অরুণিকা #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||বোনাস পর্ব||

0
1134

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

১০১.
রুম বন্ধ করে বসে আছে তূর্য৷ উপমা ছাড়া ঘরটা শূণ্য শূণ্য লাগছে। এই ঘরের প্রতিটি দেওয়ালের ফাঁকে ফাঁকে উপমার দীর্ঘশ্বাস আটকে আছে। তূর্য প্রতিবারই বলেছে সে উপমাকে ভালোবাসে। কিন্তু তার কাজে ভালোবাসার কোনো লক্ষণই ছিল না। তবে আজ তূর্য উপমাকে অনুভব করছে। সে বুঝতে পারছে নিরবে এতোদিন তার পাশে থাকা মানুষটিকে ছাড়া সে কতোটা অসহায়। বাড়ির সবাই নির্জীব হয়ে বসে আছে। অরুণিকা নিজেই রান্নাঘরে গেলো দুপুরের রান্না-বান্না করার জন্য। আহনাফও তার পিছু পিছু গেলো। অরুণিকা চুপচাপ রান্নার কাজ করছে। আহনাফ তার হাত ধরে বলল,
“কথা বলছো না কেন?”

অরুণিকা মলিন মুখে বললো,
“ভাবী চলে যাওয়ার পর থেকে আমার এই ঘরে মন বসছে না।”

“কেন? আমরা তো আছি।”

“ভালো লাগছে না, আহনাফ। সত্যিই ভালো লাগছে না। কেউ এভাবে আদিল ভাইয়াকে এসে মেরে দিলো?”

“অরু, যা হওয়ার তাতো হয়েই গেছে। এখন আমাদের উচিত উপমাকে সান্ত্বনা দেওয়া। আর তুমি ওকে ফোন করে বুঝিয়ে বলো। তূর্যকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না।”

অরুণিকা “হুম” বলে রান্নায় মনোযোগ দিলো। রান্না শেষ হলে অরুণিকা তূর্যকে ডাকার জন্য উপরে গেলো। দরজা খুলেই দেখলো তূর্য উপমার হাতের চুড়ি নিয়ে বিছানায় বসে আছে। অরুণিকা ভেতরে গিয়ে তূর্যের পাশে বসলো। তূর্য অরুণিকার দিকে মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“টুইংকেল, ও কি আর ফিরে আসবে না? আমি কি ওকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি?”

অরুণিকা কিছু বলার আগেই তূর্য ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আর অরুণিকার কোলে মাথা রাখলো। অরুণিকা তূর্যের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“রকস্টার, তুমি এভাবে কাঁদছো কেন? আমি আমার সুইট স্টার ভাবীকে ফোন দেবো। আহনাফ তো আমাকে ভাবীর বাসায় নিয়ে যাবে বলেছে। দেখো, আমি গিয়েই ভাবীকে সাথে করে নিয়ে আসবো।”

তূর্য অরুণিকার হাত আঁকড়ে ধরে ভেজা কণ্ঠে বলল,
“তুমি আগে বলো, আমি কি বেশি খারাপ?”

“উহুম। কে বলেছে তুমি খারাপ?”

“সবাই তো বলে। আমিও তো জানি। উপমাকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি। কতো মেয়ের সাথে যোগাযোগ রেখেছি।”

“আহনাফের যদি এতো এতো মেয়ের সাথে যোগাযোগ থাকতো, তখন কি তুমি আমায় ওর সাথে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করতে পারতে?”

“পারাপারি পরে হতো। আগে ওর নাক ফাটিয়ে দিতাম।”

“তো, উপমা ভাবীর মাও এসব বুঝতে পেরেছে। তোমাকে নাকি কোন মেয়ের সাথে রিক্সায় দেখলো। অনেককিছুই তো শুনেছি আমি। তুমিই যে রিকি দা স্টার, এটা তো এখনো সবাই জানে না। তুমি বরং সবাইকে এই সত্যটা জানাও। আর ভাবীকে তোমার স্ত্রী হিসেবে পুরো মিডিয়ার সামনে পরিচয় করিয়ে দাও। দেখবে, ভাবী অনেক খুশি হবে।”

“টুইংকেল, এরপর কি ও সত্যিই আমার কাছে ফিরে আসবে?”

