#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৮||
৪৫.
ক্যাম্পাস থেকে বের হয়েই যতিকে দেখে থমকে গেলো আহনাফ। যতি তার কাছে এসে বলল,
“আহনাফ, আমি তোমাকে কতো খুঁজেছি, জানো?”
আহনাফ যতিকে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে যাবে তখনই যতি বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
আহনাফ যতির দিকে ফিরে বলল,
“দেখো, যা করার করে ফেলেছো। আর শুনো, তোমার সেই মহান কাজের জন্য আমি কোর্ট থেকে লিখিতভাবে অরুর হবু বর হওয়ার অনুমতি পেয়েছি। অরুর আঠারো হলেই আমি ওকে বিয়ে করে ফেলবো। এখন শুধু আট কি নয় বছরের অপেক্ষা!”
“এভাবে অনুমতি দিলে হয় নাকি! অরুণিকা যদি না চায়।”
“কেন? আমার মধ্যে কি কোনো সমস্যা আছে যে চাইবে না?”
যতি আহনাফের পা ধরতে যাবে তখনই আহনাফ কয়েক পা পিছিয়ে বলল,
“এসব অভিনয় আমার সামনে না করে, কোনো ডিরেক্টরের সামনে করতে পারো। সিনেমায় ভালো একটা সুযোগ হবে তোমার।”
আহনাফ ক্যাম্পাস থেকে সোজা বাসায় চলে এলো। বাসায় এসেই যতির বাবাকে ফোন করে বলে দিলো, যতি বার-বার তাকে বিরক্ত করছে। যতির বাবা সব শুনে এবার মেয়ের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। যতির কাজকর্ম তার আত্মীয়রা জানার পর যতির বাবা-মাকে কথা শুনাচ্ছে। সবাই যতির মাকেই দোষ দিচ্ছেন। বাসায় মেয়ের সাথে না থেকে বাইরে চাকরি করতে গিয়েই নাকি মেয়ের স্বভাব নষ্ট হয়ে গেছে। যতির মা এসব শুনে মেয়ের উপর আরো ক্ষুব্ধ হয়ে যান। তিনি আবার মেয়েকে ইচ্ছেমতো মারলেন। যতি এবার নিজেকে বাঁচাতে বলল, সে আর কখনোই আহনাফের সামনে যাবে না।
আহনাফ শুয়ে মুখে বালিশ দিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। তখনই তার মনে হলো কেউ তার পায়ের উপর ভর দিয়েছে। সে বালিশ সরিয়ে দেখলো অরুণিকা তার পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কি চাও?”
অরুণিকা ধপ করে লাফিয়ে এসে আহনাফের সামনে বসতেই আহনাফ মাথা তুলে উঠে বসলো৷ অরুণিকা বলল,
“তোমার ফোনটা দাও।”
আহনাফ পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,
“আমার ফোন দিয়ে কি করবে?”
“আমার বন্ধুর সাথে কথা বলবো।”
আহনাফ ফোনটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। অরুণিকা উৎসুক দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ বলল,
“যাও। আমি ঘুমাবো।”
“ফোন দিবে না?”
“না।”
অরুণিকার হাসিমাখা মুখে মুহূর্তেই বিষন্নতা ভীড় জমালো। আহনাফ বলল,
“আচ্ছা, দেবো। আগে বলো, কোন বন্ধুর সাথে কথা বলবে?”
অরুণিকা আনন্দিত কন্ঠে বললো,
“আমার নতুন বন্ধু।”
“নাম কি?”
“বিয়োন। ও ক্লাসে নতুন এসেছে। আমাকে ফোন নম্বর দিয়েছে। বলেছে ফোন করতে।”
“ফোন দেওয়ার কারণ?”
“কথা বলবো, তাই।”
আহনাফ ফোন এগিয়ে দিতেই অরুণিকা নম্বরটি ফোনে তুলে নিলো। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তুমি মুখস্থ করে ফেলেছো?”
