আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ #মাইশাতুল_মিহির [পর্ব – ১৯]

0
1764

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব – ১৯]

রুমের এসে দরজা লাগিয়ে বিছানায় বসলো দীবা। এতোক্ষণ আবরারকে তরতর করে এতোগুলো কথা শুনিয়ে দিলেও এখন তার মন বিষণ্ণবদন। ভয় লাগছে তার। মুখের উপর কথা গুলো বলা একদম উচিত হয়নি। বিছানার হেডসাইডে পিঠ ঠেকিয়ে বসলো দীবা। চোখের পাতা ভিজে এলো আপনা আপনি। মনে পরলো সেই দিনের কথা! কান্না পেলো প্রচুর। নাক টেনে শুকনো ঢোক গিললো সে। দুই হাঁটু উঁচু করে তাতে মাথা রেখে কেঁদে ফেললো।
~
তিন মাস আগে। দিনটি ছিলো বৃহঃস্পতিবার! যেদিন আবরার ঠিক বারো বছর পর শান্তি নিবাস এসেছিলো। ঈদের আনন্দ নেমে এসেছিলো পরিবারে। এতো বছর পর বাড়ির বড়ো ছেলে বাড়ি ফিরেছে। তৃতীয় ঈদের আমেজ যেন শান্তি নিবাসের পরিবারের প্রতিটি মানুষের মনে। আবরারের সাথে এসেছিলো তারই এসিস্ট্যান্ট অভ্র হাসান। আবরার আসার পর ড্রয়িংরুমে সবাই যখন খুশিতে আত্মহারা ; তখন এক পাশে দাঁড়িয়ে নিরবে সব দেখছিলো দীবা। তখন দীবা ও তার মা রোহানা এই পরিবারে এসেছে প্রায় নয় মাস হবে। আবরার সাধারন ভাবে শুধু একবার তাকিয়ে ছিলো দীবার দিকে। এতোদিন পর পরিবারকে কাছে পেয়ে মেয়েটি কে এই প্রশ্ন মাথায় আসেনি।

পরেরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে রোশান জানায় তার খালা অসুস্থ। তিনি রোশান, হোসেন এবং তাদের ছেলেমেয়ে কে দেখতে চাইছে। বৃদ্ধ মানুষ! কখন কি ঘটে যাবে তা বলা মুশকিল। তাই রোশান নাস্তার টেবিলে সবাইকে জানালো যে দুপুরেই তারা বেড়িয়ে পরবে গ্রামের উদ্দেশ্যে। আবরারের প্রথমে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু তার ছোট নানু তাকে অনেক আদর করেছে। নানু বাড়িতে অনেকবার থেকেছে সে। কিছুটা টান রয়েছে তাদের প্রতি। তাই এক কথায় রাজি হয়ে গেলো। দুপুর হলো। সবাই তৈরি হতে হতে প্রায় বিকেল ঘনিয়ে এলো। অতঃপর এক রাতের জন্য গ্রামে যাবার জন্য বের হলো!

চকরিয়া বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। আগ্রাবাদ থেকে চকরিয়া উপজেলার দূরত্ব প্রায় ১০২.১ কিলোমিটার। গাড়ি করে গেলে সর্বমোট তিন ঘন্টা সাত মিনিট সময় লাগবে। চট্টগ্রাম শহরে এতোটা রাস্তা যেতে কেউ কখনো অনুরাগশূন্য হবে না।গাড়িতে বসে প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখার মাঝেও রয়েছে অদ্ভুত রকমের প্রশান্তি। এই প্রশান্তি কেবল প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য উপভোগ্য। অবশেষে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে চকরিয়া উপজেলার আওতাধীন লক্ষ্যারচর ইউনিয়ন পরিষদে রোশানদের গাড়ি ঢুকে। যেহেতু পরিবার বৃহৎ ; সেহেতু একটা গাড়ি যথেষ্ট ছিলো না তাদের। মোট তিনটে গাড়ি দরকার পরেছে। এতোক্ষণ পিচ ঢালা রাস্তা পার করে গাড়ি নামলো মাটির তৈরিকৃত কাঁচা রাস্তায়। আষাঢ় মাস হওয়ায় প্রতিটা অঞ্চলেই তুমুল রুপে বর্ষণ হয়েছে। যার ধরণ মাটির রাস্তা বৃষ্টির পানিতে একদম কর্দমাক্ত! রোশানের খালার বাড়ি লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের একদম ভিতরে। চিপা রাস্তায় গাড়ি যাওয়া দুষ্কর হয়ে পরেছে। তবুও যতোটুকু সম্ভব গাড়ি এগিয়ে নিয়েছে ড্রাইভার। অবশেষে সামনের দিকে আর অগ্রসর হতে না পেরে ব্যর্থ হলেন তিনি। রাস্তার এক পাশে গাড়ি পার্ক করলো। হতাশ হলো সবাই। না জানি এই কাদাযুক্ত মাটিতে কতক্ষণ পায়ে হাঁটতে হবে। রোশান কল দিয়ে তার খালাতো ভাইকে জানিয়ে দিলে তারা এসে এগিয়ে নিয়ে গেলো সবাইকে। ভাগ্যক্রমে মিনিট পাঁচেক পরেই কাঙ্ক্ষিত বাড়িতে এসে পৌঁছেছে তারা।

