#নীল_আকাশের_পরী
#এম_আর_এ_আকিব
#পর্ব_১৮
শব্দসংখ্যা: ১১৮২
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার সাথে একসাথে বসে নাশতা করলো। গত দুইদিন পরীস্থানের সুস্বাদু খাবার খেয়ে এখন এসব খাবার তার তেমন ভালো লাগছে না। কিন্তু ভালো না লাগলে তো খেতে হবে। ছোটবেলায় সে একটি কবিতা পড়েছিল। সেখানে একটি পঙক্তি ছিল এরকম,
“কাঁচা হোক তবু ভাই, নিজের বাসা,
নিজ হাতে গড়া মোর, কাঁচা ঘর খাসা।”
খাওয়ার সময় সায়রা জিজ্ঞেস করলো যে কেমন লাগল ট্যুরে গিয়ে? আকিব হাসিমুখেই বলল, “ভালো।” তারপর আরো কিছুক্ষণ আরো অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলো। আকিব সবকিছুই সংক্ষিপ্তভাবে উত্তর দিলো।
তারপর নাশতা শেষ করে সেকলেজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। মাত্র দুইদিন কলেজে যায়নি সে। অথচ মনে হচ্ছে অনেকদিন ধরে কলেজে যাচ্ছে না।
আকিব কলেজ পৌঁছেই ঐশীকে দেখলো। ঐশীও আকিবকে দেখে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু স্যার চলে আসায় আর তেমন কথা বলা হলো না।
ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর আকিব ও ঐশী ক্যান্টিনে বসে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলো। পরীস্থানে আকিব এ দুইদিন কী করলো, কী না করলো তা নিয়েই আলোচনা হলো। যদিও আকিবকে নিশি বলেছিল পরীস্থানের ঘটনা যেন কাউকে না বলে। কিন্তু তারপরেও সে ঐশীকে অনেক কিছু বলে দিয়েছে। ঐশীকে না বললে যেন তার ভালো লাগে না।
সময়গুলো এভাবেই যাচ্ছিলো। প্রতি রাতে-ই আকিব নিশির সাথে দেখা করতো। তারপর এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াতো। অনেক গল্প করতো। আবার দিন হলে ঐশীর সাথে দেখা হতো। এভাবেই সময় চলছিল। আকিব এতকিছু করলেও তার মনের মধ্যে একটি প্রশ্ন সবসময়-ই উঁকি দিতো৷ কে তার মা? কে তার বাবা? তার মা ব’ন্ধি কেন? সে অপেক্ষা করতো তার আঠারো বছর পূর্ণ হওয়ার জন্য। কারণ আঠারো বছর হলেই সে স্বপ্নের মাধ্যমে সবকিছু জানতে পারবে।
দেখতে দেখতে আকিবের আঠারো বছর হয়ে গেল। যেদিন রাতে আঠারো বছর হলো সেদিন রাতে সে খুব আনন্দের সাথেই নিশির সাথে দেখা করতে গেল। ভাবলো নিশি হয়তো তাকে অনেক তথ্য দেবে। কিন্তু নিশি সে রাতে তাকে কিছুই বলল না। শুধু বলল, “তুমি আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘুমাও। আজ রাতেই তুমি সবকিছু জানতে পারবে। আর নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত রেখো সবকিছুর সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য।
আকিব বলল, ” আচ্ছা।”
এ রাতে আর নিশির সাথে তেমন কথা হলো না। নিশিই তাকে দ্রুত বাড়ি গিয়ে ঘুমাতে বলল।
আকিব নিজের বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। তার মনে হাজারও জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি হচ্ছে। আদৌও কি সে আজ রাতে সবকিছু স্বপ্ন দেখবে? সত্যি কি সে সাধারণ কোনো মানুষ নয়?”
