অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||বোনাস পর্ব||

0
1154

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

৮৯.
ইমন আর মাওশিয়াতের এনগেজমেন্টের পর অরুণিকার শর্ত মোতাবেক অনুষ্ঠান শুরু হলো। একে একে সবাই গান করলো। কেউ কেউ গানের পরিবর্তে অরুণিকার প্রশ্নের উত্তর দিলো। এবার অরুণিকা রাহিকে বলল,
“রাহি আপু, এবার তোমার পালা। একটা গান করো।”

রাহি লাজুক হেসে মাথা নুইয়ে ফেললো। সানায়া বলল,
“রাহি গান গাইতে পারে না। ওর সুরই ঠিকভাবে আসে না। তবে ও ভালো লেখালেখি করতে পারে। ওকে নিজের লেখা পড়ে শুনাতে বলো। ওর লেখা শুনে তোমরা মুগ্ধ হয়ে যাবে।”

অরুণিকা বলল,
“হ্যাঁ আপু। শোনাও একটা।”

রাহি চোখ তুলে আরাফের দিকে তাকালো। সাথে সাথেই তাদের চোখাচোখি হয়ে গেলো। রাহি তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে বলল,
“আমি কিছুদিন আগেই লেখাটা লিখেছিলাম। ওইটাই পড়ে শুনাচ্ছি।”

রাহি মোবাইল থেকে লেখাটি বের করলো। ফোনের স্ক্রিনে কালো অক্ষরে লেখাগুলো জ্বলজ্বল করছে। রাহি সেকেন্ড খানিকের জন্য চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল,
“আরাফ, এই লেখাটা তোমাকে নিয়েই লিখেছি। তুমি হয়তো বুঝবে না। কিন্তু আমার জীবনে আসা সব পুরুষের মধ্যে তুমিই অনেক আলাদা।”

রাহি চোখ খুলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পড়তে লাগলো,
“সেদিনটা খুব ব্যস্তময় দিন ছিল৷ ব্যস্ততার ভীড়ে আমি ব্যস্ত মানুষের মতো ছুটছিলাম। হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো তার সাথে। ভালোভাবে তাকানোর সুযোগটাও পেলাম না। শুধু তার কন্ঠ শুনলাম। এভাবে অনেকবার তার কন্ঠ শুনেছি। কিন্তু তাকে দেখা হয় নি৷ কিভাবে দেখবো! আমি তো অন্ধ হয়ে গেছি। আমার চোখের আলো কেউ এসে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। এখন আমি তা-ই দেখি, যা আমাকে দেখানো হয়। কিন্তু আমার মনটা এখনো উন্মুক্ত। তাই মন ভরে তাকে শুনি, শুনতে চাই। তবে আমার কোনো অনুভূতি নেই। নেই কোনো চাওয়া-পাওয়া। শুধু একটাই ইচ্ছে আছে, যদি সেই কন্ঠ রোজ শোনার সুযোগ হতো। বেশ জমতো আমার সেই দিনটা।”

রাহি মোবাইল থেকে চোখ তুলে আরাফের দিকে তাকালো। আরাফও তার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার আর রাহি চোখ সরালো না। উলটো আরাফই চোখ সরিয়ে নিলো। রাহির লেখা অনুভূতির অংশটি শুনে সবাই হাততালি দিচ্ছিল, শুধু সানায়া অবাক হয়ে রাহির দিকে তাকিয়ে ছিল। এরপর সানায়ার গান গাওয়ার পালা এলো। সে সোজা হয়ে বসে বলল,
“আমার গান গাইতে অনেক ভালো লাগে। দাঁড়াও, আগে আমি একটু ভাবি, কোনটা গাইবো।”

রাহি চোখ বাঁকা করে সানায়ার দিকে তাকালো। আর কানে হাত গুঁজে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর সানায়া গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“শুরু করছি। ঠিক আছে?
বলো, কেন তুমি দূরে দূরে!
কেন আমি একা?
হৃদয়ে চুরমার
আনো না…
তুমিই আমার, স্বপ্ন ঢেকে থাকা।
নামে না রোদ্দুর।
দেয়ালে দেয়ালে, খেয়ালে খেয়ালে
হিসেবে-বেহিসেবে তোমাকেই খুঁজি
আড়ালে আড়ালে, কোথায় হারালে?
ফিরে তুমি আর আসবে না বুঝি?”

