অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৩২||

0
1163

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩২||

৫২.
“দাঁড়াও, মাওশিয়াত। প্লিজ আমার কথাটা তো শুনো।”

“ইমন প্লিজ। আমাকে আর বিরক্ত করো না।”

“আমি ভুল করে ফেলেছি। রাগের মাথায়..”

মাওশিয়াত ইমনকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“নাটক করা বন্ধ করো। তোমার কাছে মানুষের অনুভূতির কোনো মূল্য নেই। সায়ন্তনী তোমাকে ভালোবাসে। তারপরও তুমি ওর সাথে অভিনয় করেছো। আমি শুরুতেই তোমাকে বারণ করেছিলাম। আর আজকে তুমি কি করলে?”

ইমন হাতজোড় করে মাওশিয়াতকে বলল,
“সরি, সরি৷ আর এমন হবে না। প্লিজ, আমার সাথে এমন করো না। আমি তোমাকেই ভালোবাসি। সায়ন্তনীকে না।”

মাওশিয়াত তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আমিও তোমাকে ভালোবাসতাম। কিন্তু এই ইমনকে নয়, আগের ইমনকে। যে মানুষকে সম্মান করতো, যে অভিমানী ছিল ঠিক, কিন্তু জেদি ছিলো না। তুমি আমাকে পরিবর্তন করে এখন নিজেকেই পরিবর্তন করে ফেলেছ? আই এম সরি, ইমন। এখন আমাদের পথ ভিন্ন হয়ে গেছে।”

ইমন মাওশিয়াতের হাত ধরে বলল,
“তুমিও আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছিলে! স্কুলে সবার সামনে আমাকে অপমান করতে। আমি তো সব সহ্য করেছি, শুধু এই আশায় যে তুমি একদিন সব ভুলে আমাকেই ভালোবাসবে। আমার ছোট বয়সের আবেগটা এখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। এই কারণে আমি বুঝতে পারছিলাম না তোমাকে কিভাবে ফিরিয়ে আনবো। আমি ভেবেছি আমাকে সায়ন্তনীর সাথে দেখলে তুমি রিয়েলাইজ করবে যে তুমিও আমাকে ভালোবাসো।”

মাওশিয়াত ইমন থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“প্রতিদিন আর এই তামাশাগুলো সহ্য করতে পারছি না। আমি মানসিক অশান্তিতে আছি। ইভান আর তোমার মধ্যে ঝামেলাটা শুধু আমার কারণে হয়েছে। তাই একটা কথায় বলবো, ইভান তোমাকে অনেক ভালোবাসে। নিজের ভাইকে তুমি এতোদিন অবহেলা করেছো। কিন্তু ও রাত-দিন তোমার কথা ভেবেছে। তোমরা তো সব হারিয়ে ফেলেছে। এখন তুমি কি ভাইকেও হারাতে চাইছ? মানুষ নিজের জীবনটাই ভাইয়ের জন্য ত্যাগ করে দেয়। আর তুমি ভালোবাসা ত্যাগ করতে পারলে না? অন্তত সেই মানসিকতা নিয়ে যদি থাকতে, তাহলে আমি সত্যিই তোমার কাছে ফিরে আসতাম। কারণ ইভান আমাকে ভালোবাসে না। আর আমিও ধীরে ধীরে তোমার গুরুত্ব বুঝতে পারলাম। কিন্তু ইমন, তুমি এখন স্বার্থপর হয়ে গেছ।”

“প্লিজ আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও।”

মাওশিয়াত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“তাহলে সায়ন্তনী?”

