ভালোবাসি তোকে ❤পর্ব- ১৭
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
উনি একটা একটা করে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে এগিয়ে আসছেন। আমারতো গলা শুকিয়ে পুরো কাঠ হয়ে আছে। আমার জানা মতে আমি তো এখন কিছুই করিনি। তাহলে? রেগে আছেন কেন? এসব ভাবতে ভাবতেই ওনার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি শার্টের লাস্ট বোতাম টা খুলছেন। আমি কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলাম না, কথাগুলো সব গলাতেই আটকে যাচ্ছে আমার। উনি শার্ট টা খুলে সোফার ওপর ছুড়ে মারলেন। থ্যাংকফুলি নিচে চিকন স্লিভস এর হোয়াইট গেঞ্জি পরে আছেন। উনি আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে টেনে বেড থেকে নামালেন। তারপর দুই বাহু ধরে নিজের কাছে এনে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
— ” ফোন কোথায় তোমার?”
আমি একটু অবাক হয়ে তাকালাম ওনার দিকে। উনি এবার জোরেই বললেন,
— ” হোয়ার ইজ ইউর ফোন?”
আমি চমকে গেলাম। তাড়াতাড়ি ফোনটা নিয়ে ওনার দিকে এগিয়ে দিলাম। উনি ফোনটা চেক করে বললেন,
— ” ফ্লাইটে করে কোথা থেকে এসছো? ইউ কে? ইউএসএ? নাকি ইন্ডিয়া? বলো?”
আমি ওনার কথার কোনো আগামাথা খুজে পাচ্ছিনা। তাই ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললাম.
— ” ম্ মানে?”
উনি ফোনের স্ক্রিনটা সামনে ধরে বললেন,
— ” মানে ফোনটা যখন ফ্লাইট মুডে দেওয়া নিশ্চয়ই কোনো জায়গা থেকে ফ্লাইটেই এসছো? বলো?”
আমি আবার মাথা নিচু করে ফেললাম। ফোনটা ফ্লাইট মুডে কখন গেলো সেটাই তো বুঝতে পারছি না। এতোক্ষণ গেমস খেলছিলাম আমি খেয়াল ও করিনি এসব। নিশ্চয়ই উনি কল করেছিলেন। এসব ভাবতে ভাবতেই উনি বললেন,
— ” তোমাকে কী বলেছিলাম আমি?”
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। উনি বাহু চেপে ধরে রাগে কটমট করে বললেন,
— ” স্পিক আপ? কী বলেছিলাম আমি? একা বেড়োতে নিষেধ করেছিলাম না?বলেছিলাম না হয় আমি পিক করব নয়তো গার্ড পাঠিয়ে দেবো? বলেছিলাম?”
এবার বুঝলাম ওনার রেগে যাওয়ার আসল কারণ। শিট! আমার তো মাথাতেই ছিল না। ঐ কূপ না রূপ এর জন্যেই তো ওখান থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে গেলাম। কিন্তু আমার তো মনেই ছিলোনা ওনার কথা। আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি ধমকে বললেন,
— ” কী হলো বলো বলেছিলাম?”
হালকা কেঁপে উঠলাম আমি। কাঁপাকাঁপা কন্ঠেই বললাম,
— ” জ্বী বলেছিলেন।”
— ” তাহলে আমাকে কিছু না বলেই একা একা বেড়িয়ে এলে কোন সাহসে? বলো!”
আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পাই উঁচু আওয়াজে কেউ কথা বললে। কেউ আমাকে ধমকালে আমার ভয়ে হাতপা কাঁপতে থাকে। একটা ফোবিয়ার মতো হয়ে গেছে এটা। আর উনি যেভাবে ধমকাচ্ছেন তাতে আমার অবস্থা করুণ হয়ে যাচ্ছে। আমি কাঁদোকাঁদো গলায় বললাম,
— ” ব্ বেড়িয়ে আপনাকে দেখতে পাইনি তাই।”
— ” তাই ড্যাং ড্যাং করে চলে এলে? ওয়াও, অসাধারণ।”
আমি ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে রেখেছি। এভাবে বকছেন কেনো আমায়? মানছি যে না বলে চলে এসছি। তাই বলে এভাবে বকাবকি করবে? খুব বেশি দূর তো না। আর আমি তো বাচ্চাও না যে এটুকু রাস্তা নিজে আসতে পারবোনা। উনি আমাকে ঝাকিয়ে বললেন,
— ” এখন চুপ হয়ে আছো কেনো বলো? নিজের খেয়াল খুশি মতো চলার ইচ্ছে হয়েছে তাইনা? ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া আমার কতোটা টেনশন হচ্ছিলো। খুব মজা পাও অন্যকে টেনশনে ফেলে?”
