আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ #মাইশাতুল_মিহির [পর্ব-১২]

0
2112

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-১২]

রাতের আবহাওয়া শীতল। প্রবল বাতাস বইছে বাহিরে। ঝুম বৃষ্টি নেই তবু পরিবেশ কেমন গুমট বেধে আছে। ‘শান্তিনিবাসে চলছে নিরবতা। যে যার আপন কাজে নিজ কক্ষে অবস্থান করছে। ঘুমানোর সময় এখন। কিন্তু আবরার বারান্দায় বসে আছে। বিষণ্ণবদন তার মন। কারণটা দীবাকে দেখতে না পারা। সন্ধ্যার পর থেকে রাত অব্ধি আবরার ড্রয়িংরুমে বসে ছিলো। কারণ টা শুধু মাত্র দীবাকে একপলক দেখার আশায়। আবরার নিজেও জানে না সে দীবাকে দেখার জন্য এতো ব্যাকুল হয়ে আছে কেন। প্রথমদিন থেকে আজ অব্ধি যতবার দীবাকে দেখেছে ততোবার মুগ্ধ হয়েছে। মনের সুপ্ত কোণে কিছু একটা অনুভব হয়েছে তার। প্রতিদিন সন্ধ্যায় দীবা চা বানাতে রান্না ঘরে আসে। আর আবরার? সোফায় বসে থেকে দীবাকে পর্যবেক্ষণ করে। যতোক্ষন পর্যন্ত দীবা চা বানাতে রান্না ঘরে থাকে ততোক্ষণ আবরার সেখানে বিভিন্ন বাহানা দেখিয়ে বসে থাকে। দীবা যেতেই সেও চলে যায়। কিন্তু আজ রাতে দীবা নিচে আসেনি। দীবাকে দেখার আশায় অস্থির হয়ে ছিলো আবরারের মন। রাত্রি গভীর হয়েছে। খাওয়া দাওয়াও সম্পন্ন হয়েছে সবার। কিন্তু দীবা নিচে নামে নি। আয়েশা সবাইকে জানায় দীবার মাইগ্রেনের ব্যাথা উঠায় সন্ধ্যার পর খাবার খেয়ে মেডিসিন নিয়ে ঘুমিয়ে গেছে। আশাহত হলো আবরার। ক্ষুন্ন মনে নিজ কক্ষে চলে আসলো সে। বারান্দায় বসে দীবাকে নিয়ে ভাবতে লাগলো আবরার। এখন অপেক্ষা সকালের।
_________________

‘হেই বস, হুয়াট আর ইউ ডুয়িং হেয়ার?’

রবিন্দ্রনাথের ‘নৌকাডুবি’ বইটা দিয়ে আরিয়ানের পিঠে হাল্কা বাড়ি দিয়ে বললো রাইমা। আরিয়ান ঘাড় কাত করে রাইমা কে দেখে মিষ্টি একটা হাসি দিলো। রাইমা এগিয়ে আরিয়ানের পাশে বসেই প্রশ্ন ছুঁড়লো, ‘মন খারাপ তোমার? এতো রাতে এখানে কি করছো?’

‘তেমন কিছু না। এমনি বসে ছিলাম।’

রাতের পরিষ্কার আকাশ। সাদা মেঘ আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চাঁদটা হয়তো কোথাও উকি দিয়ে আছে কিন্তু ‘শান্তিনিবাস’এর ছাদ থেকে তার প্রদর্শন করা যাচ্ছে না। সেই দুপুরে ভারি বর্ষণের পর আগ্রাবাদে আর বৃষ্টি হয়নি। তাই পরিষ্কার আকাশে শীতল বাতাস প্রভাহমান। ছাদে ইটের তৈরিকৃত ব্যাঞ্চির উপর বসে আছে তারা দুজন। আরিয়ানের হাতে ক্লাসিক হাই গ্লোস অরেঞ্জ কালার গিটার। উষ্ঠধয় কামড়ে ধরে চুপচাপ গিটারের তার পর্যবেক্ষণ করছে সে। সোডিয়ামের কৃতিম আলোতে ছাদের এক পাশ আলোকিত হয়ে আছে। সেই আলোতে রাইমা আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আরু ভাই? একটা জিনিস খেয়াল করেছো??’