সানায়ার ভাঙা কন্ঠ শুনে সবাই মাথা নিচু করে রইলো। তূর্য ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“ওয়েট ওয়েট ওয়েট, তুমি এই লিরিক্স কোথায় পেয়েছো?”

সানায়া বলল, “শুনেছি।”

“তুমি কি আদৌ শুনেছো? আমার তো মনে হয় না। তুমি পুরাটাই ভুল গেয়েছো। না জানলে গাইবে কেন?”

ইভান শব্দ করে হাসলো। ইভানকে হাসতে দেখে সানায়া রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। তূর্য বলল,
“আমি গেয়ে শুনাচ্ছি। ওয়েট।
বলো না কেন তুমি বহুদূর?
কেন আমি একা?
হৃদয়ে ভাঙচুর, জানো না
তুমি হীনা এ আমার
স্বপ্ন মেঘে ঢাকা, নামে না রোদ্দুর।”

সানায়া হেসে বলল,
“আমি ইচ্ছে করেই ভুল গেয়েছি, যাতে তুমি আমাকে শুদ্ধ করে দেওয়ার জন্য গানটা গাও।”

ইভান এবার মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“এখন নিজের অপারগতা ঢাকার চেষ্টা করছে!”

সানায়া কিছু বলতে যাবে, রাহি তার হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিলো। এবার আহনাফের গান গাওয়ার পালা এলো। সে ইচ্ছে করেই গান না গেয়ে বলল,
“অরু, তুমি আমাকে যেকোনো ধরণের প্রশ্ন করো। আমি উত্তর দেবো।”

অরুণিকা হেসে বলল,
“আচ্ছা বলো। আরাফ কার সাথে তোমার বিয়ের কথা বলেছে!”

আহনাফ আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ বলল,
“আমিই বরং এই উত্তরটা দেই।”

আরাফ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে উঠে দাঁড়ালো, আর বলল,
“আমি আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি।”

সবাই আরাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আরাফ অরুণিকাকে ডাক দিয়ে বলল,
“অরু, এদিকে আসো।”

অরুণিকা কিছুটা অবাক হলো। সে একনজর উপমার দিকে তাকালো। পরক্ষণেই তাহমিদ তাকে ইশারায় সামনে যেতে বলল। অরুণিকা আরাফের কাছে যেতেই আরাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“দাদা, বাবা, ভাইয়া আর চাচাদের অবর্তমানে আমি তোমার অভিভাবক। জুবায়ের আংকেল মৃত্যুর আগে তোমাকে আমাদের দায়িত্বে দিয়ে গেছেন। আর আমি এই দায়িত্বটা সারাজীবনের জন্য অন্য কারো হাতে তুলে দিতে চাচ্ছি।”

অরুণিকা ভয়ার্ত চোখে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আরাফ আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি চাই ইমন আর মাওশিয়াতের বিয়ের পর আহনাফ আর অরুর আক্দটা হয়ে যাক।”

অরুণিকা স্তব্ধ হয়ে গেলো। আহনাফ অরুণিকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

এদিকে সব অতিথিরা চলে যাওয়ার পর অরুণিকা আরাফের সামনে এসে বলল,
“আরাফ, তুমি আমাকে না বলে এই সিদ্ধান্ত কিভাবে নিয়েছো? তুমি অন্তত আমার পছন্দ-অপছন্দ জানতে পারতে।”

আরাফ শান্ত কন্ঠে বললো,
“এটা আমার সিদ্ধান্ত না। এটা তোমার বাবার সিদ্ধান্ত ছিল।”

“বাবার সিদ্ধান্ত ছিল, তাই বলে সেটাই মানতে হবে? সেদিন যদি আহনাফের কিছু হয়ে যেতো, তাহলে তাদের সিদ্ধান্তের কি কোনো মূল্য থাকতো!”

অরুণিকার কথা শুনে আহনাফের গলা আটকে গেলো। ইভান ধমকের সুরে বলল,
“অরুণিকা, বেশি কথা বলবে না। আরাফ তোমার খারাপ চাইবে না।”

অরুণিকা আহনাফের কাছে এসে বলল,
“তুমি কি এই সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছো? তোমারও কি খারাপ লাগছে না!”

আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“না, আমার কোনো সমস্যা নেই।”

অরুণিকা ছলছল চোখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। সে ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“যদি বলি আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি, তবুও আমাকে বিয়ে করবে?”

