অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৬০||

0
1031

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৬০||

৯৯.
সবাই ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়েছে। একটু পরই তারা কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে। তূর্য গাড়িতে ব্যাগগুলো উঠিয়ে গেইটের কাছে এসে দাঁড়ালো। তখনই তার ফোন বেজে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো আদিলের কল। সে রিসিভ করতেই আদিল ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
“তূর্য, কোথায় তুমি?”

তূর্য ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমরা বের হচ্ছি, ভাইয়া। আপনি ঠিক আছেন তো?”

“না, আমি ঠিক নেই৷ কিছুই ঠিক নেই। তুমি এখনই আমার দেওয়া লোকেশনে আসো। তুমি সব বুঝতে পারবে। তোমাদের সাথে অনেক বড় ধোঁকা হয়েছে৷ আমার কাছে সব প্রমাণ আছে। কে তোমাদের পরিবারকে খুন করেছে, কেন করেছে সব তথ্য আমার হাতে আছে। তুমি তাড়াতাড়ি আসো।”

তূর্য ফোন রেখেই ঘরে ঢুকে আহনাফকে তার সাথে যেতে বললো, সাথে তার পিস্তলটি সাথে নিলো। উপমা তূর্যের হাতে পিস্তল দেখে ভীত কন্ঠে বললো,
“কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”

তূর্য কোনো উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তারপর আহনাফকে গাড়িতে আদিলের বলা কথাগুলো বললো। তারা হুড়োহুড়িতে সবাইকে জানাতে পারে নি। তাই আহনাফ আরাফকে মেসেজ দিয়ে সারসংক্ষেপ জানিয়ে দিলো।

বিশ মিনিটের মধ্যে আদিলের দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছে গেলো তারা। গাড়ি থেকে নেমেই দেখলো একটা পুরোনো বাড়ি। তূর্য পিস্তলটি পেছনের পকেটে নিয়ে ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকলো। আহনাফ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“আমি তো আমার পিস্তলটিই সাথে আনি নি। এখন যদি কারো উপর এট্যাক করতে হয়?”

তূর্য বলল,
“করতে হলে করবো। এখন আমার পিস্তলে মাত্র তিনটা বুলেট আছে। আর আমি কারো উপর এট্যাক করতে ইচ্ছুক নয়। আমি শুধু আমার পরিবারের হত্যাকারীদের উপরই এই বুলেটগুলো ছুঁড়তে চাই। কিন্তু কেউ যদি সামনে চলে আসে, তাহলে শারীরিক শক্তি দিয়ে তার উপর এট্যাক করবো।”

আহনাফ বলল, “মারতে পারবি তো!”

“তুই পারবি?”

“কলকাতায় এক বছর তো এসবের উপরই ট্রেনিং নিয়েছি। কিন্তু তুই তো শিখিস নি। তোর উপর এট্যাক করলে, কিভাবে সামলাবি?”

“এখন এসব কথা বন্ধ কর। দেখি কি হয়!”

তারা ভেতরে ঢুকে আশেপাশে তাকাতে লাগলো। আহনাফ বলল,
“তূর্য, তুই কি শিউর? আমাদের এখানেই আসতে বলেছে?”

“হ্যাঁ, এই লোকেশানটাই তো শেয়ার করলো।”

তারা দু’তলায় উঠতেই উপরে কারো কন্ঠ শুনে দাঁড়িয়ে গেলো। এক সিঁড়ি উঠতেই উপর থেকে কেউ একজন তাদের উপর গুলিবর্ষণ করতে শুরু করলো। অতর্কিত আক্রমণে গুলিটা সোজা তূর্যের হাতে এসে লাগলো। মুহূর্তেই তার হাত থেকে পিস্তলটা পড়ে গেলো। আহনাফ তূর্যকে পেছনে সরিয়ে পিস্তল উঠিয়ে নিতেই মনে পড়লো, পিস্তলে শুধু তিনটি বুলেট আছে। তাই সে তাড়াতাড়ি পিছু ফিরে তূর্যকে নিয়ে পিলারের পেছনে চলে গেল। তূর্য শক্ত করে নিজের হাতটা ধরে রেখেছে। আহনাফ তার ফোন বের করে আরাফকে মেসেজ দিয়ে তাড়াতাড়ি সব জানালো। আরাফ ফোন হাতে নিয়ে আহনাফের মেসেজ দেখে চমকে উঠলো। উপরের মেসেজটার দিকে মিনিট খানিক তাকিয়ে সে ইভান আর ইমনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তাহমিদ যেতে চাইলে ওকে অরুণিকা আর উপমার খেয়াল রাখতে বললো। অরুণিকা আরাফকে এভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে তাহমিদের হাত ধরে বলল,
“ওরা এভাবে কোথায় যাচ্ছে? ওদের কিছু হয়ে গেলে? আমার খুব ভয় লাগছে, তাহমিদ!”

