#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৯||
৮১.
কলকাতায় এসে মাওশিয়াতের বাবা-মা, মিরাজ হাসান আর তিশা হাসানের সাথে দেখা করলেন উপমার বাবা-মা। ছেলের তো একজন অভিভাবক প্রয়োজন। অভিভাবক ছাড়া মেয়েকে ছেলের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব না। মূলত উপমার জোরাজুরিতেই তারা এই সম্পর্কে আগাচ্ছেন। নয়তো মেয়েকে এমন অনিশ্চিত জীবনে ঠেলে দেওয়ার কোনো ইচ্ছেই তাদের ছিল না। তবে করিম সিদ্দিক আর মিসেস জুলেখার তূর্যকে পছন্দ হয়েছে। তারা সবাই কথাবার্তার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিলেন দুই মাস পর একেবারে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করবেন।
এদিকে তূর্য কলকাতায় ফেরার পর থেকে অরুণিকা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। তূর্য তার আশেপাশে এলেই সে দূরে চলে যাচ্ছে। আহনাফের বিষয়টা একদমই পছন্দ হচ্ছে না। সে ভয়ে আছে, অরুণিকার এমন হাবভাব দেখে যদি তূর্য বিয়ে করতে না চায়?
বিকেলে অরুণিকা রুমে বসে টিভি দেখছিল। তখনই তূর্য তার সামনে এসে বসলো। অরুণিকা হাত নাড়িয়ে বলল,
“সরো। আমি টিভি দেখছি।”
তূর্য অরুণিকার দুই পা ধরে তাকে টেনে নিজের কাছে আনলো। অরুণিকা পা ভাঁজ করে বলল,
“কি সমস্যা তোমার?”
তূর্য মুখ ছোট করে বলল,
“আমার টুইংকেলটা কেন আমার সাথে রাগ করেছে?”
আহনাফ তখনই রুমে এসে তাদের একসাথে দেখে বলল,
“কি হচ্ছে? তূর্য, দেখছিস না ও টিভি দেখছে! তুই এদিকে আয়।”
তূর্য ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এই তোর কি সমস্যা? আমি আমার টুইংকেলের সাথে কথা বলছি।”
“ও তোর সাথে কথা বলবে না। আয় এদিকে, বিয়ের শপিংয়ের লিস্ট করতে হবে।”
অরুণিকা আহনাফের কথা শুনে তূর্যের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে আগের জায়গায় বসে পড়লো। তূর্য আহনাফের কথায় পাত্তা না দিয়ে তাকে আবার ধরে টেনে তার কাছে আনলো। এবার আহনাফের প্রচুর রাগ হলো। সে রাগটা দমিয়ে তূর্যকে টেনে উঠাবে, তখনই অরুণিকা বসা থেকে উঠে আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি দেখছো না রকস্টার আমার রাগ ভাঙাতে এসেছে? তুমি কেন ওকে বিরক্ত করছো?”
হুট করে এমন কথা শুনে আহনাফের খুব খারাপ লাগলো। সে তূর্যের হাত ছেড়ে দিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আচ্ছা, কথা বল তোরা।”
তারপর রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। তূর্য কপাল চাপড়ে বলল,
“আহনাফ, তুই আবার গাল ফুলিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?”
তারপর অরুণিকাকে বলল,
“দেখলে তো, আহনাফ রাগ করে চলে গেলো!”
অরুণিকা আহনাফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ও কি আমার কথায় রাগ করেছে?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা, আমি ওর রাগ ভাঙাতে পারবো। তুমি আগে আমার রাগ ভাঙাও।”
এরপর অরুণিকা বুকে হাত গুঁজে অন্যদিকে তাকালো। তূর্য অরুণিকার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“আমার টুইংকেল কেন রাগ করেছে?”
অরুণিকা মলিন মুখে বললো,
“তুমি আমাকে বলেছ, বিয়ে করবে না। কিন্তু এখন বিয়ে করছ কেন?”
“হ্যাঁ, বিয়ে তো করতে চাই নি। কিন্তু এখন তো হয়ে যাচ্ছে।”
“এখন তো আমাকে কেউই সময় দেবে না।”
“কেন দেবে না? কে বলেছে দেবে না?”
