‘আমি আবরার জুহায়ের যার জন্য হাজার টা মেয়ে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সে আমি কিনা ওই মেয়ের মতো সাধারন একটা মেয়ে কে মেনে নেবো? শুধু মাত্র মা’য়ের জন্য বিয়ে টা করতে হয়েছে।’ বিছানায় শুয়ে সিলিং’য়ের দিকে তাকিয়ে দুই হাত দু দিকে মেলে স্বাভাবিক গলায় বললো আবরার।
পাশে দাড়িয়ে থাকা আবরারের বিশিষ্ট সেক্রেটারি অভ্র সরফরাজ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কণ্ঠস্বরে বিস্ময় প্রকাশ করে বললো, ‘তার মানে আপনি ম্যাম কে ভালোবাসেন না?’ উষ্ঠধয় প্রসারিত করে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো আবরার। যেনো এটা পৃথিবীর সব থেকে বেশী হাস্যকর বাক্য ছিলো। এবির হাসার কারন বুঝতে না পেরে ভ্রুঁ জোড়া কিঞ্চিৎ বাঁকা করে তাকিয়ে রইলো অভ্র।
‘ভালোবাসা হলো মায়া জাল। এই মায়া জালে ফেঁসে যাওয়া মানে সারাজীবনের জন্য নিজেকে অন্য কারোর কাছে হস্তক্ষেপ করে দেওয়া। এমন ভুল এবি কখনো করবে না। ভালোবাসি না কাউকে, আর না কাউকে ভালোবাসবো।’
এবি’র কথা শুনে তার উপর রাগ হচ্ছে অভ্রর। ভালোই যদি না বাসে তাহলে বিয়ে করার কি দরকার ছিলো? তখন পরিবার কে বারণ করতে পারে নি? মেয়েটার তো কোনো দোষ ছিলো না। তাহলে? ক্রোধ মনে দমিয়ে রাখলো সে। কিছু বলার সাহস নেই তার। কারন সে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী এবি উরফে আবরার জুহায়ের এর পারসোনাল সেক্রেটারি। তাই নিরবে রাগ দমিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। তাকে ঠিক কি বলার জন্য এখানে ডাকা হয়েছে তা জানার অপেক্ষায় আছে সে।
অন্যদিকে আবরার তার কক্ষে আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে আছে। মাথার উপর থাকা সাদা সিলিং’য়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। কিয়ৎক্ষণ পর অভ্রকে ডাকার মূল কারণ মনে পরার পর বললো, ‘অভ্র? আজকে সন্ধ্যায় যে গান রেকর্ডিং করার কথা ছিলো সেটা আজ ক্যান্সেল করে দাও। আমি অনেক টায়ার্ড আপাতত আমার কিছু রিফ্রেশমেন্ট চাই।’
হঠাৎ রেকর্ডিং ক্যান্সেল করায় অবাক হলো অভ্র। বললো, ‘কিন্তু স্যার হঠাৎ ক্যান্সেল করবেন কেন? গত সাপ্তাহ থেকেই ডিরেক্ট আজিজ গানটা রেকর্ড করার জন্য পিছু ঘুরছে। আজ করার কথা তাও ক্যান্সেল করছেন কেন?’
আবরার লম্বা একটা হাই তুললো। তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে উত্তর দিলো, ‘আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে অভ্র। তুমি ক্যান্সেল করে দাও। পেইন্ডিং ওয়ার্ক গুলো একটু চেক করে নিও।’
অভ্র প্রতি উত্তরে অভ্র মাথা দুলিয়ে ‘হ্যাঁ’ সম্মতি দিলো। তারপর নিরবে দরজা ভিড়িয়ে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। রুমের বাহিরে এসে একবার পিছু ফিরে তাকালো। এবি বরাবরই অদ্ভুত। নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে একটা কাজও করবে না। হোক সেটা প্রয়োজন কিংবা অহেতুক।
______________
‘শান্তিনিবাস’
রাত্রি প্রায় ছয়টা পঁচিশ ছুঁই ছুই! বাহিরের পরিবেশ নির্জন। পরিচ্ছন্ন অম্বরে মিটমিট করে তারা জ্বলছে। এক পাশে চাঁদ তার শুভ্র আলোতে ধরনী আলোকিত করে রেখেছে। রাস্তায় সোডিয়ামের কৃতির আলোর নিচে বসে থাকা ঘুটঘুটে কালো কুকুরের আর্তনাদ চারপাশ ভয়াংকর করে তুলছে। শান্তিনিবাসের ড্রয়িংরুম থেকে আড্ডায় মেতে উঠা একদল যুবক যুবতীর হাসি ঠাট্টার ধ্বনি চারপাশ জমিয়ে রেখেছে। রান্না ঘর থেকে সদ্য বানানো গরমাগরম খাবারের সুভাশ সন্ধ্যার পরিবেশ করেছে মুখরিত। বাড়ির গৃহিণী নিশিতা আর আয়েশা এক সাথে হাতে ট্রে নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসলেন। তাদের দুজনের আগমনে উপস্থিত সবার মুখ উল্লাসিত হয়ে উঠলো। সবাই হাতে গরম পাকড়া নিয়ে কামড় বসিয়ে ‘ইয়াম্ম’ সুর তুললো।
গরম গরম পাকড়া তে কামড় বসিয়ে আরিয়ান বললো, ‘আহঃ এ যেনো এক অমৃত! তোমাদের হাতের পাকড়া খেতে হলেও আজীবন বেঁচে থাকতে হবে!’
