অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৫১||

0
1158

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫১||

৮৫.
কলিং বেল বাজতেই উপমা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই সে একটা শাড়ি পরা মেয়েকে দেখে থমকে গেলো। উপমা মেয়েটাকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
“জ্বি, কাকে খুঁজছেন?”

শতাব্দী এদিক-ওদিক তাকিয়ে মিনমিনিয়ে বলল,
“আমাকে তো দু’তলায় বলেছিল!”

“জ্বি?”

শতাব্দী আমতা আমতা করে বলল,
“না, আমি আসলে অরুণিকাদের বাসা খুঁজছি। আমাকে এই বাসার ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল।”

“হ্যাঁ, এটা ওদেরই বাসা। আপনি কে?”

“আমি শতাব্দী।”

পেছন থেকে তূর্য চোখ কচলাতে কচলাতে দরজার কাছে এসে শতাব্দীকে দেখে আনন্দিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“আরেহ শতাব্দী, তুমি?”

তারপর সে শতাব্দীর হাত ধরে তাকে টেনে ঘরে ঢুকালো। উপমা অবাক হয়ে তূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। শতাব্দী ঘরে ঢুকে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
“বাসায় কেউ নেই?”

তূর্য বলল, “না, আমিই আছি।”

শতাব্দী এবার উপমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওকে তো চিনলাম না!”

উপমা মুচকি হেসে বলল,
“আমি তূর্যের ওয়াইফ।”

শতাব্দী অবাক হয়ে তূর্যের মুখের দিকে তাকালো। তূর্য লাজুক হেসে বলল,
“বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না?”

শতাব্দী বলল,
“একদমই না। তুমি সত্যিই বিয়ে করেছো?”

“হ্যাঁ।”

“বাহ। আমি তো বলেছিলাম, তুমিই সবার আগে বিয়ে করবে। দেখো, আমার কথা সত্য হলো তো!”

উপমা শতাব্দীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমি অরুণিকার কাছ থেকে আপনার নাম শুনেছি। আর আজ আপনার সাথে দেখাও হয়ে গেলো।”

শতাব্দী উপমার থুতনি ধরে বলল,
“বাহ, কি মিষ্টি মেয়ে! তোমাদের ব্যাচেলর ঘরে তাহলে এবার লক্ষী এলো!”

শতাব্দীর কথা শুনে উপমা লাজুক হেসে নিচের দিকে তাকালো। তূর্য একনজর উপমার দিকে তাকালো। তারপর বলল,
“আমাদের ঘরে লক্ষী তো আগে থেকেই ছিল। আমার টুইংকেল কি কম লক্ষী?”

“আরেহ, আমার ছোট সখীর সাথে তো কারো তুলনায় হবে না।”

এবার শতাব্দী উপমার হাত ধরে বলল,
“গায়ক সাহেব তো আমাকে বিয়েতে দাওয়াতই করলো না।”

উপমা শতাব্দীর কথা শুনে তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য বলল,
“তুমি নিজের সংসার থেকে বেরুতেই পারলেই তো তোমার খোঁজ পেতাম! বিয়ের পর তো তোমার কোনো খবরই পাই নি।”

শতাব্দী মলিন মুখে বলল,
“হ্যাঁ, আমিও তো যোগাযোগ করি নি।”

কথাটা বলেই শতাব্দী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। উপমা শতাব্দীর মলিন মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

দুপুরে অরুণিকা স্কুল থেকে ফিরে শতাব্দীকে দেখে তাকে ঝাপটে ধরলো। আরাফ আর আহনাফের সাথেও কুশল বিনিময় হলো। উপমা দুপুরের খাবার টেবিলে সাজিয়ে তূর্যের কাছে এসে বলল,
“খেতে আসো।”

তূর্য হঠাৎ উপমার হাত ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। উপমা তূর্যের এমন আচরণে অবাক হয়ে গেলো। তূর্য উপমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“শতাব্দীর সাথে আমাদের ব্যাপারে বেশিকিছু বলো না। আমাদের কিভাবে বিয়ে হয়েছে, বিয়ের দিন কি হয়েছে, এসব একদমই বলবে না। বলবে দেখা হয়েছে, এরপর প্রস্তাব পাঠিয়েছি, এতোটুকুই।”

তূর্য কথাগুলো বলে উপমাকে ছেড়ে দিলো৷ উপমা তূর্যের হাত ধরে বলল,
“আমার একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে!”

