অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৫০||

0
1147

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫০||

৮৪.
আদিল তূর্যের মুখোমুখি বসে আছে। সুস্থ হওয়ার এক সপ্তাহ পর সে বাবা-মাকে নিয়ে কলকাতায় এসেছে। আসার পর পরই সে তূর্যকে প্রশ্ন করলো, সেদিন রাতে কেন এমনটা হয়েছিল? তূর্যের পাশে ইমন দাঁড়িয়ে আছে। সে একনজর ইমনের দিকে তাকালো। ইমন সাথে সাথে মাথা নিচু করে নিলো। একপাশের সোফায় ইভান আর আরাফ বসে আছে। আর অন্যপাশে করিম সিদ্দিক ও মিসেস জুলেখার মাঝখানে উপমা বসে আছে। সেও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ এতোদিন সে অনেকবার তূর্যকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু তূর্য প্রতিবারই তাকে এড়িয়ে গেছে। তাহমিদ রান্নাঘর থেকে নাস্তার ট্রে নিয়ে টেবিলের উপর রাখলো। সবাই গম্ভীরমুখে বসে আছে। অরুণিকা সবার হাবভাব দেখে আহনাফকে গুঁতো দিয়ে বলল,
“সবাই এভাবে নিরবতা পালন করছে কেন?”

আহনাফ তাকে ইশারায় চুপ করে থাকতে বলল। এবার করিম সিদ্দিক বললেন,
“বাবা, কিছু তো বলো! কি হয়েছিল? ওরা কারা ছিল? তোমরা এখনো আমাদের কিছু বলছো না।”

সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে আহনাফ বলল,
“আংকেল, আমরা আপনাদের কাছ থেকে একটা সত্য লুকিয়েছিলাম।”

সবাই আহনাফের দিকে তাকালো। ইভান চোখের ইশারায় আহনাফকে চুপ করে থাকতে বলল, কিন্তু সে ইভানের ইঙ্গিতের তোয়াক্কা না করে, নিজেদের আসল পরিচয় দিয়ে দিলো। সাথে বাংলাদেশ থেকে কলকাতা আসা, আর তাদের সংগ্রাম করে এতোটুকু আসার সব’টাই জানালো। সব শুনে করিম সিদ্দিক আর মিসেস জুলেখা পাথরের মতো বসে আছেন। আর আদিল তূর্যের দিকে তাকালো। তারপর শান্ত কন্ঠে বলল,
“তোমার সম্পর্কে জানার পর মনে হচ্ছে, আমার বোনটা বিশ্বাসযোগ্য হাতে আছে। অতীতে তোমাদের সাথে যা হয়েছিল, একদম ভালো হয় নি। কিন্তু এখন তোমাদের জীবনে একটা ভালো সুযোগ এসেছে। এই সুযোগ ফেলে দেওয়া উচিত নয়। আমি তোমাদের সাথে আছি৷ তোমাদের পরিবারের খুনিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য আমার পক্ষ থেকে যা যা সম্ভব, আমি এর সবটাই করবো।”

মিসেস জুলেখা আতংকিত কন্ঠে বললেন,
“কিন্তু এরা যদি আবার হামলা করতে আসে!”

ইভান বলল,
“এখন ওরা আমাদের কোনো তথ্য পাবে না। এতোদিন আমাদের সব তথ্য ওরা ওদের গুপ্তচর থেকে পেয়েছিল। মাওশিয়াতদের বাসায় একজন মহিলা কাজ করতো। তার নাম রাহেলা ছিল। তিনি বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় এসেছে, আমাদের সব খবরাখবর নেওয়ার জন্য।”

করিম সিদ্দিক বললেন,
“তোমরা তাকে ধরতে পেরেছ?”

আরাফ বলল, “জ্বি, আংকেল।”

“কি বলেছে সে? কে পাঠিয়েছে তাকে?”

“যে পাঠিয়েছে তাকে সে চেনে না। এক লোকের মাধ্যমে সে কাজ পেয়েছিল। যেই লোকটা কাজ দিয়েছিল, তার কোনো খবর পাই নি। আর যে আমাদের উপর নজরদারি করছে, সে নিজেকে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে। মহিলাটার ফোনের রেকর্ডিং বের করার ব্যবস্থা করছি। একজন ইন্সপেক্টর এই কেইসে আমাদের সাহায্য করছেন। দেখা যাক, মহিলাটা কার কার সাথে কথা বলেছে।”

এদিকে, অনেকক্ষণ ধরে রহমতুল্লাহর ফোন বাজছে। একটা পরিচিত নম্বর ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে। কিন্তু তিনি কল ধরার সাহস পাচ্ছেন না। বার-বার কল আসায় অনেকটা বাধ্য হয়েই তিনি কলটা ধরলেন৷ কল ধরার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে কর্কশ কন্ঠে একজন বলে উঠল,
“কোথায় ছিলে এতোক্ষণ? কতোবার তোমাকে ফোন করেছি? কোথায় থাকো তুমি?”