“ভাবী তোমাকে অনেক ভালোবাসে৷ তাহমিদ যেভাবে শতু আপুকে ভালোবাসে, আরাফ যেভাবে সায়ন্তনী আপুকে ভালোবাসে, তার চেয়েও বেশি ভাবী তোমাকে ভালোবাসে। সারাদিন ভাবী তোমার কথা বলতো। তোমার জন্য কতো মজার মজার নাস্তা বানাতো। তুমি আসার আগে সুন্দর করে সাজতো। কিন্তু তুমি কখনোই ভাবীর দিকে মনোযোগ দাও নি। সারাদিন নিজের কাজেই ব্যস্ত ছিলে। ভাবী কতো সুন্দর! অথচ তুমি কিনা ওই মেয়েগুলোকে সময় দাও, যারা দেখতেও সুন্দর না, যাদের মনটাও নোংরা।”

আহনাফ তূর্যের ঘরের সামনে এসে ভ্রূ কুঁচকে তূর্য আর অরুণিকার দিকে তাকালো। তূর্য এভাবে অরুণিকার কোলে মাথা রেখেছে, বিষয়টা আহনাফের হজম হলো না। সে রুমে এসেই তূর্যকে টেনে উঠিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“চল, উপমাকে আনতে যাই। তুই ওর পছন্দের কিছু কিনে নিয়ে আয়। আর ইমনকে সাথে নিয়ে যা। ও ফ্রি আছে।”

এই কথা বলে আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“চলো, চলো টেবিলে খাবার সাজাতে হবে। আমি এসব একা একা করবো নাকি?”

এদিকে তূর্য এসে ইভানের পাশে বসলো। অনেকদিন ইভান আর তূর্য একে অপরের সাথে কথা বলে নি। উপমার ব্যাপার নিয়ে তাদের একটা ঝগড়া বেঁধেছিল। আহনাফ আর আরাফ মিলে তাদের মধ্যে সব ঠিক করিয়ে দিলেও ইভান তূর্যের সাথে কথাবার্তা কমিয়ে দিয়েছিল। তবে আজ নিজ থেকেই ইভান তূর্যের হাত ধরে বলল,
“ব্যথা কমেছে?”

তূর্য মাথা নাড়িয়ে বলল,
“না, হাত নাড়াতে পারছি না। ভীষণ ব্যথা।”

ইভান তূর্যের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আমরা উপমাকে ফিরিয়ে আনবো। মন খারাপ করিস না।”

তূর্য মলিন মুখে বললো,
“আমি তোর সাথে অনেক বাজে ব্যবহার করেছিলাম। দোষটা আসলে আমার ছিল। একটা মানুষ সবার চোখে একসাথে খারাপ হতে পারে না। নিশ্চয় তার মধ্যে সমস্যা আছে, তাই সবাই তাকে খারাপ ভাবছে। আমি অন্যায় করেছি। ইভান, তুই আমাকে মাফ করে দে।”

ইভান তূর্যের কাঁধে হাত রেখে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“বন্ধু, তোর উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই। দিনশেষে আমরাই নিজেদের জন্য আছি।”

এদিকে অরুণিকা টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়ে বলল,
“আর আমি তোমাদের জন্য আছি৷ মা, মেয়ে, বোন, শাশুড়ি যেকোনো পরিস্থিতিতে আমি নিজেকে তোমাদের জন্য তৈরী করবো।”

ইমন হেসে বলল,
“শুধু বউটা তুমি আহনাফেরই থাকবে।”

আহনাফ মুচকি হেসে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি এখনো ওকে বিয়ে করি নি। তাই আপতত আমি কারো বউ না।”

অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে আহনাফের হাতে চিমটে দিয়ে বলল,
“আমি তোমার বউ না, মনে থাকে যেন।”

আহনাফ হাত ঢলতে ঢলতে বলল,
“এটা কি চিমটে দিয়ে বলতে হয়?”