জেনারেশন বদলেছে। বদলেছে পরিবেশ। রোশান ছোটবেলায় যাদের দেখেছে তাদের মাঝে কেউ এখানে নেই। তারা যার যার ব্যস্ত জীবনের কারণে শহরমুখী হয়েছে কিংবা কেউ দেশের বাহিরে অবস্থান করছে। পরিচিত শুধু খালাতো ভাই ও তার পরিবারসহ পেয়েছে রোশান। এতো বছর পর এসে সব কিছুই বড্ড অপরিচিত লাগছে তার। এসেই প্রথমে খালার ঘরে গিয়েছে রোশান। নিজের আপন খালাকে মৃত্যুশয্যায় শয়ন অবস্থায় দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারে নি। এগিয়ে এসে খালার হাত ধরে কেঁদে ফেললো রোশান!
.
আবরার জুহায়ের কে চিনে না এমন কোনো মানুষ নেই। যেহেতু সে বাংলাদেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ; সেহেতু তাকে প্রতিটা অঞ্চলের মানুষজন চিনে। তাই তার আপ্যায়ন একটু আলাদা ভাবে হলো। গ্রামের বাড়ি! এখানে শহরের মতো এতো বিলাসিতা না থাকলেও যথেষ্ট আড়াম দায়ক পরিবেশ রয়েছে। কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তৈরিকৃত বাড়িটি দুই তলা। উপরের তলায় রয়েছে দুইটা রুম। একটাতে আবরার, অভ্র, সাবিত ও আরিয়ান। অপর রুমে দীবা, রিমি, নুরা ও রাইমা। নিচের তিনটা রুম। সেখানে থাকবে রোশান ও হোসেন! উঠানের অপর পাশে দুইটা টিনের ঘর। সেখানে রোশানের খালা ও খালাতো ভাই জাবেদ। এভাবেই থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

পরদিন সকালে রোশানের খালার শ্বাসকষ্ট উঠলো। অবস্থা খুবই বেগতিক! চারপাশে শোরগোল পাকিয়ে গেলো। গ্রামের মানুষ একে একে আসতে লাগলো মৃত্যুশয্যায় শায়িত বৃদ্ধাকে দেখতে। পুরো বাড়ি মানুষে পরিপূর্ণ! দুতলার ঘরে মেয়েরা বসে আছে। দীবা জানালার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গ্রামের দৃশ্যপট দেখছে। হঠাৎ-ই বাড়ির পিছনে নজর গেলো তার। ঝোপঝাড়ের মাঝে ছোট একটা সাদা বিড়ালের বাচ্চা! মায়া হলো দীবার। রাইমাকে বলে দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ির পিছনের দিকে আসলো। এখানটায় মানুষদের যাতায়াত খুব কম। তাই গাছগাছালি তে জঙ্গল হয়ে আছে। এক পাশে ছোট একটা ভাঙ্গা কুঁড়েঘর দেখলো দীবা। বিড়ালটার দিকে এগিয়ে গেলে বিড়ালটা দূরে সরে গেলো। দীবা আবারো বিড়াল ধরার প্রয়াস করলো। এক পর্যায়ে বিড়ালটা ভাঙ্গা ঘরটায় ঢুকে গেলো। হাসলো দীবা। কারণ ঘর থেকে খুব সহজেই বিড়ালটা ধরতে পারবে। চুপিসারে পিটপিট পায়ে ঘরের ভিতরে ঢুকলো সে। এক পাশে বিড়ালটা দেখলো। সেদিকে এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে কারোর উপস্থিতি টের পেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু ফিরে তাকাতেই আবরাকে দেখে হকচকিয়ে গেলো দীবা। আবরার এখানে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিলো। বাড়িতে এতো এতো মানুষের মাঝে আবরারের অস্বস্তি লাগছিলো। তাই বাড়ির পিছনে এই ঘরটার মাঝে দাঁড়িয়ে সময় অতিবাহিত করছিলো সে। তখুনি দীবা সেখানে আসে। আবরার তাকে দেখে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। দীবা অপ্রস্তুত হয়ে কোনো রকমে, ‘স্যরি!’ বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসলো। বিড়াল জাহান্নামে যাক! এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে আগে কখনো পরেনি দীবা। ঘর থেকে বেড়িয়েই দ্রুত পা চালিয়ে দুতলায় চলে গেলো। দীবা যাবার কিছুসময় পর আবরার কুঁড়েঘর থেকে বেড়িয়ে উপরে চলে আসলো।
.
দুপুরে আবরারকে বসার ঘরে জরুরি তলবে ডেকেছে রোশান। আবরার সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখলো গ্রামের বেশ কয়েকজন বৃদ্ধ, অর্ধবয়স্ক লোক সেখানে উপস্থিত। রোশানের মুখখানি গম্ভীর। আবরার সেখানে হাজির হওয়ার কিছুক্ষণ পর রোশান গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করে বসলো, ‘দীবার সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক?’

