#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৮||
৩৩.
আহনাফের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে অরুণিকা। আহনাফ এতোক্ষণ যতির সাথে ভিডিও কলে কথা বলছিলো। যতি হুটহাট আহনাফকে ভিডিও কল দেয়। কল না ধরলে বাসায় চলে আসে। তাই আহনাফ বাধ্য হয়েই যতির সাথে কথা বলে। যদিও যতি দেখতে সুন্দর আর আহনাফকেও ভালোবাসে, এখন তারা বন্ধুও হয়েছে, তবুও আহনাফ যতির ব্যাপারে কোনো আগ্রহ পাচ্ছে না। এদিকে অরুণিকার তাকানো দেখে আহনাফ চোখ ছোট করে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি দেখছো?”
অরুণিকা কোনো উত্তর দিলো না। আহনাফ নিজের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে যতির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অরুণিকাকে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
অরুণিকা এবার মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। বয়স কম হলেও সে ইদানিং অনেক কিছুই বুঝে। এবার আহনাফ ফোনটা পাশে রেখে অরুণিকাকে টেনে নিজের কাছে আনলো। অরুণিকা এবার আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ অরুণিকার কপালের চুলগুলো পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বলল,
“যার সাথে আমি কথা বলছিলাম ওর নাম যতি। বুঝেছ?”
অরুণিকা বলল, “যতি কে?”
“আমার বন্ধু।”
“জানো, আমারও বন্ধু আছে।”
“তাই নাকি! তোমার ক’টা বন্ধু হয়েছে?”
“অনেকগুলো। তপন আর তিরা আমার সাথে খেলে। তপন আমাকে চকোলেট দেয়।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“ও তোমাকে কেন চকোলেট দেয়?”
“আমি ওর বন্ধু তাই।”
“বাইরের কেউ কিছু দিলে খাবে না। আমরা তো তোমার জন্য চকোলেট নিয়ে আসি। এখন থেকে বাইরের কিছুই খাবে না। ঠিক আছে?”
অরুণিকা মাথা নেড়ে বলল, “আচ্ছা।”
এদিকে মাওশিয়াত সায়ন্তনীর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিন্তু সায়ন্তনী সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ইভানের পাশে বসে পড়া বুঝিয়ে নিচ্ছে। মাওশিয়াত সামনে এগুতেই দেখতে পেলো ইমন একা একা বসে ঝিমাচ্ছে। সে ইমনের সামনে এসে তার হাত ধরে তাকে টেনে ক্লাসের বাইরে নিয়ে গেলো। ইমন অবাক হয়ে মাওশিয়াতের দিকে তাকিয়ে রইলো। মাওশিয়াত ইমনকে নিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে মাঠের এক কোণায় এসে দাঁড়ালো। ইমন বলল,
“তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছো কেন?”
মাওশিয়াত বলল,
“ইমন, সায়ন্তনীর সাথে দেখছি অল্প দিনেই তোমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। সারাদিন ও তোমাদের আগেপিছে ঘুরতে থাকে।”
“হ্যাঁ, ও আমাদের নতুন বন্ধু।”
“কিন্তু তুমি ওর সম্পর্কে কতোটুকুই বা জানো?”
“যতোটুকু জেনেছি অনেক কম জেনেছি। এতেই যদি এতো ভালো বন্ধু হতে পারে, ভেবে দেখো, বেশি জানলে হয়তো প্রেমে পড়ে যাবো।”
ইমনের কথায় মাওশিয়াতের চোখে মুখে আতংক ভীড় করে উঠলো। মাওশিয়াত ইমনের হাত ধরে বলল,
“তুমি কি আমার চেয়ে বেশি সায়ন্তনীকে পছন্দ করো?”
ইমন মাওশিয়াতের চোখের দিকে তাকালো। এমনিতেই মাওশিয়াতকে সে পছন্দ করে। কিন্তু ভাই আর বন্ধুদের কথায় সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আপতত নিজের ভালো লাগাটা প্রকাশ করবে না। কিন্তু এখন মাওশিয়াতের এমন প্রশ্নে সে আবার দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইমনকে চুপ করে থাকতে দেখে মাওশিয়াত নিজের চুল টেনে ধরে, নিজের গালে নিজেই চড় মারলো। আর কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়লো আর বলতে লাগলো,
“হ্যাঁ, আমি তোমার সাথে বন্ধুত্ব করেছিলাম, ইভানের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য। ওর কাছ থেকে নোট নিয়ে ওর চেয়ে সুন্দর করে নোট তৈরি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন বুঝেছি বন্ধুত্ব আর পড়াশুনা দু’টো আলাদা বিষয়। কিন্তু আজ সব বুঝেও কোনো লাভ হচ্ছে না। কেউ আর আমার বন্ধু হতে চাই না।”
ইমন মাওশিয়াতের পাশে বসে তার দুই হাত ধরে বলল,
“আমি তোমার বন্ধু হবো, মাওশিয়াত। অনেক ভালো বন্ধু হবো।”
মাওশিয়াত অশ্রুভেজা চোখে ইমনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তাহলে সায়ন্তনী আমাদের বন্ধুত্বের মাঝখানে কেন এসেছে?”
