অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-২৫||

0
1229

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৫||

৪২.
সুরাইয়া আর সালেহ আলী মহল্লার লোকেদের শান্ত করিয়ে অরুণিকাকে নিজের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। আরাফ অরুণিকার হাত ধরে সুরাইয়াকে বলল,
“বাঁধন এতো কিছু করার পর, আমরা অরুকে আপনাদের সাথে থাকতে দেবো না।”

সুরাইয়া কথাটি শুনে আরাফের দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ছেলের কুকর্মের জন্য এখন কেউই তাদের বিশ্বাস করতে চাইছে না।

তূর্য মহল্লার লোকেদের উদ্দেশ্যে বলল,
“আমরা অরুর অভিভাবক। আমরা থাকতে ও ওই বাড়িতে কেন থাকবে?”

তূর্যের প্রশ্নের উত্তরে মহল্লার একজন মহিলা বলে উঠলেন,
“বাবা-মার অবর্তমানে চাচা-চাচীই অভিভাবক হয়। প্রাপ্ত বয়ষ্ক যুবক ছেলে নয়। আজ তোমরা থাকবে, কাল অন্য ছেলেরাও তার বান্ধবীদের নিয়ে থাকতে চাইবে।”

ইভান রাগী কন্ঠে আরাফকে বললো,
“এদের কি মাথায় সমস্যা আছে? আমাদের সম্পর্কটাকে কিসের সাথে তুলনা করছে?”

আহনাফ আরাফের কাছে এসে বলল,
“অরুকে হোস্টেলে দিয়ে দে, আরাফ৷ নয়তো ওরা অরুকে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেবে৷ হোস্টেলে থাকলে অন্তত অরুকে হারিয়ে ফেলার ভয় থাকবে না। আমরা ওকে সপ্তাহে একদিন দেখতে যাবো। কিন্তু এখন যদি কোনো পরিবার এসে ওকে নিয়ে যায়? তখন ও অন্য কোথাও চলে যাবে। এরপর ওর নতুন পরিবার যদি আমাদেরকে ওর সাথে দেখা করতে না দেয়? আমি ওকে যেতে দেবো না। আরাফ, কিছু তো কর।”

আরাফ আহনাফকে ধাক্কা দিয়ে রাগী কন্ঠে বলল,
“সব তোর জন্য হয়েছে। তোর যখন যতিকে ভালোই লাগতো না, তাহলে ওর সাথে সম্পর্কে কেন গিয়েছিস?”

আহনাফ যতির দিকে একনজর তাকালো। যতি একপাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে আর আহনাফের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে। আহনাফ মলিন মুখে বললো,
“আমি তো যেতে চাই নি। তূর্য, ইমন ওরা আমাকে বাধ্য করেছিল।”

“নিজের ইচ্ছে না থাকলে কেউ বাধ্য করতে পারে না। আর আমি জানি, তুই কেন যতির সাথে সম্পর্কে গিয়েছিস!”

আহনাফ আরাফের হাত ধরে তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। তূর্য ভ্রূ কুঁচকে একবার আহনাফের দিকে তাকালো, আরেকবার আরাফের দিকে। আরাফ আহনাফের হাত সরিয়ে দিয়ে বিড় বিড় করে বলল,
“তুই যা চেয়েছিস তাই হয়েছে। এখন আর অরুর ব্যাপারে তোর নাক গলানোর প্রয়োজন নেই।”

আহনাফ আরাফের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আরাফ ঠিকই বলেছে, জোর করে কোনো সম্পর্ক শুরু হয় না। যতির সাথে সম্পর্কে যাওয়াটা শুধুই ইমন আর তূর্যের জোরাজুরিতে হয় নি। এখানে তারও ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এই ইচ্ছেটা তো ভালোবাসা থেকে আসে নি। এই ইচ্ছের কারণটাই তো জটিলতায় ঘেরা। যেই জটিলতা তাকে কোনোভাবেই ভালো থাকতে দিচ্ছে না।

ছ’জনের কেউই রাতে ঘুমাতে পারে নি। আহনাফের কথায় বাঁধন আজ তাদের সাথেই ছিল। আর অরুণিকা সুরাইয়াদের বাড়িতে। মধ্য রাতে আহনাফ বিছানা ছেড়ে উঠে অরুণিকা যেই বিছানায় ঘুমায় সেখানে উঠে বসলো। আরাফ তাকে উঠে বসতে দেখে নিজেও বিছানা ছেড়ে উঠলো। তারপর আহনাফের পাশে বসে বললো,
“ভালোবাসিস ওকে?”

