#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৪||
৭৪.
শতাব্দী বিয়ের শাড়ি পরে চুপচাপ বসে আছে। তার এক আত্মীয় তার হাতে শাঁখা পরিয়ে দিচ্ছে। এদিকে বাড়ি ভর্তি অতিথি ভীড় করেছে। মাস্টারমশাই বিশেষভাবে নিমন্ত্রণ দিয়েছেন তাই ছ’জনই অরুণিকাকে নিয়ে বিয়েতে এসেছে। এদিকে তাহমিদ একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ ঢাক-ঢোল বাজানোর শব্দ কানে এলো। সবাই ‘বর এসেছে, বর এসেছে’ বলে শোরগোল ফেলে দিলো। মেয়েরা এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। তাহমিদ এক দৃষ্টিতে তার চন্দ্রিমার হবু বরের দিকে তাকিয়ে আছে। বিরাজ কুমার, একজন সেনা অফিসার। তাকে দেখে তাহমিদ প্রশান্তির হাসি হাসলো। কারণ তার চন্দ্রিমার রাজপুত্র তার চেয়ে যোগ্যতায় অনেক ঊর্ধ্বে। সে মনে মনে ভাবলো,
“আমার চন্দ্রিমা তো রাজপুত্র পেয়েছে। এখন আর কিসের চিন্তা!”
শতাব্দীর মা মিতুবালা হবু জামাতাকে বরণ করে নিলেন। শ্রীজা বোনের কাছে এসে বলল,
“দিদি, বর এসেছে।”
শতাব্দী ধরা কন্ঠে বলল,
“তোর তাহমিদ দাদা ছিল ওখানে?”
শ্রীজা ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “হ্যাঁ।”
“তাহলে নিশ্চয় আমার হবু বরকে দেখেছে, তাই না!”
“হ্যাঁ, দেখবেই তো।”
শতাব্দী মলিন হাসি দিয়ে বলল,
“ওর জন্য তো আজ খুশির দিন। নিশ্চয় খুশি হয়েছে!”
শ্রীজা আর কিছু বললো না। এদিকে বিয়ের সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। তাই বরকে বিবাহ মণ্ডপে বসানো হলো। শতাব্দীকেও আনা হলো। পান পাতার আড়ালে ঢেকে আছে শতাব্দীর মুখ। শুধু মেহেদি রাঙা হাত দু’টিই চোখে পড়ছে। তাহমিদ শতাব্দীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার নিজেকে খুব নিঃস্ব মনে হচ্ছে। চোখ দু’টিও জ্বালা করছে। কিন্তু কাঁদতে পারছে না। সে কেনই বা কাঁদবে? সে এটাই তো চেয়েছিল!
এদিকে শতাব্দীকে বসানোর পর সে ভীড়ের মাঝে তাহমিদকে খুঁজতে লাগলো। আর তাহমিদ নিজেকে আড়াল করে নিলো। মালাবদল হয়ে যাওয়ার পর মাওশিয়াত ইমনকে বলল,
“আমি এখন যাই। এতোক্ষণ থাকতে পারবো না।”
ইমন বলল,
“চলো, আমি তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি।”
“তুমি একা আসবে আমার সাথে? অন্য কাউকে সাথে নিয়ে আসো। কারণ আমাকে নামিয়ে দেওয়ার পর তুমি তো একাই হয়ে যাবে। একা একা ওই বাসায় ফিরবে নাকি!”
তূর্য তাদের কথা শুনে বলল,
“আমার এখানে ভালো লাগছে না। আমি বাসায় যাবো। চল, ইমন। আমিও তোর সাথে যাবো।”
ইমন বলল,
“তুই থাক। শতাব্দীর সাথে তোর ভালোই বন্ধুত্ব ছিল। এভাবে চলে যাবি?”