“হ্যাঁ, বিয়োন মুখস্থ করে ফেলতে বলেছে।”
ততোক্ষণে অপর প্রান্ত থেকে একটা ছেলের কন্ঠ শুনা গেলো। অরুণিকা সেই কন্ঠের স্বর শুনেই উৎসুক হয়ে বলল,
“বিয়োন, আমি অরুণিকা।”
বিয়োন বলল,
“হাই, কেমন আছো?”
“ভালো। তুমি ফোন করতে বলেছো, তাই ফোন করেছি।”
“এটা কার নম্বর?”
“এটা আহনাফের নম্বর। আমার তো ফোন নেই।”
“আহনাফ কে, ওই তোমাকে সারাদিন বকা দেয় ওইটা?”
আহনাফ চোখ বড় বড় করে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা মনোযোগ দিয়ে বিয়োনের সাথে কথা বলে যাচ্ছে। অরুণিকা উত্তরে বলল,
“না, না। ও আমাকে এখন বকে না। ওর ফোন দিয়েই তো আমি গেইমস খেলি। ও আমার জন্য চকোলেট এনে দেয়। খেলনাও কিনে দেয়৷”
আহনাফ বিড়বিড় করে বলল,
“কতো আহ্লাদ, বাহ! আর এদিকে যত্তোসব বিয়োন-ফিয়োনের সাথে কথা বলতে গিয়ে এই মেয়ে আমার ব্যালেন্স শেষ করে দিচ্ছে।”
অরুণিকার কাছ থেকে ফোন কেঁড়ে নিয়ে আহনাফ বলল,
“আর কথা বলতে হবে না। অনেক বলেছো।”
কল কেটে দেওয়ার পর আহনাফ আবার জিজ্ঞেস করলো,
“কে তোমাকে সারাদিন বকাঝকা করে?”
অরুণিকা মুখে হাত দিয়ে বলল,
“তুমি কিভাবে জানলে?”
আহনাফের ফোনের ভলিউম বড়, তাই স্পিকারে না থাকলেও সব শুনা যায়। আহনাফ বলল,
“জেনে ফেলেছি। এখন বলো কে তোমাকে বকা দেয়?”
“ইভান।”
আহনাফ মুচকি হেসে বললো,
“আর কে তোমাকে বেশি ভালোবাসে?”
অরুণিকা কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“আরাফ আর রকস্টার।”
আহনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো?”
“আরাফ আর রকস্টারকে।”
“আর আমাকে?”
“তোমাকেও ভালোবাসি। সবাইকে ভালোবাসি।”
আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“রকস্টার, রকস্টার, সারাদিন রকস্টার।”
এবার অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“শুনো অরু, ওর একটা নাম আছে। ওর নাম তূর্য৷ রকস্টার না।”
অরুণিকা বলল,
“না, আমি ওর টুংইকেল, ও আমার রকস্টার!”
কথাটা বলেই অরুণিকা ধিন ধিন করে চলে গেলো। আহনাফ সেখানেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে মনে বলল,
“বাচ্চা মেয়েটা বলে কি! এগুলো নিশ্চয় ওই তূর্যের বাচ্চাই ওকে শিখিয়েছে।”
৪৬.
চায়ের দোকানে ভীড় জমেছে। সবাই জড়ো হয়ে প্রেম নিবেদন দেখছে। তাহমিদ, আহনাফ আর তূর্য একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। আরাফের চোখ দুটি স্থির হয়ে আছে। আর ইভান অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাওশিয়াতের চোখ দুটি ছলছল করছে। হয়তো এখনোই অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে। সায়ন্তনীর চোখ দু’টিও ভিজে যাচ্ছে। ইমন তার এক হাত এগিয়ে দিয়ে সায়ন্তনীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। ইমন সায়ন্তনীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি হলো, চুপ করে আছো কেন? তুমি কি আমার হতে চাও না?”