‘খাওয়ার সময় বেশি কথা বলতে নেই আরু! খিচকি উঠবে পরে!’ আবরারের চাচি আয়েশা চা’য়ের কাপ আরিয়ানের হাতে এগিয়ে দিয়ে বললো। একে একে সবাইকে কাপ দেওয়ার পর রাইমা চা কাপে চুমুক বসিয়ে বললো, ‘আম্মু তোমার হাতের চা পৃথিবীর সেরা চা! আমার ভালো থাকার ছোট্ট একটা প্রান!’
রাইমার বড় ভাই সাবিত আড় চোখে তাকালো রাইমার দিকে। কন্ঠস্বর ত্যাঁছড়া করে বললো, ‘ আর কত চা খাইবি? চা খাইতে খাইতে তো শরিরের অবস্থা বারো টা বাজাইছোস। একদম কাইল্লা ট্যাংরা মাছ! পরে তোরে বিয়া দেওয়ার লাইগা দুনিয়া খুইজ্জাও জামাই পাওয়া যাইবো না।’
উপস্থিত সবাই সাবিতের কথায় হেসে উঠলো। রাইমা কপাট রাগ দেখিয়ে বললো, ‘আমার বিয়ে নিয়ে তোমাকে এতো চিন্তা করতে হবে না। নিজের চর্কায় আগে তেল দাও।’
সাবিত সিঙ্গারায় কামড় দিয়ে চিবুতে চিবুতে বললো, ‘আমার চর্কায় যেই পরিমানের তেল। ওই তেল বেইচা বড়লোক হইতে পারমু। তোর জ্ঞান দেওয়া লাগবো না।’
রিমি ভ্রঁজোড়া কুঁচকিয়ে সাবিতের উদ্দেশ্যে বললো, ‘ট্যাংরা মাছ কাকে বলছো? তুমি একবার নিজের অবস্থা দেখেছো? ফু দিলেই তো উড়ে যাবে। আবার আসছো অন্য জনকে ট্যাংড়া বলতে হুহ!’
‘তুই জানিস তোকে মাথায় তুলে আছাড় দেওয়া আমার বাম হাতের কাজ? খালি শরিরে একটু মাংস কম তাই এমন দেখায়। কিন্তু শক্তি তার জায়গা মতো আছে!’ শার্টের কলার টেনে ভাব নিয়ে বললো সাবিত।
রিমি এক গাল হেসে টিটকারি জায়গা মতো ছুঁড়ে বললো, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ! তোমাকে দেখলে না অনেক মায়া হয়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে তোমাকে দিয়ে দেই।’
নুরা হাসতে হাসতে সোফায় হেলান দিলো। তার মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা প্রায়। সবাই এক এক করে সাবিতের দিকে তাকালো। প্রত্যেকের এমন চাহনীতে সাবিত নিঃশব্দে হাসতেই সবাই এক সাথে হেসে ফেললো। কিছুক্ষণ হাসি তামাশা চলতে থাকে তাদের মাঝে। এরই মাঝে আরিয়ান প্রশ্ন করেছিলো, ‘কিরে দীবা কোথায়? সন্ধ্যায় নিচে নামলো না যে।’
রাইমা চায়ের কাপ টি-টেবিলের উপর রেখে উত্তর দিয়েছিলো, ‘দীবার নাকি মাথা ব্যাথ্যা করছে তাই মেডিসিন খেয়ে ঘুমিয়ে আছে।’
~
শান্তিনিবাসের বড় ছেলে হলো আবরার জুহায়ের। আবরারের বাবা হলেন রোশান মাহমুদ আর মা নিশিতা। আরিয়ান আর রিমি তার ছোট দুই ভাইবোন। ছোট কাকা হোসেন মাহমুদ আর চাচিমা আয়েশা। চাচাতো ভাইবোন সাবিত, রাইমা, নুহা। সাবিত আবরারের সমবয়সী। আরিয়ান রাইমার থেকে এক বছরের বড়। রিমি, নুরা আর দীবা সমবয়সী।
দীবা সানজিদাহ! তার মা হলেন রোহানা শেখ। দীবার বাবা আর রোশানের মধ্যে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো। দীবার বাবা মা*রা গেছে দেড় বছর আগে। তার পর থেকে সে তার মায়ের সাথে শান্তিনিবাসে থাকে।