“হ্যাঁ, মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছি। সেট করে নাও। এমনি বললে তো মনে থাকবে না। তাই বাইরে থেকে প্রভাবক দিচ্ছি চিমটে দিয়ে।”

সন্ধ্যায় আরাফ আর আহনাফ ছাদে এসে বসলো। তাদের মৌনতা আদিলের আকস্মিক মৃত্যুকে ঘিরে। আহনাফ নীরবতা ভেঙে বলল,
“একটা জিনিস খেয়াল করেছিস?”

আরাফ আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ বলল,
“আদিল ভাইয়ার সাথে ইমানের অনেক ভালোই সম্পর্ক। অথচ ভাইয়ার মৃত্যুর পর থেকে ওর অদ্ভুত ব্যবহার আমার চোখে পড়ছে। তোদের চোখে পড়েছে কিনা জানি না। কিন্তু ইমান খুবই সন্দেহজনক আচরণ করছে। আর সেদিন আদিল ভাইয়ার সাথে তো ওরও থাকার কথা ছিল, কারণ ওই তো ভাইয়ার সাথে কাজ করছে।”

আরাফ চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“সেটাই তো। কিন্তু এখন তো আমরা জেনেই গেছি আসল খুনি কে!”

“নাহ, আরাফ। খুনি এতো সহজে আমাদের সামনে আসে নি। শাহবাজ খানকে কেউ ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।”

“কি বলতে চাইছিস তুই!”

“ভালোভাবে চিন্তা করে দেখ। শুরু থেকে যদি আমরা ক্যালকুলেশন করি, তাহলে বুঝবো আমাদের গ্যাপটা কোথায়! রহমতুল্লাহকে আমরা সন্দেহ করেছি। তিনি আমাদের বলেছেন রিয়াজুর রহমান খুনিদের সাহায্য করেছেন। মিডিয়ার লোকেরা মির্জা গ্রুপকে সন্দেহ করেছে আর শাহবাজ খানের সাথে শাহেদ মির্জার ভালোই যোগাযোগ ছিল, এখনও আছে, তাই তাকেও সন্দেহ করা হচ্ছে। মুরশিদ জুবাইয়েরকে আমরা প্রথমে সন্দেহ করেছি, কিন্তু উনার সব কথা শুনার পর মনে হচ্ছে রহমতুল্লাহ আমাদের সাথে অনেক বড় মাইন্ড গেইমস খেলেছে। সবকিছু ঘুরেফিরে একটা জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছে, আর তা হলো, আমরা ধোঁকা খেয়েছি। আদিল ভাইয়াই এই কথাটা বলেছে। যেখানে আমরা মির্জাদের সন্দেহ করছি, শাহবাজ খানকে সন্দেহ করছি, সেখানে ধোঁকা খাওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। ধোঁকা কাদের থেকে খাওয়া যায়? যাদের আমরা বিশ্বাস করছি, তাদের থেকেই তো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা বিশ্বাস কাদের করছি? আদিল ভাইয়ার কথামতে, আমাদের বিশ্বস্ত কেউই আমাদের সাথে প্রতারণা করছে।”

আরাফ চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“কিন্তু আমরা ছ’জন তো নিজেদের ছাড়া কাউকেই বিশ্বাস করছি না।”

“করছি। ইমানকে বিশ্বাস করছি। এই মুহূর্তে ইমানকে আমার সন্দেহ হচ্ছে। আর ভাইয়ার মৃত্যুর পর থেকেই ও কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করছে। ওদিন ভাইয়া কি ওর কথায় বলতে চেয়েছিল?”