ইমন আর কিছুই বললো না। মাওশিয়াত মলিন হেসে সামনের রাস্তায় পা বাড়ালো।

দুই সপ্তাহ দেখতে দেখতেই কেটে গেছে। সবার বাড়িতেই এখব নীরবতা বিরাজ করছে। শতাব্দী সারাদিন বাসায় বসে বসে তাহমিদকে নিয়েই ভাবতে থাকে। বাবা-মাকে সে খুব ভালোবাসে। তাদের কষ্ট দিয়ে তাহমিদকে পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না৷ আর তারা তাহমিদ আর তার সম্পর্ক কখনোই মেনে নেবে না। আর তাহমিদও তাকে ভালোবাসে কিনা এই ব্যাপারে শতাব্দী কিছুই জানে না। এদিকে মাওশিয়াত সারাদিন রুমে একা একা বসে থাকে। ইমন প্রতি ঘন্টায় তিন-চারবার করে কল দেয়। কিন্তু মাওশিয়াত একবারো কল রিসিভ করে না। অন্যদিকে ইমন আর ইভানের মধ্যে সব ঝামেলা মিটে গেছে। কিন্তু তাহমিদের অসুস্থতার জন্য সবার মধ্যেই বিষন্নতা বিরাজ করছে। নতুন করে এক্স-রে করার পর তার আরো সমস্যা দেখা গিয়েছে। এখন পায়ের হাড্ডি মজবুত করার জন্য থেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইভান আর আহনাফ সারাদিন তাহমিদের পেছনেই পড়ে থাকে। আর তাই অরুণিকার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ইমনের উপরেই পড়েছে।
এদিকে সায়ন্তনী দোকান খুলে ইমনের অপেক্ষায় বসে থাকে। দোকানে আগের মতো সবাই আসে, শুধু ইমন আসে না। সে ইমনকে অনেকবার ফোন দিয়েছিল, কিন্তু সে কল রিসিভ করে নি। তবে আরাফ মাঝে মাঝে দোকানে এসে চা খেয়ে যায়। কিন্তু সেদিনের ঘটনার পর সায়ন্তনী আরাফের চোখের দিকে তাকানোর মতো সাহস পাচ্ছে না। তার আরাফের সাথে কথা বলতে খুব লজ্জা লাগছে। আরাফও সেটা বুঝতে পেরে দোকানে যাওয়ায় বন্ধ করে দিয়েছে।

কিছুদিন পর মাওশিয়াত স্বাভাবিক হলো। সে বাসা থেকে বের হলো। অনেকদিন পরই সে কলেজে গেলো। মনে মনে আশা করছিলো যাতে তাকে আর ইভান বা ইমন কারো মুখোমুখিই হতে না হয়। সামনে তার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। ঘরে বসে থাকলে পরীক্ষায় ভালো করতে পারবে না। তার উপর অনেকগুলো ল্যাব করা বাকি।
মাওশিয়াত ক্লাসে ঢুকতেই ইভানের মুখোমুখি হলো। কিন্তু সে ইভানের সাথে কোনো কথা না বলে, ক্লাসে ঢুকে পড়লো। এদিকে ইভান ক্লাস থেকে বের হয়েই ইমনকে ফোন করে মাওশিয়াতের কথা জানালো। ইমনও দেরী না করে ইভানদের কলেজে পৌঁছে গেলো। ক্লাস শেষে মাওশিয়াত কলেজ থেকে বের হওয়ার সময় ইমন তার সামনে এসে দাঁড়ালো। ইমনকে দেখেই মাওশিয়াত চমকে উঠলো। ইমন তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আমাকে কি আরেকটা সুযোগ দেওয়া যায় না? একেবারেই শেষ সুযোগ। আই প্রমিজ, আমি আর এমন ভুল করবো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, মাওশিয়াত। আমি যা করেছি, সেটা আমার ভুল ছিল না, অপরাধ ছিল। প্লিজ আমাকে শেষ সুযোগ দাও। আমি আর কোনো মেয়ের সাথেই কথা বলবো না৷ তুমি ছাড়া কারো দিকেই তাকাবো না।”

ইভান ইমনের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। মনে মনে বলল,
“বাহ, কোনো মেয়ের দিকেই তাকাবে না! দেখা যাক।”

ইমন পাশে ইভানকে দেখে ভ্রূ কুঁচকালো। ইভান হাতের ইশারায় ইমনের কথাগুলো শুনে শব্দহীন তালি দিতে লাগলো। মাওশিয়াত ইমনের চোখ অনুসরণ করে পেছন ফিরতেই ইমন চোখ বড় বড় করে ইভানের দিকে তাকালো। ইভানও মুহূর্তেই স্বাভাবিক হয়ে মুখটা মলিন করে দাঁড়িয়ে রইলো৷ মাওশিয়াত এবার ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সায়ন্তনীর কি হবে?”