এমন উদ্ভট প্রশ্ন শুনে কপাল কুঁচকালো আবরার। প্রশ্নটা বুঝতে না পারে পালটা প্রশ্ন করলো, ‘দীবা কে? আর কোন সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছে?’

আবরারের কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো উপস্থিত সকলে। একজন বৃদ্ধা কর্কষ কন্ঠে বলেই উঠলো, ‘এহন কিল্লাই ফুস গইত্যে লাইগ্যু দিবা হন? এহালা গরত ফষ্টিনষ্টি গরিবার আগে মনত ন’আছিল মাইয়্যে ইবে হন?’ (এখন জিজ্ঞেস করছো দীবা কে? একা ঘরে ফষ্টিনষ্টি করার আগে মনে ছিলো না কে এই মেয়ে?)

আবরার ভ্রুঁ কিঞ্চিৎ বাঁকা করে লোকটার দিকে তাকালো। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। দাঁতে দাঁত লাগিয়ে কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, ‘হুয়াট ডু ইউ মিন বাই ফষ্টিনষ্টি? ঠিক কি বলতে চাইছেন সরাসরি বলুন।’

আরেকজন লোক রুক্ষতার সাথে বলল, ‘সেলিব্রেটি অক্কল বেয়াগিনর একি অবস্থা ৷ সাম্যে গব সাজি বিতুরে বিতুরে হাছারামি গরে ৷’ (সেলেব্রিটিদের এই একই অবস্থা। মিডিয়ার সামনে ভালো সেজে গোপনে গোপনে নোংরামি করে।)

চোয়াল দ্বিগুণ শক্ত হয়ে এলো আবরারের। লোকটার দিকে আঙ্গুল তুলে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘মুখ সামলে কথা বলবেন। নয়তো আপনি আমার বড় সেটা ভুলে যাবো।’

তারপর হোসেনের দিকে তাকিয়ে রাগি গলায় বলল, ‘কি হয়েছে বলবে প্লিজ?’

হোসেন আবরারের দিকে চোখ তুলে তাকালো। চিন্তিত তার চেহারা! বিবর্ণ মুখশ্রী! হোসেন কিছু বলার আগেই গ্রাম প্রধান পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক অর্ধবয়স্ক লোকের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো, ‘তুমি ঠিক দেখেছো তো?’

লোকটা দৃঢ়তার সাথে অশুদ্ধ ভাষায় উত্তর দিলো, ‘জি মালিক। আমি ঠিক দেখছি। এই পোলা আর ওই মাইয়া বাড়ির পিছনের ভাঙ্গা ঘর থেইক্কা বাইর হইছে। আগে মাইয়া ডা বাইর হইছে। এর পরে পোলাডা।’

লোকটার এমন কথা শুনে প্রকাণ্ড রকমের বিস্মিত হলো আবরার। ঘটনার মূল কেন্দ্রবিন্দু বুঝে আসলো তার। সকালের দিকে সে বাড়ির পিছনের কুঁড়েঘরে দাঁড়িয়ে সময় কাটাচ্ছিলো। তখুনি একটা মেয়ে সেখানে চলে আসে। আবার দেরি না করে মুহূর্তেই মেয়েটি বেড়িয়ে গিয়েছিলো। মেয়েটির পরেই আবরার বের হয়েছে। তখুনি বোধহয় এই লোক দেখেছিলো তাদের। আর এমন কুৎসিত কাহিনী রটিয়েছে! রাগে শরির মৃদু কেঁপে উঠলো আবরারের। চোখমুখ শক্ত করে কন্ঠস্বরে ক্রোধ প্রকাশ করে বললো, ‘না জেনে, না দেখে অনুমানে কোনো কথা বলবেন না। আপনাদের মাইন্ড এমন কুৎসিত জানা ছিলো না! ওই মেয়েকে আমি চিনি-ই না।…’

অতঃপর শুরু হলো তর্কাতর্কি। আবরার নিজের সবটা দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বসার ঘরে উপস্থিত লোকজন বুঝতে চাইছে না। গ্রামপ্রধান তার সিদ্ধান্ত জানালো অবৈধ সম্পর্ক থেকে বৈধ সম্পর্কে আবদ্ধ করতে! তাদের এমন সিদ্ধান্ত শুনে রাগান্বিত হলো আবরার। ক্ষেপে উঠলো সে। পরিস্থিতি হাতের নাগালের বাইরে। তখন রোশানও জানালো এই সিদ্ধান্তে সে রাজি। বাবার উপরে থাকা পূর্বের ক্ষোভ আবারো গভীর হলো আবরারের মনে।

চলমান..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here