“তুমিই তো বলেছো।”
তূর্য কপাল চাপড়ে বলল,
“ওটা তো এমনি বলেছি।”
“না, কেন বলবে? একদিন সবাই বিয়ে করে ফেলবে, তখন সবাই ব্যস্ত হয়ে যাবে। আমাকে কেউ দেখবে না। আমার সাথে কথাও বলবে না, ঘুরতেও নিয়ে যাবে না। তুমি বলেছ, তুমি সবসময় আমার সাথে কথা বলবে। সবাই বিয়ে করলেও তুমি করবে না। সবাই ভাবী নিয়ে ঘুরবে, আর তুমি আমাকে নিয়ে ঘুরবে। কিন্তু দেখো, তুমিই বিয়ে করে ফেলছো! আমার তো কেউ নেই। এক কাজ করো, আমাকেও বিয়ে দিয়ে দাও। আমিও তখন আমার বর নিয়ে ঘুরবো।”
তূর্য হাতে মুখ গুঁজে বলল,
“হায় আল্লাহ, এ মেয়েটা বলে কি!”
তারপর অরুণিকার দিকে তাকিয়ে তার দুই হাত ধরে বলল,
“আমি, তুমি আর তোমার ভাবী, আমার তিনজন একসাথে ঘুরবো।”
“ভাবী কি আমাকে শতু আপুর মতো ভালোবাসবে?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই। ভালোবাসবে না কেন? আমার টুইংকেলকে ভালোবাসতে পারবে না এমন কেউ আছে?”
“না, আগে আমি ভাবীর সাথে কথা বলবো। তারপরই বুঝবো।”
তূর্য এবার উপমাকে ফোন দিয়ে অরুণিকার সাথে কথা বলিয়ে দিলো। অরুণিকা প্রায় এক ঘন্টা উপমার সাথে কথা বলার পর তূর্যকে ফোন দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমি ভাবীকে ভাবী বলবো না কিন্তু। সুইট স্টার বলবো। কারণ ভাবী অনেক সুইট।”
তূর্য মুচকি হাসলো। ফোনটি কানের কাছে এনে উপমার মিষ্টি কন্ঠ শুনে বলল,
“আগে বলো আমার টুইংকেলকে কেমন লেগেছে?”
উপমা হেসে বলল,
“অনেক মিষ্টি একটা বাচ্চা। ও এতো সুন্দর করে কথা বলে! আমাকে বলছে, আমি যাতে ওর সখী হয়ে যাই। তারপর রকস্টার আর আমাকে নিয়ে সে বাইরে ঘুরতে যাবে। জানো, এতোদিন আমি খুব চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু ওর সাথে কথা বলে মনে হচ্ছে, আমি বিয়ের পর একটা বোন পাবো।”
তূর্য প্রশান্তির হাসি দিয়ে বলল,
“থ্যাংক ইউ, উপমা। তোমার কথাটা শুনে ভালো লাগলো। টুইংকেল আমাদের ছয় জনেরই প্রাণ। আমি চাই, তুমি ওকে আমাদের মতোই আগলে রাখো। ওর কিছু হলে আমরা সহ্য করতে পারবো না।”
“অরুণিকাকে অনেক ভালোবাসো, তাই না?”
“হ্যাঁ, নিজের চেয়েও বেশি। ওকে ছাড়া আমার দিনটাই ফিঁকে লাগে। এতোদিন বাংলাদেশে খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। এখন ওকে দেখার পর থেকে সব ভালো লাগছে।”
উপমা হেসে বলল,
“আচ্ছা, আমিসহ থাকলে হয়তো বিরক্ত লাগতো না।”
তূর্য মলিন হাসলো। উপমা মনে করছে, সে উপমাকে ভালোবাসে। কিন্তু সে তো অনুশোচনা থেকে বাঁচার জন্য বিয়ে করছে। উপমা যদি জানতে পারে, সে উপমাকে ভালোবাসতো না। এসব সময় কাটানোর জন্য ছিল, তখন অনেক কষ্ট পাবে।
তূর্য উপমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফোন কেটে দিয়ে মনে মনে বলল,
“সব কিছু এতো তাড়াতাড়ি হচ্ছে, আমি কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারছি না। আমি এতো দুর্বল তো আগে ছিলাম না।”
এদিকে ইভানকে রহমত চাচা ফোন করলেন। তিনি অনেকক্ষণ ইভানের সাথে কথা বললেন। তার সাথে কথা বলার পর থেকেই ইভান ভাবনায় ডুবে গেলো। আহনাফ তাকে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে?”