“তো কি করবো? এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাহমিদের বিধ্বস্ত মুখ দেখবো? দেখ কিভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মধ্যে আল্লাহ এতো ধৈর্য কিভাবে দিয়েছে? আমি ওর জায়গায় হলে হয়তো শতাব্দীকে উঠিয়ে নিয়ে যেতাম, নয়তো বিয়েতেই আসতাম না।”
ইমন আর তূর্য মাওশিয়াতকে বাসায় পৌঁছে দিতে গেলো। এরপর সেখান থেকেই তারা বাসায় চলে যাবে।
এদিকে মাস্টার মশাই কন্যা সম্প্রদান করে তাহমিদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। আর বললেন,
“মেয়েটা আমার, সুখে থাকুক, এটাই চাই।”
তাহমিদ মুচকি হেসে বললো,
“সুখে থাকবে, মাস্টার মশাই। ও তো লক্ষী একটা মেয়ে।”
মাস্টার মশাই তাহমিদের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“শতাব্দী কি তোমায় বিয়ের আগে কিছু বলেছিল?”
তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে মাস্টার মশাইয়ের দিকে তাকালো। তিনি আবার বললেন,
“জানি বলেছে। তোমার চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বাবা, তুমি আমার বিশ্বাস রেখেছো, তার জন্য তোমাকে কোটি কোটি ধন্যবাদ। তুমি আমার মেয়েটাকে গ্রহণ করলে, আমার অনেক সম্মানহানি হতো। শতাব্দী আমার বড় মেয়ে, এরপর পুচকিকেও বিয়ে দিতে হবে। মহল্লায় আমার একটা সম্মান আছে। আজ সব তুমিই রক্ষা করেছ।”
তাহমিদ এই মুহূর্তে কথা বলার ভাষায় হারিয়ে ফেললো। মাস্টার মশাই আবার বললেন,
“শতাব্দী তার মাকে তোমার কথা বলেছিল। এরপর মিতুই আমাকে বলেছে কিছু একটা করার জন্য। কিন্তু আমি বিশ্বাস নিয়ে বলেছিলাম, তুমি আমার মেয়েকে নিয়ে কোথাও যাবে না। ও তো বোকা মেয়ে। কিন্তু তুমি তো বুদ্ধিমান। দেখো, তুমি আমার কথা সত্য প্রমাণ করে দিয়েছো। আর তুমি আজ এসে আরো ভালোভাবে শতাব্দীকে বুঝিয়ে দিয়েছ, তুমি এই বিয়েতে অনেক খুশি। এখন আমার মেয়েটা নতুন সংসারে মন দিতে পারলেই হলো।”
মাস্টার মশাই কথাগুলো বলেই চলে গেলেন। তাহমিদের চোখ দু’টো ছলছল করছিল। আশেপাশের মানুষের বিশ্বাস আর সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে, সে তো নিজের মনকেই ভেঙে গুঁড়ো করে দিয়েছে। আর আজ সেটা তার কাছে সম্মানের পরিবর্তে কাঁটা হয়ে গেছে। লোকে বলে মহৎ কাজের পর আত্মিক প্রশান্তি আসে। আর তাহমিদের ক্ষেত্রে তো উল্টোটাই হচ্ছে। এখন তার আত্মার আর্তনাদ বাড়ছে। আর সেই আর্তনাদ একমাত্র সে নিজেই শুনতে পারছে।
বিরাজ কুমার শতাব্দীর সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়ার আগেই শতাব্দী শেষবার চোখ জোড়া উঠিয়ে ভীড়ের মাঝেই তাহমিদকে খুঁজতে লাগলো। তাহমিদ এবার সামনে এলো। তাদের চোখাচোখি হতেই তাহমিদ মুচকি হাসলো৷ আর শতাব্দীর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সবাই হয়তো তা দেখে ভাবলো, নতুন জীবন শুরুর আনন্দে এই অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কে জানতো, সেই ভীড়ে তখন দু’টো আত্মার বিচ্ছেদ হচ্ছিল! শতাব্দীর মুখ বরাবর ঘোমটা টেনে দিতেই তাহমিদ মাথা নিচু করে নিলো। আরাফ তাহমিদের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“বিয়ে শেষ হতে তো অনেক সময় লাগবে। আমি আর আহনাফ অরুকে নিয়ে চলে যাচ্ছি, তুই কি থাকবি ইভানের সাথে?”