“না, ইমান হবে না। ইমান হলে উনি নামটা নিয়েই নিতো। উনি তূর্যকে কারো নাম বলে নি। তার মানে উনি লোকটাকে চেনে, অথচ নাম জানে না। নাম জানে না তাই নামটা সাথে সাথেই নিতে পারে নি৷”

“আর যাই বলিস, তোকে যখন মেসেজ দিয়েছিলাম, সাথে সাথেই বেরিয়ে যেতে পারতি। আমরা অনেকক্ষণ নিজেদের আড়ালে রেখেছিলাম। ততোক্ষণে হয়তো ওই বিল্ডিংয়ে কোনো প্রমাণ থাকলে তা সরিয়ে ফেলেছে।”

“তোর মেসেজ দেখেই আমি বাকিদের বলে বের হয়েছি।”

“তাহলে তোদের আসতে এতো সময় লেগেছে কেন?”

“কি বলছিস তুই? সাথে সাথেই তো বের হয়েছি। আমরা তো তোদের দু’জনকে পুরো ঘরে খুঁজছিলাম। উপমা তো বলেই নি তোরা কোথায় গিয়েছিস। অনেকক্ষণ পর বললো তূর্য পিস্তল নিয়ে বেরিয়েছে। এরপর ফোন দিতে যাবো, দেখলাম তোর মেসেজ।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আরাফ, আমি গাড়িতে উঠার পাঁচমিনিটের মধ্যে তোকে মেসেজ দিয়েছিলাম। আর সাথে সাথেই তুই মেসেজ সিন করে ফেলেছিস।”

আরাফ ফোন বের করে আহনাফের সামনে দেখলো, আহনাফের আগের মেসেজটা আরো অনেক সময়ের ব্যবধানে এসেছিল। আরাফ বলল,
“কিন্তু আমি শেষ মেসেজটাই দেখেছি। আগেরটা আমার ওই সময়ই চোখে পড়েছিল। ভেবেছি ওইসময়ই মেসেজটা দিয়েছিলি।”

“আরাফ, আমি মেসেজ দেওয়ার সাথে সাথেই সিন হয়েছিল। আর তুই অনলাইনেই ছিলি।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“ওয়েট, তোর ফোনটা দে।”

আহনাফ আরাফের ফেইসবুকের সিকিউরিটি চেক করতে গিয়েই দেখলো, আরাফের ফেইসবুক একাউন্ট আরো চারটা ফোনে লগ ইন করা আছে। আহনাফ মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“তুই এই ফোন কাকে দিয়েছিস?”

“কাউকেই তো দেই নি।”

“তোর ফেইসবুক অন্য কোথাও লগ ইন কিভাবে, আরাফ! তুই এতো বড় ভুল কিভাবে করেছিস? তারমানে এতোদিন আমাদের সব প্ল্যান অন্য কেউ পেয়ে যাচ্ছিল। চেঞ্জ ইউর পাসওয়ার্ড, আরাফ। সব জায়গা থেকেই লগ আউট করবি।”

আরাফ পুরো ফেইসবুকে সিকিউরিটি দিয়ে তার সব সোশ্যাল একাউন্টেও সিকিউরিটি বসিয়ে দিলো। এবার আহনাফ নিচে এসে সবাইকে কথাটা জানাতেই একই সমস্যা তারা তাহমিদের ফোনেও খেয়াল করলো। আহনাফ সবার ফোন নিয়ে বলল,
“আমাদের কথাবার্তা, এখন খুনির কাছে পৌঁছে গেছে। আর শাহবাজ খান যদি সত্যিই খুনি হতো, তাহলে উনার লোককে ওখানে বসিয়ে রাখতো না। কারণ উনি জানে আমরা ওখানে যাচ্ছি। অনেক আগেই সব ক্লিয়ার করে নিতো। কেউ একজন ইচ্ছে করে উনার নাম উচ্চারণ করে আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্য ওই লোক দুইটাকে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। এটা ওদেরই প্ল্যান ছিল।”

