#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির
[পর্ব-০৭]
আষাঢ় মাসের শুরু কেবল। আকাশে জমে আছে কালো মেঘ। তাদের আনাগোনার খেলা অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। স্নিগ্ধ এই সকাল। চারপাশে শীতল হাওয়া বিরাজমান। গাছের কচি পাতা থেকে চুইয়ে ঝরছে শিশিরের ছোট ছোট বিন্দু কণা। শুভ্র কাদম্বরী দূর দূরান্ত থেকে দৃশ্যমান যেনো হাত বাড়ালেই তাদের ছোঁয়া। প্রত্যেকটা স্নিগ্ধ প্রভাত যদি চা দিয়ে আরম্ভ হয়; তাহলে সেই মুগ্ধতায় মন একদম চাঙ্গা হয়। রোজকার দিনের মতো আজও দীবা সবার জন্য চা বানালো। এক এক করে সবার রুমে চা পৌছে দিল সে। রিমির রুমে চা দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় খেয়াল করলো অভ্রের রুমের দরজা খুলা। চা দিবে? কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভাবলো। যেহেতু এখন অতিথি সেহেতু চা দেওয়ায় যায়। তাই দীবা নিজে থেকে অভ্রর জন্য চা নিয়ে গেলো। দরজার কাছে এসে নক করলো দীবা। অভ্র বিছানায় বসে ইমেইল চেক করছিলো। দরজায় টোকা পরার শব্দ শুনে উঠে দাঁড়ালো। নিঃশব্দে দরজা খুলার পর দীবা কে দেখে সৌজন্যমূলক হাসি দিলো একটা। ঠোঁটে হাসি রেখেই সালাম দিলো। দীবা প্রত্যুত্তরে নম্রতার সাথে সালামের উত্তর দিলো। তারপর এক কাপ চা এগিয়ে দিলে অভ্র চা হাতে নিয়ে বললো, ‘ধন্যবাদ!’
দীবা স্বাভাবিক ভাবে জানতে চাইলো, ‘আপনি কি প্রতিদিন ভোরে উঠেন?’
অভ্র মাথা দুলিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ! ভোরের এই সময়টায় আমি আমার একাংশ কাজ শেষ করি। এইসময় ব্রেইন এক্টিভ থাকে। তাই রিলেক্সে ইজিলি কাজ কমপ্লিট করা যায়।’
দীবা মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘তাহলে প্রতিদিন সকালে এক কাপ চা আপনার জন্য বরাদ্দ।’
বিনিময়ে অভ্র মুচকি হাসলো। কিছুটা প্রফুল্লিত হয়ে বললো, ‘ঠিক আছে ভাবি। আব্ মানে..!’
ভাবি বলে নিজেই হকচকিয়ে গেলো অভ্র। কিছুটা আমতা আমতা করতে লাগলো। দীবা স্বাভাবিক ভাবে বললো, ‘আমাকে দীবা বলে ডাকতে পারেন। আমি আপনার থেকে অনেক ছোট।’
অভ্র মাথা কাত করে ‘আচ্ছা’ সম্মতি জানালো। দীবা চুপচাপ চলে আসলো সেখান থেকে। অভ্র রুমের দরজা লাগিয়ে বিছানায় বসলো। মনে মনে ভাবলো মেয়েটা বেশ ভালো আর মিশুক বটে। দেখতে এতোটাও খারাপ না। এবি মেনে নিলো না কেন? সেদিনের ঘটনায় অভ্র উপস্থিত ছিলো বিধায় সে সবই জানে। এমনকি দীবাকেও দেখেছে সে। কয়েকবার কথাও হয়েছিলো। তাই চিনতে ভুল হয়নি। এতো কিউট আর মিশুক মেয়ের প্রেমে এবি কিভাবে না পরে থাকে দেখবো। ভাবতেই হেসে উঠলো অভ্র।।
দীবা গায়ে ওড়না ভালো ভাবে পেঁচিয়ে বাগানের দিকে যাচ্ছে। যেতে যেতে অভ্রর বলা ‘ভাবি’ ডাকটা নিয়ে ভাবতে লাগলো দীবা। সে তো একমালুম ভুলেই গেছে যে সে বিবাহিত। তিন মাস আগে আবরার নামে এক ব্যক্তিকে সে কবুল বলে স্বামী হিসেবে গ্রহন করেছে। অথচ যার নাম ছাড়া আজ অব্ধি কিছুই জানে না। সেই ঘটনা পর রুমে বসে প্রচুর কেঁদেছিল দীবা। প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলো হঠাৎ এমন হওয়ায়। অতঃপর নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছিলো। তখন