“কি কথা?”

“আমাকে কেন বিয়ে করেছিলে?”

তূর্য অপরাধীর চোখে উপমার দিকে তাকালো। উপমা আবার বলল,
“আমাদের বিয়ের দুই মাস হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তোমার চোখে কখনো ভালোবাসা দেখি নি। সারাদিন অরুণিকার সাথেই ব্যস্ত থাকো। কখনো বা ভাইয়াদের সাথে আড্ডা দাও, স্টুডিও বা গিটার নিয়ে ঘরের এক কোণে বসে থাকো। আমি যে এখানে আছি, সেটা তোমার শুধু রাতে বিছানায় গেলেই মনে পড়ে।”

তূর্য স্থির দৃষ্টিতে উপমার দিকে তাকিয়ে রইলো। উপমা মলিন মুখে বললো,
“খেতে আসো। আজ তোমার পছন্দের তরকারি রান্না করেছি। আরাফ ভাইয়া বাজার করে এনেছিল। তোমাকে তো লিস্ট দিয়েছিলাম, কিন্তু নিয়ে যাও নি।”

উপমা কথাগুলো বলেই রুম থেকে বেরিয়ে এলো। তূর্য ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। এই মুহূর্তে তার নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। বিয়ের আগে সে নিজের যা ইচ্ছে হতো তাই করতো, এখনো তাই করছে। কিন্তু তার ইচ্ছেমতো চলাফেরায় উপমা বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সারাদিন তার পাঁচ বন্ধু তাকে বলে উপমাকে সময় দিতে। কিন্তু তার উপমার সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে না। সে উপমার সাথে বেশিক্ষণ বসলেই বিরক্ত হয়ে পড়ে। কারণ উপমার উষ্ণ ভালোবাসাগুলো তূর্যের কাছে খুবই বেরসিক মনে হয়। তার চেয়ে অরুণিকার সাথে হাসাহাসি করতেই তার অনেক ভালো লাগে। সে গম্ভীর মানুষ খুব কম পছন্দ করে, আর উপমা দিন দিন যেন গম্ভীরই হয়ে যাছে। খুব একটা হাসে না, সবসময় মুখটা মলিন করে রাখে, ঠান্ডা গলায় কথা বলে, যা তূর্যের মোটেও পছন্দ হয় না। উপমা বিয়ের আগে এমন ছিল না। অনেক হাস্যজ্বল ছিল, তাদের যখন প্রথম দার্জিলিং দেখা হয়েছিল, তখনও সে উপমার মধ্যে একটা হাস্যরস দেখেছিল, যা এখন আর খুঁজেই পাওয়া যায় না।

এদিকে তাহমিদ সন্ধ্যায় বাসায় ঢুকে শতাব্দীকে দেখে থমকে গেলো। শতাব্দী বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তাহমিদ ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে এসে তাকে আপাদমস্তক দেখে বলল,
“কেমন আছ?”

শতাব্দী মলিন মুখে বলল,
“তুমি তো জানোই আমি কেমন আছি।”

তাহমিদ শতাব্দীর চোখের দিকে তাকালো। সে শতাব্দীর চোখে মলিনতা ছাড়া কিছুই দেখলো না। আর সেই চোখ দু’টি তাহমিদের বুকটা কাঁপিয়ে দিল। তার চন্দ্রিমা কি সত্যিই ভালো নেই? কিন্তু কেন ভালো নেই? শতাব্দী কি এখনো তাকে ভুলতে পারে নি?
তবে তাহমিদ নিজেকে শান্ত রাখলো। সে মলিন হেসে বলল,
“আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুমি বসো।”

তাহমিদ নিজের ঘরে এসে সোজা বারান্দায় চলে গেলো। বারান্দায় গিয়ে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এখন তার চোখ দু’টো জ্বালা করছে। বুকটা ভারী ভারী লাগছে। সে মনে মনে ভাবছে, কেন এসেছে শতাব্দী? কেন শতাব্দী বার বার তার চোখের সামনে এসে তাকে দুর্বল করে দেয়? কেন শতাব্দীকে না পাওয়ার কষ্টে তার দম বন্ধ হয়ে আসে? কেন খুব অধিকার নিয়ে শতাব্দীর হাতটা ধরতে ইচ্ছে করে? তাহমিদ এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পায় না। তার জীবনটা প্রশ্নের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে গেছে। আর এই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর তার কাছে নেই।