“ও আমাদের বন্ধুত্বের মাঝখানে আসে নি। বরং ও ইভান, আরাফ, তূর্য, তাহমিদ আর আহনাফকে বলেছে সব ভুলে গিয়ে আমরা যাতে সবাই বন্ধু হয়েই থাকি। বাকিরা তাই তোমার সাথে সহজ হয়েছে। ওদিন তুমি যা করেছিলে, তা কারোই পছন্দ হয় নি। হ্যাঁ, তুমি ভুল করেছো। এটা এখন আমরা সবাই বুঝেছি, তুমিও বুঝেছো। আর এটা বোঝাতে সাহায্য করেছে সায়ন্তনী।”
মাওশিয়াত ইমনের উপর ক্ষীপ্ত হয়ে বলল,
“সায়ন্তনী, সায়ন্তনী, সায়ন্তনী। এই নাম ছাড়া আর কি কোনো নাম নেই? আমি সোজাসাপটা বলে দিচ্ছি, ওই মেয়েটাকে আমি বন্ধু মনে করি না। আর আমার বন্ধুরাও ওর বন্ধু হতে পারবে না।”
ইমন ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“মাওশিয়াত আমরা এখন বড় হচ্ছি। আর তুমি বাচ্চাদের মতো আবদার করছো!”
মাওশিয়াত অভিমানী কন্ঠে বলল,
“যাও কথা বলবো না তোমার সাথে। আমি কারো সাথেই কথা বলবো না।”
মাওশিয়াত হনহন করে ক্লাসে গিয়ে একা একা একপাশে বসে পড়লো। পুরো ক্লাস সে নিরবে চোখের জল ফেলেছে।
মাওশিয়াতের অভ্যাস তার ভালো লাগার কোনো জিনিস বা মানুষকে সে অন্য কারো সাথে ভাগ করে নিতে পারে না। মাওশিয়াতের পরিবার তার বাবা মিরাজ হাসান ও তার বাবার স্ত্রী, তিশা হাসানকে নিয়ে। মাওশিয়াতের জন্মের সময় তার মা মারা যায়। তার বাবা কয়েক মাস পর মাওশিয়াতের জন্য তিশাকে বিয়ে করেন। তিশা মিরাজের স্কুলের বান্ধবী ছিলেন। তিনি কখনোই মা হতে পারবেন না। আর তিনি মাওশিয়াতকে অনেক বেশিই ভালোবাসেন। বাবার চেয়ে বেশি সৎ মা-ই মাওশিয়াতকে বেশি ভালোবাসে। অতি ভালোবাসা পাওয়ায় সে অতিরিক্ত জেদি চরিত্রের হয়ে যায়। তার যখনই যা প্রয়োজন হয়, তখনই সেই ইচ্ছে পূর্ণ হয়ে যায়, তাই সে কারো কাছে হারতে পছন্দ করে না। যে-কোনো ব্যাপারেই তার জেদ থাকে, তা হোক বন্ধু তৈরি করা, বা কোনো বস্তুগত জিনিসের প্রতি। এর জন্য মাওশিয়াতের চেয়ে তার বাবা-মার অপরাধটাই বেশি। কারণ সন্তানরা যা চায়, তা সাথে সাথে তাদের দেওয়া উচিত নয়। মাঝে মাঝে না দেওয়ায় ভালো। তখনই তারা সব পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারবে।
কয়েক দিন পর সন্ধ্যায় অরুণিকা তার স্কুল ব্যাগটা মুখের সামনে ধরে আরাফের সামনে এসে দাঁড়ালো। আরাফ তখন পড়তে বসেছিলো। আরাফ মাথা বাঁকিয়ে ব্যাগের পেছনে অরুণিকাকে দেখতে যাবে তখনই অরুণিকা আবার ব্যাগটা সামনে এনে ধরলো। আরাফ অরুণিকার হাবভাব বুঝতে পারলো না। সে আবার পড়ায় মনোযোগ দিলো। তখনই অরুণিকা ব্যাগটা সরিয়ে আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ মুখে কলম পুরে অরুণিকার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। অরুণিকা মিষ্টি হাসি দিয়ে ব্যাগ থেকে একটা ড্রয়িং খাতা বের করে আরাফের সামনে রাখলো। আরাফ খাতাটা উল্টে দেখলো সে বৃত্ত আর ত্রিভুজে রং করেছে। আরাফ বলল,