আহনাফ আরাফকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ভালোবাসি না। একদম ভালোবাসি না। কিন্তু কোথাও তো একটা মায়া আছে। আর আমি এই মায়া কাটাতে পারছি না। পারবো কিনা সন্দেহ।”

আরাফ বলল,
“কিন্তু তুই এটাই চেয়েছিলি।”

আহনাফ আরাফের দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইলো।

আরাফ আবার বলল,
“অরু, আমাদের বংশের একমাত্র মেয়ে। দাদা-দাদী ওকে অনেক বেশি পছন্দ করতো। অরু বাড়ির সবার আদরের মেয়ে ছিল। ওকে এভাবে অন্য কেউ দত্তক নিয়ে যাবে, এটা অন্যায় হবে। ওর চৌধুরী বংশের পরিচয়েই বড় হতে হবে। কিন্তু এখন কি করবো সেটাই বুঝতে পারছি না।”

আহনাফ বলল,
“পালিয়ে যাই চল। আবার কোনো নতুন ঠিকানা খুঁজে নিবো। আচ্ছা, দেশে ফিরে গেলেই তো ভালো হয়, তাই না? এই শহরে কোনো প্রাণ নেই। দেশে গিয়ে অরুকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবো। আমরা একটা বাসা নেবো। আবার সব নতুন করে শুরু করবো।”

আরাফ বলল,
“খবর রাখিস না, তাই এই কথা বলছিস।”

“কেন কি হয়েছে?”

“মির্জা গ্রুপের এমডি, এবারের ভোটে মন্ত্রী হয়েছে। তার এখন অনেক ক্ষমতা। আমাদের এখন জনসম্মুখে মেরে ফেললেও কেউ কিছু করতে পারবে না। অরুর মামার খবর নিলাম ওইদিন, শুনলাম হঠাৎ উনি আমেরিকায় যাচ্ছেন। ওখানে বাড়িও কিনেছেন।”

“থানার ওসির তো এতো সামর্থ্য থাকার কথা না। আর যতোটুকু জানি, উনিই ওই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।”

“হ্যাঁ।”

“আচ্ছা, অরুর মামা কি সত্যিই এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন?”

আরাফ বলল, “জানি না।”

“আমরা না হয় তার কেউই ছিলাম না। কিন্তু চাচী? নিজের বোনকে কি কেউ হত্যা করতে পারে?”

“ক্ষমতা আর টাকার লোভ মানুষকে অন্ধ করে দেয়।”

আহনাফ কিছু একটা ভেবে বলল,
“উনি জড়িত থাকলে ওনার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয় নি কেন? কিন্তু রহমত চাচা বলেছিলেন, সবাই উনাকে সন্দেহ করছে।”

আরাফ বলল,
“হয়তো উনাকে ছাড়িয়ে এনেছে আর মিডিয়ার সামনেও এই খবর আসে নি। অনেক খবরই তো মিডিয়ার কাছে পৌঁছায় না।”

আহনাফ অরুণিকার বালিশে মাথা দিয়ে বলল,
“এখন শুধু অরু আবার এখানে ফিরে আসুক। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।”

পরের দিন থেকে সবকিছুই স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। কাজ, স্কুল কিছুই বন্ধ নেই৷ পার্থক্য শুধু অরুণিকা আর ছ’জনের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা যাচ্ছে না। অরুণিকা ছ’জনের সাথেই নিজেকে অভ্যস্ত করে ফেলেছে। সে সুরাইয়াদের বাসায় কোনোভাবেই থাকতে চাইছে না। ঠিক মতো খাচ্ছে না। রাতে ঘুমানোর সময় কান্নাকাটি করে। এদিকে ছ’জনেরও একই অবস্থা। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে আরাফ, তূর্য আর আহনাফের। তিন জনই খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তারা কলেজ শেষে এখন অরুণিকার স্কুলে চলে যায়। সেখানেই তাদের অরুণিকার সাথে দেখা হয়। কারণ মহল্লায় এখন তাদের একসাথে দেখলেই লোকজন কানাঘুঁষা করে। তারা বুঝতে পারছে না, অরুণিকার সাথে কথা বললে, তাদের সমস্যাটা কোথায়। কিন্তু সমস্যাটাতে যে যতি মারাত্মক জট লাগিয়ে দিয়েছে। এখন এই জটের সমাধান একমাত্র সময়ই দিয়ে দেবে।