রাতে ড্রয়িংরুম থেকে ভাঙ্গচুর আর চেঁচামিচির আওয়াজে রুম থেকে বেড়িয়ে আসে। উপর থেকেই নিরবে দাঁড়িয়ে থেকে ড্রয়িংরুমে আবরারের রা’গা’রা’গি দেখলো দীবা। ওইদিন আবরার তার ভয়াংকর রাগ বহিঃপ্রকাশ করে যা দীবার মনে গভীর দাগ কাটে। প্রচুর ভয় পেয়ে যায় সে আবরার কে। কাল বিকেলে আবরার আসার পর থেকে সে রুম থেকেই বের হয়নি। আর আজ মনে মনে দো’য়া করছে যেন আবরারের সামনে যেন ভুলেও না পরে।
এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে বাগানে চলে এসেছে টের পায়নি দীবা। মালি জসিম মিয়ার ডাকে ধ্যান ভাঙ্গলো তার। জসিম মিয়া কে দেখে এক গাল হেসে এগিয়ে আসলো। তারপর হলুদ রঙের গোলাপ ফুল গাছে পানি দিতে দিতে বললো, ‘চাচা? আমার মনে হয় গোলাপ গাছের পাতা গুলো ছাঁটিয়ে দিতে হবে। মোজাইক পরেছে। নাহলে বাকি গাছ গুলো নষ্ট হয়ে যাবে।’
মালি জসিম মিয়া আফসোস করে বললেন, ‘এতো যত্ন করার পরে গাছের এই অবস্থা? অথচ রাস্তার অপর পাশের গাছ গুলো দেখো। কেউ কোনো যত্ন করে না। কিন্তু কতো সুন্দর।’
দীবা হেসে প্রতিত্তুর করলো, ‘অতিরিক্ত যত্নে থাকা জিনিস কখনো মূল্য দিতে বুঝে না।’
জসিম মিয়া মাথা দুলালেন। দীবার সাথে কথা বলতে বলতে বাগান পরিচর্যা করতে লাগলেন।
_______________
পরিচিত হলেও আজ এই কক্ষ আবরারের জন্য বড্ড অচেনা। একদম নতুনত্ব। এই রুমে আবরার আগে থাকলেও অভ্যেস বদলে গেছে। নতুন জায়গা, নতুন বিছানায় ঘুমানো কষ্ট হয়ে গেছে। সারারাত ভালো ঘুম হয়নি। শেষরাতে একটু ঘুমিয়েছিলো। কিন্তু ভোরেই ঘুম ভেঙ্গে গেছে তার। এই মুহূর্তে কড়া করে এক কাপ কফি হলে ভালো হতো। কিন্তু কাউকে ডাকতে ইচ্ছে করে না। তাই উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। মুহূর্তেই মৃদু শীতল বাতাস গায়ে লাগলো। ফুরফুরে হয়ে গেলো মন। বাহিরে সূর্যের আলোতে পরিবেশ আলোকিত হয়ে আছে। আবরার আড়মোড় ভাঙ্গলো। আশেপাশে তাকাতেই বাগানের এক পাশে চোখ আটকে গেলো তার। ছোট গোলগাল মায়াবী এক মুখশ্রী জসিম কাকার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে আর গাছে পানি দিচ্ছে। পরনে তার শুভ্র রঙের থ্রি-পিস। চুল গুলো উঁচু করে কাঠি দিয়ে খোঁপা বাধা। আবরার রেলিঙে দুই হাত ভর দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকালো সোনালি রৌদ্দুরে আলোকিত হয়ে থাকা এই রমনীর দিকে। ভীষণ মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো আবরার। হঠাৎ মনে হলো পাশে থাকা সাদা নয়নতারা ফুল ছিঁড়ে যদি তার কানে গুঁজে দেওয়া হতো তাহলে এই মুখশ্রীর সৌন্দর্য আরো দ্বিগুণ বেড়ে যেত! অথবা বেলী ফুলের মালা যদি খোঁপায় বেঁধে দেওয়া হয় তাহলে? নিশ্চয় আরো সুন্দর লাগবে। আবরারের অবাধ্য মন মেয়েটির মায়াবী মুখশ্রী ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা পুষণ করলো। হঠাৎ নিজের এমন বেহায়াপনায় হকচকিয়ে গেলো আবরার। রেলিং থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। এক হাত দিয়ে মাথা চুলকিয়ে নিজের এই অধম মন কে কয়েকটা গালি দিল। মেয়েটি কে? কথাটি মাথায় আসতেই সজাক হলো তার মস্তিষ্ক। আপনা আপনি মুখ থেকে বেরিয়ে এলো ‘দীবা?’ অবাক চোখে দীবার দিকে তাকালো আবরার। এবার চোখ ছোট ছোট করে ভালোভাবে দেখতে লাগলো দীবাকে। অতঃপর বিড়বিড় করে বলে উঠলো ‘বউ আমার ভালোই সুন্দরী!’ আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে ভিতরে চলে আসলো। কিছুক্ষন আগে নিজের এহেন কান্ডে নিজেই বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করতে করতে ওয়াশরুমে গেলো। অতঃপর ফ্রেশ হয়ে নিচে যাবার জন্য তৈরি হয়ে নিলো। রুম থেকে বের হয়ে অভ্রকে সাথে নিয়ে আবরার ড্রয়িংরুমের আসলো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ড্রয়িংরুমে রোশান ও হোসেন কে দেখতে পেলো। দুইজন অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। কাল অনেক বড় জার্নি করে এসেছিলো বিধায় আবরার ও অভ্র তাড়াতাড়ি শুয়ে পরেছে। আর রোশান ও হোসেন দুইজনই দেড়ি করে বাড়িতে এসেছে। যার জন্য তাদের দেখা হয়নি। আবরার কে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে হোসেন হেসে এগিয়ে এলো।
‘হ্যালো ইয়াং বয়’স, কি অবস্থা তোমাদের?’
আবরার, অভ্র এক গাল হেসে হোসেনের সাথে কোলাকোলি করলো। উত্তরে বললো, ‘এইতো ভালো। তোমার?’
‘ভালো!’
অতঃপর হোসেনেত সাথে অভ্রের পরিচয় করিয়ে দিলো আবরার। অভ্র নম্রতার সাথে দুজনের সাথে সংক্ষিপ্ত আলাপ শেষ করলো। অভ্রের সাথে আলাপ শেষে আবরার রোশানের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে সালাম দিয়ে বললো, ‘কেমন আছেন?’
রোশান গম্ভীর মুখে সালামের উত্তর নিয়ে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ!’
আবরারের আপনি সম্মোধন টা রোশানের পছন্দ হয় নি। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় আদর বেশি পেয়েছে আবরার। অন্যরা তাদের দুই জনকে আপনি করে সম্মোধন করলেও আবরার তুমি করে ডাকতো। আর বাবা ছেলের মাঝে বন্ধুত্বসুভল সম্পর্ক ছিলো একসময়। কিন্তু ছোট্ট একটা ঘটনা কেন্দ্র করে বাবা ছেলের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে বহু বছর আগে। ভেবেই তপ্ত শ্বাস ফেলে রোশান। আবরারও আর কথা বাড়ায় নি।
হোসেন বাবা ছেলের অবস্থা বুঝতে পেরে কথার প্রসংজ্ঞ বদলাতে আবরারকে বলে উঠে, ”তোর গায়ে সেলেব্রিটি সেলেব্রিটি গন্ধ আসছে। ঢাকা গিয়ে বদলে গেছিস একদম।”
কাকা ভাতিজার মাঝে কিছুক্ষণ রশিকতা চললো। অতঃপর রোশান হোসেন অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেলো। এর কিছু সময় পর আরিয়ান সাবিত নিচে নামলো। চারজন মিলে কথা কিছুক্ষণ আলাপ করলো। রাইমা নিচে নামতেই সবাই নাস্তা করতে টেবিলে বসলো।
_______________
দীবার ওয়াশরুমের দরজার সামনে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিমি ও নুরা। দুইজনই বিরক্ত, রাগান্বিত। দাঁতে দাঁত পিষে দাঁড়িয়ে আছে তারা। সেই কখন থেকেই ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে বসে আছে দীবা। সময় চলে যাচ্ছে অথচ দীবা বের হচ্ছে না। সহ্য হলো না আর। ওয়াশরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে নুরা চেঁচিয়ে উঠলো, ‘সমস্যা কি রে বইন? ওয়াশরুমেই কি সংসার পেতে বাচ্চা পয়দা করবি তুই?’