তাহমিদ অরুণিকার মাথায় হাত রেখে বলল,
“চিন্তা করো না। ওরা ফিরে আসবে।”

এদিকে আহনাফ তূর্যকে আড়াল করে পিলারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। শত প্রশিক্ষণ নিলেও এভাবে বাস্তবেই কারো উপর গুলি চালাতে হবে, এর জন্য এই মুহূর্তে তার প্রস্তুতি নেই। তার গুলিতে যদি কারো মৃত্যু হয়, হোক সে খুনী বা ভাড়া করা গুন্ডা, তাহলে সে কিভাবে এই অপরাধবোধ থেকে নিজেকে বের করবে, এখন সে সেটাই ভাবছে। তূর্য আহনাফের চেহারা দেখেই বুঝতে পারল, সে এই মুহূর্তে কি ভাবছে। তাই সে নিজের গুলিবিদ্ধ হাতটা দেখিয়ে বলল,
“আমার শরীরে এতো রক্ত নেই। তাড়াতাড়ি এখান থেকে বের হ। নয়তো আমি এখানেই মারা যাবো। মনে রাখিস, এরা আমাদের পরিবারের কাউকে ছাড়ে নি। দুই বছরের দিশান, তাহমিদের প্যারালাইজড দাদি, তোর প্র‍্যাগনেন্ট চাচী কাউকেই ছাড়ে নি। তাহলে তুই ওদের উপর এতো দয়া দেখাচ্ছিস কেন? হত্যার বদলে হত্যা। এটাই ন্যায় বিচার। তারা আমাদের পরিবারকে এমন ভাবে হত্যা করেছে যে লাশ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় নি।”

“কিছুক্ষণ আগেই তুই বললি, শারীরিক শক্তি দিয়ে এট্যাক কর‍তে।”

“হ্যাঁ, কিন্তু এখন ওরা তো আমাদের উপর সোজাসুজি এট্যাক করছে।”

আহনাফের এবার রক্ত গরম হয়ে উঠলো। সে হুট করে পিলারের পেছন থেকে বেরিয়ে পিস্তল তাক করলো উপরের সিঁড়িতে। উপরে কেউ নেই৷ সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। তিনতলায় উঠতেই তার দিকে গুলি ছোঁড়া হলো। সে নিজেকে দেওয়ালের পেছনে আড়াল করে আত্মরক্ষা করল। এখন শুধু ওদের বুলেটগুলো শেষ কর‍তে হবে। তাই সে কিছুক্ষণ পর পর নিজেকে সামনে এনে আড়াল করছে। এরই মধ্যে সে ভেতরে নিজেকে আড়াল করার মতো পিলার খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোনোভাবেই আহনাফ ভেতরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না।
সে জোরে শ্বাস নিয়ে আস্তে করে ছাড়লো। সেই মুহূর্তেই তার মনে পড়ে গেলো তার মায়ের হাসি মাখা মুখটা, দিশান আর অরুণিকার করা দুষ্টু-মিষ্টি আবদারের কথা, বিকেলে মৈত্রী ম্যানশনের বাইরে বসে বড়দের চায়ের আড্ডা, আর অরুণিকার সেই চার বছর বয়সে করা প্রশ্ন,
“বাবা কোথায়? বাবা কখন আসবে? আমি মায়ের কাছে যাবো। মাকে ফোন করে আসতে বলো।”

