আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ #মাইশাতুল_মিহির [পর্ব-১৪]

0
1879

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-১৪]

রাতের ঘড়ির কাটা নয়টা ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। রিমি নুরার রুমের যাওয়ার জন্য নিজের রুম থেকে বেরিয়েছিল। রুমের বাহিরে এসে অভ্রকে আবরারের রুম থেকে বের হতে দেখে তাৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে পরলো সে। লোকটাকে দেখেই রাগ উঠলো তার। এই বদ লোকের জন্য মায়ের বকা শুনতে হয়েছে। এই বদ লোকটাকে নাকি রিমি জুবাইরা স্যরি বলবে? জীবনেও না! অভ্রকে দেখেই মনে মনে শয়তানী বুদ্ধি বের করলো সে। কাল বিকেলে তো তাকে হাতি মশার সাথে তুলনা করেছে। আজ ওকে মজা দেখানো যাক। যেই ভাবা সেই কাজ। অভ্রকে না দেখার ভান ধরে হাঁটতে লাগলো রিমি। অভ্র রিমিকে খেয়াল করেছে ঠিকই কিন্তু রিমির দিকে তেমন ধ্যান দেয়নি। নিজের মতোই চলতে লাগলো। অভ্র রিমি পাশাপাশি আসতেই রিমি ইচ্ছে করে ধাক্কা দিলো অভ্রকে। হঠাৎ ধাক্কা লাগায় অভ্র হকচকিয়ে গেলো। রিমির ইচ্ছে ছিলো অভ্রকে ফেলে দেবার কিন্তু তা আর হয়নি। উল্টো নিজেই ব্যাথা পেলো বাহুতে। এক হাতে বাহু ধরে আর্তনাদ করে উঠলো, ‘ওরে আল্লাহ রে! ইটের বস্তার মতো শরির আমাকে চ্যাপ্টা বানিয়ে ফেললো রে।’

রিমির সাথে ধাক্কা খাওয়ার পর হতভম্ব হয়ে গেলো অভ্র। পরোক্ষনে রিমির চিৎকার শুনে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে তাকালো। রিমির নাটক বুঝতে বাকি নেই তার। হাসি পেলো ভীষণ। তাই তাচ্ছিল্য করে বলে উঠলো, ‘একেই বলে নিজের পায়ে নিজেই কু*ড়া*ল মা*রা। আমাকে ধা*ক্কা দিতে এসে নিজেই চিৎপটাং।’

রেগে গেলো রিমি। আসলেই সে অভ্রকে ব্যাথা দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু অভ্রের মতো শরিরের সাথে তার এইটুকু শরিলের তুলনা হয় না। হুদাই নিজেই ব্যাথা পেলো। তবুও নিজের দোষ স্বীকার করতে নাজার। তাই উলটো রাগ দেখিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল, ‘আমি না আপনি নিজে ধা*ক্কা দিছেন।’

‘মিথ্যে বলবে না একদম। তুমি ইচ্ছে করেই ধা*ক্কা দিয়েছো।’

‘এহ আমার তো খেয়ে বসে আর কোনো কাজ নেই যে একটা বস্তার সাথে স্বেচ্ছায় ধা*ক্কা খাবো। চোখ কি আকাশে রেখে হাঁটেন?’

রিমির ঝগড়া দেখে বিরক্ত হলো অভ্র। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ ফেলে বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলল, ‘এই মেয়ে সমস্যা কি হ্যাঁ? নিজেই ধাক্কা দিয়ে আবার কোমড় বেধে ঝ*গ*ড়া করছো?’

রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠলো রিমি, ‘ঝগড়া করছি মানে? আমাকে আপনি ইনডাইরেক্টলি ঝ’গ’ড়াটে বললেন?’

হাসি পেলো অভ্রের। সে কখন রিমিকে ঝ’গ’ড়াটে বললো? এক লাইন বাড়িয়ে বলে নিজ ইচ্ছায় ঝগড়া করছে মেয়েটা। হাসি মনে দমিয়ে রেখে ত্যাঁছড়া ভাবে বলল, ‘বাহ, পাশের বাসার আন্টিদের মতো ক কে টেনে টুনে কলকাতা বানানোর স্বাভাব টা তোমার ভালোই আছে দেখছি।’

রিমির কাটা গায়ে নুনের ছিটা পরলো। রাগ শরিরে রিরি করে বেড়ে গেলো। মাত্রারিক্ত রেগে আঙুল তুলে বলে উঠলো, ‘হুয়াট ডু ইউ মিন বাই পাশের বাসার আন্টি? আমাকে আন্টি দের মতো লাগে আপনার? আপনার সাহস তো কম না আমাকে আন্টি বলেন।’

‘সাহসের কি দেখলে তুমি? এখনো তো কিছু বলি নি। করিও নি।’

রিমি চোখ ছোট ছোট করে কুৎসামূলক ভাবে বললো, ‘আর কি-ই বা করবেন? মেয়ে মানুষ দেখলে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিতে পারবেন। বাঁজে লোক কোথাকার।’