সায়ন্তনী কাঁদোকাঁদো মুখে মাথা নেড়ে ইমনের হাত ধরলো। ইমন শক্ত করে সায়ন্তনীর হাত ধরে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এরপর মাওশিয়াতের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“সেদিন তুমি আমার ভালোবাসা ফিরিয়ে দিয়েছ। আজ আমি তোমাকেই দূরে সরিয়ে দিয়েছি। তুমি আর ভাই, দু’জনই আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ। এখন আমি তোমাদের সামনেই সুখী হয়ে দেখাবো।”
আরাফ আহনাফকে এক পাশে টেনে এনে বলল,
“তুই ইমনের এমন কাজে তালি দিচ্ছিস?”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“সায়ন্তনী হ্যাঁ বলেছে, তো তালি দেবো না নাকি!”
“ইমন সায়ন্তনীকে ভালোবাসে না।”
“তো, কিছুক্ষণ আগে কি হলো এটা!”
“ছেলেটার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। ইভান আর মাওশিয়াতকে দেখানোর জন্য ও এমন অভিনয় করেছে।”
“ও!”
“ও কি! সায়ন্তনী এসব অভিনয় সম্পর্কে কিছুই জানে না। ও তো সব এখন সত্য ভেবেই বসে আছে।”
“তো বলে দিলেই তো সব জেনে যাবে।”
আরাফ রাগী কন্ঠে বললো,
“তুই বুঝতে পারছিস না আমার কথা?”
আহনাফ জোরেই বলল, “না।”
“সায়ন্তনী ইমনকে সত্যিই পছন্দ করে। আর ইমন ওর সাথে অভিনয় করছে, এটা শুনলে ও অনেক কষ্ট পাবে।”
আহনাফ চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“আপতত ইমনের মাথা থেকে মাওশিয়াত বের হলেই হবে। সায়ন্তনী মেয়েটা অনেক ভালো।”
আরাফ আহনাফকে এখনো কিছুই বোঝাতে পারলো না। ইমন এখন যা-ই করছে জেদের বশে করছে। জেদ কেটে গেলে সায়ন্তনী নিশ্চয় অনেক কষ্ট পাবে। কিন্তু ইমনকে এখন বুঝিয়েও লাভ নেই। কারণ সে কারো কথা শোনার মতো ছেলে না। সে নিজে যা বুঝে তাই করে।
এদিকে মাওশিয়াত বাসায় এসে ইচ্ছেমতো কান্নাকাটি করলো। আজ সে ভেবেছিলো ইমনকে বলবে, সেও ইমনকে পছন্দ করে। কিন্তু হঠাৎ ইমন এমন কিছু করে বসবে, তা মাওশিয়াত ভাবতেও পারে নি৷ সে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“যাকেই আমি ভালোবাসি, সেই আমাকে দূরে সরিয়ে দেয়। কেন বার-বার আমার সাথে এমন হচ্ছে?”
কয়েক সপ্তাহ ধরেই সায়ন্তনী আর ইমনের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। সায়ন্তনী এখনো বুঝতে পারছে না, ইমন এসব মাওশিয়াত আর ইভানকে দেখানোর জন্যই করছে। আজ সে সেজেগুজে চায়ের দোকান খুলেছে। ক্লাস শেষে এক কাপ চা খাওয়ার জন্য আরাফ সায়ন্তনীর দোকানে এসেই অবাক হয়ে গেলো। সায়ন্তনী কোন পরিবেশে কেমন সাজ দিতে হয়, তা জানে না। তাই এই মুহূর্তে তাকে দেখতে মোটেও ভালো লাগছে না। আশেপাশের সবাই কেমন যেন বাঁকা চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে। আরাফ পকেট থেকে টিস্যু বের করে, তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমাকে কেমন লাগছে দেখতে? তাড়াতাড়ি মুখটা মুছে ফেলো।”
সায়ন্তনী অবাক হয়ে বলল,
“কেন? অনেক সময় নিয়ে সেজেছি। ইমনের সাথে আজকে বাইরে ঘুরতে যাবো। ও বলেছে, আমাকে এসে নিয়ে যাবে।”
“আমি বলছি তো তোমাকে দেখতে ভালো লাগছে না।”
সায়ন্তনী আরাফের কথা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে চাইছে না। তার মনে হচ্ছে আরাফ তাকে ইচ্ছে করেই মিথ্যে বলছে। সে নিজেই বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আয়না দেখে এসেছিলো। তার মোটেও নিজেকে খারাপ লাগে নি। তখনই মাওশিয়াত তার দোকানে এলো। মাওশিয়াতকে দেখে সায়ন্তনী বলল,
“চা দেবো?”