আহনাফের চোখ ছলছল করে উঠলো। তার পুরো শরীর রাগে কাঁপতে লাগলো। এবার সে আর থামলো না। পিস্তল তাক করেই সামনে এগুতে লাগলো। প্রথম বুলেট, দ্বিতীয় বুলেট দু’টোই দেয়ালে এসে বিদ্ধ হয়েছে। তবে তৃতীয়টি সোজা এসে ঠেকেছে অপর পাশে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির উপর। আহনাফ এবার নিজেকে পিলারের পেছনে আড়াল করে অসহায় চোখে পিস্তলের দিকে তাকিয়ে রইলো। এদের সাথে এট্যাক করার জন্য এই মুহূর্তে শারীরিক শক্তিটাই প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু যেখানে অপর পক্ষ বন্দুকধারী, সেখানে তার শারীরিক বল দেখানো মোটেও ফলপ্রসূ হবে না।
এদিকে লোক দুইটার মধ্যে অন্যটি বন্দুক হাতে সামনে আগাতেই সিঁড়ি বেয়ে উঠে ঠা ঠা করে বুলেট ছুঁড়তে লাগলো ইভান আর ইমন। লোকটার বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে গেলো। পিস্তলে আবার বুলেট ঢুকিয়ে সামনে এগিয়ে পিলারের পেছনে আড়াল করে রাখা আরেকটা লোকের দিকে এগিয়ে গেলো ইমন। ইমনের চোখ লাল হয়ে গেছে। পানিগুলো চোখে চিকচিক করছে। সে লোকটার বুকে খুব জোরে লাথি মারতেই দেখলো সামনের মেঝেতে রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। ইভান লোকটাকে ইচ্ছেমতো ঘুষি মারতে লাগলো। আহনাফও এবার এগিয়ে এসে সমানে লোকটাকে মারছে। আর ইমন সেই রক্তের স্রোতের সূত্রপাত দেখতেই সামনে এগিয়ে গিয়ে থমকে গেলো। তার হাত থেকে পিস্তলটাই পড়ে গেলো। তার পুরো শরীরটা রিনরিনিয়ে উঠলো।
আদিলের গলা বেয়ে গলগল করে রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। ইমন আর আগানোর সাহস পেলো না। সেখানেই সে ধপ করে বসে পড়লো। ইভান আর আহনাফও লোকটাকে মেরে হাঁটার অনুপযোগী করে ফেলেছে। তারা ইমনের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে সামনে এগিয়েই দেখলো আদিলের গলা কাঁটা নিথর শরীর মেঝেতে পড়ে আছে। ইভান পেছন ফিরে সেই লোকটার চুল টেনে ধরে বলল,
“কে মেরেছে আদিল ভাইয়াকে?”

লোকটা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি মারি নি। বস মেরেছে।”

“কে তোমাদের বস?”

“আমাকে ছেড়ে দিন, স্যার। আমি সত্যটা বলবো।”

“ছেড়ে দেবো। আগে বলো কে মেরেছে?”

“শাহবাজ খান।”

ইভান নামটা শুনেই লোকটার মাথায় গুলিবিদ্ধ করলো। আর ইমনকে টেনে ধরে নিচে নামালো। এদিকে আরাফ তূর্যকে গাড়িতে বসিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছে। ইভান আর আহনাফকে নামতে দেখে সে বলল,
“কি হয়েছে? কোনো খবর পেয়েছিস?”

আহনাফ বলল,
“আদিল ভাইয়াকে মেরে ফেলেছে ওরা।”

তূর্য এই কথা শুনে থম মেরে রইলো। আরাফের কান দিয়ে যেন গরম কিছু প্রবেশ করানো হয়েছে। সে মুহূর্তেই থমকে গেলো। ইমন কাঁপা কন্ঠে বলল,
“উনি আমাদের জন্য খুন হয়েছেন? কি করবো এখন আমরা? উপমা আর ওর বাবা-মাকে কিভাবে ফেইস করবো এখন?”

ইভান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আর এসব করেছে ওই শাহবাজ খান। উনার লোকই উনার নাম বলে দিয়েছে। ওই লোকটাকে এখন মরতেই হবে। আই উইল কিল হিম।”

১০০.

