#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||
৪৮.
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে তাহমিদ যেই না ক্যাবে উঠতে গেলো, তখনই একটা মিনি মাইক্রো তার ক্যাবটাকে জোরে ধাক্কা দেয়। ক্যাবে এক পা থাকা অবস্থায় ধাক্কাটা লাগায় মাইক্রোটা ক্যাবটাকে যতোদূর টেনে নিয়ে গেছে, তাহমিদের শরীরটাকেও ক্যাবটা ততোদূর টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেছে। ইটের রাস্তায় ঘষা খেয়ে তার মুখের বাম পাশ ছিঁড়ে গেছে। বাম হাতের অস্থি ভেঙে গেছে। পা দু’টো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডাক্তার জানিয়েছে, আপতত কয়েক মাস পর দুই পায়ে ভর দিতে পারলেও, সে কখনোই বেশিক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে পারবে না, জোরে হাঁটা তো অসম্ভব। প্রায় পাঁচদিন পর তাহমিদকে রিলিজ দেওয়া হলো। হাস্পাতালের পাঁচদিনের বিল, অপারেশনের খরচ আর তাহমিদের ওষুধের পেছনে তূর্যের পুরো সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে। আহনাফও বাইক কেনার জন্য অনেক মাস ধরেই টাকা জমাচ্ছিলো। সেই টাকাগুলোও তাহমিদের পেছনে খরচ হয়ে গেছে।
এখন পাঁচ জনই পড়াশোনা, কাজ সব বাদ দিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে তাহমিদকে নিয়ে ছোটাছুটি করছে। এদিকে ইভান মাইক্রোবাস চালকের উপর মামলা করে এসেছিলো। এখন এই মামলা চালাতে গেলে, আর কোনো টাকাই অবশিষ্ট থাকবে না। তাই শেষমেশ মামলাটা উঠিয়ে নিতে বাধ্য হলো। মামলা উঠানোর পর বাসায় এসে ইভান চুপ করে বসে রইলো।
মাইক্রোবাসের চালককে তার মালিক ঝামেলায় পড়তে দেন নি। তিনি সম্মানের সাথে তার চালককে ফিরিয়ে এনেছেন, আর ইভান কিছুই করতে পারলো না। মামলা উঠানোর পর থেকেই ঘরে নিরবতা বিরাজ করছে।
অরুণিকাও এখন সেই নিরবতা বুঝতে পারছে। সে ইদানীং তাহমিদের কাজগুলো কাঁচা হাতে করার চেষ্টা করে। অরুণিকা এখন প্রতিদিন সবার কাপড় ভাঁজ করে আলমারিতে তুলে রাখে, ঘরটাও ঝাড়ু দিয়ে ফেলে। এতোদিন তাহমিদই তাকে খাইয়ে দিতো। এখন সে নিজ হাতে খায়। আবার নিজের প্লেট নিজেই ধুয়ে ফেলে। তূর্য আর ইমন এসব দেখে প্রথম কয়েকদিন তাকে আটকাতে চেয়েছিল। আর নিজেরাই সেই কাজগুলো করতে চেয়েছিল। কিন্তু আরাফই তাদের বারণ করেছে। যদিও অরুণিকা এখনো ছোট, কিন্তু তাকে এখন থেকেই নিজের কাজ নিজে করা শিখতে হবে। কারণ আজ তাহমিদের সাথে অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। কাল বাকিরাও যে সুস্থ থাকবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তখন তো অরুণিকাকে একাই চলতে হবে। তাই এখন থেকেই তাকে কাজ শিখতে হবে। সংসারের কাজগুলো বুঝে নিতে হবে।
তাহমিদের পরিবর্তে এখন রান্নার কাজ আহনাফ আর আরাফ ভাগাভাগি করেই করে। মাঝে মাঝে সায়ন্তনী অথবা সুরাইয়া এসে রান্না করে দেন। আবার মাঝে মাঝে মাওশিয়াত আর শতাব্দী নিজেদের বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে আসে।
বিকেলে তূর্য বারান্দায় বসে ছিল। ইমন তার পাশে এসে বসলো। তূর্য ইমনকে দেখেই দুর্বল হয়ে পড়ল। সে ইমনের কোলে মাথা ফেলে দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ইমন তূর্যকে ঝাঁকিয়ে বলল,
“কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে?”
তূর্য চোখ মুছতে মুছতে বলল,
“তাহমিদের জন্য খারাপ লাগছে। এখনো ও দাঁড়াতে পারছে না। হুইলচেয়ারে বসে আছে। আর ওইদিকে ওর এই অবস্থা যেই করেছে, তার কোনো শাস্তিই হলো না!”