আমি এতোক্ষণ ভয়ে মাথা নিচু করে রাখলেও এবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে। উনি আমাকে ছেড়ে চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিয়ে নিজের চুলগুলো হাত দিয়ে উল্টে ধরলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— ” জানো কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম? কারণ আমি জাস্ট দশ মিনিট লেট করেছি। তোমার যে এইটুকু লেট সহ্য হবেনা কে জানতো? তোমাকে এইজন্য আগেই ফোন করেছিলাম যে একটু ওয়েট করো আমার মিনিট দশ লেট হবে। কিন্তু তোমার ফোন তো লাগছিলোই না। লাগবে কীকরে? ওটাতো তখন উড়ছিল তাইনা? স্টুপিড কোথাকার।”
আমি মাথা নিচু করে মুখ ফুলিয়ে হাত কচলে যাচ্ছি। উনি আবারও বললেন,
— ” যখন গিয়ে দেখলাম তুমি নেই তখন তোমার নম্বরে কল করেও পেলাম না। বাড়ির নম্বরে কল করবো তখনই শুনলাম সামনে একটা রিকশা আর গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়েছে। কোচিং এরই একজন মেয়ে স্টুডেন্ট। তখন আমার অবস্থা কী হয়েছিল জানো? ছুটে গিয়েছিলাম ওখানে। কিন্তু থ্যাংকফুলি ওটা তুমি ছিলে না। এরপর বাড়িতে ফোন করে জানলাম ম্যাডাম বাড়িতেই আছেন। বাড়িতে এসছো সেটা অন্তত আমায় জানাতে পারতে? মিনিমাম কমনসেন্স তো থাকে মানুষের তাইনা?”
আমার এবার একটু খারাপ লাগল আসলেই অন্তত জানানোটা উচিত ছিলো আমার। উনি জোরে একটা শ্বাস ফেলে বললেন,
— ” কী এমন তাড়া ছিলো শুনি?”
আমি একবার ওনার দিকে তাকিয়ে আবার মাথাটা নিচু করে বললাম,
— ” আসলে কালকের ঐ আঙ্কেল ছেলে এসে কথা বলছিল আমার ভালো লাগছিল না তাই…”
এটুকু বলে থেমে গেলাম। উনি এবার হাত ধরে নিজের একটু কাছে এনে বললেন,
— ” আজকের পর যদি আমার পার্মিশন ছাড়া কোথাও বেড়িয়েছো তাহলে যেটা করতে চাইনা সেটাই করতে বাধ্য হবো। বাড়িতে টিউটর রেখে কোচিং যাওয়াটাই বন্ধ করে দেবো। আর বাড়ি থেকে বেড়োনোটাও। ঘরবন্দি হয়ে থাকতে না চাইলে নেক্সট টাইম থেকে কেয়ারফুল থাকবে।”
এটুকু বলে আমার হাত ঝাড়া দিয়ে ছেড়ে উনি হনহনে পায়ে বেড়িয়ে চলে গেলেন। রোজ আমাকে বাড়ি পৌছে দিয়ে তবেই ওনার কাজে যায়। এখন হয়তো ওখানেই যাচ্ছেন। আমিও কিছু না বলে মুখ ফুলিয়ে একটা বই নিয়ে বেডে বসে পরলাম। ভীষণ রেগে আছে আমার ওপর। থাক গে তাতে আমার কী? কিন্তু খুব বেশিই রেগে আছে কী? কিছুই তো বুঝতে পারছিনা। ধ্যাত। এইটুকু মাথায় এতো প্রেশার আর ভালো লাগে না।
__________________
দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেড়ে একেবারে আপির রুমে চলে গেলাম। আপি বেডে হেলান দিয়ে বসে বসে ফোন স্ক্রল করছে। আমি আপির পাশে বসে আপিকে জরিয়ে ধরে কাধে মাথা দিয়ে রইলাম। আপি ফোনটা রেখে আমার হাতের ওপর হাত রেখে বলল,
— ” কী ব্যাপার মন খারাপ?”
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। আপি আড়চোখে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
— ” কেনো কী হয়েছে?”
আমি ঠোঁট ফুলিয়ে অভিযোগের সুরে বললাম,
— ” তোমার দেবর বকেছে আমায়।”
— ” বকার মতো কাজ করলে তো বকবেই।”
আমি আপিকে ছেড়ে দিয়ে কোমরে হাত দিয়ে বললাম,
— ” তুমি ওনার পক্ষ নিচ্ছো? আচ্ছা আমি কী বাচ্চা বলো যে এইটুকু পথ ও আমাকে রোজ রোজ ধরে ধরে নিয়ে যেতে হবে?”