ইমন গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“তাহলে এখানে দুইটা কনফিউশান আছে। হয়তো খুনি নিজেকে শাহবাজ খান হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। নয়তো শাহবাজ খান সত্যিই এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত আছে।”

তূর্য বলল,
“আর যাই বল, আহনাফের কথা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। ইমান খুনির ব্যাপারে কিছু তো একটা জেনেছে। কিছু একটা তো এখানে আছে। এখন এটাই আমাদের বের করতে হবে।”

কিছুদিন পর আরাফ, ইভান, আহনাফ আর অরুণিকা উপমাদের বাসায় গেলো। আরাফ উপমাকে অনেক অনুরোধ করলো, তাদের সাথে বাসায় ফিরে আসার জন্য। কিন্তু উপমা রাজি হলো না। সে তার বাবা-মাকে আর কষ্ট দিতে চায় না। উপমা ও তার পরিবারের ধারণা তূর্যকে বিয়ে করার ফলে আদিলের মৃত্যু হয়েছে। অরুণিকা উপমার হাত ধরে বলল,
“আমি রকস্টারকে আশা দিয়ে এসেছি যে আমি আমার সুইট স্টার ভাবীকে ফিরিয়ে আনবো। ও সারাদিন-রাত তোমার জন্য ছটফট করে। রকস্টার তোমাকে অনেক ভালোবাসে। সবার ভালোবাসা প্রকাশের ধরণ একই ধরণের হয় না। কেউ ভালোবাসে, তবুও মুখে আনে না। কেউ মুখে বললেও ভালোবাসা দেখায় না। আর কেউ ভালোবাসি না বলেও অনেক ভালোবাসা দিয়ে যায়। ভাবী, তোমার স্টার তোমাকে ছাড়া ভালো নেই।”

উপমা ছলছল চোখে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার বাবা-মা ভাইয়াকে হারিয়ে একদম একা হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে আমি ওই বাড়িতে থাকলে এরা শোকেই মারা যাবে। আমাকে এখানে থাকতে দাও। আমি তোমার রকস্টারকে এখনো ভালোবাসি। কিন্তু ভালোবাসলেই যে সংসার করতে হবে, এমন তো নয়। আমি একটা চাকরি খুঁজছি। আমার সময় কেটে যাবে। তোমার রকস্টার এখন স্বাধীন। ও এখন মুক্ত হাওয়ায় মেয়েদের সাথে উড়বে, ঘুরবে। ঘরে বউ আছে সেই চিন্তায় অস্থির হতে হবে না। অরুণিকা, ওই বাড়িতে একমাত্র তুমিই আমাকে বুঝো। আশা করবো, এখনও আমাকে বুঝবে। আমাকে আমার বাবা-মার সাথে থাকতে দাও।”

“কিন্তু আংকেল যে তালাকের কথা বললো।”

“বাবা রাগের মাথায় বলেছে, আর আমি অভিমান থেকে বলেছি। কিন্তু যদি তোমার রকস্টার দিয়ে দিতে চায়, আমি সাইন করে দেবো। তবে আমার পক্ষ থেকে কোনো লেটার যাবে না। আমি তাকে ছাড়তে পারবো না, অরুণিকা। মানুষটা আমার সাথে মিশে গেছে। তাকে নিয়ে ভাবতে, তাকে ভালোবাসতে আমার খুব ভালো লাগে। তাকে পাওয়া, না পাওয়া ভাগ্যের লিখন৷ আমি এভাবেই তাকে ভালোবেসেছিলাম। তাকে পাওয়ার চেয়ে, তাকে ভালোবাসাটাই আমার জেদ ছিল। এই জেদ আমি কখনোই হারাতে চাই না।”

“তুমি রকস্টারকে ছাড়া ভালো থাকবে?”