“অনেক সুন্দর হয়েছে।”
অরুণিকা পাতা উল্টিয়ে বলল,
“দেখো আমি আজ অনেক ড্রয়িং করেছি।”
অরুণিকা আরাফের কোলে উঠে বসলো। আরাফ বলল,
“অরু, আমি এখন পড়বো। তুমি ওপাশে বসে ড্রয়িং করো।”
অরুণিকা কথা শুনলো না। সে আরাফের কোলে বসেই ড্রয়িং খাতায় আঁকা ছবির উপরই পেন্সিল চালাতে লাগলো। আরাফ তাকে কোলে নিয়ে পাশে বই খুলে বসে আছে। অরুণিকা একটু পরপর আরাফকে তার আঁকা ছবি দেখাচ্ছে। যার কারণে আরাফ পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছিলো না। বাকিরাও পড়তে বসেছিলো। তাই এই মুহূর্তে সবাই ব্যস্ত। দুইদিন পর তাদের দ্বাদশ শ্রেণির সাময়িক পরীক্ষা। আরাফ অরুণিকাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলল,
“অরু, আমার পড়তে হবে। তুমিও পড়ো। আমিও পড়ি।”
অরুণিকা ড্রয়িংখাতা নিয়ে আরাফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর তূর্যের কাছে গেলো। তূর্য গানে হেডফোন গুঁজে গান শুনে শুনে অংক করছে। অরুণিকা পাশে এসে বসতেই সে মুচকি হাসলো। অরুণিকা এবার তূর্যকে তার ড্রয়িং দেখালো। তূর্যও হাতের ইশারায় বুঝালো সুন্দর হয়েছে। তারপর নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। অরুণিকা অনেকবার তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে গেলো, কিন্তু তূর্য কোনো উত্তর দিলো না। কারণ সে গানের শব্দে কিছুই শুনে নি। এবার অরুণিকা তূর্যের মনোযোগ না পেয়ে তাহমিদের কাছে গেলো। তাহমিদও অরুণিকার দিকে তাকালো না। সে কানে হাত দিয়ে পড়ছে। এবার অরুণিকা ইমনের কাছে গেলো। ইমন কিছুক্ষণ অরুণিকার ড্রয়িং খাতা ঘাঁটলো, তারপর বলল,
“অরুণিকা, এবার আমি পড়ি। এখন যাও।”
অরুণিকা ইভানের দিকে কিছুক্ষণ তাকালো। সে ইভানের কাছে এমনিতেই যায় না। কারণ ইভান কোনো কারণ ছাড়াই তাকে বকাবকি করে। তাই অরুণিকা আহনাফের কাছে গেলো। আহনাফের মেজাজ এমনিতেই চটে আছে। অরুণিকা তার পাশে এসে মিষ্টি হেসে বলল,
“আহনাফ, আমার ড্রয়িং দেখবে? আমি এঁকেছি।”
আহনাফ শীতল কণ্ঠে বললো,
“না, আমি এখন ব্যস্ত আছি।”
অরুণিকা আবার বলল,
“দেখো না। একটু করে দেখো। টিচার আমাকে গুড দিয়েছে। দেখো।”
আহনাফ ড্রয়িং খাতাটা অরুণিকার হাত থেকে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারলো। ভয়ে অরুণিকার মুখ শুকিয়ে গেলো। আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এমনিতেই ওই যতির জ্বালায় আমার মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, এদিকে একটু শান্তিতে যে পড়বো সে উপায় নেই। এই মেয়ে এসেও বিরক্ত করছে। যাও এখান থেকে।”
আরাফ আর তাহমিদ অরুণিকার দিকে তাকালো। ইমন আবার বইয়ে মনোযোগ দিলো। ইভান তো তাকালোও না। তূর্য হেডফোন গুঁজেছিল, তাই কিছু শুনে নি। আরাফ চেয়ার ছেড়ে উঠে অরুণিকার ড্রয়িং খাতা তুলে আহনাফকে বলল,
“এভাবে বকছিস কেন ওকে?”