আরিয়ান গিটারের দিকে তাকিয়ে থেকেই ছোট করে বললো, ‘কি?’

রাইমা একটু নড়েচড়ে বসলো। তারপর আরিয়ানের দিকে ঘুরে বসে বললো, ‘আরব ভাইয়া মনে হয় দীবার প্রতি একটু উইক।’

রাইমার কথা শুনে তাচ্ছিল্য ভাবে হেসে উঠলো আরিয়ান। ত্যাঁছড়া চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘এমন কিছু জীবনেও সম্ভব না।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ এমন কিছু ঘটেছে বলেই সম্ভব। আমি এই কয়েকদিন খেয়াল করেছি। আরব ভাই দীবার দিকে কেমন চোরা চোখে তাকায়।’

আরিয়ানের চেহারায় এবার বিরক্ত আসলো। কণ্ঠস্বরে ক্রোধ প্রকাশ করে আবরারের উদ্দেশ্যে বললো, ‘এরে তো ইচ্ছে করে ধরে কিছুক্ষণ কে*লা*নি দেই। দীবা তার লিগ্যাল ওয়াইফ, তাহলে মেনে নিতে সম*স্যা কোথায়? ওই তো এমন ভাব দেখাই যেন রানী ভিক্টোরিয়ার নাতি তার জন্য পাগল। রেডিকিউলাস!’

‘প্রথমে হয়তো ভালো লাগতো না কিন্তু এখন ভালো লাগে।’

আরিয়ান জড়তাহীন ভাবে বলে উঠলো, ‘হ্যা, বললেই হলো। এতো দিন প্রত্যাখ্যান করে এখন যদি বলে আই এক্সেপ্টেড হার তো পঁচা পুকুরে চু*বা*বো।’

রাইমা বললো, ‘পারবে তো না শুধু শুধু ফা*পর নিও না।’

আরিয়ান আর কিছু বললো না। চুপচাপ বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর রাইমা গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো তাকে। তখন আরিয়ান গিটারের তারে টুংটাং সুর তুলে গাইতে লাগলো…

‘সেদিন ভোরে, বুকের গভীরে
শুনেছি জমে থাকা নীল বেদনারা ডাকে
এই শহরে ইটের পাহাড়ে,
ছিলনা কেউ যে দেওয়ার প্রেরণা
যন্ত্রে বাঁধা মন, ছিল ক্লান্ত অসহায়
অর্থে কেনা সুখ, ম্রিয়মাণ দুঃখের ছায়ায়
যন্ত্রে বাঁধা মন, ছিল ক্লান্ত অসহায়
অর্থে কেনা সুখ, ম্রিয়মাণ দুঃখের ছায়ায়

আর নয় সময় উদ্দেশ্যহীন মিছিলে
তুমি সেই পূর্ণতা আমার অনুভবে
আর নয় আঁধার, তুমি স্বপ্নে ডেকে নিলে
ভরে মন অন্তহীন রঙ্গিন এক উৎসবে।
_______________

বর্ষাকাল মানেই দিনরাত বৃষ্টি। ভারী বর্ষণ প্রকৃতিকে করে তুলে শান্ত, মনোরম। অম্বরে চলতে থাকে মেঘ আর সূর্যের লুকোচুরি খেলা। আড়ম্বরের ধ্বনিতে কম্পিত হয় পরিবেশ। শেষ রাতে ভাড়ি বর্ষণের পর সকালে পরিষ্কার অম্বর কিন্তু মেঘাচ্ছন্ন। পিচ ঢালা রাস্তা ভিজে একাকার। বর্ষায় ফোটা ফুল গুলো তার রঙিন সজীবতা ছড়িয়ে মুখরিত করেছে পরিবেশ। সদ্য ফোটা কচি পাতা গুলো অসম্ভব সুন্দর লাগছে। বারান্দায় উঁকি দিয়ে আকাশ ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে ব্যাগ কাধে নিয়ে বের হলো দীবা। ড্রয়িংরুমে এসে দেখলো প্রায় সকলে উপস্থিত শুধু মাত্র রোশান, হোসেন আর সাবিত ছাড়া। আয়েশা, নিশিতা আর দীবার মা এক সাথে উপরের রুমে কাজ করছে। বাকিরা সোফায় বসে মোবাইল টিপতে ব্যস্ত। তিন জন নিচে নামার পর আরিয়ান উঠে দাঁড়ালো। মোবাইল পকেটে রেখে বলে উঠলো, ‘গাড়িতে গিয়ে বস। আমি আসছি।’

তাৎক্ষনাৎ আবরার সোফায় বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরলো। সবার দৃষ্টি তার উপর আসার পর বললো, ‘তুই থাক আমি দিয়ে আসি।’

আরিয়ান ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে প্রশ্ন করলো, ‘তুমি দিয়ে আসবে মানে?’