মুরশিদ জুবাইয়েরের সহযোগিতায় কোনো টানাহেঁচড়া ছাড়াই আদিলের লাশটা দাফন করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে আরো দুইটা লাশ পাওয়া গিয়েছে, আর তারা তূর্য আর ইভানের পিস্তল থেকে চালানো গুলিতেই মারা গেছে। তবুও তাদের উপর কোনো মামলা হয় নি। বরং এই লোক দুইটা যে ভাড়া করা আসামী, তার প্রমাণ দিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এলেন মুরশিদ জুবাইয়ের৷ তবে আদিলের খুনের জন্য উপমার বাবা-মা ছ’জনকেই দোষারোপ করে যাচ্ছেন।
এদিকে উপমা পাথরের মতো ভাইয়ের রক্তাক্ত জামাকাপড় হাতে নিয়ে বসে আছে। মিসেস জুলেখা পুরো ঘরে দৌঁড়ে দৌঁড়ে ছেলেকে খুঁজছেন আর পাগলামো করছেন। তাদের এলাকার সবাই জেনে গেছে তারা মৈত্রীদের সাথে আত্মীয়তা করেছে। প্রতিবেশীরাও কানাঘুঁষা করে বলছে,
“একেই বলে বেশি প্রভাবশালীদের ঘরে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার নমুনা।”

মিসেস জুলেখা এসব শুনে উপমাকে ইচ্ছেমতো চড় মারলেন আর বললেন,
“তোর জেদের জন্য আমার ছেলে আজ বলির পাঁঠা হয়েছে। আমার ছেলেকে মেরে দিয়েছে ওরা।”

উপমার বাবা থানায় গিয়ে তূর্য ও তার বন্ধুদের নামে মামলা করতে গেলেন৷ কিন্তু ক্ষমতার কাছে একজন বাবার পরাজয় হলো। মুরশিদ জুবাইয়ের জানতেন আবেগী হয়ে উপমার বাবা-মা ছ’জনের নামেই মামলা করতে যাবেন। কিন্তু তারা তো নির্দোষ। তবে এই মুহূর্তে ছেলেহারা বাবা-মা এই সত্যটা বুঝতে চাইবেন না। তাই আগে থেকেই তিনি তার সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে পুরো প্রশাসনকে নিজের দিকে করে ফেললেন। আর থানায় উপমার বাবার দেওয়া অভিযোগটাও আর গ্রহণ করা হলো না।

এদিকে ইমন মাওশিয়াতকে ফোন করে বলল,
“মাও, তোমাকে আরো অপেক্ষা করতে হবে। আদিল ভাইয়ার খুন হয়েছে।”

মাওশিয়াত ধপ করে চেয়ারে বসে বলল, “কিভাবে?”

ইমন সবকিছুই মাওশিয়াতকে খুলে বলল। সব শুনে মাওশিয়াত কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
“প্লিজ, এসব ছেড়ে দাও। আল্লাহ সেই খুনীদের শাস্তি দেবেন। তোমরা এসবে আর জড়াতে যেও না। তোমরা সবাই কলকাতায় চলে আসো। আমরা এখানেই ভালো থাকবো। এখানের সিটিজেনশিপ নিয়ে নিলে আর কিছু হবে না।”

ইমন বলল,
“এখন তো জবাব না দিয়ে আর সরে আসতে পারবো না। এতোদিন আমাদের আমানতের জন্য এতোদূর এসেছি। এখন অন্যের আমানতের জন্য লড়াই করবো। এখন আর পিছু হটার সময় নেই। আপতত বিয়ের তারিখ পেছাতে হবে। দুই মাস পর সব চিন্তাভাবনা করবো।”

“বিয়ে নিয়ে আমার হুড়োহুড়ি নেই। আমি জানি দিনশেষে তুমি আমারই থাকবে। কিন্তু তোমাকে নিয়েই আমার চিন্তা। স্পেশালি অরুণিকাকে নিয়ে। ওকে কলকাতায় পাঠিয়ে দাও। আমার সাথে থাকুক। ওখানে যদি ওর কোনো বিপদ হয়।”