এক সপ্তাহ এভাবেই কেটে গেছে। এক সপ্তাহ পর এনজিও থেকে দুইজন মহিলা এলো। অরুণিকাকে তাদের তত্ত্বাবধানে রেখে দত্তক দেওয়া হবে। যতি জানতে পেরেছিলো সুরাইয়া আর সালেহ আলী তাদের আপন চাচা-চাচী নয়। তাই সে তার কাজিনের সাহায্য নিয়ে এই কথা এনজিওর লোকদের জানায়। তারা সন্তান জন্মদানে অক্ষম দম্পতিদের হাতেই অনাথ বাচ্চাদের দত্তক দেয়।

এদিকে অরুণিকাকে নিতে আসলেই ইমন এসে তাদের আটকায়। কিন্তু কোন সম্পর্কে সে অরুণিকাকে ধরে রাখবে? একজন বেকার অবিবাহিত ছেলে একটা আট বছর বয়সী মেয়েকে দত্তক নেবে, এটা তো সম্ভব না। অরুণিকাকে নিয়ে যাওয়ার সময় সে আরাফের হাত ধরে বলল,
“আমি ওদের সাথে যাবো না। তুমি অনেক পঁচা। তুমি আমাকে ওদের সাথে পাঠিয়ে দিচ্ছ।”

অরুণিকা কেঁদেই দিয়েছে। ওর কান্না ক্রমশ বাড়ছে। তার চোখে পানি দেখে আরাফ আর তূর্য ডুকরে কেঁদে উঠলো। আহনাফ নিজের অশ্রু গুলো আটকে রেখেছে। তার চোখ দুটি লাল হয়ে গেছে। ইমন আর তাহমিদ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা এখনো বুঝতে পারছে না, হঠাৎ সবকিছু এমন উলোটপালোট কেন হয়ে গেল? তবে ইভান শান্ত হয়ে বসে নেই। সে কাঁদছে না, বরং অরুণিকাকে আইনগত ভাবে এমন পরিস্থিতি থেকে বের করে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর ইভানকে সাহায্য করছে শতাব্দীর বাবা।

অরুণিকা এনজিওর মহিলাদের সাথে যাওয়ার পর থেকেই কান্নাকাটি করে পুরো আশ্রম মাথায় তুলে ফেলেছে। যতির কাজিনের বান্ধবী এনজিওতে কাজ করে। সে-ই অরুণিকাকে এই আশ্রমে নিয়ে এসেছে। এদিকে ইভান থানায় যতির বিরুদ্ধে মামলা করে এসেছে। তারা ঘটনা ভালোভাবে তদন্ত করবে বলে ইভান আর মাস্টারমশাইকে আশ্বস্ত করে বিদায় করলো।

এদিকে অরুণিকা কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। সে এতোদিন সুরাইয়ার সাথে থেকেছিল, কারণ সে ছোটবেলা থেকেই সুরাইয়াকে দেখে আসছে। কিন্তু এখন এখানের কাউকেই সে চিনে না।

যতি বিকেলে আশ্রমে এসে অরুণিকার সামনে বসলো। অরুণিকা ক্ষুব্ধ হয়ে তার পাশে থাকা ফুলদানিটি যতির দিকে ছুঁড়ে মারলো। যতি তাড়াতাড়ি সরে যাওয়াতেই অল্পের জন্য রক্ষা পেলো। সে অরুণিকার হাত চেপে ধরে বলল,
“আমি চাইলে অনেক কিছুই করতে পারি। আমার সেই ক্ষমতা আছে। দেখেছো, তোমাকে কোথায় নিয়ে এসেছি? আমি তোমাকে আহনাফ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছি।”

অরুণিকা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললো,
“তুমি অনেক খারাপ। আমি তোমার সাথে কথা বলবো না। যাও এখান থেকে। যাও, যাও।”

অরুণিকা আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে তার হেঁচকি উঠে গেছে। সেখানে কর্মরত একজন কর্মচারী দৌঁড়ে অরুণিকার কাছে এলেন। তিনি অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরতেই, সে মহিলাটির বুকে মাথা রেখে ফোঁপাতে লাগলো। যতি উঠে যেতেই অন্য শিফটে থাকা একজন কর্মচারী তার পথ আটকে বলল,
“তুমি এখানে কেন এসেছো? তোমাকে এখানে আসার অনুমতি কে দিয়েছে?”

যতি বুকে হাত গুঁজে বলল,
“তোশিবা, আমি ওর বান্ধবী। আমি আমার এক্স প্রেমিকের চাচাতো বোনের সাথে দেখা করতে এসেছি।”

যতি আশ্রম থেকে বের হতেই আহনাফ আর ইভানের মুখোমুখি হলো। আহনাফ তাকে দেখে বলল,
“তুমি এখানে?”

