অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-২২||

0
1181

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২২||

৩৯.
ইভান এক সপ্তাহ ধরে মাওশিয়াতের কাছ থেকে দূরত্ব রাখছে। এমনকি যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছে। তবে মাওশিয়াত ইভানের দূরত্ব রাখার কারণটা আন্দাজ করতে পেরেছে। তাই আজ সে কলেজে না গিয়েই ইমনের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলো। এদিকে মাওশিয়াত দেখা করবে শুনে ইমন মনে মনে খুবই খুশি হলো। সে ভালোভাবে তৈরি হয়ে ফুরফুরে মেজাজে মাওশিয়াতের বলা স্থানে পৌঁছে গেলো। মাওশিয়াত তাকে দেখেই তার হাত ধরে পাশের একটা বেঞ্চে বসিয়ে বলল,
“আমি জানি না তুমি ইভানকে কি বলেছো। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, তোমার জন্যই ও আমার সাথে কথাবার্তা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।”

ইমন বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। তার মুখটা মুহূর্তেই মলিন হয়ে গেলো। মাওশিয়াত ইমনের হাত ধরে বলল,
“আমি ইভানকে ফেরত চাই। তোমার অনুভূতিগুলো তুমি ওর উপর চাপিয়ে দিও না। তুমি আমাকে পছন্দ করো, তার মানে আমিও তোমাকে পছন্দ করবো, এটা তো সম্ভব নয়, ইমন। আমি ইভানকে পছন্দ করি।”

ইমন মাওশিয়াতের হাত দু’টি নিজের হাতে মধ্যে আবদ্ধ করে বলল,
“মাওশিয়াত, তুমি ভুল ভাবছো। স্কুলে আমরা দু’বছর একসাথে ছিলাম। তুমি ভাইয়ের চেয়ে আমার সাথে বেশি কথাবার্তা বলেছো। এখন তোমাদের কলেজের ক্লাস শুরু হয়েছে এক বছরও হয় নি। আর তুমি এই কয়েক মাসে ভাইকে পছন্দ করে ফেলেছো? এটা তো আমি মানতে পারছি না।”

মাওশিয়াত বলল,
“তোমাকে এটাই মেনে নিতে হবে। প্লিজ, আমার আর ইভানের মধ্যে ঝামেলা সৃষ্টি করো না, ইমন।”

“আমি তোমাকে ভালোবাসি, মাওশিয়াত। আমি তোমার আর ভাইয়ের মধ্যে ঝামেলা সৃষ্টি করি নি। আমি তো তোমাকে চাইছি।”

“এটা সম্ভব না। কারণ আমি এটা চাই না।”

ইমন তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“তাহলে ইভান তোমার অনেক যত্ন নেয়। আমার চেয়েও বেশি, তাই না?”

মাওশিয়াত মলিন মুখে বললো,
“আমি জানি তুমি আমাকে খুব পছন্দ করো। কিন্তু..”

ইমন মাওশিয়াতকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি ইভান মাহমুদকে বলবো, তোমাকে আমার ভাবী বানিয়ে নিতে। এরপর তো আমি তোমার দেবর হয়ে যাচ্ছি, তাই না?”

কথাটি বলেই ইমন চলে গেলো। আর মাওশিয়াত শূন্য দৃষ্টিতে ইমনের চলে যাওয়া দেখছে। ইমন আর ইভান আপন ভাই। তাহলে তো এই সম্পর্কে কেউই সুখী হবে না। ইমন তার ভালোবাসার মানুষকে ভাইয়ের স্ত্রী হিসেবে কিভাবে মেনে নিবে? আর ইভান তার ভাইয়ের ভালোবাসার মানুষকে কখনোই আপন করে নিতে পারবে না। মাওশিয়াত বিড়বিড় করে বলল,
“এটা এতোদিন কেন আমার মাথায় আসে নি? তাহলে কি ইভানকে আমি কখনোই পাবো না? কিন্তু ইভানও যদি আমাকে পছন্দ করে, তাহলে তো সম্ভব। ইমন একদিন অবশ্যই এটা মেনে নেবে।”

মাওশিয়াত ইভানকে সুযোগ বুঝে তার ভালো লাগার কথাটা জানিয়ে দিলো। ইভানও সরাসরি না করে দিলো। বলল,
“আমি তোমাকে কখনোই বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু মনে করি নি। এমন নয় যে আমি ইমনের জন্য তোমাকে মেনে নিচ্ছি না, বা আমার অন্য কাউকে পছন্দ। আমি কখনোই ভালোবাসা বা সম্পর্কে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ খুঁজে পাই নি।”

মাওশিয়াত ইভানের হাত ধরে বলল,
“আজ থেকে আমাদের বন্ধুত্বও শেষ। আমি তোমার উপর রাগ করে থাকবো না। ইমনের উপরও আমার কোনো ক্ষোভ নেই। ও সত্যিই আমাকে ভালোবাসতো। এখনো হয়তো ভালোবাসে। এটা আমি প্রথম দিন থেকেই বুঝেছিলাম। কিন্তু আমি মনে করতাম সম্পর্ক নিজের যোগ্যতার সাথে যাবে এমন মানুষের সাথে করা উচিত। আমার দৃষ্টিতে একজন মেয়ে ডাক্তার আর একজন পুরুষ সাহিত্যিক কখনোই একে অপরের জন্য মানানসই নয়। ঠিক তেমনি আমার পাশে ইমনের চেয়ে তোমাকেই বেশি মানানসই মনে হয়েছে। তাই আমি তোমাকেই চেয়েছিলাম।”

ইভান বলল,
“তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে। শুধু তোমার দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটা পরিবর্তন করা উচিত৷”