ইমন বলল,
“আমি আজ ওকে সব জানিয়ে দেবো।”

“এরপর ও যদি এই সত্যটা মেনে নিতে না পারে?”

ইভান সামনে এসে বলল,
“আমি বোঝাব ওকে।”

মাওশিয়াত ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অভিনয় তো তোমার ভাই করেছে, তাহলে তুমি কেন বোঝাবে?”

ইমন দাঁড়িয়ে বলল,
“আমিই বোঝাব৷ আজই বলবো। প্লিজ, আমাকে একটা সুযোগ দাও।”

“কেন সুযোগ দেবো, বলো?”

“জানি না। সুযোগ দিতে হবে, তাই দেবে।”

মাওশিয়াত ভেংচি কেটে বলল,
“কাল থেকে রোজা শুরু। আমি চাই, আজই সায়ন্তনী সব জানুক। আগামীকাল যাতে সবার জীবনে নতুন সূর্য উঠে এই আশা রাখছি।”

“তুমি কি আমাকে সুযোগ দিচ্ছ?”

মাওশিয়াত মুচকি হেসে বললো,
“ইদে আমার বাসায় তোমাদের দাওয়াত রইলো। অরুণিকা, তোমার বন্ধুদের আর…”

ইভানকে দেখিয়ে বলল,
“তোমার এই ভ্রাতাকেও নিয়ে আসবে। সেদিনই সব উত্তর পাবে।”

ইমন মনে মনে খুশি হলো। কিন্তু মুখে বলল,
“দেখো, মাও‌!”

মাওশিয়াত ‘মাও’ সম্বোধন শুনে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। ইভান হেসে চলে গেলো। ইমন বলল,
“সরি, মাওশিয়াত!”

মাওশিয়াত বুকে হাত গুঁজে বলল,
“ইটস ওকে। মাও নামটা খারাপ না। মিষ্টি একটা নাম।”

ইমন কথাটি শুনে মুচকি হেসে বলল,
“মাও, বলছি কি! ইদ তো আনন্দের দিন। সেদিন এই অবুঝ যুবকটাকে কষ্ট দিও না। ঠিক আছে?”

মাওশিয়াত হাসলো। ইমন বলল,
“আমি কি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেব?”

“না, আমি মামার বাসায় যাবো। পাশেই বাসা। মা আজ ওখানেই আছে। বাসায় কেউ নেই। তুমি সাথে না গেলেই ভালো হবে। নিচে মামার স্টোর আছে একটা। মাঝে মাঝে ওখানে বসেন। উনি দেখলে অনেক প্রশ্ন করবেন। আমি আপতত এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে চাচ্ছি না। তবে সময় হলে উত্তর দিতে আপত্তি নেই।”

মাওশিয়াতের শেষ কথাটি শুনে ইমন খুশি হলো। মাওশিয়াতের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে বাসায় চলে এলো। বাসায় এসে ভাবতে লাগলো, কিভাবে সে সায়ন্তনীকে সত্যটা বলবে!

৫৩.

বিকেলে সায়ন্তনীর দোকানে চায়ের আসর বসলো। তূর্য তাহমিদ আর অরুণিকাকে নিয়ে দোকানে এলো। অনেকদিন পর তাহমিদ ঘোরার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছে। সাধারণত ডাক্তার দেখানোর জন্যই সে বাসা থেকে বের হয়৷ এদিকে তূর্য দোকানে এসেই সবাইকে ফোন করে সায়ন্তনীর দোকানে আসতে বলল। অনেকদিন নিজেদের ব্যস্ততার জন্য বাসায় একসাথে থেকেও আড্ডা দেওয়া হয় না।
এদিকে ইমনও সুযোগ পেয়ে গেলো। সে দেরী না করে দশমিনিটের মধ্যেই দোকানে চলে এলো। সায়ন্তনী ইমনকে দেখে যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেলো। চায়ের কেটলি একপাশে রেখে দৌঁড়ে ইমনের সামনে এসে দাঁড়ালো। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“এতোদিন কোথায় ছিলে?”