“একসাথে বেঁচে ফিরেছি, একসাথে বেড়ে উঠেছি। মরলেও একসাথেই মরবো। যতোক্ষণ বেঁচে থাকবো, জুবাইয়ের আংকেলের আমানতের হেফাজত করবো। অরুণিকার কিছু হবে না। আমরা ছ’জন ওর জন্য যথেষ্ট।”

এদিকে তূর্য উপমার পাশে এসে বসলো। উপমা মলিন মুখে দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে। তূর্য তার হাতটি উপমার হাতের উপর রাখতেই উপমা এক ঝটকায় সেই হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“দূরে সরে যাও আমার কাছ থেকে। তোমার জন্য আমার ভাইয়ের খুন হয়েছে। তুমি আমার ভাইয়ের আসামী। যাও এখান থেকে।”

উপমার মুখ থেকে ‘তুমি’ ডাক শুনে তূর্য বুঝতে পারলো, তাদের সম্পর্কে অনেক বড় পরিবর্তন এসে গেছে। বিয়ের পর থেকেই উপমা তাকে আপনি করে ডেকেছে, আর আজ প্রথম তাকে তুমি করে ডাকছে। তূর্য বলল,
“ভাইয়ার সাথে যা হয়েছে, তার জন্য আমি খুব গিল্টি ফিল করছি। আর যে খুন করেছে, তাকে আমরা ছাড়বো না। তাকে আমরা শাস্তি দেবো।”

উপমা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“এতো বছরে নিজের বাবা-মার খুনীদের শাস্তি দিতে পারছো না, আর আমার ভাইয়ের খুনের শাস্তি দেবে? আমার ভাইয়ের খুনের? হাসালে আমাকে, তূর্য। আমি তোমার কে, হ্যাঁ? আমি এতো বছর তোমার রক্ষিতা হয়েই আছি। যাকে তুমি শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্যই ব্যবহার করেছো শুধু। তোমার কাছ থেকে এতোটুকু পরিমাণ ভালোবাসা আমি পাই নি।”

তূর্য উপমার হাত ধরে বলল,
“ছি! কি বলছো তুমি এসব। তুমি আমার ওয়াইফ। তুমি এমন বাজে শব্দ কিভাবে নিজের জন্য ব্যবহার করছো?”

“আমি তোমার ওয়াইফ, এটা শুধু তোমার রাতেই মনে আসে, তাই না?”

তূর্য উপমার হাতটা নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে বলল,
“আল্লাহর ওয়াস্তে তুমি এসব কথা বন্ধ করো। আমি অনেক খারাপ, তবুও নিজেকে নিয়ে এমন কথা বলো না। তুমি আমার কাছে অনেক সম্মানের। প্লিজ উপমা, এমন কথা আর বলো না।”

উপমা তূর্যকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। তূর্য তার হাতের ক্ষতস্থান চেপে ধরে কুঁকড়ে উঠলো। উপমা একনজর তূর্যের দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর উপমার বাবা এসে তূর্যের হাত ধরে তাকে টেনে বাইরে নিয়ে গেলেন। আর বললেন,
“আমার ছেলে মারা গেছে, এখনো চারদিনও হয় নি। এখন আমরা আমাদের দ্বিতীয় সন্তানকে হারাতে চাই না। আমাদের এই দুইটাই সম্পদ ছিল। তোমরা একটা কেঁড়ে নিয়েছো। এখন আর একটাই আছে। তাকে মুক্তি দাও। তাকে অন্তত বাঁচতে দাও।”

তূর্য কাঁপা কন্ঠে বলল,
“বাবা, আমি উপমার খেয়াল রাখবো, আমি থাকতে….”

তূর্যকে থামিয়ে দিয়ে করিম সিদ্দিক বললেন,
“আমি তোমার বাবা নই। আর উপমার খেয়াল রাখার জন্য ওর বাবা-মা বেঁচে আছে। তুমি আমার মেয়েকে মুক্তি দাও। এই সম্পর্কটা এখানেই শেষ হোক।”

“ও আমার ওয়াইফ। আমি ওর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারবো না।”

মিসেস জুলেখা আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বললেন,
“আমি উপমার মা। আমি জানি, তোমাদের সম্পর্ক কতোটুকু সুস্থ, আর কতোটুকু অসুস্থ। তাই এই সম্পর্ক বিচ্ছেদে তোমার এতো আফসোস হওয়ার কথা না।”