মাওশিয়াত আরাফের দিকে তাকিয়ে সায়ন্তনীকে বলল,
“আমার তোমার সাথে কথা আছে।”
সায়ন্তনী বলল, “বলো।”
“ইমন, তোমাকে ভালোবাসে না। শুধু শুধু ওর পেছনে সময় নষ্ট করো না।”
সায়ন্তনী মাওশিয়াতের কথা শুনে আবার চা বানাতে লাগলো। মাওশিয়াত সায়ন্তনীর এমন গা ছাড়া ভাব দেখে বলল,
“তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছো না?”
সায়ন্তনী মাথা নেড়ে বলল,
“তোমার কথা বিশ্বাস করলে, সবাই ঠকবে। সেই স্কুল থেকেই দেখেছি, তোমার যা ভালো লাগে, তা তুমি অন্য কাউকে দিতে পছন্দ করো না। এখন তুমি ইমনকে পছন্দ করো, তাই আমাকে নিষেধ করছো। কাল ইভানকে ভালো লাগতো, তাই ইমনকে কষ্ট দিয়েছ।”
মাওশিয়াত মলিন হেসে বললো,
“আমি তখন বোকা ছিলাম। অনেক কিছুই বুঝতাম না। হ্যাঁ, আমার ইভানকে ভালো লাগতো। তাই ইমনকে কষ্ট দিয়েছি। আর আমার তোমার সাথে কোনো বন্ধুত্ব নেই, যার জন্য তোমাকে সাহায্য করতে চাইছি। আমি ইমনকে ভালোবাসি। তাই আমি চাই না, ও এমন কাজ করুক, যার জন্য ও নিজেই অনুতপ্ত হোক।”
ইমন তখনই সায়ন্তনীর দোকানের সামনে এসে মাওশিয়াতকে দেখে নেশা লাগানো কন্ঠে বলল,
“সায়ন্তনী, তোমাকে দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।”
ইমন মাওশিয়াতের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মনে হচ্ছে কোনো রূপকথার রাজকন্যা।”
মাওশিয়াত দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তুমি এসব অভিনয় কখন শিখেছো? তুমি মানুষের অনুভূতি নিয়ে তামাশা করছো।”
ইমন মাওশিয়াতের দিকে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
“তুমি আর ভাই মিলে আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ। তাই অনুভূতি নিয়ে অন্তত তুমি আমাকে কোনো ভাষণ দিও না।”
ইমন সায়ন্তনীকে টেনে দোকান থেকে বের করলো। এরপর একটা ছেলেকে দোকানে বসিয়ে দিয়ে সায়ন্তনীকে নিয়ে চলে গেলো।
আজ অরুণিকার দশ বছর পূর্ণ হয়েছে। ছ’জন মিলেই তার জন্মদিনের আয়োজন করেছে। শতাব্দী, সায়ন্তনী আর মাওশিয়াতও দাওয়াত পেয়েছে। সাথে সুরাইয়া খোকা আর ডুমুরকে নিয়ে এসেছেন। অরুণিকা অনেক জোরাজোরি করছিলো, তাই বিয়োনসহ তার দুই-তিন জন বন্ধুদেরও বিকেলে দাওয়াত দেওয়া হলো।
কেক কাটার পর উপহার নিয়েই অরুণিকার যতো আগ্রহ। সে সবার উপহার খুলে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছিলো। শেষমেশ একটা একটা করে বক্স খুলতে লাগলো। ইমন তাকে একটা খেলনার গাড়ি উপহার দিয়েছিল। সেই গাড়িটা দেখেই শতাব্দী হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। ইমন রাগী কন্ঠে বললো,
“এভাবে হাসার কি আছে?”