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়লো সে জানে না।
আকিব গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এরকম গভীর ঘুম ইতোপূর্বে সে কখনো ঘুমায়নি। সে গভীর ঘুমের মধ্যেই অনুভব করলো হঠাৎ তার দরজাটি খুলে গেল। সে ঘুমের মধ্যেই যেন দেখতে পেলো দরজা দিয়ে কে যেন প্রবেশ করছে। সে ঘুমে হলেও সবকিছু যেন দেখতে পাচ্ছে। সে দেখলো একজন মহিলা সাদা কাপর পরনে তার পাশে এসে বসেছেন। দেখতে অনেকটা তার মতোই মুখ। তিনি তার বালিশের পাশে এসে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আকিবের খুব-ই ভালো লাগছে। হঠাৎ সেই মহিলা বললেন, “বাবা আকিব, তুই আমাকে চিনিসনি? আমি তোর হতভাগিনী মা।” কথাটি বলে চোখের জল মুছতে লাগলেন। আকিব এবার চোখ মেলে তাকালো। সে ভালো করে তার মা-কে দেখতে লাগলো। একদম তার মতোই মুখ। কিন্তু পেছনে বড় দুটি ডানা রয়েছে। যা সাধারণত পরীদের থাকে। তাহলে কি তার মা পরী?
তার মা বললেন, “এভাবে কী দেখিস? আমি-ই তোর মা। আমি আজ তোকে সব ঘটনা খুলে বলব। আমাকে তোর উ’দ্ধার করতে হবে বাবা।”
আকিব যেন ঘুমিয়ে থেকেও জেগে। সে কথা বলতে পারছে। সে বলল, “বিস্তারিত বলো।”
তার মা বলল, “আগে একবার আমাকে ‘মা’ বলে ডাক।”
আকিব বলল, “মা।”
তার মা বললেন, “আরেকবার বল।”
আকিব বলল, “মা।”
তার মা তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কান্না করতে লাগলেন। সে-ও মা-কে জড়িয়ে ধরলো। মায়ের বুকে থেকে তার মনে হলো পৃথিবীতেই সে যেন স্বর্গ সুখ পাচ্ছে। বর্তমানে সে যাকে মা বলে জানে, তিনি কখনো তাকে এভাবে বুকে জড়িয়ে রাখেননি। আকিন যেন বুঝতে পারলো ইনি-ই তার মা।”
তারপর তার মা বলতে শুরু করলেন, “জানিস, আমি কোনো মানুষ না। একজন পরী। আমরা সময় পেলেই পৃথিবীতে বেড়াতে আসতাম। এভাবে নিয়মিত-ই আসতাম। হঠাৎ একদিন তোর বাবার সাথে দেখা হলো। তিনি প্রতিদিন রাতে বাগানে বসে থাকতেন। এভাবে তোর বাবাকে দেখতে দেখতে আমার তাকে ভালো লেগে যায়। তাই একদিন তার সামনে যাই। তারপর সে প্রথমে আমাকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। তারপর একসময় আমাদের ভালো করে কথা হয়। আমি তাকে ভালো লাগার বলা বলি। সে-ও রাজি হয়ে যায়। এরপর এভাবেই আমাদের ভালোবাসা চলতে থাকে। একসময় আমরা বিয়ের কথা বললে সে বলে যে আমি যদি মানুষের মতো বসবাস করতে পারি তাহলে সে আমাকে বিয়ে করবে না হয় করবে না। আমি তার প্রেমে এতো পা’গল ছিলাম যে তার সব কথা রাজি হয়ে যায়। তোর দাদা তখন বেঁচে নেই৷ শুধু দাদি বেঁচে ছিলেন। তবে তিনি তোর সৎ দাদি। তোর দাদা দুই বিয়ে করেছিলেন। তার আগের একজন সন্তান ছিল। যিনি তোর বড় চাচা। আমি তোর বাবাকে বিয়ে করে পরীস্থান ছেড়ে একেবারে এখানে চলে আসি। কিন্তু তোর চাচা এবং চাচি তোর বাবাকে তেমন পছন্দ করতো না। তারা নানাভাবে আমাদের ক্ষ’তি করার চেষ্টা করতো। কিন্তু তোর দাদির জন্য পেরে ওঠতো না। একসময় তোর দাদিও মা’রা যান। এরপর থেকেই তাদের অ’ত্যাচার আরো বেড়ে যায়। তারা নানাভাবে আমাকে নি’র্যাতন করতো। তোর বাবা অফিসে গেলে আমাকে অনেক অ’ত্যাচার করতো। আমি সব সহ্য করতাম কারণ এখানে আমার কেউ নেই। আমি যে পরীস্থান ছেড়ে একেবারে চলে এসেছি।