বাকিরাও ততোক্ষণে ইভানের সামনে এসে বসলো। সবাই ইভানকে চিন্তিত দেখে ভাবছে, কিছু একটা তো হয়েছে। এবার তাহমিদ বলল,
“ইভান, কার ফোন ছিল?”
ইমন বলল,
“হ্যাঁ, ভাই। কে ফোন দিয়েছে? কখন থেকে এভাবে পাথরের মতো বসে আছিস।”
ইভান এবার তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এভাবে কি দেখছিস?”
ইভান থমথমে কন্ঠে বলল,
“রহমত চাচা তোর বিয়ের খবর কিভাবে জানলো?”
“মানে? আমি তো উনার সাথে কথায় বলি নি।”
“তাহলে উনি তোর বিয়ের কথা কিভাবে জানলো? এই খবর তার কাছে যাওয়া একদমই অসম্ভব ছিল। কারণ আমরা ছ’জন, আর মাওশিয়াতের বাবা-মা ছাড়া এটা কারোই জানার কথা না।”
আরাফ কিছু একটা ভেবে বলল,
“উনি কি মাওশিয়াতের বাবা-মার সাথে যোগাযোগ করে?”
ইমন বলল,
“না। উনারা তো সালেহ আলীকে চেনে। রহমত চাচা তো কখনো কলকাতায় আসে নি।”
“তাহলে কি সালেহ আলীর সাথে যোগাযোগ আছে?”
তাহমিদ বলল,
“হয়তো অরুণিকা কাউকে বলেছে!”
ইভান অরুণিকাকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই সে “না” বললো। এবার ইমন মাওশিয়াতকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলো। সেও বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করে জানালো, তাদের সাথে সালেহ চাচার কোনো যোগাযোগ নেই।
আহনাফ বলল,
“তবে কি কেউ আমাদের উপর নজর রাখছে?”
হঠাৎ ইমনের টনক নড়লো। সে সাথে সাথে মাওশিয়াতকে কল করলো আর বলল,
“তোমাদের বাসার কাজের মহিলাটি কি জানে তূর্যের বিয়ে?”
“হ্যাঁ কেন জানবে না? তিনি তো আমাদের সাথেই থাকে। ইনফ্যাক্ট, উনি সবসময় তোমাদের কথায় জিজ্ঞেস করে। উনার তো অনেক আফসোস হয় তোমরা একা একা থাকো তাই।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
“কিন্তু তুমি উনার কথা কেন জিজ্ঞেস করছো?”
“এমনিতেই। আচ্ছা উনাকে আপতত আমাদের কথা কিছুই বলো না। আর তুমি সময় নিয়ে আমাদের বাসায় এসো।”
ইমন কল কেটে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমরাই পিছিয়ে আছি। শত্রুপক্ষ জানে, আমরা কি করছি, কি করছি না। রহমতুল্লাহ, আগের মহল্লায় আমাদের ওঠাবসার খবর সালেহ চাচার মাধ্যমে পেয়েছিল। নতুন এলাকায় যাওয়ার পর আমাদের বাসায় পারমানেন্ট কাজ করার জন্য এক মহিলা এসেছিল। কান্নাকাটি করছিল, তাকে কাজে রাখার জন্য। কিন্তু আমরাই তাকে রাখি নি। কিছুদিন আগে আমি সেই মহিলাকে মাওশিয়াতদের বাসায় দেখেছি। সে নাকি সাড়ে তিন বছর ধরে সেখানেই কাজ করে। তার মানে কি? মাওশিয়াতের কাছ থেকে সে সব তথ্য নিয়ে আমাদের শত্রুদের দিচ্ছে। আর রহমত চাচা সেখান থেকেই সব খবর পেয়েছে।”
(রাতে একটা বোনাস পর্ব দেবো।)
চলবে-