আবরার আরিয়ানের কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। কিছুটা ইতস্ততবোধ করে বললো, ‘তুই অভ্রকে নিয়ে বাহিরে যা। আমি ওদের কলেজে দিয়ে তোদের সাথে জয়েন করবো।’

উপস্থিত সকলে বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে প্রায়। রাইমা ঠোঁট টিপে হাসলো। তারপর ভ্রুঁ উঁচিয়ে আরিয়ানের উদ্দেশ্যে ইশারা করলো সে। অর্থাৎ সে ঠিকই বলেছিল; আরব ভাই দীবার প্রতি দুর্বল। আরিয়ান চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আবরারকে বললো, ‘তোমাকে কষ্ট করে যেতে হবে না। আমিই যাচ্ছি!’

‘আরে কোনো কষ্ট হবে না। এই সুযোগে না হয় আগ্রাবাদ কলেজটা দেখে নিবো। তোরা যা আমি ওদের নিয়ে যাচ্ছি।’ বলেই দীবার দিকে এক পলক তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেলো আবরার। বেশ অস্বস্তিতে পরেছিল সে। দীবা এই মুহূর্তে শুধু মাত্র নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।

অপরদিকে সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থেকে রিমির হাতে চিমটি কাটলো নুরা। ফিশফিশ করে বললো, ‘বোইন দেখছোস আমি কইছিলাম না? আরব মিয়া দীবার প্রেমে পরছে।’

রিমি সন্দিহান দৃষ্টি ফেলে বলল, ‘হু বইন। আমিও দেখছি।’

আবরার যেতেই আরিয়ান আহাম্মকের মতো বলে উঠলো, ‘এটা কি হলো?’

অভ্র শব্দ করে হেসে উঠলো। অতঃপর আরিয়ানের কাধে চাপড় দিয়ে বললো, ‘অনেক কিছু। আসো আমরা যাই।’

আরিয়ান মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো। তারপর দীবাদের যেতে হলে বলে নিজেও বের হলো অভ্রের সাথে। দীবা অসহায়ত্ব মুখে রাইমার দিকে তাকাতেই রাইমা দাঁত বের করে বললো, ‘যাও যাও!’

গাল ফুলিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো দীবা।মনে মনে আবরারের চৌদ্দ গোষ্টি উদ্ধার করতে লাগলো দীবা। বাহিরে এসে দেখলো আবরার গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবরারকে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধাতস্থ হলো দীবা। গাড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকলে সে ভিতরে গিয়ে বসবে কি করে? সরছে না কেন লোকটা? বিরক্ত হলো কিছুটা। গাড়ির দিকে এগিয়ে যাবে কি যাবে না তা নিয়ে ইতস্ততবোধ করতে লাগলো। দীবাকে দেখেই আবরারের মুখে পরিপূর্ণ হাসি ফুটে উঠলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় তাকে কাছে ডাকলো। কপালে সরু ভাজ ফেলে তাকালো দীবা। ইদানীং আবরারের ব্যবহারের পরিবর্তন তার মোটেও ভালো টিকছে না। আসলে চাইছে কি ব্যাটায়?

ইশারায় কাছে ডাকার পরেও দীবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবরার কিছুটা বিরক্ত হলো। হাল্কা ধ*মকের স্বরে বলে উঠলো, ‘কি ব্যাপার আসছো না কেন?’