আপি আমার দিকে একটু তাকিয়ে থেকে আমার হাত ধরে নিজের কোলে শুইয়ে দিয়ে চুলে বিলি কাটতে লাগল আমিও চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আমার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল,
— ” একটা জিনিস কী জানিস ? আমাদের সমাজে এমন অনেক স্বামী আছে যারা নিজের স্ত্রীর দিকে ঠিক করে তাকায়ও না। অনেকেই আছে স্ত্রী খেলো কী খেলোনা, কী হলো না হলো এসব নিয়ে মাথাই ঘামায় না। তাদের শুধুমাত্র রাতের বেলাতেই নিজের স্ত্রীকে প্রয়োজন পরে। কঠিন হলেও এটাই সত্যি। কিন্তু সেদিক দিয়ে আমাদের হাজবেন্টরা তো কতো আলাদা তাইনা? যারা আমাদের কতো কেয়ার করে। আর আদ্রিয়ান তো তোকে চোখে হারায়। কী খেলি, কতটুকু ঘুমালি, এমনকি এইটুকু পথও একা ছাড়েনা। তোর তো নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করা উচিত তাইনা?”
আমি চোখ বন্ধ করে রেখেই বললাম,
— ” হ্যাঁ বাট ডোন্ট ইউ থিংক কী উনি একটু বাড়াবাড়ি করেন। কিছু ক্ষেত্রে?”
আপি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
— ” ওনেস্টলি বললে হ্যাঁ। তোকে নিয়ে একটু বেশিই প্রটেক্টিভ ও। মানে যেমন কোনো বাচ্চাকে কেউ একা ছাড়তে চায়না হারিয়ে যাবে বা কেউ নিয়ে যাবে সেই ভয়ে ঠিক সেইরকম ভাবেই ও তোকে চোখে চোখে রাখে। কিন্তু তোকে নিয়ে এতোটা ইনসিকিউর ফিল করার কারণ কী? আচ্ছা ওকে কী তুই বলেছিস ওসব?”
আমি এবার চোখ খুলে আপির দিকে ঘুরে না বোধক মাথা নাড়লাম। আপি চিন্তিত মুখ করে বলল,
— ” তাহলে সমস্যা কোথায়? আর তাছাড়াও অনেক দিন তো হয়ে গেছে। প্রথমে তো আমরাও তোকে চোখে চোখে রেখেছিলাম। কিন্তু এতোদিনেও যখন কিছু করেনি তারমানেতো..”
— ” আপি প্লিজ বাদ দাও না আ্ আমার ভালো লাগছেনা।”
আপি একটা শ্বাস ফেলে আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
— ” আচ্ছা। কিন্তু একটা জিনিস কিন্তু সত্যি আদ্রিয়ান কিন্তু তোকে খুব ভালোবাসে। এইজন্যেই এতো কেয়ার করে তোর।”
আমি একটা মলিন হাসি দিয়ে বললাম,
— ” ওগুলোতো সব উনি দায়িত্ববোধ থেকেই করেন আপি। উনি তো আমায় পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন উনি ওনার সব দায়িত্ব পালন করবেন কিন্তু আমি জেনো এরচেয়ে বেশি কিছু এক্সপেক্ট না করি।”
— ” আরে সেতো শুরুতে বলেছে। কিন্তু এখন আমি অন্যকিছু দেখতে পাচ্ছি ওর চোখে।”
আমি একটু হেসে বললাম,
— ” দূর। এমন কিছু হলে উনি নিশ্চয়ই বলতেন আমাকে।”
— ” দিনতো পরে আছে সুইটহার্ট। দেখ কবে হুট করে বলে দেয়।”
— ” তাহলেই হয়েছে।”
আপি আমার চোখ হাত দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে বলল,
— ” এবার চুপচাপ ঘুমা তো? বিকেল হয়ে এসছে। তোমার বর এসে যদি দেখে ঘুমাও নি আবার রেগে যাবে। আমাকে দায়িত্ব দিয়ে গেছে তোকে বিকেলে ঘুম পাড়ানোর।”
আমি চোখ বন্ধ করে হেসে দিলাম। আপিরও হাসির আওয়াজ পেলাম। কিন্তু আর কথা না বাড়িয়ে চোখ বন্ধ করেই রইলাম। কিন্তু মনের মধ্যে হাজারটা ভাবনা আসছে। সেদিন পার্টিতে যা দেখেছিলাম সবটাই কী আমার চোখের ভুল ছিলো? তাই হবে হয়তো নইলে এতগুলো দিন পরেই কেনো আসবে? আমারই দোষ ওসব মাথা থেকে ঝাড়তে পারছিনা। আর আদ্রিয়ান? আচ্ছা সত্যিই কী উনি যা করেন সব দায়িত্বের খাতিরে? নাকি ভালোবাসেন আমায়? কিন্তু সেটা কীকরে সম্ভব? ধ্যাত! উনি কেনো আমায় হঠাৎ আমায় ভালোবাসতে যাবেন? আমিই বরাবরের একটু বেশি বেশিই ভাবছি। এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে আপির কোলেই ঘুমিয়ে পরলাম।
#চলবে…