মাওশিয়াত দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলো।

প্রেমানুভূতি এমন একটা রোগ, যেই রোগ বসন্তের হাওয়ার মতো জীবনে চলে আসে। কিন্তু কাউকে জানায় না সে এসেছে। যেমন বসন্তেও এখন আর আগের মতো ফুল ফুটে না।
আর সেই হাওয়া নতুন করে আরাফের কাছে ছুটে এসেছে। রুহানির মৃত্যুর পর সে দ্বিতীয় বার সেই জায়গায় কাউকে অনুভব করতে পারছে। কিন্তু এই কথা সে ঘুণাক্ষরেও সেই মেয়েটিকে জানাবে না। সে দূর থেকেই মেয়েটিকে ভালোবাসবে। কাছেও যাবে না।

সায়ন্তনী দোকান বন্ধ করে বের হতেই আরাফের মুখোমুখি হলো। আরাফ তাকে দেখেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। সায়ন্তনী এদিক-ওদিক তাকিয়ে ইমনকে খুঁজতে লাগলো। কারণ প্রতিদিন ক্লাস শেষে ইমন সায়ন্তনীর দোকান এসে চা খেয়ে যায়। কিন্তু আজ আসে নি। সায়ন্তনী আরাফকে জিজ্ঞেস করলো,
“ইমন আসবে না?”

আরাফ শূন্য দৃষ্টিতে সায়ন্তনীর চোখের দিকে তাকালো। এই ছেলের দৃষ্টিতে আসলেই কিছু একটা আছে। সায়ন্তনী সেই চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলো, এই গভীর চোখ দুটি অনেক কিছুই বুঝে ফেলে। আরাফের চোখ দু’টি অদ্ভুতভাবে মানুষের চোখের ভাষা পড়তে পারে। যেমন সে বুঝে ফেলেছে সায়ন্তনী ইমনকে খুব পছন্দ করে। কিন্তু সায়ন্তনীও তার মতোই অপারগ। আরাফ সায়ন্তনীকে কখনোই তার ভালো লাগার কথা বলবে না, কারণ সে সায়ন্তনীর দায়িত্ব নেওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারে নি। হয়তো পারবেও না। আর সায়ন্তনী ইমনকে তার ভালো লাগার কথা বলবে না, কারণ সে নিজেকে ইমনের অযোগ্য মনে করে আর এমনিতেই ইমনের মনে মাওশিয়াতের বসবাস।

ভালো লাগাগুলোও খুব অদ্ভুত হয়। এখানে তাকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছে যেমন থাকে, তাকে না পাওয়ার আক্ষেপও থাকে। তবুও চোখ একটুখানিও ভিজবে না। মনে উথাল-পাতাল সৃষ্টি হলেও চোখে থাকবে শূণ্যতা। তবুও ঠোঁটের হাসি মুছে যাবে না।

এদিকে সবাই যার যার সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত৷ তূর্য সারাদিন তার ভিডিও তৈরীর কাজে লেগে থাকে। ইভান আর ইমনের মধ্যে এখনো কোনো কথাবার্তা হয় না। ইমন রাতেই বাসায় ফিরে। সারাদিন আর বাড়িতে আসে না। অন্যদিকে ইভান কিছুদিনের জন্য তার কলেজ বন্ধুর সাথে থাকছে। আর আরাফ সায়ন্তনীর ভাবনায় ব্যস্ত, তাহমিদ সারাদিন দোকানে বা রেস্টুরেন্টে থাকে, আর সময় পেলে শতাব্দীর সাথে গল্প করে সময় পার করে। এদিকে আহনাফও যতির যন্ত্রণায় এক সেকেন্ড বাসায় থাকতে পারে না। তাকে ক্লাসের পর কোচিংয়ে, আর এরপর দোকানে যেতে হয়। আর বাকি সময়টা যতির জন্য বরাদ্ধ রাখতেই হবে। নয়তো সেদিনই যতি ঘুমের ওষুধ খেয়ে আহনাফকে নাজেহাল করে ছাড়বে।

এসবের ভীড়ে অরুণিকাকে সবাই ভুলেই গেছে। মহল্লার একটা মেয়ের সাথেই অরুণিকা স্কুল থেকে বাসায় ফিরে। এখন সে আট বছরে পা দিয়েছে। সে মোটামুটি একা একা আসা যাওয়া করতে পারে। বাসায়ও একা থাকতে পারে। অরুণিকার জন্য গত মাসেই ছোট একটা টিভি কিনে এনেছিলো তূর্য। এখন টিভি দেখেই তার বাকি সময়টা কাটে। কিন্তু তার একা একা যাওয়া আসাটাই মহল্লার উঠতি বয়সী ছেলেদের চোখ এড়ায় নি। তারা মাঝে মাঝে অরুণিকার ব্যাগ টেনে নিয়ে ফেলে, হাত ধরে রাখে, ছোট ছোট ইটের ভাঙা টুকরো তার দিকে ছুঁড়ে দেয়। এরপর অরুণিকা বাসায় এসে কান্না করে। কিছুক্ষণ পর আবার ভুলে যায়।
আরাফ আর তাহমিদ সন্ধ্যার পর পরই বাসায় ফিরে আসে৷ বাকিরা রাত দশটার পরই ফিরে। কিন্তু বাসায় এসেই তারা পড়তে বসে যায়, বা ঘুমিয়ে পড়ে। তারা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে অরুণিকার সাথে কিছুক্ষণ বসে কথা বলারও সময় হয় না। অরুণিকাও কাউকে কিছু জানায় নি। এমনকি তার মনেও থাকে না। মনে পড়লেও বলার সুযোগ পায় না। কারণ সেই সুযোগটা সে আর ছ’জনের কাছ থেকে পায় না।

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here