আহনাফ রাগী কন্ঠে বললো,
“তুই সামলা ওকে। আমার মেজাজ ঠিক নেই। আমার সাথে কথা বলিস না।”
আরাফ অরুণিকাকে একপাশে বসিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তারপর বলল,
“আমাদের পরীক্ষা। তুমি ড্রয়িং করো। আমরা পরে দেখবো।”
আরাফ আবার নিজের পড়ায় ডুবে গেলো। এদিকে অরুণিকা স্থির হয়ে বসে আছে। তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে সেই জল মুছে নিচ্ছে। কিন্তু বাঁধন হারা জল যেন আজ থামছেই না। বাবা-মা কাউকেই তার মনে পড়ছে না। সবার ছবি দেখলেই সে চেনে। কিন্তু অরুণিকা তাদের অনুভব করতে পারছে না। কারণ তার অনুভব সব ছ’জনকে ঘিরেই। তারা বকলেই সে কষ্ট পায়, তাদের কাছেই তার সব আবদার, তাদের দূরে যাওয়ায় তাকে বেশি আঘাত করে। তবে আঘাত, দূরে যাওয়া এসব অনুভূতি অরুণিকা বুঝে না। তার কাছে তিনটি শব্দই পরিচিত, আদর, অভিমান আর বকা। সে বকা খেয়েই অভিমান করে, আবার আদর করলে সব ভুলে যায়।
এদিকে অরুণিকার ফুঁপানোর শব্দ বাড়তে লাগলো। এবার সে মুখে হাত দিয়ে কাঁদছে। তূর্য ছাড়া বাকি পাঁচজন অরুণিকার দিকে তাকালো। আরাফ আর তাহমিদ দৌঁড়ে তার কাছে গেলো। আরাফ কাছে আসতেই অরুণিকা তার কাছ থেকে দূরত্ব রেখে পিছিয়ে গেলো। আহনাফ, ইমন আর ইভানও উঠে এলো। তূর্য সবাইকে উঠতে দেখে কান থেকে হেডফোন নামালো।
অরুণিকাকে কাঁদতে দেখে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তাহমিদ অরুণিকার দিকে হাত এগিয়ে দিতেই অরুণিকা এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিলো। আহনাফ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে অরুণিকাকে বলল,
“সরি অরু।”
অরুণিকা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আহনাফ অরুণিকার হাত ধরতেই সে আহনাফের হাতে খামচি দিয়ে বলল,
“আমি তোমার সাথে কখনো কথা বলবো না।”
কথাটি বলতে বলতেই অরুণিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তূর্য অরুণিকার কাছে এসে বলল,
“টুইংকেল, তুমি আর কান্না করো না। আমি এখন তোমার সব ড্রয়িং দেখবো।”
“না, আমি কাউকে আমার ড্রয়িং দেখাবো না। শুধু বাঁধনকে দেখবো। ও আমার সব ড্রয়িং দেখবে। তোমরা কেউ আমাকে ভালোবাসো না। বাঁধন আমাকে ভালোবাসে।”
ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এখানে বাঁধন কেন এলো?”
আহনাফ কান ধরে বলল,
“আমি কান ধরে ওঠবস করছি। তুমি দশ পর্যন্ত গুনতে থাকো।”
ইভান ছাড়া বাকিরাও কান ধরলো। অরুণিকা ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ও কান ধরে নি।”
ইভান চোখ ছোট করে তাকালো। আরাফ চোখের ইশারায় তাকে অরুণিকার কথা রাখতে বললো। সেও এবার কান ধরে ওঠবস করতে শুরু করলো। আর অরুণিকা গুনতে লাগল। শেষমেশ অরুণিকার মুখে হাসি ফুটলো। এবার ইভান অরুণিকার ড্রয়িং দেখতে বসলো। বাকিরা আবার পড়তে বসে গেলো।
তিনমাস পর,
আহনাফ ছাড়া বাসায় আজ কেউ নেই। অরুণিকা বাঁধনের সাথে খেলছে। আর তাদের পাশেই আহনাফ ঘুমোচ্ছে। বাঁধন হুট করে অরুণিকার কাছে এসে বলল,
“প্রেম প্রেম খেলবে?”
অরুণিকা বাঁধনের দিকে তাকালো। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“প্রেম প্রেম কিভাবে খেলে?”