আহনাফ অরুণিকার কথা শুনে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আরাফ বলল,
“তোমার পছন্দ কি সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তোমার পছন্দটা আমার পছন্দ হয় নি।”

অরুণিকা অবাক হয়ে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমন ভ্রূ কুঁচকে আরাফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“অরুণিকা আবার কাকে পছন্দ করে? আমি তো এই ব্যাপারে কিছুই জানি না।”

আরাফ বলল,
“জানার জন্য চোখ কান খোলা রাখতে হয়। আর আমার অরুর ব্যাপারে, সব চোখই খোলা ছিল, এখনো খোলা আছে। তাই আমি ভালোভাবেই দেখেছি, এবং বুঝেছিও।”

অরুণিকা কিছু বলতে যাবে উপমা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“অরু, প্লিজ ভাইয়ার কথায় রাজি হয়ে যাও। তোমার জন্য আহনাফ ভাইয়ার চেয়ে ভালো কেউ হবে না। ভাইয়া তোমার যেভাবে খেয়াল রাখে, অন্য কেউ রাখবে না। আজকাল কি ছেলেদের বিশ্বাস আছে, বলো? কোনদিক দিয়ে মেয়েরা ঠকে যায়, তারা নিজেরাই বুঝে না। আর তুমি তো সেই ছোট বেলা থেকেই আহনাফ ভাইয়াকে চেনো।”

তূর্য উপমার কথাগুলো শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আর অরুণিকা উপমার দিকে তাকিয়ে রইল। এই মুহূর্তে কেউই তার অনুভূতি বুঝতে চাইছে না। সে যে ইমানকে পছন্দ করে, এটা কাউকে বোঝানো সম্ভব না। যেখানে পাত্র স্বয়ং আহনাফ, সেখানে আহনাফকে ছেড়ে ইমানকে যোগ্য পাত্র মনে করার কোনো লক্ষণ কারো কাছেই নেই। কারণ সবাই আহনাফকেই ভালোভাবে চেনে। এমনিতে ইমান গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করে। তার কাজগুলো অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। আরাফ কোনোভাবেই অরুণিকাকে ইমানের সাথে বিয়ে দেবে না। পুরো রাত উপমা অরুণিকাকে এটাই বুঝিয়েছে।

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই অরুণিকা আহনাফের রুমে ঢুকে আহনাফের পাশে বসলো। আহনাফের মাত্রই ঘুম ভেঙেছে। অরুণিকাকে দেখে সে তাড়াতাড়ি উঠে বসলো। অরুণিকা আহনাফের হাত শক্ত করে ধরে বলল,
“একটা অনুরোধ রাখবে, আহনাফ?”

আহনাফ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। তার ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি।

অরুণিকা বলল,
“আমি ইমানকে পছন্দ করি। কিন্তু আমি জানি না ও আমাকে পছন্দ করে কি না। তুমি একবার ওকে জিজ্ঞেস করবে ও আমাকে ভালোবাসে নাকি। অথবা আমাদের একবার দেখা করিয়ে দাও, আমি নিজেই জিজ্ঞেস করবো। তারপর ও যদি না বলে দেয়, তাহলে আমি তোমাকে বিয়ে করে নেবো। কিন্তু ও যদি হ্যাঁ বলে, তাহলে তুমি আরাফকে রাজি করাবে। ঠিক আছে?”

আহনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমি তোমার কাছে অপশনাল?”

অরুণিকা ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“না, তুমি আমার কাছে অপশনাল কেন হবে? যদি ইমান আমাকে ভালো না বাসে, তাহলে আমি তো আমার পছন্দ ওর উপর চাপিয়ে দিতে পারবো না৷ তাই এরপর আমার ভাগ্যে যা লেখা থাকবে, তাই হবে। কিন্তু আমি….”

আহনাফ অরুণিকাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা, আমি দেখছি।”

অরুণিকা খুশি হয়ে আহনাফের গাল টেনে দিয়ে বলল,
“আমি জানি, তুমি আমার জন্য এটা অবশ্যই করবে।”

আহনাফ মলিন মুখে বললো,
“তোমার জন্য আমি সব করতে পারবো অরুণিকা।”

অরুণিকা মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আর আহনাফ মনে মনে বলল,
“শুধু তোমাকেই ছাড়তে পারবো না।”

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here