তাহমিদ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“না, আমি থাকবো না। দাঁড়া, ইভানকে একা রেখে না যাওয়ায় ভালো।”
ইভান মাস্টার মশাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরেই গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আহনাফ। গাড়ি মহল্লা থেকে বের হতেই পাশের অন্ধকার গলি থেকে বের হয়ে একটা কোট পরা ব্যক্তি, তার ফোন কানের কাছে নিয়ে বলল,
“তাহমিদ ওর বন্ধুদের নিয়ে চলে গেছে।”
মুরশিদ জুবাইয়ের জানালার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি ফোনে থাকা লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“শুনো, কেউ একজন ওদের উপর নজর রাখছে৷ তুমি ওদের কাছাকাছি থাকবে। তাহমিদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়।”
“স্যার, আপনি চিন্তা করবেন না। আমাদের টিম ওদের দিকে নজর রাখবো।”
মুরশিদ জুবাইয়ের ফোন রেখেই মনে মনে বললেন,
“রহমত সাহেবকে এই বিষয়ে কিছুই জানানো উচিত হবে না। লোকটাকে দিন দিন খুব সন্দেহ হচ্ছে। তিনি ছাড়া তাহমিদ আর ওর বন্ধুরা কোথায় থাকে, এটা কেউই জানে না৷ তাহলে সেদিন ওদের বাসার সামনে কে গিয়েছিল? কে তাদের উপর নজর রাখছে?”
মুরশিদ জুবাইয়ের বিড়বিড় করে বললেন,
“ভাগ্যিস, বিক্রমের মাধ্যমে আমি এই ব্যাপারটা জানতে পেরেছিলাম। ওকে একটা ফোন দেওয়া উচিত।”
মুরশিদ জুবাইয়ের বিক্রমকে ফোন করতেই বিক্রম বলল,
“আংকেল, কেমন আছেন?”
“ভালোই আছি। তোমাকে ধন্যবাদ, তুমি আমাকে তাহমিদের কথা জানিয়েছ।”
“কি যে বলেন, আংকেল। এটা আমার দায়িত্ব। আফটার অল, আপনি আমাদের পরিচিত মানুষ। বাবার সাথে আপনার ওঠাবসা ছিল। আর আপনি পরিচয় না দিলে আমি তো জানতামই না, তাহমিদ আপনার বোনের ছেলে।”
“হ্যাঁ। আমার এক পরিচিত লোক আছে, সে-ই বলেছিল তুমি নাকি অরুণিকার কেইস নিয়েছিলে। তারপর তোমার ডিটেইলস নিয়ে জানলাম, তুমিই সেই বিক্রম। আচ্ছা, তুমি কিন্তু তাহমিদের সাথে যোগাযোগ রাখবে।”
“জ্বি আংকেল, আমি ওকে মাঝে মাঝে ফোন দেই। যখন থেকে জেনেছি, ও আপনার ভাগ্নে আরো ভালোভাবেই কথাবার্তা হয়। তবে ও জানে না, আমি আপনার বলাতেই ওর সাথে যোগাযোগ রাখি।”
“আরেহ, এটা আবার ওকে বলতে যেও না।”
“না, না বলবো না। চিন্তা করবেন না।”
৭৫.
“আমি দেশে যাচ্ছি।”
তূর্যের এমন কথায় সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। আহনাফ বলল,
“মাস্টার্সে ভর্তি হবি না?”
“হবো, কিন্তু আপতত কিছু দিনের জন্য দেশে যাব।”
তাহমিদ বলল, “কিন্তু কেন?”
“আছে একটা কারণ।”
ইমন মুখে পাউরুটি নিয়েই বলল,
“দামপাড়ার ওই মেয়েটার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে হয়তো।”
ইমনের কথা শুনে তূর্য তাকে ব্যাঙ্গ করে বলল,
“দামপাড়ারা ওই মেয়েটার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে হয়তো।”
ইমন পানি দিয়ে পাউরুটি গিলে বলল,
“ওই তুই আমাকে ভেঙ্গাচ্ছিস কেন? আমি যেটা সত্য সেটাই বলছি।”
আরাফ জোর গলায় বলল,
“সকাল সকাল ঝামেলা করিস না তো। আগামী মাসেই আমরা বাসা চেঞ্জ করবো। আর তুই বলছিস দেশে যাবি।”
তূর্য বলল,
“আমি একা যাবো। তোদের নিয়ে যাবো নাকি!”
