#নীল_আকাশের_পরী
#এম_আর_এ_আকিব
#পর্ব_১৬
শব্দসংখ্যা: ১১৮৪
নাশতা খাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেছে কিন্তু আকিবের এখনো স্বাভাবিক-ই লাগছে। আকিব অনেকটা নিশ্চিত হলো যে নাশতায় কোনো কিছু মিশানো ছিল না।
নিশি নাশতার ট্রে নিয়ে চলে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। এখনো ফেরার নাম নেই৷ আকিবের একা একা ভালো লাগছে না। তার বাইরে বেরুতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু একা একা বাইরে যেতে ভয়ও করছে। সে খলিলকে ডাকবে কি-না ভাবলো। খলিলকে ডাকলে খলিলের সাথে বাইরে ঘুরেবেড়ানো যেত। কিন্তু সে এই চিন্তা মাথা থেকে মুছে ফেললো। এই খলিল লোকটাকে তার কেন জানি ভালো লাগে না। পৃথিবীতে কিছু মানুষ রয়েছে যাদেরকে ভালো না লাগার পেছনে কোনো কারণ থাকে না৷ তারপরেও তাদের ভালো লাগে না৷ এই যেমন খলিলকে ভালো না লাগার কোনো কারণ আকিব খুঁজে পায় না। খলিল তো তার সাথে ভালো ব্যবহার-ই করছে৷ স্বপ্নে দেখা সামান্য একটা ঘটনার জন্য খলিলকে ঘৃণা করার কোনো মানে নেই।
কিছুক্ষণ পর নিশি ফিরে এলো। কিন্তু তার সাথে একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা এলেন। হয়তো এরা তার বাবা-মা। আকিব খুব ভালো করে তাদের দুজনকে দেখতে লাগলো। তাদের দুজনের পরনে রাজকীয় পোশাক। দেখলে যে কেউ বুঝে যাবে সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাদের বসবাস। নিশির বাবা দেখতে খুব-ই লম্বা। হয়তো ছয় ফুটের বেশি হবে। বাম গালে একটি বড়ো তিল রয়েছে। মুখে রয়েছে বড়ো গোঁফ৷ কিন্তু কোনো দাড়ি নেই। চেয়ারায় রয়েছে গম্ভীর ভাব৷ গায়ের রং ফর্সা। দেখলেই মনে হয় রাজা রাজা ভাব। আগেকার যুগের রাজাদের ছবি আকিব বইয়ে দেখেছিল। ঠিক তাদের মতোই চেহারা!
নিশির মা দেখতে একদম নিশির মতোই। শুধু বয়স হয়েছে বলে চেহারায় একটু বয়সের ছাপ। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে তিনি এ মহলের রানি৷
নিশি বলল, “আকিব, পরিচিত হও। এই হলো আমার আব্বু-আম্মু।”
তারপর তার বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এই হলো আকিব।”
আকিব দুজনকে সালাম জানালো। তারা সালামের জবাব দিলেন। নিশির আব্বু বললেন, “তা ভালো আছ তো? আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?”
আকিব মুচকি হেসে বলল, “জি না, কোনো অসুবিধা হয়নি। আর আমি ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন?”
নিশির আব্বু বললেন, “হ্যাঁ, আমরাও ভালো আছি।”
তারপর নিশির আব্বু দেওয়ালে রাখা একটি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, “আরে ৯টা বেজে গেছে যে! আমাকে একটা সভায় যেতে হবে। ওখান থেকে এসে সবাই একসাথে ভাত খাবো। তোমরা থাকো আমি গেলাম।”
কথাটি বলে আর একটুও অপেক্ষা করলেন না। দ্রুত ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। আকিব নিশির বাবার যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে রইলো।
নিশির আম্মু বললেন, “তোমার নামটা যেন কী?”
আকিব বলল, “জি, আমার নাম আকিব।”
নিশির আম্মু কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “কতো বড়ো হয়ে গেছ। বেঁচে থাকো বাবা। তোমাকে সেই ছোট্টকালে দেখেছিলাম। তখন তুমি কথাও বলতে পারতে না। আর আজ কতো বড়ো হয়ে গেছ!”