তূর্য মিসেস জুলেখার কথা শুনে কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা উপমার দিকে তাকালো। তূর্য তার দিকে এগুতে গেলেই সে দৌঁড়ে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভেতর থেকে বলল,
“আমি আমার বাবা-মার সাথেই থাকবো। আপনি আমাকে তালাক দিয়ে দিন। আমি আর আপনার সাথে ওই বাড়িতে থাকতে পারবো না।”

তূর্য বন্ধ দরজায় হাত দিয়ে বলল,
“সরি, উপমা। আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও। আমি সব ঠিক করে দেবো। প্লিজ, এমন কথা বলো না। আমি তোমাকে ছাড়তে চাই না।”

করিম সিদ্দিক তূর্যকে টেনে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বললেন,
“তোমাদের অনেক ক্ষমতা আছে। হয়তো আমার মেয়েকেও ঝুলিয়ে রাখবে। সমস্যা নেই। আমাদের কাবিনের টাকার প্রতি কোনো লোভ নেই। উপমা নিজেই তোমার কাছ থেকে তালাক নেবে। খুব শীঘ্রই তুমি কাগজ পেয়ে যাবে।”

তূর্য হাত জোড় করে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“বাবা, আমাকে একটু সুযোগ দিন। আমার তো বাবা-মা নেই। আপনাদেরই আমি বাবা-মার জায়গা দিয়েছি। প্লিজ, আমার সাথে এমনটা করবেন না। আমি উপমাকে ভালো রাখবো। আমাকে প্লিজ আরেকটা শেষ সুযোগ দিন।”

করিম সিদ্দিক তূর্যের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন। আর তূর্য বসা থেকে উঠে ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল। অন্যদিকে উপমা তার রুমে লাগিয়ে রাখা তূর্যের ছবিগুলো একে একে নামাতে লাগলো। সে শব্দ করে কাঁদছে। রুমের বাইরে থেকে মিসেস জুলেখা মেয়ের কান্না শুনে মেঝেতে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন, আর বললেন,
“আমার সাজানো-গোছানো সংসারটা শেষ হয়ে গেছে। আমাদের আদিল আমাদের ফেলে চলে গেছে। ও তো উপমাকে সবসময় সাহস দিতো, প্রেরণা দিতো। এখন আমার মেয়েটাকে কে দেখবে?”

এদিকে নিয়াজ হোসেন রিয়াজুর রহমানের রুমে এসে বললেন,
“ভাই, ওই মেয়ের সব তথ্য পেয়েছি।”

রিয়াজুর রহমান মুচকি হেসে বললেন,
“কি নাম তার!”

“উপমা করিম।”

“খুব সুন্দর নাম।”

“আরেকটা খবর আছে।”

“হুম, বল।”

“উপমা তূর্য আহমেদের স্ত্রী।”

রিয়াজুর রহমান ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“তূর্যটা কে!”

“মৈত্রীদের সন্তান। হাকিম আহমেদের ছেলে।”

রিয়াজুর রহমান থমকে গেলেন। নিয়াজ হোসেন আবার বললেন,
“উপমা করিমের বড় ভাই আদিল সিদ্দিকের খুন হয়েছে দুই দিন আগে। ধারণা করা হচ্ছে মৈত্রীদের শত্রুই এই খুনের সাথে জড়িত ছিল।”

“আমি যতোদূর জানি মৈত্রীদের তো শত্রুর অভাব নেই। তাহলে এই কাজ কারা করেছে? আর কেনই বা করেছে?”

“আদিল খুনীদের ব্যাপারে কিছু তথ্য পেয়েছিল। লাস্ট কল রেকর্ডে এটাই পাওয়া গেছে। আর মুরশিদ জুবাইয়ের এই মামলায় তাদের সাহায্য করছেন।”

রিয়াজুর রহমান হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“আমার গাড়িটা গ্যারেজ থেকে বের কর। মিসেস উপমা করিমের বাসায় আজ আমার বিনা নিমন্ত্রণে আগমন হবে। আর আজকের রাতের খাবারটা আমার পক্ষ থেকে যাবে।”

চলবে—-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here