যতি মুচকি হেসে বললো,
“অরুর সাথে দেখা করতে এসেছি।”

আহনাফ রাগী কন্ঠে বলল,
“তুমি আমাদের একা ছেড়ে দাও। আমি তোমার কাছ থেকে মুক্তি চাই। প্লিজ তুমি আমার জন্য অরুর কোনো ক্ষতি করো না।”

“তুমি কি চাও অরু আবার ওই ঘরে ফিরে যাক?”

ইভান বলল,
“অবশ্যই। আর খুব শীঘ্রই এটা হবে। তোমার এসব উদ্ভট ষড়যন্ত্র বেশিদিন ঠিকবে না। কারণ তোমার এই কাজগুলো খুবই অযৌক্তিক ছিল। আর অরুণিকাকে আমাদের সাথে রাখার অনেক যৌক্তিকতা আছে।”

“হ্যাঁ, তবে ভালো হবে যদি আহনাফ আমাকে বিয়ে করে ফেলে। এমনিতেই আইনগত ভাবে আমাদের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। আর বিয়ের পর অরুণিকা ভাইয়া-ভাবীর সাথে থাকতেই পারে।”

আহনাফ যতির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো। তারপর ইভানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুই যে আজ সকালে বললি, অন্য উপায়ে অরুণিকাকে ফিরিয়ে আনা যাবে।”

“হ্যাঁ।”

“আমি উপায় পেয়েছি।”

যতি কথাটি শুনে হাসলো। আহনাফ যতির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে ধন্যবাদ, আমার মাথায় ভালো একটা বুদ্ধি ঢুকিয়ে দিয়েছ। এখন বাসায় গিয়ে তোমার মাথাটাকে বিশ্রাম দাও। এতো ঝামেলা সৃষ্টি করেছো, দেখা যাবে মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটবে।”

ইভান তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“যার মস্তিষ্ক আগে থেকেই বিকৃত, তার আবার নতুন করে বিকৃতি হবে না।”

আহনাফ ইভানকে নিয়ে অরুণিকার সাথে দেখা না করেই বাসায় চলে এলো। সে অরুণিকাকে বের করে আনার সেই উপায়টি সবাইকে বলল। সব শুনে আরাফ ছাড়া সবাই অবাক হলো। ইমন বলল,
“অরুকে বিয়ের চুক্তিতে ফিরিয়ে আনা! তুই কি পাগল হয়ে গেছিস, আহনাফ?”

ইভান বলল,
“ও ঠিকই বলেছে। এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়। আর এটা সম্ভবও। এরকম অনেক ঘটনা ঘটে। তবে খুবই কম।”

তাহমিদ বলল,
“সব বুঝলাম। কিন্তু বিয়ের চুক্তি কার সাথে হবে?”

তূর্য বলল,
“আমাদের মধ্যেই কি কেউ একজন এই চুক্তি করবে? আর এটা তো কোর্টে গিয়ে জানাতে হবে। তারপরই তো সব সম্ভব হবে। কিন্তু টুইংকেল যদি বড় হয়ে এই চুক্তির জন্য আমাদের ছেড়ে চলে যায়? ওর তো একটা পছন্দ থাকতে পারে, তাই না?”

আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ও চলে গেলে আটকাবো না। আমরাই ওর বিয়ে দেবো। চুক্তিটা শুধু ওকে ফিরিয়ে আনার জন্য হবে। বিয়ে তো আর করছি না। শুধু চুক্তি করছি। আর অরু এখানেই থাকতে চাইবে। এটা আমাদের জন্য প্লাস পয়েন্ট। ও কোর্টে জানাবে ও আমাদের সাথেই থাকবে। ওর মতামত শুনে এই চুক্তির কথা উঠবে। তারপর আমাদের মধ্যেই কেউ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে। এরপরই সে আইনগত ভাবে অরুর দায়িত্ব নেবে।”

তাহমিদ বলল, “কিন্তু সে কে হবে?”

সবাই একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলো। আরাফ তখন বলে উঠল, “আহনাফ।”

তূর্য কথাটি শুনে ভ্রূ কুঁচকে আরাফের দিকে তাকালো। ইমন বলল,
“আহনাফের প্রেমিকার জন্য এতোকিছু হয়েছে, ও কেন দায়িত্ব নেবে?”

আরাফ ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“তাহলে কি তুই নিতে চাস?”

ইমন ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“না, ভাই তো নিতে পারতো।”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তুই আমার কথা কেন বলছিস? মাওশিয়াতের জন্য?”

ইমন আমতা-আমতা করে বলল,
“চুক্তি করলে বিয়ে হয়ে যায় নাকি!”