শতাব্দী হাসতে হাসতে বলল,
“ছোট সখী, তুমি ইমনের দেওয়া গাড়িতে চড়ে স্কুলে যেও।”
শতাব্দী আবার হাসতে লাগলো। মাওশিয়াত তার দেওয়া উপহারটি এগিয়ে দিয়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করলো। কারণ সে বুঝেছিলো ইমনের উপহার দেখে অরুণিকা তেমন একটা খুশি হয় নি, আর তাই ইমনেরও মন খারাপ হয়ে গেছে। মাওশিয়াত অরুণিকাকে একটা ছোট ব্যাগ উপহার দিয়েছে। অরুণিকা সেটা কাঁধে ঝুলিয়ে বলল,
“সামনে ইদ আসলে আমি এই ব্যাগটাতে আমার সব টাকা রাখবো।”
মাওশিয়াত মুচকি হেসে ইমনের দিকে তাকালো। ইমন মাওশিয়াতের চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিলো। এবার অরুণিকা বাকিদের উপহারগুলো দেখতে লাগলো। সুরাইয়া অরুণিকার জন্য একটা জামা এনেছেন, তাহমিদ হাতের বালা কিনেছে, শতাব্দী দিয়েছে মেকাপ বক্স, আর আরাফ দিয়েছে বড় একটা পুতুল। অরুণিকা পুতুলটা দেখেই আরাফের কাছে দৌঁড়ে গেলো। আরাফ হাঁটু গেড়ে অরুণিকার সামনে বসে বলল,
“পছন্দ হয়েছে?”
“হ্যাঁ, খুব পছন্দ হয়েছে। আমি এখন থেকে ঘুমানোর সময় এটাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো। কেমন?”
“আচ্ছা।”
ইভান তার উপহারটি এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমিও তোমার জন্য স্পেশাল গিফট এনেছি।”
অরুণিকা প্যাকেটটি খুলে দেখলো কয়েকটা বই। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে ইভানের দিকে তাকালো। ইভান বলল,
“এখানে ফল, ফুল, প্রাণি, পাখি, যানবাহন, পোকামাকড় সব কিছুর নাম আছে। এখন থেকে ছুটির দিনে তুমি এক পৃষ্ঠা করে শিখে আমাকে মুখস্থ দেবে।”
অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“না। আমি এটা নেবো না। তুমি নাও তোমার গিফট।”
“ভালো জিনিসের তো কোনো মূল্যই নেই। শুনো, এখন আর তোমার পুতুল খেলার বয়স নেই।”
তাহমিদ ইভানকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আজ অন্তত এসব বন্ধ কর।”
শতাব্দী অনেক কষ্টে নিজের হাসি চাপিয়ে রেখেছে। আরাফ তার দিকে তাকিয়ে ইশারায় তাকে সরে যেতে বললো। শতাব্দীও একপাশে সরে হাসতে লাগলো। ইভান সেটা খেয়াল করে বলল,
“তুমি হাসছো কেন?”
শতাব্দী হাসি আটকে বলল,
“ভাবছি অরুণিকার বিয়ের দিন তুমি ওকে কি গিফট দেবে! কিভাবে সংসারে সুখী হওয়া যায়, এমন বই? মিষ্টি মশাই তাহলে রান্নাবান্নার বই পাবে, যেখানে অনেক ধরণের রেসিপি থাকবে৷ আরাফকে তুমি কঙ্কাল গিফট করবে আর তূর্যকে গানের বই। ইমনকে হয়তো ফুটবলের ইতিহাস আছে এমন বই দেবে। আর আহনাফকে কি স্ক্রু দেবে নাকি জিনিসপত্র ঠিক করার জন্য?”
