেই তরুর বুকের ভেতর ধুপধাপ ঢোল বাজতে লাগলো। উত্তেজনা আর আশঙ্কায় গলা শুকিয়ে গেলো। হৃদপিণ্ডটা যেন ধপ করে গলার কাছে উঠে এলো। কী অবস্থা! তরু টেবিলের উপর আঙুল নাচাতে নাচাতে গুনগুন করলো,

‘ ঠাকুমার ঝুলি খুলবে
মজার গল্প বলবে।
গা ছমছম, কী হয়! কী হয়!
কখনো মজা, কখনো-বা ভয়….’

তরুর গুনগুন গানের মাঝেই ঠাকুমার ঝুলি খুলে গেলো। অর্থাৎ, মাহবুব ফোন তুললো। টেলিফোনের ওপাশ থেকে অপরিচিত এক ব্যক্তির মেঘস্বর ভেসে এলো,

‘ হ্যালো।’

তরুর ভেতর-বাহির কেঁপে উঠলো সেই স্বরে। এই লোককে সে চেনে না। কখনো কথা বলেনি। অথচ লোকটার সাথে তার সবথেকে কাছের সম্পর্ক। আশ্চর্য! আশ্চর্য! তরুর একবার মনে হলো ফোনটা ফট করে কেটে দেওয়ায় উত্তম। মাহবুবের সাথে জীবনেও সে ফোনে কথা বলতে পারবে না। এই লোকের গলার স্বর এতো সুন্দর কেন? সুন্দর নাকি আতঙ্ক? তরুর বুক দরফর করছে। জানে না কেন, হাত-পা দুটো থরথর করে কাঁপছে। সব কথা গুলিয়ে বেকুব বনে গিয়েছে। তরু গোপনে লম্বা শ্বাস নিলো। নিজেকে শান্ত করে একদম স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,

‘ কী আশ্চর্য বলো তো? তুমি কী দিনদিন বেকুব হয়ে যাচ্ছো মাহবুব? তুমি যে আমাকে একটা টাকাও দিয়ে গেলে না এখন আমি বিলটা কী করে পে করবো?’

ওপাশের কণ্ঠস্বর একটু থমকালো। নিশ্চয় চমকে গিয়েছে? তরু মনে মনে খুশি হয়ে কতৃত্বপূর্ণ কণ্ঠে ওয়েটারকে ডাকলো। ডেকে বললো,

‘ আপনাদের এখানে বিকাশের মাধ্যমে পেমেন্ট করা যায় না? না, না স্ক্যান ফ্যান হবে না। বিকাশ নাম্বারটা বলুন!’

ওয়েটারের থেকে বিকাশ নাম্বার শুনে মাহবুবকে নাম্বার জানালো তরু। বললো,

‘ তুমি পেমেন্ট করে দাও। বিল এমাউন্ট হলো, দুই হাজার পঞ্চাশ টাকা।’

পুরোটা সময় মাহবুব একটা কথাও বললো না তবে মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তরু মনে মনে কল্পনা করে ফেললো, লোকটা নিশ্চয় এই মুহূর্তে ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে? কুঁচকানো ভ্রুতে তাকে কেমন দেখতে লাগছে? তরুর ভাবনার মাঝেই কোনোরকম উত্তর না দিয়েই টুট টুট শব্দ তুলে ফোন কেটে দিলো মাহবুব। তরু হতাশ মুখে ফোনের দিকে চেয়ে রইলো। মনে মনে কিঞ্চিৎ অপমানিতও বোধ করলো। বুকের ভেতর বিষাক্ত বাতাস হুল্লোড় দিয়ে উঠলো। ইশ! মাহবুব কেন তাকে এতো যন্ত্রণা দিচ্ছে? কী ক্ষতি করেছে তরু তার? কিচ্ছু তো না। তরুর দীর্ঘশ্বাসগুলো হাওয়ায় ভাসার আগেই আগ্রহী কণ্ঠে প্রশ্ন করলো সরব,

‘ ভাইয়া কী বললো?’