ইভান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমি কোনো চুক্তি করতে পারবো না।”

তাহমিদ বলল,
“ভাই, তোরা দুই জন এখনো যুদ্ধ করবি? আর আমার মনে হয়, আরাফ ঠিকই বলেছে। আহনাফই এই চুক্তিতে আসুক। যতির একটা ভালো শিক্ষা হবে। আর চুক্তি মানে তো বিয়ে না। ওর তো বয়স হয় নি। আর অরুণিকার আঠারো বছর হওয়ার আগেই আমরা এই দেশ ছেড়ে বের হয়ে যাবো। আর মাত্র চার-পাঁচ বছর এখানে থাকতে হবে।”

পরের দিন মাস্টারমশাইকে সব জানাতেই তিনি অরুণিকাকে ফিরিয়ে আনার উপায়টি পছন্দ করলেন। তিন দিন পর কোর্টে গিয়ে লিখিত দরখাস্ত দেওয়া হলো। এবার যতির বাবা-মার কানেও এই খবর পৌঁছালো। আহনাফকে পাওয়ার জন্য তাদের মেয়ে এমন উদ্ভট কাজ করবে তারা সেটা কল্পনাও করতে পারে নি। যতির মা ইচ্ছেমতো মেয়েকে মারলেন। যতিকে বাসায় আটকে রাখা হলো। তার বাবা তার কলেজে যাওয়াও বন্ধ করে দিলেন। মেয়ের জন্য পুলিশ তার বাসায় এসেছে, এটা তার জন্য খুবই অপমানজনক ছিল। এদিকে মাওশিয়াত সব শুনে তার বাবাকে বলেছে ছয় জনকে এই ব্যাপারে সাহায্য করতে। মাওশিয়াতের বাবাও এগিয়ে এলেন।
এদিকে তদন্ত করে এনজিওর সদস্য তোশিবার বিরুদ্ধে জরিমানা করা হলো। কারণ সে ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে অরুণিকাকে নিয়ে এসেছে। আর এটা আরো সম্ভব হয়েছে অরুণিকা শারিরীক ভাবে অসুস্থ হয়ে যাওয়ায়।কারণ আশ্রমে গিয়ে অরুণিকা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর প্রশাসনিকে ভাবে মহল্লার লোকেদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেলো, অরুণিকাকে খাওয়া- পড়া আর ওর দেখাশুনার কোনো কমতি রাখে নি সেই ছয় জন যুবক। শেষমেশ বিয়ের চুক্তিতেই অরুণিকাকে তাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো।

বিয়ের উপযুক্ত বয়স হলে অরুণিকাকে বিয়ে করে তার দায়িত্ব পুরোপুরি নিয়ে নেবে আহনাফ, এই চুক্তিতে আহনাফ স্বাক্ষর করলো। অরুণিকাকে তার নাম লিখতে বলা হলো। সে কাঁচা হাতে না বুঝেই স্বাক্ষর করলো। এরপর আইনগত ভাবে তারা অরুণিকাকে ফিরে পেলো। তবে এবার তারা আর পুরোনো বাসায় গেলো না। মাস্টারমশাই তাদের অন্য মহল্লায় তিন রুমের বাসা খুঁজে দিলেন। অরুণিকা বড় হচ্ছে, তাই এখন তার জন্য আলাদা ঘর থাকা প্রয়োজন। তারা কোর্ট থেকেই সরাসরি নতুন বাসায় উঠলো। নতুন বাসায় উঠে অরুণিকা অনেক খুশি। এখনো জিনিসপত্র না আসায় ঘরটা খালি খালি লাগছে। শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অরুণিকা সেই প্রতিধ্বনিত শব্দ শুনে মজা পাচ্ছে।

সমাজের নিয়মগুলো জটিল হয়। কিন্তু আত্মার সম্পর্কের কাছে সব জটিলতার পরাজয় ঘটে। এই কয়েক সপ্তাহ ছয়টা ছেলের অস্থিরতা, সেই বারান্দার সামনে নিঃস্ব মানুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকা, সকাল হলেই পানির জন্য ছোটাছুটি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে ধৈর্য ধরে অরুণিকাকে খাওয়ানো, এখন সবই শূন্য। যারা তাদের বিরুদ্ধে ছিল, এখন তারাই সেই শূন্য ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“অরুণিকাকে ফিরিয়ে আনার জন্য ছেলেগুলো অনেক ছুটেছে। কিন্তু তারা হেরে যায় নি। তাদের কাছে সমাজই হেরে গেছে। তারা জয়ী হয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে আত্মার সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বেশি গভীর হয়।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here