রিমির কথাটা ও কথা বলার ধরণ দুটোই অভ্রের গায়ে লাগলো খুব। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। মুখশ্রী তে স্পষ্ট ক্রোধের ছাপ ভেসে উঠলো। চোখমুখ শক্ত করে বললো, ‘ঠিক করে কথা বলো রিমি।’

অভ্রের চেহারা দেখে ও রাগি গলা শুনে শুকনো ঢুক গিললো রিমি। মন ভয়ার্ত হলেও প্রকাশ করলো না। কিছুটা ফিচেল গলায় বললো, ‘ঠিকই বলেছি। আপনি ধাক্কা দিয়েছেন। স্বীকার করে নেন। এন্ড স্যরি বলেন।’

অভ্র একটা ভ্রুঁ বাঁকা করে বললো, ‘আমি কেন স্যরি বললো? কোন দুঃখে স্যরি বলতে যাবো? পাগল নাকি?’

রিমি চোখ বড় বড় করে তাকালো। কিছুটা আর্তনাদ করে চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘কি? আমাকে আপনি পাগল বলেছেন? এই মিয়া সমস্যা কি আপনার? আমাকে পাগল বললেন কেন? আপনি নিজে কি? আপনি পাবনা হতে পালাতক পুরনো পাগল।’

অভ্র এবার বেজায় বিরক্ত। অপ্রসন্ন চোখেমুখে তাকালো রিমির দিকে। বিরক্ত হয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই কানে আসলো অন্য কথা।

‘স্টপ গাইস! ঝগড়া করছো কেন তোমরা?’

আরিয়ানের কথা কর্ণগোচর হতেই থেমে গেলো দুজন। অভ্র ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রিমির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। রিমি ঠোঁট কামড়ে ভাবছে কিভাবে নিজের দোষ ঢাকতে পারবে। আরিয়ান বিজ্ঞব্যক্তিদের মতো ভ্রুঁ বাঁকিয়ে দেখছে দুজনকে। মাথায় আসছে না এরা দুজন ঝগড়া করছে কেন? তার বোনই বা এতো ঝগড়াটে হলো কবে থেকে? আরিয়ান কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিমি ন্যাকা কান্না শুরু করে বলে উঠলো,

‘ভাইই দেখো এই লোকটা আমাকে বুড়ি বলছে। আমাকে নাকি আন্টি আন্টি লাগে। আবার পাগল বলছে।’

অভ্র বিস্মিত হয়ে তাৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে রিমির দিকে তাকালো। সে কখন এই কথা বললো? কপালে সূক্ষ্ম ভাজ ফেলে বলে উঠলো, ‘ওই মেয়ে, মিথ্যে বলছো কেন?’

রিমি অভ্রের দিকে আড় চোখে তাকালো। তারপর এক হাত অভ্রের দিকে তুলে আরিয়ানের কাছে অভিযোগ করলো, ‘দেখছো ভাইয়া আমাকে মিথ্যাবাদী বলছে।’

আরিয়ান রিমির উপর বিরক্ত হলো। কথা ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে কোথায় লাগাতে হয় তা রিমির থেকে কেউ ভালো পারে না। সে তার বোনের স্বাভাব সম্পর্কে অবগত। কিন্তু বাড়ির মেহমানের সাথে ঝগড়া করাটা একদম বেয়াদবি। এতো বড় মেয়েকে এই কথা কে বুঝাবে? তাছাড়া আরব ভাই যদি ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারে তাহলে প্রচন্ড ক্ষেপে যাবে। সে রিমিকে কপাট শাসনের মাধ্যমে বললো, ‘রিমি? অভ্র ভাই তোর বড়। উনার সাথে ঝগড়া করার মানে কি?’

রিমির মাত্রারিক্ত ন্যাকামি আর মিথ্যে বলাতে অভ্র আরিয়ানকে বলে উঠলো, ‘তোমার বোন তো দেখছি ভালোই ঝগ’ড়া জানে। কেমন পায়ে পরে ঝ’গ’ড়া করছে এখন।’

ঝটপট চোখে অভ্রের দিকে তাকালো রিমি। রাগে গিজগিজ করতে করতে বললো, ‘ওহ আচ্ছা আচ্ছা। ঝগড়া একা আমি করেছি? আপনি দুধে ধোয়া তুলসি পাতা ছিলেন? এখানে তো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। কিছুই বুঝেন না কচি খোকা আপনি। ফিডার খাওয়ানো উচিত! এক হাতে তালি বাজে তাই না?’

আরিয়ান রিমিকে ধমকে উঠলো, ”চুপ করবি তুই।’

রিমির কথায় চোখে হাসলো অভ্র। এই কিছুদিনে আরিয়ানের সাথে তার বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। যতোটুকু চিনেছে তার থেকে এটা অনুমান করতে পেরেছে রিমি আর আরিয়ান সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাচের মানুষ। ভাই বোন হলেও দুজনের মাঝে কোনো মিল নেই। অভ্র এক হাতে কপাল চুলকে বললো, ‘এটা আসলেই তোমার বোন?’