রিমিও রাগে দরজায় লাথি দিয়ে বলে উঠলো, ‘দীবানির বাচ্চা, তুই কলেজ যাবি না তো তোর ১৪ গোষ্টি কলেজে যাবে। এক্ষুনি বের হ তুই।’
নুরা কপাল কুঁচকে রিমির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘১৪ গোষ্টি কলেজ যাবে কেন? আমরা তিন জন যাবো শুধু।’
রিমি নুরার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো। তারপর আবারো দরজায় ধাক্কা দিল। ওয়াশরুমের ভিতরে দীবা হাই-কমোডে পা তুলে কাচুমুচু হয়ে বসে আছে। গায়ে কলেজ ড্রেস পরা, চুল গুলো এক পাশে এনে ঝুটি করে রেখেছে। বের হবে না কিছুতেই। নাস্তার টেবিলে গেলে ওই লোকটার সাথে দেখা হবে। তার থেকে থেকে হাজার গুণ ভালো কলেজেই যাবে না দীবা। সারাদিন রুমে বসে থাকবে। তাই দরজা খুলছে না। কিন্তু রিমি ও নুরা যে নাছোড়বান্দা। তারা দুইজন দীবাকে নিয়ে নাস্তা করবে, কলেজেও যাবে। কিছুতেই দীবাকে রেখে যাবে না তারা। তাই বারবার দরজা ধাক্কাতে লাগলো। কিছুটা বিরক্ত হলো দীবা। ভিতর থেকেই চেঁচিয়ে উঠলো, ‘বললাম তো যাবো না আমি। তোরাই যা।’
রিমি জানতে চাইলো, ‘কেন যাবি না? কারণ বল আগে।’
দীবা পূর্বের ন্যায় চেঁচিয়ে বললো, ‘বলবো না।’
নুরা বললো, ‘তুই বের হ বলছি।’
হতাশ হলো দীবা। উঠে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অনুনয় স্বরে বললো, ‘যাবো কিন্তু একটা শর্তে।’
নুরা রিমি আগ্রহপূর্ণ চোখেমুখে দ্রুত দরজার একদম কাছে এসে বললো, ‘কি?’
‘আমাকে নাস্তা করার জন্য জোড় করবি না। আমি ডিরেক্ট গাড়িতে গিয়ে বসে থাকবো। তোদের নাস্তা শেষ হলে চলে আসবি।’
নুরা রেগে কিছু বলতে যাবে তখুনি তার হাত ধরে থামিয়ে দিলো রিমি। চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বললো। তারপর দীবার উদ্দেশ্যে বললো, ‘ঠিক আছে। আমরা নাস্তা করতে যাচ্ছি। তুই বেড়িয়ে গাড়িতে গিয়ে বস।’
বলেই পা দিয়ে একটু শব্দ করলো। সাথে নুরাও। কিছুক্ষণ পর পায়ের শব্দ থামিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমের দরজার দুই পাশে দাঁড়িয়ে রইলো দুইজন। বেশকিছু সময় ধরে রিমি নুরার সাড়াশব্দ না পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো দীবা। লম্বা দম নিয়ে ওয়াশরুমের দরজা খুলে বের হলো। তখুনি পাশ থেকে নুরা দীবার হাত ধপ করে ধরে বললো, ‘এবার কোথায় যাবে বাবু?’
চলমান…