রহমতুল্লাহ ঠান্ডা গলায় বললেন,
“ক্ষমা করবেন, জনাব। আমি একটু অসুস্থ আছি।”

“তুমি মোটেও অসুস্থ নও। তুমি ইচ্ছে করে আমার কল ধরছো না। খবরদার আমার সাথে চালাকি করার চেষ্টা করবে না। নয়তো তোমার মাথার খুলি উড়াতে আমার দুই সেকেন্ডও লাগবে না।”

রহমতুল্লাহ আমতা আমতা করে বললেন,
“শুধু শুধু রাগ করছেন, জনাব। আমি কি করেছি?”

“তুমি কেন ওদের উপর হামলা করিয়েছো? আমার কাজ এখনো শেষ হয় নি। যতোদিন আমি আমার কাজ শেষ করতে পারবো না, ততোদিন ওদের ছ’জনকে বেঁচে থাকতে হবে। কিন্তু তুমি ওদের উপর হামলা করিয়েছো। আর ওরা আবার কলকাতায় পালিয়ে গেছে।”

“না, জনাব। আমি এই হামলা করাই নি। বস করিয়েছে।”

“বস? তোমার বসকে বলে দাও, আমার উপর খবরদারি না করতে!”

“জ্বি জনাব।”

“এর আগেও তোমার বস ওদের উপর হামলা করাতে চেয়েছিল। ওরা যখন সিলেটে ছিল, তখনও ওদের মারার জন্য লোক পাঠিয়েছিল।”

এবার রহমতুল্লাহ বললেন,
“কিন্তু মারতে তো পারে নি। আমি ওদের সরিয়ে দিয়ে ওই ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছি। জনাব, আপনি যেটা চাচ্ছেন, আমিও সেটাই চাচ্ছি। কিন্তু বস চাচ্ছে ওদের রাস্তা থেকেই সরিয়ে দিতে। আপনি আমেরিকা থেকে ফিরে বসের সাথে আলাপ করলে ভালো হবে। এরপর আপনি বুঝালে উনি বুঝবেন যে এই ছয়জনের এই মুহূর্তে বেঁচে থাকা কতো জরুরি। বিশেষ করে ইমন আর অরুণিকার।”

“আর যাই বলো জুবাইয়ের করিম চৌধুরী মৃত্যুর আগে অরুণিকাকে বাঁচিয়ে আমার রাস্তা আরো সহজ করে দিয়েছেন। এই মেয়েটাকেই এখন আমার প্রয়োজন। আমার সব কাজ শেষ হওয়ার পর ওই মেয়েকে সেই ছ’জনের সাথে জীবিত দাফন করেই সারাজীবনের জন্য মৈত্রী বংশের চিহ্ন মিটিয়ে দেবো।”

“কিন্তু জনাব, এখন তূর্য তো বিয়ে করেছে।”

“তো! ওই মেয়ে আমাদের কাজে বাঁধা হয়ে আসলে ওকেও মেরে ফেলবো। কেউ বাঁচবে না। কেউ না।”

উপমা তূর্যের পাশে বসে আছে। তূর্য ফোন নিয়ে ব্যস্ত। তাদের বিয়ের কয়েক সপ্তাহ হয়ে গেছে। এই কয়েক সপ্তাহে উপমা তূর্যের চোখে তার প্রতি কোনো ভালোবাসা দেখে নি। তূর্য কেমন যেন চুপচাপ থাকে। বেশিরভাগ সময় বন্ধুদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে। রাতে যদিও একটু কাছে পায়, কিন্তু সেই কাছে পাওয়ার মাঝে উপমা কোনো ভালোবাসা খুঁজে পায় নি। এটা শুধু তূর্যকে দেওয়া একটা বৈধ অধিকার মাত্র। কিন্তু ভালোবাসা ছাড়া এভাবে কাছে আসা কি বৈধ? অবৈধ হওয়ার কোনো যুক্তি নেই, কিন্তু উপমার মন যে তাকে বলছে এটা অন্যায় হচ্ছে। তূর্য তার উপর অন্যায় করছে। তবে এটা শুধু মনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, মুখে আর প্রকাশ পাচ্ছে না। কারণ তার এতো বছরের ভালোবাসা, তার প্রিয় মানুষটিকে বৈধভাবে পাওয়ায় তার জন্য বিরাট কিছু। এর চেয়ে বেশি চাইতে গেলে যদি হারিয়ে ফেলে? তাই উপমা চুপ করে আছে।