“হ্যাঁ, কিছু মানুষকে স্মৃতিতে রেখেও ভালো থাকা যায়।”

“তুমি তাহমিদ আর আরাফের মতো কঠিন মানুষ হয়ে গেছো। কিন্তু আমার রকস্টার অনেক নরম মনের মানুষ। ও কাঁদলে আমার ভালো লাগে না। ওর এতো ভুল ক্ষমা করেছো, এই বারও ক্ষমা করে দাও। এমনিতেই আদিল ভাইয়ার মৃত্যুতে ওরা সবাই অনেক দুশ্চিন্তায় আছে। এর মধ্যে তুমি রকস্টারকে ছেড়ে চলে এসেছো। ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।”

উপমা বসা থেকে উঠে বলল,
“আমি তোমার সাথে যাচ্ছি না, অরুণিকা। চলে যাও তুমি।”

অরুণিকা মন খারাপ করে বেরিয়ে গেলো।
তারা চারজন রাস্তায় হাঁটছে। ইভান আর আরাফ চুপ করে আছে। আহনাফ এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে আর গাড়ি খুঁজছে। হঠাৎ অরুণিকা আহনাফের হাত ধরে বলল,
“চলো না, একবার ওই বাড়িতে যাই।”

আরাফ আর ইভান অরুণিকার দিকে তাকালো। ইভান বলল,
“কোন বাড়িতে?”

“ওই পোড়া বাড়িতে।”

আরাফ বলল, “ওখানে হঠাৎ!”

“মা-বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। ওখানে গেলে হয়তো ভালো লাগবে।”

ইভান বলল,
“অরুণিকা, রাত নয়টা বাজছে। ওইদিকে তো কেউ থাকে না। ওইদিন ইমনের আক্দ উপলক্ষে আলাদা লাইটিং করা হয়েছিল। এখন ওই দিকটায় অন্ধকার।”

“মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে হাঁটবো। আর তোমরা থাকলে আমার ভয় লাগবে না।”

অরুণিকার অনুরোধে আরাফ আর আহনাফ সেখানে যেতে রাজি হলো। আর ইভান অনিচ্ছাসত্ত্বেও গেলো। মৈত্রী ম্যানশনে পৌঁছাতেই অরুণিকা বলল,
“আমার না মাঝে মাঝেই মনে পড়ে, সেদিন রাতে আগুন লেগেছিল এই বাড়িতে। বাবা আমাকে কোলে নিয়ে দৌঁড়াচ্ছিল। চাচিকে এক লোক মেরে দিয়েছিল। বাসার সবাই চেঁচামেচি করছিল। গুলির শব্দ হচ্ছিল। সবার মুখেই কালো মুখোশ। আমি কারো চেহারা দেখি নি। জানো, এসব বার বার আমার চোখের সামনে ভেসে আসে। কিন্তু সবকিছুই ঝাপসা। এতো পুরোনো কথা আমার মস্তিষ্কে গেঁথে আছে কেন জানো?”

আহনাফ জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“কারণ আমি সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলাম। জানো, বাবার সেই পুরোনো চাদরটা তাহমিদ আলমারিতে রেখে দিয়েছিল। সেটা দেখেই আমার সব মনে পড়ে যায়। আমি সারাদিন এসব নিয়েই ভাবি। তাহমিদকে কতোবার শুনিয়েছি। ও নিজেও আমাকে বার-বার এই ঘটনাগুলো শুনিয়েছে, তাই আমি কিছুই ভুলতে পারি নি। আচ্ছা, আজ সবাই যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে কি আমি তোমাদের এতো ভালবাসতে পারতাম, বলো?”

ইভান বলল,
“হয়তো তুমিও তখন আমাদের এতো প্রিয় হতে না।”

আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“এসব পুরোনো কথা ভুলে যাও।”

অরুণিকা বলল,
“এসবের কি কোনো শেষ নেই? আজ আদিল ভাইয়া মারা গেছে, কাল যদি তোমাদের কিছু হয়? একটা মানুষ কি দুইবার অনাথ হতে পারে, বলো? আমি তো তোমাদের হারালে আবার অনাথ হয়ে যাবো।”

আরাফ অরুণিকার মাথায় হাত রেখে বলল,
“অরু, এসব কথা কেন বলছো?”