ইভান বলল,
“আর আমরা তোকে একা দেশে যেতে দেবো?”
“ভাই, তোরা বাসা চেঞ্জ করলে কর। আমি দেশে যাবো। আমি মেয়েটাকে কথা দিয়েছি। ও বার-বার রিকুয়েষ্ট করছিল।”
ইভান কিছু একটা ভেবে বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমাদের কলেজ থেকে একটা ট্যুরে নেবে বলেছে। আমি ভাবছি, সেই ট্যুরে না গিয়ে তোর সাথে দেশে যাবো।”
ইমন মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, আর আমরা এখানে ফার্নিচার নিয়ে টানাহেঁচড়া করবো!”
আরাফ বলল,
“ঠিক আছে, ওরা না হয় যাক। তুই তো এমনিতেই কোনো কাজ করিস না। সারাদিন মাওশিয়াতের সাথেই কথা বলিস। তূর্য আর ইভানের ভাগের কাজ করে, তুই পুরোনো কাজের মাশুল দিয়ে দিস।”
“আরাফ, তুই তো মারাত্মক জালিম। এভাবে আমাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিলি? আমি কিন্তু তাহমিদের সাথে দেশে গিয়ে অনেক কাজ করেছি।”
আহনাফ বলল,
“হ্যাঁ, মহান কাজ করেছিস। অর্ধেক সময় আমাকেই ল্যাপটপে বসিয়ে রেখেছিস। আর শুন, আমি মাওশিয়াতের চাচার সাথে ওই গাড়ির মালিকের খবর নেওয়ার জন্য অনেক দৌঁড়াদৌঁড়ি করেছিলাম।”
ইভান চেঁচিয়ে বলল,
“চুপ করবি তোরা? তোদের সমস্যা কি? তোরা চারজনই সারাদিন ঘরে যতো ঝামেলা বাঁধাস। বাসায় তো আমরা সারাদিন তোদের উদ্ভট কথা শুনার জন্যই বসে থাকি, তাই না? আমাদের তো আর কোনো কাজ নেই।”
তাহমিদ বলল,
“ঠিক বলেছিস, ইভান। তবে আমাদের ব্যাচেলর সংসার নিয়ে আলাদা পত্রিকা বের হলে, প্রতিদিন শিরোনামে আসতো, ‘আজ ইমন আর মাওশিয়াতের ঝগড়া, তাই সারাদিন ইমন কিছুই খায় নি।’ ‘বিশেষ শিরোনাম: তূর্য আর ইমনের ঝগড়া লেগেছে, তূর্য আজ ইমনকে রুম থেকে বের করে দিয়েছে।’ ‘চলছে আহনাফ, তূর্য আর ইমনের ত্রিকোণ ঝগড়া, কে হবে এই ঝগড়ায় জয়ী?’ ‘আজ আবার অরুণিকার সাথে আহনাফের মারাত্মক মারামারি, মারামারির এক পর্যায়ে অরুণিকা তার নখ দিয়ে আহনাফের মুখ ছিঁড়ে দিয়েছে, পরিস্থিতি সামলাতে মাঠে নামলেন আরাফ চৌধুরী।'”
অরুণিকা বলল,
“তাহমিদ, ওইটাও থাকবে, কেমন! আজ আহনাফ বাথরুম থেকে বের হতেই ধপাস করে নিচে পড়ে গেছে।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আর তুমি যে দু’দিন আগে ঘুমাতে ঘুমাতে বিছানা থেকে নিচে পড়ে গিয়েছিল, ওইটা তো সবার আগেই থাকা দরকার।”
“আর তুমি যে ডাস্টবিন থেকে ঘড়ি নিয়ে পরেছিলে, ওইটাই প্রথম শিরোনাম হওয়া উচিত।”
“আর তুমি যে স্কুলে যাওয়ার সময় ড্রেনে পড়ে গিয়েছিলে, ওইটা তো বড় বড় করে শিরোনামে আসা উচিত।”
অরুণিকা এবার নাক ফুলিয়ে বলল,
“তুমি যে উলটো প্যান্ট পরে বের হয়েছিলে, সেইটা শিরোনামে আসা উচিত।”
আরাফ চেঁচিয়ে বলল,
“চুপ, একদম চুপ। তাহমিদ তোর সমস্যা কি!”