বিচিত্র এই জীবনে কেউ ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেয়েও তার হাতটা ধরতে চায় না, আর কেউ না পেয়ে সেই হাত ধরার মিথ্যে স্বপ্ন বুনতে থাকে।

এদিকে বিক্রম রাহেলার ফোন রেকর্ডিং বের করে ছ’জনকে পাঠালো। যদিও তেমন কোনো তথ্য পাওয়া গেলো না। শুধু তারা কি করছে না করছে এসব তথ্য রাহেলা একজন অপরিচিত লোককে জানিয়েছিল। রাহেলা যার সাথে কথা বলেছে সে একজন বাংলাদেশী নাগরিক। বিক্রম সিমটির মালিকের তথ্য বের করে আরাফকে পাঠালো। আরাফ মালিকের নাম দেখে চমকে উঠলো। আহনাফ আরাফের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আরাফ, লোকটা কে?”

আরাফ থমথমে কন্ঠে বলল,
“শাহবাজ খান।”

ইমন ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“অরুণিকার মামায় তাহলে আমাদের শত্রু?”

“হ্যাঁ।”

ছ’মাস মাস পর মাস্টার্সের ফলাফল হাতে নিয়েই তারা বাসায় ফিরলো। ছ’জনের পড়াশুনা শেষ। এবার বাংলাদেশ ফেরার পালা। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তারা নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলো। সব কাজ সম্পন্ন করে তারা বাসে উঠে পড়লো।

দশ বছর আগের এপার আর ওপারের গল্প। দশ বছর আগের এক রাতে সিলেট থেকে কলকাতা নামক এক অজানা শহরে এসেছিল ছ’জন মাঝ বয়সী কিশোর। সেদিন তাদের হাতে আবদ্ধ ছিল চার বছর বয়সী ছোট্ট অরুণিকার হাত। চোখে ছিল ভীতি, হতাশা আর ক্লান্তি। এই শহরে এসে দেখা হয়েছিল শতাব্দীর মতো মিষ্টি একটা মেয়ের। সাক্ষাৎ হয়েছিল আলেয়া আপা আর মাস্টারমশাইয়ের মতো উষ্ণ হৃদয়ের মানুষের সাথে। দেখা হয়েছিল হারিয়ে ফেলা প্রিয় মানুষ সায়ন্তনীর সাথে। আবার কিছু ভয়ংকর মুহূর্তের সাক্ষী দেওয়া যতি আর বাঁধনদেরও আজ তারা ফেলে আসছে কোনো এক রাস্তার মোড়ে।
কলকাতার রাস্তার ফাঁকে ফাঁকে এখনো তাহমিদের মিষ্টান্ন ভোজনের গন্ধ পাওয়া যায়, ইমনের মাঠে মাঠে বল নিয়ে দৌঁড়ানো, আর তার প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে থাকা যেন এখনো সেই স্কুলের মাঠে-বারান্দায় গেঁথে আছে। কলকাতার লাইব্রেরিগুলোতে এখন আর ইভানের পদচিহ্ন পড়বে না। তূর্যের স্টুডিও এখন বন্ধ। গেইটে তালা দেওয়া। আহনাফের বাইকটার মালিক আজ অন্য কেউ হয়ে গেছে। যেই বাইকে করে এই শহরে তার নিরব ভালোবাসা নিয়ে ঘুরাফেরার স্মৃতি জেগে আছে। আরাফকে এখন আর কখনোই সায়ন্তনীর দোকানের সামনে দেখা যাবে না, যাবে না অরুণিকাকে স্কুলের ব্যাগ নিয়ে কলকাতার রাস্তায় ছুটতে।
ফেলে আসা মানুষগুলোকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়ে এবার জন্ম নিতে যাচ্ছে সাতটি নতুন জীবন। আর আজ দশ বছর পর ঠিক আগের মতো পুরোনো শহরে ফিরছে ছ’জন পঁচিশ বছর বয়সী যুবক। যাদের চোখে এবার জমেছে দুঃসাহসিকতা আর প্রতিশোধের নেশা। আর তাদের হাতের মুঠোয় এবার ভরসার হাত হয়ে আছে চৌদ্দ বছরের বালিকা, অরুণিকা।

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here