তূর্য আর তাহমিদ একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। অরুণিকা হঠাৎ বলে উঠলো,
“জানো, রকস্টার, ওইদিন ইমন সায়ন্তনী আপুকে..”

এতোটুকু বলেই অরুণিকা মুখে হাত দিয়ে হাসলো। ইমন রাগী দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকালে, তূর্য অরুণিকাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলল। তবে তূর্য আর তাহমিদ বাকিদের কাছে এসব শুনেছিল। তখনই দোকানে আহনাফ আর ইভান চলে এলো। তাদের দেখে ইমন আর কিছু বললো না। সে বেঞ্চের উপর গিয়ে বসলো। সায়ন্তনীও কিছু না বলে দোকানে ঢুকে চায়ের কাপ সাজাতে লাগলো। সবাই চুপচাপ বসে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। অরুণিকাও সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো৷ এরপর বিড়বিড় করে বলল,
“সবাই এমন স্ট্যাচু হয়ে গেছে কেন?”

সে এবার ইমনের দুই হাঁটুতে হাত রেখে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “মুভ।”

অরুণিকার এমন কান্ডে ইমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। অরুণিকা বুকে হাত গুঁজে বলল,
“তোমরা সবাই স্ট্যাচু হয়ে গেলে কেন? তোমাদের মাথায় কি বিজলি পড়েছে।”

ইমন বলল, “বিজলি!”

“হ্যাঁ, বিজলি। আমাদের ক্লাসে একটা বিজলি আছে। ও কি বলে জানো? ওর সেদিন জন্ম হয়েছিল, সেদিন বাইরে বিজলি পড়ছিল। তাই ওর নাম বিজলি রাখা হয়েছে। আর বিজলি পড়লে মানুষ নাকি স্ট্যাচু হয়ে যায়।”

অরুণিকা “স্ট্যাচু অব লিবার্টি’র” ভঙ্গিতে দাঁড়ালো। ইভান তার হাত নামিয়ে দিয়ে বলল,
“এখন তুমি কথা কম বলো। আর চুপচাপ বসে থাকো।”

অরুণিকা ইভানের উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে ইভানকে ভেংচি কাটলো। তূর্য আর তাহমিদ তার মুখোমুখি থাকায়, তারা অরুণিকার মুখের ভঙ্গিমা দেখে হাসতে লাগলো। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তোরা হাসছিস কেন?”

অরুণিকা পেছন ফিরে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তূর্য আর তাহমিদের দিকে তাকালো। তারপর ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে ইশারায় তাদের চুপ থাকতে বলল। তারপর তূর্যের কানের কাছে গিয়ে বলল,
“ওদের কিছু বলবে না। ঠিক আছে? ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা।”

তূর্য মুখ চেপে হেসে বলল,
“কি বলছো এগুলো?”

“এখন ওরা ভাববে ওদের নিয়ে কথা বলছি।”

অরুণিকা কথাটি বলেই মুখে হাত দিয়ে হাসলো।

তারপর তাহমিদের কানের কাছে এসে বলল,
“ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা!”

তাহমিদ কানে হাত দিয়ে অরুণিকাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “কি!”

অরুণিকা আবার ফিসফিস করে বলল,
“আরেহ, আমি তো ওদের জ্বালানোর জন্য বলছি। ওরা ভাববে ওদের নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু আমি তো ব্লা ব্লা করছি। বুঝেছো?”

তাহমিদ মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, বুঝলাম।”

অরুণিকা আবার বলল,
“ওরা তিনটাই দুষ্টু ছেলে। ইমনও এখন দুষ্টু হয়ে গেছে। ও এখন ইভানের মতোই আমাকে বকা দেয়।”

ইমন ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“এই ও কি বলছে তোদের কানে কানে?”