তাহমিদ চোখ ছোট করে বলল,
“আমি আবার কি করলাম।”
ইভান বলল,
“আগুনে ঘি ঢেলেছিস শুধু। আর কিছুই করিস নি।”
আহনাফ বসা থেকে উঠে চলে গেলো। অরুণিকা আহনাফকে যেতে দেখে পায়ের উপর পা তুলে বলল,
“বালা টালি।”
অরুণিকার কথা শুনে আরাফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। অরুণিকা ঠোঁটে এক আঙ্গুল রেখে ইশারায় বুঝালো, সে আর কোনো কথা বলবে না।
তিন সপ্তাহ পর।
আজ তূর্য আর ইভান বাংলাদেশে এসেছে। তারা ঢাকায় দুই দিন থেকে চট্টগ্রামে চলে এলো। চট্টগ্রাম আসার পর নিজেদের পুরোনো পরিত্যক্ত বাড়িতে গেলো। এরপর ভালো মানের একটা হোটেলে উঠলো। তূর্য উপমাকে মেসেজ করে বলল,
“আমি বাংলাদেশে এসেছি।”
উপমা মেসেজ দেখে খুশিতে লাফাতে লাগলো। সে তাড়াতাড়ি উত্তর দিলো,
“আজ মা নানুর বাসায় যাবে। এরপর আমি বিকেলে বের হবো।”
“আচ্ছা।”
“রিকি, আমি তোমাকে কিভাবে চিনবো?”
“আমি আমার সেই গিটারটা নিয়েই আসবো।”
“নতুন কিনেছিলে ওইটা?”
“হ্যাঁ।”
উপমা ভার্সিটির ক্লাস করে বের হবে, তখনই তার এক বান্ধবী এসে বলল,
“চল, মেলায় যাবো। স্টেডিয়ামের পাশে মেলা বসেছে।”
উপমা বলল,
“না, আমার একটা কাজ আছে।”
“হ্যাঁ, আমরা তো ভুলেই গেছি। তুই তো ঘরে বসে ডিম পারিস। তোর আর কোথাও যাওয়া লাগবে না। তুই ডিম পার।”
উপমা মনে মনে বলল,
“আজ তো ঘরে বসে ডিম পারবো না। আজ তো আমার স্টার আসবে।”
উপমা বাসায় এসেই আলমারি খুলে বসে আছে। কি পরবে কিছুই বুঝতে পারছে না। অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করার পর তার মনে হলো, শাড়ি পরলেই ভালো লাগবে। কারণ হুমায়ুন আহমেদ বলেছিলেন,
“সাদা শাড়ি পরে মেয়েরা অনায়াসে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার সাথে মিশে যেতে পারে।”
উপমার হুমায়ুন আহমেদের এই উক্তি মনে পড়তেই সে সাদা শাড়ি বের করে পরে নিল। কপালে একটা কালো টিপ লাগিয়ে সে আয়নায় নিজেকে দেখে বলল,
“রিকি, মাই স্টার, আজ আমি তোমার জন্য সেজেছি। আজ আমি আমার জীবনের সেরা কাজটা করবো। সবসময় তো ছেলেরাই মেয়েদের ভালোবাসার কথা বলে। কিন্তু আমার ভালোবাসার গল্পটা উলটো হবে। আমিই তোমাকে আমার মনের কথা বলবো।”
এদিকে তূর্য ইভানকে নিয়ে উপমার বলা জায়গায় চলে এলো। ইভান তূর্যের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। তূর্য বলল,
“এভাবে কি দেখছিস?”
“তুই সত্যি প্রেমে পড়েছিস, ভাবতে অবাক লাগছে।”
তূর্য অবাক হয়ে বলল,
“প্রেমে পড়েছি! তোকে কে বলল, আমি প্রেমে পড়েছি?”
“তো! এখানে কেন এসেছিস?”