বাঁধন অরুণিকার চোখ বেঁধে দিলো। তারপর অরুণিকাকে কিছুক্ষণ ঘুরালো। তারপর অরুণিকার কাছে এসে তার গালে চুম্বন করলো। অরুণিকা এসবের কিছুই বুঝলো না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। বাঁধন এবার অরুণিকার ঠোঁটের কাছে আসতে যাবে তখনই আহনাফের চিৎকারে দু’জনই কেঁপে উঠলো। আহনাফ বিছানা ছেড়ে উঠে এক চড় মেরে বাঁধনকে মেঝেতে ফেলে দিলো। এরপর অরুণিকার চোখ থেকে কাপড় খুলে তার গালেও একটা বসিয়ে দিলো। অরুণিকা চড় খেয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। এই প্রথম সে আহনাফের চড় খেয়েছে। সে গাল ধরে কাঁদতেই আহনাফের ভয়ংকর মুখটা আরো বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠলো। বাঁধনকে টেনে তুলে ঘর থেকে বের করতে যাবে তখনই ইমন আর তাহমিদ বাসায় এলো। ঘটনা তাদের খুলে বলতেই তাহমিদ বাঁধনের গালে আরেকটা চড় মারলো। ইমন বাঁধনের কান টেনে ধরে বলল,
“এসব কোথায় শিখেছিস?”
বাঁধন কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“টিভিতে দেখেছি।”
আহনাফ বলল,
“ডাক ওর মাকে। তোর পিঠের ছাল তুলে নেবো আজ। বেয়াদব ছেলে। তোর সাহস কি করে হয় অরুকে নিয়ে বাজে চিন্তা করার? ও বাচ্চা মেয়ে ও কিছু বুঝতে পারছে না, তাই তুই যা তা শিখাবি ওকে?”
ইমন সুরাইয়াকে ডেকে আনল। সুরাইয়া ছেলের এমন কাজে লজ্জায় নুইয়ে পড়লেন। সামনে থাকা স্টিলের পেন্সিল বক্স দিয়ে ইচ্ছে মতো হাতে-পিঠে মারলেন। বাঁধন এক পাশে জড়ো হয়ে গেলো। অরুণিকা ভয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো। ততোক্ষণে আলেয়া খালা আর ডুমুর ছুটে এসেছে। আলেয়া খালা টেনে সুরাইয়ার কাছ থেকে বাঁধনকে ছাড়ালেন। সুরাইয়া কপাল চাপড়ে বললেন,
“হায় আল্লাহ, মৃত্যু হোক আমার। এতোটুকুন ছেলে কি শিখে ফেলেছে। বড় হলে তুই তো আমাদের সম্মান কেঁড়ে নিবি।”
তাহমিদ রাগী কন্ঠে বলল,
“ওর সামনে বসে বসে টিভিতে এমন নোংরা জিনিস দেখলে ও এসবই শিখবে। ওর দোষ নেই। দোষ কার সেটা নিজেই ভেবে দেখুন।”
এবার ইমন বলল,
“আপনাকে আর চাচাকে আমরা অনেক সম্মান করি। আপনারা আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন। কিন্তু অরুণিকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে কিছুই না। ওর সাথে খারাপ কিছু হলে আমাদের কিছুই মনে থাকবে না।”
আহনাফ ইমনকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“এতো কথা বলার দরকার নেই। এই ছেলে আর যদি অরুর আশেপাশেও আসে, আমি এর হাত-পা ভেঙে দেবো।”
সুরাইয়া কান টেনে ধরে ছেলেকে অরুণিকাদের ঘর থেকে বের করলেন। তারা বের হওয়ার সময় আরাফ, ইভান আর তূর্য বাসায় এলো। বাসায় এসে তারা বাকি ঘটনা জানলো। ইভানের তো মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। আরাফও অনেক কষ্টে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেছে। আহনাফ অরুণিকার দিকে এগিয়ে আসতেই সে এক দৌঁড়ে আরাফের দিকে ছুটে গেলো। আরাফ তাকে কোলে উঠিয়ে বলল,
“বাঁধন এর আগেও এমন করেছে?”
অরুণিকা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“না আজকেই।”
“এগুলো ভালো না অরু। কেউ এমন করলে তার থেকে দূরে থাকতে হয়।”
“আমি কিছু দেখি নি। বাঁধন চোখ বেঁধে দিয়েছিল।”
ইভান মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“ওর বয়সে আমরা তো এসব জানতামই না। ওই ছেলের মাথা পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। অরুণিকাকে আর ওই বাসায় রাখা ঠিক হবে না। এখন থেকে ওর স্কুল ছুটি হলে ওকে আমাদের স্কুলেই বসিয়ে রাখবো।”
তূর্য বলল,
“কিভাবে? এভাবে ও আমাদের স্কুলে একা একা বসে থাকবে?”
“ক্লাসে এনে বসিয়ে রাখবো।”
“ক্লাসে এনে বসিয়ে রাখবো আর কেউ আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করবে না ও কি করছে?”
আহনাফ রাগী কন্ঠে বলল,
“তো ওকে কি একা ছাড়বো এখন? কোথায় রাখবো ওকে? কোন জায়গাটা ওর জন্য নিরাপদ, বল?”
চলবে–