আকিব এ ঘটনাগুলোর কিছুই জানে না। তাই সে অদ্ভুতভাবে নিশির আম্মুর দিকে চেয়ে রইলো।
নিশির আম্মু বললেন, “নিশি কি তোমাকে কিছু বলেনি? তুমি যাদের কাছে থাকো তারা যে তোমার বাবা-মা নয়, এটি বলেনি?”
আকিব বলল, “হ্যাঁ, বলেছে তো।”
নিশির আম্মু বললেন, “আমি সেদিন তোমাকে নিয়ে আসিনি কারণ আমি চেয়েছিলাম তুমি কোনো মানুষের ঘরে লালিত-পালিত হও। এখানে এসে হয়তো তুমি বুঝতে পারছো যে পরীরা অনেক শ’ক্তিশালী। কিন্তু আসলে তা না। মানুষই সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। আমি যদি সেদিন তোমাকে নিয়ে আসতাম তাহলে তুমি পরীদের সকল বৈশিষ্ট্য পেয়ে যেতে। কিন্তু আমি তা চাইনি। আমি চেয়েছিলাম তুমি মানুষের ঘরেই থাকো। তাহলে তুমি তোমার মা-কে মুক্ত করতে পারবে।”
নিশির আম্মুর কথাগুলো আকিবের ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। তিনি কী বলছেন তা সে বুঝার চেষ্টা করছে কিন্তু বুঝতে পারছে না। কে তার মা? তার মা-কে মুক্ত করতে পারবে মানে কী? তার মা কি কোথাও ব’ন্ধি? কোথায় সেটা? কে ব’ন্ধি করলো? অসংখ্য প্রশ্ন তার মাথায় সৃষ্টি হচ্ছে৷ কিন্তু সে প্রশ্ন করার সাহস পাচ্ছে না। অন্তর্মুখী হওয়ার জন্য প্রথম পরিচয়ে কাউকে কোনো প্রশ্ন করতে পারে না। চুপচাপ শুধু শুনে-ই যায়।
নিশি তার মা’কে বলল, “আম্মু, এখন এসব বলছ কেন? আমি তাকে এখনো কিছু বলিনি৷ আমি চাই সে আগে সবকিছু স্বপ্নে দেখুক। তা না হলে সে আমাদের বিশ্বাস করতে পারবে না।”
নিশির আম্মু বললেন, “আরে বলে দিলে কী এমন হবে? ওর তো এসব জানা উচিত। তাই না?”
নিশি বলল, “হ্যাঁ, জানা উচিত। কিন্তু সে ভাবে আমি যা বলছি সব মিথ্যা বলছি। সে আমাদের বিশ্বাস করতে পারে না। তাই আমি চাচ্ছি সে আগে স্বপ্ন দেখুক তারপর আমরা সবকিছু বলবো।”
নিশির মা অবাক হয়ে বললেন, “তুমি আমাদের বিশ্বাস করো না বাবা? আমরা কী জন্য তোমার সাথে মিথ্যা বলবো? আমাদের এতে কী লাভ? আমরা চাইলে তো যে কাউকে এখানে ব’ন্ধি করে নিয়ে আসতে পারি। তোমাকে মিথ্যা কেন বলবো, বলো? আমাদের দেখে কি তোমার মি’থ্যুক মনে হয়?”