ইভান ধমকের সুরে বলল,
“চুপ করো তুমি!”
শতাব্দী চুপ হয়ে গেলো। এরপর আহনাফ অরুণিকার হাতে একটা ঘড়ি পরিয়ে দিলো। বলল,
“তোমার গিফট পছন্দ হয়েছে?”
অরুণিকা কিছু বলার আগেই তূর্য এসে বলল,
“টুইংকেল, সারপ্রাইজ!”
তূর্য একটা সাইকেল অরুণিকার সামনে এনে রাখলো। অরুণিকা সাইকেলটি দেখেই আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। সেটা নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আহনাফ চুপচাপ সেদিকেই তাকিয়ে রইলো। আরাফ আহনাফের দিকে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য অরুণিকাকে সাইকেলে বসিয়ে সাইকেলটা চালাতে তাকে সাহায্য করছে। অরুণিকাও উৎসাহ নিয়ে সাইকেলটা চালাচ্ছে। আহনাফ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে বারান্দায় চলে এলো। আরাফও তার পিছু পিছু এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“ও এখনো ছোট! পুতুল, সাইকেল এসব জিনিসগুলো ওকে বেশি আকর্ষণ করবে। তোর ঘড়িটির মূল্য বুঝতে ওর অনেক বড় হতে হবে, আহনাফ।”
“তূর্য কি ইচ্ছা করে এসব করছে?”
“ও তো এতোকিছু জানে না। তুই কি কাউকে জানিয়েছিস এসব?”
“আমি কি ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানাবো? তাহমিদ কি ঢোল পিটিয়ে বলেছে ওর শতাব্দীকে ভালো লাগে? কিন্তু আমরা তো সবাই বুঝে ফেলেছি।”
“শতাব্দীর এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে। অরুর মাত্র দশ বছর পূর্ণ হয়েছে। তোর ওকে ভালো লাগে, এটা সবাই কিভাবে বুঝবে?”
“তাহলে তুই কিভাবে বুঝেছিস?”
“কারণ আমি শুরুর গল্পটা জানি। আর বাকিরা এর মধ্যের অংশটা দেখছে। আর শুরুটা না জানলে, কেউ কিছুই বুঝবে না। তুই কেন অরুকে অপছন্দ করতি? কেন ওর সাথে অকারণে ঝগড়াঝাটি করতি? কেন যতির সাথে জোর করে সম্পর্কে জড়িয়েছিস? কেন এই চুক্তিতে বিনা দ্বিধায় সাক্ষর করেছিস? এসব আমি জানি, আহনাফ। কারণ আমি শুরু থেকেই এসবের সাক্ষী ছিলাম।”
“তুই সেদিন আমার জায়গায় থাকলে কি করতি?”
“বুঝতে পারছি না।”
“আমি অনেক খারাপ অবস্থায় আছি, আরাফ। বিশ্রী একটা চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। নিজেকে কেমন কীট মনে হচ্ছে! কি ভাবছি আমি? কি হচ্ছে আমার সাথে? আমার এই অবস্থার জন্য একমাত্র দাদা-দাদিই দায়ী।”
আরাফ আহনাফকে কিছু বলতে যাবে তখনই ইভান এসে বলল,
“তোরা দুই ভাই এখানে কি করছিস!”
ইভান আসায় আহনাফ নিজেকে স্বাভাবিক করলো। ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তূর্য অরুণিকাকে সাইকেল গিফট করেছে, এটা দেখে তুই বিরক্ত হয়েছিস মনে হচ্ছে!”
আহনাফ আর আরাফ দু’জনই ইভানের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ মনে মনে ভাবল,
“এভাবে সামনে থেকে চলে আসা হয়তো উচিত হয় নি। কেউ যদি এসব জানতে পারে, তাহলে আমাকে নিয়েই হাসাহাসি করবে।”
চলবে-