ইমন বলল,
“এটাই তো দুর্ভাগ্য। টাকার জন্য মানুষ অনেক নিঃস্ব হয়ে যায়।”
“আমাদের পরিবারের খুনিদেরও এখনো শাস্তি হয় নি। যেখানে আমরা তাহমিদের জন্য এতোটুকু করতে পারলাম না, সেখানে সেই খুনিদের কিভাবে শাস্তি দেবো? আমরা তাদের বিরুদ্ধে কখন প্রমাণ পাবো! কখন আদালতে তাদের শাস্তির রায় হবে? আদৌ রায়টা আমাদের পক্ষে হবে কিনা, এর নিশ্চয়তা নেই।”
তূর্যের কথা শুনে পেছন থেকে ইভান বলে উঠলো,
“কে বলেছে রায় আমাদের পক্ষে হবে না? যখন রায় আমরাই দেবো, সেখানে বিপক্ষে থাকার প্রশ্নই আসে না।”
তূর্য মাথা তুলে ইভানের দিকে তাকালো। ইমনও ইভানের কথা শুনে অবাক হলো। ইভান বলল,
“খুনিদের একমাত্র শাস্তি মৃত্যু। আর তা আমি নিজ হাতে ওদের দেবো। একটা একটা করে সবাইকে খুঁজে বের করে আমিই ওদের মারবো।”
ইমন বলল,
“ভাই, তুই খুন করবি?”
“এটাকে খুন বলে না। ন্যায়বিচার বলে। হত্যার বদলে হত্যা। এটাই তো বিচার। এখনকার বিচার বিভাগের উপর আমার কোনো আস্থা নেই। তাই আমি ওদের নিজ হাতে শাস্তি দেবো। আর ওই মাইক্রোবাস চালককে আইনগতভাবে শাস্তি দিতে পারি নি তো কি হয়েছে। ওর তো আপতত শাস্তি হয়েই গেছে।”
তূর্য বলল, “মানে? কেমন শাস্তি?”
আহনাফ পেছন থেকে এসে বলল,
“হত্যার বদলে হত্যা, আঘাতের বদলে আঘাত।”
ইমন বলল,
“ভাই তোরা কথাটা এভাবে ঘোরাচ্ছিস কেন? সোজাসুজি বল না।”
“আমি আর ইভান মিলে গতকাল ওই লোকটাকে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছি। লোকটা যেই নতুন মাইক্রোটা চালাচ্ছিলো, সেটাও ভেঙে দিয়ে এসেছি। তার লাইসেন্সও পুড়িয়ে ফেলেছি। তার পকেটে যা টাকা ছিল, সব রাস্তায় বসা ভিক্ষুকদের মধ্যে ভাগাভাগি করে দিয়ে চলে এসেছি। ওই লোকটা অন্তত দুই-তিনদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না।”
“লোকটা তোদের দেখে নি?”
“না, আগে মুখে পিপার স্প্রে করেছি। তাই চোখ খুলতে পারে নি৷”
ইভান বলল,
“তাহমিদ যেই কষ্ট পাচ্ছে, সেটার তুলনায় এই শাস্তি খুবই নগন্য ছিল। কিন্তু তবুও এখন একটু শান্তি লাগছে।”
এদিকে শতাব্দী তাহমিদের ঘরে এসে তার পাশে বসলো। তাহমিদ কারো উপস্থিতি পেয়ে চোখ খুললো। শতাব্দীকে দেখে সে উঠে বসতে যাবে, তখনই শতাব্দী তার হাত ধরে বলল,
“দাঁড়াও, আমি সাহায্য করছি।”
শতাব্দী তাকে ধীরে ধীরে বসালো। তাহমিদ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“কখন এসেছো?”
“একটু আগে।”
তাহমিদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হুইলচেয়ারটির দিকে তাকিয়ে রইলো। শতাব্দী বলল,
“মিষ্টিমশাই!”
“হুম!”