এদিকে তূর্য উপমাকে ঘরে উঠানোর পর থেকে ইমনকে রুম ছাড়তে হয়েছে। এখন সে তাহমিদ আর আহনাফের সাথে থাকে। ইমন রুমে আসার পর থেকে আহনাফ ঠিকভাবে ঘুমাতে পারছে না। একটা বিছানায় তিনজন কোনোভাবেই থাকা যাচ্ছে না। আজ বাধ্য হয়ে আহনাফ ডায়নিংয়ে চাদর বিছিয়ে ঘুমিয়েছে৷ আর সকালে এটা দেখার পর তূর্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে রুম ছেড়ে দেবে। সে সোজা এসে উপমাকে বলল,
“তুমি বরং অরুণিকার রুমে চলে যাও। আজ থেকে ওর সাথেই থেকো। আমাদের আলাদা রুম নিয়ে ফেলাতে বাকিদের থাকার অসুবিধা হচ্ছে।”

উপমা তূর্যের কথা শুনে চুপ করে রইলো৷ মনে মনে খারাপ লাগলেও ব্যাগপত্র গুছিয়ে সে চুপচাপ অরুণিকার রুমে চলে গেলো। আরাফ উপমাকে অরুণিকার রুমে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“উপমা, তুমি ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?”

“অরুণিকার ঘরে যাচ্ছি।”

“কেন?”

“আমাদের জন্য সবার থাকার অসুবিধে হচ্ছে। আমি আর তূর্য একটা রুম নিয়ে বসে আছি। আমি অরুণিকার সাথে থাকলে ইমন ভাইয়া আবার তূর্যের সাথে থাকতে পারবে, তাই।”

আহনাফ অবাক হয়ে বলল,
“তোমাকে কে বলেছে রুম ছাড়তে? এটা আমাদের ব্যাপার। আমরা দু’একদিনের মধ্যে একটা ব্যবস্থা করে ফেলবো। তুমি এখন তূর্যের স্ত্রী। এভাবে আলাদা কেন থাকবে? যাও ব্যাগ নিয়ে ঘরে যাও।”

উপমা আহনাফের কথায় আবার ব্যাগ নিয়ে রুমে চলে এলো। তূর্য উপমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
“কি হলো, আবার চলে এসেছো যে!”

“আহনাফ ভাইয়া বলছে আমাকে এখানে থাকতে।”

তূর্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”

এরপর তূর্য রুম থেকে বের হতেই আরাফ তাকে টেনে ঘরের বাইরে নিয়ে গেলো। তূর্য হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“কি করছিস?”

আরাফ বলল, “তুই কি করছিস?”

“আমি আবার কি করলাম?”

“তুই নতুন বিয়ে করেছিস। কিন্তু তোকে দেখে মনে হচ্ছে বিয়ের সত্তর বছর পার করে ফেলেছিস। তোর এই মুহূর্তে উপমাকে সময় দেওয়া উচিত, নাকি ফোনে আর আমাদেরকে।”

তূর্য শান্ত কন্ঠে বলল,
“আরাফ, প্লিজ। আমি ওকে যতোটুকু সময় দেওয়ার দিচ্ছি। আর কতো সময় দেবো ওকে? সারাদিন কি এখন ওকে কোলে নিয়ে বসে থাকবো?”

আরাফ রাগী দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে কিছুক্ষনের তাকিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো। তূর্যও রাগ দেখিয়ে দেয়ালে পা দিয়ে জোরে আঘাত করে মিনমিনিয়ে বলল,
“বিয়েটা করেই ভুল করেছি৷ আমার তো বাংলাদেশে গিয়ে ওর সাথে দেখা করাই উচিত হয় নি।”

দুপুরে উপমা রান্নাঘরে এসে তূর্যের পছন্দের বিরিয়ানি রান্না কর‍তে লাগলো। তূর্য রান্নাঘরে এসে দেখলো উপমা খোলা চুলে দাঁড়িয়ে আছে। সে রুম থেকে একটা মাথার কাঁটা এনে তার চুল বেঁধে দিলো। তূর্যের স্পর্শ পেয়ে উপমা কেঁপে উঠলো, মনে মনে খুশিও হলো। পরক্ষণেই তার মনটা খারাপ হয়ে গেলো, যখন তূর্য বলল,
“বাসায় আমি ছাড়া অনেকেই আছে। তরকারিতে চুল পড়লে, বাকিরা কি মনে করবে? তাহমিদ এগুলো পছন্দ করে না। তাই একটু সাবধানে কাজ করো।”

তূর্য বের হতে যাবে তখনই উপমা বলল,
“আপনার পছন্দের বিরিয়ানি রান্না করছি।”

তূর্য মুচকি হেসে বলল,
“আচ্ছা, থ্যাংক ইউ। কিন্তু আমি দুপুরে বাসায় খাচ্ছি না। আমার স্টুডিওতে যেতে হবে।”

উপমা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। তূর্য রুম থেকে তার গিটার নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। তূর্যের যাওয়া দেখে উপমার চোখ দু’টি ছলছল করে উঠল। খ্যাতিসম্পন্ন মানুষগুলো কি এমনই হয়? তারা কি অন্যের অনুভূতি বুঝে না? তূর্য কি বুঝতে পারছে না উপমা কি চাইছে?

চলবে–

(আগামী পর্বে সবার অনেকদিনের অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটবে। 🤗)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here