নিশির মায়ের এমন প্রশ্নে আকিব কী বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। তার নিজের-ই নিজের কাছে লজ্জা লাগছে সে যে তাদের বিশ্বাস করে না এ জন্য। কিন্তু সে হঠাৎ করে অচেনা কারো কথা বিশ্বাস করবেই বা কেন? তার মতো করে কেন নিশির আম্মু বুঝছেন না? আর সে যখন বলেছিল সে বিশ্বাস করে না তখন তো নিশির সাথে তার প্রথম পরিচয়। প্রথম পরিচয়ে কীভাবে বিশ্বাস করবে? এখন পরীস্থানে এসে তার অনেক কিছুই বিশ্বাস হয়েছে। এখন তাকে পুরো ঘটনা বললে সে বিশ্বাস করতো। কিন্তু এখন নিশির মা’কে কী বলবে তা ভাবতে লাগলো।
আকিবের কিছু বলতে হলো না। এর আগেই নিশি তার মা’কে জবাব দিতে দিলো। নিশি বলল, “তুমি বেশি কথা বলছ মা। সে বিশ্বাস না করাটা স্বাভাবিক। হুট করে আমাকে যদি কেউ বলে তুমি আমার মা না, তাহলে আমি কি সহজে বিশ্বাস করতে পারবো? নিশ্চয়ই না। ঠিক তেমনিভাবে সে-ও বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা স্বাভাবিক। এর জন্য তাকে ভুল বুঝবে না। আর আমরা যদি পুরো ঘটনা বলে দেই আর পরে যদি সে স্বপ্নে দেখে তাহলে সে ভাববে আমরা যা বলেছি তা তার মস্তিষ্কে রয়ে গেছে বলেই সে এমন স্বপ্ন দেখছে। তাই আমি চাই সে আগে স্বপ্ন দেখুক, তারপর সব ঘটনা খুলে বলবো।”
নিশির কথাগুলো আকিবের ভালো লাগলো। মেয়েটি খুব-ই গুছিয়ে কথা বলতে পারে। তার কথায় অনেকটা যুক্তিও আছে। অনেকটা ঐশীর মতো। ঐশীর কথা মনে পড়তেই মনটা একটু খা’রাপ হয়ে গেল। তার জীবনের প্রথম ভালো লাগা ঐশী। কিন্তু মাঝখান থেকে নিশি এসে কী থেকে কী হয়ে গেল। যদি নিশি নামের পরী তার জীবনে না আসতো তাহলে ঐশী-ই হতো তার জীবনের একমাত্র মেয়ে। কিন্তু তার ভাগ্যটাই মনে হয় এমন। না হয় যেদিন ঐশীর সাথে দেখা হলো সেদিন-ই কেন নিশির সাথে দেখা হলো?
নিশির আম্মু বললেন, “তা ঠিক বলেছিস। তবে সে তো তার মায়ের চেহারাই পেয়েছে৷ সে যখন স্বপ্নে তার মা’কে দেখবে তখন চেহারা দেখে চিনে যাবে যে ইনি তার মা।”
তারপর ছলছল চোখে বললেন, “কতদিন তোর মা’কে দেখি না! জানি না আর কখনো দেখতে পাবো কি-না।” কথাটি বলে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন।
নিশি বলল, “আরে মা, চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। এই তো আকিব এসেছে। ওর ১৮ বছর হতে আর বেশি দিন নেই। তারপর-ই তো সে সব জানতে পারবে। আমার বিশ্বাস সে একদিন আন্টিকে মুক্ত করে আনবে।”
নিশির মা কান্না করতে করতে বললেন, “তাই যেন হয় মা, তাই যেন হয়।”
আকিব তাকিয়ে দেখলো নিশির চোখেও জল।
আকিবের অনেকটা অবাক লাগছে এই ভেবে যে সবাই-ই তার মায়ের জন্য কান্না করছে কিন্তু সে করছে না। বিষয়টা অদ্ভুত না? আকিবের উচিত ছিল সবচেয়ে বেশি কান্না করা। কারণ যার জন্য কান্না করছে সবাই তিনি তার মা। মায়ের থেকে আপন তো আর কেউ নেই। কিন্তু তার চোখে পানি নেই। তার মা যে ব’ন্ধি এতে তার তেমন খা’রাপ লাগছে না। তবে খা’রাপ না লাগার কারণ হলো সে তার মা’কে চিনে না। আকিব ভাবলো সবাই তার মায়ের কথা বলছে কেন? তার বাবার কী খবর? তার বাবার কথা কেউ বলছে না কেন? তার বাবা কোথায়? তার মনে প্রশ্নটি উদয় হলেও সে চুপ করে রইলো।
চলবে…
[বি.দ্র. বেশি বেশি লাইক, কমেন্ট এবং শেয়ার করুন।]