তাহমিদ শতাব্দীর চোখের দিকে তাকালো। শতাব্দী তাহমিদের হাত ধরে বলল,
“তুমি খুব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে যাবে।”
“আমাকে আর মিষ্টিমশাই ডেকো না। আমি আর মিষ্টি তৈরী করতে পারবো না।”
“মিষ্টি তো হাতে বানায়। তাহলে কেন তৈরি করতে পারবে না? ব্যথা তো তুমি পায়ে পেয়েছো। হাতে তো এখন আর তেমন ব্যথা নেই।”
“আবার ঘরে বসে মিষ্টি বানানো, তারপর হুইলচেয়ারে বসে রাস্তায় নেমে বিক্রি করা, আমি তো এমন জীবন চাইনি। একটা রেস্টুরেন্টে চাকরি পেয়েছিলাম। ভালোই তো দিন কাটছিল। এখন চাকরিটাও হারিয়ে ফেলেছি।”
“তুমি অন্যের রেস্টুরেন্টে কাজ না করে, নিজেই একটা রেস্টুরেন্ট খুলে বসো।”
“এখন আর এসব সম্ভব না।”
“অবশ্যই সম্ভব।”
“শুধু শুধু মিথ্যে আশা দিও না।”
“আমি কোনো মিথ্যে আশা দিচ্ছি না। আজকালকার সবাই অনলাইনে ব্যবসা করছে। কে বলেছে তোমাকে রাস্তায় নেমে খাবার বিক্রি করতে হবে? তুমি ঘরে বসে রান্না করবে, তারপর ছবিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাড়বে। সেখান থেকেই তোমার খাবারের অর্ডার আসবে। এভাবে একদিন তুমি অনেক বড় ব্যবসায়ী হতে পারবে।”
“এসব এতটাও সহজ না। কেউ টেস্ট না করেই কেন আমার থেকে খাবার কিনবে?”
“আরেহ, টেস্ট না করেই তো সবাই অনলাইন থেকে খাবার অর্ডার করে। তুমি একবার চেষ্টা করে দেখো।”
তাহমিদ মলিন হেসে বলল,
“আগে নিজের পায়ে দাঁড়াই। হুইলচেয়ারে বসে আমার আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখার সাহস নেই।”
শতাব্দী তাহমিদের গালে হাত রেখে বলল,
“আমি তোমার পাশে আছি। তোমার আকাশকুসুম স্বপ্নগুলো খুব শীঘ্রই হাতের নাগালে চলে আসবে।”
তখনই অরুণিকা রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে বলল,
“শতু আপু, তুমি কবে এসেছো?”
শতাব্দী হেসে বলল,
“এই তো একটু আগে। কেমন আছো সখী?”
“ভালো আছি।”
“শুনলাম, মিষ্টি মশাইয়ের ভাগের কিছু কাজ তুমিও করছো?”
অরুণিকা বিছানায় উঠে তাহমিদের পাশে বসে বলল,
“আমি সকালে উঠেই ব্রাশ করে নিজে নিজে স্কুলের ড্রেস পরি, নিজ হাতে নাস্তা করি। আরাফ এখন আর আমাকে জুতো পরিয়ে দেয় না। আমি নিজেই পরতে পারি। এরপর বাসায় এসে সব গুছিয়ে রাখি। আর তাহমিদকে দেখায়। ওর খুব পছন্দ হয়, তাই না?”
তাহমিদ হেসে বলল, “হ্যাঁ, অনেক পছন্দ হয়।”
অরুণিকা হামাগুড়ি দিয়ে টেবিলের উপর থেকে একটা ক্রিম নিয়ে তাহমিদের পায়ের কাছে এসে বসলো। শতাব্দী বলল,
“কি করছো সখী!”
“ডাক্তার বলেছে, প্রতিদিন তিন বেলা পুরো পায়ে এই ক্রিমটা লাগাতে হবে। বিশেষ করে, হাঁটুতে আর গোড়ালিতে। তারপর খুব তাড়াতাড়ি তাহমিদ হাঁটতে পারবে।”
তাহমিদ মুচকি হাসলো আর বলল,
“এই কাজটা অরুণিকা নিয়েছে। ও সময়মত আমাকে ওষুধ খাইয়ে দেয়। পায়ে ক্রিমটা মালিশ করে দেয়। আমাদের অরুণিকা অনেক সংসারী হয়ে গেছে।”
কিছুক্ষণ পর আহনাফ রুমে ঢুকে তাহমিদের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। তখন শতাব্দী বলল,
“আমি বাসায় বলেছি, কয়েকদিন এখানে থাকবো।”
তাহমিদ আর আহনাফ অবাক হয়ে শতাব্দীর দিকে তাকালো। তাহমিদ বলল, “তারপর!”
“কিন্তু মা অনুমতি দিচ্ছে না।”
আহনাফ বলল,
“অনুমতি দেওয়ার কথাও না। তুমি একা উপযুক্ত একটা মেয়ে একটা ব্যাচেলর বাসায় এসে থাকবে, এটা তো সুন্দর দেখায় না।”
অরুণিকা বলল,
“কেন সুন্দর দেখাবে না? আপু আমার সাথে থাকবে।”
“আপু তোমার বোন বা কাজিন হয় না, যে তোমার সাথে থাকতে দেবে।”
তাহমিদ শতাব্দীকে বলল,
“তুমি এখানে কেন থাকার কথা বলেছো?”
শতাব্দী বলল
“কেন আবার? তোমার দেখাশুনা করার জন্য।”
চলবে-