তোর জন্মের তিন মাস পরে তারা একদিন প্লান করে তোর বাবাকে হ*ত্য করার জন্য৷ কারণ তারা চাচ্ছিলো না এ সম্পত্তির অংশীদার যে৷ তোর বাবা হোন। তোর বাবা একদিন অফিস থেকে ফিরছিলেন। তোর চাচা একটি একটা ট্রাক ভাড়া করে তোর বাবাকে পি’ষে ফেলে। তারপর দুর্ঘট’না বলে চালিয়ে দেয়। তোর বাবাকে যে তারা মে’রেছে তা আমি প্রথমে জানতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম সত্যি হয়তো দু’র্ঘটনায় মা’রা গেছেন। তারা সবাই আমাকে দো’ষারোপ করছিল। বলছে আমাকে বিয়ে করার জন্যই না-কি এমন হয়েছে। তবে একদিন তারা দুজন মিলে গল্প করছিল কীভাবে তোর বাবাকে হ*ত্যা করেছিল। তাদের সাথে একজন রান্ত্রিকও বসে ছিল। আর আমি সব শুনে ফেলেছিলাম। এসব শুনে আমার হাত থরথর করে কাঁপছিল। তোর বড় চাচি আমাকে হঠাৎ দেখে ফেলেন আর বলেন যে ও তো সিব শুনে ফেলেছে। তোর চাচা বলেন সমস্যা নেই, ওকে ব’ন্ধি করার জন্য তান্ত্রিক নিয়ে এসেছি। সে এখন একে ব’ন্ধি করবে। তারপর সে তান্ত্রিক এসে আমাকে একটা বোতলে বন্ধি করে রাখে। আমি পালানোর অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারিনি। পরীর থেকে মানুষের শক্তি বেশি। তারপর আমাকে বোতলে ব’ন্ধি করে ঘরে রেখে দেয়।
এরপর তোর চাচি পরামর্শ দেয় তোকেও হ’ত্যা করার জন্য। তখন তোর চাচা তোকে নদীতে ফেলে দেওয়ার জন্য নিয়ে যায়। কিন্তু এই খবরটা আমার বোন মানে নিশির মা জেনে যায়। তারপর তিনি পরীস্থানের সবাইকে নিয়ে তোকে উদ্ধার করতে যান। পরীস্থানের সৈ’ন্যদের দেখে তোর চাচা ভয় পেয়ে যান। ভয় পেয়ে তোকে তার কাছে দিয়ে দেন। তারপর আমার বোন চায়নি তোকে পরীস্থানে বড় করতে। কারণ পরীস্থানে বড় করলে তুই পরীর সব বৈশিষ্ট্য পেয়ে যাবি৷ আর পরীদের চাইলেই তান্ত্রিকরা মন্ত্র পড়ে ব’ন্ধি করতে পারে। তাই আমার বোন চেয়েছে তুই মানুষ হয়ে যেন সবাইকে উদ্ধার করতে পারিস। তাই তোকে এই বাড়ির সামনে রেখে যায়। তখন তোর মা মানে যিনি তোর পালক মা তিনি তোকে পান। তার কোনো সন্তান ছিল না বলে তোকে সন্তান স্নেহে লালন-পালন করেন। অনেক লম্বা ঘটনা। আমি তোকে সংক্ষেপে বললাম। আমার সময় কম। আমাকে যেতে হবে। আমি আর কখনোই তোর সামনে আসতে পারবো না। আমি এখনো ওই ঘরে বোতলে ব’ন্ধি আছি। আর সবকিছু তুই নিশির কাছ থেকে জেনে নিস। আমার এখন-ই যেতে হবে। তুই ভালো থাকিস বাবা। আর পারলে আমায় উদ্ধার করিস।”
কথাগুলো বলে আকিবের কপালে একটি চুমু দিয়ে তার মা চলে গেলেন। আকিব কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুয়ে রইল।
চলবে…