________________
জৈষ্ঠমাসের শেষের দিকে এক প্রকার অসয্যকর গরম পরে বাংলাদেশে। আজকেও পরিবেশটা কেমন গুমোট বেধে আছে। সন্ধ্যার অসহ্য তপ্ত গরমে মাথা ঘুরিয়ে ফেলার উপক্রম। বাহিরের অসহনীয় গরম থাকলেও রুমের ভিতর এসি থাকায় শীতল হাওয়া বিদ্যমান। তাই এই অসহ্য গরম অনুভব করতে হয়নি। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে ঘুম ভেঙ্গেছে আবরারের। অলস শরির টেনে ওয়াশরুম গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো। ল্যাপটপ হাতে নিয়ে রুমে থাকা ডিভানের উপর বসে নিজের গাওয়া একটা গান প্লে করলো। মন তার প্রফুল্লিত, বেশ আনন্দিত। কারন রিসেন্টলি তার গাওয়া গানটি বেশ ভালো জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। মনে মনে নিজেকে বাহ্ বাহ্ দিচ্ছে সে। ফুরফুরে মনে পূর্ণ মনোযোগ সহকারে গান শুনছে ও ল্যাপটপে কিছু ইমেইল চেক করছে। তখন ডিভানের উপরে থাকা মোবাইলের কর্কষ রিংটোনের ধ্বনি কর্ণপাত হতেই মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটলো তার। ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি তুলে মোবাইলের দিকে তাকালো। স্কিনে ডিরেক্টের নামের অক্ষর দেখে চোখে মুখে তার বিরক্ত এসে হানা দিলো। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মোবাইল হাতে নিয়ে কল রিসিভ করলো আবরার। রিসিভ হওয়ার পর অপর প্রান্ত থেকে ডিরেক্টরের অস্থির কন্ঠ ভেসে আসলো, ‘হ্যালো এবি? হুয়াট’স রং উইথ ইউ? আজকে গান রেকর্ডিং ক্যান্সেল করছো কেনো?’
‘আই’ম নট রেডি ফর দ্যাট টুডে!’ ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো আবরার। তেঁতে উঠলেন ডিরেক্ট। এমন সিরিয়াস একটা কাজে আবরারের এমন অন্যমনস্ক দেখে মোটেও সন্তুষ্ট নন তিনি। তাই কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে বলে উঠলেন, ‘মানে কি? তোমার এমন গা ছাড়া ভাবের জন্য আমাদের কত বড় ক্ষতি হবে তুমি জানো?’
‘ইট’স ডাজন’ট ম্যাটার টু মি! আমার আজ গান রেকর্ডিং করতে ইচ্ছে করছে না দ্যাট’স মিনস আমি আজ করবো না। আপনার সমস্যা হলে আমার সাথে ডিল ক্যান্সেল করতে পারেন। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। গট ইট মিঃ আজিজ!’ বলেই কল কেটে দিয়ে মোবাইল টা সামনে থাকা টি-টেবিলের উপর ছুঁড়ে মারলো আবরার। বিরক্ত লাগলো বেশ। বিবর্ণ মুখে ল্যাপটপ হাতে নিলো।
অর্ধবয়স্ক ব্যক্তি আজিজ মুখখানি থমথমে হয়ে গেলো। চেহারায় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ভেসে উঠলো। তার ক্যারিয়ার জীবনে বহুত অনেক সেলিব্রেটির সাথে কাজ করেছে। কিন্তু আবরার জুহায়ের মতো এমন ঘাড় ত্যা’ড়া তার এতো বছর ক্যারিয়ার জীবনে দেখে নি। আবরারের সাথে যতোদিন কাজ করেছে ততো দিনে এইটুকু বুঝতে সক্ষম হয়েছে সে। আবরার একবার কিছুতে না বললে সেটাকে কাঠখড় পুড়িয়েও হ্যাঁ করাতে পারবেন না কেউ। নিঃশব্দে তপ্ত শ্বাস ফেললো ডিরেক্ট আজিজ।
চলমান..
#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[সূচনা পর্ব]