তরু প্রত্যুত্তর করার আগেই তরুর ফোন বাজলো। অপরিচিত নাম্বার। তরু ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে মেঘমন্দ্র কণ্ঠ ভেসে এলো। শান্ত, ধীর। কোথাও কোনো উত্তেজনা নেই। একদম উত্তেজনাহীন কণ্ঠটি মোলায়েম স্বরে তরুর নাম ধরে ডাকলো,

‘ তরু?’

তরু চমকে উঠলো। তরু যেন এই প্রথম উপলব্ধি করলো, তার নামের অর্থ গাছ। তার নাম উচ্চারণ করলে গাছের মতোই স্নিগ্ধ শোনায়। কই? কেউ তো আগে কখনো এতো স্নিগ্ধভাবে ডাকেনি আর? তরু উত্তর দিলো না। ওপাশের কণ্ঠটা নিজ থেকেই বললো,

‘ এমাউন্টটা কত বললে? আবার বলো তো। সরি, আমি তখন শুনতে পাইনি।’

মাহবুবের বলা বাক্যটা যেন তরুর গালে অদৃশ্য এক চপেটাঘাত দিয়ে গেলো। কত বড়ো ফাজিল পুরুষ! তরুকে ইচ্ছে করে লজ্জা দেওয়ার পাঁয়তারা! সে মহা বুদ্ধিমান। শেয়ালের বংশধর। তাই বলে নিজের বুদ্ধিটা এভাবে জাহির করতে হবে? তরুকে মিষ্টি কথায় এমন ভয়াবহ অপমানটা করতেই হবে? তরু চোখ-মুখ শক্ত করে বললো,

‘ আপনি হাসপাতালে এসেই কেন সরবকে দুটো চড় মেরেছেন? এটা কী চড় মারার সময়?’

বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো একেবারে অপ্রত্যাশিত প্রসঙ্গের ঝাপটায় মাহবুব বোধহয় এবার সত্যি সত্যিই থমকে গেলো। প্রথম কয়েক সেকেন্ড কোনো উত্তরই দিতে পারলো না। তারপর শান্ত কণ্ঠে বললো,

‘ ওকে চড় মারার পেছনে যথাযোগ্য কারণ ছিলো। ও প্রি-টেস্ট পরীক্ষায় অঙ্কে ষোল পেয়েছে।’

‘ আপনি চড় মারার পর কী ষোল দুগুণে বত্রিশ। বত্রিশ দুগুণে চৌষট্টি হয়ে গিয়েছে?’

মাহবুব জবাব দিলো না। তরু বললো,

‘ বত্রিশ দুগুণে চৌষট্টি না হলে পরের বার আর মারবেন না। সব জায়গায় পুলিশগিরি!’

কথা শেষ করেই খট করে ফোন কাটলো তরু। লম্বা একটা দম নিয়ে সরবের দিকে গাল এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘ তোমার ভাইয়া আসলেই একটা গরু। আমি ছাগলের মতো তোমার গরু ভাইকে বিয়ে করেছি বলে এই মুহূর্তে আমার গালে একটা থাপ্পড় মারো। এক্ষুনি!’

সরব হতভম্ব চোখে তরুর দিকে চাইলো। ঠিক তখনই এক ওয়েটার জানালো,

‘ ম্যাম আপনাদের বিল পে হয়ে গিয়েছে। এক হাজার টাকা বেশি পে করা হয়েছে। আপনারা কী আর কিছু অর্ডার করতে ইচ্ছুক?’

#চলবে…

[ বিঃদ্রঃ তিনদিন গল্প দিতে না পারার নির্দিষ্ট কিছু কারণ ছিলো। তার মাঝে একটি কারণ স্বয়ং পাঠকবৃন্দ। এমনিতেই রাইটার্স ব্লকে আছি। মাঝে মাঝেই মনে হয়, লেখালেখি আমার জন্য নয়। আমার দ্বারা হবে না।তারউপর আপনারা চুপচাপ পড়ে চলে যান। একটুখানি উৎসাহ পর্যন্ত দেন না। উৎসাহ ছাড়া কী লিখতে বসা যায়?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here