“আমার ভক্তের সাথে দেখা করতে।”
ইভান রাগী কন্ঠে বললো,
“তূর্য আমি তোর মাথা ফাঁটিয়ে এখান থেকে যাবো।”
“সত্যি ইভান। আমি তো জাস্ট….জাস্ট এমনিতেই।”
“জাস্ট এমনিতেই কি? তাহলে তুই মেয়েটাকে ভালোবাসিস না?”
তূর্য হেসে ভাব নিয়ে বলল,
“তূর্য মেয়েদের প্রেমে পড়ে না। মেয়েরা তূর্যের প্রেমে পড়ে।”
“তোর এই পিঠ এখনো অক্ষত আছে কেন জানিস?”
“কেন?”
“কারণ আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি। এই কথা ইমন, তাহমিদ বা আরাফ শুনলে, তোকে এখানেই পিটিয়ে দম নিতো।”
হঠাৎ সাদা শাড়ি পরা একটা মেয়েকে লাল গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তূর্য নির্বাক হয়ে গেলো। ইভান তূর্যের চোখ অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই দেখলো উপমা দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। তূর্য তাদের উপমার ছবি দেখিয়েছিল। কিন্তু মেয়েটা ছবির চেয়েও বেশি সুন্দর। ইভান তূর্যকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
“এখন হাঁ করে আছিস কেন? কিছুক্ষণ আগে কতো সুন্দর ভাষণ দিচ্ছিলি, তূর্য মেয়েদের প্রেমে পড়ে না। মেয়েরা তূর্যের প্রেমে পড়ে।”
“এটাকে প্রেমে পড়া বলে না। এটাকে চোখ দিয়ে দেখা বলে। আমি ওকে দেখছি। প্রেমে পড়ছি না।”
তূর্য উপমার সামনে এসে দাঁড়াতেই উপমা অবাক হয়ে গেলো। উপমা কিছু বলার আগেই তূর্য বলল,
“আমি জানি, আমাদের আগেও দার্জিলিং দেখা হয়েছিল। সেদিনই তুমি তোমার স্টারকে দেখেছিলে, অথচ চিনতে পারো নি। আর আজ আমি পরিচয় নিয়ে তোমার সামনে এসেছি। হাই, আমি আসলে রিকি নই। রিকি আমার ছদ্মনাম, আমার আসল নাম তূর্য আহমেদ।”
উপমা এখনো হাঁ করে তাকিয়ে আছে। তূর্য তার চোখের সামনে হাত নাড়াতেই সে ফুলটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“হাই, স্টার, আই মিন, তূর্য। এটা তোমার জন্য।”
তূর্য মুচকি হেসে ফুলটা নিতেই উপমা মনে মনে বলল,
“ইয়া আল্লাহ, তার মানে আমি আমার স্টারকে সেদিনই দেখেছিলাম? আর আজ সে আবারও আমার সামনে? এতো সুন্দর ছেলে, আমার প্রেমে কিভাবে পড়েছে? থাক, ভালোই হয়েছে। এখন বাবা-মাকে সহজে রাজি করানো যাবে। আমার স্টার তো সব দিক দিয়েই পারফেক্ট।”
তূর্য বলল, “কি ভাবছো?”
উপমা মুচকি হেসে বলল, “কিছু না।”
ইভান সামনে এসে তূর্যকে বলল,
“ভাই, তুই ওকে নিয়ে বস। আমি ওদিকটাই যাচ্ছি।”
“আচ্ছা। আর উপমা, মিট মাই ফ্রেন্ড, ইভান।”
উপমা বলল, “হাই, ভাইয়া।”
ইভান মুচকি হেসে বললো,
“হ্যালো। তোমরা বসো আমি একটু ওদিকে যাচ্ছি।”
ইভান যেতেই তূর্য উপমাকে বলল,
“চলো। স্টেডিয়ামের ওদিকে মেলা হচ্ছে দেখলাম৷ ওখানেই যাই। গল্প করাও হবে, ঘুরাঘুরিও হবে।”
উপমা ভীত কন্ঠে চেঁচিয়ে বললো, “না, না, না।”
তূর্য অবাক হয়ে বলল, “কোনো সমস্যা?”
“চলুন না, আমরা সামনের রেস্টুরেন্টেই বসি।”
“ওকে।”
চলবে-