দীবা এক চুলও নড়লো না। স্থির দাঁড়িয়ে ইতস্ততবোধ করতে লাগলো। ভয়ে শুকনো ঢুক গিললো সে।

‘বাই এনি চান্স তুমি কি কোলে তুলে আনার জন্য দাঁড়িয়ে আছো?’ আবরার ভ্রুঁ নাচিয়ে প্রশ্ন করে উঠলো। দীবার মুখ আপনা আপনি ফাঁক হয়ে গেলো। গাড়ির দিকে এগিয়ে এসে ঝাঁঝালো গলায় বললো, ‘আশ্চর্য মানুষ তো আপনি। উলটা পালটা কথা বলেন কেন সবসময়?’

আবরার বুঝতে না পারার ভান ধরে বললো, ‘উলটা পালটা কথা কখন বললাম?’

দীবা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলো, ‘এইযে এখন বললেন। ওইদিনও বলেছিলেন কোলে তোলার কথা। আজও বললেন। এইসব উলটা পালটা কথা না?’

আবরার পকেটে দুই হাত গুঁজে প্রত্যত্তর করলো, ‘ভালো কথায় না শুনলে কি করবো?’

‘হ্যাঁ ভাই, এই ছেড়ি কখনো সোজা কথা শুনে না। মাঝে মাঝে ত্যাড়া কথা বলবেন কাজে দিবে।’

দাঁত কেলিয়ে বললো নুরা রিমি। ডিঙ্গিয়ে ডিঙ্গিয়ে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো দুজন। দুজনের কথা শুনে আবরার অল্প শব্দে হেসে উঠলো। দীবার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললো, ‘তাই করতে হবে।’

হতাশ হলো দীবা। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ অস্বস্তি লাগছে তার। তিন ভাই বোনের দিকে বিরক্তি মাখা চোখে তাকিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। মনে মনে আবরারকে গা:লি শুনাতে ভুললো না। রাগে, বিরক্তিতে মুখখানি কালো করে গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। রিমি ও নুরা দীবার দুই পাশে বসলো। আবরার গাড়িতে বসে সামনের আয়নাটা ভালো ভাবে দীবার দিকে স্থির করলো। আয়নাতে দীবার গাল ফুলানো মুখটা দেখে আলতো ভাবে হাসলো। তারপর চোখে সানগ্লাস পরে গাড়ি স্টার্ট দিলো। পুরোটা রাস্তা ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে দীবাকে যতোটুকু পেরেছে দেখেছে আবরার। মেয়েটাকে সারাদিন দেখলেও বিরক্ত আসবে না। এতো কিউট কেন দীবা? আগে জানলে এই তিন মাস অপচয় করতো না আবরার।

কলেজের সামনে গাড়ি থামালে তিনজন নেমে পরলো। দীবা গাড়ি থেকে নেমে আবরারের দিকে ভুলেও তাকালো না। চুপচাপ গটগট পায়ের কদম ফেলে কলেজের ভিতরে চলে গেলো। তাকে এভাবে চলে যেতে দেখে আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলো রিমি নুরা। আবরার গাড়ির কাচ নামিয়ে তাকিয়ে রইলো দীবার চলে যাওয়ার দিকে। তারপর রিমি ও নুরার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, ‘তোদের বান্ধুবির কি ম্যানারস বলতে কিছু নেই? কলেজে পৌঁছে দিলাম অথচ ধন্যবাদ জানানো তো দূরে থাক; ফিরেও তাকালো না?’

রিমি ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকানোর প্রয়াস করলো। নুরা কিছুটা ঠাট্টার ছলে উত্তর দিলো, ‘চিন্তা করো না বস! ম্যানারস আমি শিখিয়ে দিবো।’

আবরার চোখমুখ কুঁচকে বিড়বিড় করে কিছুটা একটা বললো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো। আবরার যেতেই শব্দ করে হেসে উঠলো রিমি নুরা। তাদের হাসির শব্দ শুনে আশেপাশের কয়েকজন শিক্ষার্থী ও পথযাত্রী অদ্ভুত চোখে তাকালো। কিন্তু সেই দিকে ধ্যান নেই তাদের। নুরা উল্লাসিত হয়ে ঠোঁটে হাসি রেখেই রিমির বাহু ধরে বললো, ‘ইয়ার! দুইজনের প্রেম কাহিনী শুরু।’

রিমি বললো, ‘আই উইশ, আরব ভাই আর দীবা যেন একে অপরকে ভালোবাসে।’

অতঃপর কথা বলতে বলতে ক্লাসে আসলো দুজন।

চলমান..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here