রিমি ভ্যাবাচ্যাকা খেলো অভ্রের এমন প্রশ্ন শুনে। অবাক কন্ঠে বললো, ‘মানে?’

অভ্র রিমির দিকে ঘুরে পকেটে দুই হাত গুঁজে দাঁড়ালো। রিমির চোখে চোখ রেখে আরিয়ানের উদ্দেশ্যে কণ্ঠস্বরে ফাজলামি প্রকাশ করে বললো ‘আরিয়ান, আমার মনে হয় তোমাদের ডিএনএ টেস্ট করানো উচিত।’

গটগট করে পায়ের কদম ফেলে রুমে চলে গেলো অভ্র। রিমি হা হয়ে আছে অভ্রের কথায়। অতঃপর রেগে দ্বিগুণ চেঁচিয়ে উঠলো। এক হাতে অভ্রের রুমের দিকে তুলে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,

‘কি বললো ওই? ডিএনএ টেস্ট মানে? আমাকে নিয়ে সন্দেহ করলো? এতো বড় সাহস ওর? এরে তো আমি আজকে মে’রেই ফেলবো। এত্ত বড় সাহস কই রাখে দেখেই ছাড়বো। তুই এই রিমির হাত থেকে বাঁচবি না অভ্রের বাচ্ছা। তোকে আমি..!!’ অভ্রের রুমের দিকে তেড়ে যেতে নিলে আরিয়ান রিমির হাত ধরে আটকে ফেললো। রিমিকে টেনে রুমে নিয়ে যেতে যেতে বললো, ‘থাম বোইন, রুমে যা।’
____________________

আজকের সকালটা মুগ্ধকর। আকাশটা বেশ স্বচ্ছ। নীল আকাশের আনাচে-কানাচে সাদা মেঘ ভাসছে। মৃদু বাতাসে শীতলতা ছড়িয়ে আছে। দীবা বারান্দায় অনেকক্ষণ কাটালো। রিমি ও নুরার ডাকে বারান্দা ছেড়ে রুম থেকে বেরুলো। প্রথম দিনের মতো নাস্তার টেবিলে না যাবার জন্য শত বাহানা দেখালো না আজ। একই বাড়িতে থেকে কতোদিনই বা লুকিয়ে থাকবে সে? তকদিরে যা ছিলো তাই হয়েছে। এবারো তকদিরে যা লিখা আছে, তাই ঘটবে। তাই কোনো প্রকার ঝামেলা না করে চুপচাপ নাস্তার টেবিলে আসলো। এক পাশে চেয়ার টেনে বসে পরলো দীবা। ঠিকঠাক ভাবে বসে সামনে তাকাতেই আবরারের চোখে চোখ পরলো তার। আশ্চর্য হলো দীবা। লোকটা কি সারাদিন তারই দিকে তাকিয়ে থাকে নাকি? আজিব! চোখ ফিরিয়ে নিলো দীবা। কিছুটা বিব্রতবোধ করলো সে। কিন্তু চোখ ফিরালো না আবরার। কফির কাপে ছোট ছোট চুমুক বসাচ্ছে আর দীবাকে প্রখর করছে। দিন দিন মেয়েটা সুন্দরী হচ্ছে। দেখতে এতো কিউট লাগে! চোখ ফিরানো কষ্টকর হয়ে যায়। আবরারের এবার আফসোস হচ্ছে! ভীষণ ভাবে আফসোস হচ্ছে। কেন সে বিয়ের দিন রাতেই চলে গেলো? কেন আরো আগেই বাড়িতে আসলো না। যদি আগে আসতো তাহলে দীবাকে আরো আগে থেকেই দেখার সুযোগ পেতো।

রিমি নুরার হাতে নিজের কনুই দিয়ে ধাক্কা দিলো। নুরা তার দিকে তাকাতেই ইশারায় আবরারের দিকে তাকাতে বললো। নুরা রিমির ইশারা অনুসরণ করে আবরারের দিকে তাকাতেই ঠোঁট টিপে হাসলো। তারপর রিমির দিকে একটু ঝুকে ফিশফিশ করে বললো, ‘জমে একদম ক্ষীর বোইন।’

রিমিও ফিশফিশ করে বললো, ‘আজকে আমরা আগে চলে যাই। দীবা ভাইয়ার সাথে আসবে। তাহলে তারা একা আলাদা সময় পাবে। এতে ওদের সম্পর্ক যদি আরেকটু মিষ্টি হয়। কি বলিস?’

নুরা মাথা দুলালো। তারপর স্যান্ডউইচে বড়বড় কয়েকটা কামড় দিয়ে শেষ করে পানি খেয়ে নিলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমার শেষ।’

বলেই টেবিল ছেড়ে চলে গেলো। নুরা যাবার কিছু সময় পর রিমিও উঠে গেলো। দীবা ব্যাপারটা নরমালি নিলো। ভেবেছে হয়তো খাওয়া শেষ তাই। কিন্তু তাকে ফেলে চলে যাওয়ার জন্য যে তারা দুইজন প্ল্যান করেছে তা একটুও ভাবেনি!

চলমান…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here