“চলো না, আরাফ। আমরা আবার কলকাতায় ফিরে যাই। ওখানে আমরা কতো ভালো ছিলাম। ওখানের সবাই কতো ভালো ছিল। স্কুলের ফ্রেন্ডরা কতো ভালো ছিল। কোথাও যেতে ভয় লাগতো না। কিন্তু এখন ফোন আসলেও ভয় লাগে।”

আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“ফোন আসলে কেন ভয় লাগবে? কেউ কি তোমাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করছে?”

অরুণিকা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“না, এমনিতেই।”

তারা আবার পিছু ফিরলো। তারা মৈত্রী ম্যানশনের গলি দিয়ে বের হতে লাগলো। অরুণিকা একবার পেছন ফিরে তাকালো। মুহূর্তেই ভয়ে তার শরীর কেঁপে উঠল। সে শক্ত করে কারো হাত চেপে ধরলো। আহনাফ অরুণিকার হাতের স্পর্শ পেয়ে খুব অধিকার নিয়েই অরুণিকাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। বাকি পথ আহনাফের বাহুতেই নিজেকে আবদ্ধ রেখেছে সে। আহনাফের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস সে অনুভব করেছে। এই প্রথম সে কাউকে অনুভব করছে। অরুণিকা বুঝতে পারছে না, এই অনুভূতিটা এতো প্রশান্তির কেন!

দুই মাস পর ছ’জন অরুণিকার সাথে কলকাতায় পৌঁছালো। দু’দিনের মধ্যে ইমন আর মাওশিয়াতের বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলো। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাদের ফেরার আগের দিন তাহমিদ একাই তাদের পুরোনো মহল্লায় গেলো৷ মহল্লার গলিতে ঢুকতেই কেমন যেন তার হাত-পা কাঁপছিল। যাকে দেখার জন্য সে এই মহল্লায় যাচ্ছে, সে তো এখানে নেই। সে তো তার স্বামীর ঘরে থাকবে। এতোদিনে হয়তো কয়েক সন্তানের মা হয়ে গেছে। তবুও কেন তার হাত-পা কাঁপছে?
তাহমিদ মহল্লায় ঢুকেই তাদের পুরোনো বাড়িটির দিকে তাকালো। গ্রিলের ফাঁকে হাত দিতেই তার শতাব্দীর গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকাটা মনে পড়ে গেলো। আনমনেই হাসলো তাহমিদ। সামনের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে পা বাড়াতেই সে থমকে গেলো। বারান্দায় বসে থাকা মানুষটিকে দেখে তার শরীরের পুরো শক্তি যেন হারিয়ে গেলো। মুহূর্তেই সে দৌঁড়ে মানুষটির দিকে এগিয়ে গেলো। তার হাতটি আলতো স্পর্শ করে বলল,
“শতাব্দী!”

মিতু বালা পুরুষালী কন্ঠ শুনে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাহমিদকে দেখে তিনি ছলছল চোখে তাকিয়ে গলা ছেড়ে বললেন,
“কই তুমি? দেখো। কে এসেছে।”

মাস্টারমশাই বের হয়ে তাহমিদকে দেখে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলেন। শ্রীজা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে তাহমিদকে দেখে মুখে কাপড় গুঁজে কেঁদে উঠলো। তাহমিদ মাস্টারমশাইকে ছেড়ে আবার শতাব্দীর পাশে এসে বসলো। শতাব্দী ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে। এই চোখে অভিমান আর অভিযোগের পাহাড় জমেছে। তাহমিদ আজ সব বাঁধা ধুলোয় মিশিয়ে শতাব্দীর হাত আঁকড়ে ধরে শুধু সেই অভিযোগে ভরা চোখ দু’টির দিকে তাকিয়ে আছে।

চলবে—-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here