অরুণিকা বেঞ্চে পা ঝুলিয়ে বসে বলল,
“বলবো না। এটা আমাদের সিক্রেট।”

আহনাফ অরুণিকার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল,
“আমরাও তোমার ক্লু লেস কথা শুনতে আমরা আগ্রহী নই।”

তখনই আরাফ এলো। আরাফ এসেই অরুণিকার পাশে বসে পড়লো। তারা অনেকক্ষণ টুকটাক কথা বললো৷ তাদের ক্লাসে ঘটা হাস্যকর কথাগুলো ভাগাভাগি করলো। চা-নাস্তাও করলো। এবার ইমন সিদ্ধান্ত নিলো, যাওয়ার আগে সায়ন্তনীকে সব জানিয়েই যাবে। তাই সে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো।

সায়ন্তনীর সামনে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। সায়ন্তনী বলল,
“ইমন, কিছু বলবে?”

এদিকে ইভান ছাড়া বাকিরা উৎসুক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমন বলল,
“আই এম সরি, সায়ন্তনী। আমি তোমাকে ভালোবাসি না।”

ইমনের মুখে এমন কথা শুনে সায়ন্তনীর বুকটা খালি হয়ে গেলো। সে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“কি বলছো, ইমন?”

ইমন বাকি কথাগুলোও সায়ন্তনীকে বলল। সায়ন্তনী সব শুনে বলল,
“আমি তো তোমার সাথে অভিনয় করি নি। আমার ভালোবাসা মিথ্যা ছিল না।”

“আমি জানি। আমাকে ক্ষমা করে দাও, প্লিজ।”

“তুমি কি সত্যিই মাওশিয়াতের সাথে নতুনভাবে সব শুরু করছো?”

ইমন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। সায়ন্তনী ধপ করে বেঞ্চে বসে মুখটা হাত দিয়ে ঢেকে রাখলো। সে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিলো। সে এতোগুলো মানুষের সামনে কাঁদতে চায় না। তবুও পারছিলো না। তার মনে হচ্ছিলো শরীরে আবরণ না থাকলে, সব ছিঁটকে বেরিয়ে পড়তো। তার গলাটা ভারী ভারী লাগছিল। ভালোভাবে নিঃশ্বাসও ফেলতে পারছিলো না। অরুণিকা ধীর পায়ে সায়ন্তনীর সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর ইমনের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বলল,
“তুমি একদম ভালো না। তুমি আপুকে কাঁদালে কেন? তুমি জানো, আপু কত ভালো?”

ইমন হাঁটু গেড়ে সায়ন্তনীর সামনে বসে পড়লো। বলল,
“আমি অনেক বড় অপরাধ করেছি হয়তো…”

সায়ন্তনী মাথা তুলে ছলছল চোখে ইমনের দিকে তাকাতেই ইমন কথা থামিয়ে দিলো। সায়ন্তনী বলল,
“অপরাধ করো নি। পাপ করেছো। আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবে না। আমার মা আর ভাই ছাড়া কেউ নেই। আমার মা মুসলিম, বাবা হিন্দু ছিলো। তারা সবার বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করেছিল। তারপর বাবা একদিন আমাদের রেখে চলে যায়। সবার বিরুদ্ধে গিয়ে তারা বিয়ে করেছিলো, তাই দাদা-নানার পরিবারের কেউই আমাদের মেনে নেয় নি। তারপর থেকে আমাদের জায়গা বস্তিতে হয়েছিল। আমি কোনো ধর্মই পালন কর‍তাম না। আমি কখনোই ভাবি নি আমার জীবনে ভালোবাসা আসবে। ভালোবাসার জন্যই তো আজ এতো কষ্ট হচ্ছে আমাদের। এরপর তোমাকে ভালো লাগার পর মাকে বললাম, আমি মুসলিম হবো। মাও তা-ই চাইতো। এরপর ধর্মান্তর হওয়ার পর আল্লাহর কাছে তোমাকে চাইতাম। পেলামও। কিন্তু এভাবে তো পেতে চাই নি।”

“সরি, সায়ন্তনী!”

“সরি? এই দোকানে বসেছি। আজ পর্যন্ত কেউ স্পর্শ করতে পারে নি আমাকে। তুমি তো আমার শরীরে দাগ লাগিয়ে দিয়েছ, ইমন।”

ইভান বলল,
“কি বলছো এসব সায়ন্তনী? এগুলো এখন খুব স্বাভাবিক!”

আরাফ ইভানকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তুই চুপ কর।”

সায়ন্তনী ইভানের সামনে এসে বলল,
“তোমাদের মতো পুরুষের কাছে স্বাভাবিক। আমাদের মতো মেয়েদের কাছে অনেক বেশি কিছু। ভালোবাসার অর্থই প্রেমিকাকে স্পর্শ করা না। আমি এটাই শিখেছি। কিন্তু দোষ তো আমার। আমিই বাঁধা দেই নি। কারণ আমি তো ভাবতাম, অন্তত ইমন প্রতারণা করার মতো ছেলে না। কিন্তু সব প্রতারকই তো ভালো সেজেই প্রতারণা করে।”

ইমন বলল,
“প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করে দাও, সায়ন্তনী।”

“না, ইমন। আমি তোমাকে আটকাবো না। তুমি চলে যাও। আমার সামনেও আর এসো না। কিন্তু আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারবো না। কারণ আমি অভিনয় করি নি। ভালোবেসেও অভিনেত্রীর খেতাব পেয়েছি, শুধু তোমার জন্য। এখন যাও এখান থেকে। আর এই দোকানের আশেপাশে আসবে না।”

অরুণিকা সায়ন্তনীর হাত ধরে বলল,
“আপু, তুমি রাগ করো না।”

সায়ন্তনী হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“যাও, তুমিও। আমি চাই না আমার কষ্টগুলো তোমার উপর আসুক। কিন্তু সত্য তো এটাই, মেয়েরাই এই সমাজে বেশি প্রতারিত হয়। তোমার সাথে এমন…”

ইমন সায়ন্তনীকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“প্লিজ, সায়ন্তনী। তুমি খারাপ কথা বলো না।”

ইভান রাগী কন্ঠে বললো,
“তুমি এসবের মধ্যে অরুণিকাকে কেন টেনে আনছো?”

সায়ন্তনী বলল,
“আমি শুধুই উদাহরণ দিলাম। এতেই এতো খারাপ লাগছে? তাহলে ভাবো, সত্যটা তো আমার সাথে ঘটেছে। আমার কেমন লাগছে?”

তূর্য অরুণিকার হাত ধরে ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর তামাশাগুলো তুই একাই শেষ কর।”

আরাফ আর ইমন ছাড়া সবাই চলে গেলো। সায়ন্তনী বলল,
“তোমরাও যাও।”

ইমন চলে যেতেই আরাফ সায়ন্তনীর কাছে এসে বলল, “সায়ন্তনী!”

“কিছু কি বলার বাকি আছে?”

“জীবনকে কি আরেকবার সুযোগ দেওয়া যায় না? আমি….”

“প্লিজ, আরাফ। যাও। আমি আর নিতে পারছি না।”

আরাফ মাথা নেড়ে চলে গেলো। আরাফ চলে যাওয়ার পর সায়ন্তনী দোকান বন্ধ করে ভেতরে ঢুকে ডুঁকরে কেঁদে উঠলো। দুই হাত তুলে বলল,
“আমি তোমার কাছে ইমনকে চেয়েছিলাম, এখনো সেই চাওয়া থেমে থাকবে না। আমি আমার ভালোবাসা ভিক্ষা চাই। আমি জোর করবো না। কাউকে জোর করবো না। কিন্তু এমন কি হওয়া সম্ভব না, ও নিজেই আমার কাছে ফিরে আসবে?”

সায়ন্তনী কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি ওকে কিভাবে ভুলে থাকবো? কিভাবে মেনে নিবো যে এসব অভিনয় ছিল? আমি তো অভিনয় করি নি। ভালোবেসেছিলাম। খুব ভালোবেসেছিলাম।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here